☼ অতুল সুর ☼
চোদ্দ শতকের বাঙালী
বিগত শতকের শেষার্ধে গণতান্ত্রিক প্রভাব যে মাত্র হিন্দুর বিবাহের ওপরই পড়েছে, তা নয়। মুসলিম বিবাহের ওপরও পড়েছে। তবে মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় অনেক বেশি মৌলবাদী। মৌলবাদীদের মতে মুসলিম সমাজের বিবাহ কোরান বা শরিয়াত অনুযায়ী হওয়া চাই।
মুসলিমসমাজে বিবাহ সম্পর্কে বাধানিষেধ হিন্দু সমাজের তুলনায় অনেক কম। তবে প্রথম বিবাহ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে অনূঢ়া মেয়ের সঙ্গে হওয়া চাই। পরবর্তী বিবাহ সম্বন্ধে কোন বাধানিষেধ নেই। হিন্দুদের মত মুসলমানসমাজে কোন গোত্রবিভাগ নেই। সেই কারণে বহির্বিবাহের কোন নিয়ম-কানুনও নেই। নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে কোন পুরুষ যে কোন স্ত্রীলোককে বিবাহ করতে পারে। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ হয় না তবে বাঞ্ছনীয় বিবাহ হিসাবে খড়তুতো, জাঠতুতো, মাসতুতো, মামাতো, পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত আছে। এরূপে ভাইবোন থাকলে তাদের মধ্যে বিবাহই অগ্রাধিকার পায়। তা না হলে অন্য পরিবারে বিবাহ হয়। এরূপ বিবাহের সমর্থনে বলা হয় যে, এতে রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা হয় ও সম্পত্তি অবিভক্ত অবস্থায় থাকে। তবে কোন কোন জায়গায় ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহের বিরোধিতাও লক্ষিত হয়।
হিন্দুসমাজের মত মুসলিমসমাজেও বিবাহ সর্বজনীন ব্যাপার। সকলকেই বিবাহ করতে হয় এবং ‘চিরকৌমার্য’ কখনও উৎসাহিত করা হয় না। মুসলিমসমাজে ১৫ বৎসরের অধিক বয়স্ক যে কোন পুরুষ বিবাহ করতে পারে। অভিভাবকদের সম্মতি নিয়ে ১৫ বৎসরের কম বয়স্ক ছেলেমেয়েদের মধ্যেও বিবাহ চলে। মুসলিমসমাজে বিবাহে বর ও কনে উভয়েরই সম্মতির প্রয়োজন হয় এবং তা বিশেষভাবে স্পষ্টতার সঙ্গে প্রকাশ করতে হয়। দু’জন পুরুষ বা একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোকের সামনে বিবাহের প্রস্তাব ও স্বীকৃতি একই সময় করতে হয়।
প্রতারণা বা বলপ্রয়োগ দ্বারা বিবাহ অবৈধ বলে গণ্য হয়। মুসলিমসমাজে কোন স্ত্রীলোক মুসলমান ব্যতীত অপর কাহাকেও বিবাহ করতে পারে না। তবে পুরুষরা মুসলমান ব্যতীত “কিতাবিয়া” ( ক্লীশ্চান বা ইহুদী) নারীকেও বিবাহ করতে পারে। মুসলিমসমাজে বহুপত্নী গ্রহণের কোন বাধা নেই। তবে চারটির বেশি পত্নী গ্রহণ নিয়মবিরুদ্ধ বলে ধরা হয়।
