☼ অতুল সুর ☼
চোদ্দ শতকের বাঙালী
গত একশ বছর সময়কালের মধ্যে বাঙালীর বিয়ে বাড়ির অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে। পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে পর্যন্ত বিয়ে বাড়িতে সানাই বাজত। আজ আর তা বাজে না। তার স্থান দখল করে নিয়েছে মাইক-নিনাদিত গান। বিয়ের শাস্ত্রীয় আচারসমূহ ও মেয়েদের কৃত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানসমূহে এখনও বজায় আছে বটে, কিন্তু বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্ন ও ভোজনের ব্যাপারে। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় ভোজপণ্ডিদের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিয়ে বাড়িতে ফলার ও ভাতের পরিবর্তে লুচি খাওয়ানো প্রবর্তিত হয়েছিল। বিয়েবাড়ির রান্নাবান্নার ব্যাপারেও পাঁচ বাড়ির গিন্নিবান্নিদের আধিপত্যেরও অবলুপ্তি ঘটেছিল। তাদের স্থান দখল করে নিয়েছিল উড়িয়া বামনের দল।
এই পরিবর্তিত পরিবেশেই আমি আমার ছেলেবেলার বিয়েবাড়ির রীতিনীতি দেখেছি। তখন সামাজিক রীতিনীতি ও জাতপাতের প্রাবল্য ছিল খুব কঠোর। তার একটা এদিক-ওদিক হবার উপায় ছিল না। আমার যখন পঁচিশ-ত্রিশ বছর বয়স, তখন পর্যন্তও ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ, পুরোহিতকে সঙ্গে নিয়ে, কর্মকর্তাকে নিজে কিংবা তাঁর কোন আত্মীয়কে নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণবাড়িতে গিয়ে করে আসতে হত। শহরে এ প্রথা এখন উঠে গিয়েছে। জানি না পল্লীগ্রামে এখনও প্রচলিত আছে কিনা।
৷৷ দুই ৷৷
ভোজনের ব্যাপারে জাতপাতের ব্যাপারটা অত্যন্ত কঠোর ছিল। ব্রাহ্মণদের সর্বাগ্রে ভোজন করাতে হত। গৃহকর্তাকে সমবেত অতিথিদের সামনে গিয়ে বলতে হত—‘আপনাদের মধ্যে যাঁরা ব্রাহ্মণ আছেন, তাঁদের গাত্রোত্থান করতে আদেশ হউক।’ তাছাড়া ভোজ্যাদি ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিবেশিত করতে হত। ভোজনের শেষে ব্রাহ্মণরা দক্ষিণা পেতেন। ভোজন দক্ষিণার হার ছিল চার আনা থেকে এক টাকা। ব্রাহ্মণ ভোজন হয়ে গেলে, তারপর ব্রাহ্মণেতর জাতিদের ডাকা হত।
আত্মীয়স্বজনদের বাড়ির মেয়েদের নিমন্ত্রণ বাড়ির মেয়েদের গিয়ে করতে হত। তা না হলে মেয়ে-নিমন্ত্রণ গ্রাহ্য হত না। এছাড়া নিমন্ত্ৰিতা মেয়েদের তাদের বাড়ি থেকে গাড়ি করে নিয়ে আসতে হত, এবং ভোজন পর্বের পর তাঁদের আবার গাড়ি করে নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দিতে হত। গত ষাট-সত্তর বছরের মধ্যে এ প্রথা উঠে গেছে। আর যে সব নিমন্ত্রিত ব্যক্তি দূর থেকে আসতেন, তাঁরা কর্মকর্তার কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া বাবদ বেশ কিছু টাকা আদায় করে নিতেন। তাও উঠে গেছে।
৷৷ তিন ৷৷
আর একটা প্রথাও এই সময়কালের মধ্যে উঠে গেছে। সেটা হচ্ছে বিবাহ বাসরে ‘প্রীতি উপহার’ বিতরণ করা। এগুলো কবিত্বপূর্ণ কাগজ। এগুলো হয় গোলাপী রঙের বা রুমাল-সদৃশ এক রকম কাগজে লাল কালিতে বা সোনার জলে ছাপা হত। এগুলো বিয়ে বাড়ির মর্যাদার একটা মাপকাঠি ছিল। কেননা, লোক বিচার করত বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষ কে ক’খানা ‘প্রীতি উপহার’ বিলি করেছে।
মনে রাখতে হবে যে আমার ছেলেবেলাটা ইলেকট্রিক আলোর যুগ ছিল না। সেজন্য বিবাহ বাসর আলোকিত করবার জন্য ‘খাস গেলাস’ ও ঝোলানো ঝাড়লণ্ঠন ব্যবহৃত হত। এগুলো রেড়ির তেল বা মোমবাতির সাহায্যে জ্বালানো হত। পরে ছাদের ওপর হোগলার মেরাপের তলায় যেখানে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের খাওয়ানো হত, সেখানে থাকত কারবাইড গ্যাসের আলো।
