» » গাদ্দার

বর্ণাকার

গাদ্দার

পাহাড়ের কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল সাইফুদ্দিন গাজীর নেতৃত্বে এগিয়ে আসা সম্মিলিত বাহিনীর তিন শক্তি। সহসা আকাশ কালো করা ভয়ংকর এক ধূলিঝড় এসে আপতিত হলো ওদের ওপর। সামনে, আশপাশে, চারদিকে কিছুই দেখা যায় না। ঝড় এত প্রবল বেগে ধাবিত হলো ওদের ওপর দিয়ে, কেউ সামলে উঠার আগেই সম্মিলিত বাহিনী তছনছ হয়ে গেল। সামরিক শৃংখলা ভেঙে যার যার মত ছত্রভঙ্গ হয়ে ওরা ছুটলো পাহাড়ের বড় বড় পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে বাঁচার আশায়। ঘোড়া ও উটগুলো ছুটলো লাগামহীনভাবে। সেনাপতি ও কমাণ্ডাররা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে গেল। ঝড় থেমে গেলে আবার গুছিয়ে নেয়া যাবে এমনটি ভাবারও অবকাশ পেল কেউ।

ঝড়ের বেগ ক্রমে আরও প্রবল থেকে প্রবলতর আকার ধারণ করলো। কেউ কেউ বালির নিচে পুরোপুরি ডুবে গেল। ঝড়ের আঘাতে আহত হয়ে ময়দানে পড়ে রইলো কেউ। যুদ্ধের মালসামান, অস্ত্র ও গোলাবারুদ বালিচাপা পড়লো অধিকাংশই।

এদিকে সুলতান আইয়ুবী ঝড়ের মত এগিয়ে আসা শত্রু বাহিনী বা এই প্রাকৃতিক ধূলিঝড়, কোনকিছু সম্পর্কেই অবগত ছিলেন না। তিনি ব্যস্ত ছিলেন তার রুটিনওয়ার্ক অনুযায়ী সৈনিকদের প্রশিক্ষণ কাজে। সহসা দিগন্তে ধূলিমেঘ দেখেই সচকিত হলেন তিনি। ভাবলেন, এ কি করে সম্ভব? কি করে গোয়েন্দাদের চোখে ধূলো দিয়ে দুশমন ফৌজ এত কাছে চলে এলো? কিন্তু এটা যে মরু সাইমুম তখনো ভাবতেই পারেননি তিনি।

ছুটে আসা দুশমন বাহিনীর অযাচিত ও আকত্মিক হামলা মোকাবেলা করার জন্য তিনি নিজের বাহিনীকে প্রস্তুত হওয়ার হুকুম দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন এক পাহাড় চূড়ায়, যাতে দুশমন বাহিনীর আকার ও অবস্থা বুঝতে পারেন।

ততক্ষণে বাদামী ঝড় গাঢ় হতে শুরু করেছে। ঝড়ের এ প্রকৃতি দেখে প্রমাদ গুণলেন তিনি। এ তো দুশমন ফৌজের আগমন বার্তা নয়! এ যে মরুভূমির দুঃস্বপ্ন সাইমুম ঝড়!

তিনি উৎকট পেরেশানী নিয়ে মুহূর্তে আবার ছুটে এলেন বাহিনীর কাছে। বললেন, যে যেখানে পারো লুকাও! যার যার অস্ত্র নিয়ে বসে পড়ো পাথরের আড়ালে। দুশমন নয়, এখনি তোমাদের ওপর আঘাত হানবে মরু সাইমুম!’

তাঁবু গুটানোরও সময় পেল না সৈনিকরা, যার যার মত ছুটলো আত্মরক্ষা করতে।

এক সময় ঝড় থামলো। পাহাড় ও পাথরের গোপন আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সৈনিকরা। দেখলো, তাঁবুর কোন চিহ্নও নেই সেখানে। খাদ্য ও মালসামানের বহর লণ্ডভণ্ড। সৈন্যরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো উড়িয়ে নেয়া মালামালের সন্ধানে। এভাবেই আল্লাহ সত্যপথের পথিকদের সাহায্য করেন। হয়তো দুই মুসলিম নারীর প্রাণের আকুতি ও প্রার্থনা আল্লাহর আরশে কাঁপন তুলেছিল। হারেস ও দাউদের মত জানবাজদের আত্মত্যাগে খুশী হয়েছিলেন আল্লাহ জাল্লে শানুহু। দুই মুসলিম মেয়ের আবেগ ও প্রেরণার ইজ্জত রক্ষার্থে আল্লাহ এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন আইয়ুবীর বাহিনীকে।

হারেস ও দাউদ! ফৌজি ও তার ভাবী! ঈমানের পরশদীপ্ত চারটি খাঁটি সোনা। আল্লাহর দ্বীনের জন্য জান কবুল করা চার বীর মুজাহিদ!

আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তিন মুসলিম গাদ্দারের সম্মিলিত বাহিনী যখন ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে তুর্কমান, এ খবর, আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য ছুটছিল দাউদ ও হারেস। কিন্তু দুশমনের গোয়েন্দা বাহিনীর চোখে ধরা পড়ে যায় ওরা। ওদের ধাওয়া করে দুশমনের গোয়েন্দা বাহিনী। আক্রান্ত হয় ওরা। বীরের মত লড়াই করে ওরা সর্বশক্তি দিয়ে, কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারে না।

ওরা মারা গেছে ভেবে দুশমনরা ফিরে যায়। মৃত্যুপথযাত্রী দাউদ বুঝতে পারে তুর্কমান সে কোনদিনই পৌঁছতে পারবে না। কোনদিন সে আর সুলতান আইয়ুবীকে গিয়ে বলতে পারবে না, দুশমন ছুটে আসছে অতর্কিত হামলা করতে। তবু প্রাণ থাকতে সে আশা ছাড়তে রাজি নয়, সে কোন রকমে এ খবর ফৌজিদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

