৫. সুখের আয়বহির্ভূত অর্থনৈতিক নিয়ামকগুলি

আয়ই সুখের একমাত্র অর্থনৈতিক নিয়ামক নয়। বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও সামাজিক অসাম্যও সুখের মাত্রাকে প্রভাবান্বিত করে। বেকারত্ব শুধু একটি অর্থনৈতিক অভিশাপই নয়, বেকারত্ব একই সঙ্গে একটি মানবিক ও সামাজিক দুর্যোগও বটে। বেকারত্ব আত্মসম্মানের সংকট সৃষ্টি করে। যারা চাকরি হারায় তাদের মর্যাদার হানি ঘটে। তারা কর্মক্ষেত্রে সহযোগীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে। তাদের মানসিক যন্ত্রণার ফলে তাদের মৃত্যুর হার বেড়ে যায়, আত্মহত্যার ও মাদকাসক্তির হার বৃদ্ধি পায়। তাদের পরিবারের মধ্যেও ফাটল দেখা দেয়। উপরন্তু সমাজে মর্যাদার হানি ঘটে। বেকারত্বের মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক মাশুল বেকারত্বের আর্থিক লোকসানের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। ফ্রে ও স্ট্রটজারের (২০০২, ৯৯) মতে, বেকারত্বের ফলে যে পরিমাণ সুখ কমে, তার এক তৃতীয়াংশ ঘটে বেকারত্বের ফলে আয় হ্রাস পাওয়ায় আর দুই-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী হলো মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক ক্ষতি। ব্রিটেনে বেকারত্ব সম্পর্কে গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে বেকারত্ব যত সুখ হ্রাস করে, অন্য কোনো ঘটনা ব্যক্তির তত ক্ষতি করে না। বেকারত্ব বিবাহবিচ্ছেদের চেয়েও বেদনাদায়ক।

যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্ব সম্পর্কে রোনাল্ড রেগানের একটি সুন্দর চুটকি রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘Recession is when your neighbor loses his job. Depression is when you lose yours. And recovery is when Jimmy Carter loses his.’ (যখন আপনার প্রতিবেশী চাকরি হারান। তখন অর্থনীতিতে পড়তি অবস্থা। যখন আপনার চাকরি চলে যায় তখন অর্থনীতিতে মন্দা। আর যখন জিমি কার্টার তার চাকরি (রাষ্ট্রপতিত্ব) হারান তখন অর্থনীতির নিরাময় ঘটে)। রেগানের রাজনৈতিক বক্তব্য না মেনে। নিলেও এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে মানুষ শুধু তার নিজের বেকারত্ব নিয়েই উদ্বিগ্ন নয়, সে তার প্রতিবেশীদের বেকারত্ব নিয়েও শঙ্কিত থাকে। বেকারত্বের হার বাড়তে থাকলে সমাজে সুখ কমতে থাকে। একটি সমীক্ষাতে সুখের দৃষ্টিকোণ থেকে মোট জনসংখ্যাকে চার ধাপে বিভক্ত করা হয়েছে। (অতিসুখী, মোটামুটি সুখী, তত সুখী নয়, সর্বনিম্ন পর্যায়ের সুখী)। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বেকারত্বের হার এক শতাংশ বাড়লে প্রতি ধাপের জনসংখ্যার দুই শতাংশ সুখের পরবর্তী ধাপে নেমে যায় (ব্রুনো এস ফ্রে ও ধ্রুটজার, ২০০২ খ, ৪২০)। এর কারণ হলো দেশে বেকারত্বের হার বাড়লে সবাই নিজ নিজ চাকরি হারানোর ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ৪৬টি দেশে ৯০ হাজার ব্যক্তিকে নিয়ে একটি সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে যে মানুষের সুখের জন্য দুটি উপাদান সবচেয়ে হানিকর। এদের গুরুত্ব সমান। এ দুটি উপাদান হচ্ছে বেকারত্ব ও স্বাস্থ্যহানি (রিচার্ড লেয়ার্ড, ২০০৬, ৬৪)।

মূল্যস্ফীতি : একজন মার্কিন অর্থনীতিবিদ যথার্থই বলেছেন, মানুষ। মূল্যস্ফীতিকে ঘৃণা করে, অথচ মূল্যস্ফীতির কোনো কোনো কারণকে খুবই পছন্দ করে। যেমন ধরুন, সরকার কর না বাড়িয়ে ঘাটতির মাধ্যমে অতিরিক্ত সেবা প্রদান করলে সবাই খুশি হয়; অথচ এ ঘাটতির ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে অর্থনীতিতে অস্থিরতার জন্ম দেয়। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদই উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিপক্ষে। তবে নিম্ন মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। মূল্যস্ফীতি সব অবস্থাতেই স্থির আয়ের আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রকৃত আয় হ্রাস করে। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলে অনেকের আয় বেড়ে যেতে পারে এবং তার প্রকৃত আয় স্থির থাকতে পারে অথবা বাড়তে পারে। আপাতদৃষ্টিতে তাদের সুখ কমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে সুখসংক্রান্ত মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়, সবাই মনে করে যে মূল্যস্ফীতি তাদের প্রকৃত আয় হ্রাস করছে এবং মূল্যস্ফীতি ক্ষতিকারক। সাধারণ মানুষের মূল্যস্ফীতি নিয়ে তিনটি উদ্বেগ রয়েছে। প্রথমত, সবাই মনে করে যে ভবিষ্যতে মূল্য বাড়তে থাকলে তাদের প্রকৃত আয় কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতির ফলে ধনীরা ফুলে-ফেঁপে ওঠে আর গরিবেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৃতীয়ত, সমাজে বেশির ভাগ মানুষ মনে করে যে মূল্যস্ফীতি অনৈতিক। মেহনতি মানুষকে নিঃস্বতর করে মূল্যস্ফীতি সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। আবার কেউ কেউ মনে করে যে মূল্যস্ফীতি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে।

