» » গাদ্দার

বর্ণাকার
🕮

মেয়েরা আবার উঠলো। চলতে শুরু করলো কাফেলা। তারা চার জন মখমলের মত ঘাসের মধ্য দিয়ে চলতে লাগলো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে তখনো বালির প্রান্তরই ছিল। কোথাও কোথাও ছিল মাটির কঠিন শিলা।

তারা চার জনই গান গাইতে গাইতে পথ চলছে। তারা যাচ্ছে পায়ে হেঁটে। মেয়েরা তাদের কয়েক গজ পিছনে ঘোড়র ওপর সওয়ার হয়ে যাচ্ছে। তাদের গতি তুর্কমানের দিকে ছিল না, যদিও কমাণ্ডোরা জানতো, তারা সুলতান আইয়ুবীর তুর্কমান ক্যাম্পেই যাচ্ছে। মেয়েরা এই চার কমাতে যুবককে তাদের অজ্ঞাতে তাদের লক্ষ্যস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আছিয়াতের কেল্লার দিকে। সেখানে ফেদাইনের গুপ্তঘাতক দলের সরদার শেখ মান্নান থাকে।

আন নাসের ও তার সাথীদের কিছুই জানা ছিল না, তারা কোথায় যাচ্ছে। তাদের অনুভূতি ও বিবেক বুদ্ধি মরে গিয়েছিল। তারা যাচ্ছিল না, বরং বলা যায় তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

তাদের পিছনে মেয়ে দুটি পরস্পর কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কথা.ঐ কমাণ্ডোদের কান পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে না।

তুমি তো বললে, ‘রাতে আর কোথাও থামবে না। ছোট মেয়েটি বড়টিকে জিজ্ঞেস করলো, এ চার জন কি পায়ে হেঁটে সারা রাত পথ চলতে পারবে?’

‘তুমি পানিতে যে পরিমাণ হাশিশ মিশিয়েছে, তার প্রভাব আগামীকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবে।’ বড় মেয়েটি বললো, ‘আর আমি যা খাইয়েছি তাও তুমি দেখেছে। ওদের সম্পর্কে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আশা করি সকাল হতে হতেই আমরা আছিয়াত পৌঁছে যাবো।’

‘আমি তো তাদের দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।’ ছোট মেয়েটি বললো, ‘এটা তোমারই কৃতিত্ব যে, তুমি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছো।’

‘মুসলমানরা জ্বীন জাতিতে বিশ্বাস করে।’

‘আর সে জ্বীনকে ওরা ভয়ও করে। তুমি তাদের মনে সে ভয় ভাল মতই ঢুকিয়ে দিয়েছে।’

‘এটা শুধু বুদ্ধির খেলা।’ বড় মেয়েটি বললো, ‘আমি তাদের মুখ ও চাল-চলন দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, এরা সুলতান আইয়ুবীর সামরিক বিভাগের লোক। তারা ভুলে
এদিকে এসে পড়েছে! আমি তাদের দেখে আরও বুঝেছি, ওরা চারজনই আমাদের দেখে ভয় পেয়েছে। ভেবেছে, আমরা জ্বীন জাতির কেউ। যদি আমরা তাদের সে ভয় দূর করে দিতাম এবং আমরা যে মেয়ে এ কথা তাদের সামনে প্রকাশ করে দিতাম, তবে ওরা আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতো, সারা জীবন যে কথা মনে রাখতে হতো। এমন নির্জন এলাকায় আমাদের মত যুবতী মেয়েকে কেউ তাদের বোন ও বেটি মনে করবে না। আমি তাদের শারীরিক অবস্থা দেখেছি, এমন সুঠাম শরীর কোন সাধারণ মানুষের হয় না। এমনকি সাধারণ যোদ্ধারাও তাদের মত এমন সুপুরুষ ও বীর হয় না। কমাণ্ডোদের বাহুতে যে অমিত তেজ ও বলিষ্ঠতা থাকে, সেই বলিষ্ঠতা আছে ওদের প্রত্যেকের মধ্যে। তাই আমি এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছি। এই মুসলমান কমাণ্ডোদের বুঝিয়েছি, আমরা কোরআনে বর্ণিত সেই জ্বীন, মানুষ বিপদে পড়লে যাদের আল্লাহ সাহায্যের জন্য পাঠায়।’

‘ভালই করেছে। মরুভূমির এই জাহান্নামে আমাদের মত রূপসী মেয়েরা আসতে পারে, এটা তাদের বিবেক বুদ্ধিতে আসার মত বিষয় নয়। প্রথমে তারা আমাদেরকে মরুভূমির কুহেলিকা ও ধাঁধা মনে করেছিল। পরে তোমার সাথে আলাপ করে তাদের মনে হয়েছে আমরা জ্বীন। আর এ বিশ্বাসকে তুমি ভালই কাজে লাগিয়েছে।’

