৩. দক্ষিণ এশিয়ায় ঘোষিত জন্মদিন কতটুকু সঠিক?

শিল্পোন্নত দেশগুলিতে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে জন্মনিবন্ধনের ব্যবস্থা রয়েছে। এর ফলে এসব দেশে জন্মদিন নিয়ে ফাঁকি-ফড়ির সুযোগ কম। দক্ষিণ এশিয়াতে এখনো নির্ভরযোগ্য জন্মনিবন্ধন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। তাই প্রশ্ন ওঠে, এখানে যেসব জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়, তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? এ প্রশ্ন পরীক্ষা করতে হলে সবার প্রকৃত জন্মতারিখ জানতে হবে। কিন্তু এ ধরনের উপাত্ত আমাদের কাছে নেই। তাই জন্মতারিখের নির্ভরযোগ্যতার প্রত্যক্ষ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। তবে পরোক্ষভাবে জন্মতারিখের নির্ভরযোগ্যতা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সংখ্যাতত্ত্বের নর্মাল নিবেশনসূত্র বা Law of normal distribution অনুসারে প্রতিদিন গড়ে সমসংখ্যক শিশুর জন্ম প্রত্যাশিত। কাজেই কোনো মাসে যদি ৩০ দিন থাকে তবে সে মাসে সারা বছরে যত শিশু ভূমিষ্ঠ হয় তার ৮.১৯ শতাংশ শিশু ভূমিষ্ঠ হবে । ৩১ দিনে মাস হলে ৮.৪৯ শতাংশ শিশু জন্মাবে আর ২৮ দিনের মাসে জন্ম নেবে ৭.৬৭ শতাংশ শিশু। যদি কোনো দেশে একটি বড় জনগোষ্ঠীর (ধরুন ৫০০-এর বেশি) জন্মতারিখের নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে কোনো কোনো মাসে ৮ শতাংশের অনেক বেশি বা অনেক কম জন্ম হয়েছে, তবে সেখানে জন্মতারিখের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্মতারিখের ওপর এ ধরনের গবেষণা হয়েছে। উইকিপিডিয়ার বিবরণ অনুসারে, এসব গবেষণার মূল বক্তব্য নিম্নরূপ :

ক) শুধু সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর মাস ছাড়া অন্য ১০টি মাসে প্রায় সমহারে শিশু জন্ম নেয়। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে জন্মের হার বেশি হওয়ার কারণ হলো, ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে রজনী হয় দীর্ঘতম। এই সময়টা নরনারীর মিলনের জন্য সুবিধাজনক। এই সময়ে সন্তান গর্ভে এলে পরবর্তী সেপ্টেম্বরে নয় মাস পূর্ণ হয়। (গর্ভাবস্থার গড় মেয়াদ ২৮০ থেকে ২৮৪ দিন)। তাই সেপ্টেম্বরে ও অক্টোবরে জন্মের হার বেড়ে যায়।

খ) ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্মদিন বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি শিশু জন্মে ১৬ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ এদের জন্মের সূচনা ডিসেম্বরে। সবচেয়ে কম শিশু জন্মায় ২৫ ডিসেম্বর। এর সঙ্গে বড়দিন বা ছোট রাত্রির কোনো সম্পর্ক নেই। এর বড় কারণ প্রাকৃতিক নয়, প্রশাসনিক। যেহেতু বেশির ভাগ ডাক্তার ২৫ ডিসেম্বর ছুটিতে থাকেন, সেহেতু তারা অনেক ক্ষেত্রে ক্রিসমাসের আগেই প্রসবের ব্যবস্থা করেন। তাই ২৫ ডিসেম্বরে অপেক্ষাকৃত কম শিশু জন্মায়।

গ) সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩৬৬ জন ব্যক্তির জন্মদিন-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হলে কমপক্ষে দুজন ব্যক্তির একই জন্মদিন হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১০০ শতাংশ। ৫৭ জন দৈবচয়নকৃত ব্যক্তির মধ্যে কমপক্ষে দুজনের অভিন্ন জন্মদিনের সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। আর ২৩ জনের মধ্যে কমপক্ষে দুজনের একই জন্মদিনের সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ।

এই প্রবন্ধে ভারত ও বাংলাদেশে জন্মতারিখের নির্ভরযোগ্যতা বিশ্লেষণ করার জন্য দুই ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রথমত, ভারতের ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের ২ হাজার ৪৫৬ জন কর্মকর্তার জন্মতারিখ বিশ্লেষণ করা হয়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৩ সালে যেসব ছাত্র মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে, তাদের মধ্য থেকে ৭৯১ জনের জন্মদিন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। উভয় দেশের জন্মদিন নিয়ে সমীক্ষাতেই শিক্ষিত লোকদের জন্মদিন সম্পর্কে উপাত্ত জোগাড় করা হয়েছে। এই দুটি সমীক্ষার একটিতেও কোনো অশিক্ষিত লোক অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এই সমীক্ষা দুটিতে যাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তাঁরা চাইলে তাদের জন্মদিন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য উপাত্ত দিতে পারেন। যদি এখানে ভুল উপাত্ত দেওয়া হয়, তবে তা ইচ্ছা করে দেওয়া হয়েছে। ভারতে ২ হাজার ৪৫৬ জন কর্মকর্তার জন্মদিনের উপাত্ত বিশ্লেষণ সারণি ৬.২-এ দেখা যাবে।

