বিশ্বায়ন
একটি সমীক্ষা ও কয়েকটি অমীমাংসিত প্রশ্ন

১. পটভূমি

একজন রসিক ব্যক্তিকে বিশ্বায়নের উদাহরণ দিতে বলা হয়েছিল। তিনি যে উদাহরণটি দেন তা ছিল অত্যন্ত বেরসিক; কেননা, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। একটি মর্মান্তিক বিয়োগান্ত ঘটনা। তবু উদাহরণটি অত্যন্ত লাগসই। তিনি বললেন, রাজকুমারী ডায়ানার মৃত্যু বিশ্বায়নের একটি চমৎকার উদাহরণ। তাকে প্রশ্ন করা হলো যে ডায়ানার মৃত্যুর সঙ্গে বিশ্বায়নের কী মিল রয়েছে? তিনি বললেন, এ ঘটনায় একজন ইংরেজ রাজকন্যা তাঁর মিসরীয় ছেলে বন্ধুর সঙ্গে ফরাসি দেশে সুড়ঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। তারা একটি জার্মান গাড়িতে চড়ে যাচ্ছিলেন। গাড়িটির ইঞ্জিন ছিল ওলন্দাজদের তৈরি। গাড়িটি চালাচ্ছিল একজন বেলজিয়াম চালক, যে স্কচ (স্কটল্যান্ডের) হুইস্কি খেয়ে মাতাল ছিল। গাড়িটির পেছন পেছন জাপানি মোটরসাইকেলে চড়ে ছুটে আসছিল একদল ইতালিয়ান চিত্রসাংবাদিক। আহত ডায়ানার চিকিৎসা করলেন একজন মার্কিন চিকিৎসক। তিনি ব্রাজিলের তৈরি ওষুধ ব্যবহার করেন। বিল গেটসের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সংবাদ পাঠান একজন মার্কিন নাগরিক । আপনি সম্ভবত এ খবর কম্পিউটারে পড়ছেন, যাতে ব্যবহার করা হয়েছে তাইওয়ানে প্রস্তুত ‘চিপস। এই কম্পিউটারের মনিটর সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা সংযোজন করে। এটি বহন করে আনছিল ভারতীয় লরিচালকেরা। পথিমধ্যে ইন্দোনেশীয় জলদস্যুরা লুট করে। এ মাল নামিয়ে আনে সিসিলির নাবিকেরা। জাহাজ থেকে ট্রাকে করে এ মাল বহন করে আনে মেক্সিকোর বেআইনি অভিবাসীরা। এই হলো বিশ্বায়নের উদাহরণ। বর্ণনাটি সর্বাংশে সত্য না হলেও হরহামেশা এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ছোট এই সংবাদটিতে কমপক্ষে জড়িয়ে রয়েছে ১৪টি দেশের মানুষ। এই খবর যখন ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তখন প্রায় ২০০টি দেশে মাতম শুরু হয়। মৃত্যুর পর ডায়ানা যত লোকের আবেগমিশ্রিত সম্মান লাভ করেন, তার অতি ক্ষুদ্র অংশও ট্রয়ের হেলেন, মিসরের ক্লিওপেট্রা বা ভারতের মমতাজ মহলের কপালে জোটেনি। তারও একটি বড় কারণ হলো বিশ্বায়ন।

বিশ্বায়ন শব্দটি ইংরেজি Globalization শব্দের বাংলা রূপান্তর । Globalization শব্দটি চয়ন করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা অনুষদের অধ্যাপক থিয়োডর লেভিট (Theodore Levitt)।১৯৮৩ সালে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ’তে তিনি ‘The Globalization of Markets’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে কারিগরি পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী ভোক্তারা সমরূপ হয়ে উঠছে। তাই সাংস্কৃতিক ভিন্নতা সত্ত্বেও সারা পৃথিবীতে পণ্যের বাজার বিশ্বায়িত হচ্ছে। বিংশ শতকের শেষ দুই দশকে বিশ্বায়নের ধারণা অর্থনীতি থেকে সংস্কৃতি, পণ্য বিপণন থেকে রাজনীতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

