৪. ইস্টারলিন প্রহেলিকা (Easterlin Paradox): ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য মানুষের সুখ কেন অব্যাহতভাবে বাড়াচ্ছে না?

কাজী নজরুল ইসলাম বড়াই করে লিখেছেন, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান। কারণ হিসেবে বলেছেন, দারিদ্র্য তাকে ‘অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস দিয়েছে’। তবে এ দাবি কখনো করেননি যে দারিদ্র্য তাঁকে সুখ দিয়েছে। বরং তিনি লিখেছেন :

দারিদ্র অসহ

পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ

আমার দুয়ার ধরি। কে বাজাবে বাঁশি?

কোথা পাব অনিন্দিত সুন্দরের হাসি?

দরিদ্র মানুষের মনে সুখ নেই, তাই তাঁর মুখে হাসি বেমানান। বেশির ভাগ মানুষেরই সুখের জন্য চাই অর্থ ও বিত্ত। তাই তো ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি’।

দেশভেদে সুখের তারতম্যের একটি বড় নিয়ামক হলো মাথাপিছু আয় । তৃতীয় অংশের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে ধনী দেশের অধিবাসীদের সুখের মাত্রা উচ্চতর পর্যায়ের। গরিব দেশের মানুষেরা অপেক্ষাকৃত অসুখী হয়। দেশভেদে এ সূত্র যেমন সত্যি, দেশের ভেতরেও শ্রেণীভেদে তা সমভাবে কার্যকর। এই বক্তব্যের সমর্থনে দুই ধরনের উপাত্ত রয়েছে। প্রথমত, দেশভেদে সুখ ও মাথাপিছু আয়ের মধ্যে ধনাত্মক সহগমন লক্ষ করা যায় । ৪৯টি দেশের সুখ ও মাথাপিছু আয়ের সম্পর্ক বিশ্লেষণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে সুখ ও মাথাপিছু আয়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে। তবে সুখের ওপর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির তাৎক্ষণিক প্রভাব অত্যন্ত নগণ্য। মাথাপিছু আয় ১০ শতাংশ বাড়লে সুখের পরিমাণ (১ থেকে ১০ মাত্রায়) ৩৩৩ ভাগের এক ভাগ বাড়ে। (ব্রুনো এস ফ্রে ও অলিয়েস স্ট্রটজার, ২০০২, ৪১৮)। দ্বিতীয়ত, একই দেশে গরিবদের তুলনায় ধনীরা বেশি সুখী হয়। ১৯৭২-৭৪ ও ১৯৯৪-৯৬ সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আয়ের শ্রেণী অনুসারে গড় সুখের (১ থেকে ৪ মাত্রায়) প্রাক্কলন সারণি ৩.৪-এ দেখা যাবে।

সারণি ৩.৪

সারণি ৩.৪ থেকে দেখা যাচ্ছে যে নিম্ন-আয়বন্ধনীর ব্যক্তিদের সুখের মাত্রা উচ্চ-আয়বন্ধনীর লোকদের চেয়ে কম। ১৯৯৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে যাদের মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলারের কম, তাদের মাত্র ১৬ শতাংশ নিজেদের অতি সুখী মনে করে। পক্ষান্তরে যাদের মাথাপিছু আয় ৭৫ হাজার ডলারের বেশি, তাদের ৪৪ শতাংশ নিজেদের ‘অতি সুখী’ গণ্য করে থাকে। একই ধরনের প্রবণতা ইউরোপ ও জাপানেও লক্ষ করা যায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সময়কালে ইউরোপে ইউরো-ব্যারোমিটার সমীক্ষায় দেখা যায়, সর্বোচ্চ আয়বন্ধনীর ব্যক্তিদের ৮৮ শতাংশ ব্যক্তি তাদের জীবন সম্পর্কে খুব অথবা যথেষ্ট সন্তুষ্ট। পক্ষান্তরে সর্বনিম্ন আয়ের এক-চতুর্থাংশ মানুষের মাত্র ৬৬ শতাংশ একই রকম সন্তুষ্ট। কোথাও কোথাও কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও সামগ্রিকভাবে এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী দেখা যাচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, ধনী দেশের মানুষেরা গরিব দেশের মানুষদের তুলনায় অধিকতর সুখী। আবার একই দেশের ভেতরে দেখা যাচ্ছে, ধনী ব্যক্তিরা গরিবদের চেয়ে সুখী। এসব উপাত্ত থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়, আয় ও সুখের মধ্যে নিবিড় ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত দেশগুলিতে মাথাপিছু আয় নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। অথচ এই সময়ে সেখানে সুখের মাত্রায় কোনো ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না; বরং কোথাও কোথাও উল্লেখযোগ্য আয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও সুখের পরিমাপ কমেছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো :

১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সময়কালে সুখ সম্পর্কিত সমীক্ষাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে আমেরিকানরা ১৯৫০ এর দশকে সবচেয়ে সুখী ছিল, তবে ১৯৪৭-৭৭ সময়কালে সুখের কোনো সুস্পষ্ট প্রবণতা লক্ষ করা যায় না। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে এ সময়ে মাথাপিছু আয়ের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। ১৯৪৬ থেকে ১৯৯১ সময়কালে ১৯৯৬ সালের স্থিরীকৃত ডলারের মানে যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় ১১ হাজার ডলার থেকে ২৭ হাজার ডলারে উন্নীত হয়। অর্থাৎ ৪৫ বছর সময়কালে এ আয় ১৫০ শতাংশ বাড়ে। মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানে দ্রুত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। মাথাপিছু আয় যখন কম ছিল তখন শৌচাগার ছিল ঘরের বাইরে। আর্থিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লাগোয়া শৌচাগারের চল হয়। ঘরে ঘরে চালু হয় তাপনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা, কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, রঙিন টেলিভিশন, টেলিফোন, হরেক রকম বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি । বাড়ি বাড়ি গাড়ি কেনার ধুম পড়ে যায়। সারা দুনিয়া থেকে। আমদানি করা হয় অজস্র স্বাদু খাদ্যদ্রব্যের উপাদান। সময়ের ব্যবধানে আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুখ বেড়ে যাওয়ার কথা। অথচ এ সময়কালে মার্কিনদের সুখ কমে যায়। ১৯৫০-এর দশকে শূন্য থেকে তিন মাত্রায় সুখের পরিমাপ ছিল ২.৪। অভাবিতপূর্ব অর্থনৈতিক সাফল্য সত্ত্বেও ১৯৯১ সালে সুখের পরিমাপ ২.২-এ নেমে আসে। আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুখ বাড়ছে না, হয় স্থিতিশীল থাকছে, নয়তো কমে যাচ্ছে।

রেখাচিত্র এক

২) ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন : ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৯ সময়কালে ইউরোপে নিম্নলিখিত নয়টি দেশে ইউরো-ব্যারোমিটার (Euro-barometer) সুখ সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ করে : (১) ডেনমার্ক (২) নেদারল্যান্ডস (৩) বেলজিয়াম (৪) আয়ারল্যান্ড (৫) ব্রিটেন (৬) জার্মানি (৭) ফ্রান্স (৮) গ্রিস এবং (৯) ইতালি। এই সময়ে স্থিরীকৃত মূল্যে মাথাপিছু আয় ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ে। অথচ এই সময়ে দুটি দেশে সুখ ও মাথাপিছু আয়ের মধ্যে সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ঋণাত্মক সহগমন দেখা যায়। অন্যদিকে পাঁচটি দেশে সুখ ও আয়ের মধ্যে সম্পর্ক সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে তাৎপর্যহীন। শুধু দুটি ক্ষেত্রে আয় ও সুখের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যাতাত্ত্বিক ধনাত্মক সহগমন পরিলক্ষিত হয়। (ইস্টারলিন, ২০০১, ১৩৭-৩৮)। অন্য আরেকটি গবেষণায় দাবি করা হয়, ডেনমার্ক, ইতালি ও জার্মানিতে আয় ও সুখের সম্পর্ক ক্ষীণ হলেও তাৎপর্যপূর্ণভাবে ধনাত্মক। তবে একই সময়ে বেকারত্বের হার, মূল্যস্ফীতির হার হ্রাস পাওয়াতে ও আয়ের সুষম বণ্টন ঘটাতে সুখের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই আয় ও সুখের মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। ইউরোপে সুখ সম্পর্কে প্রাপ্ত বিশ্লেষণগুলি বিবেচনা করলে মনে হয়, সেখানে সময়ের ব্যবধানে আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুখের কোনো লক্ষণীয় তারতম্য ঘটেনি।

