৩. বাংলাদেশে মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে কতিপয় উদাহরণ

৩.১. জাতীয় পর্যায়ে মিত্রপক্ষের গুলির উদাহরণ

বাংলাদেশে মিত্রপক্ষের গুলির বিষয়টি দুটি পর্যায়ে দেখা যায় : (১) জাতীয় পর্যায়ে ও (২) তৃণমূল পর্যায়ে। জাতীয় পর্যায়ে মিত্রপক্ষের গুলি সরকারি উপাত্ত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ সম্ভব। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে মিত্রপক্ষের গুলি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হলে প্রাথমিক উপাত্তের প্রয়োজন। এই নিবন্ধে বাংলাদেশের পাঁচটি মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনা বর্ণিত হবে। এর মধ্যে তিনটি পরোক্ষ তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হবে। দুটি ঘটনা বর্ণিত হবে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।

ক) হস্তচালিত নলকূপ: ইতিহাসে জনগোষ্ঠীর ওপর বিষপ্রয়োগের সর্ববৃহৎ ঘটনা

অতি প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের অধিবাসীরা ভূ-উপরিস্থ জলাধার থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করেছে। কিন্তু পানীয় জল ছিল কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড ও উদরাময়ের মতো জলবাহিত রোগের উৎস। বিশেষ করে, জলবাহিত এ ব্যামোগুলি ছিল শিশুমৃত্যু ও ব্যাধিগ্রস্ততার সবচেয়ে বড় কারণ। ১৯৬০-এর দশকে বাংলাদেশে নবজাতকের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল মাত্র ৪২ বছর।

১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু (জরুরি) তহবিলের (UNICEF) সহায়তায় সুপেয় ও নিরাপদ পানি সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা নিরাপদ পানীয় জলের উৎস হিসেবে হস্তচালিত অগভীর নলকূপকে চিহ্নিত করে জনসাধারণকে নলকূপের জল পান করতে উৎসাহিত করে। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তান সরকার সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে পানীয় জল সরবরাহের জন্য ১ লাখ ৬৪ হাজার হস্তচালিত নলকূপ বসায় (পাকিস্তান সরকার, ১৯৭০, ১৯২)। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার একই নীতি অনুসরণ করে। ১৯৮০ সালে গণখাতে হস্তচালিত নলকূপের সংখ্যা ৪.৬ লাখে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে মোট নলকূপের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখে দাঁড়ায়। এর অধিকাংশই ছিল বেসরকারি খাতে। একটি সাম্প্রতিক জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে ৮৮ থেকে ৯৫.৭ শতাংশ মানুষ হস্তচালিত নলকূপকে নিরাপদ পানীয় জলের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে (আসাদুল্লা, এমএন এবং নজমুল চৌধুরী, ২০০৮)। হস্তচালিত নলকূপের এই দ্রুত সম্প্রসারণের সুফলও পাওয়া যায়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে গড় আয়ুর প্রত্যাশা ৬৪ বছরে উন্নীত হয়। একা ইউনিসেফ বাংলাদেশে ৯ লাখ হস্তচালিত নলকূপ স্থাপনের অর্থায়ন করে। তারা এই কর্মসূচিকে একটি অসাধারণ সফল কর্মসূচিরূপে বর্ণনা করে এবং দাবি করে যে এই কর্মসূচির ফলে বাংলাদেশে ৯৭ শতাংশ লোক নিরাপদ পানি পান করছে।

তিন দশক ধরে নলকূপের গুণকীর্তনের পর হঠাৎ সুর পাল্টে গেল। এই উদ্যোগ একটি বিরাট বিপর্যয় বলে চিহ্নিত হলো। দেখা গেল, নলকূপের পানি অনেক ক্ষেত্রে আর্সেনিক বিষে দুষ্ট। তৃষ্ণার্তের মুখে যে জল তুলে দেওয়া হচ্ছে তা একেবারে অগ্রহণযোগ্য বিষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করল, বাংলাদেশের হস্তচালিত নলকূপ কর্মসূচি হচ্ছে “The largest mass poisoning of a population in history (ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গণবিষ প্রয়োগের ঘটনা)। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্সেনিক গবেষণা কর্মসূচির পরিচালক ড. এলান এইচ স্মিথ বাংলাদেশের আর্সেনিক-পরিস্থিতি বর্ণনা করে লিখেছেন ‘The highest environmental cancer risk ever found, a threat worse than Chernobyl and Bhopal’ (এ পর্যন্ত চিহ্নিত সর্বোচ্চ ক্যানসার ঝুঁকি, যা চেরনোবিল ও ভোপালের চেয়েও ভয়াবহ।) (রোড ও মানিক, ২০০৫)।

