৬. সুখ ও রাজনৈতিক পরিবেশ

প্রখ্যাত মার্কিন রাজনৈতিক নেতা প্যাট্রিক হেনরি দাবি করেছিলেন, ‘Give me liberty or give me death’ (হয় স্বাধীনতা দাও নয় মৃত্যু দাও)। হেনরি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের সুখের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা অপরিহার্য। বাঙালি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন :

স্বাধীনতা হীনতায়      কে বাঁচিতে চায় হে,

কে বাঁচিতে চায়?

দাসত্ব শৃঙ্খল বল       কে পরিবে পায় হে,

কে পরিবে পায়?

কোটিকল্প দাস থাকা       নরকের প্রায় হে,

নরকের প্রায়।

দিনেকের স্বাধীনতা       স্বর্গসুখ তায় হে,

স্বর্গসুখ তায়।

স্বাধীনতার এসব বর্ণনা পড়লে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে যে স্বাধীনতার সঙ্গে সুখের সত্যি কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না। বিশেষজ্ঞদের মতে তিন ধরনের স্বাধীনতা রয়েছে :

  • রাজনৈতিক স্বাধীনতা মানব অধিকার ও জনগণের রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার প্রদান করে।
  • অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া পণ্য ও সেবার অবাধ উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিময় নিশ্চিত করে।
  • ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ব্যক্তির নিজ নিজ ধর্ম পালনের সুযোগ, অবাধে চলাচল ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সংরক্ষণ করে।

১৯৯০-এর দশকে ৩৮টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুখ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালিত হয়। এ সমীক্ষাতে সুখের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ধনাত্মক সহগমন পরিলক্ষিত হয়। তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির আয়ের প্রভাবও এতে প্রতিফলিত। এই আয়ের প্রভাব বাদ দিলে দরিদ্র দেশগুলির সঙ্গে ধনী দেশগুলির একটি বড় তফাত দেখা যায়। গরিব দেশগুলোতে সুখের সঙ্গে শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতার তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সুস্পষ্ট সম্পর্ক দেখা যায় না। ধনী দেশগুলির ক্ষেত্রে শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয়, তিন ধরনের স্বাধীনতাই তাৎপর্যপূর্ণ।

তবে এ ধরনের সহগমন থেকে বোঝার উপায় নেই যে গণতন্ত্রের কোন উপাদানগুলি জনসাধারণকে সুখী করে। এ সম্পর্কে সুইজারল্যান্ডের গণতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন ফ্রে এবং স্ট্রটজার (২০০২)। তাদের মূল সিদ্ধান্তগুলি নিম্নরূপ :

  • সুইজারল্যান্ডে ২৬টি ক্যান্টন বা প্রশাসনিক এককে বিভিন্ন ধরনের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে। কোথাও কোথাও সরকারের সব আয় ব্যয়সংক্রান্ত বিষয়ে বড় সিদ্ধান্ত গণভভাটের মাধ্যমে নেওয়া হয়। এ ধরনের ব্যবস্থাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আবার কোথাও কোথাও পরোক্ষ গণতন্ত্র চালু রয়েছে, যেখানে ভোটারদের অনুমতি ছাড়াই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সব সিদ্ধান্ত নেন। সমীক্ষায় দেখা যায়, যেখানে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র রয়েছে সেখানে মানুষ পরোক্ষ গণতান্ত্রিক অঞ্চলের মানুষের চেয়ে সুখী। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় করের হার কম হয়; সরকারের ঋণ কম হয়; শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বেশি হয়। যেহেতু সাধারণ মানুষ এ ধরনের অঞ্চলে বাস করতে পছন্দ করে, সেহেতু এসব অঞ্চলে জমির দাম বেড়ে যায়।
  • সুইজারল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যেখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ যত বেশি সেখানে মানুষ তত সুখী। বিকেন্দ্রীকরণ হলে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সহজ হয়। এখানে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও ত্বরান্বিত করা সম্ভব। তাই বিকেন্দ্রীকরণ সুখ বাড়িয়ে দেয়।