১৯৭৫-১৯৯১ সময়কালে ইউরোপে পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি ১ শতাংশ বাড়লে সুখের গড় পরিমাপ (১ থেকে ৪ স্কেলে) ৩.২ থেকে ৩.১ শতাংশে কমে আসে। আপাতদৃষ্টিতে এ প্রভাব ক্ষীণ মনে। হলেও মূল্যস্ফীতির হার লক্ষণীয়ভাবে বাড়লে সুখের ওপর তার সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যদি মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশ বাড়ে তবে এ ক্ষেত্রে সুখের গড় পরিমাপ ৩.২ থেকে ২.৭ শতাংশে নেমে আসে।

বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি উভয়েই সুখের শত্রু। আশির দশক থেকে মার্কিন রাজনীতিবিদেরা দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সুখ মাপার জন্য একটি নতুন সূচক ব্যবহার করছেন। তারা এর নাম দিয়েছেন Misery Index বা দুর্গতির সূচক। এই সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতির শতকরা হার ও বেকারত্বের শতকরা হারের যোগফল। যদি কোনো দেশে বেকারত্বের হার হয় ১০ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতির হার হয় ১০ শতাংশ, তবে দুর্গতির হার হবে ২০ শতাংশ। তবে উন্নত দেশগুলিতে এ হার কমানোর একটি বড় অসুবিধা হলো, যেসব দেশে কর্মসংস্থানের হার অতি উঁচু, সেসব দেশে বেকারত্ব হ্রাস করতে গেলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। ফলে দুর্গতির হার কমে না। অবশ্য সুখের দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্গতির সূচকের একটি বড় দুর্বলতা রয়েছে। এই হারের প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন যে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি একই মাত্রায় সুখ হ্রাস করে। বাস্তবে বেকারত্ব মূল্যস্ফীতির চেয়ে সুখের জন্য অনেক বেশি হানিকর। ১৯৭৩-১৯৯৮ সময় কালে ইউরোপে সুখ-সম্পর্কিত একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যায় ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যে পরিমাণ সুখ হ্রাস করে, তার ৪.৭ গুণ সুখ নাশ করে ১ শতাংশ বেকারত্বের বৃদ্ধি (রাফায়েল ডি তুল্লা ও রবার্ট ম্যাক্‌-কুলক, ২০০৬, ৩৮)। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের চেয়ে বেকার সমস্যা হ্রাস অনেক বেশি জরুরি।

ধন-বণ্টনও সুখের একটি নিয়ামক। যারা ধনী তাদের জন্য মূল্যস্ফীতি আদৌ কোনো সমস্যা নয়। অথচ যারা স্থির আয়ের দরিদ্র, মূল্যস্ফীতি তাদের জন্য একটি বড় বালাই। জনসংখ্যার সিংহভাগ সচ্ছল হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিদারুণ দুর্গতি সত্ত্বেও সুখের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব সীমিত থাকবে। একই কারণে অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করার জন্য সম্পদের পুনর্বণ্টন সমাজের সুখ বাড়াতে পারে। সম্পদের পুনর্বণ্টন হলে ধনীরা আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু যেহেতু তাদের অনেক অর্থ আছে সেহেতু পুনর্বণ্টনের আর্থিক ক্ষতি তাদের তত কষ্টের কারণ হয় না। পক্ষান্তরে পুনর্বণ্টনের ফলে গরিবেরা অল্প লাভবান হলেও অনেক বেশি। সুখী হয়। কাজেই ধনের পুনর্বণ্টন সমাজে সুখ বাড়াতে পারে। পুনর্বণ্টনের সমস্যা অন্যত্র। পুনর্বণ্টনের জন্য করের বোঝা বাড়ানো হলে বিত্তবানরা অতিরিক্ত বিনিয়োগের প্রণোদনা হারিয়ে ফেলতে পারে। এতে সমাজে ধন উৎপাদন কমে যেতে পারে। আয় কমে যাওয়াতে সুখ কমে যেতে পারে। কাজেই ধন পুনর্বণ্টনের আগে এর লাভ ও ক্ষতি দুটি দিকই বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।