বাড়িতে যুবতী ফৌজি ও তার ভাবী ছাড়া আর কেউ নেই। এক মুজাহিদের লাশ ও বাড়ি আল্লাহর হাওলা করে দিয়ে এ খবর নিয়ে অবলা দুই নারী ছুটলো তুর্কমান।

অনেক দূরের পথ, পথে পদে পদে বিপদ, কিন্তু ঈমানের কাছে সব বিপদ হার মানে। ওরা ছুটে চলে তুর্কমান।

পথে ফৌজি দেখতে পায় পাহাড়ের কোলে পড়ে আছে এক মুসাফিরের লাশ। ওরা এগিয়ে যায় লাশের কাছে। দেখতে পায় ওটা লাশ নয়, তারই আপন ভাইয়ের আহত রক্তাক্ত দেহ। সেই রক্তাক্ত দেহকে বুকে জড়িয়ে ফৌজি ও তার ভাবী আবার ছুটতে শুরু করে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয়, ব্যথা সবকিছু ছাপিয়ে তাদের মাথায় তখন একটাই চিন্তা, কতক্ষণে তারা পৌঁছবে তুর্কমান, সতর্ক করবে আইয়ুবী ও তার বাহিনীকে। এ সময়ই নেমে আসে সেই প্রলয়ংকরী মরু ঝড় সাইমুম।

এই ঘটনা প্রমাণ করে, এক বোন তার আহত ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে মুসলিম মুজাহিদদের বিরুদ্ধে কাফেরদের অতর্কিত আক্রমণের খবর পৌঁছানোর জন্য জীবন বাজী রেখে যখন ছুটে যাবে মুসলিম ছাউনিতে, ভাই মারা যাচ্ছে এ নিয়ে দু:খ করারও সময় পাবে না বোন, এই আবেগ ও প্রেরণা যেখানে থাকবে, সেখানে আল্লাহর সাহায্য যুগে যুগে। এমনিভাবে হেফাজত করবে মুজাহিদদের।

❀ ❀ ❀

সুলতান আইয়ুবীর ক্যাম্পের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। ঝড়ে উড়ে গেছে তাঁবু, বাঁধা উট ও ঘোড়া ছুটাছুটি করে শোচনীয় অবস্থা করেছে নিজেদের। বালির সাথে ছোট ছোট পাথরকুচির আঘাত শরীরে বিদ্ধ হয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছিল মানুষ-পশু সবাইকে। আহতদের আর্তচিৎকার ভুতপ্রেতের কান্নার মত চারদিক আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সূর্য তখনও অস্ত যায়নি, কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন সূর্যকে ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে। ঝড়ের প্রচণ্ডতা একটু কমতেই কমাণ্ডাররা চিৎকার দিয়ে সৈন্যদের সতর্ক ও তালাশ করতে শুরু করলো। তখনো ঝড় বইছে হালকা, এলোমলো ভাবে।

তিন চারজন সিপাই এক বিরাট পাথরের আড়ালে আচ্ছন্নের মত বসেছিল। পাশ দিয়ে একটি ঘোড়াকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে দেখলো ওরা। ঘোড়ার ওপর আরোহীও আছে। সিপাইরা চিৎকার করে ডাকলো, ‘এদিকে! এদিকে এসো! পড়ে যাবে তো! এমন ঝড়ের সময় কেউ ঘোড়ায় সওয়ার হয়!’

আরেকজন অবাক হয়ে বললো, “আরে, কি বলছো! আরোহী তো দেখছি মহিলা!’

তখনি পেছনের ঘোড়াটিও চোখে পড়লো ওদের। একজন বললো, দু’জন মহিলা!’

এ দুই মহিলা ছিল ফৌজি ও তার ভাবী। সিপাইরা ভাবলো ঝড়ের কবলে পড়ে এরা রাস্তা ভুলে এদিকে এসে পড়েছে।

‘ঘোড়ার লাগমটা টেনে ধরো, পাথরের আড়ালে আশ্রয় নাও।’

আমাদেরকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে দাও। ফৌজি সিপাইদের উদ্দেশ্য করে বললো।

‘আরে মারা পড়বে তো! ঝড় থামুক। সুলতান আইয়ুবীকে কি দরকার তোমাদের!’ পেরেশান হয়ে প্রশ্ন করলো এক সিপাই।

ঝড়ের শব্দ উপেক্ষা করে কর্কশ কণ্ঠে ফৌজি চিৎকার দিয়ে বললো, “আহাম্মক! আমাকে জলদি সুলতান আইয়ুবীর কাছে নিয়ে চলো। তিনি কোথায়? আমি খুব জরুরী সংবাদ নিয়ে এসেছি। এ সংবাদ এখনি তাকে জানাতে হবে, নইলে তোমরা সবাই মারা পড়বে।’

সিপাইরা ঘোড়ার উপরে রক্তাক্ত এক লোককেও দেখতে পেলো। তারা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে অতি কষ্টে সুলতান আইয়ুবীর তাঁবু পর্যন্ত নিয়ে গেলো ওদের। কিন্তু সেখানে কোন তাঁবু ছিল না, ঝড়ে তাঁবু কোথায় উড়ে গেছে কেউ জানে না।

এক কমাণ্ডার তাদের দেখে এগিয়ে এলো। বললো, ‘কি ব্যাপার! কি চাও তোমরা এখানে?’

