শুভ জন্মদিন
জন্মদিনের অর্থনীতি ও রাজনীতি

১. ভূমিকা

রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী সরলাদেবী চৌধুরানী তাঁর আত্মজীবনী জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থে লিখেছেন, “মেজমামী বিলেত থেকে ফিরে আসার পর থেকে ‘জন্মদিন’ বলে একটা ব্যাপারের সঙ্গে পরিচয় হল আমাদের–সে বিলাতী ধরনে সুরেন বিবির জন্মদিন উৎসব করার উপলক্ষে। তার আগে এ পরিবারে ‘জন্মদিন’ কেউ কারো জন্য করে নি (২০০৯, ৫৪)।” মেজো মামি অর্থাৎ প্রথম ভারতীয় আইসিএস সত্যেন ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ১৮৭৭ সালে প্রথমবার বিলেতে যান। সঙ্গে ছিল পাঁচ বছরের ছেলে সুরেন ও চার বছরের কন্যা ইন্দিরা (যার ডাক নাম ছিল বিবি)। ১৮৮০ সালে তিনি পুত্র-কন্যা নিয়ে ফিরে আসেন। ফেরতযাত্রায় তাঁর সঙ্গে যোগ দেন স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দেবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সরলাদেবীর বিবরণ থেকে প্রতিভাত হয় যে বাংলাদেশে বিলেতি কেতায় জন্মদিনের চল হয় ১৮৮০ সাল বা তার কিছু পর। এর আগে কারও কারও জন্মদিনে জন্মতিথির পূজা হয়েছে। কিন্তু জন্মদিন উৎসব ছিল বাঙালিদের অজানা। জন্মদিন পালিত হতো দেবতাদের (যেমন জন্মাষ্টমী) অথবা প্রেরিত পুরুষদের (যেমন বড়দিন ও ঈদে মিলাদুন্নবি) এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাদশাহদের। দেবতা ও পয়গম্বররা হচ্ছেন অমর। আর বাদশাহরা যখন গদিতে থাকতেন তখন নিজেদের অমর গণ্য করতেন। তবে মরণশীল মানুষের জন্মদিন নিয়ে মাতামাতি করা হতো না।

মনে করা হয়, ভারতের সাধারণ মানুষ দুটি কারণে জন্মদিন নিয়ে হই হুল্লোড় করত না। প্রথমত, উনবিংশ শতাব্দীতে অধিকাংশ ভারতীয় ছিল দরিদ্র। তাই অধিকাংশ লোকেরই জন্মদিনের রেস্ত ছিল না। তবে এ যুক্তি দুটি কারণে দুর্বল। অভিজিৎ ভি ব্যানার্জি ও এসথার ডাফলো (২০১১) সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন, অতিদরিদ্ররাও জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তির জন্য উৎসব ও পালাপার্বণে নিজেদের ক্ষমতা না থাকলেও (ধারদেনা করে বা আধপেটা থেকে) দরাজ হাতে খরচ করতে দ্বিধা বোধ করে না। তাই অর্থাভাবে জন্মদিনের উৎসব বন্ধ হয়ে থাকার সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয়ত, গরিব দেশে সবাই দরিদ্র নয়। এসব দেশে অনেক সচ্ছল পরিবার রয়েছে। তারাও প্রাক ব্রিটিশ বাংলায় জন্মদিন পালনে উৎসাহ দেখায়নি। তাই অর্থাভাবের কারণটি খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় না।

জন্মদিন উদ্যাপিত না হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল খুবই কম। শিয়রে অপেক্ষমাণ যমদূত নিয়ে জন্মদিনের মাতামাতির কথা অধিকাংশ মানুষই চিন্তা করতে পারত না। সারণি ৬.১-এ ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশে ও যুক্তরাজ্যে গড় আয়ুর প্রত্যাশার তুলনামূলক চিত্র দেখা যাবে।

সারণি ৬.১

১৮২০ সালে ভারতে গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল মাত্র ২১। ১৯০০ সালে ভারতে মানুষ গড়ে ২৪ বছর বাঁচত। এই সময় শিশুমৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত বেশি। তাই এক জন্মদিন থেকে আরেক জন্মদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকাটাই ছিল একটি বড় ঝক্কি। অবশ্য বিলাতের পরিস্থিতি ছিল অনেকটা ভিন্ন। সেখানে ১৮২০ সালে গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল ভারতের প্রায় দ্বিগুণ (অর্থাৎ ৪০ থেকে ৫০ বছর)। বিলাতে তাই উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে জন্মদিনের রেওয়াজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিলাতের অনুকরণে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর মতো বিলেতফেরতরা বাংলাদেশে জন্মদিন চালু করেন।

