৪. উপসংহার : কতিপয় অমীমাংসিত প্রশ্ন

বিশ্বায়ন একটি চলমান ও অসমাপ্ত প্রক্রিয়া। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া চলছে। মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব পড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া থেমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বস্তুত, আজকের অর্থনীতিবিদদের পঞ্চদশ শতকের কলম্বাসের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। কলম্বাস যখন আটলান্টিক সমুদ্র পাড়ি দেন, তখন তিনি জানতেন না কোথায় যাচ্ছেন। যখন তিনি আমেরিকায় পৌঁছান তখন তিনি জানতেন না তিনি কোথায় পৌঁছেছেন। তিনি মনে করতেন যে তিনি ভারতে পৌঁছেছেন; তবে এখানে ভারতীয়রা কৃষ্ণাঙ্গ নয়; এদের গায়ের রং লাল। আজকের অর্থনীতিবিদেরাও কলম্বাসের মতো জানেন না, তাঁরা বর্তমানে কোথায় আছেন এবং কোথায় যাচ্ছেন। সমাজবিজ্ঞানীদের এ সমস্যা সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন অ্যান্টনি গিডেন্স (১৯৯৯, ১৯), ‘We are the first generation to live in this society, whose contours we can as yet only dimly see. It is shaking up our existing ways of life, no matter where we happen to be. This is not–at least at the moment–a global order driven by collective human will. Instead, it is emerging in an anarchic, haphazard fashion, carried along by a mixture of influences.’ (আমরা হচ্ছি এ বিশ্বায়িত] সমাজের প্রথম প্রজন্ম। এখন পর্যন্ত এ সমাজের অবয়ব অস্পষ্ট। আমরা যেখানেই থাকি না কেন, এটা বিশ্বায়ন] আমাদের চিরাচরিত জীবনকে আন্দোলিত করছে। অন্তত এখন পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া মানুষের সমষ্টিগত আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বৈশ্বিক ব্যবস্থা নয়। বিশৃঙ্খল ও এলোমেলোভাবে এর আত্মপ্রকাশ ঘটছে। একে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কতিপয় প্রভাবের সংমিশ্রণ।)

এলোমেলোভাবে আত্মপ্রকাশ করলেও বিশ্বায়ন সবাইকে নাড়া দিয়েছে। এই প্রক্রিয়া কাউকে লাভবান করেছে; কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু কাউকে স্বস্তি দেয়নি। যারা বিশ্বায়নে উপকৃত হয়েছে তারাও অপ্রসন্ন; আবার যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারাও অসন্তুষ্ট। অথচ বিশ্বায়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো মতবিরোধ নেই। বর্তমান বিশ্ব-অর্থনীতির একজন কঠোর সমালোচক নোয়ম চমস্কি (২০০৬) যথার্থই বলেছেন, ‘I do not know of anyone. opposed to globalization–that is, international integration, economic and otherwise–except perhaps, for dedicated hermits.’ (শুধু নিষ্ঠাবান গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী ছাড়া আর কেউ অর্থনীতি এবং অন্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক একীকরণ অর্থে বিশ্বায়নের বিরোধিতা করে, বলে জানি না। বিশ্বায়নের প্রয়োজন নিয়ে মতবিরোধ নেই। অথচ বাস্তব জীবনে। যেভাবে বিশ্বায়ন চলছে সে সম্পর্কে মতদ্বৈধতার শেষ নেই।

