» » সর্প কেল্লার খুনী

বর্ণাকার

সর্প কেল্লার খুনী

দামেশকে সুলতান আইয়ুবী বীর বেশে প্রবেশ করলেন, সঙ্গে মাত্র সাতশ অশ্বারোহী। কি করে এই স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে এমন বিপুল বিজয় সাধন করলেন তিনি, সে এক বিষ্ময়ের ব্যাপার। এ ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে ছিল সুলতান আইয়ুবীর জান-কবুল অগ্রগামী সৈন্যদের অবিস্মরণীয় ভূমিকা। এ জান-কবুল অগ্রগামী বাহিনী ছিল সেসব গোয়েন্দাদের, যাদের কেউ কেউ বণিকের বেশে, কেউ নিরিহ পথচারী সেজে, কখনো একাকী, কখনো দু’জন, কখনো তিন বা চার জনের ছোট ছোট দলে দামেশকে প্রবেশ করেছিল। দামেশকের সাধারণ মানুষের সাথে একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল তারা। কুলি-মজুর থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, পথচারী, এমনকি ছাউনিতেও ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছিল এসব গোয়েন্দারা। পরিবেশ পরিস্থিতিকে সুলতান আইয়ুবীর অনুকূলে আনার জন্য জনমতকে প্রভাবিত করা এবং সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য সুলতানের পক্ষে আছে তাদেরকে সংগঠিত করাই ছিল তাদের মূল কাজ।

এভাবে সুলতানের আগমনের পূর্বেই দামেশকের পরিস্থিতি তারা সুলতানের স্বপক্ষে নিয়ে আসে। সুলতান আইয়ুবী দামেশকের ফটকে পৌঁছলে সুলতানের জন্য দামেশকের দরজা খুলে দেয়ার যে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয় জনগণের পক্ষ থেকে, মূলত তারাই সে চাপের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। এসব গোয়েন্দাদের প্রায় সবাই ছিল চৌকস ও বুদ্ধিদীপ্ত। আলী বিন সুফিয়ান গোয়েন্দাগিরিতে ঝানু এবং যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শীদের বাছাই করে এ অভিযানে পাঠিয়েছিলেন। যে কোন ধরনের পরিস্থিতে ঠান্ডা মাথায় কাজ করার জন্য
পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পেয়েছিল এরা সুলতানের কাছ থেকে।

প্রতিটি গোয়েন্দাই ছিল সব ধরনের অস্ত্র ব্যাবহারে অভ্যস্ত এবং সব রকমের বিপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পটু। তারা কেবল বুদ্ধিদীপ্ত এবং বিচক্ষণই ছিল না, তারা দুঃসাহসী এবং বেপরোয়াও ছিল। আল্লাহর কাছে জীবন বিলিয়ে দেয়ার উদগ্র কামনা ছিল সবার অন্তরে। শাহাদাত লাভের জন্য তাদের প্রতিটি অন্তর ছিল উদগ্রীব।

তাই তারা অবলীলায় এমন সব ঝুঁকি গ্রহণ করতে পারতো, যা সাধারণভাবে কেউ চিন্তা করতেও ভয় পেতো। এ আবেগ শুধু সামরিক ট্রেনিং দিয়ে সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন হতো নৈতিক প্রশিক্ষণ।

আলী তার বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে এমনভাবে তৈরি করতেন, যাতে তাদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস জন্মে, দ্বীনের প্রতি সৃষ্টি হয় অপরিসীম ভালবাসা ও মহব্বত। হৃদয় ভরপুর থাকে শাহাদাতের তামান্নায়।

ইসলামের জন্য নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে শরীক হতে হতো তাদের। এ চেতনার কারনেই এসব অভিযানে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়তো জেহাদের আবেগময় জযবা নিয়ে। এমনি একদল নিবেদিতপ্রাণ যুবকদের নিয়েই সুলতান আইয়ুবী তার কমান্ডো বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনী নিয়ে দামেশক যাত্রা করার আগেই বাছাই করা এ কমান্ডো ও গোয়েন্দাদের দামেশক যাত্রা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওরা রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলে তাদের সামনে এক আবেগময় ভাষণ দিলেন তিনি।

