দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
সত্যিই তখন কোনো প্রশ্নের কিংবা চিন্তার অবকাশ খুব ছিল না। ফিরোজ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কোথায় যাবেন? রাস্তায় ব্যারিকেড। বড়ো বড়ো গাছ কেটে রাস্তায় প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হয়েছে। এরি মধ্যে? এতো শীঘ্র এতো বিরাট গাছটাকে আনল কেমন ক’রে? আর জনগণ জানলই বা কেমন ক’রে যে, এখনি এই রাতে এসবের প্রয়োজন। দেশবাসী তবে অনেক এগিয়ে গেছে। বিকেলেও তিনি এই পথ দিয়ে পল্টন ময়দানের জনসভায় গিয়েছিলেন। বিকেলেও যথারীতি জনসভা হয়েছে ন্যাপের। মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থন জানিয়েছে আওয়ামী লীগকে। বুড়ো বয়সে মাওলানা সেদিন ঘোষণা করেছেন, শেখ মুজিব তার সন্তানতুল্য। না, পঁচিশ তারিখের জনসভায় নয়। সকলেই তো জানে, পঁচিশ তারিখের জনসভায় মাওলানা উপস্থিত ছিলেন না। ঢাকাতেই ছিলেন না। অসুস্থ হয়ে সন্তোষ চলে গিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগের অন্য এক জনসভায় বলেছিলেন, শেখ মুজিব আমার সন্তানতুল্য। ঠিক বলেছিলেন। একটা দলের সাথে দ্বিমত যতোই থাক, দেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বটে। সেখানে কোনো মতভেদ দিয়ে কথা ওঠে নাকি! এই বৃদ্ধ বয়সেও মাওলানার চিন্তায় কোনো অস্বচ্ছতা নেই। এখন দলের নয়, দেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বল। দেশের স্বার্থ নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছে আওয়ামী লীগ। তুমি দেশ প্রেমিক হলে অবশ্যই তাকে সমর্থন জানাবে। সোজা কথা। বিভিন্ন আওয়ামী পার্টি, ন্যাশনাল লীগ এখন তাই শেখ সাহেবের সঙ্গে। সঙ্গে নেই জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পিডিপি আর মুসলিম লীগের বিচিত্র শাখা। এই দলগুলো কি চায়? ঠিক কি যে চায় ফিরোজ বুঝতে পারেন না। ইসলামকে বাঁচানোই নাকি এদের লক্ষ্য। যত সব রাস্কেলের দল। আরে বাবা, ইসলামকে বাঁচানোর জন্য তোরা পাকিস্তান বানিয়েছিলি। কিন্তু ইসলামের অনুসারী অর্ধেক মানুষকেই তো হিন্দুস্থানে ফেলে পালিয়ে এলি তোরা। হ্যাঁ, সেই হিন্দুস্থানে যেখানে তোদের মতে, ইসলাম বিপন্ন। ইসলামের অর্ধাংশকে বিপন্ন ক’রে বাকি অর্ধাংশ বাঁচাতে হবে— এ কোন্ ধরনের পলিটিক্স রে বাবা! আস্ত হাবারামের পলিটিক্স। পলিটিশিয়ানকে খানিকটা দার্শনিকও হতে হয়। না ভাববাদি দার্শনিকের কথা হচ্ছে না। সমাজ-বিজ্ঞান ও ইতিহাস-চেতনার উপর দাঁড়িয়ে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা ক’রে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সে সিদ্ধান্ত সাময়িক ভাবে সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট-বিরোধী হলেও যিনি তাতে পিছিয়ে যাবেন না তিনিই সত্যকার দেশনেতা। সাধারণ মানুষের যুক্তি ও বুদ্ধির কাছে তিনি নিজের বক্তব্য পৌঁছে দেবেন, কখনো তাদের সেন্টিমেন্টকে উত্তেজিত ক’রে নিজের নেতাগিরি বজায় রাখবেন না। চিন্তা ক’রে ফিরোজ দেখেছেন, প্রকৃত দেশ-নেতার এই গুণাবলি দেশ ভাগের সময় ছিল অতি অল্প কয়েকজনের মধ্যেই। মুসলিমদের মধ্যে ছিল কেবল মাওলানা আজাদের মধ্যে। কিন্তু জিন্নার অনুগামীদের বক্তব্যটা বর্তমানে কী?
