সুখের লাগিয়া
সুখ ও অর্থনীতি
১. ভূমিকা
দেশটির নাম সুখস্থান।
এ রাজ্যে ১০০ জন সুদর্শন যুবক বাস করে। এরা প্রত্যেকে বছরে ১ কোটি টাকা আয় করে। এদের ধনুর্ভঙ্গপণ যে এরা কেউ বিয়ে করবে না। তাই এদের কোনো স্ত্রী নেই। তবে তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে একজন করে চাকরানি রয়েছে। প্রতি চাকরানি বছরে ১ লাখ টাকা বেতন পায়। এ রাজ্যে আর কোনো মানুষ নেই। এ দেশে মোট জাতীয় উৎপাদ হচ্ছে ১০১ কোটি টাকা। এদের মাথাপিছু আয় হলো ৫০.৫ লাখ টাকা।
হঠাৎ এ রাজ্যে মদন দেব তশরিফ আনলেন। স্বঘোষিত চিরকুমার যুবকদের শাস্তি দেওয়ার জন্য তিনি তাদের প্রেমের বাণে বিদ্ধ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ১০০ জন যুবক তাদের নিজ নিজ চাকরানির প্রেমে পড়ে গেল ও তাদের বিয়ে করে ফেলল। চাকরানিরা বহুদিন ধরে তাদের মনিবদের আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করছিল। তাই মদন দেবের কল্যাণে বিয়ে হওয়াতে তারা মহাখুশি। তারা বিয়ের আগে যত কাজ করত, নিজের সংসারে তার চেয়ে অনেক বেশি খেদমত করে, যাতে স্বামীরা আগের চেয়ে বেশি সুখে থাকে। স্বামীরাও স্ত্রীদের যত্নে মহাসন্তুষ্ট। তারা তাদের ব্যাংকে বলে দিয়েছে যে স্ত্রীরা তাদের স্বামীর আয়ের অর্ধেক টাকা ব্যাংক থেকে মাসে মাসে তুলতে পারবে। ফলে স্ত্রীরা নিজেদের ইচ্ছমতো দেদার খরচ করছে।
রাজ্যে সবার সুখ বেড়ে গেছে। অথচ রাজ্যের সংখ্যাতত্ত্ববিদেরা বলছেন, রাজ্যে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৫০.৫ লাখ থেকে ৫০ লাখে নেমে গেছে। বিয়ে করার আগে চাকরানিরা বেতন পেত। যদিও স্ত্রী হওয়ার পর একই কাজ তারা আরও অনেক ভালোভাবে ও দরদ দিয়ে করছে, তবু তারা বেতন পায় না। তবে বেতনের চেয়ে অনেক বেশি টাকা স্বামীরা স্ত্রীদের দিচ্ছে। কিন্তু স্ত্রীকে স্বামীর দেওয়া অর্থ জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত হয় না। অথচ গৃহস্বামী চাকরানিকে যে বেতন দেয়, তা জাতীয় আয়ের অংশ। কাজেই সুখস্থান রাজ্যে চাকরানিরা গৃহস্বামীদের বিয়ে করায় রাজ্যের সকলের সুখ বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও মোট জাতীয় উৎপাদ ও মাথাপিছু আয় কমে গেছে।
ধরুন, এক বছর পর এ রাজ্যের ১০০ দম্পতি তাদের বিবাহবার্ষিকীতে নিজেদের নতুন গাড়িতে চড়ে বেড়াতে গেল। ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় ১০ জন স্ত্রী মারা যায়। ১০ জন স্বামী প্রত্যেকে একটি করে পায়ের আঙুল হারায়। আরও ২০ জন হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে যায়। সারা বছর রাজ্যের সবাই দুঃখে কাঁদে। এক বছর পর রাজ্যের সংখ্যাতত্ত্ববিদেরা জানালেন যে রাজ্যে মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে; কারণ, ১০ জন স্ত্রী মারা যাওয়াতে জনসংখ্যা কমেছে (এ সময়ে কোনো বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হয়নি) অথচ সব পুরুষ জীবিত থাকায় (ও কোম্পানি অসুস্থদের পুরো বেতন দেওয়ায়) মোট জাতীয় উৎপাদ কমেনি; বরং বেড়েছে। কেননা, হাসপাতালে মৃতদের সৎকারকারীদের এবং গাড়ি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানগুলির আয় বেড়েছে। অর্থনীতির ভোজবাজিতে মানুষের দুর্দশা বাড়লেও জাতীয় আয় বেড়ে গেল।