‘আমরা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে দেখা করতে চাই এবং এক্ষুণি।’ ফৌজি কর্তৃত্বের সুরে বললো কমাণ্ডারকে।

কমাণ্ডার আর কোন প্রশ্ন না করে ওদেরকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে নিয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবী তখন এক বিরাট পাথরের আড়ালে বসেছিলেন।

এই প্রলয়ংকরী ঝড় উপেক্ষা করে দু’জন মেয়েকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি জলদি উঠে দাঁড়ালেন। পাথরের আড়াল ছেড়ে কয়েক কদম এগিয়ে এলেন তাদের দিকে।

প্রথমেই হারেসকে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামানো হলো। সে তখনও জীবিত। ফৌজি দ্রুত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সুলতান আইয়ুবীর মুখখামুখি দাঁড়ালো। বললো, ‘মাননীয় সুলতান! সম্মিলিত শক্ৰদল আক্রমণের জন্য প্রবলবেগে ধেয়ে আসছে। তারা একদম কাছে চলে এসেছে। যে কোন সময় তারা আপনার বাহিনীর ওপর চড়াও হয়ে যাবে।’ সে দাউদের লেখানো চিঠি সুলতান আইয়ুবীর কাছে হস্তান্তর করলো।

হারেস হাত তুলে ইশারায় সুলতানকে কাছে ডাকলো। সুলতান চিঠি না পড়েই এগিয়ে গেলেন তার কাছে। হারেস ফিসফিস করে কিছু বললো। তখনো কথা শেষ হয়নি তার, জবান বন্ধ হয়ে গেল তার। চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেল এক মুজাহিদ, যেন এ কয়টি কথা বলার জন্যই সে এতক্ষণ বেঁচে ছিল।

একটু পরই ঝড় পুরোপুরি থেমে গেল। সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের ডাকলেন! জরুরী ভিত্তিতে আদেশ দিলেন, ‘তাঁবু মেরামতের প্রয়োজন নেই। সৈন্যদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলল। কমাণ্ডো বাহিনীর সৈন্যদের জলদি তলব করো।’

তিনি সেনাপতিদের কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝিয়ে বললেন। বললেন, ‘ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করতে হবে।’

ঝড়ের বেগ পুরোপুরি শান্ত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এলো। সাইফুদ্দিনের নাস্তানাবুদ বাহিনী একে একে তাঁবুর স্থলে ফিরে আসতে লাগলো। তাঁবু নেই, অস্ত্র নেই, খাদ্যভাণ্ডারও লণ্ডভণ্ড। বালির নিচে চাপা পড়া অস্ত্রপাতি খুঁজে বের করতে লেগে গেল কেউ। কেউ ছড়িয়ে পড়লো আশেপাশে, উদ্দেশ্য, উড়িয়ে নেয়া তাঁবু খুঁজে বের করা। আহত সৈনিকদের সেবা করছিল কেউ, কেউ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

রাতের অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমণের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেল সাইফুদ্দিনের। আক্রমণতো দূরের কথা, আক্রমণের চিন্তাও এলো না তার মনে। সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। উট ও ঘোড়া এদিকে ওদিক ছুটে গিয়েছিল। সেগুলো গুছাতে ও বেঁধে রাখতে রাতের অর্ধেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। এসব করতে করতে সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়লো, চোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম।

সুলতান আইয়ুবীর ক্যাম্পে তখন সাজ সাজ রব। যুদ্ধের তৎপরতা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। সাইফুদ্দিনের কোন ধারণাই ছিল, তাদের থেকে দুই তিন মাইল দূরে কি ঘটছে।

সন্ধ্যার পরপরই আইয়ুবী একদল কমাণ্ডোকে ক্যাম্পের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। ওদের বলে দিলেন, সাইফুদ্দিনের নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনী কোথায় ক্যাম্প করেছে এবং তাদের এখন অবস্থা কি সব তথ্য নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবে।’

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে এলো ওরা। মধ্য রাতের আগেই আইয়ুবীর সৈন্যরা মার্চ করলো। সাইফুদ্দিনের ক্যাম্পের চারদিকে অবস্থান নিয়ে ওঁৎ পেতে বসে রইলো ওরা।

সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীকে অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য হলব থেকে বীর বিক্রমে ছুটে আসা সম্মিলিত বাহিনী তখন আইয়ুবীর বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই আইয়ুবী এখন ওদের নিকেশ করে দিতে পারেন, কিন্তু তিনি তার বাহিনীকে বললেন, ‘রাতের আঁধারে কেউ দুশমনকে আঘাত করতে যেয়ো না। এতে যারা মারা পড়বে তারা তোমাদেরই ভাই। যারা অস্ত্র সমর্পণ করবে, তাদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব তোমাদের।’

❀ ❀ ❀

সকাল হলো। সম্মিলিত বাহিনী তখনো ভীষণ অগোছালো। তাদের তাঁবু ও খাদ্যশস্য উড়ে গেছে। ভয়ার্ত ঘোড়ার ছুটাছুটিতে বহু সৈন্য আহত। তারপরও সৈন্যদেরকে তড়িঘড়ি করে সাজানো শুরু হলো। তাতেই কেটে গেল দিনের অর্ধেক বেলা।

সাইফুদ্দিন তার তিন বাহিনীর সেনাপতিকে একত্র করে আদেশ দিলেন, ‘জলদি তৈরী হয়ে নাও। সালাহউদ্দিন জানে না আমরা তার ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছি। এখনও সে নিশ্চয়ই অপ্রস্তুত অবস্থায় আছে। ঝড়ে আমাদের যতই ক্ষতি হোক, আমরা আমাদের অবশিষ্ট সৈন্য নিয়েই তার বাহিনীর ওপর সরাসরি আক্রমণ চালাবো।’

দিনের শেষ প্রহরে তারা আক্রমণের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করলো। সম্মিলিত সেনাদলের ডাইনে ও বামে উভয় পাশেই পার্বত্য এলাকা, পর্বত জুড়ে পাথর ও ঝোপঝাড়। তারা সবে রওনা শুরু করেছে, ঝোঁপঝাড় ও পাথরের আড়াল থেকে শুরু হলো প্রবল তীর বর্ষণ।

সাইফুদ্দিনের বাহিনী প্রথমে থমকে দাঁড়াল, পরে অদৃশ্য শত্রুর সাথে লড়াই করার পরিবর্তে আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সামনে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ওরা যেই সামনের দিকে পা বাড়াল, সামনে থেকে শুরু হলো আগুনের গোলা বর্ষণ। হাঁড়িতে কাপড় ভরে তাতে জ্বালানী তেল ও পেট্রোল ঢেলে দূর থেকে নিক্ষিপ্ত হতে লাগলো আগুনের গোলা। সম্মুখ বাহিনীর ওপর এসে পড়তে লাগলো আগুনের লেলিহান শিখা।

