অষ্টম পরিচ্ছেদ
সুদীপ্ত প্রায় রেল-গেটের কাছে এসে পৌঁছতেই একটা ভক্সওয়াগন গাড়ির মুখোমুখি হলেন। ভয়ের কিছু ছিল না। সাধারণ নাগরিকের গাড়ি। কিন্তু চেনা মানুষ কেউ নেই গাড়িতে। এবং আশ্চর্য এই যে গাড়িটা তাদের আবাসিক এলাকার ভেতরেই ঢুকছে। তাকে দেখেই হয়ত হবে, গাড়িটা থেমে গেল। এক ভদ্রলোক গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শুধালেন—
‘তেইশ নম্বর বিল্ডিংটা কোনদিকে বলতে পারেন।’
তেইশ নম্বর? এরা তেইশ নম্বরে যাবে? কারা এরা? কার খোঁজে যাচ্ছেন?—প্রশ্ন তো এমনি অনেক কটি ছিল। এবং মনে হচ্ছে, প্রশ্নগুলি তাঁর ভয়াবহ একাকীত্বকে বিদ্ধ ক’রে বোমার ভেতরকার এক-একটি লৌহ-শলাকার মতো তার মনের প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে গেল। ভালোই তো হ’ল। এতে একাকীত্বের ভার এতক্ষণ কী ক’রে তিনি বহন ক’রে চলেছিলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে দুটো কথা বলে সুদীপ্ত যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। ভদ্রলোক যাচ্ছেন মৃধা সাহেবের খোঁজে।
‘হাঁ, ভালোই আছেন তিনি। গতকাল তিনি সপরিবারে ফরিদপুর যাবেন বলে বেরিয়ে গেছেন।’
‘না তা বলতে পারি নে। আপনি লঞ্চঘাটে খোঁজ নিলে বোধ হয় জানতে পারবেন। গতকাল যদি ফরিদপুরের কোন লঞ্চ ছেড়ে থাকে, নিশ্চয় তা হ’লে চ’লে গেছেন তারা। নইলে যেতে পারেন নি।………
‘হাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ওটা মৃধা সাহেবের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটের ঘটনা। তেইশ-এর এফ-এ সকলেই মারা গেছেন। মৃধা সাহেব থাকতেন তেইশ-এর ই-তে।……
‘জি, আল্লাহ্ বাঁচিয়েছেন। মৃধা সাহেবের বেঁচে যাওয়াটা একটা মিরাক্ল্।’
মৃধা সাহেবের মুখে তাঁর বাঁচার কাহিনী সুদীপ্তর মিরাকলই মনে হয়েছিল গতকাল। কিন্তু পরবর্তীকালে? অমন যে কত ঘটনার কথা কানে এসেছে যা বিশ্বের যাবতীয় মিরাক্ল্কে হার মানাবে। মৃধা সাহেবের স্ত্রী অনর্গল উর্দু বলতে পারেন। অতএব তাদের বেঁচে যাওয়ার একটা ক্ষীণ কার্যকারণ সূত্র সুদীপ্ত খুঁজে পেয়েছিলেন। উর্দুভাষীকে নয়, কেবল বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যার আদেশ ছিল টিক্কা খাঁর। সেই অবস্থায়, একটুও উর্দু জানে না—এমন বাঙালি হিন্দুর পক্ষে পাকিস্তানি জওয়ানদের কবল থেকে বেঁচে আসাটা কোন পর্যায়ে পড়ে?