বাংলাদেশে মোট ৪৭ লাখ নলকূপের পানি পরীক্ষা করা হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুসারে এর মধ্যে ১৪ লাখ হস্তচালিত নলকূপের জল আর্সেনিক-সংক্রমিত। অর্থাৎ প্রতি পাঁচটি নলকূপের কমপক্ষে একটি আর্সেনিক বিষে দুষ্ট। এমন ৮ হাজার গ্রাম রয়েছে, যেখানে ৮০ শতাংশ নলকূপ আর্সেনিক ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে ২ কোটি লোক আর্সেনিক-সংক্রমিত পানি পান করছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশে আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর ২০ হাজার লোক মারা যাবে।

উন্নয়ন প্রকল্পের এই মর্মান্তিক ব্যর্থতা সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন বিশেষভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথম প্রশ্ন হলো যে যদিও ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার এই কর্মসূচিতে কোটি কোটি টাকা ঢেলেছে, তবু তিন দশক ধরে নলকূপ দিয়ে উত্তোলিত পানির মান কেন আদৌ পরীক্ষা করা হয়নি? অথচ এ ধরনের পরীক্ষার ব্যয় অতি নগণ্য। এতে প্রমাণিত হয় যে তৃতীয় বিশ্বে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় তার কারিগরি মানের ওপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হয় না।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো যে পানিতে আর্সেনিক বিষের যখন সন্ধান পাওয়া গেল, তার পরও কেন এ সমস্যা সমাধানের জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের সমস্যা পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮২ সালে প্রথম দেখা দেয়। ১৯৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের এক হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে তারা দুজন বাংলাদেশি রোগী পেয়েছে, যারা আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত (পিয়ার্স, ২০০১)। এতেও বাংলাদেশের টনক নড়েনি এবং নলকূপের পানির মান পরীক্ষার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৩ সময়কালে নলকূপের সঙ্গে জড়িত দাতা সংস্থারা ও বাংলাদেশ সরকার নলকূপের পানিতে আর্সেনিক আছে জেনেও এ সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ১৯৯৩ সালে সরকারিভাবে আর্সেনিক দূষণসমস্যার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। তবে, জাতীয় পর্যায়ে দূষিত নলকূপ চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। অথচ এই প্রক্রিয়া ১৯৮৫ সালে, যখন প্রথম আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়, শুরু হওয়া উচিত ছিল। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৮ সময়কালে লাখ লাখ নাগরিক আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত হয়। ত্বরিত ব্যবস্থা নিলে অনেকেই এ বিষের হাত থেকে বাঁচতে পারত। ১৩ বছর ধরে এই দণ্ডনীয় নিষ্ক্রিয়তার জবাবদিহি কে করবে? ইতোমধ্যে এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ইতোমধ্যে ৪০ হাজার রোগীর শরীরে আর্সেনিকের বিষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার কোনো কার্যকর প্রতিষেধক নেই। আর্সেনিক-আক্রান্ত এলাকায় এখনো অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প নিরাপদ সুপেয় পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়নি। অর্থাৎ সরকার ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে নলকূপ প্রকল্প নিলেও তা একটি মিত্রপক্ষের গুলিতে পরিণত হয়।

খ) নদীর প্রতিশোধ : দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে জলাভূমির বিয়োগান্তক নাটক

১৯৬০-এর দশকে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার মার্কিন সাহায্য সংস্থার সহযোগিতায় ৩৭টি পোল্ডার নির্মাণ করে। প্রতিটি পোল্ডারে একটি জলাভূমির চারদিকে বাঁধ দেওয়া হয়, যাতে বাইরের পানি ভেতরে ঢুকতে না পারে। সেই সঙ্গে ভেতরের পানি নিষ্কাশনের জন্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে ২৮২টি জল নিষ্কাশনের দ্বার (sluice gate)-সহ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধক্ষম ১ হাজার ৫৬৬ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এসব অবকাঠামোর মূল লক্ষ্য ছিল জমিতে সামুদ্রিক লোনা পানির প্রবেশ বন্ধ করা এবং নিচু জমিতে উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ধানের উৎপাদন। প্রকল্প সমাপ্তির পর ভৌত অবকাঠামোগুলি পরিকল্পনামাফিক কাজ করে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ভৌত অবকাঠামোগুলি ব্যাপক পরিবেশগত সংকটের জন্ম দেয়। এসব অবকাঠামো নির্মাণের আগে সমুদ্রের পানির অনুপ্রবেশ রোধ করার জন্য অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হতো। এতে বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ডিঙিয়ে পানি ঢুকত ও পানির সঙ্গে পলি এসে জমিকে উঁচু করত। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পর পানিও আসে না এবং জমিতে নতুন পলিও জমে না। পলির অভাবে জলাভূমিগুলো নিচু থেকে যায়। অন্যদিকে জল নিষ্কাশনের দ্বারগুলি পলি জমে বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ভেতরের পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। চারদিকে বাঁধ দেওয়া পোল্ডারগুলিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এভাবে উপকূলীয় বাঁধ অঞ্চলে ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর জমিতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে ফসল চাষ বন্ধ হয়ে গেছে। লোনা ও মানুষের বর্জ্য মিলে উপদ্রুত অঞ্চলে বদ্ধ জলকে দূষিত করে তুলেছে। জলবাহিত রোগগুলি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। সড়ক ও নৌপথ বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শিশুদের বিদ্যালয় পানির নিচে তলিয়ে গেছে। দূষিত জলে মাছ মরে যাচ্ছে। গাছ মরে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে জ্বালানিসংকট দেখা দিয়েছে। বেকারত্বের হার বেড়ে গেছে। অনেক গ্রামবাসী উপকূলীয় বাঁধে ও বসতবাড়ির বাইরে উঁচু জমিতে আশ্রয় নিয়েছে। এভাবে প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলি হলো বিল ডাকাতিয়া ও ভবদহের জলাভূমি। ভবদহের উপদ্রুত অঞ্চলগুলি যশোর জেলার অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলায় অবস্থিত। বিল ডাকাতিয়া বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৫ নম্বর পোল্ডারে অবস্থিত। এখানে আটটি ইউনিয়নের ৩৬টি গ্রাম রয়েছে। এই অঞ্চলটি খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও দৌলতপুর উপজেলায় অবস্থিত। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বিল ডাকাতিয়ার মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ১.৬৫ লাখ। এর মধ্যে ১ লাখ একর এলাকার অধিবাসীরা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত (আতিউর রহমান, ১৯৯৫)।

সমস্যাটি মানুষের সৃষ্ট। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতার কোনো কাঠামোগত সমাধান খুঁজে পায়নি। এর ফলে জলাবদ্ধতার বিস্তৃতি ক্রমশ বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে বাঁধের ভেতরের জল নিষ্কাশনের জন্য বাঁধ কেটে দেয়। তবে এতেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফল পাওয়া যায়নি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাহায্য নিয়ে পর পর দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়। দুটি প্রকল্পই ব্যর্থ হয়েছে। অতি সম্প্রতি স্থানীয় প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে জোয়ার-ভাটা নদী ব্যবস্থাপনা (Tidal River Management) করে কিছু ফল পাওয়া গেছে। এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো, কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়া জোয়ার-ভাটার পানির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। এর ফলে নদীতে পলি জমে নদীগর্ভকে উঁচু করে তোলে না। বরং নিচু জলাভূমিতে পলি জমে জমি উঁচু করে। এ ধরনের ব্যবস্থা বিল ডাকাতিয়াসহ কয়েকটি প্রকল্পে নেওয়া হয়েছে (ইসলাম ও কিবরিয়া, ২০০৬)। ক্ষতিগ্রস্তদের সংগঠন সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে দাবি করছে : Several thousand houses on 80,000 hectares of land are under ankle to knee-deep water. In total, around two lakh hectares of land remain waterlogged and the number of affected people is around twelve lakh (http://www.sos-arsenic,net?english/development/destruction.html) এভাবে গরিব মানুষের উপকারের জন্য যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, তা-ই তিন দশক ধরে গরিবদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে এ প্রকল্প থেকে আমরা দুটি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেছি :

  • পশ্চিমা প্রযুক্তি বাংলাদেশে সব সময় কার্যকর হয় না। নেদারল্যান্ডে যে ধরনের পানি-ব্যবস্থাপনা করা হয়ে থাকে তা সব ক্ষেত্রে নকল করা সম্ভব নয়।
  • পানিসংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় এসব প্রকল্পের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না।

গ) দরিদ্রদের জন্য ঋণ কর্মসূচি

বদান্যতার প্রহসন ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের বিঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে স্বল্প সুদে দরিদ্রদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা। সব সরকারই দাবি করে থাকে যে গরিব মানুষদের স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার উপলব্ধি করে না যে সুদের হার কমে গেলে মোট ঋণ সরবরাহ কমে যাবে। দরিদ্র মানুষ সুদের হার নিয়ে তত চিন্তিত নয়, যত উদ্বিগ্ন তারা ঋণপ্রাপ্তি নিয়ে। চড়া সুদ দিতে হলেও তাদের ঋণ প্রয়োজন। যদি গরিব লোকেরা প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ না পায়, তাহলে তাদের মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে সরকারি ব্যাংকগুলির দেওয়া ঋণের পরিমাণ কৃষকদের চাহিদার তুলনায় নেহাতই অপ্রতুল। এখানে কিছু সংখ্যা স্মরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের (২০১২, ৮২) ২০১০-১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের সব ব্যাংক মিলে ঐ অর্থবছরে মোট ৯২১০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১২ অনুসারে গ্রামীণ ব্যাংক ও দেশের প্রধান এনজিওগুলি মিলে একই সময়ে ২৮ হাজার ৩৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। অনুমান করা হয় যে গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রধান এনজিওগুলি ৮০ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করে। এই হিসাব অনুসারে ২০১০-১১ সালে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করা হয়েছে। যদি অনুমান করি যে ক্ষুদ্রঋণের সমপরিমাণ ঋণ অনানুষ্ঠানিক (যথা : মহাজন, পরিচিত ব্যক্তি বা আত্মীয়স্বজন) সূত্র থেকে আসে, তবে গরিব মানুষের ঋণের মোট চাহিদা দাঁড়ায় কমপক্ষে ৭৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সব ব্যাংক মিলে মোট চাহিদার প্রায় ১১.৫ শতাংশ মেটায়। তাই গরিবের উপকার করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ঋণের প্রবাহ অনেক বাড়াতে হবে। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে অনাদায়ী ঋণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি না দিলে গরিবদের জন্য ঋণের সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে তাই সুদের হারের চেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে ঋণের জোগান বাড়ানো। সুদের হার জোর করে কমিয়ে দিলে ঋণের পরিমাণ কমে যাবে। অথচ এই সহজ বিষয়টি বাংলাদেশে কোনো সরকারই সম্যকভাবে উপলব্ধি করেনি।

অর্থনীতির জন্মের অনেক আগে থেকেই দার্শনিকেরা বারবার সতর্ক করছিলেন যে সরকারি হুকুমে সুদের হার কমালে মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গল বেশি হবে। এ ব্যাপারে সপ্তদশ শতকের ব্রিটিশ দার্শনিক জন লকের (১৬৩২-১৭০৪) বক্তব্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশ সরকার সুদের হার ৬ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে হ্রাসের উদ্যোগ নেয়। জন লক এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন (নর্টন, ২০০৮)। এই বিতর্কে সুদের হার কমানোর বিপক্ষে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। তার যুক্তিগুলি ছিল নিম্নরূপ :

  • মহাজনরা সুদের হারের অবাস্তব (নির্ধারিত) সর্বোচ্চ সীমা এড়ানোর ফন্দিফিকির করবে। এতে তাদের যে অতিরিক্ত ব্যয় হয় তা তারা খাতকদের কাছ থেকেই আদায় করবে। এর ফলে বাস্তবে সুদের হার কমাতে গেলে সুদের হার বেড়ে যেতে পারে।
  • যদি সরকার সত্যি সত্যি সুদের হার কমাতে পারে, তাহলে ঋণের জোগান কমে যাবে। যাদের ঋণ দরকার তারা ঋণ পাবে না।
  • বিধবা, এতিম ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা তাদের সঞ্চিত অর্থ লগ্নি করে সংসার চালায়। সুদের হার কমে গেলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

লক তাই মনে করেন, সুদের হার কমে গেলে এর অপ্রত্যাশিত বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। যদি সুদের হার কমানোর আইনটি সঠিকভাবে কাজ করে, তবে ঋণের জোগান কমে যাবে। যদি ফাঁকি-ফক্কড়ির মাধ্যমে আইনটি এড়ানো সম্ভব হয়, তবে সুদের হার বেড়ে যাবে।

৩০০ বছর আগে লক বলেছেন যে সুদের হার বাজার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। সুদের হার সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলেই সমস্যা দেখা দেবে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো সরকারই অর্থনীতির এ সাধারণ সূত্র মেনে নেয়নি। এর ফলে বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচিতে স্বল্প সুদের হারে গরিব মানুষদের জন্য ঋণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু তাতে লোকের উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে বেশি। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত তথ্যগুলি প্রাসঙ্গিক;

বেশির ভাগ গরিব মানুষ স্বল্প সুদে ঋণ পায় না। স্বল্প সুদে ঋণের অর্থায়ন সরকারকে করতে হয়। বেসরকারি খাত লোকসান দিয়ে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে রাজি হয় না। তাই এ ধরনের ঋণের অর্থসংস্থান সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে করতে হয়। তাদের পক্ষে গরিবদের ঋণের জন্য যথেষ্ট অর্থ দেওয়া সম্ভব হয় না। এখন ব্যাংক খাত থেকে যে ঋণ দেওয়া হয় তা গরিবদের প্রদত্ত প্রাতিষ্ঠানিক (ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংকসহ এনজিওদের প্রদত্ত ক্ষুদ্রঋণ) ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে প্রদত্ত ঋণের ১২ থেকে ২০ শতাংশ হতে পারে। অর্থাৎ চাহিদার কমপক্ষে ৮০ শতাংশ ঋণ সরকার দিতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষা (ফেরারি, ২০০৮) থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে কমপক্ষে ১০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (ক্ষুদ্রঋণের ফলে এ সংখ্যা অনেক কমার পরও) এবং ৪৩ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষককে মহাজনদের মতো অনানুষ্ঠানিক উৎস হতে ঋণ নিতে হয়। এদের জন্য সুদের হার বড় কথা নয়, এদের সবচেয়ে বড় দাবি হলো যখন দরকার তখন ঋণ দিতে হবে। সরকারি ঋণনীতির ফলে এরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

  • যেহেতু স্বল্প সুদের ঋণের চাহিদার তুলনায় জোগান কম, সেহেতু এ ঋণের জন্য অশুভ প্রতিযোগিতা হয়। এ ধরনের ঋণ রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা পান। তারা একবার সরকারি ঋণ পেলে আর শোধ করেন না। অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা যাদের নেই তাদের ঋণ পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (২০০৫) একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকারীদের ৬১ শতাংশ ঋণ পাওয়ার জন্য ঘুষ দিয়েছে। পক্ষান্তরে বেসরকারি ব্যাংক থেকে যারা ঋণ নিয়েছে, তাদের মাত্র ১৫ শতাংশ ঘুষ দিয়েছে। যারা ঘুষ দিয়ে ঋণ নেয় তারা একবার ঋণ পেলে ফেরত দিতে চায় না। ফলে স্বল্প সুদে যেসব ঋণ দেওয়া হয়, সেখানে খেলাপির হার আশঙ্কাজনক। সাধারণত আশা করা হয় যে স্বল্প সুদে ঋণ দিলে উপকৃত ব্যক্তিরা ঋণ ফেরত দেবে এবং যারা উচ্চ সুদের হারে ঋণ নেয় তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশে একটি ঋণ কর্মসূচিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে সুদের হার কম অথচ আদায়ের হার উঁচু সুদযুক্ত ঋণের চেয়ে বেশি।
  • স্বল্প সুদে ঋণ দিতে গিয়ে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়। ২০০৬ সালের একটি হিসাব থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মোট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ১০০ থেকে ৬ হাজার ১০০ কোটি। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মোট লোকসান হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। উপরন্তু সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি কৃষিঋণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য শত শত কোটি টাকার ভর্তুকি সরকারের দিতে হচ্ছে। সমবায় দপ্তর ও সমবায় সংশ্লিষ্ট পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের বেতন দেওয়ার জন্যই সরকারের বছরে ১৩০ কোটি টাকার আবর্তক ব্যয় হয়। এইসব তৎপরতার পরও দেখা যাচ্ছে যে দেশের অধিকাংশ গরিব মানুষই বেশি সুদেও ঋণ পাচ্ছে না। স্বল্প সুদের হার চাপিয়ে দিলে ঋণের জোগান কমে যায়। তাতে গরিবদের দুঃখ লাঘব করতে গিয়ে তাদের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

৩.২ বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে মিত্রপক্ষের গুলি

জাতীয় পর্যায়ে মিত্রপক্ষের গুলি সব সময় ঠাহর করা যায় না। সরকারের ক্রিয়াকাণ্ডের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায় তৃণমূল পর্যায়ে। তবে এ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য মাঠপর্যায়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের গবেষণা সীমিত। এ নিবন্ধে লেখকের দুটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উদাহরণস্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে অন্যান্য দেশেও এ ধরনের অভিজ্ঞতার উদাহরণ রয়েছে। তাই এই অভিজ্ঞতাগুলিকে অনন্য মনে করার কারণ নেই।

ক) দুধে পানি মেশানো বন্ধ করার উদ্যোগের পরিণতি

১৯৫০-এর দশকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ভেজাল খাদ্য, বিশেষ করে দুধে পানি মেশানো নিয়ে সংবাদপত্রে অনেক হইচই হয়। খাদ্যে ভেজাল দেওয়া ও ভেজাল খাদ্য বিক্রয় করা পাকিস্তান দণ্ডবিধির ২৭৩ ও ২৭৪ ধারা অনুসারে দণ্ডনীয় অপরাধ। ভেজাল-সংক্রান্ত আইনের দুটি লক্ষণীয় বিশেষত্ব ছিল। প্রথমত, এই আইনে কোথাও ‘ভেজাল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। আক্ষরিক অর্থে একটি পদার্থের সঙ্গে ভিন্ন ধরনের পদার্থ মেশালেই তা ভেজাল হয়ে যায়। কিন্তু সব ভেজালই ক্ষতিকারক নয়। দুধের সঙ্গে বিশুদ্ধ জল মেশালে দুধের স্বাদ কমতে পারে; তবে তা স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর হওয়ার কারণ নেই। পাকিস্তান দণ্ডবিধিতে তাই স্পষ্ট করে বলা ছিল যে মিশ্রিত পদার্থটি ক্ষতিকর হতে হবে। ভেজাল নির্মূল হলে দণ্ডবিধি অনুসারে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হবে না। তাই কেউ দুধে বিশুদ্ধ পানি মেশালে এ আইন অনুসারে তার কোনো দণ্ড হবে না। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান দণ্ডবিধিতে ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য কোনো সর্বনিম্ন সাজার বিধান ছিল না। সাজার মাত্রা বিচারক তার নিজের বিবেচনামতো নির্ধারণ করতেন। এর ফলে বিচারক লঘু ও গুরু অপরাধের মধ্যে তারতম্য করতে পারতেন। ইচ্ছা করলে বিচারক সিকি বা আধুলি জরিমানা করতেন, আবার ইচ্ছে করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড, ১ হাজার টাকা জরিমানা বা একসঙ্গে উভয় দণ্ড দিতেন।

১৯৫৮ সালে দেশে সেনাশাসন এল। কর্তাব্যক্তিরা হুকুম দিলেন, ভেজাল সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই। তারা জনস্বাস্থ্য বিভাগীয় কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা করতে বললেন, কেন তারা ভেজালের রমরমা কারবার বন্ধ করতে পারছেন না। জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা বললেন যে তাঁরা আসামিদের ঠিকই ধরছেন। তবে ম্যাজিস্ট্রেটরা, ক্ষতিকর দ্রব্য মেশানো হয়নি, এই অজুহাতে অনেক আসামি ছেড়ে দিচ্ছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে নামে মাত্র জরিমানা করছেন। যারা ভেজালের ব্যবসা করে তারা জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীদের আদৌ পরোয়া করে না। এই অবস্থাতে ভেজাল ঠেকাতে হলে ঔপনিবেশিক আমলের ভেজাল আইন সংশোধন করতে হবে।

ভেজাল রোধের লক্ষ্যে সামরিক শাসকেরা ১৯৫৯ সালে Pure Food Ordinance 1959 বা বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ জারি করলেন। এই আইনে দুটি বড় পরিবর্তন আনা হলো। প্রথমত, বলা হলো যে এই আইনে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাকে কমপক্ষে ১৫০ টাকা জরিমানা করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেটরা তাঁদের মর্জিমতো নামমাত্র জরিমানা করতে পারবেন না। আশা করা হলো যে শাস্তির ভয়ে কেউ ভেজাল দেবে না।

দ্বিতীয়ত, সামরিক শাসকেরা বললেন যে এক জিনিসের সঙ্গে আরেক জিনিস মেশালেই ভেজাল বলে গণ্য হবে। মিশ্রিত দ্রব্যটি ক্ষতিকর না হলেও ভেজালের অপরাধে দণ্ড দেওয়া হবে। ফলে যদি দুধে বিশুদ্ধ পানিও মেশানো হয়, তবু তা ভেজাল হিসেবে দণ্ডনীয় হবে। দুধের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য আইনটি ছিল বদ্ধপরিকর। কী ধরনের দুধ বাজারে বেচা যাবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান রয়েছে ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশের আট ধারায়। দুধের মান সম্পর্কে আইনের নির্দেশগুলি নিচে উদ্ধৃত হলো :

  • the species of animal from which the milk is derived shall be specified by the seller in such manner as the local authority may direct by general and special order in this behalf,
  • The article sold shall be normal, clear and fresh secretion obtained by the complete milking of the udder of a healthy animal of the species specified, not earlier than seven days after the calving and freeing the colstrums of such animal, and
  • the article sold shall whether such secretion has been processed or not be an article from which no ingredient has been extracted and to which no water or other substance (including any preservative) has been added and which contains the normal constituents prescribed under Clause (a) of subsection (1) of Section 5.

ওপরের শর্তগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশে ভেজাল দুধের সংজ্ঞা অনেক ব্যাপক করা হয়েছে। প্রথমত, সব গরুর দুধ বেচা যাবে না। যে দুধ কর্তৃপক্ষের শর্ত পূরণ করে, শুধু সে দুধই বাজারে বিক্রয় করা যাবে। দ্বিতীয়ত, বাছুর জন্মের কত দিন পর কীভাবে দুধ সংগ্রহ করলে বিক্রি করা যাবে, সে সম্পর্কেও এতে নির্দেশনা রয়েছে। তৃতীয়ত, দুধ থেকে কোনো উপাদান তোলা যাবে না বা তাতে কোনো কিছু মেশানো যাবে না। পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ জল মেশালেও তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

আশা করা হয়েছিল, এই নতুন আইন করার পর ভেজাল দুধ বিক্রয় বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সে ধরনের কোনো প্রবণতা মোটেও দেখা যায়নি। বরং এ আইন পাস হওয়ার ১০ বছর পর মাঠপর্যায়ে এ আইনের অনভিপ্রেত প্রভাব দেখতে পাই।

১৯৬৯ সালে আমি তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) ফৌজদারি আদালতের প্রধান বিচারক পদে নিয়োজিত ছিলাম। আমি লক্ষ করি যে দুধে পানি মেশানোর কয়েক শত মামলা অনিষ্পন্ন রয়েছে। সরকার মামলা রুজু করেছে এবং দুধের নমুনা ঢাকায় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষাগারের প্রতিবেদন না পাওয়াতে মামলা নিষ্পন্ন করা যাচ্ছে না। আমি বারবার স্বাস্থ্যসচিবের কাছে নালিশ করলাম। অবশেষে আমার চেঁচামেচির ফল মিলল। প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক একসঙ্গে গোটা পঞ্চাশেক প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিল। আমিও মহানন্দে একই দিনে ৫০টি মামলার শুনানি ধার্য করলাম। প্রতিটি প্রতিবেদনেই লেখা ছিল যে দুধে পানি মেশানো হয়েছে। আমার ধারণা ছিল যে এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক আসামিকে দু-চার টাকা জরিমানা করলেই মামলা নিষ্পন্ন হবে। সরকারপক্ষ থেকে আমাকে বলা হলো যে এগুলি পাকিস্তান দণ্ডবিধির আওতায় দাখিল করা মামলা নয়, এ মামলাগুলি করা হয়েছে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশের ভিত্তিতে। অপরাধ প্রমাণিত হলে প্রত্যেককে কমপক্ষে ১৫০ টাকা জরিমানা করতে হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ৫০ জন দুধ বিক্রেতার প্রত্যেককে ১৫০ টাকা জরিমানা করি।

আমি আশা করেছিলাম যে এ ধরনের পাইকারি জরিমানার পর বাজারে দুধে পানি মেশানো কমে যাবে। হবিগঞ্জ শহরে আমার পূর্বপরিচিত একজন স্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। আমি তাঁকে দুধের বাজারে গিয়ে এ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আমাকে জানানোর জন্য অনুরোধ করি। কয় দিন পর তিনি আমাকে যা জানালেন তাতে আমার আক্কেলগুড়ুম। জানা গেল, বাজারে দুধে পানির পরিমাণ বেড়ে গেছে। মূল সমস্যা হলো প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট দুধ হয় না। খাঁটি দুধ কেনার সামর্থ্য অধিকাংশ ক্রেতার নেই। তাই কম দামে পানি মেশানো দুধ কিনতে ক্রেতাদের আপত্তি নেই। বিক্রেতাদেরও এতে সুবিধা। তাই বাজারে পানি মেশানোর বিপক্ষে কেউ নেই। শুধু সরকারের পক্ষ থেকে স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা উপদ্রব করে। যত দিন পর্যন্ত দায়ের করা মামলাগুলি অনিষ্পন্ন ছিল তত দিন স্যানিটরি ইন্সপেক্টরদের কেউ পাত্তা দিত না। এত লোকের একসাথে জরিমানা হওয়ার পর দুধ বিক্রেতারা বুঝতে পেরেছে, স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিশেষ করে, ইন্সপেক্টররা প্রচার করছে যে এক পাগলা হাকিম এসেছে যার কাছে দুধে পানি মেশানোর মামলা গেলেই অবধারিত ১৫০ টাকা জরিমানা হবে। চাই দুধ বিক্রেতারা স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের ঘুষ দিচ্ছে এবং ঘুষের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দুধে আরও বেশি পরিমাণ পানি মেশাচ্ছে। কাজেই দুধে পানি মেশানো বন্ধের জন্য যে আইন করা হয়েছিল তা প্রয়োগ করতে গিয়ে দুধে পানি মেশানো বেড়ে গেল।