পরের বছর রাজ্যে গুজব রটল যে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ হলো রাস্তার ঠিকাদারদের দুর্নীতি। এতে রাজ্যে প্রচণ্ড রাজনৈতিক অসন্তোষ দেখা দিল। সেনাবাহিনী-প্রধান ক্ষমতা দখল করে নিল। সেনাবাহিনী রাজ্যের সবাইকে অতিরিক্ত রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে বাধ্য করল। রাজ্যে মাথাপিছু আয় ২০ শতাংশ বেড়ে গেল। যদিও রপ্তানি-আয়সহ রাজ্যের মোট উৎপাদের ৫০ শতাংশ সেনাপ্রধান ও তার নয়জন স্যাঙাত আত্মসাৎ করে। এর ফলে রাজ্যের ৯০ শতাংশ লোকের আয় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। তার মানে গড় আয়ের ভিত্তিতে মানুষের সুখ বেড়েছে। কিন্তু ৯০ শতাংশ লোকের মাথাপিছু আয় ও সুখ কমে গেছে। শুধু ১০ ভাগ লোকের আয় বেড়েছে। এ রাজ্যে এখন কারও পৌষ মাস আর কারও সর্বনাশ।
এভাবে দেখা গেল, সুখস্থান রাজ্যে মানুষের সুখ যখন বাড়ছে মাথাপিছু আয় তখন কমে যাচ্ছে; আর যখন দুঃখ বাড়ছে তখন মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে। এ অদ্ভুত কাণ্ড অবশ্য সুখস্থানের সর্বনেশে নিয়মকানুনের জন্য ঘটছে না। দোষ সুখস্থানের নয়, সমস্যা হলো জাতীয় আয় প্রাক্কলনের পদ্ধতিটাতেই রয়েছে অনেক ফাঁক। পৃথিবীর সব দেশেই বর্তমানে মোট জাতীয় উৎপাদের হিসাব নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। ২০০৮ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সারকোজি মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদের তাৎপর্য নিয়ে এতই সন্দিহান হয়ে পড়েন যে তিনি জীবন-কুশলতার সূচক হিসেবে জাতীয় আয়ের উপযোগিতা পরীক্ষা করে পরামর্শ দেওয়ার জন্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজের (২০০৮) নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। অমর্ত্য সেন এ কমিশনের উপদেষ্টা ছিলেন। এই কমিশন জাতীয় উৎপাদের তিনটি দুর্বলতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রথমত, সব উৎপাদ ও সেবা সঠিক মূল্যে সব সময় জাতীয় উৎপাদের অন্তর্ভুক্ত হয় না। দ্বিতীয়ত, পণ্য ও সেবা উৎপাদন করতে গিয়ে পরিবেশের অথবা সমাজের যে ক্ষতি হয় তা বিবেচনায় না নেওয়াতে জাতীয় উৎপাদের পরিমাণ অতিরঞ্জিত করা হয়। সবশেষে, জাতীয় উৎপাদের হিসেবে শুধু অর্থের পরিমাণের ওপর জোর দেওয়া হয়; কিন্তু জীবন কুশলতার মান সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। জীবনযাত্রার গুণগত মান বিশ্লেষণ করার জন্য জাতীয় উৎপাদের বিষয়-নির্ভর (objective) পরিমাপই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির মনোনির্ভর (subjective) মূল্যায়নও প্রয়োজন। স্টিগলিজ কমিশনের সুপারিশ হলো যে জীবন-কুশলতা পরিমাপ করার জন্য শুধু জাতীয় উৎপাদের হিসাব করলেই চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে ব্যক্তিদের মনোনির্ভর মূল্যায়নও বিবেচনা করতে হবে। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে মোট জাতীয় সুখ পরিমাপ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভুটান সরকার মোট জাতীয় সুখ বৃদ্ধিকে তাদের জাতীয় লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মতো শিল্পোন্নত দেশগুলিতেও সরকারের উদ্যোগে সুখ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে।
নাগরিকদের সুখ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে সম্প্রতি যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তা বিংশ শতাব্দীর মূলধারার অর্থনৈতিক তত্ত্বের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ঊনবিংশ শতকে অবশ্য উপযোগবাদী (utilitarian) দার্শনিকদের মধ্যে সুখ পরিমাপ করার জন্য প্রচণ্ড আগ্রহ দেখা গিয়েছিল । এজওয়ার্থের মতো কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ আশা করেছিলেন যে মানুষের সুখ পরিমাপক যন্ত্র (hedonometer) আবিষ্কার করাও সম্ভব হবে। (ফ্রে ও অলিয়েস ফ্রঁটজার, ২০০২)। বিশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে লায়োনেল রবিন্স ও জন হিকসের মতো অর্থনীতিবিদেরা প্রমাণ করলেন যে উপযোগ বা মানুষের হিতের ক্রমবাচক বা ordinal (কোনটা আগে ও কোনটা পরে) মূল্যায়ন সম্ভব হলেও সংখ্যাবাচক বা cardinal (তুলনামূলকভাবে কোনটি কত বেশি) মূল্যায়ন সম্ভব নয়। ব্যক্তিভেদে উপযোগের মূল্যায়নে প্রভেদ ঘটে। কাজেই একাধিক ব্যক্তির উপযোগ (যা ভিন্ন ভিন্ন) একসঙ্গে যোগ করা অযৌক্তিক। তাই ব্যক্তির সুখ সম্পর্কে গবেষণা অর্থনীতির মূল স্রোতোধারাতে পরিত্যক্ত হয়। শুধু মনস্তত্ত্ববিদেরা এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যান (ক্যায়নেম্যান, ড্যানিয়েল ও এলেন বি ক্রুগার, ২০০৬)। যদিও অর্থনীতিবিদেরা মনস্তত্ত্ববিদদের এসব গবেষণা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেন। অতি সম্প্রতি অর্থনীতিবিদেরা মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে মনস্তাত্ত্বিক উপাদানগুলির ভূমিকা সম্পর্কে ক্রমশ সজাগ হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে, ২০০২ সালে মনস্তত্ত্ববিদ ড্যানিয়েল কায়নেম্যানকে (Daniel Kahneman) অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রদানের পর সুখ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদেরা নতুন করে চিন্তাভাবনা করেছেন।
বর্তমান প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো সুখ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও মনস্তত্ত্ববিদেরা দুই দশক ধরে যেসব গবেষণা করছেন, তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা। এই বিশ্লেষণ থেকে সুখ অথবা মানুষের জীবন-কুশলতা বাড়ানোর জন্য গৃহীতব্য ব্যবস্থাগুলি চিহ্নিত করা সম্ভব। প্রবন্ধটি সাতটি খণ্ডে বিভক্ত। দ্বিতীয় খণ্ডে সুখের পরিমাপের প্রচলিত পদ্ধতির তাৎপর্য ও দুর্বলতাগুলি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে দেশভেদে সুখবোধের তারতম্য সম্পর্কে সমীক্ষার ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে। চতুর্থ খণ্ডে ব্যক্তিগত সুখ ও আয়ের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেকোনো সময়ে আয় ও সুখের মধ্যে সুস্পষ্ট ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে। অথচ সময়ের পরিসরে মাথাপিছু আয় বাড়লেও সুখ বাড়ছে না। প্রবন্ধের এই খণ্ডে এ প্রহেলিকার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পঞ্চম খণ্ডে সুখের সঙ্গে সমষ্টিগত স্থিতিশীলতার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিশেষ করে, দেখানো হয়েছে যে বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি মানুষের সুখকে প্রভাবিত করে। ষষ্ঠ খণ্ডে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সুখের সম্পর্কের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে এই নিবন্ধের বক্তব্যগুলির সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রবন্ধের মূল বক্তব্যের ভিত্তিতে মানুষের সুখ বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক নীতিমালায় কী ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন সে সম্পর্কেও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।