জগন্নাথ হলের সেই ছাত্রটির কথাই ধরা যাক। পঁচিশের রাত দশটা থেকে সাতাশের বেলা দশটা পর্যন্ত ছেলেটি তাদের হলের পাশে স্যাভেজ রোডের সবচেয়ে উঁচু গাছটার উচ্চতম ডালে কাটিয়েছিল। এই ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে না কিছু সে খেয়েছে, না ঘুমিয়েছে। সাতাশ তারিখে গাছ থেকে নামবার সময় মাটির কাছাকাছি পৌঁছতেই সামনে পড়ে একটা মিলিটারি গাড়ি। যাচ্ছিল পুরোনো ঢাকার দিকে। তাকে গাছ থেকে নামতে দেখে ধরে ফেলে তারা, এবং গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। হায় হায়, ছত্রিশ ঘণ্টা এতো কষ্ট ক’রে নিজেকে সে বাঁচিয়েছিল কি শেষ পর্যন্ত এইভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাবার জন্য! এখন তাকে নিয়ে কি করবে এরা! কি করতে পারে। নিঃসন্দেহে কোথাও নামিয়ে এক্ষুণি মেরে ফেলবে। মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকে ছেলেটি হঠাৎ গাড়িটা একটা বাজারের মোড়ে এসে থেমে যায়। বাজার লুঠ হচ্ছে। তা দেখে গাড়ির চারটে জওয়ানের তখন মাথা ঠিক থাকার কথা নয়। লড়াই ক’রে তারা ঢাকা শহর জয় করেছে! সারা শহরের সকল সম্পদ এখন গণিমতের মাল। যেখানে যা পাও লুটে-পুটে নাও। কাফের বাঙালিদের দোকান-পাট লুট করা নেকির কাম। হুজুর টিক্কা ফতোয়া দিয়েছে। অতএব নেকি হাসিল করার কামে ঝাপিয়ে পড়ল জওয়ানেরা। ছেলেটি তখন খালি গাড়িতে বসে তার জওয়ান ভাইদের জন্য প্রতীক্ষা করবে নাকি! একদিকে নেমে এক ফাঁকে সে পালাল। কিন্তু এখানেই তার কাহিনী শেষ হয় নি। প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পর তার বেঁচে থাকার বৃত্তান্ত সুদীপ্ত শুনেছিলেন। কাহিনীটা সেকালের হলে একালের মানুষ তাকে বলত রীতিমত নভেল।
আরো তিনবার সে সামরিক জওয়ানদের কবলে পড়ে। দ্বিতীয়বার নদীতে নৌকায় নদী পার হবার সময় পাকিস্তানি বীরপুরুষেরা নৌকা লক্ষ্য ক’রে গুলি চালাতে শুরু করলে কিভাবে সে বেঁচেছিল? সে কি কম অলৌকিক? অধিকাংশই মারা গেল। কেউ গুলি খেয়ে, কেউ নদীর জলে খাবি খেয়ে। কিন্তু সে নিজে সাঁতার না শিখেও বাঁচল কিভাবে? গুলিতে ছিন্নভিন্ন নৌকার ভগ্নাংশ আশ্রয় ক’রে এক সময় ছেলেটি কুল পেয়েছিল। মৃত্যুর তীর থেকে এসে জীবনের কূলে ভিড়েছিল। এবং তারপর?
গ্রামাঞ্চলের একটি বাজার এলাকায় পুনরায় সে পাক-জওয়ানদের কবলে পড়েছিল। ইতিপূর্বে দু’বার বেঁচে এসেছে। না, এবার আর রক্ষা নেই। প্রাণের ভয়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। সেইখানে গিয়ে পাক-জওয়ানেরা পাকড়াও ক’রে তাদের—প্রায় বিশ-তিরিশ জন। আশ্চর্য, জওয়ানরা তাদের নিয়ে গিয়ে বাজার লুঠ করার হুকুম দিল। বাজার লুঠ ক’রে সকল মাল-মাত্তা মিলিটারি লরীতে তুলে দিতে হ’ল। তারপর তাদের উপর হুকুম হল-বাজারে আগুন ধরিয়ে দাও। যারা ইতস্তত করছিল বুটের লাথি খেয়ে তাদের আক্কেল হ’ল। প্রাণে বাঁচতে হলে ঐ কামই করতে হবে এখন। কিন্তু তবু কি প্রাণে বেঁচেছিল তারা? অন্ততঃ। একজন তো বেঁচেছিল। হাঁ, বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করার সাধ্য তোমাদের নেই। সেই কথাই যেন বলার জন্য বেঁচেছিল সেই জগন্নাথ হলের ছাত্রটি। তাদের সেই লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগের সকল ঘটনা মুভিক্যামেরায় ধ’রে নিয়েছিল পাকিস্তানিদের একজন। তারপর দিয়েছিল পুরস্কার। লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগের পুরস্কার স্বরূপ তাদেরকে খেতে দেওয়া হয়েছিল মেশিনগানের গুলি। কিন্তু হতভাগ্য ছাত্রটি তা খেতে পায় নি। তার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। অলৌকিক