‘মানুষের বিশ্বাস ও আবেগকে কাজে লাগানোর কৌশল জানতে হয়। তুই ছেমড়ি এখনো কিছুই শিখলি না। আমি তাদের সঙ্গে যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলেছি, তাতে তারা সন্দেহাতীতভাবেই বিশ্বাস করেছে, আমরা জ্বীন। কারণ আমি তাদের আবেগ অনুভূতি সম্পর্কে জানি। তোকে এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে।’

‘আর শিখেছি! আমার এসব ভাল লাগে না।’

‘বলিস কি! এটাই তো এ লাইনের বড় পুঁজি। আমি তো এখন সাইফুদ্দিনের মত চালাক লোককেও ইশারায় নাচাতে পারি। আর এগুলো তো গোবেচারা সাধারণ সিপাহী।’

‘আসলেও তোমার কাছ থেকে আমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। ছোট মেয়েটি বললো, কিন্তু আমার যে এসব ভাল লাগে না। মানুষের সাথে প্রতারণা ও ছল-চাতুরী করতে মন চায় না আমার।’

‘তবুও এ চেষ্টা তোকে করতেই হবে।’ বড় মেয়েটি বললো, ‘তোকে এ সব পুরুষের খেলনা হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে হবে। শোন, তুই এই রাস্তায় প্রথম নেমেছিস তো, তাই কায়দা কৌশল এখনো সব রপ্ত করতে পারিসনি। এভাবে পুতুল সেজে বসে থাকলে তুই ক্রুশের কোন কাজই করতে পারবি না। নিজের দেহটাকে অল্প বয়সেই বৃদ্ধা বানিয়ে নিলে পুরুষরা তোকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে বাইরে।’

‘তাহলে আমাকে কি করতে হবে?

‘শোন, মুসলমান আমীর ও শাসকদের শুধু আনন্দ দান করাই তো আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ওদের ভোগের সামগ্রী হয়ে থাকার জন্য আমরা এ পথে নামিনি। আমাদের কাজ ওদের বিবেক বুদ্ধির ওপর প্রভাব বিস্তার করা। ওদের দীল-দেমাগ থেকে ঈমানের আলো সরিয়ে দেয়া।’

‘কিন্তু এটা তো খুবই কঠিন কাজ?’

‘আরে, বোকা মেয়ে বলে কি? এটা তেমন কোন কঠিন কাজই না। তুই নিজের চোখেই তো দেখলি, আমি কৃত সহজে ও তাড়াতাড়ি তাদেরকে আমার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলাম।’

‘তুমি সত্যি যাদু জানো।’ বললো ছোট মেয়েটি।

‘না, এখানে যাদুর কিছু নেই, সামান্য ট্রেনিংয়ের ব্যাপার মাত্র। আমাদের খৃস্টান ও ইহুদী ওস্তাদরা শিখিয়ে পড়িয়ে আমাদের এভাবে তৈরি করেছে। আমি এই চার জনকে ঘায়েল করার জন্য সেই কথাই বলেছিলাম, যে কথা আমার ওস্তাদ শিখিয়ে ছিলেন। সে শিক্ষা হলো, মানুষ সর্বদা ভোগের লালসা করে। আমাদের কাজ হলো, মুসলমানদের মধ্যে এই মজা বা ভোগের লালসা বাড়িয়ে দেয়া। কারণ এই দুর্বলতা মানুষকে ধ্বংসের দিকে টেনে নামায়। তাই আমি ওদেরকে স্বপ্নের সুন্দর রাজ্য দেখিয়েছি।’

‘এই লালসা কি শুধু মুসলমানদেরই আছে, অন্য কারো নেই?’

‘এই লালসা মানুষ মাত্রই আছে। কিন্তু আমাদের কাজ মুসলমানদের দুর্বল করা আর নিজের জাতির লোকদেরকে জাতীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করা। কেন, তোমার কি সে রাতের কথা মনে নেই, সাইফুদ্দিন যখন আমাদের সামনে তার এক সেনাপতিকে বললেন, তিনি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে একটা আপোস রফা করতে চান। আমি এক রাতেই তার সে দুর্বলতা দূর করে দিয়েছিলাম। সে রাতেই আমি তার এ চিন্তা ও পরিকল্পনা বাতিল করিয়ে তাকে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংকল্প যুগিয়েছিলাম।’

‘আগে আছিয়াত পৌঁছতে দাও, তারপর তোমার এসব ওস্তাদী কৌশল আমাকেও শিখিয়ে দিও। ছোট মেয়েটা বললো, বুঝতে পারছি, এই কাজের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে লাভ নেই। আমি আসলেই মুসলমান আমীরদের খেলনার বস্তু হয়ে গেছি। তুমি তোমার সম্মান রক্ষা করে চলতে পারো, কিন্তু আমি পারি না। কখনও কখনও পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা হয়, কিন্তু কোন পথ খুঁজে পাই না। এমন কোন আশ্রয়ও খুঁজে পাই না, যেখানে পালিয়ে গিয়ে বাঁচতে পারবো।’