আক্রমণের গতি থেমে গেল। সাইফুদ্দিন তার বাহিনী পিছনে সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো।

আক্রমণের প্ল্যান পাল্টে নতুন ভাবে সৈন্য সমাবেশ করার কথা ভাবছিল সাইফুদ্দিন, কিন্তু ভাবনা কার্যকরী করার কোন সময় পেল না, যেই তারা পিছনের দিকে সরিয়ে নিল তাদের সৈন্য, তখনই শুরু হলো পিছন থেকে কঠিন আক্রমণ। এ আক্রমণের গতি এত তীব্র ছিল যে, ময়দানে সৈন্যদেরকে শৃংখলাবদ্ধ রাখাই দায় হয়ে পড়লো সাইফুদ্দিনের পক্ষে।

এটা ছিল সুলতান আইয়ুবীর বিশেষ আক্রমণ পদ্ধতি। দুশমনকে ঘেরাও করে তাদের সব আশা-ভরসা চুরমার করে দিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত সৈন্যদের আত্মসমর্পনে বাধ্য করাই এ আক্রমণের লক্ষ্য।

এ জন্য দরকার ত্রাস সৃষ্টি করা। সুলতান এবার সে পদক্ষেপই নিলেন। ওরা যে চারদিক থেকে ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়েছে এ কথা বুঝিয়ে দেয়ার পর এবার পিছন থেকে তীরবেগে অশ্বারোহী বাহিনী ছুটিয়ে দিলেন তাদের ওপর। অশ্বারোহী বাহিনী বর্শা ও তলোয়ারের আঘাত হেনে সাইফুদ্দিনের বাহিনী তছনছ করে দিয়ে একদিক থেকে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। সাইফুদ্দিনের বাহিনীর মনে হলো, তারা কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে। কারণ মুহূর্তের জন্য মাত্র তারা আইয়ুবীর বাহিনীকে দেখতে পেয়েছিল, ওরা একদিক দিয়ে ঢুকে আবার নিমেষেই গায়েব হয়ে গেল অন্যদিক দিয়ে। দুই পাশ থেকেও একই সাথে আক্রমণ চললো। সাইফুদ্দিনের কেন্দ্রীয় কমাণ্ড শেষ হয়ে গেল।

একটুপর নেমে এলো রাত। সাইফুদ্দিনের বাহিনী রাতের আঁধারে পাহাড়ে চড়ে আত্মরক্ষা করতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ওখানে ওঁৎ পেতে থাকা আইয়ুবীর কমাণ্ডোরা সহজেই তাদেরকে টার্গেট বানিয়ে নিল।

পাহাড়ের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, থেকে থেকে ভেসে আসছিল আহত সৈনিকদের আর্ত চিৎকার। রাতেও বিরতি দিয়ে ঝটিকা আক্রমণ চলতে লাগলো অশ্বারোহী বাহিনীর।

সাইফুদ্দিন আশ্রয় নিল পাহাড়ের এক খাঁজের ভেতর। তাঁর বাহিনীর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল। কারণ ওরা সামান্য নড়াচড়া করলেই পাহাড় থেকে তাদের ওপর ছুটে আসে তীরের প্রবল বর্ষণ।

সুলতান আইয়ুবীর কমাণ্ডোা বাহিনী সারা রাত সাইফুদ্দিনের বাহিনীর ওপর কমাণ্ডো আক্রমণ চালিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখলো তাদের। ময়দানে কোথাও তারা পা জমাতে পারলো না। কোথাও একটু সুস্থির হয়ে বসতে পারলো না তারা।

ভোর। সুলতান আইয়ুবী এক উঁচু পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের অবস্থা দেখছিলেন। তাঁর বাহিনী যুদ্ধের শেষ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি কাসেদকে তাঁর রিজার্ভ বাহিনীর কমাণ্ডারের কাছে পাঠালেন।

কাসেদ কমাণ্ডারের কাছে পৌঁছার কিছুক্ষণ পর। সুলতানের রিজার্ভ অশ্বারোহী বাহিনীর একটি দল আকাশবাতাস কাঁপিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাদের পেছনে ছুটে এলো পদাতিক বাহিনী। প্রচণ্ড বিক্রমে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো সাইফুদ্দিনের বাহিনীর ওপর। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশবাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। ময়দান জুড়ে তখন চলছিল এক মহা প্রলয়কাণ্ড!

সাইফুদ্দিনের বাহিনীর যুদ্ধ করার কোন ক্ষমতাই রইল না আর। আইয়ুবীর বাহিনীর তুমুল আক্রমণের মুখে মুখ থুবড়ে পড়লো ওরা। এ আক্রমণ প্রতিহত করার সব যোগ্যতা ও ক্ষমতা হারিয়ে তারা চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লো।

রাতভর প্রচণ্ড ভীতি ও শঙ্কার মধ্যে ৭কাটিয়েছে ওরা। ভোরে যখন সুলতান আইয়ুবীর অশ্বারোহী বাহিনী ছুটে এলো তাদের দিকে, প্রথম আক্রমণেই সাইফুদ্দিনের সৈন্যবাহিনীর মনোবল একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেল। দেখতে দেখতে সাইফুদ্দিনের মনোবলও ভেঙ্গে গেল। তার চোখের সামনে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। নিজের বাহিনীর দিকে তাকিয়ে সাইফুদ্দিন দেখলো, তার এত কষ্টের সাজানো বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে। এখন তারা তার কমাণ্ডোর নাগালের বাইরে। যুদ্ধ করার যোগ্যতা হারিয়ে আত্মসমর্পন শুরু করেছে ওরা। যারা আত্মসমর্পন করছে না তারা আইয়ুবীর অশ্বারোহী বাহিনীর পদতলে পিষ্ট হচ্ছে নির্বিচারে। সঙ্গীর দুরবস্থা দেখে পাশের জন অস্ত্র সমর্পণ করে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছে।