ভাষণের শেষ প্রান্তে এসে তিনি বললেন, ‘যদি দামেশকের সেনাবাহিনী মোকাবেলার জন্য ময়দানে নেমে আসে, তাহলে তোমাদের প্রতি আমার নির্দেশ রইল, শহরের মধ্যে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দেবে। উত্তেজিত জনগণকে নিয়ে ছুটে আসবে ফটক প্রাঙ্গণে। ভেতর থেকে গেট খুলে দিতে চেষ্টা করবে শহরের।’

জনমতকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে এদের কোন জুড়ি ছিল না। সুলতানের পক্ষের লোকদের সংগঠিত করে সুবিশাল জঙ্গী মিছিলের মাধ্যমে খলিফার অনুগত লোকদের মনে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করে, সুলতান ফটকে
পৌঁছার আগেই সুলতানের এসব জানবাজ কমান্ডো ও গোয়েন্দারা শহরের অবস্থান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

এক ফরাসি কথাশিল্পী তার কাহিনীতে এ যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধবাজ কমান্ডোরা স্বাভাবিক মানুষ ছিল বলে মনে হয় না। ইসলামের ধর্মীয় আবেগ তাদের উন্মাদ বানিয়ে ফেলেছিল! নইলে জেনেশুনে এভাবে হাসতে হাসতে মরণ সাগরে ঝাঁপ দিতে পারতো না ওরা। জেহাদী জযবা এক ধরণের মানসিক রোগ। পতঙ্গ যেমন আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ছুটে যায়, এ রোগে ধরলে মানুষও তেমনি ছুটে যায় মরণ সাগরে ঝাঁপ দিতে।

তাঁর হয়তো জানা নেই, এ জেহাদী জযবাই একজন মানুষকে মুজাহিদে রূপান্তরিত করে। এ আবেগের সাথে পরিচয় নেই বলেই ফরাসি লেখক তাকে ‘ধর্মীয় উন্মাদনা’ ও ‘মানসিক রোগ’ বলে খাটো করে দেখছেন। কিন্তু তিনি জানেন না, মুসলমানদের কাছে এ আবেগ বা জযবার মূল্য কত! এর স্বাদ কত মধুর ও তৃপ্তিদায়ক! প্রকৃত মুসলমানের জীবন তো ধন্য হয় এই আবেগ ও জযবাকে সম্বল করেই!

এ জানবাজ গোয়েন্দাদেরই নেতা আলী বিন সুফিয়ান। তার দুই সহকর্মী হাসান বিন আব্দুল্লাহ ও জায়েদানকে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজ হাতে। যুদ্ধ কৌশলে তারা এতটাই পারদর্শী ও দক্ষ হয়ে উঠে যে, এখন সেনানায়করাও তাদের কাছে শিখতে পারবে। আলী তাদেরকেই পাঠিয়েছিলেন দামেশকে।

সুলতান আইয়ুবী দামেশক রওনা হবার আগে বললেন, ‘আলী, কায়রোর আভ্যন্তরীণ অবস্থা ভাল না। এ অবস্থায় কায়রোকে অরক্ষিত রেখে অভিজানে বের হওয়া আমার সাজে না। কিন্তু ওস্তাদ জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর আহাজারী এবং মিল্লাতের দুর্দিন ডাকছে আমাকে। আমি চাই, আমি যে কয়দিন কায়রোতে অনুপস্থিত থাকবো, তুমি থাকবে কায়রোতে। খ্রিস্টান ক্রীড়নকদের হাত থেকে দামেশকে মুক্ত করে আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এর হেফাজতের জিম্মা থাকবে তোমার ওপর। মিশরে খ্রিস্টান সন্ত্রাসীদের তৎপরতা আশংকাজনক হারে বেরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সে কারণে তোমাকে খুবই হুশিয়ার থাকতে হবে।

এ কারণেই সুলতানের সাথে অভিযানে আসতে পারেন নি আলী। পরিবর্তে সুলতানকে সামগ্রিক সহায়তাদানের জন্য হাসান বিন আবদুল্লাহকে আগেই দামেশকের পথে পাঠিয়ে দিলেন। দামেশকের সুলতানের জানবাজ গেরিলা ও গোয়েন্দাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলো এই হাসান বিন আবদুল্লাহ।