‘আরে মেয়ে, পালিয়ে গিয়ে বাঁচার দরকার হবে না। যে দিন সব কিছু শিখে যাবে, সে দিন দুনিয়া থাকবে তোমার হাতের মুঠোয়!’ বড় মেয়েটা বললো, ‘তোমাকে এই প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যই তো আমার সাথে পাঠানো হয়েছে। আমি তোমার মাঝে যেসব দুর্বলতা- লক্ষ্য করেছি, সে দুর্বলতা দু’দিনেই দূর হয়ে যাবে।’

আন নাসের মেয়েদের আগে আগে তার সাথীদের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে পথের নিশানা ঠিক, আছে কিনা জেনে নিচ্ছে মেয়েদের কাছ থেকে।

বড় মেয়েটি বললো, ‘পথ হারানোর কোন ভয় নেই তোমাদের। আমরা তো তোমাদের সাথেই আছি।’

‘পেছনে না থেকে তোমরাই সামনে চলো না কেন, তাতে আমাদের পথ হারাবার কোন ভয় থাকে না!’

মেয়েরা ঘোড়া সামনে নিয়ে গেল। কমান্ডোরা নিশ্চিন্ত মনে তাদের অনুসরণ করতে লাগলো। রাত আরও গভীর হলো। আইয়ুবীর চার জানবাজ কমাণ্ডো এক সাথে গান গাইতে গাইতে পথ চলছে। কোন রকম দুঃখ, শোক, কষ্টই যেন তাদের স্পর্শ করতে পারছে না। পায়ের নিচের বালি, মাটি ও পাথর তাদের কাছে মনে হচ্ছিল পুষ্পিত উদ্যানের সবুজ সতেজ ঘাসের মখমল।

ছোট মেয়েটি বললো, ‘এদেরকে আছিয়াত নিয়ে গিয়ে কি করবে?’

‘আমাদের ওস্তাদ শেখ মান্নানের কাছে এর চেয়ে বড় উপহার আর কিছু নেই।’ বড় মেয়েটি উত্তর দিল, ‘এরা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা! তুমি জানো না, উস্তাদের কাছে এদের মূল্য কত! আমাকে বিশেষভাবে তিনি জানিয়েছেন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর একটা গোয়েন্দা ধরা এক হাজার সৈন্য হত্যার চেয়েও বেশী। কারণ এক হাজার সৈন্য হত্যা করলে নতুন সৈন্য ভর্তি করে তিনি সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু একজন গোয়েন্দা উস্তাদের হাতে পড়লে তিনি এমনভাবে মগজ ধোলাই করে তাকে ফেরত পাঠাবেন, যখন সে আর আইয়ুবীর সৈন্য থাকবে না, সে হয়ে যাবে আমাদের। অথচ আইয়ুবীর বাহিনীতে তারা অবাধে বিচরণ করতে পারবে। তাদের যে কোন গোপন খবর আমাদের সরবরাহ করতে পারবে। আমাদের হয়ে আইয়ুবীকে বা তার যে কোন জেনারেলকে গুপ্ত হত্যা করতে পারবে। আরো যে কত কিছু তাদেরকে দিয়ে করানো সম্ভব তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’

‘সে জন্য গোয়েন্দা ধরার দরকার কি, যে কোন সৈন্য ধরলেই তো হয়!’

‘না, সৈন্যদের নির্দিষ্ট ব্যারাক আছে। চলাচলের নির্দিষ্ট জায়গা আছে। যখন যেখানে খুশী তারা যেতে পারে না। কিন্তু গোয়েন্দাদের কাজই হলো সংবাদ সংগ্রহ ও তা আইয়ুবীর কাছে পৌঁছে দেয়া। এ জন্য তারা যত্রতত্র অবাধে বিচরণ করতে পারে। তা ছাড়া গোয়েন্দাদের আছে কমাণ্ডো প্রশিক্ষণ। সুলতান আইয়ুবী তার গোয়েন্দাদের এমন কমান্ডো প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছে, যে ট্রেনিং সেনাবাহিনীর অফিসাররাও পায় না। শক্তিতে, বীরত্বে, ক্ষীপ্রতায় তারা হয় অসাধারণ। আর মানসিক দিক দিয়ে এরা আপন কর্তব্য পালনে হয় পাগলপারা ও জানকবুল!’