সারণি ৬.২

এই বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ১২ মাসের মধ্যে ১১ মাস মোট জন্মের শতকরা হার ৭ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে সীমিত ছিল। বিস্তারিত সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ছাড়াও এ কথা স্পষ্ট (কেননা মাসের মোট দিনভেদে এ সংখ্যা ৭.৬৭ থেকে ৮.৪৯ হতে পারে) যে এ ধরনের সংখ্যা মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো জুলাই মাস বা বাংলা পঞ্জিকায় আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। এ মাসে ১১ শতাংশ আইএএস অফিসারের জন্মদিন। এটা মাসিক প্রত্যাশিত গড়ের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। এর কারণ স্পষ্ট নয়। জানুয়ারি মাসে জন্মতারিখ বেশি হলে ধরে নেওয়া যেত, জন্মতারিখ না জানায় ভর্তির সময়ের কাছাকাছি একটি তারিখ স্কুলের নিবন্ধনের ফর্মে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে জন্মের হার বেশি। অনুমান করা হয়, এসব সন্তানের গর্ভাবস্থা শুরু হয় পূর্ববর্তী ডিসেম্বরে দীর্ঘতম রজনী ও তার কাছাকাছি সময়ে। এই সমীক্ষায় ভারতে সন্তান উৎপাদনে দীর্ঘতম রজনীর কোনো প্রভাব দেখা যায় না। ভারতীয়রা অবশ্য বিশ্বাস করে, নরনারীর জন্য সবচেয়ে রোমান্টিক সময় হচ্ছে বর্ষাকাল। কালিদাস মেঘদূত-এ আষাঢ়ের প্রথম দিনে নতুন মেঘ দেখে যক্ষের মনে যে ভাবের উদ্রেক হয় তা বর্ণনা করেছেন। বুদ্ধদেব বসু এই বর্ণনার নিম্নরূপ অনুবাদ করেছেন :

কামের উদ্রেক যে করে, সেই মেঘে সহসা দেখে তাঁর সমুখে

যক্ষ কোনোমতে চোখের জল চেপে ভাবলে মনে মনে বহুখন

নবীন মেঘ দেখে মিলিত সুখী-জন তারাও হয়ে যায় আনমনা।

কি আর কথা তবে, যদি সে দূরে থাকে সে চায় কণ্ঠের আলিঙ্গন।

কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রবণে

যদি না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গল বার্তা?

যক্ষ অতএব কুরচি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য

স্বাগত-সম্ভাষ জানাল মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।

নবীন মেঘের আবির্ভাবের সঙ্গে যদি প্রিয়ার আলিঙ্গনের জন্য দয়িতরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে, তাহলে আষাঢ়-শ্রাবণের ২৮০ দিন পর অনেক নতুন শিশুর জন্ম হওয়ার কথা। কালিদাসের অনুমান সঠিক হলে চৈত্র-বৈশাখে শিশু জন্মের হার বেশি হওয়া ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতীয় সমীক্ষায় জন্মের হার বেশি দেখা যাচ্ছে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। এর কোনো বোধগম্য ব্যাখ্যা দেখা যাচ্ছে না। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যারা বেরিয়ে যান তাঁদের জন্মদিন বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সারণি ৬.৩-এ দেখা যাবে।

সারণি ৬.৩

সারণি ৬.৩ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২২.৩ শতাংশ পুরুষ এবং ২১.৬৮ শতাংশ মহিলা জানুয়ারি মাসে জন্মেছেন। জানুয়ারি মাসে এত উঁচু হারে জন্মের কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। এর একমাত্র সহজ ব্যাখ্যা হলো, জানুয়ারি মাসে শিক্ষাবছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়। ওই সময়ে যেসব ছাত্রছাত্রী তাদের সঠিক জন্মদিন জানে না, স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের জন্মদিন পয়লা জানুয়ারি বা তার কাছাকাছি সময়ে লিখে দেয়। এর ফলে বিদ্যালয়ের সনদে উল্লেখিত জন্মতারিখ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুয়া ও কল্পিত।

ভারতীয় আইএএস অফিসারদের তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্মদিন অনেক বেশি ভুয়া মনে হয়। এর একটি কারণ হতে পারে, ভারতীয় আইএএস অফিসারদের সিংহভাগ অভিজাত হিন্দু পরিবারের সন্তান। এদের প্রায় সবারই কুষ্ঠি আছে। তাই তারা সঠিক জন্মদিন জানেন। এর ফলে এঁদের জন্মতারিখ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। পক্ষান্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রীই জানেন না তারা কখন জন্মেছেন।