যদি বিদ্যমান সম্পর্ক অবৈধ বলে গণ্য না হয় তাহলে মুসলিমসমাজে স্ত্রী-পুরুষ যেখানে স্থায়ীভাবে স্বামী-স্ত্রীরূপে বাস করে আসছে কিংবা পুরষ যদি স্বীকার করে যে সে নারী তার স্ত্রী তাহলে সে সম্পর্ক কে বিবাহের পর্যায়ে ফেলা হয়। ইসলামধর্মাবলম্বী কোন কোন শাখার মধ্যে “মোতা” নামে একরকম বিবাহ প্রচলিত আছে। “মোতা” বিবাহ হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাময়িক বিবাহ। অনেক সময় এরূপ বিবাহ মাত্র একদিনের জন্যও স্থায়ী হয়। এরূপ বিবাহে স্ত্রীধনও দেওয়া হয়। কিন্তু এরূপ বিবাহের ফলে উৎপন্ন সন্তানের কোন উত্তরাধিকার থাকে না। তবে পরস্পরের মধ্যে চুক্তি করে এরূপ সন্তানের উত্তরাধিকার দেওয়া চলে। অবশ্য উত্তরাধিকার না থাকলেও সন্তানের বৈধতা সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন বা বিবাদ ওঠে না। বিচ্ছেদের পর এরূপ বিবাহে স্ত্রী কোনরূপ ভরণপোষণ পায় না। সাধারণতঃ নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ হলে বা তার পূর্বে উভয়ের মধ্যে কেউ মারা গেলে বা স্বামী যদি মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগেই সময়ের মকুব করে তাহলে এরূপ বিবাহের ছেদ ঘটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্ত্রীকে “ইদ্দত” উদ্যাপন করতে হয়। মুসলিমসমাজে “ইদ্দত” বলতে বোঝায় এক বিবাহ বিচ্ছেদের সময় থেকে অপর বিবাহের মধ্যবর্তীকালীন অপেক্ষা করবার সময়।
আদালতের সাহায্য ব্যতিরেকে মুসলিমসমাজে সহজে বিবাহ বিচ্ছেদ করা যায়। এ সম্পর্কে প্রথাগত রীতি অনুযায়ী ছ’রকম পদ্ধতি আছে। প্রথম পদ্ধতি হচ্ছে “তালাক” উচ্চারণ করে দাম্পত্য সম্পর্কের ছেদ ঘটানো। যদি “তালাক” একবার উচ্চারণ করা হয় তাহলে তালাকের পর “ইদ্দত” পালন করতে হয়। আর এক রকমের “তালাক” হচ্ছে স্ত্রীলোকের ক্রমান্বয় তিনটি “তুড়”-এর (মাসিক ঋতু) সময় তিনবার “তালাক” উচ্চারণ করা। তবে প্রত্যাহার না করবার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে একই সঙ্গে তিনবার “তালাক” উচ্চারণ করা যেতে পারে। “তালাক” উচ্চারণের সময় কোন সাক্ষী বা স্ত্রীর উপস্থিতির প্রয়োজন হয় না। স্ত্রী নেপথ্যে থাকলেও “তালাক” দেওয়া যেতে পারে। বিবাহ-বিচ্ছেদের দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে ‘ইলা’। ‘ইলা’ হচ্ছে ব্রত গ্রহণ করে চারমাস স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম না করা। তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে ‘জিহার’। ‘জিহার’ হচ্ছে স্বামী যদি বিবাহের জন্য সম্পর্কিত কোন আত্মীয়ার নাম উচ্চারণ করে, তাহলে স্ত্রী তাকে ‘তালাক’ উচ্চারণ করতে বাধ্য করাতে পারে। স্বামী যদি অস্বীকৃত হয় তাহলে স্ত্রী আদালতে গিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রার্থনা করতে পারে। চতুর্থ পদ্ধতি হচ্ছে ‘খোলা’। যেখানে স্ত্রী স্বামীকে রাজি করিয়ে এবং তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে দাম্পত্য বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায় সেখানে বিবাহ-বিচ্ছেদকে ‘খোলা’ বলা হয়। পঞ্চম পদ্ধতিকে ‘মুবারত’ বলা হয়। ‘মুবারত’ হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সম্মতিক্রমে বিবাহ-বিচ্ছেদ। ‘মুবারতে’র সঙ্গে ‘খোলা’-র প্রভেদ হচ্ছে এই যে, ‘খোলা’ পদ্ধতিতে স্ত্রী-ই বিবাহ-বিচ্ছেদ চায় আর ‘মুবারত’ পদ্ধতিতে স্বামী- স্ত্রী উভয়েই বিবাহ-বিচ্ছেদ চায়। বিবাহ-বিচ্ছেদের ষষ্ঠ পদ্ধতি হচ্ছে ‘তালাক-ই-তাফয়ূজ’। এ ক্ষেত্রে স্বামী দ্বারা আদিষ্ট হয়ে স্ত্রী-ই ‘তালাক’ উচ্চারণ করে।
আদালতের আশ্রয় নিয়েও মুসলিমসমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদ করা যায়। এ সম্বন্ধে ১৯৩৯ সালে মুসলিম বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইনের ২নং ধারায় যে সকল কারণে আদালতকে বিবাহ-বিচ্ছেদ গ্রাহ্য করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে আছে :
(১) চার বৎসর যদি স্বামীর কোন খোঁজ-খবর না পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে আদালতের রায় ছ’মাসের জন্য মূলতবী রাখা হয় এবং ওই সময়ের মধ্যে স্বামী যদি প্রত্যাবর্তন করে তাহলে ওই রায় বাতিল হয়ে যায়;
(২) দু বৎসর যদি স্বামী স্ত্রীর ভরণপোষণে অমনোযোগী হয়;
(৩) সাত বা ততোধিক বৎসরের জন্য যদি স্বামীর কারাদণ্ড হয়;
(৪) তিন বৎসর যদি স্বামী তার “দাম্পত্যধর্ম” না পালন করে;
(৫) স্বামী যদি নপুংসক হয়। এক্ষেত্রে তার প্রজননশক্তি প্রমাণ করবার জন্য স্বামীকে এক বৎসরের জন্য সময় দেওয়া হয়;
(৬) দু বৎসর ব্যাপী স্বামী যদি উন্মাদ রোগাক্রান্ত হয়;
(৭) স্বামী যদি কুষ্ঠ বা কোন কুৎসিত যৌনব্যাধিগ্রস্ত হয়;
(৮) ১৫ বৎসর বয়স উত্তীর্ণ হবার আগেই যদি পিতামাতা বা অভিভাবকের সম্মতি অনুসারে তার বিবাহ হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রী ১৮ বৎসর বয়স উত্তীর্ণ হবার পর স্বামীকে পরিহার করতে পারে;
(৯) স্বামী যদি স্ত্রীকে দৈহিক বা মানসিক কোনরূপে পীড়া দেয়।
যদিও কারণ বিশেষে আদালতের আশ্রয় নিয়ে মুসলিমসমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদ করা যায় তা হলেও ‘তালাক’ দ্বারা বিবাহ-বিচ্ছেদ করা মুসলিম-সমাজের প্রথাগত পন্থা। তালাক দ্বারা বিবাহ-বিচ্ছেদের বৈশিষ্ট্য এই যে তালাক দেবার পর স্বামীর স্ত্রী সম্বন্ধে আর কোন দায়িত্ব থাকে না। এ সম্বন্ধে মুসলিমসমাজের ব্যক্তিগত আইন (Personal Law) বলবৎ থাকে। এই আইন অনুযায়ী তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর নয়; তার পুত্রদের কিংবা তার পিতামাতার বা পিতৃকুলের আত্মীয়দের। তারা যদি এ দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে এ দায়িত্ব ওয়াকফ বোর্ডের ওপর ন্যস্ত হয়। কিন্তু ১৯৮৬ খ্রীষ্টাব্দে সুপ্রিম কোর্ট শাহবানু মামলায় তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর ভরণপোষণের ভার তার প্রাক্তন স্বামীর ওপরই ন্যস্ত করে। এই নিয়ে মুসলিম সমাজে ভীষণ আলোড়ন সৃষ্ট হয়। চতুর্দিকে রব তোলা হয় যে সুপ্রিম কোর্ট প্রাক্তন স্বামীর ওপর তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর খোরপোষের দায়িত্ব অর্পণ করে শরিয়াতের বিধান লঙ্ঘন করেছে। বলা হয় যে এই রায় দ্বারা সুপ্রিম কোর্ট মুসলিম ধর্মের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেছে।
