» » সর্প কেল্লার খুনী

বর্ণাকার
🕮

ত্রিপলীর খ্রিস্টান রাজা রিমান্ডের কাছ থেকে খলিফা আল মালেকুস সালেহের পাঠানো দূত যেদিন ফিরে এলো তার পরের দিন।

মেয়েটি মাজেদ হেজাযীকে বললো, ‘আজ রাতে আমি আমার স্বামীর কাছ থেকে অনেক গোপন তথ্য আদায় করেছি। সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল তৈরী করছে তারা। আমি যখন তাকে বললাম, ‘তোমরা আসলে কাপুরুষ। নইলে এতো বড় রাজ্যের খলিফা, এত যার সৈন্য সামন্ত, সামান্য কয়েক হাজার সৈন্যের ভয়ে দামেশক থেকে পালিয়ে হলবে এসে আশ্রয় নিয়েছো, আর এমন দেখাচ্ছো, যেনো প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধের ময়দানে কাটাচ্ছো, এত যারা ভীতু তাদের রাজ্য রাজ্য খেলার কাজ কি? আমার মতো নারীর আঁচলেই মানায় তোমাদের।’

স্বামী বললো, ‘দেখো ঠাট্টা করবে না বলে দিচ্ছি। আইয়ুবীর সামনে তো পড়োনি, পড়লে বুঝতে।’

‘ওরে আমার বীর পুরুষ! এক আইয়ুবীর ভয়েই কম্ম সারা! যেই খলিফার সামরিক উপদেষ্টার এত সাহস, সেই খলিফার ভাগ্যে কি আছে আল্লা মালুম!’

আমার এ কথায় ভয়ানক ক্ষেপে উঠলেন তিনি। গজর গজর করতে করতে বললেন, ‘বেকায়দায় পড়লে নাকি চামচিকাও হাতির গায়ে লাথি মারে। বললো, ‘আর কয়দিন বলবে! আরে, আইয়ুবী তো কয়েক দিনের মেহমান মাত্র! ফেদাইন গ্রুপের খুনি পীর মান্নানকে দায়িত্ব দিয়েছি। শীঘ্রই সুলতান আইয়ুবীর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মান্নানকে তো চেনো না! এ কাজে তার মত দক্ষ ব্যক্তি এ তল্লাটে আর নেই!’

‘সেনাবাহিনী রেখে এখন একজন মাত্র খুনীর উপর ভরসা করছো!’

‘আরে না না! আমাদের সেনাবাহিনী গঠনের কাজ পুরোদমেই চলছে। শীতকাল এসে গেছে প্রায়। পাহাড়ি এলাকায় বরফ পড়াও শুরু হয়ে গেছে। পুরোমাত্রায় বরফ যখন পড়বে, আমরাও তখন চড়াও হবো আইয়ুবীর উপর। সুলতান আইয়ুবী ও তার সৈন্যরা মরুভূমিতে যত সচ্ছন্দে লড়াই করতে পারে পাহাড়ী এলাকায় এত শীত ও বরফের মধ্যে ততটা দক্ষতা দেখাতে পারবে না।’

এভাবেই শুরু।

নারী ও মদের নেশা একজন পুরুষের বুক থেকে সকল গোপন তথ্য বের করে নিতে পারে। মেয়েটি প্রতি রাতে তার স্বামীর কাছ থেকে সারা দিনের খবরা-খবর জেনে নিতে থাকে, আর পরদিন সকালে এসব গোপন তথ্য মাজেদ হেজাযী তার মনের খাতায় লিপিবদ্ধ করতে থাকে।

কিন্তু এ অবস্থায় বাধা এলো হঠাৎ করেই। একদিন তার স্বামী মাজেদ হেজাযীকে দেকে বললো, ‘তোমার সম্পর্কে আমার কানে কিছু আপত্তিকর অভিযোগ এসেছে। তুমি নাকি আমার অনুপস্থিতিতে বেশীরভাগ সময় আমার বেগমের কাছে বসে থাকো এবং তোমাদের মেলামেশা আপত্তিকর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।’

মাজেদ কেঁপে উঠলো। ভাবলো, হয়তো সব গোপন ফাঁস হয়ে গেছে। সে মাথা নিচু করে মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।

মেয়েটির স্বামী আবার বললো, ‘আমি জানি, আমার তুলনায় তুমি সুন্দর ও বয়সে যুবক। আমার স্ত্রী তোমাকে পছন্দ করে ফেলতে পারে। এমনও হতে পারে, তুমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারো। কিন্তু আমি সে সুযোগ তোমাকে দেবো না। যদি অভিযোগ সত্য হয় এবং তুমি আমার স্ত্রীর দিকে নজর দিয়ে থাকো, থাহলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলবো।’

মাজেদ হেজাযী তাকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করলো। বললো, ‘এটা আপনার ভুল ধারণা। উনি আমার মালকিন! উনার দিকে আমি কুনজর দিতে যাবো কোন সাহসে!’

