বেলা বাড়ার সাথে সাথে দিক বদলাল নদীর স্রোত। জল যেই বাড়তে আরম্ভ করল, শুশুকগুলোও সরে যেতে লাগল দহটা থেকে। আস্তে আস্তে শেষ ডলফিনটাও যখন চলে গেল, মেঘার দিকে ডিঙির মুখ ফিরিয়ে দাঁড় টানতে শুরু করল ফকির।
ইতিমধ্যে হরেন আর তার নাতি মিলে লঞ্চের পেছন দিকটায় কয়েকটা তেরপল খাঁটিয়ে স্নানের জন্য একটা ঘেরা জায়গা তৈরি করে ফেলেছে। সারাটা দিন রোদের মধ্যে কাটানোর পর ভাল করে স্নান করার এরকম সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না পিয়া। তোয়ালে সাবান নিয়ে চটপট ঢুকে পড়ল ঘেরাটোপের ভেতর। দুটো বালতি রাখা রয়েছে সেখানে, তার মধ্যে একটা ভর্তি, আর অন্যটার হাতলের সঙ্গে একটা লম্বা দড়ি বাঁধা রয়েছে জল তোলার জন্য। নদীতে ছুঁড়ে দিল সেটাকে পিয়া। জলটা তুলে পুরো বালতি উপুড় করে ঢালল মাথায়। শিরশিরে ঠান্ডায় গা-টা যেন জুড়িয়ে গেল একেবারে। অন্য বালতিটায় ভর্তি করে পরিষ্কার জল রাখা ছিল। একটা এনামেলের মগে করে তার থেকে একটু একটু করে নিয়ে গায়ের সাবানটা ধুয়ে নিল। স্নান হয়ে যাওয়ার পরেও অর্ধেকটা মতো জল রয়ে গেল বালতিতে।
কেবিনে ফেরার পথে কানাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। কাঁধে একটা তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ডেকের একধারে।
“অনেকটা পরিষ্কার জল রেখে এসেছি আপনার জন্যে।”
“যাই, সেটার সদ্ব্যবহার করে আসি তা হলে।”
খানিক দূর থেকে ঝপাৎ ঝপাৎ করে আরেকটা কারও গায়ে জল ঢালার আওয়াজ কানে এল। নিশ্চয়ই ফকির, স্নান করছে নিজের ডিঙিতে।
একটু বাদে ধোয়া জামাকাপড় পরে ডেকের ওপর এসে দাঁড়াল পিয়া। ভরা জোয়ারে থই থই করছে নদী, নোঙর করা বোটের গায়ে ধাক্কা খেয়ে স্রোতের ঘূর্ণি নানা রকম নকশা তৈরি করছে। দূরে কয়েকটা দ্বীপ ছোট হয়ে সরু চড়ার মতো দেখা যাচ্ছে। খানিক আগে যে জায়গাটা ছিল জঙ্গল, সেখানে এখন গাছের কয়েকটা ডাল শুধু চোখে পড়ছে, নলখাগড়ার মতো দুলছে স্রোতের টানে।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে রেলিং-এর ধারে বসতে যাচ্ছে পিয়া, এমন সময় কানাই এসে পাশে দাঁড়াল। দু’হাতে ধোঁয়া ওঠা দুটো চায়ের কাপ। পিয়াকে একটা দিয়ে বলল, “হরেন পাঠাল নীচে থেকে।”
কানাইও একটা চেয়ার নিয়ে বসল পিয়ার পাশে। চারপাশের দ্বীপ-জঙ্গল আস্তে আস্তে কেমন তলিয়ে যাচ্ছে, দেখতে লাগল মগ্ন হয়ে। পিয়ার মনে হল এই বোধহয় কানাই কোনও ঠাট্টার কথা বলে উঠবে, কিংবা ট্যারাবাঁকা মন্তব্য করবে কিছু একটা; কিন্তু সেসব কিছুই করল না কানাই, চুপচাপ বসে রইল শান্ত হয়ে। তবে তার মধ্যেও একটা উষ্ণ আন্তরিকতা বেশ অনুভব করা যাচ্ছিল। নীরবতা ভেঙে শেষে পিয়াই শুরু করল কথা বলতে।
“মনে হয় আমি যেন সারা জীবন ধরে বসে বসে এই জোয়ার ভাটার খেলা দেখে যেতে পারি।”
“দ্যাটস ইন্টারেস্টিং,” বলল কানাই। “আমি এক সময় একটি মেয়েকে জানতাম যে প্রায় এই একই রকমের একটা কথা বলত–সমুদ্র সম্পর্কে।”
“কোনও গার্লফ্রেন্ড?”
