২. বিভিন্ন দেশে মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে কতিপয় উদাহরণ

ক) প্রাচীন ইহুদিদের মধ্যে মিত্রপক্ষের গুলি

মিত্রপক্ষের গুলি নতুন ঘটনা নয়। অতি প্রাচীনকাল থেকেই অনেক বিধিবিধান করা হয়েছে, যা মানুষের উপকারের চেয়ে অনেক বেশি অপকার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইহুদিদের সপ্তবর্ষীয় বিরতি বা sabbatical সম্পর্কে বিধান স্মরণ করা যেতে পারে (ডুবনার ও লেভিট, ২০০৮)। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস এই যে বিধাতা ছয় দিন ধরে পৃথিবী সৃষ্টি করে সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন। ইহুদিরা আরও বিশ্বাস করে যে ফসলের জমিকেও অনুরূপভাবে সাত বছরে একবার বিশ্রাম দেওয়া উচিত। প্রাচীন ইহুদিরা প্রতি সপ্তম বছরে সব জমি অনাবাদি রাখত। যেসব ফসল চাষ ছাড়াই নিজে নিজে গজাত, গরিবেরা তা-ই দিয়ে উদরপূর্তির ব্যবস্থা করত। আর যারা সচ্ছল, তারা তাদের গোলায় সংরক্ষিত ফসল দিয়ে সংসার চালাত। এর পাশাপাশি আরেকটি নতুন নিয়ম চালু করা হয়। প্রতি সপ্তম বছরে যখন জমিতে চাষবাস হতো না, তখন সব অধমর্ণের ঋণ মাফ হয়ে যেত। এই নিয়মের উদ্দেশ্য ছিল মহাজনদের খপ্পর থেকে দেনাদারদের রক্ষা করা। প্রথম দিকে এ নিয়ম কাজ করেছিল। মহাজনেরা ধর্মীয় নির্দেশ মেনে খাতকদের ঋণ মাফ করে দিত। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে তারা বুঝতে পারে যে এভাবে চললে তাদের ব্যবসা লাটে উঠবে। অথচ ধর্মের বিধিবিধান অগ্রাহ্য করার মতো সাহসও তাদের ছিল না। তাই তারা সপ্তম বর্ষের চক্র (cycle) পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোদমে ঋণ দিত। যারা যথানিয়মে ঋণ শোধ করত না, তাদের অথবা তাদের সন্তানদের ক্রীতদাস হিসেবে বেচে দেওয়া হতো। এ ব্যবসা পঞ্চম বছর পর্যন্ত চলত। এরপর নতুন ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হতো। তাই ষষ্ঠ ও সপ্তম বছরে ঋণের সংকট দেখা দিত। সপ্তম বছরে ঋণ মওকুফের নিয়মটি করা হয়েছিল গরিবদের উপকারের জন্য। দেখা গেল, যতই সপ্তম বছর এগিয়ে আসে, ততই বাজার থেকে ঋণ উধাও হয়ে যায়। ষষ্ঠ ও সপ্তম বছরে ঋণ না পাওয়াতে গরিবদের অনেকের পক্ষে বেঁচে থাকাই শক্ত হয়ে ওঠে। অবশেষে ইহুদিরা এই বিধান এড়ানোর জন্য একটি ব্যবস্থা বের করে। পাওনাদাররা সপ্তম বর্ষ শুরু হওয়ার আগে বকেয়া ঋণ আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতো। আদালতে মামলা অনিষ্পন্ন থাকলে অনাদায়ী ঋণকে আদালতের পাওনা বলে গণ্য করা হতো। আদালতের পাওনা কখনো মাফ হয় না। তাই সপ্তম বছরে অধমর্ণদের ঋণ আর মাফ হতো না। আদালত ধীরেসুস্থে ঋণ আদায় করে উত্তমর্ণকে পরিশোধ করত। সপ্তম বছরে জমি চাষের ওপর নিষেধাজ্ঞাও পাশ কাটানোর একটা ফন্দি বের করা হয়। সপ্তম বছরে চাষের জমি ইহুদি নয়, এমন কোনো ব্যক্তির কাছে এক বছরের জন্য বিক্রি করা হতো। বিধান দেওয়া হলো, ইহুদিদের জমি না হলে তা চাষে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ওই জমি এক বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে ইহুদিরাই চাষ করত। সপ্তম বছরের শেষে জমির মালিকানা আবার ইহুদি মালিকের কাছে ফিরে আসত। এমনি করে বিভিন্ন ফন্দিফিকির করে মিত্রপক্ষের গুলি থামানোর ব্যবস্থা করা হয়।

