২. সরকারি অপচয়ের সংজ্ঞা

অপচয়ের উদাহরণ দেওয়া যত সহজ, তার সংজ্ঞা নির্ধারণ তত সহজ নয়। ইংরেজি ভাষায় অপচয়ের সমার্থবোধক শব্দ হলো waste। এই শব্দটির উৎপত্তি হলো ল্যাটিন শব্দ wastus থেকে, যার শাব্দিক অর্থ হলো জমি পতিত ফেলে রাখা বা কৰ্ষণ না করা। বাংলা অপচয় শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এর খুবই কাছাকাছি। সুকুমার সেন (২০০৩, ৭) জানাচ্ছেন, অপচয় শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো মূল্যবান দ্রব্য রক্ষা না করা। স্পষ্টতই, মূল্যবান সম্পদের যথাযথ ব্যবহারে ব্যর্থতা (জমি পতিত ফেলে রাখার মতো) অপচয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে ব্যর্থতাই হচ্ছে অপচয়।

সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারি অপচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন। নিম্নলিখিত তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়ের সংজ্ঞা নির্ণয় করা যেতে পারে :

  • আইনগত
  • অর্থনৈতিক
  • নৈতিক

আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়

আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়ের দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, সরকারি ব্যয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আছে কি না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি অর্থ ব্যয় করতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগে। এই অনুমোদন ছাড়া যেকোনো সরকারি ব্যয় অপচয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯-এর ২(৪) ধারায় অপচয়ের নিম্নরূপ সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে : ‘অপচয় অর্থ বার্ষিক বাজেটে যে উদ্দেশ্যে (purpose) অর্থ বরাদ্দ প্রদান করা হইয়াছে সে উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় বা ব্যবহার না করিয়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় বা ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, সরকারের ব্যয় ও ক্রয়সংক্রান্ত যেসব বিধিবিধান রয়েছে তা অগ্রাহ্য করে যেকোনো ব্যয় করলে তা অপচয় হিসেবে বিবেচিত হয়।

আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়ের সংজ্ঞা স্পষ্ট কিন্তু অত্যন্ত সংকীর্ণ। এই সংজ্ঞার দুটি পূর্ব-অনুমান রয়েছে। প্রথমত, অনুমান করা হচ্ছে যে সরকার খারাপ কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিলেও তা ব্যয় করলে অপচয় হবে না। বরং সরকার যে উদ্দেশ্যে বরাদ্দ দিয়েছে সে উদ্দেশ্যে ব্যয় না করলে অপচয় হবে। ধরুন, সরকার জেলখানার কয়েদিদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য বরাদ্দ দিল। সে অর্থ দিয়ে জেলে হাসপাতাল নির্মাণ করলে তা সরকারি অর্থের অপচয় হবে । কিন্তু উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের আদেশে নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসি দিলে আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয় হবে না। দ্বিতীয়ত, নির্ধারিত উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় বা ব্যবহার করাই যথেষ্ট। এতে কোনো ফল না পাওয়া গেলে বা উলটো ফল পাওয়া গেলেও ব্যয়টি অপচয় হিসেবে বিবেচিত হবে না।

নৈতিক দিক থেকে এই দুটি অনুমানের একটিও গ্রহণযোগ্য নয়। বাজেটে বরাদ্দ অনুমোদন করেন সংসদ সদস্যরা বা রাজনীতিবিদেরা। এঁরা সব সময় জনস্বার্থে কাজ করেন না; অনেক সময় নিজেদের স্বার্থে কাজ করেন। মার্কিন সাংসদদের সম্পর্কে একটি সুন্দর চুটকি প্রায়ই শোনা যায়। ঘটনাটি হলো, একজন কংগ্রেসম্যান গভীর রাতে সংসদ ভবনের সামনে বিরাট মাঠ পেরিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। এমন সময় তিনি এক ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েন। ছিনতাইকারী কংগ্রেসম্যানকে বলল, ‘দে ব্যাটা, তোর কাছে যা টাকা আছে তা আমাকে দিয়ে দে।’ কংগ্রেসম্যান বললেন, ‘জানো, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ? আমি একজন কংগ্রেসম্যান।’ ছিনতাইকারী বলল, ‘পিস্তলটা দেখেছিস? উলটাপালটা কিছু করলে শেষ করে দেব। দে, দে, টাকা দে। তোর পকেটের টাকার মালিক তুই নস। আমার মতো করদাতার টাকা তুই মেরেছিস। দে, আমার টাকাই আমাকে ফেরত দে।’

