৭. উপসংহার

সুখ সম্পর্কে দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতদ্বৈধতা রয়েছে। চৈনিক দার্শনিক লাও জু (Lao Tsu) বিশ্বাস করতেন, সক্রিয় উদ্যোগ সুখ আনতে পারে না, নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমেই সুখ অর্জন সম্ভব। অনেকে মনে করেন যে সুখ খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হলে মানুষ আরও অসুখী হয়। প্রখ্যাত মার্কিন লেখক ন্যাথানিয়েল হথর্ন মনে করেন, সুখ অর্জনের চেষ্টা বৃথা। তিনি লিখেছেন, ‘Happiness is like a butterfly which, when pursued, is always beyond our grasp, but, if you sit down quietly, may alight upon you.’ (সুখ হচ্ছে প্রজাপতির মতো যাকে তাড়া করে ধরা যায় না। তবে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলে নিজেই আপনার গায়ের ওপর এসে বসবে)। সুখের পেছনে দৌড়ালে সব সময় সুখ মেলে না, অনেক সময় তার বদলে দুঃখ পাওয়া যায়। তাই একজন মার্কিন লেখক লিখেছেন, ‘The search of happiness is one of the chief sources of unhappiness’ (76375 অন্বেষা হচ্ছে দুঃখের একটি বড় কারণ)।

সুখের অন্বেষার ফলাফল যা-ই হোক না কেন, মানুষ প্রতিনিয়ত সুখ খুঁজছে। সুখের উৎস শুধু অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নয়। অর্থনীতি-বহির্ভূত অনেক উপাদানও সুখের নিয়ামক। সুখ তাই জাতীয় উৎপাদের চেয়ে অনেক ব্যাপক। উপরন্তু সুখ সম্পর্কে ব্যক্তির মূল্যায়নও সহজে সংগ্রহ করা যায় । তাই আশা করা হয়েছিল, ব্যক্তিদের সুখ সম্পর্কে মনোনির্ভর মূল্যায়ন যোগ করলে সহজেই জাতীয় সুখের পরিমাপ করা সম্ভব। এ হিসাব জীবন-কুশলতার পরিমাপ হিসেবে অনেক বেশি নির্ভরশীল হবে। কিন্তু এ আশা সফল হয়নি। জাতীয় সুখের সূচক-সম্পর্কিত প্রাক্কলনের তিনটি প্রধান দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, সুখের কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। মানুষের যতই আয় বাড়ছে সুখের জন্য উপকরণের চাহিদা ততই বাড়ছে। তাই আয় বৃদ্ধির অনুপাতে সুখ বাড়ে না। উপরন্তু ব্যক্তির সুখ শুধু তার নিজের আয়ের ওপর নির্ভর করে না। অনেকাংশে তা নির্ভর করে সমাজের অন্যদের আয়ের ওপর। অন্যদের আয় কমে গেলে নিজের আয় না বাড়লেও সুখ বেড়ে যেতে পারে। তাই এ ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে জীবন-কুশলতার অগ্রগতি বা অবনতি পরিমাপ করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, সমাজের সব মানুষের সুখ একসঙ্গে যোগ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তিভেদে সুখের নিবিড়তার প্রভেদ ঘটে। ধরুন, লটারিতে আয় হঠাৎ বেড়ে গেলে সবার সুখ একই মাত্রায় বাড়বে না। কারও কারও ক্ষেত্রে বাড়তি আয়ের সুখ অতি তাড়াতাড়ি অভিযোজিত হয়, যার ফলে সুখের পরিবর্তন ক্ষণস্থায়ী হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে অভিযোজন সম্পূর্ণ হয়। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে অভিযোজন অসম্পূর্ণ থাকে। সে ক্ষেত্রে সুখের পরিমাণ বেশি হয়। যেখানে অভিযোজন সম্পূর্ণ হয়, সেখানে সুখ বৃদ্ধির মাত্রা শূন্যে নেমে আসে। অভিযোজনের মাত্রাভেদে তাই সুখের পরিমাপে বিভিন্ন ব্যক্তির সুখের ওজন ভিন্ন হওয়া উচিত। যদিও বাস্তবে তা সম্ভব হয় না। সামাজিক সুখ প্রাক্কলনে তাই সকলের অভিযোজনের মাত্রা অভিন্ন ও সমান বলে অনুমান করা হয়। এই অনুমান একেবারেই অচল।

তৃতীয়ত, সুখের পরিমাপ করা হয় ব্যক্তির মনোনির্ভর মূল্যায়নের ভিত্তিতে। ব্যক্তি যদি বুঝতে পারে যে তার মূল্যায়নের ভিত্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তবে সে তার নিজের ইচ্ছামতো সরকারকে প্রভাবান্বিত করার জন্য মিথ্যা তথ্য প্রদান করতে পারে। এ ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট মূল্যায়নের ভিত্তিতে সুখের সঠিক পরিমাপ সম্ভব নয়। সমাজের সুখের পরিমাপ হিসেবে সামাজিক সুখের প্রাক্কলন স্কুল জাতীয় উৎপাদের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য নয়।

ফ্রে ও স্ট্রটজার (২০০৬) মনে করেন, সুখ-সম্পর্কিত গবেষণার মূল লক্ষ্য সমাজের সামগ্রিক সুখ বাড়ানো নয়। কারণ সামগ্রিক সুখের হ্রাস-বৃদ্ধির নিখুঁত পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সুখ সম্পর্কে গবেষণার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা, যার মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের সুখের জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের মতে, প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র মানুষের সুখ বৃদ্ধির জন্য অধিকতর সহায়ক।

ফ্রে ও স্ট্রটজারের বক্তব্য সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলির বেলায় এ বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সুখ-সম্পর্কিত সমীক্ষায় ধনী ও গরিবদের মধ্যে কোনো তফাত করা হয় না। অথচ গরিবদের সুখ-দুঃখ বুঝতে হলে গরিবদের সরাসরি স্বতন্ত্র প্রশ্নমালার ভিত্তিতে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ দিতে হবে। দীপা নারায়ণ ও অন্যরা (২০০০) সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন, সমীক্ষার মাধ্যমে নয়, শুধু অংশগ্রহণমূলক গবেষণার ভিত্তিতে দরিদ্রদের সুখ দুঃখের উপলব্ধি সম্ভব। এ ধরনের গবেষণার নামকরণ করা হয়েছে দরিদ্রদের কণ্ঠস্বর’ বা Voices of the Poor।

অর্থনীতিতে সুখ-সম্পর্কিত গবেষণার সবচেয়ে বড় অবদান হলো, এর ফলে অর্থনীতিতে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলি অধিকতর প্রাধান্য লাভ করেছে। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত সূত্রগুলি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের আরও সজাগ থাকতে হবে :

  • স্থিতাবস্থার (Status quo) প্রতি পক্ষপাত ও লাভ-ক্ষতির ক্ষেত্রে সুখের তারতম্য : একই পরিমাণ লাভ করলে যে পরিমাণ সুখ হয়, ওই পরিমাণ লোকসান করলে তার চেয়ে দুঃখ অনেক বেশি হয়। গবেষকদের নিরীক্ষা থেকে দেখা যায় যে ১০০ ডলার হারালে মানুষের যে কষ্ট হয় সে পরিমাণ সুখ অর্জন করতে ২০০ ডলার লাভ করতে হবে (লেয়ার্ড, ২০০৫, ২২৭)। অর্থাৎ মানুষ যা আছে তা হারাতে চায় না। স্থিতাবস্থার প্রতি মানুষের পক্ষপাত রয়েছে। যারা সুখী তারা তাদের যা আছে তাই নিয়ে খুশি। একজন ইহুদি ধর্মযাজক যথার্থই বলেছেন, ‘Happiness is not having what you want. It is wanting what you have.’ (আপনি যা চান তা অর্জন করলে সুখ আসবে না, বরং সুখী হতে হলে আপনার যা আছে তা-ই চাইতে হবে)।
  • ঝুঁকির প্রতি বিতৃষ্ণা : ঝুঁকি নিয়ে লাভ করার চেয়ে লোকসান এড়ানো বেশির ভাগ মানুষের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির ভাষায় বেশির ভাগ মানুষের ঝুঁকির প্রতি অনীহা রয়েছে। তাই রাষ্ট্র যদি এমন কোনো সংস্কার করে, যার ফলে দীর্ঘ মেয়াদে অনেক বড় লাভ হলেও স্বল্প মেয়াদে কিছুসংখ্যক লোকের ক্ষতি হতে পারে, তাহলে সংস্কারের বিরোধীরা যত সক্রিয় হবেন সংস্কারের সম্ভাব্য উপকারভোগীরা তত সোচ্চার হবেন না। যারা সংস্কারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁদের সংস্কারের আগে ক্ষতিপূরণ করা হলে সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধার আশঙ্কা রয়েছে।
  • সুখের জন্য ব্যক্তিসত্তার চেয়ে সামাজিক সত্তার গুরুত্ব অধিক : নিজের আয় বাড়লেই মানুষের সুখ বাড়ে না। অন্যের আয়ের তুলনায় নিজের আয় বাড়লে মানুষের সুখ বাড়ে। সামাজিক মর্যাদা সুখের একটি বড় উপাদান। সামাজিক সম্পর্কও সুখের নিয়ামক। বন্ধুবিচ্ছেদ, বিবাহবিচ্ছেদ, প্রতারণা মানুষের সুখ কমাতে পারে। পক্ষান্তরে সফল পারিবারিক সম্পর্ক মানুষের সুখ বাড়াতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুখ বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবারের সদস্যদের সুবিধামতো কাজের সময় ঠিক করার ব্যবস্থা, কাজের সময় শিশুদের পরিচর্যার সুযোগ ও প্রসবকালীন দীর্ঘ ছুটির উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে রাষ্ট্রের পক্ষে ধনবৈষম্য উৎসাহিত করা বিপজ্জনক। অনেকে তাক লাগানো ভোগবিলাস থেকে সুখ-লাভ করলেও অধিকাংশ নাগরিকই এ ধরনের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়। এর ফলে গোটা সমাজে অসন্তোষের দাবানল ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
  • সুখ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী প্রবণতা : মানুষ একদিকে হিংসুটে, অন্যদিকে সে পরার্থপর। অন্যের তুলনায় আয় বাড়লে যে মানুষ মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, সে মানুষই পরের দুঃখে কাঁদে।
  • বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি : বাড়তি আয় মানুষের সুখ বাড়ায়। তবে শুধু আয় বৃদ্ধিই মানুষের সুখের জন্য যথেষ্ট নয়। বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। সঙ্গে সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাও মানুষের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
  • রাষ্ট্র দুর্গতি ও দুঃখ হ্রাস করতে পারে, তবে সুখ বাড়াতে পারে না : দুঃখের ও দুর্গতির কারণ বাইরে থেকে দেখা যায়। রাষ্ট্র অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে, বেকারত্ব কমিয়ে ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে নাগরিকদের দুর্গতি ও উদ্বেগ কমাতে পারে। কিন্তু মানুষের সুখ বাড়ানোর জন্য তা যথেষ্ট না-ও হতে পারে।