বিশ্বায়নের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বিশ্বায়ন পৃথিবীজুড়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। প্রমত্ত নদীর মতো পুঁজিবাদ কখনো স্থির থাকতে পারে না। নিত্যনতুন কারিগরি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গতানুগতিক জগৎকে ভেঙে সে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে এগিয়ে যায়। ঊনবিংশ শতকে মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলস (১৯৬২, ৩৭) কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে যা লিখেছিলেন তা আজকের বিশ্বায়ন সম্পর্কে সমভাবে প্রযোজ্য : ‘Constant revolutionizing of production, uninterrupted disturbance of all social conditions, everlasting uncertainty and agitation distinguish the bourgeois epoch from all earlier ones. All fixed, fast-frozen relations, with their train of ancient and venerable prejudices and opinions are swept away, all new formed ones become antiquated before they can ossify. All that is solid melts into air, all that is holy is profaned and man is at last compelled to face with sober senses, his real conditions of life, and his relations with his kind.’ (উৎপাদনে নিয়ত বৈপ্লবিক পরিবর্তন, সব সামাজিক অবস্থায় নিরবচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খলা, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা বুর্জোয়া যুগকে পূর্বতন যুগ থেকে পৃথক করেছে। সুপ্রাচীন ও নমস্য পূর্বসংস্কার, বিশ্বাসসহ সব স্থির ও দ্রুত জমাটবাধা সম্পর্ক ঝেটিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন বিশ্বাসগুলি দানা বাঁধার আগেই বাতিল হয়ে গিয়েছে। যা-কিছু কঠিন বায়ুতে উবে যায়; যা-কিছু পবিত্র হয়ে যায় নোংরা। মানুষ অচঞ্চল চিত্তে তার জীবনের বাস্তবতা এবং অন্য মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনুধাবন করতে বাধ্য হয়।)।

অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলাই হচ্ছে বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়ায় খেটে খাওয়া মানুষের নিয়তি। অনিশ্চয়তা শুধু উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা নয়। এ সমস্যা শিল্পোন্নত দেশগুলির শ্রমিকদের সমভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এসব দেশে দুভাবে কর্মসংস্থান কমছে। প্রথমত, কারিগরি পরিবর্তনের ফলে কম শ্রমিক দিয়ে বেশি ও উন্নততর পণ্য এবং সেবা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। কাজেই চাকরির পরিমাণ কমছে। দ্বিতীয়ত, বৈদ্যুতিন (electronic) যোগাযোগের ফলে অনেক সেবা অনুন্নত দেশগুলি থেকে কম মূল্যে সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে। বহিঃউৎস থেকে সংগ্রহের (outsourcing) ফলে উন্নত দেশগুলির অনেক চাকরি উন্নয়নশীল দেশগুলিতে চলে যাচ্ছে। এতে উন্নত দেশগুলির শ্রমিকেরা অনিশ্চয়তায় ভুগছে।

সম্প্রতি মনস্তাত্ত্বিক ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তার প্রভাব সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র আবিষ্কার করেছেন। প্রথমত, মানুষ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের তুলনায় স্থিতাবস্থা বেশি পছন্দ করে। অধ্যাপক রিচার্ড লেয়ার্ড (২০০৫, ২২৭) যথার্থই লিখেছেন, ‘People are also deeply attached to status quo. They hate loss of any kind and they care less about gains than about losses.’ (স্থিতাবস্থার জন্য রয়েছে মানুষের প্রচণ্ড আকর্ষণ। তারা যেকোনো ধরনের ক্ষতি অপছন্দ করে এবং তারা লাভের চেয়ে ক্ষতির ব্যাপারে অনেক বেশি স্পর্শকাতর)। বেশির ভাগ মানুষ নিজেদের রুটি-রোজগার নিয়ে ঝুঁকি এড়াতে চায়। তাই উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির শ্রমিকেরা চাকরি হ্রাসের সম্ভাবনা আছে, এমন ধরনের যেকোনো পরিবর্তন প্রতিহত করতে চায়। দ্বিতীয়ত, মানুষ লাভ করে যত খুশি হয়, তার চেয়ে লোকসানের ফলে অনেক বেশি সংক্ষুব্ধ হয়। তাই বিশ্বায়নে যারা লাভবান হয়, তারা বিশ্বায়নকে যতটা সমর্থন করে, তার চেয়ে অনেক তীব্র বিরোধিতা আসে বিশ্বায়নে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে। তাই উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় অঞ্চলেই শ্রমিকশ্রেণী বিশ্বায়নের বিপক্ষে। বিশ্বায়নের বর্তমান পর্যায়ের আগে শিল্পোন্নত দেশগুলির শ্রমিকেরা বিশ্বায়নের বিরোধিতা করেনি। এই বিরোধিতা শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন শিল্পোন্নত দেশগুলিও শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