খ্রিস্টানদের তল্পীবাহক কতিপয় স্বার্থপর আমীর ষড়যন্ত্র করে জঙ্গীর নাবালক সন্তান আল মালেকুস সালেহকে খলিফা ঘোষণা করলে মুসলিম মিল্লাতের স্বার্থে জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী সুলতান আইয়ুবীকে দামেশক অভিযানের আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। এ আবেদনে সাড়া দিয়ে সুলতান যখন দামেশক এসে পৌঁছলেন তখন সেখানকার বেশীর ভাগ সৈন্যই কমান্ডার তাওফীক জাওয়াদের সেনা কমান্ডে ছিল। খলিফার দেহরক্ষী রেজিমেন্ট, পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী অবশ্য তার নেতৃত্বে ছিল না। এরা ছাড়া মূল সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সৈন্যই সেনাপতি জাওয়াদের নেতৃত্বে সুলতান আইয়ুবীর আনুগত্য কবুল করে নিলে সুলতান এসব সৈন্যদেরকে তার নিজ বাহিনীর সাথে একীভূত করে নিলেন।

দামেশকে আইয়ুবীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে তথাকথিত খলিফা এবং তার মন্ত্রণাদাতা ওমরারা দামেশক ছেড়ে পালিয়ে গেল। তাদের সাথে গেল তাদের প্রতি অনুগত সৈন্য ও খলিফার দেহরক্ষী বাহিনী।

তাদের ভয় এবং আশংকা ছিল, সুলতানের আইয়ুবীর সৈন্যরা তাদের পিছু ধাওয়া করবে। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তা করলেন না। সেনাপতিদের কেউ কেউ পালিয়ে যাওয়া খলিফা ও আমীরদের পিছু ধাওয়া করার অনুমতি চাইলে তিনি তাদের বারণ করলেন।

তারা আশংকা প্রকাশ করে বললো, ‘কিন্তু ওরা আবার ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে বাইরের সাহায্য নিয়ে অভিযান চালাতে পারে!’

আরেকজন বললো, ‘খ্রিস্টানরা তো ওদের সাহায্য করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে!’

সুলতান আইয়ুবী ওদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি কখনও অন্ধকারে পথ চলি না। আপনারা অস্থির হবেন না। ওরা কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং কারা কারা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে আমি তা দেখতে চাই। আমার চোখ ও কান ওদের সাথেই সারাক্ষণ ঘোরাফেরা করছে!

ঐ হতভাগারা এত তাড়াতাড়ি আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে পারবে না। আমি শুধু দেখতে চাই, ক্রুসেড বাহিনীর দৃষ্টি কোন দিকে? তারা কি মিশরের দিকে নজর দেয়, না দামেশকের দিকে, ওটাই এখন দেখার বিষয়।’

সুলতানের কথার উপর আর কথা চলে না, তাই সবাই চুপ করে গেল। সুলতান খানিক বিরতি দিলেন। একটা গুমোট নিস্তব্ধতা বয়ে গেল সবার উপর দিয়ে।

নিস্তব্ধতা ভাঙলেন সুলতান নিজেই। বললেন, ‘সম্ভবত ওরাও অপেক্ষা করছে, আমি কি পদক্ষেপ নেই তা দেখার জন্য। এমনও হতে পারে, তারা আমার চাল বুঝেই তাদের চাল চালবে। অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আপনারা নিয়মিত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকুন, পুরোদমে যুদ্ধের মহড়া চালাতে থাকুন। সময় এলে গাদ্দার আমীরদের শায়েস্তা করার জন্য আমি ওদেরকে আপনাদের হাতেই তুলে দেবো।’

সুলতান আইয়ুবী যাদেরকে তাঁর চোখ ও কান বলেছিলেন, তারা আর কেউ নয়, আলীর গোয়েন্দা বিভাগের সেই জানবাজ বাহিনী। এদের অধিকাংশই মিশরের বাসিন্দা, তবে সবাই নয়, এ অঞ্চলের বেশ কিছু সদস্য আছে এ দলে।