খ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ আইনে মিত্রপক্ষের গুলি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশ আইনের অন্যতম লক্ষ্য হলো বিরল প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদগুলি যাতে নিশ্চিহ্ন না হয় তা নিশ্চিত করা। অন্তত দুটি বিপন্ন প্রজাতির পাখি রক্ষা করতে গিয়ে মার্কিন সরকার পাখিদের অস্তিত্বের সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এ দুই প্রজাতির পাখি হলো : (১) লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরা ও (২) কাঁটা ঝোঁপের মরচে রঙের পেঁচা।

লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরা একটি বিপন্ন পাখি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে এই প্রজাতির প্রায় ১২ হাজার পাখি জীবিত আছে। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বিপন্ন প্রজাতি আইন বা Endangered Species Act পাস করা হয়। এই আইনের বিধান অনুযায়ী সরকার কোনো পাখিকে কোনো অঞ্চলে বিলুপ্ত প্রজাতি ঘোষণা করলে সেসব অঞ্চলে ওই প্রজাতির পাখিরা যে ধরনের গাছে বাসা বাঁধে তা কাটা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরা সাধারণত বড় আকারের পুরোনো পাইনগাছে বাসা বাঁধে। তাই বিলুপ্ত প্রজাতি আইন পাস হলে যারা পাইনগাছ চাষ করে তারা ঘাবড়ে যায়। তারা চিন্তা করে, যদি পাইনগাছ পুরোনো হয়, তবে লাল ঝুঁটিওয়ালা পাখিরা বাসা বাঁধতে পারে। তাই অনেক বনের মালিকেরা পাইনগাছ পুরোপুরি পরিপক্ক হওয়ার আগেই কম দামে বাজারে বিক্রি করে দেয়। পরিপক্ক হওয়ার জন্য তারা ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। একবার কোনো জমির পাইনগাছে লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরা বাসা বাঁধলে সে জমির কোনো গাছ কাটা যাবে না। এর ফলে যারা পাইনের বাগান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ করে, তারা ফতুর হয়ে যাবে। উত্তর ক্যারোলিনাতে পরিবেশ আইনের প্রভাব বিশ্লেষণ করে দুজন মার্কিন অর্থনীতিবিদ এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে সরকারি বিধিনিষেধের ফলে লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরার প্রাকৃতিক বাসস্থান ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে এবং এ প্রজাতির পাখির বিলুপ্তির সম্ভাবনা বাড়ছে (লিউক, ডিন ও জেফরি এ. মাইকেল, ২০০৩)।

মার্কিন পরিবেশ আইনে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের তালিকা চূড়ান্ত নয়। যখনই সরকারের কাছে কোনো প্রজাতি বিপন্ন মনে হবে তখনই ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তবে সরকার এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে। এ সময়ে কোনো অঞ্চলে যদি গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রশ্ন ওঠে, তবে জমির মালিকেরা নিষেধাজ্ঞা জারির আগেই সব গাছ কেটে ফেলে। তাদের ভয় হলো, গাছ কাটার নিষেধাজ্ঞা জারি হলে এসব জমিতে আর গাছ পরিষ্কার করে বাড়িঘর নির্মাণ করার অনুমতি মিলবে না। ফলে এসব জমির দাম কমে যাবে। অ্যারিজোনাতে টুসন শহরের আশপাশে কাঁটাঝোঁপের মরচে রঙের খুদে পেঁচাদের নিয়ে এ ধরনের কাণ্ড ঘটে। যখন খুদে পেঁচাদের রক্ষার জন্য গাছ কাটা নিষিদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব আলোচনায় আসে, তখনই শহরের আশপাশের অঞ্চলের জমির মালিকেরা সব গাছ কেটে ফেলে, যাতে সংরক্ষণের নিষেধাজ্ঞার ফলে সেসব অঞ্চলে বসত বাড়ি নির্মাণ বন্ধ না হয়ে যায়। এভাবে খুদে পেঁচাদের রক্ষা করতে গিয়ে তাদের আবাসস্থল সংকুচিত করে দীর্ঘ মেয়াদে তাদের ক্ষতি করা হয়।

গ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবন্ধীদের আইনে মিত্রপক্ষের গুলি