‘তাই তো বলি, এই চার জন সৈনিক রাতের এমন দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালানোর পর, যুদ্ধের ক্লান্তি ও অবসাদ নিয়ে মরুভূমির কঠিন বিপদে কিভাবে এত সময় বেঁচে রইলো? কোন মানুষের পক্ষে এমন বিপদ ও ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করে বেঁচে থাকা যে আদৌ সম্ভব, এদের না দেখলে তা বিশ্বাসই, করতাম না।’

‘আমি হলপ করে বলতে পারি, আমাদের সৈন্যদের মাঝে এমন মনোবলের অধিকারী একটা সৈন্যও নেই। এই চারজনকে আমি শেখ মান্নানের হাতে তুলে দেবো। তিনি ও তার লোকেরা এদেরকে সহজেই নিজেদের মত দক্ষ বানিয়ে নিতে পারবে। তাদের এই অপরিমেয় শক্তি ও কৌশল নিজেদের কাজে লাগাতে পারবে। তোমার হয়তো জানা নাও থাকতে পারে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্য আমাদের গুপ্ত সেনারা অনেকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু একবারও সফল হতে পারেনি। এই চারজনকে হাশিশ ও নেশায় ডুবিয়ে দিয়ে তারপর ওদের ওপর প্রয়োগ করতে হবে সম্মোহনী বিদ্যা। তখন এরাই সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্য পাগল হয়ে যাবে। আমাদের সৈন্যরা সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছতে অনেক বাঁধাবিঘ্নের সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু এদের সে সমস্যা হবে না, কারণ এরাতো তারই কমান্ডো সেনা।’

‘কেন! সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ওপর অন্য কোন উপায়ে আক্রমণ করা যায় না, যেমন সাইফুদ্দিন, গুমাস্তগীনের ওপর গ্রহণ করা হয়েছে।’ ছোট মেয়েটি বললো।

‘না!’ বড়ো মেয়েটি বললো, ‘যে মানুষ লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়, তার সামনে সোনা-দানা, হীরে-জহরত, মণি-মাণিক্য, আমাদের মত সুন্দরী নারী সবই মূল্যহীন। ভয় বা লোভ কিছু দিয়েই তাকে সত্য পথ থেকে সরানো যায় না। তাদের কাছে একমাত্র মহামূল্যবান বস্তু হচ্ছে ঈমান। এই ঈমানী সম্পদের কোন কমতি নেই আইয়ুবীর। ফলে তাকে সম্পদ বা ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে দখল করা যাবে না।’

‘তোমার মত মেয়ে দিয়েও কি তাকে জয় করা সম্ভব নয়?’

‘না, তাদের ধর্মীয় বিধান মতে সে এক সাথে চার বিবি রাখতে পারে। কিন্তু আইয়ুবী এক বিবিতেই সন্তুষ্ট। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অন্য কোন নারীর কথা হয়তো সে চিন্তাও করে না। তার মন ভেজানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু এই পাথরকে কিছুতেই গলানো যায়নি।

ফিলিস্তিনের ওপর আমাদের আধিপত্য চিরস্থায়ী করার পথ একটাই, সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করা।’

‘এমন ব্যক্তিই তো ভাল যে এক স্ত্রীর বাধ্য থাকে। ছোট মেয়েটা বললো, আমি ক্রুশের পূজারী এবং ক্রুশের কল্যাণ কামনা করি। কিন্তু মাঝে মাঝে চিন্তা করি, যদি আমি কোন এক ব্যক্তির হৃদয়ের রাণী হতে পারতাম, তবে এই দেহ মন তার হাতে সঁপে দিয়ে ধন্য মনে করতাম নিজেকে।’

‘এমন ভাবালুতা ভাল নয়, এসব ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ত্যাগ করো!’ বড় মেয়েটা তাকে সাবধান করে বললো, ‘তোমার সামনে সেই মহান উদ্দেশ্য রাখো, যাতে ক্রুশের বিজয় হয়। তোমার শপথের কথা চিন্তা করো, যে শপথ তুমি ক্রুশকে হাতে নিয়ে করেছিলে। আমি জানি তুমি পূর্ণ যৌবনা, যোড়শী। এ বয়সে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কিন্তু ক্রুশ আমাদের কাছে এই কোরবানী ও ত্যাগই চাচ্ছে।’

‘কাফেলা চলছে তো চলছেই। বিজন প্রান্তর ধরে নিশুতি রাতে এগিয়ে যাচ্ছে ছয় জনের এ ছোট্ট কাফেলা। আন নাসের ও তার সাথীরা তখনো মেয়েদের ঘোড়ার পিছনে পিছনে পথ চলছে। তারা হাঁটছে আর সুর করে গান গাইছে। কখনো অকারণে হেসে উঠছে। একজন হাসলে সে হাসি ছড়িয়ে পড়ছে অন্যদের মুখেও! তাদের সে হাসি ও আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিল, কোন কষ্টকর সফর নয়, তারা বেরিয়েছে প্রমোদ ভ্রমণে। রাতক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিল ভোরের দিকে। যতই রাত বাড়ছিল, তাদের ঠিকানাও ততই নিকটবর্তী হচ্ছিল।

এই মেয়ে দুটি কে, কি তাদের পরিচয়? এরা সেই জাতির মেয়ে, যাদের কাহিনী ও ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে কোরআনে। এরা সেই ইহুদী ও খৃস্টান কন্যা, মুসলমানদের ঈমান ক্রয়ের জন্য যাদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল।