এর পদক্ষেপে ভারত সরকার সংসদে ‘মুসলিম মহিলা (তালাকের পর অধিকার সংরক্ষণ) বিল’ আনে। এই বিলের বিরুদ্ধে ১০২টি সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়। সংসদে অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর বিলটি ৮ মে ১৯৮৬ তারিখে বিধিবদ্ধ হয়। সংশোধনের পর আইনটি যে রূপ নিয়েছে তাতে তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী ইদ্দত-এর (শরিয়াত অনুযায়ী পুনরায় বিবাহের নিষিদ্ধ কাল) সময় পর্যন্ত স্বামীর কাছ থেকে খোরপোষ পাবে; তারপর তার ভরণপোষণের ভার নিতে হবে তার পিতৃ-পরিবার বা অন্য আত্মীয়বর্গকে; তারা যদি সে দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে, তাহলে দায়িত্ব গ্রহণ করবে ‘ওয়াকফ বোর্ড’।
সবশেষে মুসলিম সমাজে তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ সম্বন্ধে উচ্চ আদালতের দুই রায়ের কথা বলব। গুয়াহাটি হাইকোর্টের দুই বিচারপতি এস. বি. রায় ও আর. কে. মানিসেনাকে নিয়ে গঠিত এক ডিভিসন বেঞ্চ রায় দেন যে স্বামী স্ত্রী উভয় পক্ষের লোকজন প্রথমে ভালরকম আলোচনা করে বুঝে নেবেন, তারপর তালাক কার্যকর হবে। মামলাটা ছিল বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ে তালাক কার্যকর হয়নি।
শেষ সংবাদ। ১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি হরিনাথ তিলহরি এক ঐতিহাসিক রায়ে বলেছেন ‘একবাক্যে তিন বার তালাক বে-আইনী। এটা অসংবিধানিক ও অমানবিক।’
সুপ্রিম কোর্টের শাহবানু মামলায় বলা হয়েছিল ফৌজদারী আইনের আওতায় পরিত্যক্তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে তার প্রাক্তন স্বামীকে। কিন্তু তালাককে বে-আইনী বা অসাংবিধানিক বলা হয়নি।
পরিশেষে মুসলমান সমাজে বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান সম্বন্ধে কিছু বলে এ অধ্যায় শেষ করব। ধর্মান্তরিত অন্যান্য সমাজের ন্যায় বাঙালী মুসলমান সমাজেও চিরাচরিত হিন্দুসমাজের অনেক লোকাচার পালিত হয়। যেমন বিবাহের পূর্বে বরকনেকে আশীর্বাদ করা, আইবুড়োভাত বা থা দেওয়া, গায়ে হলুদ দেওয়া, জল আনা, লৌকিক গীত গাওয়া, বরের সঙ্গে নিতবরের যাওয়া, বিয়েতে বরকনের গাঁটছড়া বাঁধা, বাসর ঘরের কৌতুক, নাপিতের ভূমিকা (নাপিতকে সিদে দেওয়া), ‘দুধভাত’ যেটা হিন্দু বিবাহের কনকাঞ্জলির সমতুল, কোন কোন জায়গায় সিন্দুর দান ইত্যাদি। বলা বাহুল্য এসব লোকাচার ছাড়া মূল মুসলমান বিবাহ অনুষ্ঠান সাক্ষীর সমক্ষে মৌলবীর দ্বারা সম্পাদিত হয় ও মৌলবী এজন্য দক্ষিণা পান।