খ) সরকারের সাহায্যপ্রাপ্তির পর বিদ্যালয়ের লেখাপড়া বন্ধ

ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৯ সালে। একদিন অপরাহে একটি তহশিল অফিস পরিদর্শনে যাই। আমি যখন বিভিন্ন নথিপত্র পরীক্ষা করছিলাম তখন দেখতে পেলাম, অফিসের বাইরে লোকজন জমছে। আমি যখন কাজ শেষে বের হয়ে আসছি, স্থানীয় লোকজন আমাকে অনুরোধ জানাল যে আমি যেন তাদের গ্রামের স্কুলটি দেখে যাই। তাদের পীড়াপীড়িতে আমি স্কুলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই যে একটি দালানের ছাদ পড়ে গেছে।

গ্রামের লোকেরা পুরো ঘটনাটি খুলে বলল। ৫০ বছর ধরে গ্রামবাসী একটি টিনের ঘরে স্কুল চালাচ্ছিল। বছর দুয়েক আগে থানা শিক্ষা অফিসার এসে জানাল যে সরকার এখানে পাকা দালান নির্মাণের জন্য ১০ হাজার টাকা দেবে। এতে পুরো কাজ হবে না। তবে গ্রামবাসী যদি টিনের ঘরটি বেচে টাকাটা দালান নির্মাণের জন্য দিয়ে দেয়, তবে কাজটি সহজেই সুসম্পন্ন হবে। গ্রামের লোকজন এ প্রস্তাব মেনে নিয়ে ঘরটি বেচে দিল। দালান নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হলো। দালানের ছাদ ঢালাই করা হলো। সবাই আশা করল, শিগগিরই দালানে ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু ছাদ ঢালাই হতে না হতেই ছাদ ভেঙে পড়ল। ঠিকাদার ভেগে গেল। থানা শিক্ষা অফিসার বদলি হয়ে গেল। শিক্ষা বিভাগ দুর্নীতি মামলা শেষ হওয়ার আগে স্কুলটি পুনর্নির্মাণের অর্থ বরাদ্দ দিতে অস্বীকার করল। সরকার সাহায্য দেওয়ার আগে এখানে টিনের ঘরে একটি স্কুল চলছিল। অথচ সরকার ১০ হাজার টাকা দেওয়ার পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেল। সরকার চাইল প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি, বাস্তবে ঘটল অবনতি।

আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হতে পারে। তবে একটু অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনগুলির মান খুবই নিচু। এর নাটকীয় প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তান ও চীনের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে। যদি সব ধরনের বাড়ির মান একই পর্যায়ের হয়, তবে ভূমিকম্প হলে সব ধরনের ইমারত সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীন ও পাকিস্তানে যখন ভূমিকম্প হয় তখন দেখা যায় যে অন্যান্য বাড়িঘরের তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির অনেক বেশি ক্ষতি হয়। ২০০৮ সালের ভূমিকম্পে সিচুয়ান প্রদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এই ভূমিকম্পে সিচুয়ান প্রদেশের ৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় মাটিতে মিশে যায়। ভূমিকম্পের সময় অনেক বিদ্যালয়ে ক্লাস চলছিল। ভবন ধসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। চীনা সরকারের প্রতি পরিবারে ‘এক সন্তান নীতি’র পরিপ্রেক্ষিতে মৃত শিশুদের অনেকেই ছিল বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। ভূমিকম্পে বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙে গেলেও আশপাশের বাড়িঘর অটুট ছিল। এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি নির্মাণের মান ছিল অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের। চীনারা এখন ঠাট্টা করে বলে যে তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি হচ্ছে টফু (tofu) বা নরম মাটির দলা দিয়ে তৈরি।