ভাবে ঠিক সেই মুহূর্তে সে ভূমিস্মাৎ হয়েছিল যখন গুলিবিদ্ধ হচ্ছিলেন তার পাশের এক মৌলভি সাহেব। মৌলভী, কিন্তু বাঙালি। অতএব সকলের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে তাকেও গুলি করা হয়েছিল। এবং থেকে গিয়েছিল তার অপকীর্তির সাক্ষ্য—জওয়ানদের মুভি ক্যামেরায়। ক্যামেরা সাক্ষ্য দেবে, জওয়ানদের অপরাধ ছিল না। তারা দুস্কৃতিকারীদের কবল থেকে দেশকে বাঁচানোর মহৎ উদ্দেশ্যে বাঙালি নিধন যজ্ঞে অবতীর্ণ হয়েছিল। হাঁ, শুধুই বাঙালি। বিহারি নয় কিন্তু। বিহারিরা খুব ভালো। এমন কি সে পকেটমার হলেও। তারা বঙ্গাল মুলুকে থাকলেও এই মুলুকের ভালো-মন্দ নিয়ে কোন কথা বলে না। তাদের কোনো অভিযোগ থাকলে তা আছে কেবল। এই নিমকহারাম কাফের বাঙালিদের বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানে থাকে সব সাচ্চা মুসলমান। তোমরা বিহারিগণও সাচ্চা মুসলমান আছ। অতএব মুসলমান হয়ে মুসলমানের বিরুদ্ধে তোমাদের কি আর অভিযোগ থাকবে। বস্তুতঃ কোন অভিযোগ ছিলও না। অতএব বিহারিরা খুব ভালো।
কয়েক ঘণ্টা পর ছেলেটি জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখে, মৃত মৌলভির লাশ তার বুকের উপর। তখনি উঠে পালাবার পথ খোঁজে সে। এবং সে পালাতে গিয়ে শেষ বারের মতো আবার একবার পাকিস্তানি জওয়ানদের খপ্পরে পড়ে। একটা বাসে চড়ে সে তখন যাচ্ছিল টাঙ্গাইলের দিকে। পথে এক জায়গায় বাস আটক ক’রে পাকিস্তানিরা সকল যাত্রীকে নামতে বলল বাস থেকে। তারপর তাদের উপর হুকুম হ’ল—
বাঙালি বিহারি আওর হিন্দু–তিন তিন আলাদা লাইন মে খাড়া হো যাও।
কিন্তু বিহারি যাত্রী বাসে একটিও ছিল না। সকলেই বাঙালি কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু। কিন্তু বাঙালি হিন্দু—এই দুটো ভাগে যাত্রীরা কি ভাবে নিজেদের বিভক্ত করবে সেটা কেউ বুঝতে না পেরে সকলেই একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। পাকিস্তানি জওয়ান এতে বিরক্ত হয়ে ভীষণ মুখ খিস্তি ক’রে সকলকে গাল দিল একবার। তারপর নল উঁচিয়ে এগিয়ে এল তাদের পানে। প্রথমেই একজনকে শুধানো হল—
‘কিয়া নাম তুমহারা?’
‘আব্দুল আজিজ।’
‘কালেমা পড়হো।’
আব্দুল আজিজ নিরক্ষর চাষী মুসলমান। কলেমা হয়ত জান্ত। কিন্তু ঘাবড়ে গিয়ে কিছু বলতে পারল না। তাকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। দ্বিতীয় ব্যক্তি সেই জগন্নাথ হলের ছাত্র। মনে মনে একটি মুসলিম নাম সে ঠিক ক’রে রেখেছিল। কিন্তু সেই মুসলিম নামেই সে কি বাঁচত?
তার বাঙালিত্ব সে লুকোতো কি দিয়ে? অতএব ভাগ্যক্রমে সঠিক মুহূর্তেই সে তার ভেবে—রাখা মুসলিম নামটি ভুলে গিয়েছিল। বলার সময় ভুল ক’রে নিজের আসল নামটিই বেরিয়ে গিয়েছিল মুখ দিয়ে—
‘বিজনবিহারী–’
বলতে বলতেই থেমে যায় ছেলেটি। নামের সেনগুপ্ত অংশটুকু বলার আগেই তার নিজের ভুল নিজের কাছে ধরা পড়ে গেছে। হায় হায়, এখন তবে উপায়? উপায় ছিল ভাগ্যের হাতে। পাকিস্তানি জওয়ানের আর বাকিটুকু শোনার দরকার ছিল না। তার যেটুকু বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে। সে বলে ওঠে—
‘আপ বিহারি হ্যায়। ইধার মে।’
তুমি যখন বিহারি তখন এদিকে দাঁড়াও। তাকে আর একপাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। আব্দুল আজিজের কাছ থেকে অনেকখানি তফাতে; অন্য পাশে। এবার তৃতীয় ব্যক্তি। সে ছিল একজন খারেজিয়া মাদ্রাসার তালবিলিম। অতএব বিশুদ্ধ উচ্চারণে সে কলেমা পাঠ করল। জওয়ানটি তা শুনে কিছু বুঝল না বোধ হয়। তখন সে আশ্বস্ত হবার জন্য বিহারিকে শুধালে—
‘ইয়ে আদমী ঠিক বোলতা হ্যায়?’