সুলতান আইয়ুবীর যে সৈন্যদল এতক্ষণ পিছনে ছিল তারা বিজয় গর্বে সাইফুদ্দিনের বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে দাঁড়ালো। ডানে ও বায়ে পাহাড়ের ওপর থেকে কমাণ্ডোরা বিজয় উল্লাস করছে। মাঝখানে সাইফুদ্দিনের সৈন্যবাহিনী যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। আত্মরক্ষার শেষ অস্ত্র হিসাবে বেছে নিয়েছে আত্মসমর্পনের পথ। এখন কমাণ্ডারের নেতৃত্বেই সৈনিকরা দলে দলে অস্ত্র সমর্পন করে বন্দীত্ব কবুল করে নিচ্ছে।

সাইফুদ্দিনের ক্যাম্পে যখন বিজয়ী বাহিনী পৌঁছল, তখন সেখানে মদের সুরাহী, কিছু সংখ্যক আনন্দকন্যা ও খেদমতগার ছাড়া সাইফুদ্দিন বা তার রক্ষীদের কেউ ছিল না।

ক্যাম্প এবং ক্যাম্পের আশপাশ থেকে যেসব কয়েদীদের ধরা হলো, তারা বললো, প্রধান সেনাপতি সাইফুদ্দিনকে তারা শেষ বারের মত উপত্যকার আড়ালে অদৃশ্য হতে দেখেছে, এরপর তার আর কোন খবর তারা জানে না। সাইফুদ্দিন কোথায় গেছে সে খবর কেউ বলতে পারলো না।

সুলতান আইয়ুবী হুকুম দিলেন, ‘তোমরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ো। খুঁজে দেখো সাইফুদ্দিন কোথায় লুকিয়েছে। সে পালিয়ে যাওয়া মানেই আবারও তাকে ষড়যন্ত্র করার অবকাশ দেয়া।’

সাথে সাথে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো আইয়ুবীর বাহিনী। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো পাহাড়ের অন্ধিসন্ধি। পাহাড় ছাড়িয়ে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত ঘুরে এলো ওরা, কিন্তু কোথাও তাকে আর পাওয়া গেল না। সাইফুদ্দিন পালিয়েছে! নিজের সেনাবাহিনীকে সুলতান আইয়ুবীর দয়ার ওপর ছেড়ে দিয়ে কোন ফাঁকে কোথায় পালিয়ে গেছে সাইফুদ্দিন তার বাহিনীও তা জানতে পারেনি।

❀ ❀ ❀

গভীর রাত। তুর্কমানের সবুজ প্রান্তরের নিরাপদ এক তাঁবুতে বসেছিল ফৌজি। সামনে তার শহীদ ভাইয়ের লাশ। সফেদ কাপড়ে ঢাকা সে লাশের দিকে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করে বলছিল, আমি রক্তের নদী পার হয়ে এসেছি। এ নদীতে কোন সেতু নেই। হারেস! ভাই! আমি তোমার ফরজ আদায় করেছি, আমার দায়িত্ব শেষ!

সুলতান আইয়ুবী যখন তার তাঁবুতে প্রবেশ করলেন, তখন ফৌজি জিজ্ঞেস করলো, ‘সুলতান! কি সংবাদ? আমার ভাইয়ের রক্ত তো বৃথা যায়নি ত?’

‘আল্লাহ শত্রুদের পরাজিত করেছেন। তুমিই বিজয়ীনী হে প্রিয় বেটি! হে বীর কন্যা! তুমি….’ তিনি আর বলতে পারলেন, অশ্রুতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।

তুর্কমানের মহা সমর শেষ হয়েছে। সুলতান আইয়ুবীর সেনাপতি ও কমাণ্ডাররা যুদ্ধের ক্লান্তি ভুলে তাকিয়েছিল ময়দানের দিকে। আল মালেকুস সালেহ, সাইফুদ্দিন ও গুমাস্তগীনের ঐক্যবদ্ধ সামরিক জোটের কাপুরুষিত আক্রমণের সমুচিত জবাব দিতে পেরে তারা আনন্দিত। কিন্তু আইয়ুবীর চোখে সে আনন্দের রেশও নেই। যদিও বিপুল সংখ্যক পরাজিত সৈন্যকে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করতে পেরেছেন, কিন্তু এ যুদ্ধে আহত ও নিহত সৈনিকের সংখ্যাও কম নয়। সেদিকেই বিমর্ষ নয়নে তাকিয়েছিলেন তিনি।

সুলতান আইয়ুবীর সামনে পড়েছিল শত্রুদের লাশ, আহতরা ছটফট করছিল। তীরবিদ্ধ উট ও আহত ঘোড়াগুলো তখনো ময়দান জুড়ে ছুটাছুটি করছে। তাদের পদতলে পিষে মরছে আহত শত্রু সৈন্যরা।

শত্রুদের যে সকল সৈন্য পালাতে পারেনি, তারা অস্ত্র সমর্পণ করে আশ্রয় নিয়েছিল আইয়ুবীর সৈন্যদের ঘেরাওয়ের ভেতর। অসংখ্য ঢাল, তলোয়ার, বর্শা, তীর, ধনুক, তীরকোষ, তাঁবু ও সৈন্যদের ব্যক্তিগত মালামাল, নগদ অর্থ ও অন্যান্য দামী মালসামান জমা করছিল আইয়ুবীর সৈন্যদের সামনে।

দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মালামাল সংগ্রহ করে আনছিল আইয়ুবীর রিজার্ভ বাহিনীর সৈন্যরা।