‘যেখানে সবটাই ধংস হয়ে যেত সেখানে কায়েদে আজম তবু অর্ধেকটা বাঁচিয়েছেন।’
যুক্তিটা ছিল অধ্যাপক গোলাম কবীরের। নেজামে ইসলামের নেতা অধ্যাপক গোলাম কবীর। নিজেই তিনি নামের আগে অধ্যাপক লেখেন। কিন্তু কখনো নাকি অধ্যাপনা করেন নি—লোকে বলে। অবশ্যই তারা দুষ্ট লোক। এবং ইসলামের শত্রু। প্রকৃতপক্ষে গোলাম সাহেব অধ্যাপনা করেছেন। তবে কোনো কলেজে নয়, মাদ্রাসায়। কোনো এক আলেয়া মাদ্রাসায় তিন বছর তালবিলিম পড়িয়েছেন। ফাজেল ও টাইটেল ক্লাসের তালবিলিম। টাইলের মরতবা কিছু বোঝ? টাইটেল হচ্ছে এম.এ. এর সমান। অতএব এম.এ. ক্লাসের ছাত্র পড়িয়েছেন গোলাম সাহেব। এম. এ. ক্লাসের ছাত্র যিনি পড়িয়েছেন তিনি অধ্যাপক না হবেন কেন? অতএব মৌলভি গোলাম কবীর। অধ্যাপক গোলাম কবীর হয়েছেন। এখন তিনি একজন প্রচণ্ড নেতা। এবং ঈমানদার নেতা। তার কথায় চললে ঈমান পাকা হয়। কিন্তু ফিরোজ অধ্যাপক গোলাম সাহেবের কথা মনে নিয়ে ঈমানদার হতে চান নি। বলেছিলেন—
‘কিন্তু যে অর্ধেকটা আপনাদের কায়েদে আজম বাঁচাতে চান নি, সেই অর্ধেকটাই দেখছি বেঁচে আছে। আর মরে যাচ্ছি আমরা। এই মোজেজাটা ঠিক। বুঝতে পারি নে।’
ফিরোজের কথায় বারুদ অবশ্যই ছিল না। কিন্তু গোলাম সাহেবের মনে তা বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। প্রচণ্ড স্বরে ব’লে উঠেছিলেন—
‘মোজেজা? মোজেজা কি বুঝেন আপনারা? না-পাক জবানে ঐ শব্দ উচ্চারণ করবেন না।’
‘তা না করলেও আমার কথাটার জবাব তো আপনাকে দিতে হবে। না, তাও দেবেন না।’
‘না দেবো না। আবোল-তাবোল একটা কিছু বললেই তার জবাব পাওয়া যায় না। হিন্দুস্থানে খাঁটি মুসলমান হয়ে বাঁচা যায় এ কথা দুনিয়া জাহানে কেউ বিশ্বাস করবে না।’
‘ভারতের অতগুলো মুসলমান তা হ’লে?’
‘হিন্দুস্থানের মুসলমানগুলো ধীরে ধীরে সব হিন্দু হয়ে যাবে।’
‘একেবারেই হিন্দু হয়ে যাবে। গুণা হবে না তাতে? এবং গুণা হলে সেটা হবে কার? আপনাদের সেই কায়েদে আজমের না?’
