সরকারের অপচয়
রাজনৈতিক অর্থনীতি

১. ভূমিকা

প্রখ্যাত মার্কিন রসিক উইল রজার্সকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তিনি কীভাবে এত মজার মজার ঘটনা খুঁজে বের করেন। উইল রজার্স জবাব দেন, কাজটি খুবই সোজা; আমার কিছুই করতে হয় না। যা করার সরকার তার লোকলস্কর নিয়ে নিজেই করে। আমি শুধু সরকারের কাজ পর্যবেক্ষণ করি। তারপর বিন্দুমাত্র রং না চড়িয়ে যা ঘটে তা-ই বলি। তাতেই সবাই হাসতে থাকে। উইল রজার্সের বক্তব্য অনুসারে যত দিন পৃথিবীতে সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটি থাকবে, তত দিন হাসির ঘটনার অভাব হবে না। রসিকপ্রবরের এ বক্তব্য একই সঙ্গে ঠিক ও বেঠিক। ঠিক এ জন্য যে প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর সব সরকারের দ্বারাই অসংখ্য তামাশা ঘটছে। বেঠিক এজন্য যে সরকারের সব কৌতুকপ্রদ কাণ্ড-কীর্তি হাসির ঘটনা নয়। যারা এসব কৌতুকের শিকার তাদের জন্য এসব তামাশা অনেক ক্ষেত্রেই মর্মান্তিক বিয়োগান্ত নাটক। সম্পদের অভাবে সরকার অনেক দুঃখী মানুষের সর্বনিম্ন পর্যায়ের অধিকার ও সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে পারে না। অথচ অপচয়ের জন্য সরকারের অর্থের অভাব হয় না। এ কথা ভাবতেও একই সঙ্গে হাসি পায় ও রাগ হয়।

সরকারি অর্থের অপচয় সব দেশেই কম-বেশি ঘটে। তবে যেসব দেশে সরকার ধনী, সেসব দেশে পেল্লায় অপচয়ের সম্ভাবনা বেশি। অপচয়ের কথা উঠলেই প্রথমে উইল রজার্সের জন্মভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম মনে পড়ে। শুরুতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু সরকারি অপচয়ের উদাহরণ তুলে ধরছি।

ক) নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে পশু চিকিৎসা বিভাগে গবাদিপশুর মূত্রত্যাগের অভ্যাস সম্পর্কে একটি গবেষণা প্রকল্পে মার্কিন সরকার ৩ মিলিয়ন ডলার বা ২৫ কোটি টাকা অনুদান প্রদান করে। যেকোনো প্রাণীর জন্য মূত্র ত্যাগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ধরনের প্রকল্পে সরকারের অনুদান মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তবে এ প্রকল্পের অস্বাভাবিক বিষয় হলো, গবেষণার প্রতিপাদ্য ও তার ফলাফল। গবেষকেরা জানতে চান যে গরু নদী পার হওয়ার সময়, না নদীতে নামার আগে প্রশ্রাব করে না নদী পার হওয়ার পর করে। ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গবেষণাটি শেষ হওয়ার পর জানা গেল যে প্রকল্পে নিযুক্ত অধিকাংশ পর্যবেক্ষক গরুগুলি কখন নীরবে মূত্র ত্যাগ করে, তা ঠাহর করতে পারেনি (দুষ্ট লোকেরা বলে যে গবেষকদের অনেকে বান্ধবীদের নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলেন যে গরু কী, করছিল সেদিকে তারা খেয়াল রাখতে পারেননি। আবার অনেক গবেষক নদীর ধারেকাছেও যাননি।)। সুতরাং এ সম্পর্কে কিছু জানতে হলে আরেকটি প্রকল্পের প্রয়োজন হবে। বলা বাহুল্য, প্রকল্পটি ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি অপচয়ের নিকৃষ্টতম উদাহরণ হিসেবে সিনেটর প্রক্সমায়ার স্মারক পুরস্কারে ভূষিত হয়।

খ) ২০০৫ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনা যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলে আঘাত হানে। এ সময় মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ লাখ দুর্গত ব্যক্তিকে সাহায্য দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৯ লাখ উপকারভোগী ছিল ভুয়া। হিসাব করে দেখা গেছে, এ ধরনের ভুয়া সাহায্য প্রাপকেরা ২ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ত্রাণের অর্থ দিয়ে অনেকে বিদেশে প্রমোদভ্রমণে গিয়েছে। এমনকি ত্রাণের পয়সায় একজন অস্ত্রোপচার করে লিঙ্গ পরিবর্তন করেছে।

গ) সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ইরাককে যে সাহায্য দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ১৩ বিলিয়ন ডলার অপচয় করা হয়েছে। অতিরিক্ত ৭.৮ বিলিয়ন ডলার লাপাত্তা হয়ে গেছে। এভাবে শ্যাম চাচা বা আংকেল স্যামের মোট গচ্চা গেছে ২০.৮ বিলিয়ন ডলার বা ১৮ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের বার্ষিক স্থূল উৎপাদের দ্বিগুণের বেশি।

ঘ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট দক্ষিণ চীনে পতিতাদের কীভাবে দায়িত্বের সঙ্গে স্বল্প মাত্রায় মদ্য পান করতে হয়, সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ২৬ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৮৩ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। প্রকল্প-প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে চীনে এ গবেষণায় লব্ধ জ্ঞান পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহার করা সম্ভব হতে পারে।

ঙ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে যেসব সরকারি কেনাকাটা করা হয় তার প্রায় অর্ধেকই ভুয়া ও প্রতারণামূলক। সরকারি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে জুয়া খেলার দেনা শোধ করা হয়েছে। মদ কেনা হয়েছে, (বান্ধবীদের) সোনার অলংকারের দাম শোধ করা হয়েছে। এমনকি সরকারি অর্থে নৈশভোজ আয়োজিত হয়েছে। ডাক বিভাগের এক নৈশভোজে মাথাপিছু খরচ হয়েছে ১৬৭ ডলার বা প্রায় ১৪ হাজার টাকা।

চ) যারা কৃষিপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারের নির্দেশে কৃষিজমি পতিত রাখে, তাদের ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের ভর্তুকি দেওয়া হয়। উপশহর এলাকায় যারা লনে ঘাস লাগায়নি তারাও এ সুবিধা দাবি করে ভর্তুকি পেয়েছে।

এ ধরনের অপচয়ের অজস্র উদাহরণ রয়েছে। এখানে একটি বিক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ চিত্র মোটেও পূর্ণাঙ্গ নয়। তবু ওপরের উদাহরণগুলি থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে মার্কিন সরকারের কর্মকাণ্ডে বিপুল অপচয় রয়েছে। প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি আল গোর দাবি করতেন যে মার্কিন সরকারের ব্যয়ের ৪৮ শতাংশই অপচয় হয়ে থাকে (স্ট্যানবেরি উইলিয়াম ও ফ্রেড টমসন, ১৯৯৫, ৪১৮)।

বাংলাদেশে অপচয়ের পরিমাণ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য হিসাব না থাকলেও এর ব্যাপকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হলো, ‘সরকার কি মাল দরিয়া মে ঢাল’। অনুমান করি, সরকারের মাল এত তছরুপ হয় যে স্থলে তা লুকিয়ে রাখার জায়গা পাওয়া যায় না, তাই নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ব্রিটিশ শাসকেরা দক্ষিণ aforico 990 fagyst af PWD (Public Works Department) (2/68 অপচয় ও দুর্নীতি দূর করতে পারেনি। তাই উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের ব্রিটিশ শাসকেরা ঠাট্টা করে বলতেন PWD-এর পূর্ণ নাম হলো Plunder Without Danger বা নির্ভয়ে লুট করো (মুন, পেন্ডেরেল, ১৯৮৯, ৮১৯)। স্মরণ করা যেতে পারে যে বর্তমানে প্রকৌশল-সংক্রান্ত যত মন্ত্রণালয় রয়েছে (যথা : সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রেলপথ, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন) সবই ছিল সে-সময় গণপূর্ত বিভাগের আওতায়।