৩) জাপান : ১৯৫৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সময়কালে জাপানে মাথাপিছু আয় ছয় গুণ বেড়েছে। ১৯৫৮ সালে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে জাপানের মাথাপিছু আয় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২.৫ শতাংশ। ১৯৮৭ সালে এ হার ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৯৫৮ সালে ১ শতাংশ পরিবারের গাড়ি ছিল । ১৯৮৭ সালে এই হার ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে জাপানে অতি নগণ্যসংখ্যক পরিবারে লাগোয়া শৌচাগার, বৈদ্যুতিক কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, ফ্রিজ, টেলিভিশন বা টেলিফোন ছিল। আশির শেষ দিকে এ ধরনের স্থায়ী সেবার সর্বজনীন ব্যবহার সাধারণ মানুষের জীবন সমৃদ্ধ করে। ১৯৫৮ সালে জাপানে জীবন-সন্তুষ্টি পরিমাপ এক থেকে চার মাত্রায় ছিল ২.৭। ১৯৯০ সালে এই পরিমাপ ২.৭-এ অপরিবর্তিত ছিল (ব্রুনো এস ফ্রে ও অলিয়েস স্ট্রটজার, জুন ২০০২)। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু আয় এবং বিভিন্ন স্থায়ী ভোগ্যপণ্য ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি সত্ত্বেও সুখের কোনো হেরফের হয়নি।

৪) চীন : ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সময়কালে চীনে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হয়। স্থিরীকৃত মূল্যে মাথাপিছু আয় ২.৫ গুণ বেড়ে যায় । ১৯৯৪ সালে ৪০ শতাংশ পরিবারের রঙিন টেলিভিশন ছিল; ২০০৫ সালে এ হার ৮৪ শতাংশে উন্নীত হয়। একই সময়ে টেলিফোন ব্যবহারকারীর হার ১০ শতাংশ থেকে ৬৩ শতাংশে উন্নীত হয়। অথচ এই সময়ে জীবন নিয়ে সন্তুষ্টের সংখ্যা ৭৮ শতাংশ থেকে প্রায় ৬৫ শতাংশে নেমে আসে; আর জীবন নিয়ে অসন্তুষ্টের হার ২২ শতাংশ থেকে প্রায় ৪০ শতাংশে উন্নীত হয় (ড্যানিয়েল কায়নেম্যান ও এলেন বি কুগার, ২০০৬)। অর্থাৎ এ কথা স্পষ্ট, চীনের মানুষের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়লেও সুখ বাড়ছে না।

যেকোনো সমাজের দিকে তাকালে দেখতে পাব, মানুষ সুখের জন্য আয় বাড়াতে ব্যস্ত। অথচ বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন ধরে আয় বাড়া সত্ত্বেও মানুষের সুখ বাড়ছে না। এই প্রহেলিকা প্রথম তুলে ধরেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ ইস্টারলিন। তাই একে ইস্টারলিন প্রহেলিকা (Easterlin Paradox) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই প্রহেলিকার একটি সহজ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, সুখ ও আয়ের সম্পর্ক সরলরৈখিক নয়। তার মানে এই সম্পর্ক একটি নিরবচ্ছিন্ন সরলরেখায় প্রকাশ করা যাবে না। এ সরলরৈখিক সম্পর্কে একটি বাঁক রয়েছে (রেখাচিত্র-১ দ্রষ্টব্য)। সব দেশেই। সুখের জন্য একটি সর্বনিম্ন গ্রহণযোগ্য আয় রয়েছে। যেখানে মাথাপিছু আয় খুবই কম অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য আয়ের নিচে, সেখানে মাথাপিছু আয় বাড়লে সুখ বাড়ে। কিন্তু মাথাপিছু আয় বেড়ে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উত্তীর্ণ হলে সে ক্ষেত্রে সুখের জন্য আয়ের গুরুত্ব কমে যায়। এ ক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় বাড়লে সুখ কমে যায় বা অপরিবর্তিত থাকে।