ছিনতাইকারী এই ক্ষেত্রে কিছুটা অতিরঞ্জন করেছে, কিন্তু একেবারে মিথ্যা বলেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাজেট চূড়ান্ত করেন সাংসদেরা। এই ক্ষমতা অপব্যবহার করে অনেক সংসদ সদস্যই নিজের স্বার্থ হাসিল করেন। এই প্রক্রিয়ার নগ্ন প্রকাশ দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাংসদদের নির্বাচনী এলাকায় ব্যয়ের জন্য বিপুল বরাদ্দে। এসব বরাদ্দে একমাত্র বিবেচনা রাজনীতি। এ ধরনের বরাদ্দ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে pork বা শূকর মাংস নামে পরিচিত। এই নাম এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল থেকে। গৃহযুদ্ধের আগে শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা শূকরের মাংসের যেসব অংশ তারা পছন্দ করত না, সেগুলি কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের দিয়ে দিত। দাসরা সে মাংস শুঁটকি করে মটকায় জমিয়ে রাখত। যখন খাওয়া কম পড়ত তখন এগুলি কাজে লাগত। এখনকার নির্বাচনী প্রতিনিধিরাও তাদের এলাকার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ জাতীয় বাজেট থেকে আলাদা করে রাখে। তাই নিজের নির্বাচনী এলাকার জন্য বিশেষ বরাদ্দ পর্ক বা শূকরের মাংস নামে পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটে এ সমস্যা অত্যন্ত ব্যাপক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘পর্কের পরিমাণ’ সম্পর্কে তথ্য সারণি ৭.১ এ দেখা যাবে।

 সারণি ৭.১

পর্ক-পদ্ধতিতে বাজেটে যেসব প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এগুলি অত্যন্ত নিম্ন মানের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থের অপচয় ঘটে। এই ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ১৯৯১-২০০৬ সময়কালে পর্কের পরিমাণ ও প্রকল্পের সংখ্যা স্ফীত হয়েছে। ২০০৬ সালে পর্কের বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের প্রায় ১.১ শতাংশ। অবশ্য সম্প্রতি এ ধরনের প্রকল্পের বরাদ্দে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিবিদেরা ধোয়া তুলসীপাতা নন। বাজেটে ব্যয়ের বরাদ্দ সংসদ অনুমোদন করলেই সব ব্যয় হালাল হয়ে গেল, এ যুক্তি মানা শক্ত। সংসদ যদি অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো বরাদ্দ করে, তবে তাকে অপচয় বলে গণ্য করা উচিত। কিন্তু আইন এ কথা মানে না। আইনগত সংজ্ঞায় সঠিক পদ্ধতি মেনে বরাদ্দ ব্যয় করলেই তা বৈধ বিবেচিত হবে।

অপচয়ের আইনগত সংজ্ঞার সুবিধা ও অসুবিধা দুটিই রয়েছে। সুবিধা হলো, এ ব্যবস্থায় ব্যয়ের ওপর জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা সুনিশ্চিত করা সম্ভব। আর অসুবিধা হলো, এ ব্যবস্থা অতি-কেন্দ্রীভূত এবং পরিস্থিতির নিরিখে পরিবর্তনের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ে। প্রতিনিয়ত যথাযথ মূল্যায়ন না করলে এ ব্যবস্থায় অপচয় বাড়তেই থাকবে। এর ফলে গোটা বাজেট-প্রক্রিয়া অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ ধরনের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩০-এর দশকে ঘটে। মার্কিন সেনাবাহিনীর ইউএস কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সকে (U.S. Army Corps of Engineers) পানি-সংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দেখা যায়, সব সাংসদ তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় নতুন নতুন অবকাঠামো দাবি করতে থাকেন। এত অবকাঠামোর অর্থায়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই ফেডারেল নৌপরিবহন আইন, ১৯৩৬ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৩৯ নির্দেশ দেয় যে ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণের (Cost-Benefit Analysis) নিরিখে কোনো প্রকল্প গ্রহণযোগ্য না হলে তার অর্থায়ন করা যাবে না।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেখানে ব্যয়ের পরিমাণ উপকারের আর্থিক পরিমাপের চেয়ে বেশি, সেখানে অর্থের অপচয় ঘটে। কিন্তু ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণের (Cost-Benefit Analysis) কয়েকটি বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, উপকারের বর্তমান আর্থিক পরিমাপ নির্ভর করে বিকল্প বিনিয়োগের অনুমিত সুদের হার বা discount rate-এর ওপর। যদি সুদের হার কম হয়, তবে প্রকল্প সমাপ্তির অনেক পর যেসব উপকার পাওয়া যায় তার আর্থিক পরিমাপের বর্তমান মূল্য বেশি হবে। যদি সুদের হার বেশি হয়, তবে বর্তমান মূল্যে ভবিষ্যতে প্রাপ্য উপকারের আর্থিক পরিমাপ অনেক কমে যাবে। ধরুন, একটি সেচ প্রকল্পের ফলে ৫০ বছর পর ১০ লাখ টাকার বাড়তি ফসল পাওয়া যাবে। যদি সুদের হার ৬ শতাংশ থাকে, তবে ৫০ বছর পর প্রাপ্ত ১০ লাখ টাকা আজকের ৫৪ হাজার ২৮৮ টাকার সমান। যদি সুদের হার ১২ শতাংশ হয়, তবে ৫০ বছর পরের ১০ লাখ টাকার উপকার বর্তমান মূল্যে ৩ হাজার ৪৬০ টাকার সমান। এই ক্ষেত্রে সুদের হার অর্ধেক হলে ৫০ বছর পরের উপকার ১৫.৬ গুণ বেড়ে যায়। অনেক দেশেই সুদের হার কম ধরে ভবিষ্যৎ উপকারের পরিমাণ ফাপানো হয়।

দ্বিতীয়ত, কোনো প্রকল্পের ফলে ভবিষ্যতে কী উপকার হবে, সে সম্পর্কে অনেক উপাত্ত পাওয়া যায় না। এসব হিসাব অনুমানের ওপর করা হয়। যারা প্রকল্পের সমর্থক, তারা সুবিধাজনক অনুমান ব্যবহার করে উপকারের পরিমাণ অতিরঞ্জিত করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পানি-সংক্রান্ত অবকাঠামোর ব্যয় উপকার বিশ্লেষণ নিয়ে সিনেটর প্রক্সমায়ার (১৯৮০, ৯৩) যথার্থই বলেছেন, ‘The Corps of Engineers under pressure from Congress has become experts in inventing benefits. The fertility a project will immediately bring can be estimated overoptimistically, as with the value of the crop that will rise up ten, twelve or twenty years from now. Recreation benefit may be added.’ (7.7816457 07291 ay ইঞ্জিনিয়ার বাহিনী উপকার আবিষ্কারে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। একটি প্রকল্পে কত উর্বরতা অবিলম্বে বাড়বে তা অতি আশাবাদী অনুমানের ভিত্তিতে হিসাব করা যেতে পারে। ১০, ১২ বা ২০ বছর পর ফসলের মূল্য নিয়ে একই ধরনের অনুমান করা যেতে পারে। এমনকি বিনোদন খাতে উপকারও যোগ করা। যেতে পারে।)। এসব অতিরঞ্জিত হিসাব যে সঠিক নয়, তা এ মুহূর্তে প্রমাণ সম্ভব না-ও হতে পারে।

তৃতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয় কমিয়ে দেখানো হয়। পরিবেশদূষণসহ বহিঃপ্রভাবের (externalities) কুফল ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছে করেই প্রকল্পের ব্যয় কম করে দেখানো হয়। একবার প্রকল্প শুরু হলে তা আর অসম্পূর্ণ রাখা যায় না। বাড়তি ব্যয় করে প্রকল্প সমাপ্ত করতে হয়। এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশেই ঘটে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এসব প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। সিনেটর প্রক্সমায়ার (১৯৮০) দেখিয়েছেন যে সত্তরের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোর অব ইঞ্জিনিয়ারের ১৭৮টি প্রকল্পের মধ্যে ৮৩টি প্রকল্পে (মোট প্রকল্পের ৪৭ শতাংশ) প্রকৃত ব্যয় অনুমোদনের সময় অনুমিত ব্যয়ের দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।

ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণ, আপাতদৃষ্টিতে আকর্ষণীয় মনে হলেও এবং বাস্তবে এ ধরনের বিশ্লেষণের নিরিখে যাচাই-বাছাই অপচয় হ্রাসে সহায়ক হলেও অপচয় বন্ধের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণের নামে অনেক সময় অগ্রহণযোগ্য প্রকল্প চালু হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদদের ভূমিকা একটি বহুল প্রচলিত চুটকি মনে করিয়ে দেয়। সেটি এরকম। একবার হিসাবরক্ষকের একটি চাকরির জন্য একজন গণিতজ্ঞ, একজন হিসাবরক্ষক ও একজন অর্থনীতিবিদ সাক্ষাৎকারে হাজির হন। প্রথমে ডাক পড়ল গণিতজ্ঞের । তাকে প্রশ্ন করা হলো, দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে কত হয়? তিনি জবাব দিলেন, ‘চার।’ তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হয়, এর কোনো ব্যতিক্রম আছে কি না। তাঁর সাফ জবাব হলো, ‘না।’ এবার হিসাবরক্ষককে ডেকে একই প্রশ্ন করা হয়। তিনি জবাব দিলেন, সাধারণত দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে চার হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫ অথবা ১০ শতাংশ এদিক-সেদিক হতে পারে। সবশেষে এলেন অর্থনীতিবিদ। তাকে যখন প্রশ্ন করা হলো, দুইয়ের সঙ্গে দুইয়ের যোগফল কত? তিনি নিজের চেয়ার থেকে উঠে প্রশ্নকর্তার কাছে চলে যান এবং তার কানে ফিসফিস করে প্রশ্ন করেন, স্যার, আপনি কত চান? বেশির ভাগ ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণে যে ফলাফল প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের খুশি করে, তা-ই অনেক অর্থনীতিবিদ পরিবেশন করে থাকেন।

ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণ নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণের মান উন্নত করার জন্য প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পাঁচ থেকে ১০ বছর পর সমাপ্ত প্রকল্পগুলির ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, কোথায় কোথায় ভুল করা হয়েছে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের বিশ্লেষণের মান বাড়াতে হবে। লাভজনক প্রকল্প নির্বাচনের আরেকটি সহজ উপায় হলো, সম্ভাব্য উপকারভোগীদের মতামত সংগ্রহ করা। যদি উপকারভোগীরা ব্যয়ের অংশ বহনে রাজি হন, তবে বুঝতে হবে যে প্রকল্পটির চাহিদা রয়েছে। জোগানতাড়িত প্রকল্পের পরিবর্তে চাহিদাতাড়িত প্রকল্পের ওপর জোর দেওয়া সমীচীন হবে।

অর্থনীতির একটি বড় দুর্বলতা হলো, অনেক বড় সমস্যা নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা একমত নন। এখানে কে শুদ্ধ আর কে ভ্রান্ত তা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। অর্থনীতি হলো একমাত্র শাস্ত্র, যেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত। বক্তব্যের জন্য উভয় ঘরানার অর্থনীতিবিদদেরই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এমনকি একই বছরে বিপরীতধর্মী বক্তব্যের জন্য দুজনকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৪ সালে একই সঙ্গে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান গুনার মিরদাল ও ফ্রিডরিক অগুস্ত ফন হায়েক। হায়েক ছিলেন মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা। মিরাল নিয়ন্ত্রিত ও নির্দেশ-অর্থনীতির সমর্থক। এঁদের একজনের পরামর্শ সঠিক হলে অন্যজনের বক্তব্য ভুল। তবু তারা দুজন একই সঙ্গে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

অপচয়ের অর্থনৈতিক তাৎপর্য নিয়েও অর্থনীতিবিদেরা বিভক্ত। যদিও দুষ্প্রাপ্য সম্পদের অপব্যবহারের কুফল নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দ্বিমত নেই, তবু কেইনস ও তার অনুসারীরা মনে করেন যে অর্থনৈতিক মন্দার সময় সরকারের বাড়তি ব্যয় আপাতদৃষ্টিতে অপচয় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ। কেইনসের অনুগামীরা বলে থাকেন, যদি দেশে বেকার সমস্যা প্রকট হয় এবং কর্মসংস্থানের জন্য ভালো কোনো প্রকল্প না থাকে, তবে সরকার বেকারদের গর্ত খুঁড়তে লাগিয়ে দিতে পারেন। বেকারদের আয় বাড়লে তাদের চাহিদা বাড়বে। এর ফলে উৎপাদন বাড়বে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে। গুণক প্রভাবে (Multiplier effects) মন্দার কালো মেঘ কেটে যাবে। যদি গর্ত খুঁড়লেও যথেষ্ট কর্মসংস্থান না হয়, তবে গর্তগুলি ভর্তি করুন এবং আবার নতুন করে গর্ত খুঁড়তে ও ভর্তি করতে থাকুন। একসময় গুণকের জাদুস্পর্শে মন্দা অতীত ইতিহাস হয়ে যাবে। বিনা প্রয়োজনে গর্ত খোঁড়া আর ভর্তি করা অপচয় মনে হতে পারে। কিন্তু কেইনসের মতে, বেকারদের জন্য কাজ সৃষ্টি করে সরকারের তথাকথিত অপচয় অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে।