মাজেদ হেজাযীর কণ্ঠে যাদু ছিলো। মালিক চরম ব্যবস্থা নিতে গিয়েও আর নিলেন না। বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তদন্ত করে দেখছি। মুখ দেখে তোমাকে যতটা নিষ্পাপ মনে হয়, বাস্তবে তার সত্যতা কতটুকূ আমাকে খতিয়ে দেখতে হবে।’

মাজেদ হেজাযী এখান থেকে সরে যেতে চাচ্ছিলো না। এখনও খলিফা সালেহর পূর্ণ পরিকল্পনা তার জানা হয় নি তার। তাই সে মনিবের দাপট ও ধমক নিরবে সহ্য করে নিল। অনুনয় বিনয় করে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। বললো, ‘আমি কোন অপরাধ করিনি, তবু যখন আপনার মনে সন্দেহ জেগেছে, এখন থেকে আরও সতর্ক থাকবো। কোন রকম অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না কাউকে।’

মাজেদ যতই তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুক, কারো মনে একবার সন্দেহ দানা বেঁধে উঠলে তা দূর করা কঠিন।

জমিদার মাজেদ হেজাযীকে সাবধান করার সাথে সাথে তার স্ত্রীর ওপরও কড়া নিষেধাজ্ঞা জারী করলো, ‘মাজেদ হেজাযীর সাথে কখনো মেলামেশা করবে না।’

এতেও সে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলো না, সেদিনই সে আরো কয়েকজন নতুন বডিগার্ড নিয়োগ করলো।

সে যুগে আমীর ও ধনী লোকদের সম্মান নির্ধারণ করা হতো বডিগার্ডের বহর দেখে।

জমিদারের বডিগার্ড সংখ্যা মাজেদ হেজাযীসহ এখন সাতজন। জমিদার তাদের মধ্য থেকে একজনকে কমান্ডার বানিয়ে দিলো। কমান্ডার মাজেদ হেজাযীকে নির্দেশ দিয়ে বললো, ‘যেহেতু মালিক তোমার ওপর খুশী নয়, সে জন্য মালিকের দরজার কাছেও যাওয়া উচিৎ নয় তোমার। আর রাতে এক মুহূর্তের জন্যেও থাকতে পারবে না।’

মাজেদ বিনয়ের সাথে তার এ আদেশ মেনে নিলো।

এরপর ঘটনাহীনভাবেই কেটে গেল দু’তিন রাত। একদিন দুপুর রাতে মেয়েটি বাড়ির বাইরে এলো। বাইরের গেটে এক গার্ড ছিল পাহারায়। মালিকের স্ত্রীকে দেখেই সে সালাম করে আদবের সাথে দাঁড়িয়ে রইলো।

মেয়েটি কর্তৃত্তের সুরে বললো, ‘তুমি কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, নাকি বাড়ির চারদিকে পায়চারী করবে?’

সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে, মেয়েটি আবার বললো, ‘তুমি নতুন এসেছো, তাই না? নিয়ম কানুন এখনো সব রপ্ত করতে পারো নি। এদিক থেকে দামেশকের প্রহরী খুব হুঁশিয়ার ও সতর্ক ছিলো! চাকরী করতে হলে তোমাকেও হুশিয়ার ও সতর্ক থাকতে হবে। তোমাদের মালিক খুব কড়া মেজাজের মানুষ। ডিউটিতে কোনরকম গাফলতি দেখলে চাকরী থাকবে না কারো!’

প্রহরী সসম্মানে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।

মেয়েটি বডিগার্ডরা যেখানে থাকে সেদিকে এগিয়ে গেলো। গেটের পাহারাদার দৌড়ে গিয়ে কমান্ডারকে জানালো, ‘মালকিন আমাদের পাহাড়া তদন্ত করতে এসেছেন!’

কমান্ডার হতভম্বের মত ছুটে এসে তার সামনে মাথা নত করা দাঁড়ালো। মেয়েটি তাকেও কড়া ধমক লাগালো, ’বাড়ির চারদিকে ডিউটির এ অব্যবস্থা কেনো?’

কমান্ডার ডিউটি তদারক করতে চলে গেলো।

মেয়েটি অন্য একটি কামরার সামনে এসে দাঁড়ালো এবং জোরে জোরে কথা বলতে লাগলো। মাজেদ হেজাযী এ কামরাতেই শুয়ে ছিলো। মেয়েটির হাক ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। সে ছুটে বাইরে এলো।

মেয়েটি তার সঙ্গেও কড়া মেজাজে কথা বললো, ‘পাহারাদারদের এতো ঘুমালে চলবে কি করে?’

ততক্ষণে কমান্ডার ডিউটি তদারক শেষে আবার ফিরে এসেছে সেখানে। মেয়েটি কমান্ডারকে সামনে পেয়েই আদেশ করলো, ‘আমার এখুনি খলিফার মহলে যেতে হবে!’ তারপর বিরতি না দিয়েই মাজেদের দিকে ফিরে বললো, ‘তোমার এখন ডিউটি নেই, তাই না? ঠিক আছে তুমিই চলো।’

‘যদি মালিক আপনার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করেন তবে কি বলবো?’ কমান্ডার তাকে প্রশ্ন করলো।

‘আমি কোন প্রমোদ ভ্রমণে যাচ্ছি না!’ মেয়েটি আরো ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো, ‘মালিকের কাজেই যাচ্ছি! যাও, জলদি ঘোড়া রেডি করো।’

কমান্ডার এক প্রহরীকে আস্তাবলে পাঠিয়ে দিল। মাজেদ হেজাযী দ্রুত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিল। মেয়েটি তাকে নিয়ে আস্তাবলের দিকে রওনা দিল।

কমান্ডারকে তার মালিককে বলে রেখেছিল, ‘মাজেদ হেজাযীর ওপর কড়া দৃষ্টি রাখবে, যেন সে মহলের ভেতর যেতে না পারে!’ এখন মালকিন নিজেই মাজেদকে বেছে নিলেন। এ অবস্থায় কমান্ডার কি করবে ভেবে পেল না। সে হতভম্বের মতো তাকিয়ে দেখলো, তারা দুজনেই আস্তাবলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সে একবার ওদের বাঁধা দেবার কথা চিন্তা করলো, কিন্তু পরক্ষণেই তা বাতিল করে দিল এই ভেবে, ‘মালিকের স্ত্রীও মালিক। তার কোন কাজে বাঁধা দেয়ার এখতিয়ার আমার নেই!’