বলাই বাহুল্য, এ কথায় ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন গোলাম সাহেব। লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করেছিলেন। হাঁ, গোলাম সাহেব বেড়াতে বেরুনোর সময় ছড়ি বলে যেটাকে সঙ্গে নেন সেটা জাতে লাঠিই বটে। অমন যার বহর তার নাম ছড়ি হয় কি করে? লম্বায় প্রায় চার ফুট বিশুদ্ধ শালের সেই গোল কাষ্টখণ্ডের ব্যাস দেড় ইঞ্চির কম নয়। ফিরোজ সেদিন হাস্যকরভাবে দৌড় দিয়ে মাথা বাঁচিয়েছিলেন।
আজো কি তেমনি দৌড়াবেন? সেনাবাহিনী আসছে শহর দখল করতে। শহরের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে সাধারণ মানুষ বাধা দিতে এগিয়েছে। না, ফিরোজের হাসি তো পায় নি। নিরস্ত্র মানুষ ব্যারিকেড দিয়ে গতিরোধ করবে কার? আধুনিক সেনাবাহিনীর? ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে হাস্যকর। এবং বাইরের লোক হলে তিনি হাসতেনই। কিন্তু ফিরোজ হাসবেন কি করে? এ তত খেলা নয়। অসহায় মানুষের বাঁচবার চেষ্টা। সেই সাতচল্লিশ সাল থেকে গায়ের জোরে আমাদের গলায় আঙুলের চাপ কষতে শুরু করেছে ওরা। টুটি টিপে ধরলে মানুষ কতক্ষণ বাঁচে! বাধা দিতেই তো হবে। হয় মুক্তি না হয় মৃত্যু। দেশবাসী কি বিনা প্রতিবাদে নিঃশব্দে মরবে। অন্ততঃ পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাই চায়।
ব্যারিকেডের সামনে ফিরোজ গাড়ি থেকে নামলেন। পথের এক পাশ থেকে রাইফেল হাতে একটি যুবক এগিয়ে এলো! সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়াল। তাঁদের পাড়ার ছেলে। এতএব চেনা ছেলে। সস্তা দামের সিগারেট খেত, আর ঘুরে বেড়াত। কাজ কিছু করত কি না ফিরোজ জানেন না। শোনা যায় সিনেমা হলের দ্বাররক্ষকের কাজ পেয়েছিল কিছুদিন আগে। সাতই মার্চের পর তা ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক হয়েছিল। ভারি কাজের ছেলে! কিছুকাল আগে একবার কলেজের দুটি ছোকরা পাড়ার একটি মেয়ের পিছু নিয়েছিল, এবং অশালিন মন্তব্য করেছিল। এই ছেলেটাই সেদিন কলেজের ছেলে দুটিকে বেধড়ক মার দিয়েছিল না! হাঁ সে একাই সেদিন দুটি ছাত্রকে পিটিয়েছিল। তোমার সাথে যার পীরিত নেই তার পিছু ধাওয়া ক’রে তাকে নাহক দশ কথা শোনাবে, আমরা পাড়ার ছেলে হ’য়ে এটা ছেড়ে দেব। সেদিন কলেজের ছেলে দুটিকে সে অমনি ছেড়ে দেয়নি।
এবং বর্বর পাকিস্তানি সেনাদেরকেও সে আজ অমনি ছেড়ে দেবে না।
‘ওরা আমাদের মারতে আসছে স্যার। কম ক’রে হ’লেও পাঁচজনকে মেরে মরব।’
ভাই আমার, মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে পারার এই সাহসটুকুই তোদের বাঁচাবে। কিন্তু এমন ক’রে মরে কিছু লাভ তো হবে না। শত্রুকে আঘাত করতে হবে তখনি যখন জয়ের সম্ভাবনা থাকবে। নিশ্চিত ধংসের সম্ভাবনার মুখে শক্রকে বাধা দিতে নেই। তখন কেবল খোঁচা দিতে হবে গোপনে গা বাঁচিয়ে। খোঁচা দিয়ে দিয়ে রক্ত ঝরিয়ে কাবু ক’রে ফেলতে হবে। কিন্তু কথাগুলি এই মুহূর্তেই ফিরোজ বলতে পারলেন না। এই প্রচণ্ড উৎসাহের আগুনে জল দেওয়া কিছুতেই উচিত কর্ম বলে তার মনে হল না। তিনি কেবল বললেন—
‘হাঁ ওরা আসছে। কিন্তু আমাদেরকে মারতেই যে আসছে সেকথা কে বলল? ফিরোজের এ কথায় কোন চাতুরি ছিল না। এবং শুধু তিনি কেন, কারো মনেই সেই সন্ধ্যায় কোন সন্দেহ ঘুণাক্ষরেও ছিল না যে, ওরা নির্বিচার গণহত্যার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আসছে। আস্থা অসামরিক শাসন-কর্তৃপক্ষের আয়ত্তের বাইরে বলে সেনাবাহিনী শাসনভার নিজের হাতে নিতে চায়, কিন্তু সাধারণ নাগরিককে সেজন্য তারা মারতে চাইবে কেন? এ প্রশ্নের জবাব সেই বাউণ্ডেলে ছোকরার জানা নেই। সে নিজের বিশ্বাসকেই ব্যক্ত করল—
‘দেখবেন স্যার, ওরা এখন ক্ষ্যাপা কুত্তা হয়ে গেছে। এখন ওরা ঘরে ঢুকে আমাদের মারবে। তা ঘরের মধ্যে মরার চেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে দু-একটাকে মেরে মরা ভালো।’
ঘরে ঘরে ঢুকে আমাদের মারবে। কথাটা একেবারেই অবিশ্বাস্য। কিন্তু মনে তবু খটকা লাগল কেন?