“হ্যাঁ।”
“অনেক গার্লফ্রেন্ড আছে বুঝি আপনার?”
মাথা ঝাঁকাল কানাই। তারপর হঠাৎ যেন আলোচনাটা ঘোরানোর জন্যই জিজ্ঞেস করল, “আর আপনার? সিটোলজিস্টদেরও কি ব্যক্তিগত জীবন-টিবন বলে কিছু থাকে?”
“জিজ্ঞেস করলেন যখন বলি,” পিয়া বলল, “খুব কম সিটোলজিস্টেরই সেটা থাকে। বিশেষ করে মহিলাদের তো থাকেই না প্রায়। যে ধরনের রুটিনের মধ্যে দিয়ে আমাদের চলতে হয় তাতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক-টম্পর্ক গড়ে ওঠা খুবই কঠিন।”
“কেন?”
“এত ঘোরাঘুরি করতে হয় আমাদের”…বলল পিয়া। “কোনও একটা জায়গায় এক টানা বেশি দিন থাকাই হয়ে ওঠে না। ফলে, ব্যাপারটা খুব একটা সহজ নয়।”
ভুরুদুটো একটু তুলে কানাই জিজ্ঞেস করল, “এটা নিশ্চয়ই আপনি দাবি করবেন না যে আপনার কখনও কারও সঙ্গে কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়নি–এমনকী কলেজে-টলেজেও নয়?”
“হ্যাঁ, সে কখনও কিছু হয়নি তা নয়,” পিয়া স্বীকার করল, “কিন্তু সে সম্পর্কগুলি শেষ পর্যন্ত কোথাও গিয়ে পৌঁছয়নি।”
“কখনও না?”
“শুধু একবার,” পিয়া বলল। “এই একবারই মাত্র আমার মনে হয়েছিল সম্পর্কটা সত্যি সত্যি কোথাও একটা যাচ্ছে।”
“তারপর?”
হেসে ফেলল পিয়া। তারপর আর কী? একদিন যাচ্ছেতাই ভাবে শেষ হয়ে গেল ব্যাপারটা। সেটা ঘটেছিল ক্রেতিতে।”
“ক্রেতি? সেটা আবার কোথায়?”
“পূর্ব কম্বোডিয়া,” বলল পিয়া। “নম পেন থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে। সেখানে এক সময় থাকতাম আমি।”
মেকং নদীর ভেতর ঢুকে আসা খাড়াই একটা অন্তরীপ মতো জায়গার ওপর ক্রেতি শহরটা তৈরি হয়েছে। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার উত্তরে নদীর মধ্যে একটা দহ আছে, গরমকালে জল কমে এলে গোটা ছয়েক ওর্কায়েলার একটা দল সেই দহটার মধ্যে থাকে। এখান থেকেই ওর রিসার্চের কাজ শুরু করেছিল পিয়া। শহরটা সুবিধাজনক জায়গাতেও বটে আর এমনিতে ছিমছাম সুন্দর, পিয়া তাই ঠিক করেছিল পরবর্তী দু-তিন বছর এখানে থেকেই রিসার্চের কাজ করবে। একটা কাঠের বাড়ির ওপরের তলাটা ভাড়া নিল ও। আরও একটা সুবিধা ছিল ক্রেতি শহরে। সরকারি মৎস্য বিভাগের একটা দফতর ছিল ওখানে। গবেষণার কাজে মাঝেমধ্যেই ওদের সাহায্য নিতে হত পিয়াকে।