তখনই তার মনে হলো, এ সংবাদ এখনই মালিককে দেয়া দরকার। তিনি যা নির্দেশ দিবেন সেভাবেই এগুনোই ভালো।

সে ভয়ে ভয়ে গেট পেরিয়ে মহলের ভেতরে গেল এবং মালিকের কামরার দরজায় নক করলো। ভেতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে সে আবারো নক করে দরজা খোলার অপেক্ষা করতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ভেতর থেকে কোন সাড়া না পাওয়ায় সে আস্তে করে দরজায় ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। ভেতরে পা রাখলো কমান্ডার।

ভেতরে প্রদীপ জ্বলছিল। কামরা ভরা শরাবের গন্ধ। সে তার মালিকের দিকে তাকালো। বিছানায় পড়ে আছেন তিনি। মাথা ও একটি হাত পালংকের পাশে ঝুলছে। একটি খঞ্জর বিদ্ধ হয়ে আছে তার বুকে। খঞ্জরটি যেখানে বিঁধে আছে তার আশেপাশে আরো কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন জ্বল জ্বল করছে।

কমান্ডার হাত ধরে তার পালসের গতি দেখলো। সব শেষ, জীবনের কোন স্পন্দন নেই সেখানে। তার কাপড় চোপড়, বিছানা রক্তে ভেজা। কমান্ডার বিষ্ময়ে বিষ্ফোরিত নয়নে সে রক্তের দিকে তাকিয়ে রইলো।

প্রতিদিনের মতো সেদিনও মেয়েটি স্বামীকে শরাব পান করাচ্ছিল আর তার কাছ থেকে কিভাবে কথা আদায় করা যায় তা ভাবছিলো। অন্যান দিনের তুলনায় স্বামীর চেহারায় সে খুশীর আভা দেখতে পেল। এটা নিয়েই কথা শুরু করলো সে, ‘কি ব্যাপার! খুব খুশী মনে হচ্ছে আজ তোমাকে?’

‘আরে খুশি হবো না, ফেদাইন গ্রুপের গুপ্তঘাতক আজই রওনা হবে আইয়ুবীর উদ্দেশ্যে। আইয়ুবীর হাত থেকে নিস্তার পাওইয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র!’

খবরটা শোনা মাত্রই শিহরণ খেলে গেল তার দেহে। আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্যে আজই রওনা হবে গুপ্তঘাতক! এ খবর এখুনি মাজেদকে জানানো দরকার। দেরি হলে যে কোন মুহূর্তে অঘটন ঘটে যেতে পারে।

সে তার স্বামীকে প্রতিদিনের মতো শরাব পান করালো। আজ সে এত বেশী খেয়েছে যে, বেহুশ হয়ে গেল। মেয়েটি তাকে অজ্ঞান অবস্থায়ই ফেলে আসতে পারতো কিন্তু তার মধ্যে জেগে উঠলো প্রচন্ড প্রতিশোধ স্পৃহা। প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে সে খঞ্জর দিয়ে তার বুক ঝাঁঝরা করে দিলো এবং শেষে খঞ্জর তার বুকে বসিয়ে রেখেই চলে এল ঘরের বাইরে।

মাজেদ হেজাযী এ কাহিনী শুনে মোটেও ভীত হলো না। সে তো প্রতি মুহূর্তে কোন না কোন বিপদ মোকাবেলা করার জন্যই এ জীবন বেছে নিয়েছে।

সে মেয়েটির এ দুঃসাহসিক কাজের প্রশংসা করে তাকে জলদি ঘোড়ায় উঠতে বললো এবিং নিজেও দ্রুত ঘোড়ায় উঠে বসলো।

বিষ্ময়ের ঘোর কাটতেই কমান্ডার দ্রুত বাইরে ছুটে এলো। ছুটে গেল আস্তাবলের দিকে। চিৎকার করে বলতে থাকলো, ‘ওদের ঘোড়া দিও না, আটকাও ওদের। মালকিন তার স্বামীকে হত্যা করে পালাচ্ছে!’

প্রহরীরা এ চিৎকার শুনে তলোয়ার ও বর্শা হাতে ছুটে এলো। ততক্ষণে মাজেদ ও মেয়েটি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে।

প্রহরীরা ছুটলো আস্তাবলের দিকে। আস্তাবল থেকে ঘোড়া নিয়ে বেরোনোর একটাই রাস্তা, যে রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে প্রহরীরা। মাজেদ সালেহাকে বললো, ‘যদি ঘোড়া চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকে তবে আমার পিছনে উঠে বসো। কারণ ওদের হাত থেকে বাঁচতে হলে প্রাণপণে ঘোড়া ছুটাতে হবে!’

সালেহা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো, ‘ভয় পেয়ো না, আমার ট্রেনিং আছে। তুমি ঘোড়া ছুটাও।’

মাজেদ হেজাযী বললো, ‘তবে তুমি আমার পিছনে একদম লেগে থাকবে।’

মাজেদ তলোয়ার হাতে নিলো। ওদিকে বডিগার্ডদের চিৎকার বেড়ে গেল। তারা হৈ চৈ করতে করতে আস্তাবলের দিকে ছুটে আসছিল।

মাজেদ হেজাযী তাদের দিকে মুখ করে প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। তার পিছনেই মেয়েটির ঘোড়া।

কমান্ডারের গর্জন ভাসে এলো, ‘থামো। নইলে মারা পড়বে।’

চাঁদনী রাত। মাজেদ দেখতে পেলো, প্রহরীরা বর্শা উচিয়ে ছুটে আসছে। সে ঘোড়ার মুখ তাদের দিকে রেখেই প্রবল বেগে তলোয়ার ঘুরাতে থাকলো।

ঘোড়ার গতি স্বাভাবিকের চেয়ে ছিল দ্রুত। দুই বডিগার্ড বাঁধা দিতে এসে ঘোড়ার পায়ের তলে পিষ্ট হয়ে গেল। একজন বর্শা ছুঁড়ে মারলো তার দিকে, সে তলোয়ার দিয়ে বর্শার গতি ফিরিয়ে দিল।

‘তোমরা তীর ধনুক বের করো।’ চিৎকার জুড়ে দিল কমান্ডার।

প্রহরীদের পেরিয়ে এল ওরা। কিন্তু প্রহরীরাও ছিলো যথেষ্ট পটু। তারা তাড়াতাড়ি তীর বের করে ছুঁড়ে মারলো। তাড়াহুড়োর কারণে তীর মাজেদ বা মেয়েটি কারো গায়েই লাগলো না। পর পর দুটো তীর ওদের পাশ দিয়ে শাঁ করে চলে গেল।

তীরের নিশানা থেকে বাঁচবার জন্য ওরা এঁকেবেঁকে ঘোড়া ডানে ও বায়ে ছুটিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই তীরের আওতার বাইরে চলে এলো।

মাজেদ ভয় পাচ্ছিলো, গার্ডরা ঘোড়া ছুটিয়ে পিছু ধাওয়া করবে। কিন্তু আরো কিছুদূর যাওয়ার পর তাদের সে ভয় দূর হয়ে গেলো। এখন আর তাদের ধরা পড়ার কোন ভয় নেই।

আসলে ঘোড়ার পিঠে জীন আটার জন্য যে সময়টুকূ দরকার ছিলো গার্ডদের, সে সুযোগে তার অনেক দূরে চলে এসেছে।

লোকালয় থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। অনেক দূর যাওয়ার পর দূর থেকে ঘোড়ার পিছু ধাওয়ার শব্দ কানে এলো মাজেদের। সে মেয়েটিকে বললো, ‘বিপদ এখনো পিছু ছাড়ে নি, আমার পাশে পাশে ঘোড়া চালাতে থাকো।’

মেয়েটি ঘোড়া নিয়ে তার পাশাপাশি চলতে লাগলো। মাজেদ হেজাযী বললো, ‘ভয় পাচ্ছো না তো?’

মেয়েটি এর কোন উত্তর না দিয়ে সমান তালে ঘোড়া ছুটিয়ে জোড়ে জোড়ে বলতে লাগলো, ‘আমি আরো অনেক গোপন কথা জানতে পেরেছি। সব কথা তোমার শোনা দরকার।’

মাজেদ বললো, ‘আগে কোথাও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়ে নেই। ওখানে গিয়েই তোমার সব কথা শুনবো।’

কিন্তু মেয়েটির তর সইছিল না, সে ছুটতে ছুটতেই কথা চালিয়ে যেতে লাগলো।

মাজেদ হেজাযী বার বার তাকে চুপ থাকতে বললো। চলন্ত অবস্থায় তার কথা সব বুঝে উঠতে পারছিলো না মাজেদ। ছুটতে ছুটতেই মাজেদ বললো, ‘তোমার সব কথা বুঝতে পারছি না।’

শেষে মেয়েটি অধৈর্য কন্ঠে বললো, ‘তবে থেমে যাও। আমি আর বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছি না।’

মাজেদ থামতে চাচ্ছিল না, কিন্তু মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মাজেদের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলো।

সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো মাজেদ, তখনই তার নজরে পড়লো তীরটি। মেয়েটির বাম দিকে গেঁথে আছে একটি তীর। মেয়েটির চলার সাথে তাল মিলিয়ে দোল খাচ্ছে সামনে, পিছনে। মাজেদ জলদি ঘোড়া থামালো।

মেয়েটি বললো, ‘আমার গায়ে তীর লাগার কারণেই আমি চলন্ত অবস্থায় সব তথ্য তোমাকে দেয়ার জন্যে পেরেশান হয়েছিলাম। মরার আগেই তোমাকে তথ্যগুলো জানানো দরকার। তাই তোমাকে জোর করে থামিয়ে দিলাম!’

মাজেদ লাফিয়ে নামলো ঘোড়ার পিঠ থেকে, তারপর মেয়েটিকেও নামিয়ে আনলো। মাটিতে বসিয়ে তাকে কোলের সাথে চেপে ধরে তীর খুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু তীর এতো বেশী গভীরে প্রবেশ করেছিল যে, টেনে বের করা সম্ভব হলো না।

ওর টানাটানিতে কাতর হয়ে মেয়েটি বললো, ‘ওটা রেখে দাও। আমার কথাগুলো আগে শুনে নাও। তারপর তোমার যা ইচ্ছা করো।’

সালেহা দুর্বল স্বরে বলে চললো স্বামীর কাছ থেকে উদ্ধার করা গোপন তথ্যাবলী। মাজেদ হেজাযী গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো আইয়ুবীকে হত্যা ও তার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর গোপন পরিকল্পনার কথা।

মেয়েটি কথা শেষ করলো এই বলে, ‘আমার ধারণা, কেউ এ কথা চিন্তাও করবে না, আমরা গোপন তথ্য নিয়ে হলব থেকে পালাচ্ছি। রক্ষীদের সবাই জানতো, আমার ও তোমার মধ্যে গোপন সম্পর্ক রয়েছে, যা আমার স্বামীর মনেও সন্দেহ সৃষ্টি করেছিল। তারা এ কথাই সবাইকে বলবে। বলবে, ভালোবাসার টানে পাগল হয়েই আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়েছি।’