শুধু মেহনতি মানুষই বিশ্বায়নের বিরোধিতা করছে না। উন্নত দেশগুলিতে পুঁজিপতিরাও অনেকে বিশ্বায়ন-ব্যবস্থাকে মেনে নিতে চায় না। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মৌলিক নির্যাস হলো প্রতিযোগিতা। আফ্রিকার জঙ্গলে বাঁচার জন্য লড়াইয়ের সঙ্গে এ প্রতিযোগিতাকে তুলনা করা যেতে পারে। টমাস এল ফ্রিডম্যান (২০০৫, ১১৪) নিম্নোক্ত আফ্রিকান প্রবাদের মাধ্যমে এই প্রতিযোগিতার বৈশিষ্ট্য অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন:

Every morning in Africa a gazelle wakes up.

It knows it must run faster than the fastest lion or it will be killed.

Every morning a lion wakes up.

It knows that it must outrun the slowest gazelle or it will starve to death.

It does not matter whether you are a lion or a gazelle.

When the sun comes up, you better start running.

(আফ্রিকায় প্রতিদিন ভোরে একটি হরিণ জাগছে।

সে জানে যে সবচেয়ে দ্রুতগামী সিংহের চেয়ে অবশ্যই তাকে জোরে দৌড়াতে হবে, নইলে তাকে মরতে হবে।

প্রতিদিন সকালে একটি সিংহ জাগছে।

সে জানে, তাকে সবচেয়ে ধীর গতিসম্পন্ন হরিণের চেয়ে জোরে দৌড়াতে হবে, নইলে তাকে উপোসে মরতে হবে।

আপনি হরিণ না সিংহ, তাতে কিছু যায় আসে না,

ভালো চাইলে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াতে শুরু করুন।)

কোনো পুঁজিপতিই আফ্রিকার জঙ্গলের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ চায় না। এ প্রতিযোগিতা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময়ে পুঁজিপতির ব্যবসাতে ধস নামতে পারে। তাই পুঁজির মালিকেরা সুযোগ পেলেই প্রতিযোগিতার স্থলে একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অথচ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রাণশক্তি হলো প্রতিযোগিতা। এখন পর্যন্ত পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো উৎপাদনশীলতার অব্যাহত বৃদ্ধি।

প্রতিযোগিতা না থাকলে উৎপাদনশীলতার প্রণোদনা থাকবে না। নিয়ন্ত্রণ প্রতিযোগিতার জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। আবার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে গদ্দিনশিনরা (incumbents), অর্থাৎ যারা বর্তমানে প্রতিযোগিতায় অধিকতর সফল, তারা সরকারকে প্রভাবিত করে নতুন প্রতিযোগিতার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়। প্রতিযোগিতা বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। এ প্রসঙ্গে রঘুরাম রাজন ও লুইজি জিংগালিস (২০০৩, ৩১২) যথার্থই লিখেছেন, ‘A truly free and competitive market occupies a very delicate middle ground between the absence of rules and the presence of suffocating rules. It is because this middle ground is so narrow that capitalism in its best form is very unstable. It easily degenerates into a system of the incumbents, by the incumbents, for the incumbents.’ (একটি প্রকৃত অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিয়ন্ত্রণহীনতা ও শ্বাসরুদ্ধকর বিধিমালার মধ্যবর্তী একটি সংবেদনশীল এলাকা। এ মধ্যবর্তী এলাকাটি এতই সংকীর্ণ যে শ্রেষ্ঠ পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও এখানে অত্যন্ত অস্থিতিশীল। অতি সহজেই এটি গদ্দিনশিনদের দ্বারা পরিচালিত গদ্দিনশিনদের জন্য গদ্দিনশিনদের একটি ব্যবস্থায় অধঃপতিত হয়)।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তাই বিপরীতমুখী প্রবণতা রয়েছে। একটি প্রবণতা হলো অবাধ প্রতিযোগিতা আর উচ্চতর উৎপাদনশীলতা। অন্য প্রবণতা হলো গদ্দিনশিনদের বা কায়েমি স্বার্থের সংরক্ষণ, যা প্রতিযোগিতা খর্ব করে । দ্বিতীয় প্রবণতাটি হলো পুঁজিবাদের আত্মঘাতী প্রবণতা। পুঁজিপতিরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতাকে খর্ব করে একচেটিয়া বাজার প্রতিষ্ঠার লোভ সংবরণ করতে পারে না। এর ফলে পুঁজিবাদের উৎপাদনশীলতা বিপন্ন হয়। এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদীরাই পুঁজিবাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। রাজন ও জিংগালিসের (২০০৩, ২৭৬) ভাষায়, Capitalism’s biggest political enemies are not the firebrand trade unions spewing vitriol against the system but the executives in pin-striped suits extolling the virtues of competitive markets with every breath while attempting to extinguish them with every action.’ (বিপক্ষে তীব্র সমালোচনামুখর অনলবর্ষী শ্রমিকনেতারা পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় শত্রু নন। এর সবচেয়ে বড় দুশমন হলো ব্যবসায়ের কেতাদুরস্ত নির্বাহীরা, যারা দমে দমে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের গুণকীর্তন করছেন অথচ প্রতিটি কাজের মাধ্যমে প্রতিযোগিতাকে নির্বাপিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন)।

পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় শত্রু পুঁজিপতিরা নিজেরাই। তারা একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিযোগিতা উচ্ছেদ করে। এর ফলে উৎপাদনশীলতার প্রণোদনা কমে যায়। উপরন্তু একচেটিয়া ব্যবসা সমাজে অসন্তোষের জন্ম দেয়। জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যবসার ওপর নতুন নতুন নিয়ন্ত্রণের ফরমান জারি করতে বাধ্য হন। পুঁজিপতিরা অনেক ক্ষেত্রেই এই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ পুঁজির সৃজনশীলতা কুরে কুরে খায়। কাজেই পুঁজিবাদকে বাঁচাতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রতিযোগিতা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। রাজন ও জিংগালিসের মতে, Saving Capitalism from Capitalists বা পুঁজিপতিদের খপ্পর থেকে পুঁজিবাদকে রক্ষাই হচ্ছে তাই সবচেয়ে বড় সমস্যা।

বিশ্বায়নের বন্ধুর চেয়ে শত্রুর সংখ্যা অনেক বেশি। নিরন্তর অনিশ্চয়তার জন্য উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় অঞ্চলের শ্রমিকেরাই বিশ্বায়নের বিপক্ষে। পুঁজিপতিরা বাইরে বিশ্বায়ন সমর্থন করলেও মনে মনে তীব্র প্রতিযোগিতা ঘৃণা করে এবং যেকোনোভাবে প্রতিযোগিতা উঠিয়ে দিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা কায়েম করতে চায়। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে বিশ্বায়ন কি সত্যি সত্যি টিকে থাকবে? এ সম্পর্কে তিন ধরনের মত দেখা যাচ্ছে।

প্রথমত, কেউ কেউ মনে করেন যে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াতে কোনো মৌলিক সমস্যা নেই। বিশ্বায়ন এত দ্রুত উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে যে এর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বায়ন বর্তমান বিশ্বে অপ্রতিরোধ্য। কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। কাজেই সবার দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্বায়ন-ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে বিশ্বায়ন আজকের অনেক সমস্যার সমাধান করবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে এ বক্তব্য যুক্তিযুক্ত। কিন্তু রাজনীতিতে এ ধরনের সমাধান গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে।

দ্বিতীয় মতবাদ হলো, বিশ্বায়নের অনেক সমস্যা আছে। তবে এসব সমস্যার সমাধানও রয়েছে। জোসেফ স্টিগলিজের (২০০৬, ২৬৯) মতে, মূল সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন রাজনৈতিক বিশ্বায়নকে ছাড়িয়ে অনেক সামনে এগিয়ে গেছে। অর্থনীতিতে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে রাজনীতিবিদেরা এখনো তা বুঝে উঠতে পারেনি এবং তা সামাল দেওয়ার মতো রণকৌশল নির্ধারণ করতে পারেনি। স্টিগলিজের মতে, এর সমাধান হলো বিশ্বায়নের গণতন্ত্রায়ণ। কিন্তু বিশ্বায়নের সব বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ধনী রাষ্ট্র ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলির কাছে কেন্দ্রীভূত। তারা এ ক্ষমতা সবার সঙ্গে ভাগ করতে রাজি না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে যেসব ক্ষোভ রয়েছে তা দূর না-ও হতে পারে।