সেখানে এক অল্প বয়স্ক সরকারি অফিসার ছিল সেই মৎস্যবিভাগের স্থানীয় প্রতিনিধি। দিব্যি ইংরেজি-টিংরেজি বলতে পারত। ছেলেটির নাম ছিল রথ, বাড়ি নম পেনে। ক্রেতিতে ওরও কোনও বন্ধুবান্ধব ছিল না, ফলে একা একা একটু মনমরা হয়ে থাকত। বিশেষ করে সন্ধেবেলাগুলো কাটানোই ওর কাছে ছিল এক সমস্যা। ক্রেতি ছোট্ট জায়গা, কয়েকটা পাড়া নিয়ে একটা গোটা শহর, ফলে মাঝে মধ্যেই পিয়ার দেখা হয়ে যেত রথের সঙ্গে। দেখা গেল নদীর পাড়ে যে কাফেটাতে সন্ধেবেলা পিয়া নুডল আর ওভালটিন খেতে যায়, প্রায়দিনই রথও যায় সেখানে ডিনার করতে। রোজ একই টেবিলে গিয়ে বসতে শুরু করল ওরা দু’জন, রোজকার টুকিটাকি খোশগল্প আস্তে আস্তে এক সময় সত্যিকারের কথোপকথনে মোড় নিল।
একদিন কথায় কথায় জানা গেল ছেলেবেলায় বেশ কিছুদিন রথকে পল পট জমানার এক ডেথ ক্যাম্পে কাটাতে হয়েছিল। খমের রুজ নম পেনের দখল নেওয়ার পর ওর মা-বাবাকে পাঠানো হয়েছিল সেখানে। যদিও এটা সেটা কথার মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে বিষয়টা একবার মাত্র উল্লেখ করেছিল রথ, কিন্তু পিয়া তাতে এমন নাড়া খেয়ে গেল যে হুড়মুড় করে নিজের ছেলেবেলার অনেক কথা ওকে বলে ফেলল। তার পরের কয়েকটা সপ্তাহে পিয়া দেখল এমনভাবে ও রথের সঙ্গে গল্প করছে যে ভাবে আগে আর কোনও পুরুষের সঙ্গে কখনও কথা বলেনি। রথকে ও নিজের মা-বাবার কথা বলল, তাদের বিয়ের কথা বলল, মায়ের ডিপ্রেশনের কথা, হাসপাতালে তার শেষ দিনগুলোর কথা–সব বলল।
ও যা যা বলেছিল তার কতটা বুঝতে পেরেছিল রথ? সত্যি বলতে কী, সেটা জানে না পিয়া। রথ তার নিজের জীবনের একটা বড় তথ্য পিয়াকে বলে দিয়েছে, সেটা কি একটা ভ্রান্ত ধারণা মাত্র ছিল? হয়তো নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথা খুব সাধারণভাবেই, উল্লেখ করেছিল ও। যে সময়টাতে রথ বড় হয়েছে এই রকম ঘটনা তো তখন বিরল কিছু ব্যাপার নয় কম্বোডিয়ায়। কে জানে? সত্যিটা কোনও দিনও আর জানতে পারবে না পিয়া।
একদিন পিয়া লক্ষ করল সমস্ত সময়ই ও কেবল রথের কথাই ভাবছে, এমনকী যখন ডলফিনগুলো তাদের ওই দহটার মধ্যে কী করছে তাতে ওর মন দেওয়া উচিত, তখনও। পিয়া বুঝতে পারছিল যে ও প্রেমে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাতে চিন্তিত হয়নি একটুও। তার অন্যতম প্রধান কারণ রথের স্বভাব–পিয়ার মতো ও-ও একটু চাপা ধরনের, একটু অমিশুক প্রকৃতির। ওর দ্বিধাগ্রস্ত হাবভাবে স্বস্তি পেত পিয়া, মনে হত ও নিজে যেমন পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশার বিষয়ে অনভিজ্ঞ, রথেরও হয়তো সেরকম নারীসঙ্গ বিষয়ে কোনও অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও যথেষ্ট সতর্ক ছিল পিয়া। ঘনিষ্ঠতা খাবার-দাবার আর স্মৃতির আদানপ্রদানের পরের স্তরে গড়াতে প্রায় মাস চারেক লেগে গিয়েছিল। আর তার পরে মনের যে একটা হালকা ভাব আসে সে কারণেই হয়তো নিজের স্বাভাবিক সব সতর্কতা সহজে দূরে সরিয়ে দিতে পেরেছিল ও। মনে হয়েছিল এই তো, পাওয়া গেছে এবার। মহিলা ফিল্ড বায়োলজিস্টদের মধ্যে যে সৌভাগ্য বিরল, সেই সৌভাগ্যের অধিকারিণী হতে চলেছে ও; ঠিক জায়গাতে এসে খুঁজে পেয়েছে নিজের মনের মানুষকে।
সেবার গ্রীষ্মের শেষে ছয় সপ্তাহের জন্যে হংকং যেতে হয়েছিল পিয়াকে একটা কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে, আর তা ছাড়া একটা সার্ভে টিমের সঙ্গে কাজ করে কিছু পয়সা রোজগারের জন্যে। রওনা যখন হল, মনে হয়েছিল ঠিকঠাকই চলছে সব কিছু। পোচেনতং এয়ারপোর্টে ওকে প্লেনে তুলে দিয়ে গিয়েছিল রথ, তারপর প্রথম কয়েক সপ্তাহ ই-মেলের আদানপ্রদানও হত প্রতিদিন। তারপরেই আস্তে আস্তে কমতে থাকল মেলের জবাব আসা। শেষে একটা সময় কোনও জবাবই আর আসত না রথের কাছ থেকে। রথের অফিসে ফোন করেনি পিয়া, কারণ যতটা সম্ভব খরচ বাঁচানোর চেষ্টা করছিল ও। আর তা ছাড়া, ওর মনে হয়েছিল এই কয়েকটা মাত্র সপ্তাহে আর কীই বা হতে পারে?
ফেরার সময় বোট থেকে ক্রেতিতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই পিয়া বুঝতে পেরেছিল একটা গোলমাল কিছু হয়েছে। হেঁটে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরতে ফিরতে সারাটা পথ যেন লোকজনের চাপা গলার কথা শুনতে পাচ্ছিল ও। ওর বাড়িওয়ালিই প্রথম দিল খবরটা, কুৎসিত একটা আনন্দের আভাস ফুটে উঠেছিল মহিলার গলায় রথ বিয়ে করেছে, ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছে নম পেনে।
পুরো বিষয়টা গোড়া থেকে ভাবতে গিয়ে প্রথমে পিয়ার মনে হল হয়তো বাড়ির চাপে বিয়েটা করে ফেলতে বাধ্য হয়েছে রথ—সেরকম কিছু একটা ঘটে থাকতেই পারে, সেটা বোঝাটা কঠিন নয় পিয়ার পক্ষে। আর ব্যাপারটার তিক্ততাও একটু হ্রাস পায় তাতে। প্রত্যাখ্যানটা অতটা সরাসরি এসে মনে ঘা দেয় না, একটু কম নিষ্ঠুর লাগে। কিন্তু সে সান্ত্বনাটাও রইল না যখন ও জানতে পারল নিজের অফিসেরই একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে রথ–একজন অ্যাকাউন্টান্টকে। পিয়া হংকং রওনা হওয়ার পরপরই মনে হল মেয়েটির কাছে যাতায়াত শুরু করেছিল রথ, আর মাত্র ছয় সপ্তাহ সময় লেগেছিল ওর মন স্থির করতে।
এইসব কিছু সত্ত্বেও মনে মনে রথকে ক্ষমা করতে পারত পিয়া। হয়তো ওর অনুপস্থিতিতে রথের মনে হয়ে থাকতে পারে এরকম একজন বিদেশি মেয়েকে বিয়ে করলে ভবিষ্যতে নানা রকম সমস্যা হতে পারে, তার ওপর যে বিদেশি একটানা বেশিদিন এক জায়গায় থাকেই না। সেই রকম কিছু ভেবে যদি রথ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তা হলে কি ওকে দোষ দেওয়া যায়?
এই সব ভেবে মনে মনে কিছু দিন একটু শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছিল পিয়া। কিন্তু সে ভুল ভেঙে গেল যেদিন রথের জায়গায় নতুন যে লোকটি এসেছে তার সঙ্গে আলাপ হল ওর। লোকটি বিবাহিত, বছর তিরিশেক বয়স, মোটামুটি ইংরেজি বলে। আলাপ হওয়ার খানিকক্ষণের মধ্যেই সে পিয়াকে নিয়ে গেল নদীপাড়ের সেই কাফেতে, যেখানে এক সময় নিয়মিত যেত রথ আর পিয়া। দূরে মেকঙের অন্য পাড়ে তখন সূর্য ডুবছে। লোকটি পিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে ওর মা-র সম্পর্কে নানা সহানুভূতিসূচক প্রশ্ন করতে শুরু করল। পিয়া বুঝতে পারল রথ সবকিছু বলে দিয়েছে এই লোকটিকে, বুঝতে পারল এই শহরের প্রতিটি পুরুষ এখন জানে ওর জীবনের একান্ত সব কথা; আর ওর সামনে বসা জঘন্য ঘিনঘিনে চরিত্রের এই লোকটি সেই তথ্য ব্যবহার করে আনাড়ির মতো ওকে ভুলিয়ে দে ফেলার চেষ্টা করছে।
সেখানেই ইতি। পরের সপ্তাহেই জিনিসপত্র প্যাক করে নিয়ে পিয়া চলে গেল মেকং নদীর উজানের দিকে আরও একশো কিলোমিটার দূরে, স্টাং ত্রেং শহরে। রথের ব্যবহার থেকে যে কষ্ট ও পেয়েছিল সে কষ্টের যন্ত্রণা নয়, সারা শহরের কাছে নিজের জীবনটা উদোম হয়ে যাওয়ার গ্লানিই ওকে শেষে তাড়িয়ে ছাড়ল ক্রেতি থেকে।
“কিন্তু ধাক্কা খাওয়ার আরও বাকি ছিল আমার,” পিয়া বলল।
“কী সে ধাক্কাটা?”
“সেটাও ঘটল আমি আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার পর। কয়েকজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল আমার। এরা সকলেই মহিলা, সকলেই ফিল্ড বায়োলজিস্ট। ওরা সবাই খুব হাসল আমার গল্পটা শুনে। ওদের প্রত্যেকের জীবনে কোথাও না কোথাও হুবহু এই একই রকম ঘটনা ঘটেছে। যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে সে যেন আমার নিজের জীবনের ঘটনা নয়, যেন আগে থেকে লিখে রাখা কোনও কাহিনি, যে কাহিনির চরিত্রযাপন আমাদের সকলের নিয়তি। এটাই বাস্তব, ওরা বলল আমাকে। বলল : এই রকমই হবে তোমার জীবন, জেনে রেখো। সব সময়ই দেখবে কোনও না কোনও একটা ছোট শহরে গিয়ে তোমাকে থাকতে হচ্ছে, সেখানে কথা বলার কেউ নেই, শুধু এই একটা মাত্র লোক যে কিছুটা ইংরেজি জানে। তাকে তুমি কিছু বলা মাত্রই সারা শহরে চাউর হয়ে যাবে তা। কাজেই এখন থেকে আর মুখটি কোথাও খুলো না, আর একা একা থাকতে অভ্যেস করো।”
কাঁধ ঝাঁকাল পিয়া। “তো সেটাই আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি তার পর থেকে।”
“কী?”
“একা নিজের মনে থাকার অভ্যাস করা।” চুপ করে গেল কানাই। পিয়ার গল্পটার কথা ভাবতে লাগল মনে মনে। মনে হল এ পর্যন্ত পিয়ার মধ্যেকার মানুষটাকে দেখতেই পায়নি ও। পিয়ার সংযত আত্মস্থ ভাব আর কম কথা বলার অভ্যাস কানাইকে–এমনকী নিজের কাছেও– স্বীকার করতে দেয়নি পিয়ার সত্যিকারের অসাধারণত্ব; মনে আর কল্পনায় ও যে শুধু কানাইয়ের সমকক্ষ তাই নয়, ভেতরের শক্তিতে আর হৃদয়ে ও অনেক অনেক বড় কানাইয়ের চেয়ে। ২৯৪
বোটের রেলিঙের ওপর পা তুলে পেছনের দিকে একটু হেলে বসেছিল কানাই এতক্ষণ। চেয়ারটাকে সোজা করে নিয়ে একটু এগিয়ে বসল এবার। পিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এভাবে আর আপনাকে থাকতে হবে না পিয়া। নিজের মনে একা একা কাটাতে হবে না আর।”
“কোনও সমাধান পেলেন নাকি?”
“পেয়েছি।” কিন্তু আর কিছু বলার আগেই নীচের ডেক থেকে হরেনের গলার আওয়াজ ভেসে এল। খেতে ডাকছে।