মেয়েটি কথা শেষ করে মাজেদ হেজাযীর হাতে গভীরভাবে চুমু খেলো এবং বললো, ‘আমি শান্তির সঙ্গে মরতে পারবো।’ এরপরই সে জ্ঞান হারালো।

মাজেদ হেজাযী সালেহার ঘোড়া তার ঘোড়ার পিছনে বেঁধে নিলো এবং আহত সালেহাকে নিজের ঘোড়ায় উঠিয়ে পিছনে বসিয়ে এমনভাবে তাকে ধররে রাখলো, যাতে বিদ্ধ তীর তাকে বেশী কষ্ট না দেয়।

কিন্তু তীর তার ক্রিয়া শেষ করেছে। মেয়েটি চলন্ত ঘোড়ার পিঠে মাজেদ হেজাযীর বুকের উপর দেহের সমস্ত ভার চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিলো।

❀ ❀ ❀

মাজেদ যখন দামেশক কমান্ডার হাসান বিন আব্দুল্লাহর কাছে উপস্থিত হলো, মেয়েটি কম বেশী তার বারো ঘন্টা আগে শহীদ হয়েছে।

মাজেদ হলবের রাজমহলের সমস্ত ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার কথা শোনালো তাকে। বললো, ‘এই বিরাট সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে আল্লাহর এই প্রিয় বান্দীর অপরিসীম ত্যাগ ও সদিচ্ছার ফলে।’

হাসান বিন আবদুল্লাহ তৎক্ষণাৎ মাজেদ হেজাযী ও শহীদ সালেহার লাশ নিয়ে সুলতান আইয়ুবীর কাছে গেলেন।

সুলতানের প্রশ্নের জবাবে মাজেদ হেজাযী মেয়েটি সম্পর্কে সব কথা খুলে বললো। কেমন করে তার বাবা তাকে জমিদারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। স্বামীর সাথে কেন তার দ্বন্দ্ব হয়েছিল এবং কেন ও কেমন করে এসব তথ্য সংগ্রহ করে মাজেদ কে দিয়েছে, সব কথাই সুলতানকে খুলে বললো সে।

পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মেয়েটির বাবাও দামেশক থেকে পালিয়েছে।

সুলতান আইয়ুবী মেয়েটির লাশ নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন বললেন, ‘এ মেয়ের দাফন সামরিক বিধি মোতাবেক সসম্মানে করা হবে।’

মেয়েটি মৃত্যুর আগে মাজেদ হেজাযীকে যে গোপন ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিল, তার সংক্ষিপ্তসার হলো, সুলতান মালেকুস সালেহ সমস্ত মুসলিম রাজ্যগুলোর শাসকবর্গকে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে কেবল ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানই জানান নি, তাদের সেনাদলকে একক কমান্ডের অধীনে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোরও অনুরোধ করেছেন। ত্রিপোলীর খ্রিস্টান শাসক রিমাণ্ডের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছেন।

মেয়েটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী রিমাণ্ড তার সেনাবাহিনীকে মিশর ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে পাঠাতে সম্মত হয়েছে। সেখানে তারা সুলতান আইয়ুবীর যেসব বাহিনী পাবে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এবং সুলতানের জন্য পাঠানো রসদপত্র লুট করে নেবে, এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তাদের ধারণা, সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধের সময় মিশর থেকে অবশ্যই সাহায্য চেয়ে পাঠাবে। তাছাড়াও রিমাণ্ড সুলতান আইয়ুবীকে অবরোধ করার জন্য তার তেজস্বী অশ্বারোহী বাহিনীকে সব সময় প্রস্তুত রাখবে। যদি প্রয়োজন পড়ে তবে রিমাণ্ড অন্যান্য খ্রিস্টান রাজাদেরও সাহায্য চেয়ে পাঠাবেন।

হাসান বিন সাবাহর আনুসারী ফেদাইন দলের সাথে খলিফার চুক্তি হয়েছে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে হত্যার বিনিময় কি হবে তাও ঠিক করা হয়েছে এ চুক্তিতে। চুক্তি মোতাবেক ফেদাইন গ্রুপ শীঘ্রই দামেশকে অভিযান চালাতে সম্মত হয়েছে।

এসব তথ্য নিঃসন্দেহে আশংকাজনক। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী এগুলোকে তেমন গুরুত্ত দিলেন না। তিনি গুরুত্ত দিলেন, শীতকালেই যুদ্ধ শুরু করবে, এ খবরটিকে। কারণ এ সময় দামেশকে প্রচন্ড শীত পড়ে। হাল্কা বৃষ্টি এবং প্রচুর বরফও পড়ে। এ আবহাওয়া যুদ্ধের অনুকূল নয়। এ অঞ্চলে কোন দিন কেউ এ মওসুমে যুদ্ধ করে নি।

মেয়েটির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করলেন। সৈন্যদেরকে দুর্গের মধ্যে সমবেত করলেন। সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করলেন এবং আক্রমণের সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন।

শীতকাল শেষ হওয়ার আগেই খ্রিস্টানদের সিরিয়া আক্রমণ করার কথা। এ জন্য খ্রিস্টান রাজা রিমাণ্ডকে যথাযথ অগ্রিম মূল্য দেয়া হয়েছে। এ মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে সোনা ও হীরা দিয়ে। বুদ্ধিমান রিমাণ্ড খলিফার প্রস্তাব এ শর্তেই কবুল করেছিলেন যে, যুদ্ধ পরিচালিনার ব্যয়ভার খলিফাকে বহন করতে হবে এবং যুদ্ধের আগেই তা পরিশোধ করতে হবে। খলিফা আস সালেহ ও তার আমীররা একমত হয়ে সিদ্ধান্ত মোতাবেক সে মূল্য এরই মধ্যে পরিশোধ করে দিয়েছে।

