৩. অপচয়ের প্রকারভেদ ও এর তাৎপর্য

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্টুয়ার্ট পটার ১৯৬৪ সালে একটি মামলায় অশ্লীলতা সম্পর্কে যা বলেছেন তা অপচয়ের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। জাস্টিস পটার বলেছেন যে অশ্লীলতার সংজ্ঞা কী তা তিনি জানেন না। তবে অশ্লীলতা যখন তার চোখের সামনে পড়ে তখন তিনি তা ঠিকই চিনতে পারেন। অপচয়ের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা প্রণয়ন দুরূহ হলেও অপচয় ঘটলে তা সহজেই চিহ্নিত করা যায়। তাই অপচয়ের সম্যক উপলব্ধির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন অপচয়ের বিভিন্ন প্রকার বা রূপ চিহ্নিত করা । স্ট্যানবেরি ও টমসন নিম্নলিখিত নয় প্রকৃতির অপচয় চিহ্নিত করেছেন :

  1. কারিগরি দিক থেকে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে ব্যর্থতা (Technical inefficiency or X-inefficiency) : কারিগরি অদক্ষতা তখনই দেখা দেয়, যখন সর্বনিম্ন খরচে সর্বোচ্চ উৎপাদন অর্জন সম্ভব হয় না। মূলত ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা থেকে এ অপচয়ের উদ্ভব হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেসরকারি খাত কম ব্যয়ে যে কাজ করতে পারে সরকারি খাতে তা করতে অনেক বেশি খরচ হয়। যেমন ধরুন, ফোর্ড মোটর কোম্পানিতে কেনাকাটার জন্য যে পরিমাণ জনবল লাগে, একই কাজ করতে মার্কিন নৌবাহিনীতে তার চার গুণ লোক লাগে। তার কারণ, ফোর্ড মোটর কোম্পানিতে ক্রয়ের জন্য তিন থেকে সর্বাধিক নয়টি স্তরের অনুমোদনের দরকার। মার্কিন নৌবাহিনীতে একই কাজে গড়ে ৩৫ জন কর্মকর্তার অনুমতি লাগে। এর একটি বড় কারণ হলো, সরকার ও বেসরকারি খাতের লক্ষ্য ও পদ্ধতির মধ্যে বড় ধরনের ফারাক রয়েছে।

  2. সঠিক মূল্য নির্ধারণে ব্যর্থতার ফলে সম্পদের অপচয় (Allocative inefficiency or doing too much or too little) : প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়ের কম মূল্যে কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয় করলে তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহৃত হবে এবং তাতে সম্পদের অপচয় ঘটে। আবার মূল্য বেশি নির্ধারণ করলে প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন কম হবে। এর ফলে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় না।
  3. ভ্রান্ত বিনিয়োগ (Allocative inefficiency or doing the wrong things) : সরকারে প্রধানত তিন ধরনের ভ্রান্ত ব্যয় দেখা যায়। প্রথমত, অনেক ব্যয় করা হয় যার ফলে প্রকৃতপক্ষে কারও কোনো লাভ হয় না। ধরুন, সরকার একটি পাঠাগার চালাচ্ছে, যেখানে দিনে গড়ে একজন লোকও যায় না। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্পদের অপচয়। দ্বিতীয়ত, অসম্ভব কিছু করার জন্য অর্থ ব্যয় করা নিছক অপচয়। তৃতীয়ত, সাংসদদের চাপে অনেক সময় নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবাদিপশুর মূত্র ত্যাগের অভ্যাসের মতো (ওপরে উল্লেখিত) প্রকল্প নেওয়া হয়।
  4. সরকারি কর্মকাণ্ডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Spillover effects) : সরকারের প্রায় সব ধরনের কর্মকাণ্ডেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমন ধরুন, সরকার আয়কর আরোপ করলে এর প্রভাব শুধু কর প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। করদাতাদের হিসাব তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। ১৯৯৩ সালের একটি হিসাব থেকে দেখা যায় যে আয়করসংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করদাতাদের আয়করের অতিরিক্ত ১৫ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। এর একটি বড় অংশ অপ্রয়োজনীয়। এ ছাড়া কর আরোপের ফলে অনেক করদাতা নিরুৎসাহিত হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেন। আবার অনেকে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য সম্পদের অপচয় করেন। এ ধরনের সব অনভিপ্রেত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অপচয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আরেকটি হিসাব থেকে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ার-সংক্রান্ত আইনকানুন মানতে ৪০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়। যেহেতু এসব ব্যয় সরকারের বাজেটে প্রতিফলিত হয় না, সেহেতু অনেকে ধরে নেন যে এ ধরনের কোনো খরচ নেই। এ ধারণা একেবারে ভুল। তাই এ ধরনের অপচয় বিবেচনায় নেওয়া বাঞ্ছনীয়। সরকারের বিধিবিধান এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে সরকারের নিয়ম প্রতিপালনের ব্যয় (Compliance Cost) সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে।
  5. অলস সম্পদ (idle asset) : সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন ধরনের সম্পদ রয়েছে। অথচ এসব সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। কোথাও কোথাও অব্যবহৃত নগদ অর্থ রয়েছে। এসব অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা হলে সরকারের ঋণের পরিমাণ কমে যেত এবং এতে সরকারের সুদ বাবদ ব্যয় কমে যেত। এই অলস অর্থের জন্য সরকারের সুদ বাবদ অপচয় হচ্ছে। আবার কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত জমি রয়েছে। এসব জমি ব্যবহারে ব্যর্থতা সম্পদের অপচয়। কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনের অনেক বেশি যন্ত্রপাতি ও ব্যবহার্য পণ্য রয়েছে। এতেও সম্পদের অপচয় ঘটে। সরকারের অব্যবহৃত ও অলস সম্পদের ফলে বিপুল পরিমাণ অপচয় হচ্ছে।
  6. দুর্নীতি, প্রতারণা, চুরি ও লাল ফিতা (Corrruption, Fraud, Theft and Red tape) : দুর্নীতি, প্রতারণা ও সরকারি সম্পদের চুরির সঙ্গে অপচয়ের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অপরাধীদের যা লাভ হয়, তার চেয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় অনেক বেশি। যদি ঘুষ দিয়ে লাভ না হয়, তবে কেউ ঘুষ দেবে না; তারা রাষ্ট্রের পাওনা রাষ্ট্রকেই শোধ করবে। তাই ঘুষখোরকে ঘুষদাতার জন্য লাভের সুযোগ সৃষ্টি করতে হয়।

    দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি, প্রতারণা ও চুরি রোধ করতে রাষ্ট্রকে সরকারি ব্যয়ের নজরদারির জন্য প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হয়। এতে দুই ধরনের অপচয় ঘটে। প্রথমত, নজরদারির জন্য অতিরিক্ত প্রশাসনিক ব্যয় বাড়ে। দ্বিতীয়ত, সরকারি নজরদারিকে কেন্দ্র করে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য দেখা দেয়। লাল ফিতার উৎপত্তি হয় সরকারের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের জন্য সৃষ্ট বিধি ও পদ্ধতি থেকে। একবার কোনো বিধি ও পদ্ধতি সৃষ্টি হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও তার কোনো পরিবর্তন হয় না। কাজেই কোনো বিধি ও পদ্ধতির প্রয়োজন না থাকলেও তা বহাল থাকে। এসব অপ্রয়োজনীয় বাধানিষেধ সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বিলম্বিত করে। যুক্তরাষ্ট্রে হিসাব করে দেখা গেছে যে সরকারের বিধিবিধান প্রয়োগের নজরদারিতে সরকার এক টাকা ব্যয় করলে কাগজপত্র তৈরি করার জন্য বেসরকারি খাতের ব্যয় হয় ১০ টাকা। কাজেই এ খাতে বেসরকারি খাতের অপচয় বিপুল।

