৪. উপসংহার

ওপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে সরকারের কর্মকাণ্ডে ব্যাপক হারে মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনা ঘটে। এর অর্থ এই নয় যে সরকার যা করে তার সবই অকল্যাণকর। সরকার নিঃসন্দেহে অনেক ভালো কাজও করে। তবে সমস্যা হলো সরকার সব সময় ভালো ও খারাপ কাজের মধ্যে তফাত করতে পারে না। আমলাতন্ত্র কখনো ভুল স্বীকার করতে চায় না। সরকারি কাগজপত্রে তাই মিত্রপক্ষের হামলার কোনো স্বীকৃতি দেখা যায় না।

সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় মিত্রপক্ষের গুলি হচ্ছে কোনো সরকারি কাজের অনভিপ্রেত পরিণতি। অনভিপ্রেত ফলাফল সব সময় ক্ষতিকর হয় না। কখনো কখনো ভালোও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাত বৈধকরণের ঘটনাটিই স্মরণ করা যেতে পারে। এর সমর্থকেরা আশা করছিলেন যে গর্ভপাত বৈধ হলে মায়েরা অনভিপ্রেত সন্তানের দায় থেকে মুক্তি পাবে। এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে, গর্ভপাত বৈধকরণ শুধু মায়েদের অধিকারই বাড়িয়ে দেয়নি; এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের হার অনেক কমে যায়, কেননা অধিকাংশ অনভিপ্রেত সন্তানই অপরাধ জগতে বিচরণ করত। এ ক্ষেত্রে অপরাধের হার হ্রাস একটি অপ্রত্যাশিত লাভ। অনেকটা ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে ধরনের ঘটনা।

বিশেষ উদ্দেশ্যে গৃহীত সামাজিক কর্মসূচির অপ্রত্যাশিত ফলাফল সম্পর্কে গবেষণা করেছেন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কে মার্টন (১৯৩৬)। সব অপ্রত্যাশিত ফলাফলই অনভিপ্রেত নয়। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত ফলাফল বাঞ্ছনীয়ও হতে পারে। তবে সব অনভিপ্রেত ফলাফলই অপ্রত্যাশিত। যদি কেউ বিরূপ ফলাফল প্রত্যাশা করে থাকেন, তবে তার জন্য এ ফলাফল অনভিপ্রেত না-ও হতে পারে। মার্টন মনে করেন, নিম্নলিখিত পাঁচটি কারণে বিভিন্ন কর্মসূচির অপ্রত্যাশিত ফলাফল দেখা দিতে পারে :

  • অজ্ঞতা : মানুষের জ্ঞান অসম্পূর্ণ। কাজেই কখনো সবকিছু জেনে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। সব সময় বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। আমরা তাই ব্যক্তিগত মতামত ও বিভিন্ন অনুমানের ভিত্তিতে কাজ করি। যত জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গৃহীত হবে ততই অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
  • ত্রুটি : মার্টন বলছেন, চার পর্যায়ে ত্রুটি দেখা দিতে পারে। প্রথমত, যে সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সে সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ ভুল হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশ্লেষণ ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। তৃতীয়ত, করণীয় ব্যবস্থা নির্বাচনে ত্রুটি হতে পারে। চতুর্থত, করণীয় ব্যবস্থা সঠিকভাবে নির্বাচিত হলেও এর বাস্তবায়ন ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। উপরন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি বড় ভুল করা হয়। ধরে নেওয়া হয় যে অতীতে যা কাজ করেছে ভবিষ্যতেও তা কাজ করবে। অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের অনুমান ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে।
  • তড়িঘড়ি কিছু করার বাধ্যবাধকতা (imperious immediacy of interest) : অনেক সময় এমন সমস্যা দেখা দেয়, যার সমাধান নিশ্চিতভাবে জানা নেই। অথচ সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু উদ্যোগ নিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চিত বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা জেনেও ব্যবস্থা নিতে হয়। যেমন ধরুন, কোনো একটি শহরে নদী অতি দ্রুত ভাঙছে। অথচ এর সঠিক সমাধান এই মুহূর্তে জানা নেই। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ চটজলদি সমাধান চায়। তাই জরুরি ব্যবস্থা নিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে অনভিপ্রেত ফলাফল দেখা দিতে পারে।
  • মূল্যবোধে বৈপরীত্য : মার্টনের মতে, যারা মূল্যবোধের দ্বারা তাড়িত, তারা ফলাফলের দিকে তাকিয়ে কাজ করে না। তারা যান্ত্রিকভাবে ধর্মীয় নির্দেশ বা মূল্যবোধ মেনে চলে; এতে তাদের লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে কি না, তা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায় না। প্রোটেস্টান্টিজম মানুষকে পরিশ্রম করতে ও কৃচ্ছুতাসাধনে উদ্বুদ্ধ করে। যারা এ অনুজ্ঞা অনুসরণ করে তারা বিত্তশালী হয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে ভোগবিলাসে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কাজেই যান্ত্রিকভাবে কাজ করলে অপ্রত্যাশিত ফল দেখা দিতে পারে।
  • যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় তার উল্টোটি ঘটা (self-defeating prediction) : এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ফলাফল অনেক সময় কল্যাণকর হতে পারে। বিংশ শতাব্দীতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে জনসংখ্যা যত বাড়বে খাদ্য উৎপাদন তত বাড়বে না। ফলে অনাহারে অনেক লোক মারা যাবে। এ ভবিষ্যদ্বাণী করার ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর এত জোর দেওয়া হলো যে ব্যাপক অনাহার-মৃত্যুর ঘটনাটি আদৌ ঘটল না।