সুলতান আইয়ুবী সম্মিলিত বাহিনীর সুপ্রিম কমাণ্ডোর হেডকোয়ার্টার সাইফুদ্দিন গাজীর পরিত্যক্ত তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। এই সে তাঁবু, যেখানে একটু আগেও জাতির এক গাদ্দার অবস্থান করছিল। মুজাহিদদের তলোয়ারের চমক দেখে তার সৈন্যরা যখন নিরুপায় হয়ে আত্মসমর্পনের পথ ধরলো, এ গাদ্দারের সে সাহসটুকুও আর অবশিষ্ট ছিল না। আত্মসমর্পনের পরিবর্তে পালিয়ে গেল সে। পালিয়ে গেল ভীরু ও কাপুরুষের মত, নিজের বাহিনী এবং সমস্ত মালসামান ও সৈন্যসামন্ত ফেলে রেখে। তার সাথে যেসব মেয়ে, নর্তকী, গায়িকা এবং বাজনাদারেরা ছিল, যেসব সোনার মোহর ও বাক্স ভর্তি নগদ টাকা-পয়সা ছিল, সবই পড়েছিল সেখানে।

তার সৈন্যদের বেতন ও খরচের টাকা এবং সুলতান আইয়ুবীর লোকদের দলছুট করানোর জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ সে রিজার্ভ করে রেখেছিল, সমুদয় সম্পদ পড়েছিল বেওয়ারিশ হয়ে। সাইফুদ্দিনের তাঁবুও ছিল মূল্যবান কাপড়ের। রেশমী কাপড়ের পর্দা ও সামিয়ানা দিয়ে সুন্দর এক মহল বানিয়ে নিয়েছিল সে নিজের জন্য।

সে যুগের যুদ্ধ ময়দানে রাজমহলের সকল আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা থাকতো রাজা-বাদশাহদের জন্য। সাইফুদ্দিন কেবল একজন সেনানায়কই ছিল না, সেই সাথে একজন শাসকও ছিল। ফলে মদের সুরাহী, রঙ বেরঙয়ের পিয়ালা, গায়িকা, নর্তকী সবই তার সঙ্গে ছিল। কিন্তু প্রাণের মায়া এমন এক মায়া যে, এর জন্য দুনিয়ার সবকিছুই ত্যাগ করা যায়। সাইফুদ্দিনও তাই করেছিল, সবকিছু ফেলে সে পালিয়ে গিয়েছিল অজানা গন্তব্যে।

সুলতান আইয়ুবী কারুকার্যখচিত বর্ণালী কাপড়ের এই মনোমুগ্ধকর মহল তাকিয়ে দেখছিলেন। তার দৃষ্টি পড়লো রাজকীয় পালঙ্কের ওপর, যেখানে পড়ে আছে এক শাহী তলোয়ার। এর বাট ও খাপ কারুকার্য খচিত। সাইফুদ্দিন কি তাহলে এতটাই ভয় পেয়েছিল যে, তলোয়ারের মত নিত্য সাথী অস্ত্র নিতেও ভুলে গেছে!

সুলতান আইয়ুবী তলোয়ারটি হাতে উঠিয়ে নিলেন। তলোয়ারটি খাপমুক্ত করতেই তার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। তিনি তলোয়ারটির চমক দেখে পাশে দাঁড়ানো এক সেনাপতিকে লক্ষ্য করে বললেন, মুসলমানের তলোয়ারে যখন নারী ও মদের ছায়া পড়ে, তখন তা আর তলোয়ার থাকে না, তা হয়ে যায় নিষ্ক্রিয় এক টুকরো লোহা। অস্ত্র হিসাবে তার আর কোন মূল্য থাকে না। এই তলোয়ার ফিলিস্তিন বিজয়ের জন্য তৈরী হয়েছিল। কিন্তু খৃস্টানরা পাপের মধ্যে ডুবিয়ে এটাকে কাঠের তলোয়ারের মত নিষ্ক্রিয় ও দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত করেছে। তলোয়ার ধরার হাতে যদি মদের ছোঁয়া লাগে, সে হাতের অস্ত্র রক্তের পরশ থেকে বঞ্চিত হয়।’

সেই মনোরম প্রশস্ত তাঁবুতে সুন্দরী অর্ধ উলঙ্গ যুবতী মেয়েরা, ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। তাদের ভাগ্যে এখন কি মুসিবত নেমে আসবে সে কথাই মনে মনে কল্পনা করছিল ওরা। বিজয়ী সৈন্যদের হাতে এখন তাদের কি গতি হবে, কেমন ব্যবহার করা হবে তাদের সাথে এই চিন্তায় ও ভয়ে। গলা শুকিয়ে আসছিল তাদের।

এমন আকর্ষণীয় দেহবল্লরী ও যুবতী নারী দেখলে কে না পশু হয়ে যায়! যদি আইয়ুবীর সৈন্যদের মধ্যে সেই পশুত্ব জেগে উঠে তাহলে তাদের হয়তো দোষ দেয়া যাবে না, কিন্তু কতজন পশুর বর্বরতা তারা সইতে পারবে? তারা যখন এইসব সাতপাঁচ ভাবছিল, তখনই তাদের কানে এলো সুলতান আইয়ুবীর আদেশ।

‘এসব মেয়েদের এখান থেকে নিয়ে যাও। তারা এখন স্বাধীন। তারা যে যেখানে যেতে চায় তাদের সসম্মানে এবং পূর্ণ নিরাপত্তা ও হেফাজতের সাথে সেখানে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করো।’

এ কথা শুনে তারা আরও ভীত হয়ে পড়লো। তারা ভাবলো, এসবই কথার কথা, তাদেরকে অসহায় পেয়ে সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়ার এটা একটা কৌশলমাত্র।

তাদের মধ্য থেকে এ সময় এক মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে করজোড়ে সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, ‘মাননীয় সুলতান! আপনি জানেন, আমরা অসহায়, কিন্তু আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আমর নিরপরাধ। এ যুদ্ধের ব্যাপারে আমাদের কোন হাত বা ভূমিকা ছিল না। আপনাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। শুনেছি আপনি নারীর বেইজ্জতি পছন্দ করেন না। দয়া করে আমাদেরকে আপনার সৈন্যদের হাতে তুলে দেবেন না।

জানি, আমাদের ইজ্জতের কোন দাম নেই। কিন্তু আমাদের অসহায়ত্বের দিকে তাকিয়ে আমাদের ওপর রহম করুন। এমন শাস্তি আমাদের দিয়েন না, যা সইবার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা আপনার মহানুভবতা ও বিরত্বের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’

তার কণ্ঠের ভাষার চাইতেও তার চোখের ভয়-বিহবলতা সুলতানের মনে দাগ কাটলো বেশী। তিনি মেয়েটির আবেদন মঞ্জুর করে বললেন, আমার সৈনিকদের কাছে থাকলেও তোমাদের কোন অমর্যাদা ও ভয়ের কারণ ছিল না। তবু তোমরা যখন এতোই ভয় পাচ্ছো, তখন তোমাদেরকে আমার হেফাজতেই রাখা হবে। আমার পক্ষ থেকে তোমাদর দেখাশোনা করবে আমার নিজস্ব রক্ষী ও রিজার্ভ বাহিনী।

সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধের ময়দানে নারীর সংশ্রব মোটেই সহ্য করতেন না। তিনি তাদেরকে নিজ নিজ ইচ্ছামত যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার জন্য কে কোথায় যেতে চায় জানতে চাইলেন। বললেন, ‘তোমরা এখানে মোট কত জন আছে এবং কে কোথায় যেতে চাও?’

জবাবে তারা নিজেদের সংখ্যা উল্লেখ করে সুলতানকে জানালো, ‘আমরা এখানে এখন যারা উপস্থিত আছি, সবাই মুসলমান। আমাদের সাথে আরো দুটি মেয়ে ছিল, তারা ছিল খৃস্টান। আমাদের মুনীব চলে যাওয়ার পর থেকে সে দু’জনও নিঁখোজ আছে। তারা দুজনই ছিল সাইফুদ্দিনের খুব প্রিয় এবং সব সময় তারা মুনীবের সাথে লেগে থাকতো। মনে হয় তারা দু’জন মুনীবের সাথেই পালিয়ে গেছে।’

সুলতান এবং তার সেনাপতিরাও এ কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন যে, সেই মেয়ে দুটি সাইফুদ্দিনের সাথেই পালিয়ে গেছে। এতে কোন সন্দেহ বা দ্বিমতের অবকাশ রইলো না এ জন্য যে, তারা জানতেন, কোন মুসলমান শাসকই তখন খৃস্টানদের বেস্টনীর বাইরে ছিল না। খৃস্টানদের চর সব সময় তাদের ঘিরে রাখতে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘিরে রাখার এ দায়িত্বটি পালন করতে হতো কোন না কোন খৃস্টান যুবতীর। তারাই ছিল বলতে গেলে তার পৃষ্ঠপোষক, উপদেষ্টা এবং মনোরঞ্জক।

সে যুগে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিজয়ীরা প্রতিপক্ষের মালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। অধিকাংশ সৈন্য পরাজিত সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের তাঁবু ও ক্যাম্প লুট করার জন্য ছুটে যেতো। হেডকোয়ার্টার লুটের সুযোগ পেলে তো কোন কথাই নেই। সেখানকার সব সম্পদ, নারী ও মদ আপন দখলে নেয়ার জন্য চলতো প্রতিযোগিতা। ঝড়ের মত লুটপাট চলতো। আর এ লুটপাট চালাতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে বেঁধে যেতো দাঙ্গা-ফ্যাসাদ। কখনো কখনো এ দাঙ্গার ফলে, লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যেতো সেখানে।

কিন্তু সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বাহিনীর অবস্থা ছিল ভিন্ন। তাঁর কঠোর আদেশ ছিল, কেউ যেন গনিমতের মালে হাত না দেয়। যত বড় সামরিক অফিসারই হোক না কেন, কারো সাধ্য ছিল না সুলতানের আদেশ অমান্য করে গনিমতের মাল কুক্ষিগত করে। গনিমতের মাল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নির্দিষ্ট বাহিনীর ওপর ন্যস্ত করা হতো। সংগৃহীত মালামাল বন্টনের দায়িত্ব পালন করতেন সুলতান নিজে।

তুর্কমানের যুদ্ধ শেষ। মালামাল সংগ্রহের পর সৈনিকরা গনিমতের মাল বন্টনের ব্যাপারে সুলতান আইয়ুবীর নির্দেশের অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তিনি এ সম্পর্কে কোন মন্তব্য বা আদেশ জারী না করে সৈনিকদের হুকুম দিলেন ময়দান থেকে নিজেদের এবং শত্রুদের সকল আহত সৈনিককে এনে তাদের সেবা ও চিকিৎসা করার।

সুলতানের নির্দেশ পেয়ে সারা ময়দান ঘুরে যেখানে যত জখমী সৈনিক ছিল তাদেরকে এক জায়গায় এনে জড়ো করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল তাদের আহত স্থানে ঔষধ লাগিয়ে ব্যাণ্ডেজ করার কাজ। চিকিৎসকদের সাথে এ কাজে হাত লাগালো সাধারণ সৈন্যরাও। স্বপক্ষ ও বিপক্ষের সকল আহত সৈনিকের চিকিৎসা ও মলম পট্টির কাজ শেষ হলে সুলতান দ্বিতীয় নির্দেশ জারী করলেন।

‘এবার আমাদের আহত মুজাহিদ এবং আহত যুদ্ধ বন্দীদের পৃথক করে দাও।’

সুলতান আইয়ুবীর সেনাবাহিনীতে ডিসিপ্লিন রক্ষার গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। তিনি সামরিক বাহিনীর শৃংখলা ভঙ্গকে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতেন। ফলে তার বাহিনী ছিল খুবই সুশৃংখল। এই যুদ্ধে কিছুসংখ্যক শত্রু সৈন্য এলোমেলোভাবে যে যেদিকে পারে পালিয়েছিল। সুলতানের বাহিনী পালিয়ে যাওয়া এসব সৈন্যদের পিছু ধাওয়া করেছিল। কিন্তু তাদের ট্রেনিং এমন ছিল যে, পিছু ধাওয়া করার সময়ও তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক অটুট রাখতো। সুলতান আইয়ুবী তাদেরকে পিছু ধাওয়া করে বেশী দূর যেতে নিষেধ করেছিলেন।

যুদ্ধের সময় তিনি একদল সৈন্যকে ময়দানের ডানে ও বামে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের ওপর নির্দেশ ছিল, সুলতানের পরবর্তী হুকুম না পাওয়া পর্যন্ত তারা যেন তাদের অবস্থানে সুশৃংখলভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। যুদ্ধ শেষ হলেও সেই বাহিনীকে তিনি সেখান থেকে সরে আসার নির্দেশ দেননি। ফলে তারা তখনো পূর্ব অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল।

আহত সৈন্যদের আলাদা করার পর রিজার্ভ বাহিনীর সালার সুলতানের কাছে এগিয়ে গেল। সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, ‘সুলতান, শত্রুদের অস্ত্রশস্ত্র, মালসামান, ঘোড়া সবই সংগ্রহ করা হয়েছে। গনিমতের এসব মাল সম্পর্কে আপনার আদেশ কি?’

সুলতান পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। বললেন, ‘যুদ্ধ শেষ হয়েছে এ কথা তোমাকে কে বললো? খুশীতে বিভোর হওয়ার মত সময় এখনও আসেনি আমাদের। আমার শিক্ষা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে তো চলবে না, বিজয়ের পূর্ণতা পাওয়ার আগে গনিমত বন্টনের কথা আমি কখনোই ভাবি না। আমার বিবেচনায় আমরা শত্রুদের একটি বৃহৎ দলকে বিচ্ছিন্ন করেছি মাত্র। কিছু সংখ্যক সৈন্য নিহত এবং কিছু সৈন্যকে আমরা বন্দীও করেছি ঠিক, কিন্তু আমার বিশ্বাস, যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। আমাদের বাহিনী কি কোন পার্শ্ব আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে? না, হয়নি। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। মূল বাহিনীর ডানে বায়ে রক্ষী বাহিনী মোতায়েন না করে ময়দানে আসার কথা নয় সাইফুদ্দিনের। আমার সন্দেহ হচ্ছে, আমাদের উভয় পাশে এখনও শত্রু বাহিনী ওঁৎ পেতে আছে। ময়দানে না আসার কারণে এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী ও সুরক্ষিত থাকার কথা ওদের। তারা যোদ্ধা সৈনিক, যদিও ঈমান বেচা গাদ্দার। কিন্তু এত আনাড়ী নয় যে, তাদের যে ব্যাটেলিয়ান যুদ্ধে অংশ নেয়নি, তারা বিনা যুদ্ধেই ফিরে যাবে? মনে হয়, সুরক্ষিত দল পলাতক সৈন্যদের গুছিয়ে নিয়ে আবার আক্রমণ চালাবে।’

‘তাদের কেন্দ্রীয় কমাণ্ড তো শেষ হয়ে গেছে, সম্মানিত সুলতান!’ এক সেনাপতি বললো, ‘সৈন্য থাকলেও এখন তাদের কমাণ্ড করার আর কেউ নেই।’

‘আছে, কেউ না থাকুক খৃস্টানরা তো আছে। যাদের সাথে এতক্ষণ যুদ্ধ করলে তারা আমাদের মূল শত্রু নয়, এরা তো আসলে খৃস্টানদের হাতের পুতুলমাত্র। খৃস্টানরা নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত এ লড়াই চলতেই থাকবে।

সুলতান আইয়ুবী আরো বললেন, যদিও কোন দিক থেকে কোন সংবাদ আসছে না, কিন্তু আমি নিশ্চিত, খৃস্টানরা কাছেই কোথাও গোপনে সৈন্য ও অস্ত্র মজুদ করে রেখেছে। এটা পার্বত্য এলাকা। এখানে আছে অসংখ্য গলিঘুপচি। উঁচু টিলার আড়ালে আছে গভীর নিম্নাঞ্চল। কোথাও কোথাও আবার গভীর জঙ্গলও রয়েছে। ফলে এই অরণ্য বা টিলার আড়ালে কি আছে কিছুই দেখা যায় না। এই সুবিধাটুকুই ভোগ করছে দুশমন। লুকিয়ে আছে দৃষ্টির অন্তরালে।

‘তেমন কিছু হলে আমরা কি খবর পেতাম না? আমাদের টহল বাহিনীর চোখে কি কিছুই ধরা পড়তো না?’ বললো এক সেনাপতি।

‘শত্রু ও বিষধর সাপকে কখনও বিশ্বাস করতে নেই, মরার সময়ও তা দংশন করে বসে। বেশ কিছু দিন হলো আমি সাইফুদ্দিনের সেনাপতি মুজাফফরুদ্দিনের কোন সংবাদ পাচ্ছি না তোমরা সবাই জানো, মুজাফফরুদ্দিন এত সহজে পালানোর মত সেনাপতি নয়। খৃস্টানদের সহযোগিতা নিয়ে কখন মুজাফফরুদ্দিন ময়দানে আসে আমি তারই অপেক্ষা করছি। তোমরাও চারদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখো। সৈন্যদের সংহত করে প্রস্তুত রাখো তাদের। আমি মুজাফফরুদ্দিনকে যতটুকু চিনি, তাতে তোমাদের এ নিশ্চয়তা দিতে পারি, এই সাপ অবশ্যই আমাদের ওপর ছোবল হানবে, মৃত্যুপথযাত্রী হলেও সে চেষ্টা করবে শেষবারের মত আমাদের ওপর এক প্রচণ্ড আক্রমণ চালাতে।’

❀ ❀ ❀