» » সর্প কেল্লার খুনী

বর্ণাকার
🕮

‘তোমরা এ কথা বিশ্বাস করো না যে, সুলতান আইয়ুবী মুসলমান! পয়গম্বরের পরেই খলিফার কদর। সেই খলিফার বিরুদ্ধে যে অস্ত্র ধরে সে মুরতাদ। নাজমুদ্দিন আইয়ুবীর বেটা সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মুরতাদ হয়ে গেছে। সে খলিফাকে তার মহল থেকে বের করে দিয়েছে। সিরিয়ার ওপর জবর দখল নিয়েছে। সে এখন মিশর ও সিরিয়ার ওপর তার একচ্ছত্র বাদশাহী দাবী করছে। সে আমাদের ধর্মীয় নেতাদের শ্রদ্ধা করে না, পীর মাশায়েখদের বিরোধিতা করে। তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছো, সে সর্প কেল্লার পীরকে গ্রেফতার করেছে।

যদি তোমরা আল্লাহর অভিশাপ থেকে বাঁচতে চাও, তবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতে হবে। খলিফাকে তাঁর সম্মান ও মর্যাদাসহ তাঁর সিংহাসনে আবার বহাল করতে হবে।’

হলবের ময়দানে খলিফার সৈন্যদের সামনে এই বক্তৃতা করছিলেন একজন আমীর। তিনি সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সৈন্যদের উত্তেজিত করতে চাচ্ছিলেন।

তিনি আরও বলেন, ‘এই শীত শেষ হওয়ার আগেই আমরা দামেশকের উপর আক্রমণ করবো। এর মধ্যে আমাদের আরো অনেক সৈন্য বেড়ে যাবে। বিশাল বাহিনী নিয়ে আমরা আঘাত হানবো আইয়ুবীর উপর। তার রাজা হওয়ার লোভ চিরতরে মিটিয়ে দেবো।’

‘ব্যাপক ধবংসযজ্ঞ ও নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি না থাকলে তোমরা যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে না।’ আস সালেহের দরবারে বসে বললেন রাজা রিমান্ডের দূত। তিনি আরো বললেন, ‘আমরা আপনাদের সাথে মিলে কোন শহরে এসে যুদ্ধ করতে পারবো না। মিশর থেকে সুলতান আইয়ুবীর জন্য যে সাহায্য আসবে আমরা সেগুলো পথে আটকাবো, লুট করে নেবো এবং সুযোগ পেলে সুলতান আইয়ুবীর সাহায্যে আসা বাহিনীকে অবরোধ করে রাখবো। আপনারা সৈন্যরা দামেশকের ওপর আক্রমণ চালাবে।’

‘আপনারা এটুকু সাহায্য করলেই চলবে। সুলতানের মোকাবেলা করার জন্য আমাদের বাহিনীই যথেষ্ঠ।’

‘আমার প্রস্তাব হচ্ছে, শীতকাল পার করে আপনার যুদ্ধ যাত্রা করুন। শীতকালে আপনাদের জন্য যুদ্ধ করা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের জন্যও তা কঠিন হবে।’

‘আমরাও প্রায় তেমনটিই ভাবছি। শীত শেষ হয় হয় অবস্থায় আমরা আক্রমণ করতে চাই, যাতে সুলতানের বাহিনীর প্রস্তুতির আগেই আমরা তাদের ধরাশায়ী করতে পারি।’ বললেন এক উপদেষ্টা।

‘কিন্তু আমার মধ্যে একটা আশংকা কাজ করছে। আপনাদের যুদ্ধ হচ্ছে ভাইয়ে ভাইয়ে। আপনাদের সৈন্যরা না আবার আপত্তি করে বসে যুদ্ধ করতে।’

‘কি যে বলেন! আইয়ুবীকে খলিফা মুরতাদ বলে ঘোষণা করেছেন। মুরতাদের বিরুদ্ধে জেহাদের প্রেরণা নিয়েই আমাদের সৈন্যরা লড়াই করবে। এ ব্যাপারে নিয়মিত তাদের ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য আমরা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি।’

‘আরো একটি পদক্ষেপ নিতে পারেন আপনারা। বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যগুলোতে তার বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কিয়ে তুলুন। এই যুদ্ধে কুরআন ও মসজিদকে ব্যবহার করুন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে।