ঠিক বোলতা হ্যায় কি না আমি কি ভাবে জানব? বিজনবিহারী একটু শুধু মাথা নেড়ে জানাতে চাইল—কি ক’রে বলব, আমি ওসব জানি নে। জওয়ানটি বিজনবিহারীর মাথা নাড়ার ভঙ্গি লক্ষ্য ক’রে তালবিলিমকে আব্দুল আজিজের পাশে দাঁড় করাল এইভাবে পরীক্ষা ক’রে করে কয়েকজনকে বিজনবিহারীর কাছে এবং অধিকাংশকে দাঁড় করানো হল আব্দুল আজিজের পাশে। তারপর বিজনবিহারীদের ক্ষুদ্র দলটির উপর হুকুম হল—
‘আপ চলা যাইয়ে।’
বিজনবিহারী ও সংগের কয়েকজন বাসে গিয়ে উঠল। জওয়ানদের ইঙ্গিতে বাস ছেড়ে দিল। আব্দুল আজিজসহ অন্যান্যের অদৃষ্টে কী ঘটল তা আর বিজনবিহারী জানে না। কেবল বাস ছেড়ে দেওয়ার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে তারা পেছনে মেশিনগানের গর্জন শুনেছিল। বিজনবিহারীর বেঁচে যাওয়ার সেই সুদীর্ঘ দেবশোভন কাহিনী সুদীপ্ত শুনেছিলেন প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পর। ততদিনে গঙ্গা-যমুনায় বহু জল গড়িয়ে গেছে। এবং মৃধা সাহেবের এমনকি তার নিজেরও, বেঁচে যাওয়াকে অন্যদের তুলনায় খুবই সামান্য একটি ঘটনা বলে তাঁর মনে হয়েছে।
এবং খুবই সামান্য ঘটনা এটি যে, এখন একজন ভদ্রলোক তাঁদের এলাকার আর-একজন ভদ্রলোকের সন্ধান নিতে এসে তাঁকে কথা বলেছেন কয়েকটি। সেই কথাতেই সুদীপ্ত বাঁচলেন। বিপুল একাকীত্বের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে মুক্তি মিলল। যেন সহসা আবার তার সাবেক পৃথিবীর মাটি পেলেন পায়ের নীচে। মানুষের সান্নিধ্য মনের জন্য এতো স্বাস্থ্যপ্রদ! কিন্তু রাস্তায় মানুষ কৈ? মোটেই তো সাড়ে এগারোটা এখন। কারফিউ নেই! তবে?
কী বেকুবের মতো ভাবছেন তিনি। কারফিউ নেই, অতএব মানুষ স্বাভাবিক ভাবে পথে বেরুবে? হাট-বাজার করবে? খুব ভালো কথা। কিন্তু ভালো কথা শোনার লোক এখন পাকিস্তানে আছে নাকি! ইয়াহিয়া খান থেকে একটা ক্ষুদে সৈনিক পর্যন্ত কোন লোকটা এখানে কোন নিয়মটা মানে শুনি?
যুদ্ধেরও কতগুলো নিয়ম-কানুন থাকে। থাকে না? কোনো দেশ আক্রমণ করতে হলে আগে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়। পাকিস্তান সরকার গায়ের জোরে একটা অঘোষিত যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষের উপর। অকস্মাৎ যাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা নিরস্ত্র। কেউ কখনো নিরস্ত্রকে আক্রমণ করে?