ইহুদী ও খৃস্টানরা মুসলমানদের সাথে অসংখ্য সমুখ সমরে পরাজিত হয়ে বেছে নিয়েছিল এই পথ। তারা তাদের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের এই কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। এ জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিল ট্রেনিং স্কুল। সেই সব স্কুল থেকে এই সব মেয়েদের শিখিয়ে দেয়া হতো, কিভাবে মুসলমানদের ঘায়েল করতে হবে। তাদেরকে সেখানে শারীরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো, মানসিক প্রশিক্ষণও দেয়া হতো। ওস্তাদ শিক্ষকরা তাদের শিখাতো দুস্কৃতির নানা কৌশল ও কায়দা কানুন। ওদের বলা হতো, মুসলমানদের শত্রু নয়, তোমরা ওদের সাথে মিশবে বন্ধু বেশে। এমন ভাবে মিশবে, যেন তোমরাই হয়ে ওঠো ওদের ধ্যান-জ্ঞান, স্বপ্ন ও কল্পনা। তোমরা হবে ওদের মনের মানসী। তাদেরকে ডুবিয়ে দেবে ভোগের রাজ্যে। আনন্দফুর্তির দুনিয়ায় ওদের এমন ভাবে আটকে রাখবে, যেন জেহাদ ও যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে দূরে থাকার জন্য ওরা হাজারটা বাহানা খুঁজে বের করতে পারে।

এই ওস্তাদরা ওদের শিখাতো মুসলমানদেরকে নিজ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার কৌশল। শিশুকাল থেকেই শুরু হয়ে যেতো, মেয়েদের এই শিক্ষা। মুসলমানরা যে ওদের জাত শত্র, তাদেরকে যে ঘৃণা করতে হবে, শত্রু ভাবতে হবে এটা যেমন তাদের শিখাতো তেমনি শিখাতো সেই শত্রুতা সাধনের জন্য ওদের বন্ধু হতে। তারপর সেই বন্ধু বেশে কিভাবে মুসলমানদের চিন্তা চেতনায় প্রভাব বিস্তার করা যায়, কিভাবে তাদের পরিণত করা যায় খৃস্টান ও ইহুদীদের মানসিক গোলামে, সব কিছুই শিখিয়ে দেয়া হতো ওদের।

এই মেয়েদের শেখানো হতো দুষ্টুমী ও নির্লজ্জতা। শেখানো হতো নিজেদের লোভনীয় করে উপস্থাপন করার নানা কৌশল। এদের ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতি বলে কিছু ছিল না, ক্রুশের জন্য ওরা সব করতে পারতো।

এই কাজে বেশী আগ্রহী ছিল ইহুদীরা। মুসলমানদেরকে ওরা মনে করতো সবচে বড় শত্রু। তাই তাদের সুন্দরী মেয়েদেরকে পাঠিয়ে দিত এইসব প্রশিক্ষণ স্কুলে।

অবশ্য এ কাজে খৃস্টানরাও পিছিয়ে ছিল না। তারাও তাদের মেয়েদেরকে এই কাজে ব্যবহারের জন্য অকাতরে সঁপে দিত। এ ছাড়াও তারা এ কাজে ব্যবহার করতে আরো কিছু মেয়ে, যারা ছিল মুসলমান। এসব মুসলিম মেয়ে ওরা সংগ্রহ করতো অধিকৃত মুসলিম এলাকা থেকে। কখনো চুরি বা হাইজ্যাক করে, কখনো কাফেলা আক্রমণের পর লুণ্ঠন চালিয়ে তাদেরকে সংগ্রহ করতো। তারপর তাদেরকে ভুলিয়ে দিত তাদের জাতি পরিচয়। শিশুরা তো এমনিতেই ভুলে যেতো, কিন্তু যারা একটু বড় তাদেরকে ভুলানোর জন্য ব্যবহার করতো, হাশিশ বা নেশাদ্রব্য এবং ড্রাগ। এভাবেই এসব মুসলিম মেয়েকেও ওরা ব্যবহার করতো মুসলমানদের বিরুদ্ধে।

এই দুই মেয়েকে কিছুদিন আগে খৃস্টানরা মুশেলের আমীর সাইফুদ্দিনকে উপহার স্বরূপ পাঠিয়েছিল। সাইফুদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর ঘোর বিরোধী এ কথা সবারই জানা। এই মেয়েদেরকে পাঠানোর উদ্দেশ্যে হলো, প্রথমতঃ তারা গোয়েন্দাগিরী করবে, দ্বিতীয়তঃ সাইফুদ্দিন যেন কখনো ভুলেও সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে আপোষের চিন্তা না করে সেদিকে নজর রাখবে, তৃতীয়তঃ সম্মিলিত ঐকফ্রন্টের এক আমীর যেন অন্য আমীরকে বিশ্বাস না করে সে জন্য তাদেরকে পরস্পর বিরোধী বানিয়ে রাখবে। কিন্তু এই বিরোধ যেন শত্রুতায় পর্যবসিত না হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখবে।