আমরা দেখেছি মুসলমানরা ধর্মের ব্যাপারে খুবই দুর্বল। ধর্মের নামে সহজেই তারা উত্তেজিত হয়ে উঠে। খলিফা চাইলে এ কাজে আমাদের সাহায্য নিতে পারেন।

আমাদের বাইবেল সোসাইটির মত একটি কোরআন সোসাইটিও আমরা আপনাদের গড়ে দিতে পারি। যার নেপথ্যে আমরাই থাকবো, কিন্তু পরিচালনায় থাকবে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু মুসলমান আলেম। এই আলেমদের তত্ত্বাবধানে মাঠে ময়দানে যারা কাজ করবে তারা এর মূল কলকাঠি নাড়াচ্ছে, কোত্থেকে নাড়াচ্ছে, কিছুই জানতে পারবে না। তারা সরল মনে ইসলামি জযবা নিয়ে ঘুরে ঘুরে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাবে।

কোরানের দোহাই দিয়ে তারা বলবে, খলিফার বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিলে ইসলাম তাকে মুরতাদ বলে। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল এই মুরতাদদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য বলেছেন। আইয়ুবী খলিফার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে মুরতাদ হয়ে গেছে। এই মুরতাদের হাত থেকে যারা জাতিকে বাঁচাতে চান, অবিলম্বে জেহাদের খাতায় নাম লেখান তারা।’

‘কিন্তু এতে কি লোকেরা আমাদের দলে নাম লিখাবে?’

‘আপনাদের দলে কতজন নাম লেখালো সেটা বড় কথা নয়, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে আইয়ুবী। ঈমানদার মুসলমানরাও তাকে বিশ্বাস করবে না, তার দলে নাম লেখাবে না, এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কি চান।’

‘আইয়ুবী নিজেকে ইসলামের রক্ষক বলে দাবী করছে। তার ডাকে যেন জনগণ সাড়া না দেয় সে জন্য ইসলামের রক্ষক সাজতে হবে আপনাদের। তখন কে যে ইসলামের রক্ষক আর কে নয়, এই নিয়ে জনগণ পড়বে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। এই দ্বন্দ্বের কারণে আইয়ুবীর ডাকে সাড়া দেবে না জনগণ। আপনারা চাইলে এই তৎপরতা আমরা দামেশকেও দেখাতে পারি।’

‘আপনার বুদ্ধি দেখে আমার মাথা লজ্জায় হেট হয়ে গেছে। প্রায় পাঁচ মাস ধরে চেষ্টা করেও আমাদের খুনি গ্রুপ সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে পারলো না। আপনি যে পথ বাতলেছেন এতে তো সে খুন হয়ে যাবে!’ ফেদাইন খুনি দলের মুরশিদ পীর শেখ মান্নানের কন্ঠ থেকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ঝরা পড়লো।

‘আরে খুন নয়, এ যে খুনের বাড়া!’ বললো খলিফার এক উজির।

বৈঠকে খুনি চক্র ফেদাইন গ্রুপের নেতা মান্নান জানালো, ‘সুলতান আইয়ুবীকে হত্যার জন্য যাদের পাঠিয়েছিলাম তাদের প্রচেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ব্যর্থই হয় নি, তাদের দুজন নিহত হয়েছে, বন্দী হয়েছে তিন জন। হাসান বিন সাবাহের আত্মা এখন আমার কাছে এর জন্য জবাবদিহি চাচ্ছে।’

‘তোমরা কি তাকে বিষ প্রয়োগেও হত্যা করতে পারলে না? গোপনে কোথাও থেকে তীরের নিশানাও বানাতে পারলে না? তোমরা এতই আনাড়ি, এতই ভীতু?’ দূত ফেদাইন নেতা মান্নানকে তিরস্কার করলো।

মান্নান নত মস্তকে বললো, ‘জানিনা ওরা শপথের কথা ভুলে গেছে কিনা? এত ট্রেনিং দিয়ে, এতসব কায়দা কানুন শিখিয়ে যাদের পাঠালাম তারা সব কি করে এমনভাবে ব্যর্থ হলো বুঝে আসে না। জানিনা, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী জীবিত আছেন এ কথা আর কতদিন শুনতে হবে?’