খলিফা আল মালেকুস সালেহ ও তাঁর আমীর ওমরারা দামেশক থেকে পালানোর সময় তাদের সাথে সুলতানের এসব গোয়েন্দাদের কেউ কেউ তাদের সঙ্গে পালিয়ে যায়। এই পলাতকদের সংখ্যা মোটেই কম ছিল না।

সমস্ত আমীর, উজির, কিছু জমিদার, প্রশাসনের অনেক অফিসার ও করমছারি, যারা খলিফার পক্ষে ছিল, সবাইকেই পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেন আইয়ুবী। পলাতকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার মত পালিয়েছিল। এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নেন আলীর গোয়েন্দারা। তারা সহজেই মিশে যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের সাথে।

খলিফা আল মালেকুস সালেহ ও তার পোষ্য আমীররা প্রতিশোধের জন্য কি ধরণের তৎপরতা চালায় এটা দেখাই তাদের উদ্দেশ্য। সেই সাথে খ্রিস্টানরা তাকে কেমন সাহায্য দেয়, কিভাবে দেয় তাও লক্ষ্য করার দায়িত্ব ছিল তাদের উপর। হাসান বিন আবদুল্লাহ নিজের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করে সুলতান বা আলীর সাথে পরামর্শ ছাড়াই এসব গোয়েন্দাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে পলায়নপর লোকদের সঙ্গী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। সে ভাল করেই জানতো, তার এই সিদ্ধান্ত এক সময় অবশ্যই সুফল বয়ে আনবে। পরে সুলতানকে এ ব্যাপারে অবহিত করলে তিনি খুবই খুশী হন এবং সন্তোষ প্রকাশ করে তার পিঠ চাপড়ে দেন।

এ গোয়েন্দাদেরই একজন মাজেদ বিন মুহাম্মদ হেজাযী। অত্যন্ত সুপুরুষ ও সুন্দর চেহারার যুবক। শারীরিক গঠন মাঝারী, তবে সুগঠিত। আল্লাহ তার মুখে এমন মাধুর্য দান করেছিলেন যে, তার কথা যাদুর মত প্রভাব বিস্তার করতো।

গোয়েন্দাদের প্রায় সবাই দক্ষতা ও গুণাবলীতে একই রকম হলেও মাজেদ বিন মুহাম্মদ ছিল বিস্ময়কর ব্যাতিক্রম। তার নৈপুণ্য ও দক্ষতা ছিল অতুলনীয়।

গোয়েন্দাদের প্রায় সবাই সুন্দর ও সুগঠিত স্বাস্থের অধিকারী ছিল। তাদের এ সুন্দর স্বাস্থ্য ও লাবণ্যের একটি বিশেষ কারণ ছিল, তারা কেউ নেশা করতো না, অলস এবং আরামপ্রিয় জীবন যাপন করতো না। নিয়মিত ব্যায়াম এবং শারীরিক ও মানসিক প্রশিক্ষণের কারণে তাদের চেহারায় সব সময় প্রশান্তির প্রলেপ মাখা থাকতো। তাদের চরিত্রের দৃঢ়তা, ইস্পাতের মতো অনড়, অটল মনোবল এবং প্রবল ও অফুরন্ত ইচ্ছাশক্তির মূলে ছিল ইসলাম। ইসলামী আদর্শের পরিপূর্ণ জ্ঞান ও অনুশীলন তাদেরকে দিয়েছিল এক অনড় দৃঢ়তা। তাদের কথা ও কাজে প্রকাশ পেতো সে দৃঢ়তার ছাপ।

মাজেদ বিন মুহাম্মদ হেজাযী কাজে কর্মে তার সঙ্গীদের চাইতেও চৌকশ এবং ইস্পাত কঠিন ছিল। হৃদয় ছিল চেহারার চাইতেও অনুপম সুন্দর আর মহৎ। এরুপ সৌন্দর্য নিয়েই সে দামেশক থেকে পালাচ্ছিল। একটি আরবী ঘোড়ার ওপর বসেছিল সে। তার কোমরে ঝুলছিল সুদ্রিশ তলোয়ার। ঘোড়ার জিনের সাথে বাঁধা ধারালো বর্শা চমকাচ্ছিল রোদের কিরণ লেগে। ঘোড়া এগিয়ে যাচ্ছিল ধীর গতিতে। আর সে উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিল দূর দিগন্তে।

