ভূমিকা

বিংশ শতাব্দী অর্থনীতির দিগ্বিজয়ের যুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীতেও অর্থনীতি ছিল সমাজবিজ্ঞানের দুয়োরানি। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উনবিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবী কার্লাইল অর্থনীতির নাম দিয়েছিলেন dismal science বা হতাশাগ্রস্ত বিজ্ঞান। রিকার্ডো ও ম্যালথুসের ভুবনে অর্থনীতির লৌহকঠিন নিগড়ে শৃঙ্খলিত জীবনযাত্রায় অগ্রগতির স্বপ্ন ছিল একটি আলেয়া। এমনকি উৎপাদনশীলতার নাটকীয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা উপলব্ধি সত্ত্বেও কার্ল মার্ক্স পুঁজিবাদীব্যবস্থার ধ্বংসের দুঃস্বপ্নে ছিলেন বিভোর। বিংশ শতাব্দীর অর্থনীতিবিদেরাই প্রথম মানুষের অপরিসীম অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তুলে ধরেন এবং ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির প্রহেলিকাসমূহের সমাধানের উদ্যোগ নেন। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে মাথাপিছু আয়ের অব্যাহত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতি সমাজবিজ্ঞানে সম্রাজ্ঞীর আসনে অধিষ্ঠিত হলো। অর্থনীতি শুধু রুটি-রোজগারের ও চাহিদা-জোগানের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকল না। অর্থনৈতিক পদ্ধতি সব ধরনের সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণে ছড়িয়ে পড়ল। এতেই শুরু হলো অর্থনীতির দিগ্বিজয়।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদদের অবদানের ক্ষেত্র বিশ্লেষণ করলে এ পরিবর্তনের প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য নোবেল স্মারক পুরস্কার প্রদান শুরু করে। ২০১২ সাল পর্যন্ত ৪৪ বার এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। একই পুরস্কার একাধিক ব্যক্তিকে দেওয়ার ফলে এখন পর্যন্ত ৭১ জন সমাজবিজ্ঞানী অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে ১২ জন রয়েছেন, যারা অর্থনৈতিক সূত্র অর্থনীতির বাইরে অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানে প্রয়োগ করেছেন অথবা অর্থনীতির সঙ্গে অন্য সমাজবিজ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এদের মধ্যে চারজন আদৌ অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। হারবার্ট এ সাইমন ছিলেন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, ড্যানিয়েল ক্যায়নেম্যান একজন মনস্তত্ত্ববিদ, রবার্ট আউম্যান হচ্ছেন গণিত বিশারদ ও এলিনর অস্ট্রম ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। রবার্ট ফগেল ও ডগলাস নর্থ ইতিহাসে অর্থনৈতিক তত্ত্বের সার্থক প্রয়োগ করেছেন; সমাজতাত্ত্বিক সমস্যা বিশ্লেষণে অর্থনীতিবিদ গ্যারি এস বেকার অসাধারণ সৃজনশীলতা দেখিয়েছেন; অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন রবার্ট আউম্যান ও টমাস সি শেলিং; আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রেখেছেন জেমস বুকানন ও রোনাল্ড কোস, অর্থনৈতিক সংগঠন নিয়ে কাজ করেছেন অলিভার উইলিয়ামসন, এলিনর অস্ট্রম ও হারবার্ট সাইমন। মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতিতে অবদান রেখেছেন ভারনন এল স্মিথ ও ড্যানিয়েল ক্যায়নেম্যান। এর বাইরে তথ্য অর্থনীতি বিমা, স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন খাতে নতুন আলোকপাত করেছে। এ বিষয়ে আরও পাঁচজন অর্থনীতিবিদকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে (স্টিগলিজ, আকেরলফ, স্পেন্স, ভিকরি ও মিরলেস)। এখনো নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি, এমন অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পদ্ধতি প্রয়োগের কাজ চলছে। ধর্ম থেকে পরিবেশ, কারিগরি পরিবর্তন থেকে নৃতত্ত্ব–সর্বত্র অর্থনীতির বিজয় পতাকা উড়ছে। ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