‘তিনি আর বেশী সময় জীবিত থাকবেন না।’ নেতার আক্ষেপ শুনে একজন ফেদাইন কর্মী বললো। সাথে সাথে সায় জানালো তার সাথীরাও।

সুলতান আইয়ুবীর অবশিষ্ট সৈন্যরা মিশরেই অবস্থান করছিল। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল সুলতানের ভাই আদিল। সুলতান আইয়ুবী তাকে হুকুম দিলেন দিয়ে এসেছিলেন, ‘দ্রুত নতুন সৈন্য ভর্তি করো এবং সামরিক ট্রেনিং আরো জোরদার করো।’

তিনি আল আদিলকে সুদানের ব্যাপারেও সাবধান করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘সুদানের তরফ থেকে যদি সামান্য আক্রমণও আসে তবে এমনভাবে তার মোকাবেলা করবে, যেনো আর কখনো এ ধরণের দুঃসাহস করার খায়েশ তাদের না জাগে।’ সুলতান আইয়ুবি আরও বলেছিলেন, ‘সব সময় সৈন্যদের প্রস্তুত রেখো। যে কোন সময় আমি সাহায্য চেয়ে পাঠাতে পারি।’

দামেশক্কের ব্যাপারে এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। যুদ্ধ বাঁধলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে বলা মুশকিল। পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে রাখতে হলে আরো সৈন্য প্রয়োজন। তিনি যে পরিকল্পনা করেছেন তা সফল করতে হলে সাহায্যের প্রয়োজন। শহীদ সালেহার রিপোর্ট অনুযায়ী ত্রিপোলীর শাসক রিমাণ্ড মিশর ও সিরিয়ার মধ্যে যোগাযোগের পথে বাঁধার সৃষ্টি করবে। সুলাতান আইয়ুবীর জন্য ছুটে আসা সাহায্য সামগ্রী লুট করবে তারা।

এ খবর পেয়ে সুলতান আইয়ুবী সিদ্ধান্ত নিলেন, ওরা এসে পৌঁছার আগেই প্রয়োজনীয় সাহায্য সংগ্রহ করে নিতে হবে। তাছাড়া শীতকালে যুদ্ধ করার মত ট্রেনিং দেয়ার জন্য তাদের আগে ভাগেই দামেশকে নিয়ে আসা দরকার। তিনি দীর্ঘ এক চিঠি লিখলেন ভাইকে। তারপর সে চিঠি কাসেদ মারফত পাঠিয়ে দিলেন কায়রোতে। চিঠিতে তিনি আল আদিলকে জানালেন কি পরিমাণ পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী পাঠাতে হবে সেই সাথে এও বললেন, ‘সমস্ত সৈন্য একসাথে পাঠাবে না। তাদের পাঠাবে ছোট ছোট দলে ভাগ করে। রাতে অন্ধকারে গোপনে পথ চলতে হবে তাদের। একজন অন্যজন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পথ চলবে। দিনের বেলায় কোন গোপন স্থানে বিশ্রাম করবে। যতদূর সম্ভব সাহায্য সামগ্রী গোপন রাখতে বলবে। সৈনিকদের পোশাকের বদলে ওদের পথ চলতে বলবে সাধারণ মুসাফিরের বেশে।

ছোট ছোট দলে উটের পিঠে সাহায্য সামগ্রী নিয়ে ওরা যখন পথ চলবে, তখন যেন সোজা ও বড় রাস্তায় না এসে যতটা সম্ভব সংকীর্ণ ও ঘুরপথে আসে। সন্দেহজনক কেউ পথে পড়লে তাকে ভালমত তল্লাশী করতে বলবে। জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রয়োজন মনে করলে তাকে গ্রেফতার করতে হবে।

কয়েকদিন পর। নিরাপদেই দামেশকে এসে পৌঁছতে লাগলো সাহায্য বহর। সুলতান আইয়ুবী নবাগত সৈন্যদের নৈশ ট্রেনিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। সেই সাথে আরও নতুন সৈন্য ভর্তি চলতে থাকলো।

❀ ❀ ❀

দামেশকের আশেপাশের এলাকা। এলাকাটা পাহাড়, জঙ্গল, খাল ও নালায় পরিপূর্ণ। শহরের বাইরে এক জায়গায় বহু বছরের পুরাতন এক দুর্গের ধবংসাবশেস।