তৃতীয় মতবাদ হলো যে রাজনৈতিক অসন্তোষ দূর না করতে পারলে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের মহা পশ্চাদ্গমন (Great Reversal) ঘটবে। এ ধরনের প্রবণতা দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ঘটেছিল। এ ধরনের পশ্চাদ্গমনের বা পেছনে ফেরার দুই ধরনের পরিণতি ঘটতে পারে। একটি পরিণাম হতে পারে বিশ্বায়ন কিছুদূর এগোনোর পর পিছিয়ে পড়বে এবং পিছিয়ে যাওয়ার পর আবার এগিয়ে যাবে। উত্থান-পতনের বন্ধুর পথ ধরে বিশ্বায়ন এগিয়ে যাবে। এমনটি ঘটেছিল বিংশ শতাব্দীতে।

আরেকটি পরিণতি হতে পারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবলুপ্তি ও নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব। এটিই ছিল পুঁজিবাদের পরিণতি সম্পর্কে কার্ল মার্ক্স ও তার সমর্থকদের ভবিষ্যদ্বাণী । বিংশ শতাব্দীজুড়ে মেহনতি মানুষ পুঁজিবাদের অন্তর্ধানের জন্য প্রতীক্ষা করেছে। কিন্তু বাস্তবে পুঁজিবাদ এ সময়ে আরও শক্তি সঞ্চয় করেছে। পুঁজিবাদের আশু মৃত্যু সম্পর্কে কার্ল মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী মার্ক টোয়েনের উক্তিকে মনে করিয়ে দেয়। টোয়েনের জীবদ্দশায় তার মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশের পর মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, ‘The rumors of my death have been greatly exaggerated.’ (আমার মৃত্যুর গুজব অতিরঞ্জিত করা হয়েছে)। পুঁজিবাদের আশু মৃত্যুর প্রত্যাশাও ছিল অযৌক্তিক। অবশ্য কার্ল মার্ক্সের সমর্থকেরা মনে করেন যে পুঁজিবাদের আশু মৃত্যু সম্পর্কে প্রত্যাশা মার্ক্সের তত্ত্বের অপব্যাখ্যার ওপর। প্রতিষ্ঠিত। মার্ক্স মনে করতেন, যখনই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার উৎপাদনশীলতা হারাবে তখনই তার অবলুপ্তি ঘটবে। দ্রুত কারিগরি পরিবর্তনের ফলে পুঁজিবাদ তার উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। তাই তার অন্তর্ধানের প্রশ্ন ওঠেনি। সৃষ্টিশীল পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছে উন্নত দেশগুলিতে। কাজেই যদি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটে, তা ঘটবে। শিল্পোন্নত দেশগুলিতে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে নয়। অথচ বিংশ শতকে সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে যারা তত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন, তারা আশা করছিলেন যে বিপ্লব শুরু হবে অনুন্নত দেশগুলিতে। এ তত্ত্ব মার্ক্সের নয়। এটি রচনা করেছিলেন লেনিন, রোজা লুক্সেমবার্গ ও হবসন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে এই তত্ত্ব পুঁজিবাদের উৎপাদনশীলতা ও কারিগরি পরিবর্তনের ক্ষমতা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেনি। সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বের প্রবক্তারা বুঝতে পারেননি, পুঁজিবাদী দেশগুলি উপনিবেশের বাজারের ওপর নির্ভর না করে উন্নত দেশগুলির ভেতরই অনেক বড় বাজার সৃষ্টি করতে পারে। তবে আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্বায়নের ফলে উন্নত দেশগুলির শ্রমিকদের মধ্যেও প্রচণ্ড অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। যদি শিল্পোন্নত দেশগুলিতে বিশ্বায়নের রথচক্র থেমে যায়, তবে বিশ্ব অর্থ-ব্যবস্থায় নতুন মোড় দেখা দিতে পারে।