একাকী পথ চলছে মাজেদ হেজাযী। যাচ্ছে হলবের দিকে। পথে অনেক লোকই চোখে পরলো তার। অনেকে তার মতো হলবের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে একজনকেও বেছে নিতে পারলো না, যার সাথে পথ চলা যায়, যাকে সফর সঙ্গী করা যায় নিঃশঙ্ক চিত্তে।

সে মনে মনে একজন সম্ভ্রান্ত সহযাত্রী খুঁজছিল। খুঁজছিল এমন সহযাত্রী, যে তার মিশনের জন্য ফলপ্রসূ হতে পারে। এমন সহযাত্রী সে-ই হতে পারে, যে লোক উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার, আমীর বা খলিফা আল মালেকুস সালেহর নিকতাত্তিয়, বন্ধু বা আপনজন।

খলিফা আল মালেকুস সালহকে খুঁজে ফিরছিল তার চোখ ও মন। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস ও করলো, খলিফা কোন দিকে গেছে জানে কিনা। কিন্তু কেউ খলিফার কোন সন্ধান দিতে পারলো না।

সে ভালো মতোই জানতো, আল মালেকুস সালেহ তার পিতা নূরুদ্দিন জঙ্গীর গুণ বা সাহস কোনটাই পায়নি। খলিফার গুণ–বৈশিষ্ট্যের কোন ছিটেফোঁটা নেই তার মধ্যে। সে এগারো বছরের এক চঞ্চল বালক মাত্র। তাকে খ্রিস্টানদের চক্রান্তে সুযোগ সন্ধানী ও লোভী আমীররা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য রাজ্যের সিংহাসনে বসিয়েছে। নামে মাত্র খলিফা বালিক সালেহ, প্রকৃত শাসক সেই স্বার্থবাদী আমীররা।

সে চিন্তা করে দেখলো, এ নাবালক খলিফার পক্ষে একা কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। কোথায় যেতে হবে, কি করতে হবে, তাই তো তার জানা থাকার কথা নয়!

ক্ষমতা হারা হলেও সে ঘোষিত খলিফা। ফলে চক্রান্তকারীরা কিছু করতে চাইলে অবশ্যই তাকে সামনে রাখবে। নিশ্চয়ই এখনো সে আমীর, উজির এবং সভাষদবর্গ পরিবেষ্টিত হয়েই পথ চলছে। আর সে কাফেলার সাথে আছে রাজকীয় ধন-দৌলত ও অর্থসম্পদ বোঝাই উটের সারি।

মাজেদ হেজাযী মনে মনে ভাবছিল, যদি সে কাফেলার সন্ধান পাই, তবে আল মালেকুস সালেহের ভক্ত হয়ে সেই কাফেলার সাথে যুক্ত হয়ে যাবো।

একবার সে কাফেলার দেখা পেলে কি করতে হবে জানা আছে তার। কি করে অচেনা লোকের আপন হওয়া যায়, কি করে তাদের মনের কথা বের করে আনা যায়, সেসব কৌশল অন্যদের চাইতে ভালই রপ্ত করেছে সে।

কিন্তু কোথায় সে কাফেলা? তার শূন্য দৃষ্টি বার বার এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলো। কিন্তু কাঙ্খিত কাফেলা, নিদেনপক্ষে সঙ্গী করার মতো পছন্দসই কোন ব্যক্তিকেও সে খুজে পেল না।

সামনে পাহাড়ী এলাকা। পাহাড়ের পাদদেশে শস্যক্ষেত ও ফলের বাগান। একটু বিশ্রামের আশায় সেই বাগানের এক গাছের নিচে বসলো মাজেদ।

অল্প দূরে এক জায়গায় দুটি ঘোড়া দেখতে পেল। ওদিকে তাকাতেই তার একটু উপরে সবুজ ঘাসের উপর একজন লোককে শুয়ে থাকতে দেখলো। দৃষ্টি আরেকটু উপরে তুলতেই তার নজর পড়লো একটি মেয়ের উপর। মেয়েটিও তার মতো শুয়ে আছে।

