৫. জন্মদিনের অর্থনীতি

অর্থনীতির চাহিদা ও জোগানের সূত্র ভবিষ্যদ্বাণী করে, ক্রেতারা যা কিনতে চায় বাজারে তারই বিকিকিনি হয় । কিন্তু প্রখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ গলব্রেথ মনে করেন যে শুধু চাহিদা জোগান সৃষ্টি করে না; পক্ষান্তরে জোগানও চাহিদার সৃষ্টি করে। যে পণ্য ক্রেতা কখনো দেখেনি, জোগানদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তার চাহিদা সৃষ্টি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে একজন পণ্ডিত ঠিকই লিখেছেন, ‘To sell something to some one who wants it is not business. But to sell something you do not have to some one who does not want it that is business.’(কেউ যা চায় তা বেচাকে প্রকৃত অর্থে ব্যবসা বলা যায় না। তবে বিক্রেতার কাছে যা নেই এবং ক্রেতা যা চায় না তা বিক্রয় করতে পারাটাই আসল ব্যবসা)।

বিক্রেতাদের জন্য জন্মদিন একটি বড় সুযোগ। জন্মদিনের উৎসবে বাচ্চারা সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায়। বাপ-মায়েরাও বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য খরচের ভয়ে পিছিয়ে আসতে চায় না। যিশুর জন্মদিন তাই বাজার সৃষ্টির একটি অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে। তবে শিল্প বিপ্লবের আগে এ ধরনের সুযোগের ব্যবহার সহজ ছিল না, কেননা তখন পণ্য ও সেবার জোগান ছিল সীমিত। শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা লোককাহিনির সান্তা ক্লজকে বাজার সৃষ্টির হাতিয়াররূপে গড়ে তোলে।

পণ্ডিতেরা মনে করেন, চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দের গ্রিক ধর্মযাজক সেন্ট নিকোলাসের আদলে সান্তা ক্লজ চরিত্রটি সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করে যে তিনি বাচ্চাদের উপহার দিতে ভালোবাসতেন। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে যখন হল্যান্ডের রমরমা অবস্থা, তখন ওলন্দাজদের মধ্যে ক্রিসমাসের আগে সেন্ট নিকোলাসের আবির্ভাব উপলক্ষে বাচ্চাদের উপহার দেওয়ার রীতি গড়ে ওঠে। তবে সারা ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায় সেন্ট নিকোলাস সান্তা ক্লজ নামে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের পর। এই সময়ে সান্তা ক্লজকে নিয়ে অনেক বই প্রকাশিত হয়। মোটা নাদুসনুদুস লাল রঙের পোশাক পরিহিত এই সাধু থাকেন উত্তর মেরুতে। তিনি নয়টি অতি দ্রুতগামী হরিণে-টানা-গাড়িতে চলাফেরা করেন। বাচ্চাদের প্রার্থিত সব উপহার তিনি ক্রিসমাসের আগের রাতে নিয়ে আসেন। চিমনি দিয়ে বাড়িতে ঢুকে তিনি বাচ্চাদের উপহার ক্রিসমাসের গাছের নিচে রেখে যান। ব্যবসায়ীরা সান্তা ক্লজের এই ভাবমূর্তিকে তাদের বিপণনের কাজে লাগান। লোক ভাড়া করে তাঁদের সান্তা সাজানো হয়। তারা মোটা হলে ভালো, না হলেও অসুবিধা নেই। পেটে বালিশ বেঁধে তাদের মোটা করা যায়। রংচঙে পোশাকে সান্তাকে দোকানে বসানো হলো। তাঁর বসার জায়গার আশপাশে তার বাহক হরিণদের মূর্তি স্থাপন করা হলো। বড় বড় দোকানে সান্তার দরবার বসানো শুরু হয়। দলে দলে বাচ্চারা দোকানে ভিড় জমায়। সান্তার বদৌলতে ব্যবসায়ীদের কামাই বেড়ে গেল। ধর্মযাজকেরা খুশি যে শিশুরা যিশুর জন্মদিন জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করায় ধর্মের প্রসার ঘটছে। বাপ-মায়েরা খুশি, বাচ্চারা আনন্দে লাফাচ্ছে। দোকানিরাও সমভাবে উপকৃত হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এখানে কারও কোনো আপত্তির কারণ নেই। কিন্তু এখানে একটি বড় নৈতিক প্রশ্ন উপেক্ষা করা হচ্ছে। সান্তা চিমনি দিয়ে ঢুকে বাচ্চাদের উপহার দিয়ে যায়–এই খবরটি একেবারেই মিথ্যা। তবু প্রতিবছর ক্রিসমাসের সময় এ মিথ্যা বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে। মিথ্যার ওপর ভর করে চলছে বড়দিনের রমরমা ব্যবসা।

সান্তা ক্লজ যিশুর জন্মদিনে বিপণনের একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু জন্মদিনের বাজার অনেক বড়। সান্তা ক্লজ সাধারণ মানুষের জন্মদিনে বড় ধরনের চাহিদা সৃষ্টি করতে পারেনি। খুব কম লোকই নিজের জন্মদিনে নিজের জন্য উপহার কেনে। জন্মদিনের উপহার আসে অন্যদের কাছ থেকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই লিখেছেন, ‘নিজের জন্মদিন বৎসরের অন্য ৩৬৪ দিনের চেয়ে নিজের কাছে কিছুমাত্র বড় নয়। যদি অন্যের কাছে তার মূল্য থাকে তবেই তার মূল্য।’ এখানে একটি বড় সমস্যা হলো, অন্যরা প্রিয়জনের জন্মদিন মনে রাখতে পারে না। এ ক্ষেত্রে বাজার সৃষ্টি করতে হলে প্রিয়জনদের জন্মদিন যথাসময়ে মনে করিয়ে দিতে হবে । এ কাজটি সান্তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এত দিন সান্তা যা করতে পারেনি, তা সাফল্যের সঙ্গে এখন ইন্টারনেট করছে। ফেসবুক, টুইটার–এ ধরনের সামাজিক জাল প্রতিদিন আগে থেকে প্রিয়জনদের জন্মদিন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। উপরন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে উপহার বিপণন সহজ হয়ে যাচ্ছে। সেদিন দূরে নয়, যখন ইন্টারনেটকে ভিত্তি করে জন্মদিনের একটি সুসমন্বিত বাজার গড়ে উঠবে।

ব্যক্তির জন্য সঠিক জন্মতারিখ গুরুত্বপূর্ণ না হলেও রাষ্ট্রের জন্য তা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ভোটাধিকারের জন্য সঠিক জন্মদিন জানা দরকার । শিশু অধিকার নিশ্চিত করার জন্য জন্মের তারিখ জানতে হবে । শিশু ও বৃদ্ধদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সম্ভাব্য উপকারভোগীদের সঠিক জন্মতারিখের প্রয়োজন। তাই আধুনিক রাষ্ট্রে জন্মনিবন্ধন-ব্যবস্থা রাষ্ট্রের খরচে গড়ে তোলা হচ্ছে। আবার ব্যবসায়ীরাও সঠিক জন্মতারিখ সম্পর্কে উপাত্ত চায়। তাদের বিপণন রণকৌশলের জন্য জন্মতারিখ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ীরা জানতে চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের জন্মদিন নিয়ে আগ্রহ নেই। তাই আইন করে ব্যক্তিকে বাধ্য না করলে জন্মদিন নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে না।