জীবনযাত্রার গ্রহণযোগ্য মানের জন্য একটি সর্বনিম্ন আয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কেউ বলেন, মাথাপিছু ১০ হাজার ডলার আয় থাকলে জীবনযাত্রার গ্রহণযোগ্য মান অর্জন সম্ভব। কেউ বলছেন ২০ হাজার ডলারের কমে এ মান অর্জন করা সম্ভব নয়।

তবে ঐতিহাসিক উপাত্তগুলি অতি নিম্ন আয়ের দেশে মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি সুখ বাড়ায়–এ প্রতর্ক সমর্থন করে না। উদাহরণস্বরূপ জাপান ও চীনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৫৮ সালে জাপান মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে ছিল এবং সে মাথাপিছু আয় গ্রহণযোগ্য জীবনযাত্রার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই এ পর্যায়ে মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির ফলে জাপানিদের সুখ বাড়ার কথা। অথচ ১৯৫৮ থেকে ১৯৯০ সময়কালে জাপানে সুখ হয় অপরিবর্তিত ছিল নয়তো কমেছে। ১৯৯৪ সালে চীনে মাথাপিছু আয় ক্রয়ক্ষমতার সমতাভিত্তিক (PPP) ডলারে ছিল ২ হাজার ৫১০ ডলার, যা শ্রীলঙ্কা (৩ হাজার ১৬০ ডলার), ইন্দোনেশিয়া (৩ হাজার ৬০০ ডলার) অথবা ফিলিপাইন্সের (২ হাজার ৭৪০ ডলার) চেয়ে কম। কাজেই চীন সে সময়ে একটি নিম্ন আয়ের দেশ ছিল । এ ধরনের গরিব দেশে আয় বাড়লে সুখ বাড়া অত্যন্ত প্রত্যাশিত। ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সময়কালে চীনে মাথাপিছু আয় ২.৫ গুণ বাড়ে। অথচ চীনে এ সময়ে সুখ কমে গেছে। জাপান ও চীনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, শুধু ধনী দেশের ক্ষেত্রেই নয়, গরিব দেশের ক্ষেত্রেও আয়ের সঙ্গে সুখের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক নেই।

ইস্টারলিনের মতে, মানুষের সুখ শুধু স্থিরীকৃত মূল্যে বর্তমান আয়ের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না। সুখের দুটি প্রধান নিয়ামক হচ্ছে : (১) আয়ের সঙ্গে সুখের অভিযোজন এবং (২) আয়ের দিক থেকে সমাজে ব্যক্তির আপেক্ষিক অবস্থান।

মানুষ অভ্যাসের দাস। ব্যক্তির আয় বাড়লে সে নতুন নতুন পণ্য ও সেবা ক্রয় করে। যেমন ধরুন, একজন ব্যক্তির আয় বাড়লে সে নতুন গাড়ি ও বাড়ি কেনে। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই নতুন গাড়ি ও বাড়ির চমক চলে যায়। গাড়ি ও বাড়ি তার অভ্যাসে পরিণত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তার সুখের জন্য পুরোনো বাড়ি-গাড়ি যথেষ্ট থাকে না, আরও বড় বাড়ি ও গাড়ির প্রয়োজন দেখা দেয়। মনস্তত্ত্বে এ প্রক্রিয়াকে বলে অভিযোজন (adaptation)। ব্যক্তিজীবনে নতুন সুখ বেশি দিন টেকে না। যেকোনো নতুন সেবা ও পণ্য গতানুগতিক জীবনে অভিযোজিত হয়ে যায়। ব্যক্তি নতুন সুখে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই তার সুখের মাত্রা অপরিবর্তিত রাখার জন্য নতুন নতুন পণ্য ও সেবার প্রয়োজন। তার জন্য দরকার বাড়তি আয় । যতই আয় বাড়তে থাকে মানুষের সাধও বাড়তে থাকে। সাধের শেষ নেই। আয় বাড়িয়েও সব সাধ মেটানো যায় না। সুখের বর্তমান মান ধরে রাখার জন্যই আয় বাড়াতে হয়। তাই কালান্তরে সুখের মাত্রা অপরিবর্তিত রাখার জন্য বাড়তি আয়ের দরকার। এ পরিস্থিতি আজব দেশে এলিসের সঙ্গে তুলনীয়। আজব দেশের নিয়ম হলো : You have to run as fast as you can just to stay where you are. If you want to get anywhere you have to run much faster’. (যেখানে আছ সেখানে থাকতে হলে তোমাকে দৌড়াতে হবে। যদি তুমি কোথাও যেতে চাও, তবে তোমাকে আরও জোরে দৌড়াতে হবে)। সুখের মান অপরিবর্তিত রাখতে হলে উচ্চতর আয়ের। পেছনে দৌড়াতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে সমাজবিজ্ঞানীরা আখ্যায়িত করেছেন। hedonic tread-mill’ বা বিদ্যমান সুখের অবস্থানে ঠায় দাঁড়ানোর জন্য দৌড়ের যন্ত্র।