ওখান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে গাছের নিচে শুয়ে পড়লো। শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছে, হঠাৎ একটি ঘোড়া বিকট শব্দে ডেকে উঠলো।

সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো ঘোড়ার পাশে শায়িত লোকটি। উঠে বসতেই তার নজর পড়লো মাজেদ হেজাযীর উপর। মাজেদ হেজাযীও ঘোড়ার ডাক শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছিল সেদিকে, চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। লোকটির পোশাক পরিচ্ছদ বলছিল, সে কোন খান্দানী বংশের লোক।

মনে হয় সে লোক ও মনে মনে কোন পছন্দসই সফর সঙ্গী খুঁজছিল। মাজেদ হেজাযীকে দেখে তার পছন্দ হয়ে গেল এবং ইশারায় তাকে কাছে ডাকলো।

মাজেদ হেজাযী সাড়া দিল তার ডাকে। সে শোয়া থেকে উঠে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে অপরিচিতের সাথে মুছাফাহ করলো।

মেয়েটিও ততক্ষণে উঠে বাসেছে। ওর বয়স বেশী নয়। দেখলে মনে হয়, কৈশর উত্তীর্ণ এক নবীন যুবতী। লাবণ্য ও সৌন্দর্য মাখামাখি হয়ে লেপ্টে আছে মেয়েটির অঙ্গ জুড়ে। গলায় হীরের হার। পোশাকে জৌলুসের ছাপ। এরা যে সাধারণ কেউ নয়, তা কাউকে বলে দিতে হয় না।

লোকটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মাজেদ এক পলক তাকিয়েই বুঝে ফেললো, এরা কারা।

‘তুমি কে?’ লোকটি জিজ্ঞেশ করলো, ‘তুমি কি দামেশক থাকে আসছো?’

‘হ্যাঁ, আমি দামেশক থেকেই এসেছি!’ মাজেদ বললো, ‘কিন্তু এখন দেয়ার মতো কোন পরিচয় নেই। ভাগ্যই এখন একমাত্র পরিচয়। তার কন্ঠ থেকে একরাশ হতাশা ঝড়ে পড়লো। হতাশ কন্ঠেই সে প্রশ্ন করলো, ‘আপনারা কোথায় যাবেন?’

‘মনে হয় আমরা একই পথের পথিক!’ লোকটি মুচকি হেসে উত্তর দিলো, ‘ধরো, তোমারই মতো মঞ্জিলহীন মুসাফির!’

কথা বলতে বলতে লোকটি ভাল করে মাজেদ হেজাযীর দিকে। বললো, ‘আমি কি ধরে নেবো, ভাগ্যই তোমার মতো যুবককে আমাদের সংগী বানিয়ে দিয়েছে।’

‘অপরিচিত যাকে-তাকে সঙ্গী করা ঠিক নয় সাহেব। বিশেষ করে যার সাথে এমন সুন্দরী মেয়ে থাকে, আর সে মেয়ের গলায় থাকে এমন মূল্যবান হার!’ মেয়েটির গলার দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

লোকটি এতে মোটেও বিব্রত না হয়ে বললো, ‘তোমার মতো সঙ্গী পাওয়া আসলেও ভাগ্যের ব্যাপার। বুদ্ধিদীপ্ত ও সাহসী সঙ্গী বিপদের বন্ধু। সাহস কেমন আছে জানি না, তবে বুদ্ধি যে সতেজ তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’

এবার মাজেদ হেজাযীও হেসে দিল। বললো, ‘আপনি কি করে আমাকে আস্থাভাজন ভাবলেন, আমি খারাপ লোকও তো হতে পারি।’

‘সে তোমার চেহারাতেই লেখা আছে। শোন, আমাদের মতো তুমিও আইয়ুবীর তাড়া খেয়ে দামেশক ছেরেছো। বিপদগ্রস্ত লোকেরা সব সময়ই একে অন্যের সহায়ক হয়। বলতে পারো, আইয়ুবীই আমাদের পরস্পরকে বন্ধু বানিয়ে দিয়েছে।’

‘এটা আপনি ঠিকই বলেছেন। অবশ্যই আমরা একে অন্যকে সাহায্য করবো। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, জীবন দিয়ে হলেও আমি আপনাদের সাহায্য করবো।’

‘আইয়ুবী কি আমাদের তাড়া করতে পারে? তুমি কি তেমন কোন আভাস পেয়েছো?’