‘মুসলমানদের দুর্ভাগ্য!’ সুলতান আইয়ুবী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আজ মুসলমানরা কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমেছে। ওরা যদি রাসূলের (সাঃ) আত্মার হাহাকার ধ্বনি শুনতে পেতো তবে কতই না মঙ্গল হতো! আমাদের জন্য এর চেয়ে অধিক কষ্টকর আর কি হতে পারে, যে একই নবীর উম্মত আজ আমরা পরষ্পরের অস্ত্র তুলে নিয়েছি হাতে!’

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তাঁর স্মৃতিচারণ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার প্রিয় বন্ধু সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এতো আবেগময় কখনও হননি, যেমন সে সময় হয়েছিলেন। তাঁকে যখন বলা হলো, ‘আমাদের আশা ছিল, মরহুম জঙ্গীর পূত্র ইসলামের গৌরবের নিদর্শন হবেন। কিন্তু স্বার্থপর আমীরদের খপ্পরে পড়ে তিনি আজ ইসলামের মূল উদ্দেশ্যই ধ্বংস করতে বসেছেন। আফসোস! খ্রিস্টানদেরকে আরব ভূমি থেকে বিতাড়িত করে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটানোর পরিবর্তে এখন তিনি তাদের দোসর হিসেবে কাজ করছেন।’

এ কথা শুনে সুলতান আইয়ুবীর দু’চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তিনি তার কামরায় পায়চারী করতে করতে আবেগের সাথে বলতে লাগলেন, ‘এরা আমার ভাই নয়, দুশমন! তাদের আমি অবশ্যই হত্যা করবো। দুনিয়ায় আমি বেঁচে থাকতে আমার প্রিয় রাসূলের দ্বীনকে কেউ কলংকিত ও লাঞ্ছিত করবে, এটা আমি কিছুতেই হতে দিবো না। এমন শাসকের উপর গজব নেমে আসুক, যে শাসক কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ত করে জাতির ক্ষতি করে।’

তিনি আরও বললেন, ‘আমি জানি, এরা ক্ষমতা ও অর্থের লালসায় অন্ধ হয়ে গেছে। এরা নিজেদের ঈমান বিক্রি করে গদি ও ক্ষমতা রক্ষা করতে চায়।’

তিনি তলোয়ারের বাটে হাত রেখে বললেন, ‘তারা শীতকালেই যুদ্ধ করতে চায়। আমি বরফের ময়দানকে ভয় পাই না। শীতকালেই আমি যুদ্ধ করবো, বরফে ঢাকা পাহাড় ও পর্বতের মাঝখানেই আমি কবর রচনা করবো ওদের।’

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কল্পনাবিলাসী লোক ছিলেন না, তিনি ছিলেন কঠোর বাস্তববাদী। কখনও আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করতেন না তিনি। যে কোন সিদ্ধান্ত নিতেন বাস্তবতার আলোকে।

যুদ্ধের ময়দানে, বিপদসংকুল অভিযানে সমস্ত সমস্যা তিনি মোকাবেলা করতেন বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়ে। তাঁর নির্দেশনা হতো সংক্ষিপ্ত অথচ স্পষ্ট। তিনি কমান্ডারদেরকে কাগজে রেখা টেনে কিংবা মাটিতে আঙ্গুল দিয়ে দাগ টেনে বুঝিয়ে দিতেন তাঁর নির্দেশনা।

কিন্তু সেদিন তার হৃদয় নদীতে আবেগের ঢেউ উঠলো, তিনি নিজেকে সামাল দিতে পারলেন না। তিনি এমন কথাও বলে ফেললেন, সচরাচর যে কথা তিনি বলেন না। তিনি ভালো করেই জানতেন, এ বৈঠকে যারা আছে তারা খুবই বিশ্বস্ত এবং আন্তরিক। তাদের সামনে মন উজার করে কথা বললে কোন বিপদের আশংকা নেই।

‘তাওফিক জাওয়াদ!’ সুলতান আইয়ুবী দামেশকের প্রধান সেনাপতিকে বললেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত জানতে পারি নি, তোমার সৈন্যরা শীতকালে যুদ্ধ করতে পারবে কিনা। উত্তর দেয়ার আগে একটু চিন্তা কররে নাও, আমি গভীর রাতে সহসা কমান্ড বাহিনীকে এমন স্থানে আক্রমণ করার জন্য পাঠাবো, তাদেরকে হয়তো পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে, নদী পার হতে হবে, বরফ ও বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে যেতে হবে।’

‘আমি আপনাকে এই আশ্বাস দিতে পারি, আমার সৈন্যরা আপনার হুকুমে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়তে বললে তাই পড়বে, উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বললে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে। তারা জানে, আপনি যে হুকুম দেবেন তা ইসলামের কল্যাণের জন্যে, আর ইসলামের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তারা আপনার পতাকার তলে সমবেত হয়েছে।’

‘তুমি যা বললে তার কতটা বাস্তব আর কতটা কল্পনা?’