বিশ্বায়ন কোথায় যাচ্ছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী এই পর্যায়ে সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে লর্ড কেইনসের একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। একবার এক ব্যক্তি কেইনসকে প্রশ্ন করেন, কেন তিনি একই মতে অবিচল না থেকে বারবার তার বক্তব্য পরিবর্তন করেন। জবাবে কেইনস বলেছিলেন, ‘আমি অচল ঘড়ির কাঁটা নই যে এক জায়গায় স্থির থেকে দিনে দুইবার দুই সেকেন্ড সঠিক সময় নির্দেশ করব। আমি একটি সচল ঘড়ি এবং তাই মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন সময় দেখাই।‘’ বিশ্বায়নের যুগে সাফল্যের সঙ্গে বেঁচে থাকতে হলে লর্ড কেইনসের মতো প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকার জঙ্গলের সিংহ ও হরিণের মতো অবিরাম দৌড়াতে হবে।

উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)

  • কুটনার, রবার্ট (Kuttner, Robert)। ১৯৯৬। Everything for Sale. New York: Alfred A. Knopf.
  • গিডেন্স, অ্যান্টনি (Giddens, Anthony)। ১৯৯৯। Runaway World: How Globalization is Reshaping Our Lives. London: Profile Books.
  • চমস্কি, নোয়ম (Chomsky, Noam)। ২০০৬। Failed States. London: Hamish Hamilton.
  • জোনস, এরিক (Jones, Eric)। ১৯৮৮। Growth Recurring: Economic Change in World History. Oxford: Oxford University Press.
  • ডায়মন্ড, জেরেদ (Diamond, Jared)। ১৯৯৯। Guns, Germs and Steel. New York: W.W. Norton and Company.
  • দেশাই, মেঘনাদ (Desai, Meghnad)। ২০০২। Marx_Revenge: The Resurgence of Capitalism and Death of Statist Socialism. London: Verso.
  • নান, নাথান ও ন্যান্সি কিয়ান (Nann, Nathan and Nancy Qian) । 2030 ‘The Columbian Exchange: A History of Diseases, Food and Ideas’. The Journal of Economic Perspectives. Vol. 24. No. 2.
  • ফজল, আবুল (Fazal, Abul)। ১৯৮৯। The Ain-i-Akbari. Delhi: Low Price Publications.
  • ফ্রিডম্যান, টমাস এল (Friedman, Thomas L) । ২০০০। The Lexus and the Olive Tree. New York: Anchor Books. — । ২০০৫। The World is Flat. New York: Farrar, Strauss and Giroux.
  • ব্রাইট, ক্রিস (Bright, Chris) । ১৯৯৮। Life Out of Bounds: Bioinvasion in a borderless World. New York: W. W. Norton and Company.
  • বিশ্বব্যাংক (World Bank)। ২০০৯। World Development Indicators. Washington D.C.
  • ভাগবতী, জগদীশ (Bhagwati, Jagadish)। ২০০২। In Defence of Globalization. Oxford: Oxford Univesity Press.
  • মার্ক্স, কার্ল ও ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস (Marx, Karl and Frederick Engels) । ১৯৬২। Selected Works. Moscow: Foreign Languages Publishing House.
  • ম্যাডিসন, অ্যাংগাস (Maddison, Angus)। ২০০১। World Economy: A Miillenial Perspective. Paris: OECD.
  • রথর্ণ, রবার্ট ও রমনা রামস্বামী (Rowthorn, Robert and Ramana Ramswami)। ১৯৯৭। Deindustrialization: Its Causes and Implications. Washington D. C. : IMF.
  • রাজন, রঘুরাম জি এবং লুইজি জিংগালিস (Rajan, Raghuram G. and Luigi Zingales) । ২০০৩। Saving Capitalism from Capitalists. New York: Busiess Crown.
  • লেভিট, থিয়োডর (Levitt, Theodore)। ১৯৮৩। ‘The Globalization of Markets’. Harvard Business Review. Vol. 51. স্টিগলিজ, জোসেফ ই (Stiglitz, Joseph E.)। ২০০২। Globalization and Its Discontents. New York: W. W. Norton and Co.