বিশ্বায়ন শব্দটির প্রচলন বিংশ শতকের শেষ পাদে হলেও, প্রক্রিয়াটির জন্ম হয়েছে অনেক আগে। কেউ কেউ বলেন, ১৪৯২ সালে কলম্বাসের আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, কলম্বাসের অনেক আগেই বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়ার জন্ম হয়েছে। এঁদের মতে, বিশ্বায়নের উৎস খুঁজতে হবে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে যখন ‘রেশম সড়ক দিয়ে চীনের সঙ্গে ভারত, পারস্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্য শুরু হয়। ভেদি মরু-পথ গিরিপর্বত যে দুঃসাহসী বণিকেরা তাদের ব্যবসা পরিচালনা করেছেন, তাঁরাই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার স্রষ্টা। যারা এ মতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন, তাঁরা বলছেন যে কলম্বাসের অভিযানের আগে বিশ্বের দুটি মহাদেশের অস্তিত্ব সম্পর্কে পুরোনো জগতের লোকেরা আদৌ জানত না। বিশ্বকে জানার আগে বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে–এ অনুমান সঠিক নয়।

কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার শুধু ভূগোলের আয়তন ও জ্ঞানের পরিধিই বাড়ায়নি; এই ঘটনা মানুষের ইতিহাসে বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিনিময়ের এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এ ঘটনা ইতিহাসে কলম্বিয়ান বিনিময় বা Columbian Exchange নামে পরিচিত। দুজন অর্থনীতিবিদের মতে, এ বিনিময়ের তিনটি উপাদান রয়েছে–Diseases, Food and Ideas-ব্যাধি, খাদ্য ও ধ্যানধারণা (নাথান নান ও ন্যান্সি কিয়ান, ২০১০, ১৬৩)।

পুরোনো দুনিয়া থেকে যে মানুষেরা নতুন ভূখণ্ডে আসে, তারা নতুন দুনিয়াতে নিয়ে এল পুরোনো দুনিয়ার রোগবালাই, জীবাণু আর ভাইরাস। ইউরোপিয়ানরা আমেরিকাতে আসার আগে আমেরিকার দুটি মহাদেশে গুটিবসন্ত ছিল না, কারও হাম হতো না, জলবসন্ত ছিল অজানা, কারও ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাস বা টাইফয়েড হতো না, ডিপথেরিয়া ছিল না। ছিল না কলেরা, দ্রুত সংক্রামক প্লেগ, আরক্ত জ্বর, ঘুংড়ি কাশি বা হুপিং কাশি ও ম্যালেরিয়া। যেহেতু এসব রোগ আমেরিকাতে তখন পর্যন্ত দেখা যায়নি, সেহেতু এসব রোগের ক্ষেত্রে স্থানীয় অধিবাসীদের কোনো প্রতিরোধক্ষমতাই ছিল না। পুরোনো জগতের মানুষের সঙ্গে এসব রোগ আমেরিকায় এল । রোগগুলো অতি দ্রুতবেগে আমেরিকার দুটি মহাদেশেই ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মৃত্যুর হার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। আমেরিকার পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ ও আমেরিকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সহিংস লড়াইয়ের ছায়াছবি দেখে অনেকেই মনে করেন যে ইউরোপিয়ানরা আদিবাসীদের গুলি করে হত্যা করেছে। এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই কোথাও কোথাও ঘটেছে, তবে অস্ত্রের আঘাতে অতি অল্পসংখ্যক রেড ইন্ডিয়ান মরেছে, বেশির ভাগ মৃত্যুর কারণ হলো পুরোনো দুনিয়া থেকে আমদানিকৃত রোগ ও মহামারি। জেরেদ ডায়মন্ড (১৯৯৯, ২১০) এ প্রসঙ্গে যথার্থই লিখেছেন, ‘Far more Native Americans died in bed from Eurasian germs than on the battlefield from European guns and swords. (যুদ্ধক্ষেত্রে ইউরোপিয়ানদের বন্দুক ও অস্ত্রের আঘাতে যত আদিবাসী আমেরিকান মারা গেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বিছানায় শুয়ে ইউরেশীয় জীবাণু সংক্রমণে মরেছে)। এ অনুমান মোটেও ঠিক নয় যে ইউরোপিয়ানদের আবির্ভাবের আগে আমেরিকা একটি জনবিরল শূন্যভূমি ছিল। কলম্বাস আসার আগে আমেরিকাতে আদিবাসীর সংখ্যা কত ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তবে জনসংখ্যার সর্বনিম্ন প্রাক্কলন হচ্ছে ৮০ লাখ আর সর্বোচ্চ প্রাক্কলন অনুসারে কলম্বাস-পূর্ব আমেরিকাতে ১১ কোটি লোক বাস করত। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে ইংল্যান্ডে এ সময়ে মোট জনসংখ্যা ছিল ২০ থেকে ২৫ লাখ এবং সে হিসাবে ৮০ লাখ জনসংখ্যাও নেহাত ফেলনা নয়। ১৪৯২ সালে আমেরিকা আবিষ্কারের ১০০ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে নতুন রোগবালাইয়ে ৮০ থেকে ৯৫ ভাগ আদিবাসী আমেরিকান মারা যায়। আমেরিকার দুটি মহাদেশ প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে।