জন বি শিরিন যথার্থই লিখেছেন, ‘Happiness is not in our circumstances but in ourselves. It is not something we see, like a rainbow, or feel, like the heat of a fire. Happiness is something we are.’ (সুখ পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত হয় না, সুখ আমাদের ভেতর থেকে উৎসারিত হয়। সুখ রংধনুর মতো নয় যে তাকে দেখা যাবে, সুখ আগুনের উত্তাপের মতো নয় যে তাকে অনুভব করা যাবে। আমরা নিজেরাই সুখ)। বাইরে থেকে রাষ্ট্র বা সমাজ সুখের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু শুধু ব্যক্তিরাই সুখ সৃষ্টি করতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তাই foresloga, ‘The Constitution only gives people the right to pursue happiness. You have to catch it yourself.’ (সংবিধান নাগরিকদের সুখের পেছনে ছোটার অধিকার দিয়েছে। আপনাকেই সুখকে পাকড়াও করতে হবে)।

সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সুখের সংজ্ঞা নির্ধারণ সম্ভব নয়। ব্যক্তিভেদে সুখের তাৎপর্য ভিন্ন হয়। এ প্রসঙ্গে গোপাল ভাঁড়ের একটি সুন্দর গল্প স্মরণ করা যেতে পারে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র একদিন গোপালকে প্রশ্ন করলেন, ‘গোপাল, বলো তো, কিসে মানুষের সবচেয়ে বেশি সুখ হয়?’

গোপাল বলল, ‘আজ্ঞে মহারাজ, আমার তো মনে হয় পেট পরিষ্কার হয়ে বাহ্যি করার চেয়ে বড় সুখ পৃথিবীতে নেই।’

মহারাজ খুব খেপে বললেন, ‘গোপাল তুই নিজে নোংরা এবং তোর কথাও নোংরা।’ গোপাল তাড়াতাড়ি বেফাঁস কথার জন্য ক্ষমা চাইল।

এর কয়েক দিন পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালসহ অমাত্যদের নিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণে বের হলেন। একদিন মাঝনদীতে যখন সফর করছেন তখন মহারাজার খুব বাহ্যির বেগ পেল। মহারাজ সঙ্গে সঙ্গে হুকুম দিলেন, ‘নৌকা ভেড়াও।’

একজন মাঝি বলে উঠল, “হুজুর একটু অপেক্ষা করুন। একটু আগে এখানে একটা বাঘ দেখা গেছে।

একটু পর মহারাজ হুকুম দিলেন, ‘নৌকা ভেড়াও।’ পাড়ের দিকে নৌকা যেতেই একটি কুমির ভেসে উঠল ।

এবারও নৌকা ভেড়ানো হলো না। মহারাজের ততক্ষণে খুব খারাপ অবস্থা। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘নৌকা পাড়ে ভেড়াও।’ পাড় কাছে এলে দেখা গেল, জায়গাটি খুবই কর্দমাক্ত। গোপাল কিছু বলতে চাইছিল। মহারাজ কারও কোনো কথা না শুনে কাদায় লাফিয়ে পড়লেন এবং কোনোরকমে পাড়ে উঠে তাঁর কাজকর্ম শেষ করে কর্দমাক্ত অবস্থায় নৌকায় ফিরে এলেন। তারপর স্নান শেষে গোপালকে বললেন, ‘গোপাল, কী যে সুখ লাগছে এখন! তুমি খাঁটি কথা বলেছিলে।’

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের মতো আমরা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সুখের বহু বিচিত্র রূপ অনুভব করি ।