‘তাড়া করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার সাথে সৈন্য খুবই কম বলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য পাঠাতে পারে নি। শহরের নিয়ন্ত্রণ আয়ত্তে এলেই সে আমাদের খুঁজে বের করার জন্য চারদিকে সৈন্য পাঠিয়ে দিবে।’

‘খুবই দুশ্চিন্তার কথা।’

‘কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা!’

‘কি?’

‘একটু আগে আমি রাস্তায় দুটো লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। শুনেছি ওরা ডাকাতের হাতে মারা গেছে। দামেশক থেকে পলাতক লোকদের ওপর হামলা করতে শুরু করেছে ডাকাতরা, এটা খুবই ভয়ের কথা। কারণ, আমরা যারা পালাচ্ছি, তার সবাই পরস্পর বিচ্ছিন্ন। অনেকেই সহায় সম্পদ সঙ্গে নিয়ে পালাচ্ছি। ডাকাতদের জন্য এ এক সুবর্ণ সুযোগ। আমাদের জান-মাল ছিনিয়ে নেয়ার এ সুযোগ ওরা হাত ছাড়া করবে বলে মনে হয় না।’

মাজেদের কথা শুনে মেয়েটির আকর্ষণীয় চেহারা হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সে তার সঙ্গীর দিকে তাকালো ভয়ার্ত ও করুণ চোখে। লোকটির অবস্থাও ভালো নয়। তার মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে সেখানে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়লো।

‘তুমি তো আমাদের বড় দুর্ভাবনায় ফেলে দিলে যুবক।’

‘না, না, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তবে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকা দরকার। সাবধান থাকলে অনেক বিপদই এড়ানো যায়।’

‘কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আইয়ুবী আর ডাকাতদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উভয়েই লুটেরা, খুনী এবং নারীদের ইজ্জত লুণ্ঠনকারী। এদের কারো মধ্যেই দয়ামায়ার চিহ্নও নেই!’

‘ঠিক বলেছেন। ইনি আপনার কি হয়?’ মেয়েটির দিকে ইশারা করে জানতে চাইল মাজেদ।

‘ও আমার স্ত্রী।’

‘দামেশকে আর কয়জন স্ত্রী ছেড়ে এসেছেন?’ মাজেদ হেজাযী আবার জিজ্ঞেস করলো।

‘চার জন।’

‘আল্লাহর হাজার শুকুর যে, আপনি আপনার পঞ্চম স্ত্রীকে নিয়ে নিরাপদে শহর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে পেরেছেন!’

‘তিরস্কার করছো! আমি তো তাও একজন স্ত্রী সঙ্গে এনেছি, কিন্তু তুমি তো তাও আনো নি!’

‘কোন নারীকে নিয়ে শর ছাড়ার মতো অবস্থা আর নেই। তাছাড়া …’

লোকটি তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি আইয়ুবীর সৈন্যদের কি অবস্থায় দেখে এসেছো? তারা কি শহরে লুটতরাজ শুরু করে দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ, মাজেদ হেজাযী বললো, ‘ সেখানে এখন ভয়ানক লুটপাট চলছে। আমি…’

‘দামেশকের কোথায় তোমার বাড়ি? সেখানে তুমি করতে?’

‘সে পরিচয় আমি কাউকে বলতে চাই না।’

‘বুঝেছি, তুমি আমাদের বিশ্বাস করতে পারছো না। ঠিক আছে, আস্থা না এলে বলার দরকার নেই। তবে বললেও তোমার কোন ক্ষতি আমাদের দিয়ে হতো না।’

‘না, না, কি বলছেন আপনি। আমি মোটেই আপনাদের অবিশ্বাস করছি না। আমার পরিচয় শুনতে আপনাদের ভাল লাগবে না বলেই আমি ইতস্তত করছি।’

‘কি যে বলো। তুমি যা তাই তোমার পরিচয়। নিজের আসল পরিচয় প্রকাশে কোন রকম হীনমন্যতা থাকা উচিৎ নয় কারো। তুমি নিঃসঙ্কোচে তোমার পরিচয় বলতে পারো, আমরা কিছুই মনে করবো না।’