এর মধ্যে অনেকদিন কোন মানুষ প্রবেশ করে নি। রাতে লোকেরা তার পাশ দিয়েও যেত না। ব্যবহারের অযোগ্য সেই দুর্গের দিকে ফিরেও তাকাতো না কেউ। সৈন্যরা সেদিকে নজর দেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করতো না। সেই পুরাতন কেল্লাকে লোকে ‘নাগু’ কেল্লা বলতো।

লোকমুখে প্রচলিত আছে, সেখানে এক জোড়া নাগ-নাগিনী বাস করে। সেই নাগ নাগিনীর বয়স নাকি প্রায় হাজার বছর। লোকমুখে আরো শুনা যায়, মহাবীর আলেকজান্ডার এই কেল্লা তৈরি করেছিলেন। আবার কেউ বলেন, ইরানের এক বাদশাহ এটা প্রস্তুত করেছিলেন। কেউ আবার একে বনি ইসরাইলীদের তৈরী বলেও মনে করেন।

এ ব্যাপারে সবচেয়ে মাশহুর কাহিনী হচ্ছে, পারস্যের এক বাদশাহ একবার এখানে এসেছিলেন। স্থানটি তার এতোই পছন্দ হয়েছিল যে, এখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণের ইচ্ছা জাগলো তার। তিনি একটি মনোরম প্রাসাদ তৈরী করালেন। তার পাশে তৈরী হলো এক কেল্লা।

কিন্তু সে মহলে বাস করার মতো বাদশাহর কোন বেগম ছিলো না। সে অভাব পূরণের জন্য তিনি একটি মেয়ে খুঁজতে লাগলেন। এক মেষ পালকের মেয়েকে তার বড় পছন্দ হলো। কিন্তু সেই মেয়ে ছিলো অন্য এক লোকের বাগদত্তা। মেয়েটিও ভালোবাসতো তাকে।

কিন্তু রাজার খায়েশ বলে কথা! তিনি মেয়ের মা-বাবাকে অগাধ ধন সম্পদ দিয়ে মেয়েটিকে কিনে নিলেন।

মেয়েটি প্রেমিক বাদশাহকে বললেন, ‘এ অন্যায় মহারাজ। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি, আপনি ওকে মুক্তি দিন।’

বাদশাহ তার কথায় কর্ণপাত করলেন না। তখন বাদশাহকে শাসিয়ে বললো, ‘এই মেয়েকে নিয়ে আপনি প্রাসাদে বাস করতে পারবেন না। আমার অভিশাপ এ প্রাসাদকে বিরাণ করে ফেলবে।’

এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাদশাহ মেয়েটিকে মুক্তি দেয়ার পরিবর্তে তার প্রেমিককে ধরে নিয়ে মহলের মধ্যে হত্যা করলো। তারপর তাকে পুতে রাখলো মহলের ভেতর।

মেয়েটি বাদশাহকে বললো, ‘আপনি আমার দেহটা খরিদ করতে পারলেও আমার আত্মাকে কোনদিন বশীভূত করতে পারবেন না। আমার হৃদয় ওই যুবকের সম্পদ। সে সম্পদ আমি কাউকে দিতে পারবো না।’

প্রথম রাতে বাদশাহ যখন মেষ পালকের মেয়েকে রাজ পোশাকে সজ্জিত করে মহলের পালংকে নিয়ে গেলেন, তখন সাজানো পালংক মেঝেতে বসে গেলো। প্রাসাদের দেয়াল ও ছাদ ধ্বসে পড়ে বাদশাহ ও মেয়েটিকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিল।

বাদশাহর সৈন্যরা যখন ইট-সুড়কি সরিয়ে তাদের উদ্ধার করতে গেলো, তখন দেখলো, সেখানে কোন মানুষের হাড়গোড়ও নেই। একজোড়া নাগ-নাগিনী ফনা তুলে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। সৈন্যরা সাপ দু’টোকে মারার জন্য বর্শা ও তলোয়ার নিয়ে ছুটে গেলো। কিন্তু কোন অস্ত্রই তাদের গায়ে লাগলো না।

সৈন্যরা ভয় পেয়ে কিছুটা দূরে সরে এলো। সেখান থেকে তারা সাপ দু’টোর দিকে তীর ছুড়তে লাগলো। কিন্তু কোন তীরই তাদের গায়ে লাগলো না। সাপ দু’টোর কাছে গিয়েই তীর অন্যদিকে ফিরে যায়। এই দেখে সৈন্যরা ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলো।

