৬. উপসংহার,

বাংলা প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘জন্ম মৃত্যু বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে।’ অর্থাৎ জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ে–এ তিন ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করেন বিধাতা, এতে মানুষের কোনো হাত নেই। বাঙালিদের এ আপ্তবাক্যের সারবত্তা মূলধারার অর্থনীতিবিদেরা মানেন না। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ গ্যারি এস বেকার (১৯৭৬) মনে করেন যে বিয়ে ও জন্ম অর্থনীতির সূত্র মেনে চলে। বিধাতার খেয়ালিপনা বিয়ে ও জন্মের নিয়ামক নয়। কপাল ভালো, অর্থনীতিবিদেরা এখন পর্যন্ত আজরাইলকে রেহাই দিয়েছেন। মৃত্যুর মতো রসকষহীন বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে বিয়ে ও সন্তান উৎপাদন সম্পর্কে গ্যারি এস বেকারের বক্তব্য হলো, ব্যক্তির আয়-ব্যয় ও লাভ-ক্ষতি হচ্ছে এসব বিষয়ের নিয়ামক। বেকার মনে করেন, সন্তান হচ্ছে একটি বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগের ব্যয় হচ্ছে গর্ভকালে মায়ের আয় হ্রাস, বাচ্চা প্রতিপালনের ব্যয়, বাচ্চাকে শিক্ষিত করার ব্যয় ইত্যাদি। অন্যদিকে বাচ্চা পয়দার আয় শুধু বৃদ্ধ বয়সে অসমর্থ পিতা-মাতাকে আর্থিক সাহায্যে সীমাবদ্ধ। নয়। বাচ্চাকে মানুষ করার যে অনাবিল আনন্দ, তাকেও একধরনের মানসিক আয় গণ্য করা যেতে পারে। যদি বাচ্চা উৎপাদনের ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হয়, তবেই বাচ্চার জন্ম হয়। এ বিষয়ে আরেক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ টি ডাবলু শুলজ (১৯৭৪) একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে অর্থনীতির তত্ত্ব কারা বাপ-মা হতে চাইবেন, সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। কিন্তু তারা কখন তাদের বাচ্চার জন্ম দেবেন, সে সম্পর্কে তাদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব হয়নি।

অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন যে যখন রাত্রি দীর্ঘ হয় তখন নরনারীর মিলন সহজ হয়। তাই দীর্ঘ রজনীর নয় মাস পর সেপ্টেম্বরে আমেরিকাতে বাচ্চা জন্মের হিড়িক পড়ে যায়। ১৬ সেপ্টেম্বর সবচেয়ে বেশি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। তবে শীতকালে রাত বড় শুধু এই কারণে নরনারীর মিলন বেড়ে যায়, এই অনুমান সঠিক নয়। শীতকালের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে শীতকালে মানুষ ঘরে আবদ্ধ থাকে। এর ফলে নরনারীর মিলন সহজ হয়। ভারতে তাই বিশ্বাস করা হয়, নরনারীর সর্বাধিক মিলন ঘটে বর্ষাকালে। কালিদাস থেকে রবি ঠাকুর–সব কবিই বর্ষার সঙ্গে প্রেমের ও কামের সংযোগ দেখতে পেয়েছেন। তবে বর্ষা শুধু আষাঢ়-শ্রাবণে সীমাবদ্ধ। নয়। নরনারীর এ মৌতাত শরৎ অবধি গড়ায়। তাই তো বৈষ্ণব কবি লিখেছেন, ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর। অবশ্য ভারত ও বাংলাদেশের জন্মদিনের বিশ্লেষণ করলে জন্মের তারিখের ওপর বর্ষার কোনো তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব দেখা যায় না।