বর্তমান নিবন্ধে যেসব ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তার কোনো কোনোটি মার্টনের তাত্ত্বিক কাঠামোতে বিশ্লেষণ করা গেলেও অনেকগুলির ক্ষেত্রে মার্টনের তত্ত্ব যথেষ্ট নয়। তার একটি বড় কারণ হলো, মার্টনের তত্ত্বে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ। তিনি যখন অপ্রত্যাশিত ফলাফল সম্পর্কে তাঁর প্রবন্ধটি লেখেন তখন পর্যন্ত আধুনিক অর্থনীতির অনেক তত্ত্বই প্রকাশিত হয়নি। সারণি ২.১-এ এই প্রবন্ধে উল্লেখিত মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনাগুলির বিশ্লেষণ দেখা যাবে।

সারণী দুই

সারণি ২.১ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে ১০টি মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনার মধ্যে একটি ক্ষেত্রে সরকারি ত্রুটি ও দুটি ক্ষেত্রে কারিগরি অজ্ঞতা মিত্রপক্ষের গুলির জন্য দায়ী। পাঁচটি ক্ষেত্রে কারণ অর্থনৈতিক। এসব ক্ষেত্রে বাজারের অস্তিত্ব অস্বীকার করে সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের ব্যয় বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। অনেকটা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা। কিন্তু বুধোরা বাড়তি ব্যয় বহন করতে রাজি হয় না। তাই সরকার নামক উদোকে তার পিণ্ডি নিয়ে বেসামাল অবস্থায় পড়তে হয়। তিনটি ঘটনার বিশ্লেষণ হতে দেখা যাচ্ছে, মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনার আশঙ্কা অনেক কমে যেত, যদি সরকারি উদ্যোগের স্থানীয় জনগণের কাছে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা থাকত। এ বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি সুপারিশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সামাজিক লাভের জন্য যদি সরকারের গৃহীত উদ্যোগে কারও ক্ষতি হয়, তবে তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্তরা সে উদ্যোগ ভণ্ডুল করে দেবে। দ্বিতীয়ত, উপকারভোগীদের সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা না হলে সরকারি উদ্যোগে উপকারের চেয়ে অপকার হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। তৃতীয়ত, মানুষের কারিগরি জ্ঞান সীমিত। তাই জটিল প্রকল্পের ক্ষেত্রে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। সবশেষে, সরকারকে তার গৃহীত ব্যবস্থার সম্ভাব্য ত্রুটি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। এ জন্য প্রতিনিয়ত সরকারি ক্রিয়াকাণ্ডের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রয়োজন।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকারের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে দুটি মৌল সমস্যা রয়েছে। রাজনীতির মূল সমস্যা হলো, রাজনীতিবিদেরা স্বল্প মেয়াদের লাভ-লোকসানকে বড় করে দেখেন। এবং দীর্ঘ মেয়াদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াগুলি অগ্রাহ্য করেন। তাদের দৃষ্টি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনের বাইরে প্রসারিত হয় না। অথচ সমাজে অনেক জটিল সমস্যা রয়েছে, স্বল্প মেয়াদে যার সমাধান সম্ভব নয়। রাজনীতিবিদেরা জটিল সমস্যার স্বল্পমেয়াদি সহজ সমাধান চান। অনেক ক্ষেত্রেই এটা সম্ভব হয় না। তাই যা অসম্ভব তাকে সম্ভব করার চেষ্টা করতে গিয়ে রাজনীতিবিদেরা সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলেন।