প্রতিবন্ধীদের সব অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের একটি পবিত্র দায়িত্ব। তবে প্রশ্ন হলো, এসব অধিকার বাস্তবায়নের ব্যয় কে বহন করবে? সরকার চায় এ ব্যয় বেসরকারি খাতের ওপর চাপিয়ে দিতে। অন্যদিকে বেসরকারি খাত এসব ব্যয়বহুল দায়িত্ব এড়াতে চায়। এর ফলে দেখা দেয় মিত্রপক্ষের গুলি। অর্থাৎ সরকার প্রতিবন্ধীদের উপকার করতে গিয়ে তাদের অপকার করে।

মূক ও বধির প্রতিবন্ধীরা সাধারণ মানুষের মতো ডাক্তারদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। তারা সংকেতের মাধ্যমে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করে থাকে। সাংকেতিক ভাষার কোনো দোভাষী (interpreter) ডাক্তারের অফিসে উপস্থিত থাকলে প্রতিবন্ধীদের বক্তব্য সঠিকভাবে ডাক্তারদের কাছে উপস্থাপন করা সহজ হয়। এতে চিকিৎসার মান উন্নত হবে। এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে আইন করা হলো যে কথা বলতে অক্ষম রোগীদের পরীক্ষা করার সময় ডাক্তারের সঙ্গে সাংকেতিক ভাষার দোভাষী থাকতে হবে এবং এ দোভাষীর ব্যয় ডাক্তারদের দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশির ভাগ রোগীর ডাক্তারের বিল বিমা কোম্পানি দেয়। এ ক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিগুলি দোভাষীর বিল দিতে অস্বীকার করে। দোভাষীদের বিল ডাক্তারদের ফিয়ের চেয়ে বেশি। এ ধরনের রোগী দেখতে গেলে ডাক্তারদের নিজের পকেট থেকে সাংকেতিক দোভাষীদের বিল দিতে হয়। ফলে ডাক্তাররা এ ধরনের রোগী দেখতে অস্বীকার করে। দোভাষী-সংক্রান্ত আইন করার আগে ডাক্তাররা সাংকেতিক ভাষার ওপর নির্ভরশীল প্রতিবন্ধীদের দেখত। এতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসার অসুবিধা হতো। কিন্তু কোনোরকমে কাজ চলত। নতুন বিধির পর অনেক প্রতিবন্ধীর চিকিৎসাই বন্ধ হয়ে যায়।

শ্রমবাজারে যাতে প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য না করা হয় তা নিশ্চিত করার জন্য ১৯৯১ সালে Americans with Disabilities Act বা প্রতিবন্ধী আমেরিকানদের জন্য আইন পাস করা হয়। এই আইনে চাকরিতে যাতে প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য না করা হয়, তার জন্য বিধান রাখা হয়। কর্মস্থলে চাকাযুক্ত চেয়ার বা হুইলচেয়ারে চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। বলা হয়, প্রতিবন্ধীদের কাজ করার জন্য যদি বিশেষ যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হয়, তবে কারখানার মালিককে তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের সুস্থ শ্রমিকদের চেয়ে কম বেতন দেওয়া যাবে না এবং নিয়োগের ক্ষেত্রেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো বৈষম্য করা যাবে না।

এ আইন পাস করার সময় আশা করা হয়েছিল যে এর ফলে প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে হলো এর উল্টোটি। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে গেল। অর্থাৎ মোট কর্মরত প্রতিবন্ধীর সংখ্যা কমে গেল। এর একটি কারণ হলো, প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি সাহায্য বাড়ানোর ফলে কোনো কোনো প্রতিবন্ধী চাকরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এটি প্রতিবন্ধীদের চাকরি কমার প্রধান কারণ নয়। মূল কারণ হলো, প্রতিবন্ধীদের চাকরি দিতে হলে কর্মস্থলকে প্রতিবন্ধীদের উপযুক্ত করতে বাড়তি বিনিয়োগ লাগবে। উপরন্তু প্রতিবন্ধীদের নিয়োগ করার পর তাদের শাস্তি দিলে বা বরখাস্ত করলে নতুন আইনে বৈষম্যের মামলা হতে পারে। এই আশঙ্কায় অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদের চাকরি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ক্ষুদ্র উৎপাদকদের জন্য এ আইন বাধ্যতামূলক ছিল না। বড় উৎপাদকেরা প্রতিবন্ধী-বান্ধব সুনাম অর্জনের জন্য বাড়তি ব্যয়ে তত আপত্তি করেনি। মূল প্রতিরোধ আসে মধ্যম উৎপাদকদের কাছ থেকে। তাদের পক্ষে বৈষম্য হ্রাসের ব্যয় অগ্রহণযোগ্য মনে হয়। তাই তারা প্রতিবন্ধীদের চাকরি দেওয়া যথাসাধ্য কমিয়ে দেয় (আচেমগলু ডেরন ও যশুয়া ডি আংগ্রিস্ট, ২০১১)। এই আইন তাই প্রতিবন্ধীদের জন্য আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

ঘ) ভারতে খাদ্যনীতিতে মিত্রপক্ষের গুলি

বিগত চার দশক ধরে ভারত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভারত সরকারের খাদ্য মজুতের পরিমাণও অনেক বেড়েছে। ২০০১ সালে ভারতে খাদ্য মজুতের পরিমাণ ছিল ৬.২ কোটি টন। এই মজুতের পরিমাণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অমর্ত্য সেনের এক সহকর্মী জঁ ড্রেজ লিখেছেন, ৬.২ কোটি টন খাদ্যশস্যের বস্তা যদি একটির ওপরে একটি সাজানো যেত, তবে ১০ লাখ কিলোমিটার ওপরে ওঠা যেত (সেন, ২০০৫)। এতটুকু পথ ভ্রমণ করলে চাঁদে গিয়ে ফিরে আসা সম্ভব। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ভারতে খাদ্য মজুতের পরিমাণ ছিল ৫.৫৩ কোটি টন (যা ভারতের মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ)। ভারত সরকারের হিসাব অনুসারে, ভারতের জন্য ২.৫ কোটি টনের আপৎকালীন মজুতই যথেষ্ট। অর্থাৎ ২০১২ সালে ভারতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি টন (যা বাংলাদেশের মোট খাদ্য উৎপাদনের কাছাকাছি)।

সরকারের গুদামে এত বিপুল পরিমাণ মজুত সত্ত্বেও ভারতে অপুষ্টির হার ভয়াবহ। অমর্ত্য সেন লিখেছেন যে উপসাহারা (Sub Sahara) অঞ্চলে মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলেও সেখানে ভারতের চেয়ে অপুষ্টির হার কম। ২০০৮-০৯ সালে ভারতে পাঁচ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের ৪৩.৫ শতাংশ ছিল অপুষ্টির শিকার। উপসাহারা আফ্রিকাতে (সাহারার দক্ষিণে অবস্থিত আফ্রিকা মহাদেশ) এই হার মাত্র ২৪.৭ শতাংশ আর সব নিম্ন আয়ের দেশে গড়ে এই হার মাত্র ২৭.৭ শতাংশ। (বাংলাদেশে এই হার ৪১.৩ শতাংশ)।

ভারতে খাদ্যসামগ্রীর অভাব নেই। খাদ্যে ভর্তুকি দেওয়াতেও সরকারের কার্পণ্য নেই। ২০১১ সালে ভারত সরকার খাদ্যশস্য খাতে ভারতীয় মুদ্রায় ব্যয় করেছে ৬২ হাজার ৯২৯ কোটি রুপি (যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরের মোট বাজেটের অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি)। ভারত সরকারের খাদ্যে ভর্তুকি মূলত তিনটি কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত, সরকার কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করার জন্য কৃষিপণ্যের সংগ্রহ-মূল্য বাজারের চেয়ে কিছুটা বেশি রাখে। এই দাম সর্বনিম্ন সমর্থন-মূল্য হিসেবে পরিচিত। এই বাড়তি দামের সুবিধা পায় জমির মালিকেরা। অথচ সরকার চড়া দামে ফসল কিনলে খাদ্যশস্যের দাম গরিবদের নাগালের বাইরে চলে যায়। দ্বিতীয়ত, খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেলে ক্রেতারা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য স্বল্পমূল্যে রেশনিং-ব্যবস্থায় খাদ্যশস্য বিক্রয়ের জন্য ভর্তুকি দিতে হয়। তবে স্বল্পমূল্যে খাদ্যশস্য শুধু গরিবেরাই পায় না, এই সুবিধা বিত্তবানেরাও ভোগ করে। ফলে সরকারের ভর্তুকি-ব্যয় বেড়ে যায়। তৃতীয়ত, বিপুল পরিমাণ খাদ্য গুদামে রাখা ও পরিবহনের জন্যও ভর্তুকি দিতে হয়।