‘আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর একজন সালার।’

সঙ্গে সঙ্গে লোকটার মুখের হাসি অদৃশ্য হয়ে গেলো। কম্পিত কন্ঠে বললো, ‘আমাদের সাথে যে টাকাকড়ি আছে সব নিয়ে যাও। কিন্তু আমাদের কোন ক্ষতি করো না। তোমার কাছে আমি করজোড়ে প্রার্থনা করছি, আমাদের ওপর রহম করো, দয়া করে একটু প্রাণ ভিক্ষা দাও।’

মাজেদ হেজাযী হো হো করে হেসে উঠলো। বললো, ‘অর্থ, সম্পদ ও নারীর চিন্তা মানুষকে কাপুরুষ ও দুর্বল বানিয়ে দেয়। আমি বেঁচে থাকতে কেউ আপনাদের গায়ে আঁচড়ও দিতে পারবে না। আর সম্পদের কথা বলছেন? এ সম্পদ আপনাদের। কেউ তা ছিনিয়ে নিতে চাইলে এ তলোয়ার তার জবাব দেবে। আসলে আপনাদের কাছে এখনো আমার আসল পরিচয় বলতেই পারিনি।’

‘মুহতারাম! আমাকে বলুন আপনি কে? দামেশকে আপনি কি পদে ছিলেন এবং আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

‘আমি সত্যি কথাই বলেছি, আমি আইয়ুবীর সৈন্য ঠিকই, তবে পলাতক। আসলে আমি জঙ্গীর সৈন্য। তিনি আমাকে আইয়ুবীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। জঙ্গীর নুন খেয়েছি আমি, আজ মরহুম জঙ্গীর পুত্রের এ দুর্দিনে তার পাশে না দাঁড়ালে নিমকহারামী হবে। তাই আইয়ুবীর ওখান থেকে পালিয়ে এসেছি। এবার আপনার পরিচয় বলুন। আশা করি আপনার অন্তরঙ্গ হিতৈষী ও জানবাজ রক্ষক হিসাবে আমার মতো আর কাউকে পাবেন না। আমরা উভয়েই একই নৌকার যাত্রী। এখন থেকে আপনাদের যে কোন বিপদে আমাকে আপনাদের পাশেই পাবেন।’

‘আমি দামেশকের শহরতলীর এক জমিদার। দরবারে আমার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ও মর্যাদা ছিল। রাজ্যের প্রশাসন পরিচালনা এবং যুদ্ধ পলিসি নির্ধারণে আমার মতামতের গুরূত্ত অনেক। খলিফার রক্ষী বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য নিয়োগ দিয়েছি আমি। তিনি আমাকে তার একান্ত আপনজন বলেই ভাবতেন। আমার বেরুতে একটু দেরী না হলে তার সাথে একত্রে যাওয়ার কথা ছিল আমার।’

‘কি সৌভাগ্য আমার! খলিফার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি আমি! আপনি কি এখন তার কাছেই যাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, খলিফা আল মালেকুস সালেহ সঙ্গী সাথীদের নিয়ে হলব গিয়ে উঠবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকেও হলব পৌঁছতে বলেছেন তিনি।’

‘আমিও হলবেই যাচ্ছিলাম। তিনি ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হলবই এখন তার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।’

‘তোমাকে পেয়ে আমার খুবই উপকার হলো। জমিদারীর সবকিছু দামেশকে ফেলে এলেও সোনাদানা ও হীরা-জহরত যথেষ্টই সঙ্গে নিয়ে এসেছি। বিদেশে মান সম্মান, প্রতিপত্তি সবই তো কিনতে হবে এ অর্থের বিনিময়ে! আফসোস হচ্ছে আমার চার বিবির জন্য! ওদেরকে চাকর-বাকরের হাতে রেখে এসেছি। কিন্তু লুটপাট শুরু হলে এ চাকররাই আমার বাড়ি লুট করবে না, তার নিশ্চয়তা কি?’

‘ও নিয়ে এখন আফসোস করে লাভ নেই। ছোট বিবিকে সঙ্গে আনতে পেরেছেন, এও কি কম কথা!’

❀ ❀ ❀