এই কাজ যে কেবল এ দুই মেয়েই শুধু করছিল, তা নয়। মুসলমান প্রত্যেক আমীরের হেরেমেই খৃস্টানদের পাঠানো চর এভাবে নিয়োজিত ছিল।

খৃস্টানরা মুসলমানদের কয়েকজন নেতাকেও খরিদ করে নিয়েছিল এবং তাদের ঈমান-আকিদা নষ্ট করে তাদেরকে মুসলমানদের বিপক্ষেই কাজে লাগাচ্ছিল।

সাইফুদ্দিন সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবে যখন তুর্কমান সমরাঙ্গণে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়তে যায়, তখন তৎকালীন নিয়ম অনুসারে তার মহলের সেরা সুন্দরীদের সঙ্গে নেয় নাচগান ও স্ফূর্তির জন্য। এই দুই খৃস্টান মেয়েও সঙ্গে ছিল তার এ অভিযানে।

সাইফুদ্দিন জানতো, এরা মুসলমান ও অভিজাত ঘরের মেয়ে। যুদ্ধে তাদের কাফেলা লুট হয় এবং তারা ধরা পড়ে খৃস্টানদের হাতে। পরে খৃস্টানরা তাদেরকে উপহার হিসাবে পাঠিয়ে দেয় সাইফুদ্দিনের কাছে। এরা খুব সরল সহজ ও ভদ্র মেয়ে, যদিও বড় মেয়েটা যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও কর্তৃত্বশীলা। এদিকে বড় মেয়েটার অবস্থা ছিল, সে সাইফুদ্দিনের পিছনে সব সময় ছায়ার মত লেগে থাকতো। মহলের সকল মেয়েদেরকে সে দাসী-বাদী বানিয়ে রেখেছিল। সাইফুদ্দিন তাকে নিজের কল্যাণকামী মনে করতো এবং এ জন্য মহলে তার এ আধিপত্য বিস্তারে তার কোন রকম দুশ্চিন্তা বা মাথাব্যথা ছিল না।

সাইফুদ্দিনের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, নইলে এমন ঝড় তুফানে সে পড়বে কেন, যে ঝড়ের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই যে ঝড় তার বাহিনীকে তছনছ করে দিয়েছিল।

এই ঝড়ের মধ্যেই ফৌজি নামের এক মেয়ে ঘোড়ার পিঠে করে নিজের ভাইয়ের লাশ নিয়ে হাজির হয়েছিল সুলতান আইয়ুবীর ক্যাম্পে। সম্মিলিত বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রবল আক্রমণ আসছে, এ খবর সে-ই সুলতানকে জানিয়েছিল। তার এ ছোট্ট একটা খবরই বলতে গেলে তুর্কমানের যুদ্ধে সুলতান আইয়ুবীর বিজয়ের জামিন হয়েছিল।

সুলতান আইয়ুবী ফৌজির কাছ থেকে খবর পাওয়ার পর আর কালবিলম্ব করেননি। তিনি দ্রুত প্রস্তুত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন যেখানে দুশমন অপেক্ষা করছে সেখানে। ফৌজির খবরের কারণেই দুশমন হামলা করার আগেই তিনি তাদের ওপর চড়াও হতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সাইফুদ্দিন এ অতর্কিত হামলার জন্য প্রস্তত ছিল না। এ জন্যই সাইফুদ্দিনের বাহিনী সহজে ধরাশায়ী হয়। অতর্কিত হামলার ফলে অনেক সৈনিক বলতে গেলে নিজের অজ্ঞাতেই মারা পড়ে ও বন্দী হয়ে যায়। ফলে যুদ্ধটা একতরফা ভাবেই শেষ হয়।

যুদ্ধের ময়দান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নিয়ন্ত্রণে। খৃস্টান এই দুই মেয়ে দেখলো, সাইফুদ্দিন ও তার সম্মিলিত বাহিনী চরম মার খাচ্ছে আইয়ুবীর বাহিনীর হাতে। যুদ্ধের যা গতি তাতে সম্মিলিত বাহিনীর পরাজয় অনিবার্য। এ অবস্থা দেখে তারা প্রমাদ গুণলো এবং সমরাঙ্গণ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে লাগলো।

এরা নিঃসঙ্গ ছিল না। খৃস্টানদের তাবেদার কিছু মুসলমান এজেন্ট সাইফুদ্দিনের উচ্চ পদে নিয়োজিত ছিল। এই মেয়েরা সব সময় তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতো। মেয়েরা তাদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতো এবং সেই তথ্য খৃস্টানদের কাছে পৌঁছে দিত।

খৃস্টানদের এ এজেন্টরা যখন দেখলো, যুদ্ধের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, সম্মিলিত বাহিনীর সামনে পিছু হটা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই, তখন তারা এই দুই মেয়েকে সেখান থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কারণ তারা জানতো, খৃস্টানদের কাছে এই মেয়ে দু’টির কদর ও মূল্য কত।