কেইনসের অনুগামী নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যানকে সম্প্রতি প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, বিশ্বব্যাপী বিরাজমান বর্তমান মহামন্দার (২০০৮ ২০১২) সমাধান কীভাবে করা যেতে পারে। ক্রুগম্যানের জবাব ছিল, সরকারের খরচ অনেক বাড়াতে হবে। তাকে আবার প্রশ্ন করা হলো, এ ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির পক্ষে জনসমর্থন না থাকলে কী করা যাবে? ক্রুগম্যান পরামর্শ দিলেন, সারা পৃথিবীতে গুজব রটিয়ে দিন যে মহাশূন্য থেকে আজব জীবেরা পৃথিবী আক্রমণ করতে আসছে এবং এ আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কোটি কোটি প্রহরীর প্রয়োজন। এই অজুহাতে একবার চাকরি সৃষ্টি করলে মন্দা কেটে যাবে। যখন ভোটাররা বুঝতে পারবে যে এ গুজব ভিত্তিহীন, তত দিনে মন্দা থাকবে না। এ ধরনের বক্তব্য হাসি-তামাশা নয়। অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এসব বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন অতিশ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদেরা। কেইনস (১৯৬৪, ১২৯) নিজেই লিখেছেন, ‘Pyramid building, earthquakes, even wars may serve to increase wealth.’ (পিরামিড নির্মাণ, ভূমিকম্প এমনকি যুদ্ধ সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে।)। ক্রুগম্যান কেইনস থেকে খুব দূরে যাননি। কেইনস বলেছিলেন যে যুদ্ধ অর্থনীতিকে চাঙা করে। ক্রুগম্যান বলছেন, ভুয়া যুদ্ধের প্রস্তুতিও মন্দা দূর করতে পারে।

উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কেইনসের অনেক সমর্থক রয়েছেন। তারা সরকারে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাকরি সৃষ্টির পক্ষে কেইনসের অর্থনৈতিক যুক্তির সঙ্গে নৈতিক যুক্তি যোগ করে থাকেন। তাঁরা বলছেন যে সরকারে অপ্রয়োজনীয় চাকরিও গুণক প্রভাবের (multiplier effects) ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে। তার চেয়েও বড় কথা হলো, দেশের মানুষকে বেকারত্বের দুর্বিষহ অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়া সরকারের পবিত্র নৈতিক দায়িত্ব। কর্মবিহীন পদে বেকারদের চাকরি দিলে একই সঙ্গে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করা ও বেকার মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানো সম্ভব। কাজেই সরকারে উদ্বৃত্ত জনবল নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

কেইনসের তত্ত্ব ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেনি। এই বক্তব্য গতানুগতিক ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে শুধু কর্মসংস্থানের উপকার পরিমাপের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে বাজারদামে উপকারের আর্থিক মূল্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অথবা ছায়ামূল্য (shadow price) ব্যবহার করতে হবে। ছায়ামূল্য চোখে দেখা যায় না, অনুমানের ভিত্তিতে হিসাব করতে হয়। এ ধরনের হিসাব অনেক ক্ষেত্রে ত্রুটিমুক্ত হয় না। উপরন্তু সঠিক ব্যয়-উপকার বিশ্লেষণের জন্য যেসব উপাত্তের প্রয়োজন, তাও পাওয়া যায় না। আশা করা হয় যে ভুল হিসাব সংশোধন করতে করতে একপর্যায়ে নির্ভরযোগ্য হিসাব করা সম্ভব হবে।