অবশ্য ফিরোজের মনে অন্য ধরনের একটা সন্দেহ ছিল। আলোচনার প্রথম দিকেই ইয়াহিয়া যে সামরিক শাসন তুলে নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য ছিল? হায় হায়, মানুষ এতো ভণ্ডও হয়! দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে তুমি যখন বললে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তোমার আগ্রহের জুড়ি নেই তখন আওয়ামী লীগ সে কথা অকপটভাবেই বিশ্বাস করেছিল। তারপর? যে সন্ধ্যায় তোমার জনগণের কাছে ভাষণ দেবার কথা সেই সন্ধ্যায় তুমি লেলিয়ে দিলে সেনাবাহিনী। না, সে জন্য আমরা অবাক হই নি। পুরোপুরি বিশ্বাস তোমাকে আমরা কোনো সময়ই করি নি। সন্দেহ একটা মনে মনে ছিলই। কিন্তু যে সন্দেহটা কোনো সময়ই মনে ছিল না এখন যে সেইটেই দেখা দিল। ওরা ঘরে ঘরে ঢুকে আমাদের মারবে। সত্যি নাকি। বিশ্বাস করেও বিশ্বাস করলেন না ফিরোজ। তিনি বাসায় ফিরে এলেন।
বাসায় ফিরেই ফোন ধরলেন। ডায়াল ঘুরিয়ে ঈপ্সিত কষ্ট পাওয়া যেতেই বললেন—
‘হ্যালো, সব শুনেছেন তো? ………’
কিছু ভেবে পাচ্ছি নে কি করব। আপনি কিছু দিক-নির্দেশ করতে পারেন?
বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছেন। তিনি এখন সরে পড়লে তার খোঁজে সারা ঢাকা শহর খবিশরা তছনছ ক’রে ছাড়বে।
‘তা ঠিক। আমাদের দুর্গতি যতোই হোক, সবের বিনিময়ে এখন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করা কর্তব্য। আপনারা তাঁকে শীঘ্র সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করুন।’……
‘না তাঁর কথা শোনা হবে না। ওই বর্বরদের হাতে পড়লে এবার তাঁকে বাঁচানো দায় হবে।
পাকিস্তানি জালেমদের হাতে এবার বঙ্গবন্ধুকে পড়তে দেওয়া হবে না কিছুতেই। মনে মনে কিছুক্ষণ ছটফট করলেন ফিরোজ। না, মুজিব ভাই বোধ হয় কথা শুনবেন না। ঐ কথাটা একবার যদি তাঁর মাথায় ঢুকে থাকে যে, তাঁকে না পেলে ওরা সাধারণ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করবে তা হলে তাঁকে নড়ানোর সাধ্য কারো হবে না। কিন্তু তাঁর বেঁচে থাকা যে দরকার। আমরা না হয় কিছু মরলাম, কিন্তু তিনি যদি বাঁচেন…। আল্লাহ, তিনি যেন নিরাপদে পালিয়ে বাঁচেন–সেই রাতে এই প্রার্থনা শুধুই ফিরোজের ছিল না, বঙ্গবাসী প্রায় সকলেই কেউ জ্ঞাতসারে কেউ বা নিজের জ্ঞাতেই শেখ মুজিবের নিরাপত্তা কামনা করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান–শুধুই একটি নাম তো নয়, তা যে বাঙালির আত্মমর্যাদার প্রতীক। এবং আনন্দময় জীবনেরও।
আর আটাশে মার্চের মধ্যাহ্নে বন্ধু সুদীপ্ত শাহিনের মুখোমুখি বসে ঐ রাতের কথা ফিরোজ স্মরণ করলেন। তার আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। মুজিব ভাই কারো কথা শুনেন নি। ঢাকা ছেড়ে যেতে রাজি হন নি। ধরা দিয়েছেন। আমার দেশের মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে আমি নিরাপত্তার সন্ধানে বেরুব। অসম্ভব। এমন মানসিকতা বহন করতে পারেন একমাত্র বোধহয় ঐ লোকটিই। অন্ততঃ পাকিস্তানে আর-কেউ তা পারেন নি। জিন্না-লিয়াকত আলি ভারতীয় মুসলমানদের সমর্থনে পাকিস্তান আদায় ক’রে তাদেরকে কি ভাবে কলা দেখিয়েছিলেন সে কথা তৎকালিন কলকাতার অধিবাসী ফিরোজদের তো জানা আছে ভালোভাবেই। তাদের পিছে পিছে ভারতের পুচকে মুসলিম লীগ নেতারা এক দীর্ঘ লাফে কেউ করাচী, কেউ লাহোর কেউ ঢাকায় পাড়ি জমিয়ে দেশপ্রেমের যে নমুনা দেখিয়েছিল তা দেখবার মতো বৈ কি!