  7. ত্রুটিপূর্ণ সরকারি উদ্যোগ (Leaky Bucket) : অনেক ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ দিল্লির লাড়ুর মতো। দিল্লির লাড়ু সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, এটি না খেলে দুঃখ থাকবে আবার খেলেও দুঃখ হবে। সরকারকে অনেক ব্যবস্থা নিতে হয়, যা স্পষ্টতই ত্রুটিপূর্ণ, অথচ এসব ব্যবস্থা না নেওয়াও সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। একটি উদাহরণ হলো বেকার ভাতা। যখন বেকারের সংখ্যা বাড়ে তখন তাদের ভাতা না দিলে তাদের জন্য বেঁচে থাকাই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আবার বেকার ভাতা পেলে অনেক বেকার কাজ না করে বেকার থাকাই পছন্দ করে। এ ধরনের ব্যক্তিদের জন্য বেকার ভাতা অর্থের অপচয়। অন্যদিকে এ ভাতা তুলে দিলে অনেক যোগ্য সাহায্যপ্রার্থী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
  8. সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা ও ত্রাণ কর্মসূচিতে অপচয় (Wasteful Transfer) : সরকার যোগ্য গরিব ও দুস্থ মানুষের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে। অনেক সময় দেখা যায় যে এসব প্রকল্পে রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে সচ্ছল ব্যক্তিরা গরিবদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ করে। এই ক্ষেত্রে সম্পদের অপচয় ঘটে।
  9. অনুপার্জিত মুনাফার ফলে অপচয় (Waste Attributable to Rent Seeking) : যেকোনো ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকলে অথবা সরকারের অনুমতির প্রয়োজন থাকলে অনুপার্জিত মুনাফার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যাদের নাম করে এসব নিয়ন্ত্রণ করা হয় তারা কিন্তু এর ফলে লাভবান হয় না; লাভ কুক্ষিগত করে মধ্যস্বত্বভোগীরা। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, যেখানেই সরকার ‘পারমিট’ বা ‘লাইসেন্স’ প্রবর্তন করে, সেখানেই সরকারি কর্মচারীরা ঘুষ আদায়ের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। এই নিবন্ধের বিশ্লেষণ থেকে এ কথা স্পষ্ট যে সরকারি অর্থের অপচয় শুধু সরকারের বাজেট বরাদ্দের মধ্যে সীমিত নয়। অপচয়ের ব্যাপকতা বাজেটের চেয়ে অনেক বিস্তৃত। অর্থনীতির পরতে পরতে অপচয় ছড়িয়ে রয়েছে। তবে সামগ্রিক অপচয়ের পরিমাপ নির্ণয় করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য। অনেক অপচয়ই দৃশ্যমান নয়। এসব ক্ষেত্রে অপচয়ের পরিমাপ একেবারেই অনুমানের ওপর নির্ভরশীল।

উইলিয়াম স্ট্যানবেরি ও ফ্রেড টমসন কারণের ভিত্তিতে অপচয়কে নয় ভাগে বিভক্ত করেছেন। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অরিয়ানা বান্দিয়েরা ও তাঁর সহকর্মীরা মনে করেন যে অপচয়ের ফলে কাদের স্বার্থ সিদ্ধি হয় তার ভিত্তিতে অপচয়কে দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। তাদের মতে, দুই ধরনের অপচয় হলো : (১) সক্রিয় অপচয় ও (২) নিষ্ক্রিয় অপচয়। সক্রিয় অপচয় তখনই ঘটে যখন কেউ ইচ্ছে করে লাভের জন্য অপচয় ঘটায়। সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি এই শ্রেণীর অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। নিষ্ক্রিয় অপচয়ে কারও লাভ হয় না। এ ধরনের অপচয় কয়েকটি কারণে ঘটতে পারে। প্রথমত, যারা সরকারি অর্থ। ব্যয় করেন তারা কীভাবে সর্বনিম্ন ব্যয়ে কাজ করতে হয়, তা জানেন না। অর্থাৎ তাদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি কর্মকর্তাদের নিজেদের লাভের সম্ভাবনা থাকলে তারা সরকারি অর্থের অপচয় নিয়ে মাথা ঘামান না। তৃতীয়ত, অপচয় রোধের জন্য সরকারের জারি করা বিধি ও নিয়ন্ত্রণগুলি সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করে। সরকারি কর্মকর্তারা অপচয় রোধের চেয়ে বিধিবিধান প্রতিপালনের ওপর বেশি জোর দেন। কাজেই অপচয় হ্রাসের জন্য কেউ উদ্যোগ নিতে সাহস পায় না। অরিয়ানা বান্দিয়েরা ও তাঁর সহকর্মীরা (২০০৯) ইতালিতে ২০০০ থেকে ২০০৫ সময়কালে সরকারি ক্রয়ে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় অপচয় সম্পর্কে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এই সমীক্ষার মূল বক্তব্যগুলি নিম্নরূপ:

