৪. জন্মদিনের রাজনীতি : চাকরি ও বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা কতটুকু যৌক্তিক?

ইংরেজি একটি প্রবাদে বলা হয়ে থাকে, যারা সত্যিকার বন্ধু তারা বন্ধুর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে কখনো ভোলে না, তবে ভুলেও জিজ্ঞেস করে না কতটি জন্মদিন পার হলো। ভারতবর্ষেও কুষ্ঠি তৈরি ছাড়া অন্য কোনো কাজে জন্মদিন নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। ইংরেজদের ভারত দখলের আগে চাকরিতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বয়ঃসীমা ছিল না। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ারও কোনো নির্ধারিত বয়স ছিল না। বাদশাহ খোশ হলে নোকরি মিলত, বাদশাহ নাখোশ হলে চাকরি খতম হয়ে যেত। ব্রিটিশরা ভারতে প্রথম চাকরিতে যোগদান আর অবসরের সময়সীমা নির্ধারণ করে। এর ফলে প্রকৃত বয়স লুকিয়ে বয়স কম করে দেখানোর প্রবণতা দেখা দেয়। সবাই বয়স কম দেখিয়ে বেশি দিন চাকরি করতে চায়। এই প্রবণতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানের পরও সক্রিয় রয়েছে। এমনকি, দীর্ঘদিন চাকরির পরও অনেক উচ্চপদস্থ আমলা তাদের বয়স কমিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়াতে চায়। ২০০১ সালে বাংলাদেশে একজন সংস্থাপন সচিব বয়স জাল করে নিজের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করেন। অথচ তার একটি বড় দায়িত্ব ছিল কেউ যেন জাল-জালিয়াতি করে বয়স না কমাতে পারে, তা নিশ্চিত করা। হাতেনাতে ধরা পড়ার পর তার চাকরি চলে যায়। ভারতে ২০১১-১২ সময়কালে সেনাপ্রধান ভি কে সিং তার নিজের বয়স কমানোর চেষ্টা করেন। চাকরি নেওয়ার সময়ে তার জন্মতারিখ লেখা হয় ১০ মে ১৯৫০। তিনি দাবি করেন, তাঁর প্রকৃত জন্মতারিখ ঠিক এক বছর পর ১০ মে ১৯৫১। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ দাবি অগ্রাহ্য করেন। ভি কে সিং সুপ্রিম কোর্টে ভারত সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট শুনানির সময় একটি বিষয়ের ওপর জোর দেন। চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেকেই জন্মতারিখ এগিয়ে আনতে চান। এ ধরনের লক্ষাধিক আবেদন বিভিন্ন হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করেছে। কাজেই আদালত ভি কে সিংকে এ আবেদন প্রত্যাহারের পরামর্শ দিলে তিনি তা মেনে নেন।

ভারতে গড় আয়ুর প্রত্যাশার তুলনায় ব্রিটিশ আমলে চাকরির অবসরের সময়সীমা যথেষ্ট উদার ছিল। তাই এ নিয়ে খুব একটা অসন্তোষ ছিল না।

ব্রিটিশ সরকারের রাজনীতির খেল ছিল চাকরিতে নিয়োগের সর্বোচ্চ বয়ঃসীমা নিয়ে। ব্রিটিশ শাসকেরা দেশি কর্মকর্তাদের চেয়ে বিলাতের সাহেবদের চাকরি দিতে পছন্দ করতেন। জন্মসূত্রে সাহেব না হলে চাকরি দেওয়া যাবে না, এ ধরনের শর্ত ছিল স্পষ্টত বৈষম্যমূলক। তাই তারা একই উদ্দেশ্যে ভিন্ন ধরনের শর্ত আরোপ করেন। সবচেয়ে কঠিন শর্ত হলো, চাকরিতে যোগদানের বয়ঃসীমা কমানো। আইসিএসের ক্ষেত্রে এ সীমা অনেক সময় ১৮/১৯-এ নামিয়ে আনা হয়। এ ধরনের বয়ঃসীমার পক্ষে যুক্তি ছিল, অল্প বয়সের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের স্বভাব ও চরিত্র চাকরির উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু বেশি বয়সে নিয়োগ দেওয়া হলে নতুন কর্মকর্তারা তাদের বদ অভ্যাস নিয়ে আসবেন। তাদের অভ্যাস আদৌ বদলানো সম্ভব হবে না। অন্যদিকে এই ব্যবস্থার সমালোচকেরা দাবি করেন, যে বয়ঃসীমা কম হলে গরিবের সন্তানেরা, যাঁরা অল্প বয়সে সুযোগের অভাবে লেখাপড়া শুরু করতে পারেন না, তাঁরা বৈষম্যের শিকার হন। এখানে দুটি পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি কাজ করছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে চাকরির বয়ঃসীমা যথেষ্ট বেশি (ধরুন ৩৫-৪০ বছর) হওয়া উচিত। অন্যদিকে প্রশাসনিক দিক থেকে অল্প বয়সের কর্মকর্তাদের গড়েপিটে সংগঠনের উপযোগী করা সম্ভব। কাজেই প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে চাকরির বয়ঃসীমা যত কম করা যায় ততই মঙ্গল।

সরকারি চাকরিতে অবসর গ্রহণের বয়ঃসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও দুটি স্বার্থগোষ্ঠী রয়েছে। যারা প্রবীণ, তাঁরা চাকরিতে থাকতে চান। প্রবীণদের যুক্তি হলো, তাঁদের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তাঁরা অনেক বয়স পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকেন, কাজেই তাদের অবসরে পাঠিয়ে আনকোরা কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে সরকারের ব্যয় বাড়বে; কেননা, অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন দিতে হবে এবং নবনিযুক্তদের বেতন দিতে হবে। অনেক উন্নত দেশে চাকরিতে অবসরের বয়ঃসীমা একেবারে তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মচারীরা নিজেরা ঠিক করেন কখন তারা অবসর নেবেন। অন্যদিকে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের হার কমে গেলে নতুন নিয়োগ কমে যাবে। নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ কমে গেলে প্রশাসনে নবীনদের নতুন ধ্যানধারণা ঢুকতে পারবে না।

বয়ঃসীমা নিয়ে বিতর্ক শুধু সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বা গণপরীক্ষাতে অংশগ্রহণের জন্য কোনো সর্বনিম্ন বয়ঃসীমার প্রয়োজন আছে কি না, সে সম্পর্কেও বিতর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে এ দেশে নিয়ম করা হয়, অতি অল্প বয়সে ছাত্রদের স্কুলে ভর্তি করা যাবে না। অবশ্য এ নিয়মের সমর্থকেরা মনে করেন যে নিয়মটি ব্রিটিশরা রাজনৈতিক কারণে করেনি। এর পেছনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি রয়েছে। অল্প বয়সের প্রতিভাবান শিশুদের ডাবল প্রমোশন বা ট্রিপল প্রমোশন দিয়ে ডিগ্রি দিলে তাদের ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটবে না। তারা সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না। শিক্ষা শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়। শিক্ষার অন্যতম দায়িত্ব হলো ব্যক্তিকে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, যাতে সে সমাজের সবার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে। গণপরীক্ষাতে অংশগ্রহণের জন্য তাই সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা থাকা উচিত। এ নিয়মের বিরোধীরা বলেন, এগুলি হচ্ছে শিক্ষকদের পেশাগত স্বার্থ রক্ষার জন্য জারিজুরি। যদি প্রতিভাবান ছাত্রদের দ্রুত পাস করতে দেওয়া হয়, তবে ছাত্রসংখ্যা কমে যাবে। তাই শিক্ষকেরা প্রতিভাবান ছাত্রদের তাড়াতাড়ি পাস করাতে আগ্রহী নয়। পক্ষান্তরে, প্রতিভাবান ছাত্ররা যথাযথ স্বীকৃতি না পেলে গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়। তাদের প্রতিভার বিকাশ ব্যাহত হয়। যদিও বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা ঔপনিবেশিক আমলে চালু হয়, তবে নিয়মটির যথার্থতা নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে এখনো বিতর্ক চলছে।

এই বিতর্ক মীমাংসার একটি উপায় হলো, যারা বিশ্বে সবচেয়ে কম বয়সে ডিগ্রি অর্জন করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করা। পৃথিবীর কনিষ্ঠতম স্নাতকদের জীবনবৃত্তান্ত ব্লগে দেখা যাবে।

Accredited online colleges-এর মধ্যে রয়েছেন একজন ভারতীয়। তাঁর নাম তথাগত অবতার তুলসী । তিনি ৯ বছরে হাইস্কুলের পাঠ শেষ করেন; ১০ বছর বয়সে পাটনা থেকে বিএসসি পাস করেন; ১২ বছর বয়সে পাটনা বিজ্ঞান কলেজ থেকে এমএসসি পাস করেন। এসব ডিগ্রি সাততাড়াতাড়ি পেলেও তার পিএইচডি করতে নয় বছর লাগে। তিনি বর্তমানে মুম্বাইয়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়াচ্ছেন। তার বয়স এখন ৩৭। এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো অসাধারণ অবদানের কথা শোনা যায়নি।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ আইকিউর অধিকারী শো ইউয়ানো চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। ১২ বছর বয়সে তিনি স্নাতক হন, ১৮ বছরে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এখন ডাক্তারি পড়ছেন। ক্যাথলিন হলজ ১৫ বছর বয়সে স্নাতক হন এবং ১৮ বছর বয়সে আইন পাস করেন। তিনি বর্তমানে আইন পেশায় নিয়োজিত। মার্কিন নাগরিক আলিয়া সবুর আট মাস বয়সে পড়তে শুরু করেন। তিনি চতুর্থ শ্রেণী থেকে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮ বছর বয়সের মধ্যে ম্যাটেরিয়াল বিজ্ঞান প্রকৌশল শাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পৃথিবীর কনিষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। মাইকেল কারনি ১০ বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এখনো পড়াশোনা করছেন। গ্রেগরি স্মিথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ এক বছরে সাঙ্গ করেন। দুই বছরে হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন। ১৩ বছর বয়সে কলেজের ডিগ্রি পান। বর্তমানে তিনি পিএইচডি করছেন। তবে সব প্রতিভাবানের পক্ষে তাড়াহুড়ো করে ডিগ্রি অর্জনের অভিজ্ঞতা সমান সুখকর হয়নি। এ প্রসঙ্গে আড্রাগন দি মালোর উদাহরণ স্মরণ করা যেতে পারে। বাপ মায়ের চাপে পড়ে তিনি ১১ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর লেখাপড়ার চাপে তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তাকে নিয়ে ঝগড়া করে বাপ-মায়ের বিয়ে ভেঙে যায়। স্বাভাবিকভাবে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়াশোনার সুযোগ না পাওয়ার জন্য তিনি অনুতাপ বোধ করেন। তিনি এখন লেখাপড়া ছেড়ে দোকানে বিক্রেতার কাজ করছেন। আরেকজন প্রতিভাবান ছাত্রের নাম মোশে কাই কাভালিন। আট বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। যথাসময়ে নভঃপদার্থবিদ্যা বা asrtrophysics শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।

ওপরের পর্যালোচনা থেকে দুটি অনুমানের সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমত, এটা অনুমান করা ঠিক নয় যে বাল্যকালে যারা অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন, তারাই পরবর্তী জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা হিসেবে আবির্ভূত হন। ওপরের আলোচনায় আটজন অসাধারণ অল্প বয়সের শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে এঁদের অধিকাংশই কর্মজীবনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। পক্ষান্তরে যারা শৈশবে প্রতিভার স্বাক্ষর দেখাতে পারেননি, তাঁদের অনেকেই হবেন আজকের আইনস্টাইন, প্লেটো, শেকস্‌পিয়ার ও রবি ঠাকুর। কাজেই অতি প্রতিভাবান শিশুদের শিক্ষা নিয়ে এত হইচইয়ের কারণ নেই।

দ্বিতীয়ত, শুধু পরীক্ষায় ভালো করলেই শিক্ষিত হওয়া যায় না। প্রকৃত শিক্ষার জন্য সুষ্ঠু ব্যক্তিত্বের বিকাশের প্রয়োজন রয়েছে। তাড়াতাড়ি ডিগ্রি অর্জনের জন্য বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাতে তারা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। ওপরে বর্ণিত আটজন প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীর মধ্যে অন্তত একজন তাড়াতাড়ি ডিগ্রি অর্জন করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আরেকজন দ্রুততার সঙ্গে তাল মিলাতে ব্যর্থ হয়ে হাঁপিয়ে পড়েছেন। কাজেই শিক্ষাব্যবস্থায় ভর্তিসংক্রান্ত নিয়মকানুন পরিবর্তন করার আগে ভালোভাবে লাভক্ষতি বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে ।