প্রায় কাছাকাছি চলে এলো প্রহরী। বৃদ্ধ দম বন্ধ করে পড়ে রইলো সেই স্তুপীকৃত কাঠের আড়ালে। সাবধানে এক পা, এক পা করে এগুতে লাগলো প্রহরী। খানিক থমকে দাঁড়ায়, খানিক এগোয়, এভাবে এগুতে এগুতে একেবারে তার পাশ কেটে সামনে এগিয়ে গেল প্রহরী। এমনি একটি সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল বৃদ্ধ। প্রহরী তার হাত দুয়েক দূরে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালো। বৃদ্ধ খঞ্জর বের করে তৈরী হলো। তারপর আলগোছে পা তুললো, কাঠের আড়াল থেকে।
সে জানে, প্রহরীর হাত থেকে মুক্তির এখন একটি পথই খোলা আছে, আর তা হচ্ছে তাকে হত্যা করা। বৃদ্ধ পা উঠালো, খঞ্জর তাক করা হাতটি নিয়ে এলো বুক বরাবর, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
প্রহরী হয়তো শেষ মুহূর্তে কিছু আঁচ করতে পেরেছিল, পই করে ঘুরে দাঁড়ালো সে, আর সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধের খঞ্জর আমূল ঢুকে গেল লোকটির বুকে। চিৎকার করারও সময় পেলো না প্রহরী, বাম হাত দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে তাল সামলাতে না পেরে তাকে নিয়েই পড়ে গেল বৃদ্ধ। সে অবস্থায় থেকেই বৃদ্ধ দ্রুত খঞ্জর টেনে বের করলো এবং পরপর আরও কয়েকটি আঘাত করলো।
লোকটি মারা গেল। নিস্তেজ হয়ে গেল তার দেহ। বৃদ্ধ তাকে রেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো এবং সেখান থেকে পালানোর চিন্তা করলো।
ধ্বস্তাধ্বস্তি সামান্য হলেও নির্জন রাত বলে তার আওয়াজ স্পষ্টই শুনতে পেলো অন্য প্রহরী। আওয়াজের উৎস লক্ষ্য করে সে যখন তাদের কাছাকাছি এসেছে ততক্ষণে একজন বিদায় নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে পরপারে। প্রহরীরা ঘটনাস্থলে এসে যখন কি ঘটছে বুঝতে পারলো তখন দেরী না করে পিছন থেকে জোরে চেপে ধরলো বৃদ্ধকে।
বৃদ্ধ এ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে সজাগ হয়ে উঠলো তার পঞ্চেন্দ্রিয়। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে বৃদ্ধ ধাক্কা দিল প্রহরীকে। প্রহরী ছিটকে গিয়ে পড়লো পেরেকআঁটা কাঠের এক তক্তার ওপর। প্রহরীর গলা চিরে বেরিয়ে এলো মরণ চিৎকার। বৃদ্ধ ছুটলো দ্রুত, কিন্তু কিছুর মধ্যে পা আটকে পড়ে গেল। হাঁচড়ে পাঁচড়ে বৃদ্ধ আবার উঠে দাঁড়ালো এবং দৌঁড় দিল। ততক্ষণে চারদিকে মশাল জ্বলে উঠেছে। তিন চারজন প্রহরী এক সঙ্গে ছুটলো বৃদ্ধকে ধরার জন্য। মশালের আলোয় তারা দেখলো, সাদা দাড়িওয়ালা যে বৃদ্ধকে তারা মনে করেছিল জয়ীফ ও দুর্বল, সে ততটা দুর্বল নয়। নিজেকে মুক্ত করার জন্য বৃদ্ধ এমন তেজের সাথে লড়ছিল, যে শক্তির প্রদর্শনী কেবল কোন প্রশিক্ষিত যুবকের পক্ষেই সম্ভব।
সে ছিল একা আর তাকে ঘেরাও করে ধরেছিল ছয়সাতজন প্রহরী। ফলে সে চেষ্টা করেও তাদের থেকে মুক্ত হতে পারলো না। কিন্তু এই চেষ্টা করতে গিয়ে তার আসল পরিচয় ফাঁস করে দিল দুশমনের সামনে। কারণ ততক্ষণে তার সাদা দাড়ি খসে পড়েছে। সেখানে এখন শোভা পাচ্ছে সুন্দরভাবে ছাটা ছোট ছোট কালো দাড়ি। সকলেই দেখলো, এ কোন বৃদ্ধ নয়, বরং এক যুবক সৈনিক। সম্ভবত আইয়ুবীর এক জানবাজ কমাণ্ডো।
তাকে কাবু করার পর যেখানে একটু আগে সে এক প্রহরীকে খঞ্জর মেরে হত্যা করেছে মশাল নিয়ে সেখানে গেল প্রহরীরা। মশালের আলোয় তারা দেখতে পেলো, এ লোক তাদের কোন প্রহরী নয়, বরং সে তারই সঙ্গী ছিল। এ মৃত যুবক ছিল সাদা দাড়িবেশী বৃদ্ধের খাদেম। অন্ধকারে ওরা পরষ্পরকে চিনতে পারেনি, এখানকার প্রহরী মনে করে অন্ধকারে নিজের একমাত্র সাথীকেই হত্যা করেছে এ যুবক।
লাশের ময়না তদন্ত নেয়া হলো। তার কাপড়ের মধ্যেও পাওয়া গেল খঞ্জর। তাদের উটের ওপর যেসব মালামাল ছিল, এবার তা খুলে দেখলো প্রহরীরা। কিন্তু তাতে তেমন কিছু ছিল, শুধু বস্তাতে কিছু ঘাস ও খড় বোঝাই করা ছিল।
গোয়েন্দা যুবককে এক সহ-সেনাপতির তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হলো। সহ-সেনাপতি তার কাছে অনেক কিছু জানতে চাইলো। কিন্তু সে কোন প্রশ্নেরই জবাব দিল না। সে এমন নীরবতা পালন করলো, যা সহ্য করা সত্যি কঠিন। কিন্তু সহসেনাপতিকে তাতেও বিরক্ত মনে হলো না।
প্রহরীরা সেনাপতির কাছে তার মুখের নকল সাদা দাড়ি হাজির করলো। সহ-সেনাপতি এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেও কোন জবাব পেলো না তার কাছ থেকে। কিন্তু এটা এমন এক প্রমাণ, যার সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
তাকে বলা হলো, ‘তাহলে তুমি স্বীকার করছো, তুমি এবং তোমার সাথী সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা!’
এ প্রশ্নেরও কোন জবাব দিল না ধৃত যুবক। সহ-সেনাপতি বললো, ‘ঠিক আছে, ওকে শান্তি সেলে নিয়ে যাও। সে তার পরিচয় না দিলে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার পরিচয় দেবে।’
তাকে শাস্তি সেলে ঢুকানো হলো। নানা রকম শাস্তি দেয়া হলো, অসহ্য মারপিট করা হলো, কিন্তু সে কিছুতেই স্বীকার করলো না, সে আইয়ুবীর গোয়েন্দা।
রাত কেটে গেল। সকাল বেলা তাকে উপস্থিত করা হলো মুজাফফরুদ্দিনের সামনে। রাতে যা ঘটেছে সে সম্পর্কে অবহিত করা হলো তাকে। তার নকল দাড়ি ও উটের বোঝা সেনাপতি মুজাফফরুদ্দিনের সামনে হাজির করা হলো। তুমি আলী বিন সুফিয়ানের শাগরেদ নাকি হাসান বিন আব্দুল্লাহর?’ মুজাফফরুদ্দিন তাকে জিজ্ঞেস করলো।
‘আমি এ দু’জনের কাউকে চিনি না।’ উত্তর দিল যুবক।
‘আমি এ দু’জনকেই ভাল মত চিনি।’ মুজাফফরুদ্দিন বললো, ‘আমি নিজেও সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর শাগরেদ ছিলাম। ওস্তাদ তার শাগরেদকে কখনও ধোকা দিতে পারে না।’
‘আপনার সাথে যেমন আমার কোন সম্পর্ক নেই তেমনি সুলতান আইয়ুবীর সাথেও আমার কোন সম্পর্ক নেই।’ বললো বন্দী।
‘শোন, হে হতভাগা বন্ধু!’ মুজাফফরুদ্দিন তার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘আমি তোমার সাথে কোন ঝগড়া করবো না আমি তোমাকে অযোগ্য এবং অকম্মাও বলবো না। তুমি তোমার দায়িত্ব সুন্দরভাবেই পালন করেছে। ধরা পড়া কোন দোষের ব্যাপার নয়, সেটা দুর্ভাগ্য। তোমার দুর্ভাগ্যের পরিমাণটা একটু বেশী, নইলে তোমার সাথী তোমারই হাতে খুন হতো না। তুমি আমাকে অনুগ্রহ করে বলে দাও, তোমার কোন সঙ্গী এখান থেকে সংবাদ নিয়ে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছেছে কিনা, আমরা যে এখানে আছি এবং কতজন আছি সে খবর সুলতান জানেন কিনা? আর এ কথাও বলো, তোমাদের সৈন্যরা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও এখানে বসে আছে কেন? সেখানে কি তৎপরতা ও প্রস্তুতি চলছে? মাত্র এই প্রশ্ন কয়টির উত্তর দাও, আমি তোমার সাথে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করছি, যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে তোমাকে মুক্ত করে দেয়া হবে। এখন তোমাকে এখানে সসম্মানে রাখা হবে।’
‘আপনার অঙ্গীকার ও কসমের ওপর আমার কোন বিশ্বাস নেই। সে বললো, কারণ আপনি কোরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।’
মুজাফফরুদ্দিন ধৈর্য ধারণ করে বললো, ‘তুমি বলতে চাচ্ছো, আমি মুসলমান নই?’
‘হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই মুসলমান!’ বন্দী কমাণ্ডো বললো, ‘কিন্তু আপনি কোরআনের অনুগত নন, ক্রুশের অনুগত!’
‘আমি তোমার অভিযোগ এই শর্তে মেনে নিতে পারি যে, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিবে।’ মুজাফফরুদ্দিন বললো, ‘তোমার জীবন মৃত্যু এখন আমার হাতে।’
‘না, জীবন মৃত্যুর মালিক আপনি নন, আল্লাহর ইচ্ছে না থাকলে আপনি আমার জীবন কেড়ে নিতে পারবেন না।’
কমান্ডো এবার মুজাফফরুদ্দিনের অভিযোগ মেনে নিয়ে বললো, ‘আপনি আমাদের সেনাবাহিনীতে ছিলেন, আপনার ভাল মতই জানা আছে, আমাদের সব সৈনিক তার জীবন আল্লাহর হাতে সঁপে দেয়। আমি আপনাকে বলে দিতে চাই, আমি যেমন আইয়ুবীর বাহিনীর এক সামান্য গোয়েন্দা, আমার সঙ্গীও তাই। আমি আর আপনার কোন প্রশ্নের উত্তর দেবো না। আমি এখনো বেঁচে আছি, অতএব তোমরা ইচ্ছা করলে এখন আমার গায়ের চামড়া খুলে নিতে পারো, কিন্তু আমার মুখ থেকে তোমাদের কোন প্রশ্নের উত্তর কখনও শুনতে পারবে না। আমি তোমাকে এ কথাও বলে দিতে চাই, পরাজয় আল্লাহ তোমার ভাগ্যেই লিখে রেখেছেন, আমাদের নয়।’
‘এর পায়ের গিরাতে শক্ত করে রশি বাঁধো, আর উল্টো করে গাছের ডালে লটকিয়ে দাও।’ মুজাফফরুদ্দিন একটি গাছ দেখিয়ে এ হুকুমনামা জারী করে দ্রুত তার তাঁবুতে চলে গেলো।
‘ওদের দু’জনের একজনও এখন পর্যন্ত ফিরলো না!’ হাসান বিন আব্দুল্লাহ সুলতান আইয়ুবীকে বললো, ‘তাদের ধরা পড়ার তো কোন ভয় ছিল না। আমাদের গোয়েন্দাদের ধরার মত লোক এখানে আর কে আছে? তাছাড়া তাদের তো বেশী দূরে যাওয়ারও কথা নয়, তবে দেরী হচ্ছে কেন?’
‘তারা গ্রেফতারওতো হয়ে যেতে পারে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তারা সেই সকালে গিয়েছে, এখন সন্ধ্যা। কিন্তু এখনও তাদের ফেরার নাম নেই, মনে হয় তারা ধরাই পড়েছে। তাদের এখন পর্যন্ত না আসাই প্রমাণ করে, আশেপাশে শত্রু আছে। আজ রাতে আরও কয়েকজনকে পাঠিয়ে দাও। তারা আরো কয়েক মাইল পর্যন্ত দেখে আসুক।’
সুলতান আইয়ুবী গোয়েন্দাদের নিয়ে কথা বলছিলেন হাসান বিন আব্দুল্লাহর সাথে। যে দুই গোয়েন্দাকে সকালে পাঠিয়েছিলেন আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করতে, তাদের না ফিরার কারণে পেরেশান ছিলেন দু’জনই। নিজের গোয়েন্দা সংস্থার ওপর সব সময় ভরসা ছিল সুলতান আইয়ুবীর। এই গোয়েন্দাদের দিয়েই তিনি শত্রুদের নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু আজ দুই গোয়েন্দার ফিরে না আসার একটিই কারণ হতে পারে, তারা ধরা পড়েছে। কিন্তু আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের ধরে এমন সাধ্য কার? সুলতান ভেবে দেখলেন, একমাত্র মুজাফফরুদ্দিনই তা পারে। কারণ মুজাফফরুদ্দিন তাঁরই শাগরেদ, তার সমর কৌশল সম্পর্কেও মুজাফফরুদ্দিন জ্ঞাত।
গত রাতে সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দার লাশ তুর্কমানের কিছু দূরে এক নির্জন প্রান্তরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তার বুকে বিদ্ধ ছিল বিষাক্ত তীর।
মুজাফফরুদ্দিন তার সহ-সেনাপতিদের বলেছিলো, ‘যদি তোমরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নিতে পারো, তবে তিনি অন্ধ ও বোবা হয়ে যাবেন। কেবল তখনই তোমরা তাকে পরাজিত করার চিন্তা করতে পারো।’
সুলতান আইয়ুবী এই দু’টি ঘটনাকে তুচ্ছ মনে করলেন না। তার আদেশে হাসান বিন আব্দুল্লাহর ছয়জন কমান্ডো সেনা রাতের আঁধারেই নিখোঁজ গোয়েন্দাদের সন্ধানে যাত্রা করলো।
সুবহে সাদেকের পর মসজিদে ফজরের আজান ধ্বনিত হলো। ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গলো সুলতান আইয়ুবীর। তিনি তাঁবুর বাইরে গেলেন। খাদেম মশাল জ্বালিয়ে তার তাঁবুর সামনে রেখে দিল।
এ সময় একদিক থেকে ছুটে এলো এক অশ্বারোহী। থামলো এসে সুলতান আইয়ুবীর সামনে। দ্রুত অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে সালাম দিল সুলতানকে। তারপর সময় ক্ষেপন না করে বলতে লাগলো, ‘সুলতান, আপনার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক! মনে হয় আপনার ডান বাহিনীর অদূরে দুশমন সৈন্য সমাবেশ করছে। অন্ধকারে ওদের দেখা না গেলেও তাদের আনাগোনার আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য দু’জনকে পাঠিয়েছি, তারা সঠিক খবর নিয়ে এখুনি আপনার সামনে হাজির হবে।’
অশ্বারোহীর কথা শেষ হলো না, দূর থেকে শোনা গেল অশ্বখুরধ্বনি; সুলতান এবং অশ্বারোহী উভয়েই কথা বন্ধ করে সেদিকে তাকালো। নতুন এক অশ্বারোহী ছুটে এসে ঘোড়া থামালে সুলতানের সামনে। সে ঘোড়া থেকে নামার আগেই সুলতান প্রশ্ন করলেন, ‘কি খবর নিয়ে এসেছো?’
‘খবর সঠিক, দুশমন সৈন্য এগিয়ে আসছে আপনার ডান পাশের বাহিনীর দিকে।’
সুলতান আইয়ুবী কেন্দ্রীয় কমাণ্ড কাউন্সিলের সেনাপতিদের নাম উল্লেখ করে বললেন, ‘এদেরকে জলদি খবর দাও।’
সুলতান তাদেরকে খবরের জন্য পাঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে পড়লেন এবং তায়াম্মুম করে নিলেন। কারণ তার কাছে ওজু করার মত সময় ছিল না। তায়াম্মুম শেষে সেখানেই তিনি কেবলামুখী হয়ে নামাজ পড়ে নিলেন। নামাজ শেষে সংক্ষিপ্ত মোনাজাত করে তিনি তার ঘোড়া আনতে বললেন।
‘এ মুজাফফরুদ্দিন ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।’ সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতিদের বললেন, ‘এ সৈন্য দল খৃস্টানদের নয়। তাদের আক্রমণের সময় এখন নয়। যদি এ সংবাদ সত্যি হয় যে, শত্রু সৈন্য আমাদের ডান দিক থেকে আসছে এবং আমাদের ডান বাহিনীকেই ওরা প্রথম টার্গেট বানাতে চায়, তবে মনে রেখো, ওরা দুই তরফা আক্রমণ চালাবে। তোমরা কোন দলকেই পিছনে হটতে দিবে না। তোমাদের পিছনে দেড় হাজার কবরের গর্ত রয়েছে। সব লাশ এখনও দাফন করা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধ শুরু হলে তোমরা আস্তে আস্তে পিছু হটবে। পিছনের সৈন্যদের সুযোগ দেবে কবর পেরিয়ে ওপাশে চলে যাওয়ার। এরপর তাদের সহায়তায় তোমরাও পার হয়ে আসবে কবরের সীমানা পুরনো সৈন্য নয়, এই গর্তগুলো আমি ভরে তুলতে চাই এই নবাগত সৈন্যদের লাশ দিয়ে। সেই লাশ আমি কষ্ট করে কবরে নামাতে চাই না, আমি চাই ওরা পায়ে হেঁটে সেই কবরে নেমে যাক।
সুলতান আইয়ুবী ঘোড়ায় আরোহণ করলেন, তার রক্ষীবাহিনীর বারো জন রক্ষী চললো তার পিছনে। তারাও অশ্বারোহী। রক্ষী ছাড়া তিনি ছয়জন কাসেদও সঙ্গে নিলেন সংবাদ সরবাহের জন্য। আর নিলেন দু’জন সেনাপতি।
তিনি দ্রুত ঘোড়া ছুটালেন এবং পাহাড়ের এমন এক উঁচু স্থানে গিয়ে দাঁড়ালেন, যেখান থেকে তার ডানের বাহিনীর এলাকা ও সৈন্যদের দেখা যায়।
রাতের আঁধার কেটে ভোরের আলো ফুটছিল একটু একটু করে। তিনি উপত্যকা থেকে নিচে নামলেন এবং ডান পাশের সৈন্যদের কমাণ্ডারকে ডেকে বললেন, ‘অশ্বারোহী সৈন্যদের ঘোড়ায় আরোহণ করতে বলো। পদাতিক বাহিনীকে বললা অতিসত্ত্বর সামনের ময়দানে পজিশন নিতে আর তীরন্দাজ বাহিনীকে পরিখা, নিম্নভূমি ও উপরের নিরাপদ স্থানে তীর-ধনুক নিয়ে অবস্থান নিতে বলল। সবাইকে বললা, তারা যেন তাড়াতাড়ি যুদ্ধের পজিশন নিয়ে বসে থাকে।’
কমাণ্ডররা নিজ নিজ সৈন্যদের পজিশনে বসিয়ে দিল।
সুলতান বললেন, ‘এখন থেকে ডান পাশের বাহিনীকে আমি নিজে উপস্থিত থেকে কমান্ড করবো। তিনি সেই বাহিনীর সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের বললেন, তোমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ কাসেদ পাশে রাখো, তাদের মাধ্যমে প্রতি মুহুর্তে আমার সাথে যোগাযোগ ঠিক রাখবে এবং প্রতিটি নির্দেশ বিচক্ষণতা ও দ্রুততার সাথে পালন করবে।’
সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর গতি এমনিতেই ছিল দ্রুত ও বেগবান, আইয়ুবীর এ নির্দেশ পাওয়ার পর তাদের গতি যেন বিজলীর মত দ্রুতগতি হয়ে উঠলো। সুলতানের যে কোন নির্দেশ পালনের জন্য সৈন্যরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। সুলতানের প্রতিটি চাল বা কৌশল মুহূর্তে সারা ময়দানে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সীনা টান করে অপেক্ষা করতে লাগলো কাসেদ বাহিনী। বিজলীর মতই দ্রুত গতিতে সুলতানের আদেশ তারা পৌঁছে দিতে লাগলো সৈনিকদের কানে কানে।
মুজাফফরুদ্দিনের সৈন্যবাহিনী তখনও নিকটবর্তী হয়নি, সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনীকে তৎপর করে তুললেন।
ময়দানে নেমে এলো মুজাফফরুদ্দিনের সেনাবাহিনী। প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিলো মুজাফফরুদ্দিন। যেইমাত্র তার প্রথম অশ্বারোহী দল সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদলের সামনে এলো, অমনি শুরু হলো তীর বৃষ্টি। মুহূর্তে তার সব প্ল্যান প্রোগ্রাম যেন উলট-পালট হয়ে গেল। কারণ এখানে অসংখ্য মাটির ঢিবি ও গর্ত ছিল। সেই সব গর্ত থেকে সুলতান আইয়ুবীর তীরন্দাজেরা অবিরাম তীর বর্ষণ করে চললো। তারা দ্রুতগামী ঘোড়া এবং তার আরোহী উভয়কেই তীর মেরে ঘায়েল করতে লাগলো। ধরাশায়ী হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগলো মুজাফফরুদ্দিনের অশ্বারোহী সৈন্যরা।
যে সব ঘোড়া তীরের আঘাতে আহত হলো, সে সব ঘোড়া পাগলের মত এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগলো। এমন ঘটনা তো প্রত্যেক যুদ্ধ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে, মুজাফফরুদ্দিনের জন্য এই অবস্থা বিস্ময়ের কিছু ছিল না। কিন্তু তার অশান্তির কারণ হলো, তার আশার বিপরীত সুলতান আইয়ুবীর ডানের সেনাদল সজাগ ছিল ও মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিল।
এই প্রচণ্ড আক্রমণে সুলতান আইয়ুবীর অসংখ্য তীরন্দাজও হতাহত হয়। এই কোরবানী বিফলে যায়নি, মুজাফফরুদ্দিনের আক্রমণের প্রচণ্ডতা তীরন্দাজদের এই তীর খেয়েই শেষ হয়ে যায়। এরপর আসে সুলতান আইয়ুবীর সেই বিশেষ আক্রমণের পালা, যার কথা মনে হলেই দুশমন সৈন্যদের পানির পিপাসা পেয়ে যায়।
মুজাফফরুদ্দিন এই আশা নিয়ে যুদ্ধে এসেছিলো যে, সে সুলতানের বাহিনীর সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের ওপর, যেমনটি তার ওস্তাদ সুলতান আইয়ুবী করে থাকেন। তার সে আশা-ভরসা তীরন্দাজদের আঘাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
এখন সুলতান আইয়ুবী তার আপন চাল অনুযায়ী যুদ্ধ করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তার যেসব তীরন্দাজ সৈন্য মুজাফফরুদ্দিনের অশ্বারোহী বাহিনীর পদতলে জীবন উৎসর্গ করেছিল, তার সুফল এখন সুলতান আইয়ুবীর হাতে।
মুজাফফরুদ্দিনের অশ্বারোহী বাহিনীর কিছু সৈন্য তীরন্দাজদের আঘাত থেকে বেঁচে সামনে চলে এসেছিল। সুলতান আইয়ুবী আক্রমণকারীদের প্রচণ্ড আক্রমণ দেখলেন এবং এই অশ্বারোহীদের মোকাবেলা করার জন্য নিজের অশ্বারোহী দলকে নির্দেশ দিলেন। সুলতান আইয়ুবী এবার বামের অশ্বারোহী দলের দিকে ঘোড়ার মুখ ঘুরালেন এবং তীরবেগে ঘোড়া ছুটালেন তাদের দিকে। সাথে সাথে ডানের বাহিনী তীর বেগে সরে দাঁড়ালো ময়দান থেকে। আক্রমণকারী শত্রুদের সামনে থেকে মুহূর্তে সব বাঁধা অপসারিত হয়ে গেল।
শত্রু সেনারা যখন ময়দান ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছিল, সে সময় ময়দান এমন উন্মুক্ত দেখে আবার দুঃসাহসী হয়ে উঠলো এবং আগ-পিছ না ভেবে মুজাফফরুদ্দিনের অবশিষ্ট সৈন্য সামনে এগিয়ে এলো। সুলতান আইয়ুবী এটাই চাচ্ছিলেন, তিনি ডান ও বামের সৈন্য বাহিনীর মাঝখানের ফাঁক দূর করে তাদের একত্রিত করে দিলেন। এই দুই বাহিনী একত্রিত হয়ে তাদেরকে তিন পাশ থেকে ঘিরে ধরলো।
মুজাফফরুদ্দিনের বাহিনী সামনে এগিয়ে গেল। তাদের পেছনে আইয়ুবীর ডান-বামের বাহিনী একত্রিত হয়ে ক্রমশ তাদের ঘেরাও সংকুচিত করে আনছিল। মুজাফফরুদ্দিনের তিন দিক ঘিরেছিল এই বাহিনী, সামনে আইয়ুবীর মূল ফৌজ। আইয়ুবীর সম্মুখ বাহিনীর দিকে ছুটছিল মুজাফফরের বাহিনী, এ সময় তিন দিকের ঘেরাও সংকুচিত করে তাদের ওপর আঘাত হানলো আইয়ুবীর ঘেরাওকারী বাহিনী।
তিন দিকের আক্রমণে শত্রু সেনারা চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো। তাদের ওপর আইয়ুবীর পার্শ্ব সেনাদের বর্শার একটি আঘাতও ব্যর্থ হলো না।
আক্রমণকারী সৈন্যের নজর ছিল সামনের দিকে। সেদিকেই তারা ছুটে চলছিল তীব্র গতিতে, দু’পাশে নজর দেয়ার মত কোন সুযোগ ছিল না তাদের। কিন্তু এ আক্রমণ তাদের হতভম্ব করে দিল। তারা দেখলো, সম্মুখ বাহিনীর একটি পাশ এখনো ফাঁকা, চারদিক থেকে ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যাওয়ার আগেই এ ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই তাদের। সেই ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবার জন্য মুজাফফরুদ্দিনের বাহিনী এবার ছুটলো সেদিকে। কিন্তু সে ফাঁকেই যে পড়ে আছে দেড় হাজার কবর, জানা ছিল না তাদের।
প্রচণ্ড বেগে ছুটছিল মুজাফফরুদ্দিনের অশ্বারোহী বাহিনী। মুহূর্তে গিয়ে পড়লো সেই কবরের সামনে। মুখ হা-করা দেড় হাজার কবর দেখে থমকে দাঁড়াবার সুযোগও পেল না, হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে কবরের ওপর। যারা থমকে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো, তারা পিছন থেকে সুলতান আইয়ুবীর ধাওয়াকারী অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলো।
মুজাফফরুদ্দিনের আক্রমণকারী বাহিনী আইয়ুবীর বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে কবরের ওপর দিয়েই ছুটতে আরম্ভ করলো। কবর টপকে এগুতে গিয়ে তাদের অনেকেই পড়ে গেল কবরের ভেতর। সেখান থেকে তারা উঠে আসার আগেই তাতে পড়লো আরো সৈন্য। এভাবে নিজের সৈন্যদের চাপে পড়ে ইহলীলা সাঙ্গ হলো অনেক সৈন্যের।
মুজাফফরুদ্দিন ভীত হওয়ার পাত্র ছিলো না। সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীতে থাকতেও অল্প সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা তার ছিল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মুজাফফরুদ্দিন রুখে দাঁড়িয়ে তার অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে পাল্টা আঘাত হানলো আইয়ুবীয় বাহিনীর ওপর। তারা তরঙ্গের মত ছুটে গেল আইয়ুবীর ঘেরাওকারী বাহিনীর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে সুলতান আইয়ুবী তার অশ্বারোহীদের থামিয়ে দিলেন, ইশারা করলেন তাদেরকে ময়দান ছেড়ে দিতে। তারা তাই করলো এবং মুজাফফরুদ্দিনের বাহিনীকে ময়দানে রেখে দ্রুত সরে গেল সুবিধাজনক পাশে। এই ফাঁকে আবার তাদের ওপর শুরু হলো তীর বর্ষণ।
তারা নিজেদের সামাল দেয়ার সুযোগও পেল না। তীরের আঘাতে একে একে লুটিয়ে পড়তে লাগলো ময়দানে।
অবস্থা বেগতিক দেখে মুজাফফরুদ্দিনও ময়দান ছেড়ে পাশে দণ্ডায়মান অশ্বারোহী বাহিনীর ওপর টুটে পড়লো। যুদ্ধ চলে গেল হাতাহাতির পর্যায়ে। সুলতান আইয়ুবীর তীরন্দাজ বাহিনীর তীর বর্ষণ বন্ধ হয়ে গেল। কারণ ময়দানে উভয় বাহিনীর যোদ্ধারা একাকার হয়ে পড়েছিল। উভয় বাহিনীর এ মারমুখী লড়াইয়ের কারণে যুদ্ধের অবস্থা বড় করুণ হয়ে উঠলো। সুলতান আইয়ুবী কাসেদ মারফত রিজার্ভ বাহিনীকে ময়দানে তলব করলেন। সাথে সাথে সংরক্ষিত রিজার্ভ বাহিনীও ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
মুজাফফরুদ্দিনের সমস্য হলো, সে কোন সাহায্য পাচ্ছিল না। তারপরও বীরের মত লড়ে যাচ্ছিল মুজাফফরুদ্দিন ও তার বাহিনী। বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো যুদ্ধ। সন্ধ্যা পর্যন্ত চললো এ মরণপণ লড়াই। সুলতান আইয়ুবী কাসেদ মারফত যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। নিজেও ছুটাছুটি করে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
সন্ধ্যা। সুলতান আইয়ুবীর রিজার্ভ বাহিনীর প্রবল আক্রমণের ফলে মুজাফফরুদ্দিনের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে দাঁড়ালো যে, ময়দান থেকে বের হওয়ারও কোন পথ খুঁজে পেল না সে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই বাহিনীর রক্তাক্ত সমর চললো। যুদ্ধের কমাণ্ড সুলতান আইয়ুবীর হাতে ছিল বলেই বাঁচা নতুবা অবস্থার বিপর্যয় ঘটে যেতে পারতো। মুজাফফরুদ্দিন তার চুড়ান্ত যোগ্যতা প্রদর্শন করে উস্তাদের সাথে যুদ্ধ করলো। সুলতান আইয়ুবীর শিখানো যুদ্ধের সকল কলা-কৌশল প্রদর্শন করে লড়াই করলো সে, কিন্তু পরাজয় রোধ করতে পারলো না শুধুমাত্র বাইরে থেকে কোন সাহায্য না পাওয়ায়।
বাজীতে হেরে গেলো মুজাফফরুদ্দিন। এ যুদ্ধেও সুলতান আইয়ুবী অনেক যুদ্ধবন্দী আটক করলেন। মুজাফফরুদ্দিনের এক উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন, তাকেও যুদ্ধবন্দী হিসাবে হাজির করা হলো সুলতানের সামনে। এই ফখরুদ্দিন যেনতেন লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন সাইফুদ্দিনের প্রধানমন্ত্রী।
তুর্কমানের যুদ্ধে যখন সাইফুদ্দিন পলায়ন করে, তখন ফখরুদ্দিন মুজাফফরুদ্দিনের কাছে চলে যায় ও তাকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করতে থাকে। সুলতান আইয়ুবীর ওপর এ আক্রমণ চালানোর অন্যতম উস্কানিদাতা ছিল এই ফখরুদ্দিন।
এই যুদ্ধ ১১৭৬ সালের এপ্রিল মাস, মুতাবেক হিজরী ৫৭১ সালের সাওয়াল মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধে মুজাফফরুদ্দিনের চরম পরাজয় ঘটেছিল। সুলতান আইয়ুবী বলতে গেলে এ যুদ্ধেই নামধারী মুসলিম শত্রুদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছিলেন।
কিন্তু এই যুদ্ধে সুলতান আইয়ুবীরও এত বেশী ক্ষতি হয়েছিল যে, যুদ্ধপরবর্তী দুই মাস তিনি তুর্কমান সমরাঙ্গণ থেকে বের হতে পারেননি। তার দক্ষিণ বাহিনী শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাতে তার নিজের দক্ষিণ হস্তই যেন ভেঙ্গে গিয়েছিল। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য তিনি নতুন সৈন্য ভর্তি শুরু করলেন।
সাথে সাথে তিনি মিশর ও দামেস্কে কাসেদ পাঠালেন সামরিক সাহায্য চেয়ে। যদি তার এত বেশী ক্ষতি না হতো, তবে তিনি বিলম্ব না করে হলব, মুশেল ও হারানের ওপর আক্রমণ চালাতেন। আর তিনি যদি তেমন আক্রমণ চালাতে পারতেন তবে ফিলিস্তিনের পথে অগ্রাভিযানে যেসব মুসলমান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, অচিরেই তিনি তাদের সঠিক পথে আনতে পারতেন অথবা তাদের সব সামরিক শক্তি নিঃশেষ করে দিতে পারতেন।
‘এই বিজয় আমার বিজয় নয়!’ যুদ্ধ অবসানের পর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তার সেনাপতিদের বলছিলেন, ‘এই বিজয় আসলে খৃস্টানদের বিজয়! তারা আমাদের দুর্বল করতে চায়, তাদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। তারা আমার অগ্রাভিযানের গতি দুর্বল করে ফিলিস্তিনের উপরে তাদের আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়, তাদের এ উদ্দেশ্যও সফল হয়েছে এ যুদ্ধে। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা বুঝবে, কাফেররা কোনদিন মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না। যখন তারা মুসলমানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়, তখন বুঝতে হবে, এই বন্ধুত্বের মধ্যেও লুকিয়ে আছে শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র। আমি বলতে পারি না, ইতিহাস লেখার সময় ঐতিহাসিকরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কি লিখবেন। তারা যদি লেখেন, মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করেই শেষ হয়ে গেছে তাহলে তা খণ্ডনের কোন ভাষা নেই আমাদের।’
সুলতান আইয়ুবী যখন তার মুসলমান ভাইদের জন্য এই দরদ ও আবেগ প্রকাশ করছিলেন, সে সময় তার অজ্ঞাতে তার সেই সব মুসলমান ভাইয়েরা ষড়যন্ত্রের নতুন এক ছক তৈরী করছিল। যারা তুৰ্কৰ্মনের অদূরে সংঘটিত সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তারা তাকে হত্যা করার নতুন পরিকল্পনা তৈরী করছিল। এই পরিকল্পনায় শামিল হয়েছিল গুমাস্তগীন ও গুপ্তহত্যাকারী দলের সরদার শেখ মান্নান।
সে সময় শেখ মান্নান আছিয়াত নামক এক কেল্লায় অবস্থান করছিলো। তাকে এ কেল্লা উপহার দিয়েছিল খৃস্টানরা। শেখ মান্নান খৃস্টানদের কাছ থেকে এ কেল্লা উপহার পাওয়ার পর সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তার গুপ্তঘাতক দলের সদস্যদের এনে জড়ো করে এ কেল্লায়। তারপর সেখানে চলতে থাকে তাদের নানা রকম প্রশিক্ষণ। এসব প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, যে কোন ভাবে সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করা।
❀ ❀ ❀
আসিয়াত ও তুর্কমান অঞ্চলের মাঝামাঝি এক বিশাল মরুভূমি। মরুভূমি না বলে তাকে দুনিয়ার জাহান্নাম বলাই ভাল। সুলতান আইয়ুবীর চার কমাণ্ডো সৈন্য রাস্তা ভুলে চলে এসেছিল এই মরু-জাহান্নামে।
সূর্য দিগন্তের পাড়ে হেলে পড়েছিল। কমাণ্ডো নেতা আন নাসেরের ঘুম ভাঙলো পড়ন্ত বেলায়। শুয়ে থেকেই চোখ খুললো কমাণ্ডো নেতা। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল তার দুঃসহ সফরের কথা। দ্রুত সে উঠে বসলো এৰং চারদিকে তাকালো। দেখলো, মেয়ে দু’জন তখনো তেমনি বসে আছে। আন নাসেরের মনে পুরোনো ভয় আবার জেগে উঠলো।
মেয়েদের একজন বললো, “ঘুম কেমন হলো?’
‘ভালো।’
‘এখন কি ক্লান্তি কিছুটা কমেছে?’
‘হ্যাঁ, এখন আমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সুস্থ। সফর করতে তেমন কষ্ট হবে না আর।’
মেয়েরা তার সাথে এমন অন্তরঙ্গভাবে কথা বলছিলো, আন নাসের অনুভব করলো, মেয়েরা তাদের সাথে কোন দুর্ব্যবহার করবে না। তবুও আন নাসেরের ভয় গেল না। কারণ তখনও সে তাদেরকে মানুষ নয়, জ্বীন ভাবছিল। এদের সাথে কথাবার্তা ও আচরণে তাই সে সাবধানতা অবলম্বন করছিল।
‘ওদেরকে জাগাও।’ আন নাসেরের সঙ্গীদের দিকে ইশারা করে বললো মেয়েদের একজন, ‘আমাদেরকে বহু দূর যেতে হবে।’
‘আমাদেরকে কি তোমাদের সঙ্গে নেবে, নাকি আমাদের ফেলে চলে যাবে তোমরা?’ আন নাসের চিন্তাৰিত মনে প্রশ্ন করলো।
‘তোমরা সবাই আমাদের সঙ্গে যাবে!’ মেয়েটি উত্তর দিল, ‘আমাদের ছাড়া তোমরা সঠিক পথ খুঁজে পাবে না।’
আন নাসের সাথীদের জাগালো। বড় মেয়েটি সঙ্গের মেয়েটিকে কিছু বললো। সে উঠে দাঁড়ালে এবং ঘোড়ার কাছে এগিয়ে গেল। সে ঘোড়ার সাথে বাঁধা থলি থেকে কিছু বের করলো এবং পানির মশক খুলে নিচে নামিয়ে আনলো। তারপর মশকের মুখ খুলে থলি থেকে বের করা জিনিস তাতে ঢেলে দিল। এবার সে মশক ভাল করে ঝাঁকিয়ে কমাণ্ডোদের কাছে নিয়ে এলো। মশকটি আন নাসেরর হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘সঙ্গীদের নিয়ে পানিটুকু পান করে নাও। কারণ সফরের সময় আর পানি পাবে না।’
বড় মেয়েটা তাদের কিছু শুকনো খাবার দিল। আন নাসের ও তার সাথীরা সেই খাবার খেয়ে সবাই পানি পান করে নিল।
ওরা যখন খাওয়া দাওয়া সারছিল, সেই ফাঁকে মেয়েরা তাদের ব্যাগ ও মশক গুছিয়ে নিয়ে ঘোড়ার জ্বীনের সাথে বাঁধলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো। মেয়েরা তাদের তাড়া দিল, ‘কই, চলো।’
ওরা চলতে শুরু করলো। একটু পরেই নেমে এলো রাতের আঁধার। আকাশে জ্বলে উঠলো লাখো-কোটি তারার আলো। একটু পর চাঁদ উঠলো। মরুভূমিতে এমনিতেই আঁধার গাঢ় হয় না, এই তারার আলো ও চাঁদের জোসনা অন্ধকার একেবারেই ফিকে হয়ে উঠলো। কোমল জোসনা ছড়িয়ে পড়লো দিগন্ত বিস্তৃত চরাচরে।
ওরা হাঁটছিল স্বাভাবিক গতিতে। বড় মেয়েটি তার ঘোড়া আন নাসেরের কাছাকাছি নিয়ে বললো, ‘তোমরা তো এই স্থানকেই জাহান্নাম বলছিলে?’
‘না, না, কি বলছো তুমি!’ আন নাসের উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো, ‘এখানে তো দেখছি চারদিকে সবুজ মাঠ। অবারিত ঘাসের সমাহার। শান্ত শীতল সমীরণ। চাঁদের মায়াবী জোসনা। এ তো জাহান্নাম নয়, জান্নাতের বাগান! তুমি কেমন করে এত শীঘ্রই এমন মনোরম জায়গায় নিয়ে এলে আমাদের?’
তার তিন সঙ্গীও অবাক বিস্ময়ে তাকাচ্ছিল এদিক-ওদিক।
‘তোমরাও কি সবাই এ সবুজ মাঠ দেখতে পাচ্ছো?’ কমাণ্ডোদের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি প্রশ্ন করলো।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমরা তো আদিগন্ত সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে অনেক আগে থেকেই পথ চলছি।’ একজন বললো। বাকীরাও উফুল্ল কণ্ঠে সায় জানালো এ কথায়।
‘তোমরা তো আমাদের প্রাণ নিয়ে নিবে না? এ কি সত্যি, নাকি ধোঁকা? নাকি আমাদের হত্যা করার আগে অলীক মায়ার রাজ্যে নিয়ে এসেছে আমাদের।’ অপরজন বললো, ‘তোমরা জ্বীন জাতির মেয়ে, তোমাদের পক্ষে তো সবই করা সম্ভব!’
‘না!’ মেয়েটি হেসে বললো, ‘আমরা তোমাদেরকে এর চেয়ে অধিক সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।’
বড় মেয়েটি আন নাসেরকে বললো, ‘এসো এখানে কিছুক্ষণ বসি।’
ওরা থেমে গেল এবং মখমলের মত কোমল ঘাসের ওপর বসে পড়লো সবাই। বড় মেয়েটি আন নাসের ও তার এক সাথীকে বললো, ‘তোমরা আমার চোখের দিকে তাকাও।’
অন্য মেয়েটিও আন নাসেরের দুই সাথীকে সামনাসামনি বসিয়ে তাদেরকে বললো, ‘তোমরাও আমার চোখের দিকে তাকাও।’
চারজন কমাণ্ড সৈন্য অনুগত ভৃত্যের মত সে হুকুম তামিল করলো। তারা পাশাপাশি বসে তাকালো দুই মেয়ের চোখে। মেয়েরা তখন সুমিষ্ট সুরে ওদের বলছিল, এই তোমাদের বেহেশত! এখানকার ফুলের সৌন্দর্য দেখো, এগুলোর ঘ্রাণ নাও। দেখো, কি সুন্দর ছোট ছোট পাখিরা উড়ছে এ ফুলের বাগানে। তাদের কিচির মিচির আওয়াজ কতই না সুন্দর! এ সবই তোমাদের পুরস্কার। তোমাদের পদতলে মখমলের মত নরম কোমল ঘাস। তাকিয়ে দেখো, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝরনাধারা! কি স্বচ্ছ সেই পানি, পান করে দেখো, এ পানি কত সুমিষ্ট! এসবই তোমাদের জন্য। তোমাদের মহৎ কর্ম ও চিন্তার বিনিময়ে আল্লাহ এ সব পাঠিয়েছেন তোমাদের জন্য।’
মেয়েদের সেই সুরেলা কণ্ঠের যাদু চার জনের জ্ঞান ও বুদ্ধির ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করছিল। তারা ভাবছিল, সত্যি তারা বেহেশতে চলে এসেছে। এরা মানুষও নয়, জ্বীনও নয়, এরা সেই বেহেশতের হুর, যাদের কথা আল্লাহ কোরআনে বার বার উল্লেখ করেছেন।
আন নাসের পরে হাসান বিন আব্দুল্লাহকে যে রিপোর্ট দিয়েছিল তাতে সে বলছিল, ‘মেয়েদের চোখে তাকিয়ে আমি সামনে পানির স্বচ্ছ ঝর্ণা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। রঙবেরঙের ফুলে ভরা বাগান দেখতে পাচ্ছিলাম। সবুজ পাতার ফাঁকে আকর্ষণীয় ফুলের গুচ্ছ দেখে মনে হচ্ছিল অপূর্ব ও অনিন্দ্য সুন্দর এ বাগান। যে বাগানের সৌন্দর্য ও ফুলের সুষম বর্ণনা করার মত নয়।
মেয়েদের সোনালী কেশগুচ্ছ থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল প্রাণ উতলা করা সুবাস। সেখানে আমি কোন বালি বা মাটির লম্বা টিলা দেখতে পাচ্ছিলাম না। সেখানে মরুভূমির কোন ছায়াও ছিল না। সবুজ-শ্যামল বাগান, বাগানের বাহারী ফুল আর নিচে মখমলের মত ঘাসের বিছানা দেখে সত্যি আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। রঙবেরঙেরে পাখি নাচানাচি ও কিচির-মিচির করছিল সেখানে। আমার মনে হচ্ছিল, সত্যি আমরা জান্নাতের বাগানে ঢুকে পড়েছি।’
❀ ❀ ❀