সরকারি দলিল-দস্তাবেজে যে জন্মতারিখ দেখা যায় তা কতটুকু সঠিক, তা নিয়ে তর্কের অবকাশ রয়েছে। স্পষ্টতই, বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের জন্মতারিখ মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়। বাংলাদেশে জানুয়ারি মাসে ২০ ভাগের বেশি মানুষের জন্ম হওয়া অস্বাভাবিক। তবে ভারতে জন্মদিন সম্পর্কে প্রাপ্ত উপাত্তগুলি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। ভারতের অনেকেরই কুষ্ঠি আছে। তাই তারা সঠিক জন্মতারিখ জানেন। ভারতীয়দের জন্মদিন অধিক নির্ভরযোগ্য মনে হয়। তবে নির্ভরযোগ্য জন্মতারিখ নিশ্চিত করার জন্য জন্ম নিবন্ধনের বিকল্প নেই।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ও অবসরের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় বয়ঃসীমা-সংক্রান্ত নিয়মাবলির মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক আমলে বয়ঃসীমা নির্ধারণের প্রধান নিয়ামক ছিল সরকারের রাজনীতি। ব্রিটিশ শাসকেরা চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ সময়সীমা কমিয়ে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। এর কারণ ছিল যে ঔপনিবেশিক শাসকেরা মনে করতেন, অল্প বয়সের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়েপিটে মানুষ করা সম্ভব। কিন্তু বেশি বয়সের প্রার্থীদের চরিত্র ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট আকার ধারণ করেছে। এদের আচার-আচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব নয়। বাস্তবে আধুনিক রাষ্ট্রগুলিতে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীগুলিকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার জন্য চাকরিতে নিয়োগের বয়ঃসীমা ক্রমশ বাড়ানো হচ্ছে। উপরন্তু গড় আয়ুর প্রত্যাশা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবসর গ্রহণের সীমাও বেড়ে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলিতে অনেক ক্ষেত্রেই অবসরের জন্য কোনো নির্ধারিত বয়স নেই। কর্মচারীরা যত দিন খুশি চাকরি করতে পারেন। তবে পদ উঠে গেলে চাকরি চলে যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চাকরি করতে পারেন। আমেরিকানরা তাই বলে থাকে, বিচারকদের নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হলেও তাদের অপসারণের ক্ষমতা ভগবানের।

ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতে শিক্ষার ক্ষেত্রেও সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা প্রবর্তন করে। দুষ্ট লোকেরা বলে, শিক্ষকেরা এ ব্যবস্থাকে তাদের স্বার্থে সমর্থন করেন। প্রতিভাবান ছাত্ররা যদি ডাবল/ট্রিপল প্রমোশন নিয়ে তরতর করে পাস করে যায়, তবে বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র কমে যাবে। অনেক অভিভাবকই মনে করেন যে তাঁদের প্রতিভাবান সন্তানদের দ্রুত প্রমোশন দিয়ে ওপরের দিকে নিয়ে গেলে তারা অসাধারণ প্রতিভা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, এ ধারণা ভুল। অল্প বয়সের বাচ্চাদের অতি দ্রুত প্রমোশনের বিপক্ষে শিক্ষকদের আপত্তির কারণ রয়েছে। শিক্ষা শুধু জ্ঞান লাভের জন্য নয়, শিক্ষার একটি বড় দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। যেসব ছাত্র সাততাড়াতাড়ি ওপরের ক্লাসে উঠতে থাকে, তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয় না। তাদের সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার সময় থাকে না। চতুর্থ খণ্ডের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বের তরুণতম স্নাতকদের অনেকেই স্বাভাবিক শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে পরবর্তী জীবনে অনুশোচনায় ভুগেছেন। পক্ষান্তরে বিশ্বের তরুণতম স্নাতকেরা কেউই এখন পর্যন্ত কেষ্টবিষ্ট হননি। বাঙালি মনীষীরা অনেক আগেই বলে গেছেন, কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না। প্রতিভাবান বালকদের পিতামাতারা এ আপ্ত বাক্য মনে রাখলে উপকৃত হবেন।

জন্মদিনের বাণিজ্য শুরু হয় যিশুর জন্মদিন নিয়ে। ইন্টারনেটের সম্প্রসারণের ফলে জন্মদিনের ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ অনেক বেড়ে গেছে। ইন্টারনেটে সামাজিক জালগুলিতে সবার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের জন্মদিন মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বৈদ্যুতিন বাণিজ্যের (e-commerce) মাধ্যমে সহজে পৌঁছানো যাচ্ছে উপহার। একদিকে জন্মদিন নিয়ে বাণিজ্য বাড়ছে। অন্যদিকে গড় আয়ুর প্রত্যাশা বাড়ছে। আরও বেশিদিন ধরে অনেক জন্মদিন পালন চলবে।

জন্মদিনের এই অগ্রগতির দিনে বেকায়দায় পড়েছেন আমার মতো কিছু লোক, যারা তাদের সঠিক জন্মদিন জানেন না। একজন জ্ঞানী বন্ধুর কাছে এ সম্পর্কে পরামর্শ চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে একটি গল্প শোনালেন। একজন আলেম ও একজন নাস্তিক খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। নাস্তিক বন্ধুটি দুঃখ করে বলল, নাস্তিকতায় সবই ভালো, শুধু একটি অসুবিধা। নাস্তিকদের কোনো মহাপুরুষ নেই। তাই তারা মহাপুরুষদের জন্মদিনে আমোদ-আহ্লাদ করতে পারে না, যেমনটি খ্রিষ্টানরা করে যিশুর জন্মদিনে, যেমনটি হিন্দুরা করে কৃষ্ণের জন্মদিনে, যেমনটি মুসলমানেরা করে ঈদে মিলাদুন্নবিতে। আলেম সাহেব বললেন, ‘তোমাদের যখন কোনো মহাপুরুষও নেই, জন্মদিনও নেই, তখন তোমরা ১ এপ্রিলে বিশ্ব বেকুব দিবস (All Fools Day) পালন করো।’ আমি জ্ঞানী বন্ধুর পরামর্শ বুঝতে পারি, তবে আমি তার কথা শুনিনি। যদি জন্মদিন না হওয়া সত্ত্বেও যিশু ও জিন্নাহর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর প্রতিপালিত হতে পারে, তবে আমার জন্মদিনও ২৫ ডিসেম্বরেই হবে–এই আমার অসিয়ত ।

উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)

  • ওয়ালপার্ট, স্ট্যানলি (Wolpert, Stanley)। ১৯৯৪। Jinnah of Pakistan. New York: Oxford University Press.
  • কালিদাস। ১৯৯৯। মেঘদূত। অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু। ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স।
  • চৌধুরানী, সরলাদেবী। ২০০৯। জীবনের ঝরাপাতা। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং।
  • বেকার, গ্যারি এস (Becker, Gary S.)। ১৯৭৬। The Economic Approach to Human Behavior. Chicago: Chicago University Press.
  • ব্যানার্জি, অভিজিৎ ভি এবং এসথার ডাফলো। (Banerjee, Abhijit V. and Esther Duflo) । ২০১১ । Poor Economics. Norda: Random House, India.
  • ম্যাকগোয়ান, অ্যান্ড্রু (McGowan, Andrew)। ২০০৯। How December 25 became Christmas. www.Plaintruthmagazine. Blogspot. Com/2009/12.
  • ম্যাডিসন, অ্যাংগাস (Angus Maddison। ২০০১, The World Economy: A Millennial Perspective. Paris: OECD.
  • রেমন্ড, কিল্ডাফ (Raymond, Kilduff)। ১৯৮৬। The Christian Tradition: The Birthday of The Sun’. The Sun Francisco Jung Institute Library Journal. Vol. 6. No. 2.
  • শুলজ, টি, ডাবলু। (Schultz, T.w.)। (সম্পাদিত)। ১৯৭৪। Economics of the Family. Marriage, Children and Human Capital. Chicago and London: University of Chicago Press.