এ কথাও লোকমুখে শোনা যায়, রাতে কেল্লার পাশ দিয়ে গেলে একটি সুন্দরী মেয়ে মেষের পাল চরিয়ে বেড়াচ্ছে। কখনো কখনো সেই সুন্দর যুবককেও দেখা যায়। সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে, এ কেল্লায় এখনো জীন-পরী বাস করে।

সুলতান আইয়ুবী যখন খলিফা আস সালেহ ও তার আমীরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত, সে সময় একদিন গুজব শোনা গেলো, ঐ সর্প কেল্লায় একজন বুজুর্গ পীর সাহেব এসেছেন। তিনি যদি দোয়া করেন তবে সকল রোগ দূর হয়ে যায়। আর তিনি ভবিষ্যত বাণীও করতে পারেন।

শহরে তার কেরামতির কথা এ-মুখ ও-মুখ করে সবার মাঝেই ছড়িয়ে পড়লো। কেউ কেউ তাকে ঈমাম মেহেদী বলেও উল্লেখ করলো।

লোকজন সেখানে যাওয়ার জন্য এবং হুজুরকে এক নজর দেখার জন্য খুবই উদগ্রীব। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। ওদের ভয়, হুজুর মেষ পালকের মেয়ের সেই প্রেমিক যুবক বা পারস্যের সেই বাদশাহর প্রেতাত্মা নয় তো! কেউ কেউ আবার ভাবলো, নিশ্চয় এটা জীন বা ভূতের কারবার।

কিন্তু মানুষের কৌতুহল বড় খারাপ জিনিস। এ জিনিস একবার কাউকে পেয়ে বসলে কৌতুহল নিবৃত্ত না হওয়া পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। তাই লোকজন এক পা, দু পা করে কেল্লার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কেউ কেউ দূরে দাঁড়িয়ে কেল্লের দিকে তাকিয়ে থাকতো।

একদিন তিন চার জন লোক বললো, ‘আমরা কেল্লার পাশ দিয়ে আসছিলাম, দেখলাম, একজন কালো দাড়িওয়ালা লোক সাদা পোশাক পরে কেল্লার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখেই তিনি ভিতরে চলে গেলেন।’

লোকজনের কানে হুজুরের কেরামতির কথা পৌঁছতে লাগলো। কিন্তু এমন একজনও পাওয়া গেলো না, যে সাহস করে কেল্লার ভিতরে ঢুকবে। অথবা সরাসরি হুজুরের দোয়া নিয়ে এসে এসেছে এমন কাউকে পাওয়া গেল না।

একদিন সুলতানের রক্ষীবাহিনীর এক সৈনিক তার ডিউটি শেষ করে ব্যারাকের বাইরে ঘোরাফেরা করছিলো। এ যুবক ছিলো খুব সাহসি এবং সুপুরুষ।

এই সুদর্শন যুবকের সামনে একজন নূরানী চেহারার লোক এলো, তার মুখে কালো দাড়ি, কিন্তু তা পরিপাটি ও ভালোমতো আঁচড়ানো। তার গায়ের জামাটি ধবধবে সুন্দর এবং মাথায় আকর্ষণীয় পাগড়ী। তার হাতে একটি তসবীহ এবং অনবরত তিনি তা টিপে চলেছেন।

তিনি রক্ষী বাহিনীর সেই সৈন্যের কাছে এসে থেমে গেলেন। তাকে থামতে দেখে সৈনিকটিও দাঁড়িয়ে পড়লো। তিনি রক্ষীর থুতনি ধরে মুখখানা একটু উপরে তুলে ধীরে ধীরে বললেন, ‘আমার তো ভুল হবার কথা নয়। তুমি কোথাকার বাসিন্দা বন্ধু?’

‘বাগদাদের।’ যুবক শান্ত উত্তর দিল। ‘আপনি কি আমাকে চেনেন?’

‘হ্যাঁ, বন্ধু! আমি তোমাকে চিনি। কিন্তু তুমি আমাকে চেন না।’

‘যুবক এ কথায় একটু বিস্মিত হলো এবং তার বলার ভঙ্গিতে আকৃষ্টও হলো। নূরানী চেহারার লোকটির দিকে ভালো করে তাকালো যুবক। তার দাড়ি পরিপাটি সুন্দর, পোশাক উজ্জ্বল সাদা। সৈনিকটি তাকে একজন দরবেশ বলে ধরে নিল।

লোকটির চোখে কেমন নেশা ধরানো আলো, যুবক মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে সে দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো।

‘তোমার পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে কিছু জানো তুমি? তারা কে ছিলেন, কি ছিলেন?’ জিজ্ঞাসা করলেন হুজুর।

‘না।’ সৈনিক জবাব দিলো।

‘তোমার দাদাকে দেখেছো?’

