৪. উপসংহার

ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে সরকারের অপচয় মোটেও অভিনব কিছু নয়। দুই হাজার বছর আগে কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে সরকারি কর্মচারীদের অপচয় ও সরকারের অর্থ আত্মসাৎ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। সরকারি কর্মচারীদের সরকারি অর্থ তছরুপের প্রবণতা লক্ষ করে তিনি লিখেছেন, ‘Just as it is impossible not to taste honey or poison that one may find at the tip of one’s tongue, so it is impossible for one dealing with government funds, not to taste, at least a little bit, of the king’s wealth.’ (জিভের ডগায় মধু অথবা বিষ এলে যেমন না চেটে থাকা যায় না, তেমনি সরকারি অর্থ যারা নাড়াচাড়া করে তারা রাজার সম্পদের ছিটেফোঁটা হলেও না খেয়ে থাকতে পারে না ।)। যারা রাজার সম্পদ মেরে দিয়ে বড় লোক হন, তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন কৌটিল্য (১৯৯২)। সরকারের সম্পদ হেফাজতের জন্য কৌটিল্য সবচেয়ে জোর দিয়েছেন হিসাব নিরীক্ষার ওপর। অর্থশাস্ত্রের বিধান হলো, যদি নিরীক্ষক যথাসময়ে তাঁর দায়িত্ব পালন না করেন, তবে নিরীক্ষককে শাস্তি দিতে হবে।

আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও অপচয় রোধের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে নিরীক্ষা। অবশ্যই জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য নিরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিরীক্ষার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংসদকে।

নিরীক্ষা অপচয় বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয়, তবে যথেষ্ট নয়। নিরীক্ষা-ব্যবস্থার কয়েকটি বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, অপচয় হওয়ার পর নিরীক্ষা হয়। নিরীক্ষা তাই অপচয়ের জন্য শাস্তি দিতে পারে; কিন্তু অপচয় রোধ করতে পারে না। অপচয় ঘটে যাওয়ার পর তা উদ্ঘাটন করে মাত্র। তাই নিরীক্ষকদের সম্পর্কে ঠাট্টা করে বলা হয়ে থাকে, ‘An auditor is someone who arrives after the battle and bayonets all the wounded.’ (নিরীক্ষক হলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে রণক্ষেত্রে আবির্ভূত হন ও সব আহত সৈনিকের ওপর বেয়নেট হামলা চালান)। যুদ্ধের ফলাফলের ক্ষেত্রে নিরীক্ষকের কোনো ভূমিকা নেই। তিনি শুধু ঘটনা-উত্তর জবাবদিহির ব্যবস্থা করেন। তবে অপচয় ঘটার আগে তা রোধ করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ বা internal control।

দুর্ভাগ্যবশত, উন্নয়নশীল দেশে নিরীক্ষার চেয়েও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ব্যবস্থা অনেক দুর্বল। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের (২০০০) মূল্যায়ন উদ্ধৃত করা যেতে পারে : ‘Perhaps the most important factor accounting for the large number of irregularities and incidence of malfeasance in public expenditure is the failure to comply with a well-structured internal control system. There is apparently a complete breakdown of the internal control mechanism within the administrative system as a whole.’ (সম্ভবত, অনেক অনিয়ম ও অবৈধ ব্যয়ের ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে একটি সুবিন্যস্ত অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা মেনে চলায় ব্যর্থতা। দৃশ্যত সামগ্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক, ২০০০, ৩)।

সমস্যাটি পদ্ধতির নয়। সমস্যাটি হচ্ছে যারা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন, তাঁদের। নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত ও সাহসী কর্মকর্তা ছাড়া অপচয় রোধ করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। অথচ অনেক সরকারই এ ধরনের কর্মকর্তা চান না। তাই ঔপনিবেশিক আমলে যে মানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা ছিল তার কাছাকাছি ব্যবস্থাও স্বাধীন দেশে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। যাদের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব, তারা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সেপ্টেম্বর ২০১০ থেকে মার্চ ২০১২ সময়কালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের উদ্যোগে পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে বাংলাদেশে সরকারি অফিসের হিসাবরক্ষণে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে। ঠিকাদারদের বিল পেতে হলে প্রাপ্য অঙ্কের ৫ থেকে ১০ শতাংশ গড়ে উৎকোচ দিতে হয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের অবসর ভাতার জন্য ১ থেকে ১০ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়। বেতনের নতুন স্কেল পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ না দিলে দৈনিক ভিত্তিতে নিযুক্ত কর্মচারীরা বেতন পায় না (Financial Express, August 13, 2012)।

নিরীক্ষা-ব্যবস্থাও অপ্রতুল। নিরীক্ষকেরা বাইরের লোক। তাদের পক্ষে কোনো প্রতিষ্ঠানের সব দুর্বলতা অনুমান করা সম্ভব হয় না। এ সম্বন্ধে একটি সুন্দর চুটকি প্রচলিত আছে। একবার একজন নিরীক্ষক একটি কারখানা নিরীক্ষার দায়িত্ব নেন। বাজারে গুজব ছিল যে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিপুল পরিমাণ চুরি হয়। নিরীক্ষক চুরি ধরার জন্য তৎপর হলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তিনি কোনো অনিয়ম দেখতে পাননি। (অবশ্য সব চোর সতর্ক হয়ে গিয়েছিল)। শুধু বিকেলের দিকে একটি রহস্যজনক ঘটনা দেখতে পান। একটি ঠেলাগাড়ি, যার ওপর একটি অস্বচ্ছ কাপড় দিয়ে কী যেন ঢাকা দেওয়া আছে, তোরণের দিকে যাচ্ছে। নিরীক্ষক সঙ্গে সঙ্গে ঠেলাগাড়িটি তোরণের কাছে আটকে দেন। কিন্তু কাপড় তুলে কিছুই পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে ঠেলাগাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হলো। পরদিন একই ধরনের একটি ঠেলা গাড়ি অস্বচ্ছ কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় তোরণের কাছে এল । তাকে আটকিয়ে আবার তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। কিছুই পাওয়া গেল না। এভাবে একই ঘটনা পর পর সাত দিন ঘটল। অষ্টম দিন নিরীক্ষক কারখানার নিরীক্ষা শেষ করে যখন তার অফিসে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি আবার অস্বচ্ছ কাপড়ে ঢাকা একটি ঠেলাগাড়ি দেখতে পান। তিনি ঠেলাগাড়িটি আটকালেন ও গাড়োয়ানকে বললেন, আমি আপনার গাড়ি আর পরিদর্শন করব না। আমি বুঝতে পারছি আপনি কাপড় দিয়ে ঢেকে কিছু সরাচ্ছেন। কিন্তু কী সরাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। হলফ করে বলছি, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। আপনার কাছে আমি চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব, যদি মেহেরবানি করে আপনি কী চুরি করছেন তা আমাকে জানান। গাড়োয়ান একটু হেসে বলল, আমি ঠেলাগাড়ি চুরি করি।’ নিরীক্ষক আদৌ সন্দেহ করেননি যে ঠেলাগাড়িও চুরি হয়। ভেতরের খবর না জানলে অর্থবহ নিরীক্ষা সম্ভব নয়। অপচয় রোধ করার জন্য ভেতরের তথ্য-ফাসকারীদের (whistleblowers) উৎসাহিত করতে হবে, যাতে তারা সব কেলেঙ্কারি প্রকাশ করে দেয়। প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তার অবগুণ্ঠন অপসারণ করতে হবে। টেলিফোনে অভিযোগ গ্রহণ করার জন্য জরুরি লাইনের (hotline) ব্যবস্থা করতে হবে।

নিরীক্ষার মানও উন্নত করতে হবে। বর্তমানে নিরীক্ষা প্রধানত সরকারের ব্যয় ও উপকার পর্যালোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। সরকার বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানকে শুধু বাজেট বরাদ্দই দেয় না। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকার বিপুল সম্পদও (যথা ভূসম্পত্তি, ভৌত অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) বিনিয়োগ করেছে। সরকারের সম্পদ যথাযথ কাজে লাগছে কি না, তা-ও নিরীক্ষা করতে হবে। যুক্তরাজ্যে সম্পদভিত্তিক হিসাব ও বাজেট-ব্যবস্থা (Resource accounting and audit) নিয়ে নিরীক্ষা চলছে। এ ধরনের কার্যক্রম অন্যান্য দেশেও গ্রহণ করা যেতে পারে। শুধু টাকা যথাযথ ব্যয় হয়েছে কি না তা দেখাই যথেষ্ট নয়; টাকাটা কাজে লাগছে কি না, তা-ও দেখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন কার্যকারিতা নিরীক্ষা (Performance Audit)। দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন প্রয়োজন। প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পাঁচ থেকে দশ বছর পর প্রকল্পের টেকসই সক্ষমতা বিশ্লেষণও (Sustainability Analysis) করতে হবে।