করে না? প্রেমে ও রণে কিছুই অন্যায় নয়।
একটা বিরাট জালিয়াতি আছে কথাটার ভিতর। প্রেমে যদি কিছু অন্যায় না হয়, তবে যুদ্ধে সবি অন্যায়। যুদ্ধটাই অন্যায়। যুদ্ধ ও প্রেম বিপরীতার্থক। তাদের সামান্য লক্ষণ সন্ধান মূর্খের কর্ম।
কিন্তু কথাটার উদ্ভাবক মূর্খ ছিলেন না।
নিশ্চয়ই না। মূর্খতার একটা লক্ষণ হিসেবেই কথাটাকে তিনি তৈরি করেছিলেন। এবং বর্তমানের মূর্খরা ক্ষেত্রবিশেষে নরপিশাচেরা, এটাকে তাদের শয়তানীর কৈফিয়ৎ হিসাবে ব্যবহার করছে।
না না, তা নয়। মানে এ ঠিক যুদ্ধ তো নয়। এ হল যথার্থতঃ বিদ্রোহ-দমন। কোনো দেশের কতকগুলো মানুষ বিদ্রোহ করলে তাকে শায়েস্তা তো করতেই হয়। সেখানে যুদ্ধ-ঘোষণার কথা ওঠে না।
তা হলে অন্য কথা ওঠে। বিদ্রোহ কাকে বলবে? দেশে নির্বাচন হয়েছে। সারা বিশ্বের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করবেন। এই স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধাচারণ যারা করল বিদ্রোহী বললে তো তাদেরকেই বলতে হয়।
কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটা অংশ যদি দেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায়?
করতে চাইলে তা হবে নাকি! পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেতে হবে না? এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যদি কোনো অযৌক্তিক অপকর্ম করতেই চায় তখন প্রেসিডেন্ট তো আছেনই, পার্লামেন্ট বাতিল ক’রে দিয়ে আবার নির্বাচন দিতে পারেন তিনি। জনগণের রায় কোন দিকে তার যাচাই হবে।
জনগণও যদি সেই অপকর্মকে সমর্থন করে?
তা হলে সেইটেই হবে। অধিকাংশের ইচ্ছাকে কোনো নীতিধর্মের দোহাই পেড়ে বাধা দেবার অধিকার কোনো একটি ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া যায় না। সারাদেশ যদি বঙ্গোপসাগরে ডুবতে চায়, সে অধিকার তাদের থাকতে হবে। কেবলি একজনের হাতে অমৃত পরিবেশনের ভার থাকার নাম স্বাধীনতা নয়।
এমনি নানা তর্কই তো মনে জাগে। কিন্তু তর্কযুক্তি এ সব তো শিক্ষিত লোকের অস্ত্র। কেবল সভ্য লোকের সাথেই তর্ক চলে। যুক্তির কথা তিনিই মানবেন যিনি বিবেকবান। শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন—কেউ যদি যুক্তির কথা বলেন এবং তিনি যদি সংখ্যায় একজনও হন, আমরা তার কথা মানব।—এই তো বিবেকবান সভ্য মানুষের কথা। এবং চিরন্তন কথা। গণতন্ত্র এই কথাতেই বাঁচে। গণতন্ত্র মানে কি সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে অপকর্ম ক’রে যাওয়া? এক শো বার তা নয়। গণতন্ত্রে আস্থাবান মানুষের মনের কথাই হবে, কেউ যদি যুক্তির কথা বলেন এবং তিনি যদি সংখ্যায় একজনও হন, আমরা তার কথা মানব।
কিন্তু যুক্তির কথা কাকে শুনাবেন শেখ মুজিবুর রহমান? যারা কেবলি দৈহিক শক্তিতে আস্থাবান তাদেরকে? ননসেন্স। অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন ননসেন্স কথাটাই উচ্চারণ করলেন মনে মনে। রেল লাইন পেরিয়ে তিনি ততক্ষণে উত্তর দিকের ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছেন। হায় আল্লাহ্ তিনি যাবার সময়ও তো দু একজন লোক দেখে গেছেন এই পথে। এরই মধ্যে কোন যাদুমন্ত্রে তারা সব অদৃশ্য হয়ে গেল! একটিও দোকান যদি খোলা থাকত।