সেনাপতি তাওফিক জাওয়াদ বললেন, ‘এর পুরোটাই বাস্তব ও সত্যি। তার প্রমাণ তারা আপনার প্রতি আস্থাশীল বলেই স্বয়ং খলিফার হুকুমকে অগ্রাহ্যও অমান্য করেছে। এখনও এ জন্যই তারা আমার সঙ্গে রয়েছে। ইচ্ছে করলেই তারা খলিফা আস সালেহর সাথে পালিয়ে যেতে পারতো, কিন্তু তারা যায় নি। এতেই প্রমাণ হয়, আমার সৈন্যরা যুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভালোভাবেই, বোঝে কি করলে মিল্লাতের কল্যাণ ও মঙ্গল হবে।’

‘হ্যাঁ, সৈন্যদের মধ্যে ইসলামী জোশ ও প্রেরনা অটুট থাকলে তারা জ্বলন্ত মরুভূমি, জমাট বরফ, এমনকি সমুদ্রের পানির উপরও যুদ্ধ করতে পারে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আল্লাহর সৈন্যদের গতি রোধ করতে পারে এমন কোন শক্তি নেই পৃথিবীতে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, তাদের ঈমান হতে হবে মজবুত, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা হতে হবে অনড়, অটল। যে ঈমান সম্বল করে বদরের প্রান্তরে সমগ্র আরবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাহাবীরা, আমাদের সহায় সেই আল্লাহ। আমরা যদি সে ঈমান সম্বল করতে পারি, নিশ্চয় সে বিজয়ও আল্লাহ আমাদের দেবেন।’

তিনি সমবেত কমান্ডার ও সেনাপতিদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘ইতিহাস হয়তো আমাকে পাগল বলবে কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়তে পারবো না। ডিসেম্বর মাসেই যুদ্ধ হবে। সে সময় শীতকাল মাত্র শুরু হবে। পাহাড়ের রং ও হয়ে যাবে সাদা। হিমেল বাতাস বইবে। রাতে কাঁপানো শীত পড়বে। তোমরা কি আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারবে?’

সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো, ‘আমরা সুলতানের প্রতিটি আদেশ বিনা প্রশ্নে, বিনা প্রতিবাদে মেনে চলব।’

সুলতানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এরপর তিনি এমন সব আদেশ দিলেন যার মধ্যে আবেগের ছিটেফোটাও ছিলো না। তিনি বললেন, ‘আজ রাত থেকেই প্রতিটি সৈনিক ও সেনাপতি ও সেনাপতি খালি গায়ে শুধু পরণের বস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে শুরু করবে। এশার নামাজের পর সৈন্যরা খালি গায়ে ঝিলের মধ্যে নেমে মার্চ করবে। আমি তোমাদের প্রশিক্ষণের প্রাথমিক পরিকল্পনা বলে দিচ্ছি। ডাক্তার ও চিকিৎসকরা সৈন্যদের সাথে থাকবে। সৈন্যরা অসুস্থ হয়ে পড়লে, তাদের সর্দি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে ডাক্তাররা সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত সৈনিককে গরম কাপড় ও ঔষুধ দিয়ে সুস্থ করে তুলবে।

আমি আশা করি আস্তে আস্তে অসুখের মাত্রা কমে যাবে। সহ্য শক্তি বেড়ে যাবে সৈনিকদের। ডাক্তাররা সারাদিন সৈন্যদের দেখাশোনায় ব্যস্ত থাকবে। প্রয়োজনে আমি মিশর থেকে আরো অভিজ্ঞ হেকিম নিয়ে আসবো। এভাবেই এখন থেকে শীতকালীন যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ চলতে থাকবে।’

১১৭৪ খৃস্টাব্দের নভেম্বর মাসের শুরু। বেশ কিছুদিন ধরেই শীত পড়তে শুরু করেছে। রাতে শীতের তীব্রতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একদিন সুলতান আইয়ুবী রাতের ট্রেনিংয়ের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।

সমাপনী অনুষ্ঠানে সেনাপতি ও কমান্ডারের সামনে সংক্ষিপ্ত ভাষণ রাখলেন তিনি। বললেন, ‘আমার সামরিক ভাই ও বন্ধুগণ! এখন তোমরা যে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতে যাচ্ছো তাদের দেখে তোমাদের তলোয়ার খাপমুক্ত হতে ইতস্তত করবে। কারণ, তোমাদের মতোই তোমাদের শত্রুরা আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে তোমাদের সামনে আসবে। তাদের পতাকাতেও তোমাদের পতাকার মতো চাঁদ তারা যুক্ত থাকবে। তারাও তোমাদের মতো কলেমা পাঠ করবে।

তোমরা তাদেরকে মুসলমান বলে দাবি করলেও তারা আসলে ইসলামের দুশমন। তাদের কোমরে তোমরা দেখতে পাবে খ্রিস্টানদের কোষবদ্ধ তলোয়ার। তাদের ধনুকে থাকবে খ্রিস্টানদের দেয়া তীর। তোমরা ধর্মের অনুসারী আর তারা ধর্ম ব্যবসায়ী। তাদের স্বঘোষিত সুলতান আস সালেহ বায়তুল মালের সোনা, রুপা এবং অর্থ সম্পদ সব সঙ্গে নিয়ে গেছে। সে এ অর্থ দিয়ে ত্রিপোলীর খ্রিস্টান শাসকের বন্ধুত্ত ক্রয় করেছে। খ্রিস্টনদের সহায়তা নিয়ে সে স্বপ্ন দেখছে তোমাদের পরাজিত করার। খোদা না করুন, সে সফল হলে পরাজিত হবে তোমরা। তোমাদের এ পরাজয় শুধু তোমাদেরই পরাজয় হবে না, এ পরাজয় হবে মিল্লাতের, এ পরাজয় শাশ্বস্ত ইসলামের।

আস সালেহ যে অর্থ দিয়ে খ্রিস্টানদের বন্ধুত্ত ক্রয় করেছে সে অর্থ তার নয়, সে অর্থ তোমাদের, সে অর্থ মুসলিম মিল্লাতের। জাতির কষ্টার্জিত অর্থ, বিত্তবানদের যাকাতের টাকা সে খরচ করছে শরাব ও বিলাসিতায়, খরচ করছে বন্ধুত্ত ক্রয়ের কাজে। তোমরা কি জাতীয় অর্থ অপচয়কারীকে খলিফা বলে মেনে নিবে?’