‘না!’

‘তোমার বাবা জীবিত আছেন?’

‘না।’ রক্ষী বললো, ‘আমি যখন দুগ্ধপোষ্য শিশু তখন বাবা মারা যান।’

‘এদের মধ্যে কে বাদশাহ ছিলেন? তোমার বাবা? দাদা? তোমার পর দাদা?’

‘কেউ নয়।’ রক্ষী উত্তর দিল, ‘আমি কোন রাজবংশের সন্তান নই। আমি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর রক্ষী দলের একজন সাধারণ সৈনিকমাত্র।’ আপনার দৃষ্টিভ্রম হতে পারে। আমার চেহারা আপনার কোন পরিচিত জনের মত হতে পারে।’

হুজুর যেন তার কথা শুনতেই পেলেন না, তিনি তার হাত ধরে ডান হাতের তালু গভীরভাবে লক্ষ্য করে রেখাগুলো দেখতে লাগলেন। শেষে চোখে খুশির ঝিলিক এনে, হেসে তার চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বিজ্ঞের মত বললেন, ‘আমার দৃষ্টিতে এ সিংহাসন কার, এ রাজমুকুট কার লক্ষ্য করছি? তোমার চোখে সেই রাজকীয় শান-শওকত এখনও আছে, যা তুমি দেখতে পাও না।

তোমার দাদার দেহরক্ষীর মধ্যে চল্লিশ জন যুবক তোমার মতই সুদর্শন ছিলো। আজ তুমি সেই লোকের দেহরক্ষী হয়েছো, যে তোমার দাদার সিংহাসনে জোরপূর্বক বসে আছে। তোমাকে কে বলেছে, তুমি রাজবংশের সন্তান নও? আমার বিদ্যে আমাকে মিথ্যা বলতে পারে না। আমার চোখ ভুল দেখতে পারে না। তুমি কি বিয়ে করেছো?’

‘না। তবে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে।’

হুজুর বললেন ‘তোমার এ বিয়ে হবে না।’

‘কেনো হবে না?’ উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো যুবক।

‘তোমার আত্মার মিলন অন্য কারো সাথে লেখা আছে।’ হুজুর বললেন, ‘কিন্তু সে এখন কোথাও বন্দী।’

রক্ষী যুবক হুজুরের এ কথায় আরো হতভম্ব হয়ে গেলো। সে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে রইলো হুজুরের দিকে।

‘শোন বন্ধু! তুমি এখন মজলুম। কারোর প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে আছো, তুমি বিভ্রান্ত হয়ে আছো। তোমার ধনরত্নের ওপর সাপ বসে পাহারা দিচ্ছে। সে আসলে সাপ নয়, এক রাজকুমারী। সে তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। সেটি ঠিক কোন জায়গা আমি চিনতে পারছি না। যদি কখনও কেউ তোমাকে বলে দেই তার সন্ধান, তুমি জীবন বাজী রেখে তাকে মুক্ত করতে চলে যেও।’

হুজুর কথা বন্ধ করে আবারো তার দিকে তাকিয়ে খুশির ঝিলিকমারা একটি হাসি দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন।

নূরানী চেহারার সেই দরবেশের ছবি গেঁথে রইল যুবকের মনে। কিছুক্ষণ তার কোন হুশ ছিলো না। হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসতেই সে দৌড়ে গিয়ে হুজুরকে থামালো।

‘আপনি আমাকে বলে জান, আমার হাতে, আমার চোখে, আপনি আসলে কি দেখেছেন? আপনি কে? কোত্থেকে এসেছেন আপনি? আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করে, আমার চিত্তকে অশান্ত ও চঞ্চল করে কোথায় চলে যাচ্ছেন?’