অর্থনীতির মৌল সমস্যাটি অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন উনবিংশ শতকের প্রখ্যাত ফরাসি অর্থনীতিবিদ ফ্রেডেরিক ব্যস্তিয়াত (১৯৯৫)। তিনি মনে করেন, কোনো অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের ফলাফল তাৎক্ষণিক দেখা যায় না। কিছু ফলাফল সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়; কিছু ফলাফল পরবর্তী সময়ে আত্মপ্রকাশ করে। কাজেই যেকোনো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলাফল দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে : (১) দৃশ্যমান ও (২) অদৃশ্য। দৃশ্যমান ও অদৃশ্য ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। দৃশ্যমান ফলাফল গ্রহণযোগ্য হলেও অদৃশ্য ফলাফল অবাঞ্ছিত হতে পারে। যারা ভালো অর্থনীতিবিদ, তাঁরা অদৃশ্য ফলাফল সঠিকভাবে অনুমান করতে পারেন, অযোগ্য অর্থনীতিবিদেরা পারেন না। ব্যস্তিয়াত (১৯৯৫, ১) তাই লিখেছেন, There is only one difference between a bad economist and a good one: the bad economist confines himself to the visible effect; and the good economist takes into account both the effect that can be seen and those effects that must be foreseen. (সু ও কু অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একটিই তফাত আছে; খারাপ বা বাজে অর্থনীতিবিদ শুধু দৃশ্যমান প্রভাব দেখতে পান; ভালো অর্থনীতিবিদ একই সঙ্গে দৃশ্যমান প্রভাব ও অদৃশ্য প্রভাব সম্পর্কে সঠিক অনুমান বিবেচনায় নেন)। কাজেই মিত্রপক্ষের গুলি এড়ানোর জন্য চাই দক্ষ অর্থনীতিবিদ। আর তাদের শুধু অর্থনীতিতে দক্ষ হলেই চলবে না। অদূরদর্শী ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদেরও জয় করতে হবে তাদের।

উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)

  1. আচেমঞ্জু, ডেরন ও যশুয়া ডি আংগ্রিস্ট (Acemoglu, Daron and Joshua D. Angrist) ২০০১। ‘Consequences of Employment Protection? The Case of the Americans with Disabilities Act’. Journal of Political Economy. Vol. 109. No.5 l
  2. আসাদুল্লাহ, মোহাম্মদ নিয়াজ ও নজমুল চৌধুরী (Asadullah, M. Niaz and Nazmul Chowdhury)। ২০০৮। Poisoning the Mind: Contamination and Cognative Achievement of Children’(Mimeo). Policy Research Working Paper. 4510. Washington DC: World Bank.
  3. ইসলাম শহিদুল ও জাকির কিবরিয়া (Islam Shahidul and Zakir Kibria)। ২০০৬। Unravelling KJDRP. Dhaka: Uttaran. কুগার, এন ও. (Krueger, Anne 0.)। ১৯৯০। The Government Failure in Development’. The Journal of Economic Perspectives. Vol. IV. No. 2.
  4. ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB Bangladesh)। ২০০৫। Data Base on Corruption. Dhaka.
  5. ডুবনার, স্টিফেন জে ও স্টিভেন ডি লেভিট (Dubner, Stephen J. and Steven D. Levitt) / Roob l ‘Unintended Consequences’. The New York Times. January 29, 2008.
  6. নর্টন, রড (Norton Rod)। ২০০৮। Unintended Consequences. The Concise Encyclopedia of Economics. Indianapolis: Liberty Press.
  7. পাকিস্তান সরকার (Government of Pakistan)। ১৯৭০। Fourth Five Year Plan. Islamabad: Planning Commission.
  8. পিয়ার্স ফ্রেড (Pearce Fred) I food Bangladesh’s Arsenic Poisoning: Who is to blame? http://www. Unesco.org/courier/ 2001 01/uk?Planet. html.
  9. ফেরারি, অরোরা (Ferari, Aurora)। ২০০৮। Increasing Access to Rural Finance in Bangladesh: The Forgotten Missing Middle. Washington DC: World Bank.
  10. বাংলাদেশ ব্যাংক (Bangladesh Bank)। ২০১২। Annual Report. Dhaka.
  11. ব্যস্তিয়াত, ফ্রেডরিক (Bastiat, Frederic)। ১৯৯৫। selected Essays. Translated by Seymour Cain. New York: Irvington on Hudson.
  12. মার্টন, রবার্ট কে (Merton, Robert K)। ১৯৩৬। The Unanticipated Consequences of Purposive Social Action’. American Sociological Review. Vol. 1. No. 6, 894-904.
  13. রোড, ডেভিড এবং জুকফিকার আলী মানিক (Rhode, David and Zulfikar Ali Manik) । 2005 ‘The lethal water wells of Bangladesh’ New York Times, july 17, 2005. Force,
  14. লিউক, ডিন ও জেফরি এ. মাইকেল (Leuck, Dean and Jeffrey A. Michael)। ২০০৩। ‘Preemptive Habitat Destruction Under Endangered Sprcies Act’. Journal of Law and Economics. Vol XLVI.
  15. সেন, অমর্ত্য (Sen, Amartya)। ২০০৫। The Argumentative Indian. New York: Farrar, Straus and Giroux.