সকলের সম্মিলিত ‘না! না!’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো।

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি যে নীতিতে আমার সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করতে চাই, সেই নীতির মৌলিক কথা হলো, শত্রুর আক্রমণের অপেক্ষায় তোমরা তোমাদের ঘরে বসে থাকবে না। এটা কোন নিয়ম নয়, শত্রু তোমাকে আক্রমণ করবে আর তুমি কেবল সে আক্রমণ প্রতিরোধ করে যাবে।’

আল কুরআন যুদ্ধের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা ঘোষণা করেছে তা হলো, ‘যুদ্ধের মুখোমুখি হলে প্রাণপণ লড়াই করবে। যখন যুদ্ধ থাকবে না তখন সব সময় যুদ্ধের অস্ত্র ও বাহন নিয়ে প্রস্তুত থাকবে। যদি সংবাদ পাও, শত্রু তোমাদের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে চেষ্টা নস্যাৎ করে দিবে। স্মরণ রেখো, যে মুসলমান নয় সে তোমার বন্ধুও নয়। শত্রুকে যে বন্ধু মনে করে তার মতো আহম্মক দুনিয়ায় আর কেউ নেই।’

দ্বিতীয় নীতিমালা হলো, মুসলিম সাম্রাজ্যের অতন্দ্র প্রহরী ও জাতীয় সম্মান ও ইজ্জতের রক্ষক মুসলিম ফৌজ। যদি শাসকশ্রেণী নির্লজ্জ ও বিপথগামী হয়ে যায়, অন্যায় ও অবৈধ কাজে লিপ্ত হয়ে ধ্বংসের পথে ধাবিত হয়, আর সে সুযোগে শত্রু বিজয়ীর বেশে তোমাদের ওপর কর্তৃত্ত করার আশংকা দেখা দেয়, তখন তাদের প্রতিরোধ করার দায়িত্ব মিল্লাতে ইসলামিয়ার। এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার জন্য জাতির প্রতিটি সদস্যকে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু বিশেষভাবে এ দায়িত্ব বর্তাবে সেনাবাহিনীর উপর।

যদি তোমরা এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হও তবে পরবর্তী প্রজন্ম তোমাদের দুর্বল ও অযোগ্য বলে অভিহিত করবে। সরকারের ব্যর্থতা ও তাদের দোষক্রুটির জন্য যদি কোন জাতির ক্ষতি হয় তবে তার জন্য প্রথমেই দায়ী হয় সেনাবাহিনী। কারণ, জাতি সেনাবাহিনীর উপরই তাদের নিরাপত্তা ও জানমালের হেফাজতের জিম্মা সোপর্দ করে নিশ্চিন্তে ঘুমুতে চায়। এর জন্যই তারা সেনাবাহিনীর ভরণ-পোষণের খরচ বহন করে। জাতির এতো বড় জিম্মা নিয়ে সাধারণ মানুষের মত ঘুমিয়ে থাকার কোন অধিকার নেই সেনাবাহিনীর কোন সদস্যের।

জয় পরাজয় যুদ্ধের ময়দানেই হয়। আমরা জানি, সরকারের স্বার্থপরতা ও বিলাসিতা সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেয় এবং জাতিকে বিপদগামী করে ফেলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমস্ত পরাজয়ের গ্লানি সেনাবাহিনীর কাঁধেই চাপিয়ে দেয়া হয়। যে সরকার জাতির স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না, সেনাবাহিনীর আনুগত্য পাওয়ার কোন হক নাই তার। তাহলে তোমরা কিসের জন্য অপেক্ষা করছো? জনগণের স্বার্থ লুন্ঠনকারী অবৈধ ও লুটেরা সরকারকে উতখাত না করে কেন তোমরা জনগণের অভিশাপ কুড়াচ্ছো?’

এ অথর্ব সরকার আমাদের জাতীয় জীবনের ক্ষতি ও সর্বনাশ করছে। আমি এ সর্বনাশ চোখ বুঝে সহ্য করতে পারি না। তাই আমি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছি। জানিনা এর ফলাফল কি হবে, কেমন হবে। শুধু জানি, একটা তুমুল যুদ্ধ হবে। হয় আমরা জিতবো, নয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবো, কিন্তু কিছুতেই গোলামীর শিকল পড়বো না।

এ যুদ্ধকে আমি কঠিন লড়াই বলছি এ জন্য যে, আমি তোমাদের প্রচন্ড শীতের মধ্যে যুদ্ধের ময়দানে ঠেলে দিচ্ছি। তাছাড়া তোমাদের সৈন্য সংখ্যাও কম। এই ঘাটতি তোমাদেরকে পূরণ করতে হবে ঈমানী শক্তি ও শাহাদাতের তামান্না দিয়ে।’

সুলতান আইয়ুবী তাদের আরো বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যদি শত্রুদের গোয়েন্দা থাকে তাদের কিভাবে শনাক্ত করবে এবং তাদের নিয়ে কি করবে সে সম্পর্কে তোমাদের আগেই বলেছি। এখন শুধু বলতে চাই, এ দিকটির প্রতি সব সময় সজাগ ও সচেতন থাকবে।’