‘আমি কিছুই নই।’ হুজুর বললেন, ‘যা কিছু অলৌকিক ক্ষমতা দেখছো, সবই তো আল্লাহ পাকের জাত। তিনি চারটি পবিত্র আত্মা আমাকে দান করেছেন। এগুলো আল্লাহর বড় নেক বান্দাদের আত্মা, যারা অতীতের সংবাদ বলতে পারে, ভবিষ্যতের খবরও বলতে পারে।

আমি প্রতিদিন অজিফা পাঠ করি। একদিন ধ্যান তন্ময় হয়ে অজিফা পাঠ করছি, হঠাৎ মনে হলো আমি আমার পরিচিত জগতে নেই। আমি চোখ মেললাম। এমন এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের জগতে আবিষ্কার করলাম নিজেকে, যা কোনদিন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

আল্লাহর ইশারায় আমি আবার অজিফায় মগ্ন হয়ে গেলাম। তখনই এ আত্মাগুলো পেয়ে গেলাম আমি। এ আত্মাগুলো যখন আমার উপর ভর করে তখন আমি অনেক কিছু বলে দিতে পারি। তখন আমার মধ্যে এক সম্মোহনী শক্তি কাজ করে যে, মানুষের চেহারা ও চোখের দিকে তাকালে তাদের বাপ-দাদা ও পরদাদার ছবিও দেখতে পাই। কিন্তু এই অবস্থা আমার মধ্যে সবসময় থাকে না, মাঝে মধ্যে আসে।

যখন আমি তোমাকে দেখলাম, তখন আমি সেই সম্মোহনী অবস্থাতে ছিলাম। কানের মধ্যে ফিসফিস ধ্বনি শুনতে পেলাম, ‘ঐ যুবকটাকে দেখো, সে একজন শাহাজাদা! রাজকুমার! কিন্তু সে তার ভাগ্যলিপি থেকে অজ্ঞাত। সে তার অতীত ভবিষ্যত কিছুই জানে না। এখন সে এক সাধারণ সৈনিকের বেশে অপরের রক্ষী হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

যুবক, সত্যি কথা বলতে কি, এখন আর আমার মধ্যে সে মোহময় অবস্থা নেই। সে অবস্থা কেটে গেছে আমার। এখন তোমাকে আমি শুধু এক সৈনিকই দেখতে পাচ্ছি।’

মানুষের এ এক প্রাকৃতিক দুর্বলতা যে, প্রত্যেক মানুষই অর্থ-সম্পদ, মান সম্মান ও প্রতিপত্তির স্বপ্ন দেখে। এই যুবক যখন অর্থ-সম্পদ ও রাজকুমারীর একটু ইশারা পেলো তখন তা পাওয়ার জন্য তার মনে আকাঙ্খ্যার জন্ম হলো।

হুজুর একটু হেসে বললো, ‘আমার জ্যোতিষীর কোন বিদ্যে নেই, আমি কোন ভবিষ্যত বক্তাও নই। আমি শুধু এক আল্লাহ ভক্ত দরবেশ মাত্র। যদি আবার আমার মধ্যে সেই সম্মোহনী শক্তি ভর করে, আমি চেষ্টা করবো তোমার সম্পর্কে আরো কিছু জেনে নিতে। কিন্তু তোমাকে সে কথা জানাবো কি করে? তোমাকে কোথায় পাবো?’

‘আপনি কষ্ট করে আমাকে সংবাদ দিবেন এমন কথা বলে আমাকে গোনাহগার বানাবেন না। আপনাকে কোথায় পাবো বলেন, আমিই আপনার সাথে দেখা করবো।’

‘আমি যেখানে আসতে বলবো তুমি কি সেখানে আসতে পারবে?’

‘হ্যাঁ, পারবো, অবশ্যই পারবো। আপনি যেখানে বলবেন সেখানে গিয়েই দেখা করবো আমি।’

‘সাপের কেল্লার মধ্যে আসতে পারবে?’

‘অবশ্যই পারবো।’

‘আজ রাতে?’

‘জ্বি।’

হুজুর বললেন, ‘গোসল করে পাক-পবিত্র হয়ে দুনিয়ার খেলার থেকে মনকে মুক্ত করে আসবে। আর মনে রাখবে, এ কথা যেন আর কেউ জানতে না পারে। আমি তোমাকে ডেকেছি ও তোমার সাথে সাক্ষাৎ করেছি, এ কথা জানাজানি হলে সেই সম্মোহনী শক্তি আর নাও আসতে পারে। রাতে অতি গোপনে তুমি সর্প কেল্লায় চলে আসবে।’