পুরোনো দুনিয়া নতুন দুনিয়াতে এত রোগ ছড়ালেও নতুন দুনিয়া পুরোনো জগতে, মাত্র একটি রোগ পাঠিয়েছিল। এই রোগটি হলো সিফিলিস। স্পেনের নাবিকেরা প্রথমে এ রোগ ইউরোপে ছড়ায়। আমেরিকা আবিষ্কারের ১০ বছরের মধ্যেই সিফিলিস ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যে, আফ্রিকা ও ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে ইউরোপে সিফিলিসে আক্রান্ত রোগীরা অল্পদিনের মধ্যে মারা যেত। কিন্তু পুরোনো জগতের মানুষেরা শরীরে সিফিলিসের দ্রুত বিস্তৃতি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্জন করে। এতে রোগের প্রসার না কমানো গেলেও সিফিলিসে মৃত্যুর হার হ্রাস পায়। তাই প্রাচীন জগতের জনসংখ্যা পরিবর্তনে নতুন জগতের রপ্তানিকৃত জীবাণুর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নগণ্য।

বিনিময় শুধু জীবাণুতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। নতুন ও পুরোনো দুনিয়ার মধ্যে শস্যের বীজ ও গৃহপালিত পশুর বিনিময়ও ঘটেছে। এ বিনিময়ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে পুরোনো দুনিয়া বা এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা। আমেরিকা থেকে চারটি প্রধান খাদ্য শস্যের বীজ আসে। শস্য চারটি হচ্ছে : গোল আলু, মিষ্টি আলু, ভুট্টা ও কাসাভা। এই চারটি ফসলের বড় আকর্ষণ হচ্ছে যে এরা প্রান্তিক বা অপেক্ষাকৃত অনুর্বর জমিতে ফলে। আলু আয়ারল্যান্ডে প্রধান খাদ্যশস্যে পরিণত হয়। প্রাচীন জগতের সর্বত্র আলু ক্রমবর্ধনশীল জনসংখ্যার জন্য বাড়তি পুষ্টির জোগান দেয়। কৃষির ঐতিহাসিক এরিক জোনসের (১৯৮৮, ১৪৩) মতে, চীনের শুষ্ক অঞ্চলে নতুন দুনিয়া থেকে আমদানিকৃত ভুট্টা চাষের ফলেই চীনে বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের সরবরাহ সম্ভব হয়েছে। ভুট্টা শুধু চীন, ভারত বা পাকিস্তানের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়; আফ্রিকাতে কেনিয়া, লেসোথো, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ের মতো অনেক দেশ খাদ্যের জন্য ভুট্টার ওপর নির্ভরশীল। কাসাভার শেকড় আফ্রিকা মহাদেশে একটি প্রধান খাদ্যশস্য। আলু, ভুট্টা ও কাসাভা চাষ করার ফলেই পুরোনো দুনিয়াতে ৩০০ বছর ধরে দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান সম্ভব হয়েছে। উপরুন্তু রোগবালাইয়ে শূন্য হয়ে যাওয়া নতুন দুনিয়াতে বাড়তি জনসংখ্যা পাঠানোর ফলে খাদ্য উৎপাদনের জন্য পুরোনো জগতে জমির ঘাটতি মেটানো সম্ভব হয়েছে।

নতুন দুনিয়াতে পুরোনো জগৎ থেকে অনেক গৃহপালিত পশু আনা হয়। আমেরিকাতে প্রাক-কলম্বাস যুগে অতি স্বল্প-সংখ্যক গৃহপালিত জন্তু (যথা আলপাকা, গিনিপিগ, লামা ও টার্কি ছিল, যাদের অর্থনৈতিক ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। অথচ পুরোনো বিশ্ব থেকে আমেরিকাতে গরু ছাগল, হাঁস মোরগ, ঘোড়া, উট, শূকর, ভেড়া, মৌমাছি ও বিড়াল আমদানি করা হয়। তেমনি আনা হয় ধান, গম, যব, কলা, ইক্ষু থেকে শুরু করে নানান জাতের ফল ও সবজি। তবে এগুলি আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের উপকৃত করেনি। এসব পণ্য পুরোনো জগতের অভিবাসীদের ভোগে লেগেছে অথবা তারা এসব পণ্য পুরোনো জগতে রপ্তানি করে অর্থ কামিয়েছে।

নতুন দুনিয়া শুধু পুরোনো দুনিয়াতে খাদ্যের পরিমাণই বাড়ায়নি, খাদ্যের বৈচিত্র্যও বাড়িয়েছে। এশিয়া মহাদেশ, আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জন্য নতুন দুনিয়ার একটি বড় সওগাত হলো মরিচ। ষোড়শ শতকের আগে দক্ষিণ এশিয়াতে মরিচ ছিল অজানা। তরকারিতে ঝাল দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো গোলমরিচ। ঐতিহাসিকেরা বলছেন, ভারতে প্রথম মরিচ আসে ১৫৪২ সালে অর্থাৎ শের শাহের রাজত্বকালে (১৫৪০-৪৫)। তবে মরিচের ব্যবহার ভারতে রাতারাতি ছড়িয়ে পড়েনি। সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) সভাসদ আবুল ফজল (১৯৯৭, ১ম খণ্ড, ৬১-৬৮) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আইন-ই আকবরীতে বাদশাহের প্রিয় খাদ্যের রন্ধনপ্রণালি সম্পর্কে বিশদ তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু তাতে কোথাও মরিচের উল্লেখ নেই। যেমন ধরুন, বাদশাহের জন্য শাকের রন্ধনপ্রণালি ছিল নিম্নরূপ : ১০ সের পালং শাক, দেড় সের ঘি, এক সের পেঁয়াজ, আধা সের টাটকা আদা, সাড়ে পাঁচ মাশা (প্রায় আধা তোলা) গোলমরিচ ও অর্ধেক মাশা (১/২৪ তোলা) এলাচি দারুচিনি। দেখা যাচ্ছে বাদশাহ ঝাল শাক পছন্দ করতেন। কিন্তু গোলমরিচ দিয়ে শাক ঝাল করতে হতো। বাদশাহি হেঁশেলে তখন মরিচ ঢোকেনি। মরিচ ব্যবহার তাই সম্ভব ছিল না। আইন-ই আকবরীতে বর্ণিত কোনো খাদ্যেই মরিচ দেওয়া হতো না। এতে মনে হয় যে যখন আইন-ই আকবরী লেখা শেষ হয় (১৫৯৮) তখন পর্যন্ত মরিচের কদর ছিল সীমিত। সম্ভবত দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে মরিচের জয়যাত্রা শুরু হয় সপ্তদশ শতকে। এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মরিচ উৎপাদিত হয় ভারতে। দ্বিতীয় স্থান চীনের, তৃতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তান আর চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আজ মনে হয় মরিচ ছাড়া বাঙালি রান্না অসম্ভব। অথচ ষোড়শ শতক পর্যন্ত বাঙালিদের পূর্বপুরুষদের মরিচ ছাড়াই খাদ্য গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। খাদ্যে নতুন জগতের আরেকটি বড় অবদান হলো টমেটো। বাঙালি রন্ধনে এর ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে বিংশ শতাব্দীতে। নতুন জগৎ থেকে আমদানিকৃত ফলের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে পেঁপে, আনারস ও পেয়ারা। রবার ও কুইনাইনের মতো অত্যাবশ্যক পণ্য এসেছে আমেরিকা থেকে।

নতুন জগৎ পুরোনো দুনিয়াকে মাত্র দুটি খারাপ জিনিস দিয়েছে। একটি সিফিলিস, আরেকটি তামাক। সিফিলিসের সমস্যা বোধগম্য কারণে লুকিয়ে রাখা হয়। আর তামাকের ক্ষতিকর দিক এখনো সবাই বুঝে উঠতে পারেনি। পুরোনো দুনিয়ার মানুষেরা আমেরিকাতে অনেক লুটপাট করেছে এবং অনেক আদিবাসীকে খুন করেছে। তবে এসব খুনোখুনি প্রাচীন জগতের ইতিহাসেও অনেক ঘটেছে। নতুন জগতের সবচেয়ে মারাত্মক দুষ্কর্ম হলো অজানিতে রোগজীবাণু পাচার। এতে যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনো দিনই পূরণ করা যাবে না। বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়ার এই প্রথম পর্বে পুরোনো জগতের একটি অংশও আমেরিকার মতো মর্মান্তিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নতুন জগতে ফসল, বিশেষ করে ইক্ষু উৎপাদনের জন্য আফ্রিকা থেকে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে আসা হয় দাসদের।

ঘোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বিশ্বায়নের এই প্রথম অঙ্ক অভিনীত হয়। এর লাভ-ক্ষতি হিসাব করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ডেভিড এস ল্যান্ডেজ (১৯৯৮, ১৭০) লিখেছেন, ‘Oceanic migrations, then voluntary and involuntary [slaves] brought much death into the world and much woe. But also riches and opportunities for the Europeans, whether leavers or stayers. (সমুদ্র অতিক্রম করে অভিবাসন, যার কিছুটা ছিল স্বেচ্ছায় আর কিছুটা ছিল অনৈচ্ছিক (দাস), পৃথিবীতে অনেক মৃত্যু ও দুঃখ বয়ে আনে। সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসী ও অনভিবাসী ইউরোপিয়ানদের জন্য নিয়ে আসে ধনসম্পদ ও সুযোগ।)। তবে যা ঘটেছে। তার সবটাই পরিকল্পিত ছিল না। অনেক কিছু ঘটেছে যা আগে থেকে চিন্তা করাও সম্ভব ছিল না।

বিশ্বায়নের ইতিহাস তিনটি স্তরে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথম পর্যায়ের শুরু ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে কলম্বাসের নতুন দুনিয়া আবিষ্কার থেকে। মোটামুটিভাবে এই পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে ১৭০০ সালে। প্রায় ২০০ বছর ধরে নতুন ও পুরোনো পৃথিবীর মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংঘর্ষে উত্তর ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ডে বিশ্বের প্রথম শিল্প বিপ্লবের সূচনা ঘটে। শিল্প বিপ্লবের যে বীজ বিশ্বায়নের প্রথম পর্যায়ে অঙ্কুরিত হয় দ্বিতীয় পর্যায়ে তাই প্রস্ফুটিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের সময়সীমা হিসেবে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮৯ বা তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবলুপ্তি পর্যন্ত সময়কালকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এই সময়ের ইতিহাসে তিন ধরনের প্রবণতা লক্ষণীয়। প্রথমত, অভূতপূর্ব উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলিতে মাথাপিছু আয়ের নাটকীয় বৃদ্ধি ঘটে। এর ফলে উন্নত দেশগুলিতে বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানে অসাধারণ অগ্রগতি দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও ক্রমবৃদ্ধিশীল ধনবৈষম্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়। তৃতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের আর দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এসব দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য কোনো কাঠামো গড়ে ওঠেনি।

সারণি ৮.১-এ ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত সময়কালে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলিতে মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধির প্রবণতাগুলি দেখা যাবে।

সারণি ৮.১
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির প্রবণতা
খ্রিষ্টাব্দ বর্তমানে উন্নত দেশগুলির মাথাপিছু আয় (১৯৯০ সালের আন্তর্জাতিক ডলারে) বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলির মাথাপিছু আয় (১৯৯০ সালের আন্তর্জাতিক ডলারে) উন্নত দেশগুলির মাথাপিছু আয়/উন্নয়নশীল দেশগুলির মাথাপিছু আয়
১০০০ ৪০৫ ৪২৯

০.৯৪৪

১৫০০ ৭০৪ ৫৩৫

১.৩১৫

১৬০০ ৮০৫ ৫৪৮

১.৪৬৮

১৭০০ ৩০২ ৫৫১

১.৬৩৭

১৮২০ ১১৩০ ৫৭৩

১.৯৭২

১৯৯৮ ২১৪৭০ ৩১০২

৬.৯২১

উৎস: অ্যাংগাস ম্যাডিসন (২০০০, ৪৬)

দ্রষ্টব্য :

  • উন্নত দেশের মধ্যে রয়েছে পশ্চিম ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও জাপান।
  • উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে রয়েছে জাপান বাদে এশিয়া, আফ্রিকার, ল্যাটিন আমেরিকার সব দেশ এবং রাশিয়াসহ সমগ্র পূর্ব ইউরোপ।

সারণি ৮.১ থেকে দেখা যাচ্ছে, কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কারের আগে আজকের উন্নয়নশীল দেশগুলির মাথাপিছু আয় বর্তমানে উন্নত দেশগুলির মাথাপিছু আয়ের চেয়ে গড়ে প্রায় ৫.৬ শতাংশ বেশি ছিল। ষোড়শ শতকের গোড়াতেই এই প্রবণতা উল্টে যায়। ফলে উন্নত দেশগুলির মাথাপিছু আয় বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলির মাথাপিছু আয় ছাড়িয়ে যায়। ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে উন্নত দেশগুলিতে মাথাপিছু আয় বাড়ে ২৭৯ শতাংশ। একই সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে মাথাপিছু আয় বেড়েছে মাত্র ৩৩.৫ শতাংশ। অথচ ১৮২০ থেকে ১৯৯৮ সময়কালে উন্নত দেশগুলিতে মাথাপিছু আয় বাড়ে ১৯০০ শতাংশ; উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বাড়ে মাত্র ৭২৩ শতাংশ। উপরিউক্ত সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে যে যদিও ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের পর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির প্রবণতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তবে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে আজকের উন্নত দেশগুলির প্রবৃদ্ধির হার পূর্ববর্তীকালের তুলনায় দ্রুত হলেও পরবর্তীকালের তুলনায় ছিল শ্লথ । ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের পর এ প্রবৃদ্ধির হার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। নতুন দুনিয়া হতে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে লুষ্ঠিত সম্পদ (যার পরিমাণ অ্যাংগাস ম্যাডিসনের মতে, ২ হাজার ৭০৮ টন সোনা ও ৭২ হাজার ৮২৫ টন রুপা) ও উপনিবেশগুলি থেকে অর্থ পাচার এ প্রক্রিয়াকে সহায়তা করলেও এর মূল চালিকা শক্তি ছিল কারিগরি পরিবর্তন ও পুঁজিবাদী-ব্যবস্থার উদ্ভব। এই পর্যায়ে উৎপাদনশীলতার অসাধারণ বৃদ্ধিই ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ের উৎপাদনশীলতা মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলসের মতো সমাজবিজ্ঞানীকেও অভিভূত করে। ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁরা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে লিখলেন, It has been the first to show what man’s activity can bring about.’ (বুর্জোয়া সভ্যতা প্রথম দেখাল মানুষ কত বড় বড় কাজ করতে পারে।)। ১৮৪৮ সালে যে উৎপাদনশীলতা ছিল অচিন্তনীয়, আজ তা বাস্তব। পুঁজিবাদী-ব্যবস্থার সৃজনশীলতার অতি ক্ষুদ্র অংশ মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলস তাদের জীবদ্দশায় দেখতে পেয়েছেন। তবু তারা সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার আত্মঘাতী প্রবণতা রয়েছে। উপরন্তু মার্ক্সের উত্তরসূরিরা আরও বললেন যে পুঁজিবাদী সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ। মুষ্টিমেয় দেশ বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে শোষণের নাগপাশে আবদ্ধ করে রেখেছে। তারা ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলি পুঁজিবাদের অবসান ঘটাবে।

মার্ক্সের অনুসারীদের কোনো কোনো অনুমান সঠিক প্রমাণিত হলেও তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী ধোপে টেকেনি। উপনিবেশ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির লড়াই ছিল অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান চালিকা শক্তি। এই পর্যায়ে দুই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। প্রথমত, মাথাপিছু আয়ের পরিমাপে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলির বৈষম্য ক্রমেই বাড়তে থাকে। তাই অনুমান করা হয় যে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ফলে এই ব্যবধান বেড়েই চলেছে। আর দীর্ঘ মেয়াদে উন্নয়নশীল দেশগুলি এই শোষণ ও বঞ্চনার বিপক্ষে বিদ্রোহ করবে।

দ্বিতীয়ত, রাশিয়া ও চীনের মতো দেশগুলিতে সর্বহারাদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আশা করা হচ্ছিল যে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পুঁজিবাদ হেরে যাবে। প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের অবসানে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলির মধ্যে মুরুব্বি-মক্কেল সম্পর্কের (patron client relationship) কাঠামো ভেঙে পড়বে। আশা করা হচ্ছিল যে বিশ্বে পুঁজিবাদের অবসান হবে।

বাস্তবে তার উল্টোটা ঘটল। পুঁজিবাদী দেশগুলিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হলো। অন্যদিকে ১৯৮৯ সালে জনতার রুদ্ররোষে বার্লিন নগরে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির সীমানাপ্রাচীর ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধসে পড়ে। পুঁজিবাদের নিরঙ্কুশ বিজয় ঘোষণা করে এককালীন মার্ক্সিস্ট তত্ত্ববিদ মেঘনাদ দেশাই (২০০২, ৩০৩) লিখলেন, ‘There is no rival mode of production on the horizon as a viable alternative. Capitalism is the only game in the town.’ (সম্ভবপর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে [আমাদের চিন্তার] দিগন্তে আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী উৎপাদন-ব্যবস্থা নেই। পুঁজিবাদই হচ্ছে শহরে [অর্থাৎ আমাদের ভুবনে] একমাত্র খেলা)।

পুঁজিবাদের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৯০-এর দশক থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি নতুন কাঠামো গড়ে ওঠে। এই কাঠামো বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্থলে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে। নাটকীয় কারিগরি পরিবর্তন দূরকে নিকট করে এবং সারা বিশ্বকে সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ করে। শুরু হয় বিশ্বায়নের তৃতীয় পর্ব। বস্তুত, আগের পর্যায়ে বিশ্বায়ন শব্দটি ব্যবহার করা হতো না, বিশ্বায়নের স্থলে বলা হতো আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বা international economy। বিশ্বায়ন বা Globalization শব্দটি ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ব্যবহার করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক থিয়োডর লেভিট (১৯৮৩)।