কতকাল এই পথে তিনি হেঁটেছেন। সকালে মাছের বাজারে গেছেন। বিকেলে বইয়ের দোকানে, কখনো বা অন্য কিছুর! হায় রে, তখন কত ক্রুদ্ধ হয়েছেন মনে মনে। তাঁর দেশবাসী এতো নোংরা। ছী, ছি, একি স্বভাব তার দেশের মানুষের? এই সকালে কাজের সময় শক্ত সমর্থ জোয়ান পুরুষগুলো ফুটপাথের ছায়াতে ক্যারাম খেলে। এবং তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন। এ জাতির ভাগ্য যদি ঘুমিয়ে না থাকবে তবে তা থাকবে কার? আর যদি বা খেলবেই তো ঘরে গিয়ে খেল গে না। মানুষের হাঁটবার পথ জুড়ে তুমি খেলবে ক্যারাম আর একজন পাতবে দোকান…‥মানুষ তবে হাঁটবে কোন দিক দিয়ে শুনি? এইখানে তো আবার প্রকাণ্ড চুলো পেতে ফুটপাথের প্রায় সবটাই রান্নাঘর বানিয়ে রাখত সেই বিশাল বপু দোকানদারটা। আহা, আজ তার সেই চুলোতে যদি তেমনি গরম জিলিপি ভাজা হত। আর তেমনি মানুষের ভীড় থাকত। সুদীপ্ত কোনোদিন ফুটপাথের দোকানে কোনো খাবার কিনেন না। আজো কিনবেন না। তাও ঠিক। তবু আজ সারা চিত্ত জুড়ে হাহাকারটা জাগল। সবখানি ফুটপাথ জুড়েও যদি লোকেরা দোকান পেতে রাখে তিনি তাতে রাগ করবেন না। কেনই বা রাগবেন? একই দেশের মানুষ না তারা? দেশের মানুষের একটু-আধটু অত্যাচার তো দেশের মানুষেই সহ্য করে। আহা, মানুষের মতো কিছু আছে নাকি পৃথিবীতে। এককালে বাংলাদেশে কত মানুষ ছিল? ধর সেই কালের কথা যখন সারা বাংলায় মানুষ ছিল বর্তমানের সাত ভাগের এক ভাগ। আর মানুষ কম থাকলে যা হয়—পড়ে থাকত সুবিস্তৃত অনাবাদী প্রান্তর। হাঁ, সেই প্রান্তরে বিশাল অরণ্য ছিল। পর্যাপ্ত রৌদ্র বৃষ্টির বাংলায় অরণ্য তো থাকবেই। বিপুল অরণ্য, বিস্তীর্ণ জলাভূমি-নদী, হাওড়, খাল-বিল—এরই মাঝে দু-একখানি গ্রাম নিয়ে এক-একটি জনবসতি এলাকা। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকার দূরত্ব কত? অনুমান কর দশ-বিশ ক্রোশ। সুদীপ্ত এখন যেন তেমনি কোনো দশ-বিশ ক্রোশের জনবসতিবিহীন এলাকা অতিক্রম করছেন পাশে প্রাচীন গৌড় নগরীর পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘর। মানুষ বিদায় নিয়েছে। আছে প্রেতাত্মারা আর শেয়ালনেকড়েরা। ঐ তো ঘরগুলির জানলা-কপাট সব ভাঙ্গা—ওর কোটরে কোনো নেকড়ে থাকতে পারে না? সুদীপ্তর মনে হতে লাগল, এখন ওখান থেকে নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপর। সেকালের মানুষের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকা গমনের অভিজ্ঞতা যেন সুদীপ্তকে স্পর্শ করল। এই মুহূর্তে কোনো মানুষের জন্য তার বলতে ইচ্ছে করছে। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। সবার উপরে মানুষ সত্য? কথাটা কদিন আগেও বলতে দ্বিধা ছিল সুদীপ্তর। ঠিক এই পথেই প্রতিদিন চলতে গিয়ে পদে পদে তিনি মানুষের ঠোক্কর খেতে খেতে কত কি ভাবতেন। না, এতো মানুষের ভীড়ে বসে কবি ঐ কথা বলতেই পারতেন না। নিশ্চয়ই কবি কোনোদিন পথে চলতে ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে কোনো মানুষের দেখা পাননি। এবং তখনি তাঁর মনে হয়েছিল ঐ কথা সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। হাঁ, সুদীপ্তও স্বচ্ছন্দে এখন ঐ সুরে সুর মিলাতে পারেন। এ জন্য অবশ্য তাঁকে ক্রোশের পর ক্রোশ হাঁটতে হয়নি। নীলক্ষেতের রেলক্রসিং থেকে বলাকা সিনেমা কতখানি পথ হবে? আধ মাইলও নয়। কিন্তু সুদীপ্তর মনে হল যেন পেরিয়ে এলেন অন্তহীন পথ। অন্তবিহীন পথ পেরিয়ে একজন লোকের দেখা পেলেন সুদীপ্ত।