অপচয়ের ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে একটি বড় তফাত রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অপচয় অভিন্ন। উন্নত দেশগুলিতে দুর্নীতি ছাড়া অন্যান্য কারণেও অপচয় ঘটে । নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবাদিপশুর মূত্রাভ্যাস নিয়ে গবেষণাতে দুর্নীতি ঘটেনি, তবে অপচয় ঘটেছে। অথচ বাংলাদেশে যেখানেই অপচয়ের অভিযোগ ওঠে, সেখানেই দুর্নীতি ঘটে। দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার ২০১১ সালের ৬ অক্টোবর তারিখের নিম্নলিখিত প্রতিবেদনটি বিবেচনা করুন : ‘বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সরকার গত বছর বেশ ঘটা করে দেশের ৩৮টি জেলায় যে এক কোটি পাঁচ লাখ এনার্জি সেভিং বাল্ব বিনা মূল্যে বিতরণ করেছিল এর ৮০ শতাংশই নষ্ট হয়ে গেছে বাতি জ্বালানোর এক সপ্তাহের মধ্যে। জলে গেছে ১০৩ কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই ভেস্তে গেছে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সাধের প্রকল্পটির প্রথম পর্ব। অথচ প্রতিটি বাতির আয়ুষ্কাল ছিল ১০০০০ ঘণ্টা যা এক নাগাড়ে চললেও ৪১৬ দিন পর্যন্ত টিকে থাকার কথা। অভিযোগ উঠেছে, দুর্নীতির মাধ্যমে নিম্ন মানের বাল্ব কেনার কারণেই এ কাণ্ড ঘটেছে। রাজধানীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় কালের কণ্ঠএর সরেজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এমন কথা। এখানে প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। প্রকল্পটির দোষে নয়, বরং দুর্নীতির জন্য সরকারের অর্থের নয়-ছয় ঘটল। আরেকটি ঘটনা বিবেচনা করুন। সপ্তম সংসদের স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদ কমিটি জানায় যে বেশ কয়েকজন সিভিল সার্জন হাসপাতালের জন্য বৈদ্যুতিক বাল্ক ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বাজারের খুচরা দামের চেয়ে সাড়ে ছয় গুণ থেকে ২৫ গুণ বেশি দামে কিনেছে (বিশ্বব্যাংক, ২০০০, ২৩) এ ধরনের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। বিশ্বব্যাংকের (২০০০) প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯৭-৯৮ সময়কালে সরকারি হিসাব কমিটি (Public Accounts Committee) ৪৯৭টি নিরীক্ষা-আপত্তি নিষ্পত্তি করে। এসব আপত্তির আর্থিক সংশ্লেষ ছিল ১ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে বিবেচনাধীন আপত্তির সংখ্যা ছিল ৫৬ হাজার ৪১২। ৪১৭টি নিরীক্ষা আপত্তিতে যদি ১ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা জড়িত থাকে, তবে ৫৬ হাজারের বেশি আপত্তির আর্থিক সংশ্লেষ যে বিপুল হবে তা অতি সহজেই অনুমেয়। এ হিসাব করা হয়েছিল ২০০০ সালে। এখন তা অনেক বেড়ে গেছে। তবে নিরীক্ষায় সরকারি অপচয়ের অতি ক্ষুদ্র অংশ ধরা পড়ে। যথাযথ অনুমোদন নিয়ে অপচয় হলে তাকে সরকারি নিরীক্ষায় অপচয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। নিরীক্ষাতে শুধু সরকারি খরচের অনিয়ম সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু সরকারের সম্পদের সব অপচয় নিরীক্ষা-প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয় না। কাজেই অপ্রতুল উপাত্ত সত্ত্বেও এ কথা অনুমান করা মোটেও শক্ত নয় যে বাংলাদেশে সরকারি অপচয় অবিশ্বাস্যভাবে বিপুল।

বিশ্বব্যাপী সরকারের ভূমিকা সম্প্রসারিত হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের ব্যয়ও বাড়ছে। যদিও উগ্র ডানপন্থী নেতারা দাবি করছেন যে তারা সরকারের ব্যয় হ্রাস করছেন, আসলে স্বাস্থ্যসেবা, বেকার ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বৃদ্ধির ফলে সরকারের ব্যয় অতি দ্রুত বাড়ছে। ২০০৯ সালে শিল্পোন্নত দেশগুলির স্কুল জাতীয় উৎপাদের ৩৯.৮ শতাংশ ব্যয় করেছে সরকার। অথচ ১৮৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ছিল ৮ শতাংশ; যুক্তরাজ্যে, ১০ শতাংশ; ফ্রান্সে, ১৫ শতাংশ; সুইডেনে ৬ শতাংশ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে সরকারের ব্যয় ছিল স্কুল জাতীয় উৎপাদের ১১.৩ শতাংশ। তবে অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যয় দ্রুত বাড়বে। সরকারের ব্যয় যত বাড়বে সরকারের অপচয়ও তত বাড়তে থাকবে। এই প্রেক্ষিতে সরকারের অপচয় নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।

সরকারে অপচয়ের ব্যাপকতার তুলনায় সমস্যাটি নিয়ে অত্যন্ত অপ্রতুল গবেষণা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারের অপচয়ের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি। বর্তমান প্রবন্ধের লক্ষ্য দুটি। প্রথমত, সরকারি অপচয়ের মূল সমস্যাগুলি চিহ্নিত করা। দ্বিতীয়ত, সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে বের করা। প্রবন্ধটি চার ভাগে বিভক্ত। উপক্রমণিকার পর দ্বিতীয় খণ্ডে সরকারের অপচয়ের সংজ্ঞা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে বিভিন্ন প্রকারের অপচয় চিহ্নিত করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে এই নিবন্ধের মূল বক্তব্যগুলি চিহ্নিত করে সরকারি অপচয়ের সমাধান সম্পর্কে সুপারিশ করা হয়েছে।