খাদ্য খাতে সরকারি ভর্তুকির একটি বড় অংশ গরিবেরা পায় না। সমর্থন মূল্যে খাদ্যশস্য কিনে সরকার গরিবদের জন্য যে সমস্যার সৃষ্টি করে সরকারের স্বল্পমূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণ নীতিমালা সে সমস্যার সমাধান করতে পারে না। অথচ ভারতের গুদামে যে ৩ কোটি টন উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য আছে তা দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করলেই দেশটিতে কোনো অপুষ্টি থাকত না।

অমর্ত্য সেন (২০০৫, ২১৩) ভারতের খাদ্যনীতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘It looks more and more like insanity.’ (এই নীতি অনেকাংশে পাগলামি বলে মনে হয়)। সরকার খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারলেও গরিবদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে পারেনি। ক্রয়ক্ষমতা না বাড়াতে পারলে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দাম নির্ধারণের জন্য যে পরিমাণ ভর্তুকির প্রয়োজন তা দেওয়াও সম্ভব হয় না। সামগ্রিকভাবে এই ভ্রান্ত নীতি ভারতের গরিবদের জন্য মিত্রপক্ষের একটি প্রচণ্ড হামলায় পরিণত হয়েছে। খাদ্যে উদ্বৃত্ত হওয়া সত্ত্বেও ভারতে ক্ষুধার ব্যাপকতা ও তীব্রতা বেড়ে গেছে।

ঙ) পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় মিত্রপক্ষের গুলি

একসময় পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ছিল অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। ধারণা করা হতো যে অপর্যাপ্ত বেতনের জন্য শিক্ষকেরা যথাযথ শিক্ষা দিতে পারছেন না। তাই প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সারা রাজ্যে দাবি ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত শতাব্দীর শেষ দিকে ও বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দিকে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে। অমর্ত্য সেন জানাচ্ছেন যে পশ্চিমবঙ্গে ২০০০ সালের দিকে একজন প্রাথমিক শিক্ষক মাসে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার রুপি বেতন-ভাতা পেতেন এবং একজন বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক পেতেন মাত্র ১ হাজার রুপি। তাই আশা করা হয়েছিল, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির ফলে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার মান বাড়বে। অথচ প্রতীচী ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় দেখা গেল যে তার উল্টোটা ঘটেছে। প্রতীচী ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা থেকে নিম্নোক্ত তথ্য জানা গেছে :

  • অনেক শিক্ষক ক্লাসে আদৌ আসেন না। বিদ্যালয়ে লেখাপড়া হয় না। লেখাপড়া শিখতে হলে গৃহশিক্ষক রাখতে হয়। যেসব ছাত্র গৃহশিক্ষক রাখতে পারে না, তাদের বেশির ভাগ নিজের নাম সই করতে পারে না।
  • যেসব অঞ্চলে নিম্নবর্ণের মানুষের সংখ্যাধিক্য রয়েছে সেসব অঞ্চলের শিক্ষকেরা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। এসব অঞ্চলের ৭৫ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষক অনুপস্থিতির হার আশঙ্কাজনক।

বেতন বৃদ্ধিতে বিপুল ব্যয় সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষার মানের এই অবনতিকে অমর্ত্য সেন ‘মিত্রপক্ষের গুলি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর কারণ অবশ্য তিনি সরাসরি বিশ্লেষণ করেননি। তবে তার আলোচনায় পরোক্ষভাবে কিছু কারণ উল্লেখিত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের স্বল্প বেতনই শিক্ষার মানের অবনতির একমাত্র কারণ নয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের তত্ত্বাবধান করার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। তারা সরকারি কর্মচারী, স্থানীয় অভিভাবকদের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। দ্বিতীয়ত, উচ্চবর্ণের শিক্ষকেরা নিম্নবর্ণের মানুষদের ঘৃণা করে। তাই নিম্নবর্ণের ছাত্রদের ফাঁকি দিতে তাঁদের বিবেকে মোটেও লাগে না। সবশেষে শিক্ষকদের রয়েছে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন। ফাঁকিবাজ ও অযোগ্য শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস রাজনৈতিক নেতাদের নেই। তত্ত্বাবধানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না থাকলে, জাতপাত সম্পর্কে শিক্ষকদের মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটলে এবং শিক্ষকদের ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমে গোষ্ঠীস্বার্থের উর্ধ্বে শিক্ষার মানকে প্রাধান্য না দিলে বেতন বাড়িয়ে লাভ হবে না। একদিকে সরকারি অর্থের শ্রাদ্ধ হবে, অন্যদিকে শিক্ষার মান নামতে থাকবে।