মিত্রপক্ষের গুলি
অনভিপ্রেত পরিণামের অর্থনীতি

১. ভূমিকা

সরকারের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে প্রখ্যাত রক্ষণশীল ব্রিটিশ দার্শনিক এডমুন্ড বার্ক লিখেছেন, ‘সরকার হচ্ছে মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য মানুষের প্রজ্ঞায় সৃষ্ট একটি উদ্ভাবন’ (a contrivance of human wisdom to provide for human wants)। তিনি আরও মন্তব্য করেন যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাছে চাহিদা মেটানোর দাবি করার অধিকার সব মানুষের রয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তাই অনুমান করা হয় যে সরকার নাগরিকদের কল্যাণের জন্য যত অর্থ ব্যয় করবে, যত ব্যবস্থা নেবে, যত দৌড়ঝাঁপ করবে, ততই মানুষের উপকার হবে। বাস্তবে দেখা যায় যে সরকার অনেক সময় ভালো কাজ করতে গিয়ে অনিষ্ট করে বসে। প্রাচীন চৈনিক দার্শনিক লাও জু বলতেন, মানুষের কল্যাণের জন্য সরকার যত আইন করবে, যত বিধিনিষেধ আরোপ করবে মানুষ ততই গরিব হবে। এই মতের প্রতিধ্বনি করে মার্কিন রসিক উইল রজার্স লিখেছেন, ‘We should not blame the government for not doing something. It is when they do something they become dangerous’ (সরকার কিছু না করলে তাকে দোষ দেবেন না। শুধু সরকার যখন কিছু করে তখনই তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে)। সাম্প্রতিক কালে সব ডানপন্থী রাজনীতিবিদ বিশ্বাস করেন, সরকারই হলো আসল সমস্যা, সরকার মোটেও কোনো সমাধান নয়। রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান লিখেছেন, ‘Many people want the government to protect the consumers. A much more urgent problem is to protect the consumer from the government’ (অনেকে চান যে সরকার ভোক্তাদের রক্ষা করুক। এর চেয়েও অনেক জরুরি সমস্যা হচ্ছে সরকারের খপ্পর থেকে ভোক্তাদের বাঁচিয়ে রাখা)।

সরকারের ক্রিয়াকাণ্ড নিয়ে বিতৃষ্ণা শুধু উগ্র ডানপন্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এ ধরনের ধারণা উদারনৈতিক ও আমূল পরিবর্তনের প্রবক্তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে অবদান স্মরণ করা যেতে পারে। সারা জীবন তিনি দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের ভূমিকা নিয়ে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। তবু তাঁর সাম্প্রতিক রচনায় তিনি সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ২০০১ সালে ‘নেহরু বক্তৃতা’য় সেন (২০০৫) মিত্রপক্ষের গুলি বা friendly fire ধারণাটি (concept) অর্থনীতিতে প্রবর্তন করেন। এই লফজটি (term) তিনি ধার করেছেন মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। সেনাবাহিনী সাধারণত শত্রুকে তাক করে গুলি চালায়। কিন্তু অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়; যুদ্ধের কুজ্ঝটিকায় শত্রু-মিত্র ঠাহর করা শক্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় অনেক সৈন্য তাদের সপক্ষের যোদ্ধাদের তাক করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। এ ধরনের গুলিই হচ্ছে মিত্রপক্ষের গুলি। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন মিত্রপক্ষের ওপর হামলা ঘটে তেমনি সরকারের উদ্যোগে অনেক ব্যবস্থা গৃহীত হয়, যা অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর উপকারের বদলে অপকার করে। এ ধরনের ব্যবস্থাকেই অধ্যাপক সেন মিত্রপক্ষের গুলি বলে আখ্যায়িত করেছেন।

সাধারণত অর্থনীতিবিদেরা সরকারের ব্যর্থতাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে থাকেন : (১) কর্ম সম্পাদন না করার জন্য ব্যর্থতা (Errors of Omission), এবং (২) কর্ম সম্পাদনের ব্যর্থতা (Erors of Commission) (এন কুগার, ১৯৯০)। ধরুন, দেশের রাস্তাঘাট ঠিকমতো মেরামত করা হলো না। এটি হবে প্রথম ধরনের ব্যর্থতা। সরকার যদি ভুল মুদ্রানীতি অনুসরণ করে, এতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটি হবে দ্বিতীয় ধরনের ব্যর্থতা। কিন্তু মিত্রপক্ষের গুলি এ দুই ধরনের ব্যর্থতার কোনোটির মধ্যেই পড়ে না। মিত্রপক্ষের গুলির ক্ষেত্রে সরকার কাজটি ঠিকই করে। এখানে কর্ম সম্পাদনে ব্যর্থতা নেই। কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে যে কাজটি সম্পন্ন করা হয় তার পরিণাম হয় ক্ষতিকর ও ঋণাত্মক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সরকার দারিদ্র্য নিরসনের জন্য যেসব প্রকল্প গ্রহণ করে তা অনেক সময় দারিদ্র্যকে আরও ব্যাপক ও দুঃসহ করে তোলে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে বা সরকারি কর্মকাণ্ডে মিত্রপক্ষের গুলি কি সত্যি সত্যি ব্যাপক, না এমন ধরনের দুর্ঘটনা, যা কালেভদ্রে ঘটে? যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা নেহাত ফেলনা নয়। এখানে কয়েকটি সংখ্যা উল্লেখ করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ড ও স্টাফ কলেজের একজন বিশেষজ্ঞের হিসাব অনুসারে যুদ্ধে সেনাবাহিনীর ২ থেকে ২০ শতাংশ সৈন্য মিত্রপক্ষের গুলিতে হতাহত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে ৭৫ হাজার ফরাসি সৈন্য মিত্রপক্ষের গুলির শিকার হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে কমপক্ষে ৬ হাজার মিত্রপক্ষের হামলার ঘটনা ঘটে। যদি প্রতিটি ঘটনায় গড়ে পাঁচজন করে সৈন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে কমপক্ষে ৩০ হাজার সৈন্য মিত্রপক্ষের আক্রমণের শিকার হয়। এই সংখ্যা বিবেচনা করলে সামরিক অভিযানে মিত্রপক্ষের হামলার গুরুত্ব অস্বীকার করার জো নেই। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডেও মিত্রপক্ষের হামলা ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। অমর্ত্য সেন (২০০৫, ২১১) তাই বলছেন, ‘It is extremely important to study the issue of friendly fire’ (মিত্রপক্ষের হামলার বিষয়টি সম্পর্কে অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি)।

এই নিবন্ধটির মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে মিত্রপক্ষের গুলির ব্যাপকতা, কারণ ও সম্ভাব্য সমাধান বিশ্লেষণ করা। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বড় অসুবিধা হলো যে মিত্রপক্ষের গুলির ওপর যথেষ্ট উপাত্ত এখনো সংগৃহীত হয়নি। এই নিবন্ধে তাই প্রথমে মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে তিনটি দেশের কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করা হবে। পরবর্তী পর্যায়ে এর কারণ ও সম্ভাব্য সমাধান বিশ্লেষণ করা হবে। নিবন্ধটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম খণ্ডে রয়েছে ভূমিকা। দ্বিতীয় খণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ভারতে মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে কতিপয় ঘটনা আলোচনা করা হবে। তৃতীয় খণ্ডে বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে কয়েকটি উদাহরণ বর্ণনা করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে পূর্বে উল্লেখিত ঘটনা সমীক্ষাগুলির ভিত্তিতে মিত্রপক্ষের গুলির কারণ ও সমাধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।