সাইফুদ্দিন যুদ্ধের ময়দানে ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। মহলের মেয়েরা তাঁবুর ভেতর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। এই দুই খৃস্টান মেয়ে তাঁবুর বাইরে এলো। সেখানে দাঁড়িয়ে ওরা ময়দানের অবস্থা দেখছিল, এ সময় সেখানে দেখা দিল এক এজেন্ট। বললো, ‘ময়দানের অবস্থা ভালো নয়। তোমাদের সরে পড়া উচিত এখান থেকে।’

‘আমরাও সে কথাই ভাবছিলাম। এখনো বেরোবার মত পরিবেশ আছে, জলদি বেরিয়ে যাওয়ার একটা বিহীত ব্যবস্থা করো।’

মেয়েরা তাঁবুর ভেতর গেল। গুছিয়ে নিল নিজেদের অপরিহার্য সামগ্রী। তারপর তাঁবু থেকে বেরিয়ে একটু দূরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলো সেই এজেন্টের।

একটু পর ফিরে এলো এজেন্ট। সে তাদের দুজনের জন্য নিয়ে এসেছে দুটো ঘোড়া। ঘোড়ার জ্বীনের সাথে পানির চারটি মশক ও দুই তিন ব্যাগ খাবার বেঁধে দিয়ে বললো, ‘আর কিছু লাগবে?’

‘না, শুধু এই ব্যাগটা বেঁধে দাও।’

‘এতে কি আছে?’

‘তেমন কিছু নয়। আমাদের সামান্য কাপড় চোপড়, অতিরিক্ত দুটো খঞ্জর ও কিছু হাশিশ।

এ থলিটিও বেঁধে দেয়া হলো ঘোড়ার জিনের সাথে। থলিতে আরও এক ধরনের নেশার দ্রব্য ছিল, যার কোন স্বাদ গন্ধ কিছু নেই। কাউকে ধোকা দিয়ে পান করালে সে বুঝতে পারবে না, তাকে পানি দেয়া হয়েছে নাকি তাতে কিছু মিশানো আছে। কিন্তু এর কথা মেয়ে দুটি এজেন্টকে বললো না।

এই দু’টি নেশার জিনিস তারা সাথে নিয়েছে, যদি কোন পুরুষের হাতে ধরা পড়ে, তবে তাদেরকে এসব পান করিয়ে যেন নিজেদের রক্ষা করতে পারে।

রাতের আঁধারে যুদ্ধের ময়দানে যখন রক্তাক্ত যুদ্ধ চলছে, তখন সেই এজেন্ট মেয়ে দুটিকে ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে তুর্কমান রণাঙ্গণ থেকে বহু দূরে নিয়ে এলো। তারপর তাদের খুব ভাল করে বুঝিয়ে বললো, কোন পথে তারা দ্রুত আছিয়াত ফিরে যেতে পারবে। মেয়েদেরকে আছিয়াত দুর্গের পথ দেখিয়ে সে সেখান থেকে ফিরে এলো।

রাতের আঁধারে দুই মেয়ে রওনা করলো আছিয়াত দুর্গে। বড় মেয়েটি বুদ্ধিমতী, কৌশলী ও বীরঙ্গণা। সে ছোট মেয়েটাকে সাহস দিয়ে বললো, ‘ভয়ের কিছু নেই। আমি আছিয়াতের পথ চিনি।’

সকাল হওয়ার আগেই তারা সবুজ শ্যামল এলাকা পেরিয়ে কঠিন শীলাময় অঞ্চলে প্রবেশ করলো। তারপর তারা ঢুকলো সেই এলাকায়, যে অঞ্চলকে পৃথিবীর জাহান্নাম বলা হয়। এলাকাটি ছিল কঠিন শিলাময় ও শুষ্ক মরুভূমি। এ ভয়ংকর মরু অঞ্চল পার হওয়ার জন্য তারা দ্রুত ঘোড়া ছুটালো। কিন্তু একটু পরই সূর্যের উত্তাপ অসহনীয় হয়ে উঠলো এবং বাতাস ক্রমে তন্দুরের মত গরম হতে লাগলো। সূর্য যখন মাথার ওপর এলো, তখন তারা একটি উপত্যকা দেখতে পেল। এ উপত্যকায় পাহাড়ের ঢালে আশ্রয় নেয়ার জন্য তারা আরো দ্রুত ঘোড়া ছুটালো এবং এক সময় সেখানে গিয়ে পৌঁছলো।

এখানে ভিতরের দিকে আশ্রয়ের মত প্রশস্ত জায়গা ছিল। তারা সেই ছায়াঘন পাহাড়ের ঢালে আশ্রয়ের জন্য থেমে গেল।

ওখানে তারা আহার ও পানি পান করে বিশ্রাম করছে, এ সময় তাদের নজরে পড়লো আন নাসের ও তার সাথীরা।

এদের দেখেই বড় মেয়েটি বুঝতে পারলো, এরা ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।

তার প্রশিক্ষণ অনুযায়ী সে সফল অভিনয় শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত তার অভিনয় সফল প্রমাণিত হলো এবং আন নাসের ও তার সাথীরা তাদেরকে জ্বীন ভেবে ভীত হয়ে পড়লো।

মেয়েটা প্রথমে তাদেরকে হাতিয়ার ত্যাগে বাধ্য করলো এবং তারপর তাদেরকে পানি পান করতে দিলো। পানি পান ও আহার করানোর পর সে ওদেরকে ফেদাইন গুপ্তঘাতকদের আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের নেশার দ্রব্য পান করালো পানির সাথে মিশিয়ে।

তাদেরকে নেশায় মাতাল করার পর মেয়েরা এবার তাদের সম্মোহন করলো। তাদের চোখের সামনে মেলে ধরলো ফুল বাগান, সবুজ মাঠ, পাখির কিচির মিচির শব্দ আর গালিচার মত নরম ঘাসের বিছানা। তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে নতুন এক স্বপ্ন-জগত, যে জগতের দৃশ্য তাদের মনে জান্নাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিল।

এটা ছিল হাসান বিন সাব্বাহর এক বিশেষ আবিষ্কার। লোকদের হাশিশ ও নেশাদ্রব্য পান করিয়ে তাদের মনে সুন্দর ও মধুর দৃশ্য সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে সে সবিশেষ সাফল্য লাভ করেছিল। তার মৃত্যুর পরও ফেদাইনরা এই নেশার দ্রব্যের ব্যবহার অব্যাহত রাখে।

তার মৃত্যুর একশ বছর পর শেখ মান্নান তার পদে অধিষ্ঠিত হয়। এই দল এখনো ফেদাইন দল বলে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত।

বড় মেয়েটা ফেদাইনদের কাছে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ লাভ করেছিল। কি করে মানুষকে হিপটোনাইজ করতে হয় ভাল মতই জানতো সে। লোকেরা নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন হলে তাদের মনে কাল্পনিক ছবি তুলে ধরতে হয়। তখন সে সেই কাল্পনিক ছবিই চোখের সামনে বাস্তবে দেখতে পায়। আন নাসের ও তার সঙ্গীদেরকে হিপটোনিজম করে বশে আনার পর নিশ্চিন্ত মনে পথ চলছে মেয়েরা। কারণ তারা জানে, এদেরকে এখন তারা যেভাবে খুশি সেভাবে চালাতে পারবে।

ছোট মেয়েটি সঙ্গীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, এরা তো আমাদের জ্বীন বলে ধরেই নিয়েছিল। তাহলে শুধু শুধু এদেরকে হাশিশ পান করালে কেন?’

তাদেরকে হাশিশ ও নেশা পান করানোর মূল উদ্দেশ্য হলো তাদেরকে সম্পূর্ণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। পুরুষ সজ্ঞানে থাকলে কখন তাদের মতিগতি কি হয় বলা মুশকিল। কোনভাবে ওরা যদি বুঝতে পারে আমরা জ্বীন নই, তাদেরই মত মানুষ তাহলে আমাদের ভোগ করার চিন্তা আসতে পারে তাদের মাথায়। আর ওরা আমাদের দিকে হাত বাড়ালে তাদের বাঁধা দেবো এমন শক্তি আমাদের নেই। তাই কোন রকম ঝুকি নেয়া সঙ্গত মনে করিনি আমি।

তাছাড়া যখন জানতে পারলাম, ওরা সুলতান আইয়ুবীর কমাণ্ডো বাহিনীর লোক, যাদের কৃতিত্বের কথা লোক মুখে বহুল প্রচারিত, তখন মনে একটু ভয়ও ঢুকে গেল। চিন্তা করে দেখলাম, এমন দুর্ধর্ষ সৈনিকদের প্রথমেই ঘায়েল না করলে তাদের বশে আনার সুযোগ আর নাও পেতে পারি। আমি তো জানি, শেখ মান্নানের কাছে ওরা কত মূল্যবান। এমন মূল্যবান সম্পদের দখলটা একটু নিশ্চিত করলাম ওদের নেশাগ্রস্থ করে।

শেখ মান্নান এদের দিয়ে বড় ধরনের ফায়দা লুটতে পারবেন। তিনি বারবার সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেও সফল হতে পারেননি, তার সে স্বপ্ন সফল করার একটা মোক্ষম সুযোগ এসেছে আমার হাতে, ওদেরকে নেশাগ্রস্ত না করে সেই সুযোগকে কাজে লাগানোর উপায় ছিল না আমার।’

ওরা যখন মরুভূমিতে পথ চলতে চলতে এসব আলাপ করছিল, আছিয়াত কেল্লায় তখন হারানের শাসক গুমাস্তগীন শেখ মান্নানকে বলছিল, ‘আরও একবার চেষ্টা করে দেখো, আইয়ুবীকে হত্যা করার কোন না কোন পথ তুমি পেয়েই যাবে।’

❀ ❀ ❀