বেটারা, তোদের ভোটের দরকার ছিল, ভোট নিয়ে পাকিস্তান বানিয়েছি। এখন চললাম সে পাকিস্তানকে ভোগ করতে।
নেতাদের পেছনে পেছনে ভারতের চার-পাঁচ কোটি মুসলমান সকলেই যদি তখন বন্যার জলের মতো এসে পাকিস্তানে ঢুকত, তা হলে? সেই বন্যায় পাকিস্তানের অস্তিত্ব তলিয়ে যেত না! ভারতীয় মুসলমানরা সব আহাম্মক। আর হিন্দুরাও গবেট। মুসলমানগুলোকে সব পাকিস্তানের দিকে খেদিয়ে দিলে কেমন ক’রে জিন্নার কায়েদেআজমগিরি বজায় থাকত একবার দেখতাম।….নানা চিন্তায় ফিরোজকে বড়ই অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। ….শেষ পর্যন্ত সেই যুবকের কথাই সত্য হল।
দেখবেন স্যার ওরা এখন খ্যাপা কুত্তা হয়ে গেছে। এখন ওরা ঘরে ঘরে ঢুকে আমাদের মারবে।
সত্যিই ওরা ঘরে ঘরে ঢুকে বাঙালিকে মেরেছে। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা কি এতটা ভাবতে পেরেছিলেন? পারেন নি। অবশ্যই কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে এতোখানি নারকীয় কাণ্ড কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু সেই যুবকটির কল্পনা তো ঠিকই এগিয়েছিল। আজ সে যুবকের পরিণতি? সুন্দর ক’রে টেরি বাগিয়ে ড্রেনপাইপ ফুলপ্যান্ট পরে সস্তা দামের সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পথে হাঁটত যখন! একটুও দেখতে ভালো লাগতো না। কিন্তু আজ?
ওরা আমাদের মারতে আসছে স্যার। ঘরের মধ্যে মরার চেয়ে এইখানে দাঁড়িয়ে দু-একটাকে মেরে মরা ভাল।
আহা, তোমার কথাই সত্য হোক ভাই যদি মরে গিয়েই থাক, তবে তার আগে দু-চারটে শত্রুসেনা তোমার গুলিতে যেন অক্কা পেয়ে থাকে। আহ্ অমনি বখাটে ছেলে যদি বাংলা মায়ের আরো অনেক থাকতো। হাঁ, আরো অনেক। কেন? ভালো ছেলেরা সবাই সেদিন মায়ের আঁচলে লুকিয়েছিল নাকি! বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ভালো ছেলে প্রাণ দিয়েছে না। না না, কথা ভালো-মন্দ নয়। দেশকে ভালোবাসা নিয়ে কথা। বখাটে ছেলেরা তাদের মাকে ভালো বাসে না? এবং সব ভালো ছেলেই কি কাপুরুষ হয়? এখন তো ভালো-মন্দ বিচারের সময় নয়। এখন চাই মাতৃভক্ত ছেলে। আর সাহসী।