তবে অপচয়ের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ আইনভিত্তিক অপচয়ের সংজ্ঞাকে অনেক সম্প্রসারিত করেছে। প্রথমত, অপচয়ের আইনি সংজ্ঞা শুধু সরকারি ব্যয়ে সীমাবদ্ধ। অর্থনৈতিক অপচয়ের সংজ্ঞায় আর্থিক বরাদ্দ ছাড়া অন্যান্য সম্পদও অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। যেমন ধরুন, রেলওয়ের অপচয় নির্ণয় করতে হলে শুধু ব্যয় পর্যালোচনা করলে চলবে না; ইতিপূর্বে ভূমি, রেললাইন, যন্ত্রপাতিসহ সব ধরনের বিনিয়োগের কতটুকু যথাযথ ব্যবহার করা হয়েছে তা বিবেচনায় নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যয়ের পরিমাণ শুধু বরাদ্দের ভিত্তিতে নির্ণয় করা যাবে না। বহিঃপ্রভাবের মোট ক্ষতিও বিবেচনায় নিতে হবে। তৃতীয়ত, যতক্ষণ একই সম্পদ ব্যবহার করে বাড়তি উপকার সৃষ্টি করা সম্ভব ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয় থেকে যাবে। স্ট্যানবেরি ও টমসন (১৯৯৫, ৪১৯) তাই বলছেন, ‘In other words, waste is the difference between what we get on average and the best we get in practice.’ (আমরা গড়ে যা পাই আর যা পাওয়া সম্ভব–এই দুইয়ের ব্যবধানই হচ্ছে অপচয়)। আইনি সংজ্ঞায় আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই। তাই আইনি সংজ্ঞায় সরকার যে ব্যয় বরাদ্দ করেন তা সঠিকভাবে খরচ করলে। কোনো অপচয় হয় না।

নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপচয়

অপচয়ের অর্থনৈতিক সংজ্ঞা অপ্রয়োজনীয় কাজে সম্পদ বরাদ্দ চিহ্নিত করে। অপচয়ের আইনি সংজ্ঞায় অননুমোদিত ব্যয় বন্ধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু ব্যয় বরাদ্দ আইনগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হলেও বাস্তবায়নের ব্যর্থতার ফলে অপচয় ঘটতে পারে। ম্যাককিনসি তাই অপচয়ের নিম্নরূপ সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন, ‘the unnecessary costs that result from inefficient or ineffective practices, systems or controls.’ (অযোগ্য অথবা অকার্যকর রীতিনীতি, ব্যবস্থা অথবা নিয়ন্ত্রণের ফলে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়)। সাধারণত অনুমান করা হয়, ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার ফলে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ঘটে। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার মূল কারণ পদ্ধতির ত্রুটি নয়। এর মূল কারণ হলো, ব্যবস্থাপকদের নিষ্ঠার ও যত্নের অভাব। ব্যবস্থাপকেরা নিজের সম্পদের যত যত্ন নেন, সরকারের সম্পত্তির তত খোঁজখবর নেন না। ব্যবস্থাপনার চেয়েও বড় সমস্যা এখানে নৈতিক। বাংলাদেশের সাধারণ অর্থনৈতিক বিধির (General Financial Rules) ১০(১) বিধিতে তাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘Every public officer is expected to exercise the same vigilance in respect of expenditure incurred from public moneys as a person of ordinary prudence would exercise in respect of expenditure of his own money.’ (সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সব গণকর্মকর্তা এমন সতর্কতা অবলম্বন করবেন, যা প্রতিটি কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি নিজের অর্থের বিষয়ে করে থাকেন)। এই নৈতিক দায়িত্ব সব সরকারি কর্মকর্তা পালন করলে অপচয় অনেক কমে যেত। দুর্ভাগ্যবশত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ দায়িত্ব। প্রতিপালিত হয় না।

ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, অপচয় একটি বহুমাত্রিক ধারণা। এর তিনটি প্রধান মাত্রার কোনোটিই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। যদি আইনি অপচয় ঘটতে থাকে, তবে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। যদি অর্থনৈতিক অপচয় রোধ না করা যায়, তবে সীমিত সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না। যদি সম্পদ ব্যবহারকারী সরকারি কর্মকর্তাদের নৈতিক আচরণে ঘাটতি থাকে, তবে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, যার ফলে সম্পদের অপব্যবহার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিরোধ করা যাবে না। অপচয়ের তাই কোনো সহজ সংজ্ঞা নির্ধারণ সম্ভব নয়। যখনই অপচয় দেখা যায় তা রোধ করতে হবে। স্ট্যানবেরি ও টমসন। (১৯৯৫) তাই যথার্থই বলেছেন, অপচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণই হচ্ছে অপচয় হ্রাসের প্রথম পদক্ষেপ।