দুর্ভাগ্যবশত অর্থনীতির এসব অর্জন বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে এখনো অনেক ক্ষেত্রেই পৌঁছায়নি। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাংলায় অনেক প্রবাদপ্রতিম অর্থনীতিবিদ জন্মগ্রহণ করেছেন। তবে এঁরা (সম্ভবত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মোহে) বাংলা ভাষায় লেখার তাগিদ অনুভব করেননি। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষায় অর্থনৈতিক পরিভাষার দৈন্য রয়েছে। তৃতীয়ত, জন্মগতভাবে বাঙালিরা বামপন্থী। বাংলায় অর্থনীতি নিয়ে যা প্রকাশিত হয়, তার সিংহভাগই হচ্ছে রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে ডান-বামের তরজা আর খিস্তি-খেউর। আজ যাকে মূল ধারার অর্থনীতি বলা হয় সে সম্পর্কে বাংলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নেহাত অপ্রতুল।

১৯৭৩ সালে কানাডার কুইনস বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু করি। তখন থেকেই নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্বসমূহের বাংলায় উপস্থাপনের তাগিদ অনুভব করছিলাম। তবে সময় করে উঠতে পারিনি। যখন কাজটি হাতে নিলাম, তখন শারীরিক বিভিন্ন অসামর্থ্য দেখা দিয়েছে। পরিকল্পনা অনুসারে অর্থনীতির নতুন তথ্যসমূহ উপস্থাপনের জন্য ২৫ থেকে ৩০টি প্রবন্ধ লিখতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কাজ কত দিনে বা আদৌ সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে কি না জানি না। আংশিক যতটুকু করতে পেরেছি, তা এ বইয়ে উপস্থাপিত হলো। ভবিষ্যতে সময় ও সুযোগ পেলে এ বিষয়ে আরও লেখার ইচ্ছে রয়েছে।

এ সংকলনে ১০টি প্রবন্ধ রয়েছে। বিষয়বস্তু অনুসারে প্রবন্ধগুলো পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। তিনটি প্রবন্ধের বিষয় হচ্ছে অনভিপ্রেত পরিণামের (unintended consequences) অর্থনীতি। কবিগুরুর ভাষায়, অনভিপ্রেত পরিণামের নির্যাস হচ্ছে, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।’ এ ঘটনা অর্থনীতিতে হরহামেশাই ঘটছে। এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আনুষ্ঠানিক গবেষণা করেছেন তরুণ মার্কিন অর্থনীতিবিদ স্টিভেন ডি লেভিট। তিনি স্টিফেন জে ডুবনারের সহযোগিতা নিয়ে Freakonomics ও Superfreakonomics নামে দুটি বই লিখেছেন। গ্রন্থ দুটি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে অনভিপ্রেত পরিণামের বিশদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’ শীর্ষক নিবন্ধে। একই ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ‘মিত্রপক্ষের গুলি’ নিবন্ধে। লেভিট ও ডুবনার অনভিপ্রেত পরিণামের নজির দেখিয়েছেন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। মিত্রপক্ষের গুলির পটভূমি আরও বিস্তৃত। এখানে অনভিপ্রেত পরিণামের উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সরকারি অর্থের অপচয় নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ যুক্ত হয়েছে। প্রবন্ধটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে। প্রবন্ধটিতে অপচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণের বাস্তব ও দার্শনিক সমস্যাসমূহ এবং অপচয়রোধের ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

বিশ্বায়ন নিয়ে দুটি প্রবন্ধ রয়েছে এ সংকলনে। একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে বিশ্বায়নের ইতিহাস ও অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিশ্বায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যা এখনো অসম্পূর্ণ। তাই বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়সমূহও তুলে ধরা হয়েছে। একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে বিশ্বায়নের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

শিল্প বিপ্লবের অনেক আগে থেকেই সমাজবিজ্ঞানীরা মানুষের জীবনে সুখের ভূমিকা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। আদি পর্যায়ে অর্থনীতিবিদেরা মানুষের সুখ পরিমাপের চেষ্টা করলেও নব্য ধ্রুপদি অর্থনীতির আত্মপ্রকাশের পর অর্থনীতিতে সুখ বিষয়টি নির্বাসিত হয়েছে। অতিসম্প্রতি সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে সুখ সম্পর্কে অনেক বিতর্ক চলছে। এই প্রসঙ্গে সুখ ও অর্থনীতির সম্পর্ক নিয়ে গবেষণাসমূহের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ উপস্থাপিত হয়েছে।