ব্যক্তির সুখ শুধু তার নিজের আয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। তার সুখের একটি নিয়ামক হলো সমাজের অন্যদের আয়ের তুলনায় তার নিজের আয়ের অবস্থান। যদি সমাজের সবার আয় স্থির থাকে এবং একজন বিশেষ ব্যক্তির আয় বাড়ে, তবে নিঃসন্দেহে লোকটির সুখ বাড়বে। যদি সমাজের ও বিশেষ ব্যক্তিটির আয় সমানুপাতিক হারে বাড়ে, তবে কেউই বিশেষ করে পুলকিত হবেন না। পক্ষান্তরে যদি কোনো ব্যক্তির আয় বাড়ে এবং এই বৃদ্ধির হার সমাজের অন্যদের চেয়ে কম হয়, তবে সে ব্যক্তি আয় বাড়া সত্ত্বেও অসুখী হবে। নিজের আয় বেড়ে গেলে সুখ বাড়লেও অন্যদের আয় অপেক্ষাকৃত বেশি বেড়ে গেলে সুখ কমে যায়। আয় বৃদ্ধিজনিত জীবন-সন্তুষ্টি অনেকাংশে কালান্তরে অভিযোজিত হয়। উপরন্তু অনাপেক্ষিক আয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তির আপেক্ষিক আয় হ্রাস (অর্থাৎ অন্যদের আয় বেশি বেড়েছে) তার সুখের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। সামগ্রিকভাবে আয়-বৃদ্ধিজনিত সুখের সময়ের ব্যবধানে অভিযোজনের এবং আয় বৃদ্ধি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ায় আপেক্ষিক ধনবৈষম্য না বাড়ার ফলে কালান্তরে আয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও সুখের পরিমাপ বাড়ে না।

কালান্তরে আয় বাড়ছে, অথচ সুখ বাড়ছে না। তবে কেন নিরন্তর মানুষ অর্থের পেছনে দৌড়াচ্ছে? মানুষ কেন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিখছে না? অর্থের পেছনে না ঘুরে পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটালে অথবা স্বাস্থ্যচর্চা করলে তাদের সুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবু পরিবার ও স্বাস্থ্যকে অবহেলা করে কেন আয়ের ওপর মানুষ জোর দিচ্ছে? এর কারণ এখনো সুস্পষ্ট নয়। তবে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। একটি কারণ হতে পারে, সবাই বাড়তি আয়ের জন্য ইঁদুর-দৌড়ে অংশ নিলে যে দৌড়াবে না। সে পিছিয়ে পড়বে। সময়ের ব্যবধানে আয়ের যথেষ্ট ওঠানামা ঘটতে পারে। অন্যদের আয়ের তুলনায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ে সবাই তটস্থ থাকে। তাই আয় থেকে যতটুকু সুখ পায় তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্যম ও সময় অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যয় করে। পরিবারের সঙ্গে কিংবা স্বাস্থ্যচর্চা বা বিনোদনের জন্য একজন ব্যক্তি কত সময় খরচ করবে, এটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু অর্থের জন্য সে কতটুকু পরিশ্রম করবে, এটি অনেকাংশে সমাজ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন পূর্ণকালীন শ্রমিক বছরে প্রায় ২ হাজার ঘণ্টা কাজ করে; অথচ জার্মানিতে ১ হাজার ৬৭০ থেকে ১ হাজার ৬৮০ ঘণ্টা কাজ করে (রিচার্ড লেয়ার্ড, ২০০৫, ৫০)। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের সমকক্ষদের সঙ্গে প্রতিযোগী থাকার জন্য ইউরোপিয়ানদের চেয়ে অনেক বেশি দৌড়াতে হয় টাকার পেছনে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে কালান্তরে সুখ কমছে।