অবশ্য এসব নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার মতো সম্পদ ও অভিজ্ঞ জনবল অনেক উন্নয়নশীল দেশেরই নেই । দুর্ভাগ্যের বিষয়, মান্ধাতার আমলের নিরীক্ষা-ব্যবস্থাও কাজ করছে না। অপচয়ের দীর্ঘদিন পর নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা লাপাত্তা হয়ে যায়। প্রশাসনিক অদক্ষতার ফলে নিরীক্ষায় অনিয়ম উদ্‌ঘাটিত হওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয় না। সরকারি হিসাবসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি বেশির ভাগ সময় অকার্যকর থাকে। অপচয় রোধে সংসদকে এগিয়ে আসতে হবে।

ওপরে উল্লেখিত ব্যবস্থাগুলি প্রয়োজনীয়, তবে যথেষ্ট নয়। যেখানে অপচয় কর্মকর্তাদের অদক্ষতা বা অর্থলিপ্সার ফলে ঘটে, সেখানে এসব ব্যবস্থা কাজ করতে পারে। কিন্তু যেখানে কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী অনুপার্জিত মুনাফার জন্য অপচয় পয়দা করে, সেখানে কারিগরি ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মরণপণ লড়াই করবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। দুর্ভাগ্যবশত রাজনীতিবিদেরাও কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কাজেই অর্থবহ উদ্যোগের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে । এর জন্য স্বেচ্ছাসেবীদের এগিয়ে আসতে হবে। অপচয় সম্পর্কে তথ্য গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। তবে দেশভেদে সমাধান ভিন্ন হবে। এ ক্ষেত্রে একটি ছোট বালক তার শিক্ষককে যে উপদেশ দিয়েছিল তা আমাদের মনে রাখতে হবে।

অঙ্কের শিক্ষক ক্লাসে এসে একটি ছোট ছেলেকে প্রশ্ন করল, ‘ধরো, আমি তোমাকে এক টাকা দিলাম। তোমার বাবা তোমাকে আরও একটি টাকা দিলেন। বলো তো, বাবা, তোমার কাছে মোট কত টাকা হলো?

ছেলেটি বলল, ‘এক টাকা।’

শিক্ষক বলল, ‘ভালো করে চিন্তা করে বলো।’

ছেলেটি আবার বলল, ‘এক টাকা।‘’

শিক্ষক রেগে বললেন, ‘তুমি দেখছি অঙ্ক একদম জানো না।’

ছেলেটি বলল, ‘স্যার, আমি অঙ্ক ঠিক জানি। কিন্তু আপনি আমার বাবাকে জানেন না। তিনি কোনো দিন আমাকে এক টাকা দূরে থাক, একটি পয়সাও দেবেন না। আমার কাছে আপনার দেওয়া টাকাটাই থাকবে।’

ছাত্রটি শিক্ষককে মনে করিয়ে দিল, বাবাভেদে যোগফল ভিন্ন হতে পারে। তেমনি দেশভেদে অপচয়ের প্রকৃতি ও সমাধান ভিন্ন হবে, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।

উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)

  • অলসন, মনসুর (Olson, Mancur)। ১৯৮২। The Rise and Decline of Nations. New Haven: Yale University Press.
  • কেইনস, জন মেনার্ড (Keynes, John Maynard)। ১৯৬৪। The General Theory of Employment, Interest and Money. New York: Harcourt, Brace and World Inc.
  • কৌটিল্য (Kautilya)। ১৯৯২। The Arthasastra. Translation L.N. Rangarajan. New Delhi: Penguin Books.
  • গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। ১৯৯৮। General Financial Rules. Dhaka: Finance Division.
  • বান্দিয়েরা, অরিয়ানা; আন্দ্রিয়া প্ৰাট ও টমাসসা ভ্যালেটি (Bandiera, Oriana; Andrea Prat and Tommaso Valletti)। ২০০৯। ‘Active and Passive Waste in Government Spending: Evidence from a Policy Experiment.’ The American Economic Review. Vol. 99. No. 3.
  • বিশ্বব্যাংক (World Bank)। ২০০০। Bangladesh: Country Financial Accountbility Asessment. Washington D.C.
  • মুন, পেন্ডেরেল (Moon, Penderel)। ১৯৮৯। The British Conquest and Dominion of India. London: Duckworth.
  • স্ট্যানবেরি, উইলিয়াম ও ফ্রেড টমসন (Stanbury, wiliam and Fred Thompson) i dode l ‘Towards a Political Economy of Governent Waste: Firsr Steps Definitions.’ Public Administration Review. Vol. 55. No. 5. (Sept-Oct, 1995)
  • সেন, সুকুমার। ২০০৩। ব্যুৎপত্তি সিদ্ধার্থ বাঙ্গলা কোষ। কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।