গত চার দশকে তথ্য অর্থনীতি, বাজারব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের দীর্ঘ দিন ধরে লালিত অনেক ধারণাকে নাড়া দিয়েছে। ‘সুকতলার অর্থনীতি ও জুতার রাজনীতি’ শীর্ষক নিবন্ধে তথ্য অর্থনীতির মৌলিক অবদানসমূহ পর্যালোচনা করা হয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত সত্যের সন্ধান করছেন। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই সত্য আর মিথ্যার ফারাক করা অত্যন্ত শক্ত। ‘ভেগোলজি ও অর্থনীতি : না সত্য মিথ্যা’ শীর্ষক নিবন্ধে অর্থনীতির পদ্ধতিগত দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। জন্মদিনের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে একটি প্রবন্ধ রয়েছে এ সংকলনে। এতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে বিভিন্ন মিথ্যা প্রচারণার ভিত্তিতে বাজার গড়ে ওঠে।

সবশেষে এই বইয়ে বাংলাদেশে সিভিল সমাজ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ রয়েছে। এখানে সিভিল সমাজ সম্পর্কে তাত্ত্বিক কাঠামোর আলোকে বাংলাদেশের সিভিল সমাজের অনন্যতা ও দুর্বলতাসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রায় দুই বছর ধরে বইটি লেখা হয়েছে। এ সময়ে অনেক শুভানুধ্যায়ী ও আত্মীয়স্বজন আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাঁদের সবার সাহায্য ছাড়া কাজটি সমাপ্ত করা সম্ভব হতো না। আমার শাশুড়ি জাহানারা রহমান, আমার সহধর্মিণী হামীম খান ও আমার মেয়ে নেহরীন খান বইটি লেখার জন্য আমাকে উৎসাহিত করেছেন ও নানাভাবে সহায়তা করেছেন। আমার ছোট ভাই জি এম জিয়াউদ্দিন খান বইটি লেখার সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছে ও বইটির প্রুফ দেখতে সাহায্য করেছে। আরেক ছোট ভাই কবীর উদ্দিন খান অনেক সাংসারিক ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়ে বইটি লেখার কাজ সহজ করেছেন। সুদূর আমেরিকা থেকে ডক্টর এহসানুর রহমান (ভাইয়া), বীণা আপা ও সেলিম ভাই (জনাব এ কে এন আহমেদ) নানাভাবে সহায়তা করেছেন ও উৎসাহ দিয়েছেন। এদের সবার কাছে আমার ঋণের সীমা নেই।

এই মুহূর্তে বিশেষভাবে স্মরণ করি আমার সদ্য প্রয়াত খালাতো ভাই সাইদুর রহমান সাচ্চুকে, যে আমার শারীরিক অসামর্থ্যকে সহনীয় করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছে। সব সময় হাসিমুখে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ জানাই আতাউল মাসুদ, গোলাম হোসেন, আহমদ আলি, জিয়াউল আনসার ও ফরহাদ উল্লাহ পেরুকে। বইটি লেখার কাজ অনেকাংশে সহজ করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের পরিচালক মামুনুর রশীদকে জানাই বিশেষ কৃতজ্ঞতা। আমার শিক্ষকতা-সহায়ক চন্দন রায় কম্পিউটারের কাজে নানাভাবে সহায়তা করেছে। তাকে ধন্যবাদ জানাই।

বইটি প্রকাশনার ব্যাপারে প্রথমার পক্ষ থেকে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন মতিউর রহমান ও সাজ্জাদ শরিফ। তাদের ধন্যবাদ জানাই। বইটি প্রকাশনায় বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন জাফর আহমদ রাশেদ ও তার সহকর্মীরা। তাঁদের জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

গুলশান, ঢাকা আকবর আলি খান

ডিসেম্বর ২০১২