  1. ইতালিতে সরকারি কেনাকাটায় অপচয়ের ফলে জাতীয় আয়ের ১.৬ থেকে ২.১ শতাংশ ক্ষতি হয়।
  2. অপচয়ের সিংহভাগই নিষ্ক্রিয় অপচয়। এই হিসাব অনুসারে নিষ্ক্রিয় অপচয় হচ্ছে মোট অপচয়ের ৮২ শতাংশ। এর তাৎপর্য হলো যে ইতালিতে সরকারি কেনাকাটায় অপচয়ের মূল কারণ দুর্নীতি নয়। দুর্নীতি অবশ্যই রয়েছে, তবে এ ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হলো অদক্ষতা ও অযোগ্যতা।
  3. নিষ্ক্রিয় অপচয় সবচেয়ে বেশি দেখা যায় কেন্দ্রীয় সরকারে। আঞ্চলিক সরকারে নিষ্ক্রিয় অপচয় কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্ক্রিয় অপচয়ের চেয়ে কম। তার চেয়েও কম অপচয় ঘটে স্থানীয় সরকারে। সবচেয়ে কম নিষ্ক্রিয় অপচয় ঘটে বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের মতো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে। এ ধরনের স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের ঐচ্ছিক ক্ষমতা বেশি থাকে। এতে প্রমাণিত হয় যে কর্মকর্তাদের ঐচ্ছিক ক্ষমতা বাড়ালেই দুর্নীতি বাড়ে না। উপরিউক্ত গবেষণার ফলাফল শুধু ইতালির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, অন্যান্য দেশেও একই ঘটনা ঘটছে। তবে এ সম্পর্কে অন্যান্য দেশের উপাত্তের ভিত্তিতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

উপরিউক্ত বিশ্লেষণগুলিতে যেসব অপচয় চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোর কারণ মোটা দাগে পাঁচ ভাগে চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথমত, দুর্নীতির কারণে অপচয় ঘটতে পারে। দ্বিতীয়ত, অদক্ষতা ও অযোগ্যতা অপচয়ের জন্ম দিতে পারে। তৃতীয়ত, সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব অপচয় সৃষ্টি করতে পারে। চতুর্থত, অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের একই সঙ্গে ভালো ও খারাপ প্রভাব থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে অপচয়ের ঝুঁকি সত্ত্বেও প্রকল্প নেওয়া হয়। পঞ্চমত, অতিরিক্ত বিধিনিষেধ অপচয়ের কারণ হতে পারে। উপরিউক্ত বিশ্লেষণের একটি প্রধান দুর্বলতা হলো, এখানে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

অনেকে মনে করেন যে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অদক্ষতা বা ব্যক্তিদের লোভ-লালসা থেকে অপচয়ের সৃষ্টি হয়। বাস্তবতা হলো, বোকামির জন্য নয়, অতিচালাকির জন্যও অনেক সময় অপচয় সৃষ্টি হয়। এসব অপচয় দূর করা। সবচেয়ে দুরূহ।

কোনো অপচয়ই দীর্ঘদিন নিজে নিজে টিকে থাকতে পারে না। ইংরেজিতে একটি আপ্তবাক্যে যথার্থই বলা হয়েছে, কিছু লোককে স্বল্প সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়, কিন্তু সব লোককে সব সময় বোকা বানিয়ে রাখা যায় না। কাজেই সাধারণত কোনো অপচয় দীর্ঘদিন টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। এর অবশ্য একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠী অপচয় থেকে লাভবান হয়। তারা নিজেদের স্বার্থে অপচয়কে বাঁচিয়ে রাখে। এসব ক্ষেত্রে অপচয় দূর করতে গেলে শক্ত প্রতিরোধ আসে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মনসুর অলসন (১৯৮২) এ ধরনের কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর নাম দিয়েছেন distributional coalition বা বণ্টনমূলক জোট। এরা শুধু সক্রিয় অপচয় (যথা–ঘুষ বা দুর্নীতি) থেকেই লাভবান হয় না, এরা নিষ্ক্রিয় অপচয় থেকেও সুবিধা হাসিল করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই অপচয় সৃষ্টি করে। যেমন ধরুন, পল্লি অঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একটি নতুন এক্স-রে মেশিন বসানো হলো। দেখা গেল, এই মেশিন কাজ করছে না, যদিও যন্ত্রটি ভালো। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বেসরকারি খাতের এক্স-রে মেশিনের মালিক তার বাজার রক্ষা করার লক্ষ্যে (যে বাজার সরকারি যন্ত্র কেনার আগে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল) সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রচালককে ঘুষ দেয়, যাতে যন্ত্রটি অচল করে রাখা হয়। আপাতদৃষ্টিতে এ ক্ষেত্রে অপচয় নিষ্ক্রিয় মনে হলেও আসলে এখানে সক্রিয় অপচয় বিরাজ করছে। কাজেই সব সময় সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় অপচয়ের মধ্যে প্রভেদ করা অত্যন্ত শক্ত।