শতাব্দীর গোড়ায় সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির বর আসত চতুর্দোলায় চেপে। ব্যাণ্ড বাজত ও দুধারে আলোর শোভা থাকত। ফিরে যাবার সময় কনে যেত মহাপায়ায় করে। ১৯২০ সাল নাগাদ এগুলো সব উঠে যায়।
বর এলে বরযাত্রীদের গায়ে গোলাপ জল ছিটানো হত। বরকে বসানো হত বরের আসনে। দুধারে থাকত দুটো ফুলের তোড়া ও দুটো বাতিদান। বরযাত্রীদের গলায় মালা পড়িয়ে দেওয়া হত। এটাই ছিল বরযাত্রীদের লক্ষণ। কেননা বরযাত্রীদের বিশেষ সমাদর করে কন্যাপক্ষীয়দের আগে খাওয়ানো হত।
৷৷ চার ৷৷
এবার বলি বিয়ের নিমন্ত্রণে কি খাওয়ানো হত। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সাধারণত খাওয়ানো হত কর্মকর্তার নিজবাড়িতে, এখনকার মত “বিয়েবাড়ি’ ভাড়া করে নয়। এর জন্য বাড়ির ছাদে হোগলা দিয়ে একটা মণ্ডপ তৈরি করা হত। তারপর ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের হালসীবাগানের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর হোগলা দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পদাঙ্কে নানারকম উপায় অবলম্বিত হয়, যার শেষ ফলশ্রুতি হচ্ছে ভাড়াকরা ‘বিয়েবাড়ী’। আরও যা পরিবর্তন ঘটেছে তা হচ্ছে, সেকালে বিয়েবাড়িতে মেঝের ওপর কুশাসন পেতে বসিয়ে কলাপাতার ওপর খেতে দেওয়া হত। কলাপাতার ডানদিকের সর্বোচ্চ কোণে থাকত লবণ ও একখণ্ড পাতিলেবু, আর কলাপাতার সামনে থাকত জলপূর্ণ মাটির গেলাস ও দই ও ক্ষীর দেওয়ার জন্য মাটির খুরি। ভোজনপর্ব শুরু হত দু’খানা গরম লুচি ও বেগুন বা পটল-ভাজা দিয়ে। ক্রমে ক্রমে আসত কুমড়ার ছক্কা (বা শীতকালে বাঁধাকপির তরকারী), ডাল, ধোঁকা বা আলুর দম, মাছের কালিয়া, চাটনি, পাঁপড় ভাজা ও মিষ্টান্ন। মিষ্টান্নের মধ্যে দেওয়া হত মিহিদানা, লেডিকেনী, রসগোল্লা, সন্দেশ, দই, ক্ষীর। সকলের শেষে দেওয়া হত পান। এটা সাধারণ গৃহস্থবাড়ির বিয়ের ভোজ্যের ফর্দ। এটাই ছিল মধ্যবিত্ত গৃহস্থবাড়িরও বিয়ের ভোজ্যদ্রব্যের তালিকা। অবস্থাপন্ন গৃহস্থবাড়িতে এর সঙ্গে যুক্ত হত পোলাও, মাংস, আরও অনেক রকম মিষ্টান্ন ও রাবড়ি। ভোজনের সময় পরিবেশনকারীরা দফায় দফায় আনত সবরকমই ভোজ্যদ্রব্য। তার মানে আগেকার দিনের বিয়ে বাড়িতে যে যত খেতে চাইত, সে তা পেত।
সেকালের বিয়ে বাড়িতে ছাঁদা বাঁধার একটা রেওয়াজ ছিল। ছাঁদা-বাঁধা হচ্ছে বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য একখণ্ড কাপড়ে পরিবেশিত সমস্ত রকম দ্রব্যসামগ্রী, বিশেষ করে লুচি ও মোণ্ডা বেঁধে নেওয়া।
আর একটা রীতি ছিল। ভোজন সমাপ্তির পূর্বে কর্মকতা সমস্ত নিমন্ত্রিত ব্যক্তির সামনে দাঁড়িয়ে, ভোজনে তাঁরা সন্তুষ্ট হয়েছেন কিনা তা জিজ্ঞাসা করতেন।
মেয়েদের খাওয়ানো পৃথক পংক্তিতে করা হত এবং সেখানে মেয়েরাই পরিবেশন করত। সেখানে ভোজনের শেষে গৃহকর্ত্রী এসে প্রত্যেককে ভোজনে সন্তোষ লাভ করেছে কিনা জিজ্ঞাসা করত।
এখন বিয়ে বাড়ির খাওয়ানোর ব্যাপারটা ঠিকেদার ক্যাটারারদের হাতে ন্যস্ত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সমাদারও হ্রাস পেয়েছে।
৷৷ পাঁচ ৷৷
সেকালে লৌকিকতা করা হত আট আনা বা এক টাকা দিয়ে। বিশিষ্ট অতিথিরা বা আত্মীয়রা চার টাকা পর্যন্ত দিতেন। পরে টাকার বদলে বই উপহার দেবার প্রথা প্রচলিত হয়েছিল। এখন দামী কাপড় বা অন্য দ্রব্যসামগ্রী দেওয়া হয়। শধু তাই নয়। এ বিষয়ে এক পরিবার অপর পরিবারের সঙ্গে পাল্লা দেয়। আজ মধ্যবিত্ত সমাজের অবনতির এটাও একটা কারণ। লৌকিকতাটা আজ সমাজ থেকে উঠে যাওয়া উচিৎ।