জন্মদিন নিয়ে আমার ঔৎসুক্যের প্রধান কারণ হলো, আমি আমার জন্মদিন কবে জানি না। অথচ আমার দুটি জন্মদিন আছে। আমার সরকারি জন্মদিন হচ্ছে ২ আগস্ট ১৯৪৪। এই তারিখ জন্মদিন হিসেবে আমার প্রবেশিকা পরীক্ষার সনদে লেখা রয়েছে। এই তারিখের ভিত্তিতেই আমি সরকারি চাকরিতে যোগ দিই এবং সরকার থেকে অবসর গ্রহণ করি। আমার মা, যিনি আমার জন্মদিন সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানতেন, বারবার জোর দিয়ে বলতেন যে তারিখটি একেবারেই ভুল। মায়ের মতে, আমার জন্ম শ্রাবণ-ভাদ্রে নয়, আমার জন্ম হাড়-কাঁপানো শীতে। তাহলে আমার জন্মদিন নিয়ে এমন অঘটন কেন ঘটল? আমার মা বলতেন, কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন আমার প্রধান শিক্ষক বাবু বিহারীলাল চক্রবর্তী। তখন নাকি প্রবেশিকা পরীক্ষার বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে সাড়ে চৌদ্দ বছর বয়স না হলে সে বছর পরীক্ষা দেওয়া যেত না। ডিসেম্বরে জন্মদিন হলে পরীক্ষার জন্য এক বছর বসে থাকতে হবে। হেডমাস্টার বিধাতাকে অগ্রাহ্য করে কেরানি বাবুকে হুকুম দিলেন, ‘এর জন্মদিন ২রা আগস্ট লিখে দাও।’ আমার মায়ের হিসাবে আমার জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর। এই দ্বিতীয় দিনটিই আমার আপনজনেরা মাঝেসাঝে পালন করে থাকে।

আমার মায়ের হিসাব ঠিক হলে আমি মহাপুরুষদের জন্মদিনে ভূমিষ্ঠ হয়েছি। বলা বাহুল্য, একই দিনে যিশুখ্রিষ্ট ও পাকিস্তানের জনক জিন্নাহর জন্ম হয়। এক স্কুলের ছাত্রকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, মহাপুরুষের লক্ষণ কী? ছাত্রটি জবাব দিয়েছিল, মহাপুরুষ হতে হলে ছুটির দিনে জন্ম হতে হয়। ছাত্রটি অবশ্য চিন্তা করেনি যে ২৫ ডিসেম্বরের ছুটির দিনে জন্ম হওয়াতে যিশু প্রেরিত পুরুষ হননি, বরং যিশুর জন্ম হওয়াতেই ওই দিনটিতে ছুটি পালন করা হয়। ছোটবেলায় অত শত বুঝতাম না। বরং ২৫ ডিসেম্বরের ছুটির দিনে জন্ম হওয়াতে ছোটবেলায় আমার মনে অনেক অহংকার ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য জন্মদিন নিয়ে আমার মনে কয়েকটি প্রশ্ন জাগে। বর্তমান প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো জন্মদিন নিয়ে এসব প্রশ্নের আলোচনা।

প্ৰথম খটকা আমার মনে জাগে, আমার মা কীভাবে মনে রেখেছেন আমার সঠিক জন্মদিন কবে। আমার কোনো কুষ্ঠি নেই। আমার জন্মতারিখ কোথাও লেখা নেই। আমার বাবা এতটুকু মনে করতে পারতেন যে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য আমার বয়স বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু ডিসেম্বরের কোন তারিখে আমার জন্ম তিনি তা স্মরণ করতে পারেননি। ২৫ ডিসেম্বর আমার প্রকৃত জন্মদিন কি না, এ নিয়ে আমার মনে সংশয় দেখা দিলে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, যিশুখ্রিষ্ট ও পাকিস্তানের জনক জিন্নাহর জন্য সত্যি সত্যি ২৫ ডিসেম্বর ছিল কি না। একটু গবেষণা করলেই বোঝা গেল, আমার সন্দেহ একেবারে অমূলক নয়। গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হয় যে আমার জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর কি না, সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু ২৫ ডিসেম্বর যে যিশু ও জিন্নাহর বানানো জন্মদিন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় খণ্ডে পঁচিশে ডিসেম্বর নিয়ে যেসব প্রচারণা রয়েছে তা বিশ্লেষণ করা হবে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, শুধু আমার জন্মদিন নয়, ভারত ও বাংলাদেশে জন্মদিন সংক্রান্ত তথ্যগুলি আদৌ নির্ভরযোগ্য কি না। এ প্রসঙ্গে ভারতে ২ হাজার ৪৫৬ জন আইএএস (IAS) কর্মকর্তার ও বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৯১ জন প্রাক্তন ছাত্রের জন্মদিন-সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়াতে, বিশেষ করে বাংলাদেশে ব্যক্তিদের ঘোষিত জন্মতারিখ এখনো নির্ভরযোগ্য নয়। প্রবন্ধের তৃতীয় খণ্ডে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রবন্ধটির চতুর্থ খণ্ডে সর্বনিম্ন বয়ঃসীমার রাজনৈতিক বিবেচনাগুলি আলোচিত হয়েছে। শুধু চাকরিতে নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও অনেক সময় সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা নির্ধারণ করা হয়। এ ধরনের বিধিনিষেধের যৌক্তিকতা এ খণ্ডে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রবন্ধটির পঞ্চম খণ্ডে জন্মদিন নিয়ে যেসব ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে এ প্রবন্ধের মূল বক্তব্যগুলি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে এবং কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে।