» » উপকূলে সংঘর্ষ

বর্ণাকার

উপকূলে সংঘর্ষ

আলীর গোয়েন্দা বাহিনীর তিন সদস্য ইমরান, রহিম, রেজাউল। আক্রায় এসেছিল ওরা শত্রুর গতিবিধি ও পরিকল্পনা জানতে। এরই মধ্য অনেক তথ্য ওরা সংগ্রহও করেছে। দলনেতা ইমরানের কাছে এমন কিছু তথ্য এলো যা এখনি সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবীকে জানানো দরকার। ওরা আক্রা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো, এমন সময় হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল রহিম।

যখন রহিমের রিপোর্ট করার কথা, তখন সে না আসায় তাকে খুঁজতে গিয়েছিল ইমরান। গিয়ে জানলো, যে বাড়িতে সে থাকতো এবং তার মালিকের কাজ করতো সেখান থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

কেন রহিমকে বরখাস্ত করা হয়েছে এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিল না কেউ। রহিমকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল ইমরান। একজন গোয়েন্দা যে কোন সমস্যা প্রথমে তার দলনেতাকে জানাবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু রহিম তা করেনি। কিন্তু কেন? তবে কি রহিম শত্রুর হাতে? এসব চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো ইমরানের মাথায়।

কমান্ডার হিসেবে রহিমের সন্ধান নেয়া তারই দায়িত্ব। একবার ভাবলো, রেজাউলের সাথে যোগযোগ করে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, পরস্থিতি না বুঝে রেজাউলের সাথে দেখা করতে যাওয়াও এখন ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে সে আর রেজাউলের ওখানে গেল না।

ইমরান শংকিত হলো এই ভেবে, যদি রহিম গ্রেফতার হয়েই থাকে তবে তা মারাত্বক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এই অবস্থায় চাপে পড়ে দুই বন্ধুর সন্ধান বলে দিতে পারে রহিম। তখন তাদেরও ধরা পরতে হবে। এই চিন্তায় ইমরানকে অস্থির করে তুললো।

একজন গোয়েন্দার ধরা পড়া বা মারা যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু ভয় ও চিন্তার কারণ, সে তার অন্যান্য সাথীদের নাম বলে দিলে পুরো মিশনকেই ধ্বংসের মুখে পড়ে যায়।

যে গোপন তথ্যের জন্য তারা এখানে এসেছিলো, তা তাদের হাতে এসে গেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সরে পড়া দরকার। শেষ মুহূর্তে এসে এ ধরণের একটা সমস্যা পুরো মিশনকেই শেষ করে দিতে পারে।

একদিকে আত্মরক্ষা করে নিরাপদে আক্রা থেকে বেরিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে বন্ধুকে খুঁজে বের করার কঠিন দায়িত্ব- কোনটা করবে ইমরান? কিভাবে করবে? এক সুকঠিন দায়িত্বের বোঝা তাড়া করতে লাগলো ইমরানকে।

সূর্য ডুবে যাওয়ার এখনও কিছুটা দেরী। রেজাউল আস্তাবলের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। চারটি ঘোড়া এসে আস্তাবলের মুখে থামলো। একজন আরোহী ঘোড়ার পিঠে লাশের মত একজনকে ফেলে রেখেছিল। তার সামনেই তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামানো হলো। নামানোর পর লোকটিকে দেখেই রেজাউলের শরীরের সমস্ত রক্ত ঠান্ডা হীম হয়ে গেল। এ লোক আর কেউ নয় তারই সহযোগী, বন্ধু রহিমের। তার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা।

আরোহীদের সবাইকে চেনে রেজাউল। সবাই অফিসার। রহিমকে নামানোর পর এক অফিসার রেজাউলকে ডাকলো। এই অফিসার রেজাউলকে বেশ পছন্দ করতো, তাকে ডাকতো ফ্রান্সিস বলে। অফিসারের ডাক শুনে বাস্তবে ফিরে এল রেজাউল। দৌড়ে গেল অফিসারের কাছে। কিন্তু তার পা তখন চলতে চাচ্ছিল না। সে ভাবছিল, তাকেও কি গ্রেফতার করা হবে।

‘এই চারটি ঘোড়া ভেতরে নিয়ে যাও।’ অফিসার রেজাউলকে বললো, ‘সহিসকে বুঝিয়ে দিয়ে এসে বন্দীকে ওই কামরাই নিয়ে চলো।’ রহিমকে দেখিয়ে বললো অফিসার।

রেজাউলকে যখন ফ্রান্সিস বলে ডাকলো, তখন সে ভাবলো, রহিম তাদের বিষয়ে এখনো কিছু বলেনি। এ খৃস্টান অফিসার এখনও তাকে সহিস ফ্রান্সিস বলেই জানে। এই ভেবে সে একটু সাহস ফিরে পেল।

রেজাউল অফিসারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বন্দী কে? এ লোক কি চুরি করেছে?’

‘এ বেটা সালাহউদ্দিন আইয়ূবীর গোয়েন্দা!’ তিরস্কারের ভঙ্গিতে বললো অফিসার, ‘এখন এই গোপন কুঠুরীতে পড়ে গোয়েন্দাগিরি করবে। যাও, ঘোড়া নিয়ে যাও।’

এই ফাঁকে রেজাউল ও রহিম একে অন্যের চোখে চোখ রেখে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। চোখে চোখে কথা হয় তাদের। ধরা পড়লে চোখের ইশারায় কিভাবে কথা বলতে হবে সে সংকেত তাদের আগেই ঠিক করা ছিল।

যদি কোনদিন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, পরস্পর কথাও বলতে পারবে না, তখন ইশারায় অন্যকে পালিয়ে যাওয়ার যে সংকেত দেয়ার কথা, রহিম রেজাউলকে সে সংকেত দিল। কিন্তু রেজাউল তার উল্টো অর্থ করে বসল। সে ভাবল, এখন পালিয়ে যাওয়ার সংকেত দেয়ার মানে হচ্ছে, রহিম আমাদের পরিচয় এখনো ফাঁস করেনি। ফলে সে পালিয়ে না গিয়ে রহিমকে উদ্ধার করার কোন সুযোগ সৃষ্টি হয় কিনা সে জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল।

যদিও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্য প্রচন্ড ঝুঁকি ছিল তবু সঙ্গীর কথা চিন্তা করে সে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। কারণ সে জানতো, এ ধরা পড়ার মানে কি এবং এর পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে।

বন্দীশালায় একজন গোয়েন্দার ওপর কেমন উৎপীড়ন হয় তা তার অজানা নয়। সে জানে, উদ্ধার করা সম্ভব না হলে রহিমকে এখন মরতে হবে। কিন্তু মরাটাই বড় কথা নয়, এ মৃত্যু যে কত বড় যন্ত্রণাদায়ক সে কথা ভেবেই শিউরে উঠল তার শরীর।

রেজাউল এও জানতো, রহিমকে এখন যে কামরায় রাখা হবে সেখান থেকে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হব

ইমরান গির্জা সংলগ্ন এক কামরায় অস্থির চিত্তে পায়চারী করছে আর চিন্তা করছে, রহিম নিখোঁজ হয়ে গেল কোথায়? এখন তাকে আমি কোথায় খুঁজে বেড়াবো?

এমন সময় কামরার দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। রেজাউল প্রবেশ করলো ভেতরে। সে ভেতরে এসেই দরজা বন্ধ করে, ভীত কন্ঠে ফিসফিস করে বললো, ‘রহিম ধরা পড়েছে।’

সে যেমন দেখেছে ইমরানকে সব খুলে বললো। শেষে বললো, ‘সে এখনো আমাদের কথা কিছু বলেনি।’

‘যদিও বলেনি কিন্তু টর্চার সেলে গেলেই বলে দেবে।’ ইমরান বললো, ‘সেই দোজখের নির্যাতনে মুখ বন্ধ রাখা সহজ ব্যাপার না।’

অবস্থা ভয়াবহ জটিল। এ অবস্থায় কি করা যায় তা নির্ধারনের দু’জনে পরামর্শে বসলো। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। তারা এখনই বেরিয়ে যাবে, না রহিমকে মুক্ত করার চেষ্টা করবে?

রেজাউল বললো, ‘আমাদের সামনে সংকটটি খুবই স্পর্শকাতর ও জটিল। এ মূহুর্তে সামান্য ভুল আমাদের জন্য মারাত্বক বিপদ ডেকে আনবে।’

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো এবং একটা ভুল এরই মধ্য আমরা করেও ফেলেছি। ভুলটা হলো, আমরা একটু বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। গোয়েন্দা বিভাগের কর্মীদের অসীম ধৈর্য ও সহ্যগুনের প্রয়োজন। আবেগের বশবর্তী হয়ে কিছু করা আমাদের সাজে না।’

‘যদি নিজেদের কোন সাথী বিপদে পড়ে?’

‘যদি তাকে সাহায্য করতে গেলে অন্যদেরও ফেঁসে যাওয়ার ভয় থাকে, তবে তাকে সাহায্য করতে যাওয়া বোকামী। রেজাউল, আবেগের বশে চলার সময় এটা নয়।’

ইমরানের কথায় রেজাউলের আবেগে মোটেও ভাটা পড়লো না। সে জেদের সাথে বললো, ‘রহিমের মত সুন্দর ও সাহসী বন্ধুকে বন্দী রেখে আমরা পালাতে পারি না। তাকে মুক্ত করার চেষ্টা আমি অবশ্যই চালাবো।’

‘অসম্ভব!’ ইমরান বললো, ‘এমন ভয়ঙ্কর সংকল্প ত্যাগ করো, নইলে আমরা উভয়েই বিপদে পড়বো। সবচেয়ে বড় কথা, যে তথ্যের জন্য আমরা এখানে এসেছিলাম, তা আমরা পেয়ে গেছি। সবার আগে এ তথ্য পৌঁছানো আমাদের জন্য ফরজ।’

রেজাউল বললো, ‘আমি যেখানে থাকি সেখানেই রহিমকে রাখা হয়েছে। ফলে তাকে মুক্ত করার একটা চেষ্টা করার সুযোগ আছে আমার। এ সুযোগ না থাকলে আমি কোন অনুরোধ করতাম না। আমাকে অন্তত একটা দিন সময় দাও, যদি এর মধ্য সফল না হই তবে আমার আর কোন আফসোস থাকবে না। নইলে তার মৃত্যুর জন্য আজীবন কষ্ট হবে আমার।’

‘কিন্তু তুমি কিভাবে একটা বাহিনীর মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে?’

রেজাউল বললো, ‘আমি একা ঠিকই, কিন্তু সেখানে এরই মধ্য অনেকে আমার বন্ধু হয়ে গেছে। তাদের সাহায্য আমি পাবো। যদি তার কাছে একবার পৌঁছাতে পারি, তবে তাকে মুক্ত করার পথ একটা পেয়েই যাবো আশা করি।’

‘কিন্তু যদি ব্যর্থ হও, যদি নিজেও ধরা পড়ে যাও দুশমনের হাতে?’

‘যদি আমি ধরা পড়ি, তুমি তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যাবে এখান থেকে। আমাদের মুক্ত করার জন্য বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবে না। যে তথ্য পাচার করা দরকার সেই গোপন তথ্য সবই তোমার কাছে আছে। তুমি পালাতে পারলেই আমাদের মিশন সফল হয়ে যাবে। আমি রহিমকে ছাড়া যাবো না। ওর জন্য আমাকে ছেড়ে দাও।’

ইমরান আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থাকল। রহিমের জন্য তার যে মায়া ছিল না বা কষ্ট হচ্ছিল না, তা নয়। কিন্তু কর্তব্য-চিন্তা তাকে কঠোর করে তুলেছিল। ইমরানকে দুর্বল হতে দেখে রেজাউল এবার বলল, ‘ঠিক আছে, আমার কথা শোন। রহিমের মুক্তির যদি কোন উপায় না দেখি , তবে রাতেই আমরা বের হয়ে যাবো। তুমি সজাগ থেকো, আমি তার খবর নিয়ে রাতের যে কোন সময় এসে তোমাকে রিপোর্ট করে যাবো। ওকে মুক্ত করার কোন সম্ভাবনা থাকলেই কেবল আমি অপেক্ষা করবো, নইলে তোমার সঙ্গী হবো।’

‘ঠিক আছে, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, আমি ঘোড়ার ব্যবস্থা করে রাখছি।’

রেজাউল তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। রাস্তায় পথ চলার সময়ও তার মাথায় রহিমের মুক্তির চিন্তাই কেবল ঘুরপাক খাচ্ছিল। রহিমকে মুক্ত করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। সে কোন সাধারণ চোর ডাকাত ছিল না, সে ছিল এক রাষ্ট্রীয় অপরাধী। সেনানিবাসের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বন্দী সে। কিন্তু রেজাউলের আবেগ তাকে দুঃসাহসী ও বেপরোয়া করে তুলল। আর সেই আবেগের বশে সে তার মূল দায়িত্বও ভুলে গেল।

ইমরানের দায়িত্ব ছিল ঘোড়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু ঘোড়ার ব্যবস্থা করাও সহজ হলো না। পাদ্রীর বডিগার্ডদের ঘোড়া সেখানে থাকে ঠিকই, কিন্তু পাহারাদারদের দৃষ্টি এড়িয়ে সেখান থেকে ঘোড়া চুরি করা ছিল বলতে গেলে অসম্ভব।

তখন পর্যন্ত রহিমকে কয়েদখানায় পাঠানো হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে গোয়েন্দা বিভাগের দুই পাষন্ড অফিসারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দারা ধরা পড়লে তাদের কাছ থেকে তথ্য ও গোপন কথা আদায় করাই প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সবাই জানে, গোয়েন্দারা কখনও একা থাকে না, তাদের একটি সংঘবদ্ধ দল থাকে। একজন ধরা পড়লে তার কাছে থেকেই তার সাথীদের সন্ধান পাওয়া যায়।

রহিমের কাছ থেকে এ সকল তথ্য আদায় করার জন্য তাকে এক কামরায় নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে প্রশ্ন করা হলো, ‘একজন গোয়েন্দা হিসেবে অনেক গোপন খবরই তোমার জানা থাকার কথা। বলো, আমাদের কি কি গোপন খবর তুমি সংগ্রহ করেছো?’

রহিম উত্তরে বললো, ‘আমি তোমাদের কোন গোপন বিষয়ই জানি না।’

‘বণিকের মেয়ের সাথে তোমার কেমন সম্পর্ক ছিল?’

‘আমাদের দু’জনের মধ্য গভীর ভালবাসার সম্পর্ক রয়েছে।’

‘রয়েছে নয়, বলো, ছিল। কখন তুমি এলিসাকে নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা করো?’

‘আলিসার বিয়ে এক বৃদ্ধ অফিসারের সাথে হতে যাচ্ছিল, সে কারণে সে বাড়ী থেকে পালিয়েছিল এবং আমাকেও সঙ্গে নিয়েছিল।’

‘তুমি কি জানো, তুমি কেমন করে ধরা পড়লে?’

‘না!’ রহিম উত্তর দিল, ‘আমি শুধু এটুকুই জানি, আমি ধরা পড়েছি।’

‘তুমি আরও অনেক কিছুই জানো।’ এক অফিসার বললো, ‘সব কথা বলে দাও, তোমাকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না।’

‘আমি এটুকুই জানি, আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পুর্ণ অসচেতন হয়ে পড়েছিলাম। তার ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। এখন আমি আমার পাপ ও কর্তব্যে অবহেলার শাস্তি ভোগ করবো। তোমরা আমাকে যে ধরণের কষ্ট ও শাস্তি দিতে চাও, দিতে পারো, আমি হাসি মুখেই আমার পাপের শাস্তি গ্রহন করবো।’

‘তোমার দীলে কি এখনো আলিসার জন্য ভালবাসা আছে?’

‘হ্যাঁ, এখনও আছে।’ রহিম বললো, ‘আর চিরকাল থাকবে। আমি তাকে সঙ্গে কায়রো যেতে চেয়েছিলাম, সেখানে ইসলামী বিধান মতে সংসার গড়তে চেয়েছিলাম।’

‘আমি যদি বলি, সে তোমার সাথে প্রতারণা করেছে, তুমি তা মানবে?’

‘না।’ রহিম বললো, ‘যে আমার জন্য তার পিতা-মাতা ও বাড়িঘর ত্যাগ করতে পারে, সে কখনও ধোঁকা দিতে পারে না। বরং তাকে অন্য কেউ ধোঁকা দিয়েছে।’

‘যদি আমি আলিসাকে তোমার সামনে হাজির করি, তবে কি তুমি বলবে, তোমার সাথে আক্রাতে আর কতজন এসেছে? এখন তারা কোথায় আছে?’

রহিম চুপ করে রইল, এ প্রশ্নের কোন জবাব দিল না।

তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তুমি কি বলবে, তুমি এখান থেকে কোন কোন গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছে?’

এবারও রহিম নিরুত্তর। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এক অফিসার এগিয়ে এসে তার মাথা উপরে তুলে ধরলো। রহিমের দুই চোখে তখন টলমল করছে অশ্রু।

অফিসার বারবার একই প্রশ্ন করল, কিন্তু সে এর কোন জবাব দিল না। সে অস্বীকার করে এ কথা বলল না যে, আমার কোন সঙ্গী সাথী নেই। আবার কে কোথায় আছে সে কথাও বলল না। স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিল, তার ভেতর চরম টানাপোড়েন চলছে। সে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সে এ প্রশ্নের জবাব দেবে কি দেবে না, দিলে কি দেবে ঠিক করতে পারছে না। তার চেহারা বলছিল, আলিসার জন্য এখনো সে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারবে।

‘তোমাকে শেষ পর্যন্ত আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে।’ এক অফিসার বললো, ‘আমরা চেয়েছিলাম তোমার কষ্ট কমাতে। এ জন্য তোমাকে একাধিকবার সুযোগ দেয়া হয়েছে। বার বার একই প্রশ্ন করার পরও তুমি কোন জবাব দাওনি। কিন্তু কি করে একজন বেয়াড়া গোয়েন্দার কাছ থেকে কথা আদায় করতে হয় সে কথা তোমার অজানা থাকার কথা নয়। তবু যখন তুমি কথা বলছো না, বাধ্য হয়ে আমাকে সে পথই ধরতে হবে। শেষ পর্যন্ত তুমি যখন একটি হাড় ও মাংসের স্তুপ হয়ে যাবে তখন আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না। তুমি বাঁচবে কি মরবে আমার সে চিন্তা করার দরকার নেই। তবে যদি এখনো উত্তর দিয়ে দাও, তবে অনেক কষ্টের হাত থেকে বেঁচে যাবে তুমি। আর আলিসার কথা যদি জানতে চাও তো বলি, আলিসা চায় না তুমি এত তাড়াতাড়ি দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যাও। তোমার সাথে এই যে ভাল ব্যবহার করা হচ্ছে এটাও অনেকটা আলিসার জন্যই।’

‘রাজ সাক্ষীকে ক্ষমা করার একটা বিধান দুনিয়া জোড়াই চালু আছে। ইচ্ছে করলে সে সুযোগ তুমি নিতে পারো। তাহলে আলিসার একটা ইচ্ছা পূরণ করার অবকাশ পাবো আমরা। তোমাকে নিয়ে ঘর বাধার যে স্বপ্ন আলিসা দেখছে, তার সে স্বপ্ন পূরণ হবে। আলিসাকে যদি তুমি চাও তবে সে সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।’

অফিসার বলে চললো, ‘এটা কয়েদখানা নয়। তুমি এখন একজন অফিসারের কামরায় আছো। যদি তুমি চিন্তা করার সময় চাও তবে আজ রাত তোমাকে এখানেই রাখা হবে।’

রহিম নিরব, নিস্তদ্ধ। বোবা চোখ মেলে সে ফ্যালফ্যাল করে অফিসারের দিকে তাকিয়ে রইল।

অফিসারদেরও তেমন ভয় ছিল না যে, সে পালিয়ে যাবে। উঠানে ও সামনে সব সময় পাহারাদার থাকে। তাছাড়া সামরিক এলাকার কড়া পাহারা থেকে পালিয়ে ও যাবেই বা কোথায়?

এক অফিসার তার সঙ্গীকে বললো, ‘কেন তুমি অযথা সময় নষ্ট করছো। একে গোপন ঘরে নিয়ে যাও। লোহার উত্তপ্ত শলাকা তার গায়ে লাগাও, দেখবে সে সব কথাই গড়গড় করে বলে দিচ্ছে। যদি তাতেও কাজ না হয় তবে ক্ষুধা ও পিপাসায় ফেলে রেখো দু’একদিন।’

অন্য অফিসার তাকে ইশারায় কামরার বাহিরে আসতে বললো। দুজনই বাইরে এলে সে বললো, ‘আমার পরীক্ষা অন্যরকম বন্ধু। এ কথা ভুলে যেওনা, এরা মুসলমান। তুমি এ পর্যন্ত কতজন মুসলমানের কাছ থেকে গোপন তথ্য বের করেছ? তুমি কি জান, এই কমবখত জাত একবার যদি মুখ বন্ধ করে তবে মরে যাবে, তবুও মুখ খুলবে না। এ বেটা তো বলেই দিয়েছে, সমস্ত উৎপীড়ন ও শাস্তি তার গোনাহের সাজা হিসেবে গ্রহন করে নিবে।’

‘এ বেটা দেখছি পাকা মুসলমান!’

‘হ্যাঁ, একে টর্চার সেলে নিলেও সে বলবে, আমি কিছু জানি না। আমার উদ্দেশ্য ওকে হত্যা করা নয়, আমার শুধু জানা দরকার, তার সাথীরা কে কোথায় আছে? আর জানা দরকার, মিশরে আমাদের আক্রমণ করার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সে তথ্য সে জানে কি না।’

‘ওর বাবারও তা জানা সম্ভব নয়।’ অন্য অফিসার বললো, ‘হাইকমান্ডের মুষ্টিমেয় অফিসার ছাড়া এ বিষয়ে আর কেউই অবগত নয়। এই গোয়েন্দা বণিকের মেয়ের ভালবাসায় বন্দী হয়ে আছে, তার তো দুনিয়ার আর কোন খবরের দরকার নেই। আমার তো এ কথাও বিশ্বাস হচ্ছে না, আলিসাই তাকে গ্রেফতার করিয়েছে। কারণ, সে এখনও এই উজবুকের প্রেমে পাগল হয়ে কান্নাকাটি করছে।’

অফিসার তাকে নিয়ে কামরার বাহিরে এল। বললো, ‘বুদ্ধু, আলিসাকেই আমি এ ব্যাপারে ব্যবহার করতে চাই। আলিসাকে আজ এই কামরাতেই এনে রাখা হবে। আমি আশা করি, যে গোপন রহস্য আমরা কয়েকদিন চেষ্টা করেও স্বীকার করাতে পারবো না, আলিসার মত যুবতী মেয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেই গোপন খবর জেনে নিতে পারবে।’

‘একটা মেয়ের উপর এতটা ভরসা করা কি ঠিক হবে?’ সন্দেহের সুর সঙ্গী অফিসারের কন্ঠে।

‘এখনও তোমার মনে সন্দেহ কাজ করছে। শোন, তুমি তো এখনও সব কথা শোনইনি। আলিসা ফিরে এসে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা জানতে পারলে বুঝতে, আলিসা কতটা কাজের। এ বন্দীর কাছ থেকে কথা বের করার দায়িত্ব যেহেতু আমাদের দু’জনের, তাই সব কথা তোমার জানা দরকার।

আলিসা ঐ লোকটাকে গভীরভাবে ভালবাসতো। একজন নির্যাতীত খৃষ্টান ও উদ্বাস্তু পরিচয়ে লোকটা তাদের কাছে আশ্রয় নেয়। পরিচয়ের সময় এ যুবক তার নাম বলে, ‘ইলিমোর’।

আলিসার বাবা কমান্ডার ওয়েস্ট মেকর্ডের সাথে মেয়ের বিয়ে পাকা করলে মেয়ে ওই বিয়েতে বেঁকে বসে। কমান্ডার মেকর্ডকে আলিসা ‘বুড়ো ভাম’ বলে গালি দেয় এবং অপমান করে।

বাপ চাচ্ছিল কমান্ডারকে মোটা ঘুষ হিসেবে কন্যা দান করতে। কিন্তু সুদর্শন যুবক ইলিমোরের প্রেমে পড়ে মেয়ে তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে বসল।

মেকর্ড যুবককে খুন করার হুমকি দিলে ঘটনা জটিল আকার ধারণ করে। নিরুপায় হয়ে ওরা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পালিয়ে যাওয়ার সময় যুবকটি যখন অনুভব করল, এখন আর ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই, তখন রাতে বিশ্রামের সময় সে তার আসল পরিচয় ফাঁস করে দেয় আলিসার কাছে। আলিসাকে সে বলে, ‘আমি ইলিমোর নই, আমার নাম রহিম। আমি একজন মুসলমান এবং আইয়ুবীর গোয়েন্দা।’

আলিস মনে করেছিল, ইলিমোর তামাশা করছে। কিন্তু এ যুবক তাকে বিশ্বাস করায়, সে মোটেও হাসি তামাশা করছে না, বাস্তবিকই মুসলমান এবং তার নাম রহিম।

রহিম জানতো না, আলিসার মনে মুসলমানদের প্রতি প্রচন্ড ভয় এবং ঘৃণা জমা হয়ে আছে। খুব শিশুকাল থেকেই এই ভীতি ও ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল তার মনে। রহিমের এ কথাও জানা ছিল না, সে একজন অন্ধ খৃষ্ট ভক্ত ও খৃষ্ট ধর্মের একনিষ্ট অনুসারী। তার ধর্মপ্রীতি এত প্রবল যে, এ জন্য সে দুনিয়ার সব কিছু ত্যাগ করতে পারে।

আলিসা যখন বুঝলো, তার প্রেমিক তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, তখন তার হৃদয়ে ভয়ের এক শিহরণ বয়ে গেল। তার মনে হলো, যে লোক ভালবাসার নামে প্রতারণা করতে পারে, সে লোক পারে না এমন কোন অপকর্ম নেই। এ ধরণের লোক কখনো বিশ্বস্ত হতে পারে না।

এ লোক একবার তাকে কায়রো নিয়ে যেতে পারলে তার ভাগ্যে কি ঘটবে কল্পনা করে শিউরে উঠল আলিসা। সে শুধু নিজেই তাকে ভোগ করবে, অন্যের দ্বারা তাকে নষ্ট করবে না এর নিশ্চয়তা কি?

যে লোক তাকে মিথ্যা কথা বলে ঘর থেকে বের করতে পারে সে লোক সাধ মিটে গেলে যদি তাকে অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দেয় তাহলে কি করতে পারবে আলিসা?

শিশুকাল থেকে মন-মগজে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা ও খারাপ ধারণা জমা ছিল, সেই সব ভয়ংকর দৃশ্য আলিসার সামনে ভেসে উঠতে লাগল। প্রেমিকের বিরুদ্ধে বিষিয়ে উঠল তার মন।

আলিসার মনে মুসলমান প্রেমিকের চেয়ে ধর্মের প্রতি ভালবাসা প্রবল হয়ে উঠল। রাতে তার প্রেমিক ঘুমিয়ে গেলে ঘৃণাভরে তাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে এল আলিসা।

তার মনে তখন প্রতিশোধের দাউ দাউ আগুন। প্রতিশোধ স্পৃহায় তার চেহারা তখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। সে এ কথা একবারও ভাবল না, আক্রা ফিরে গেলে তার বাবা তার সাথে কেমন ব্যবহার করবে? ভাবল না, সেই বুড়ো অফিসার আবার হামলে পড়বে তাকে বিয়ে করার জন্য। তার মনে তখন একটাই চিন্তা, একটাই শপথ, যে করেই হোক মুসলমানদের অনিষ্ট করতে হবে। সর্বাবস্থায় তাদের শত্রু মনে করতে হবে। ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য ক্রুশের নামে শপথ নিল সে।

আলিসা ছিল খুব সাহসী ও চতুর মেয়ে। পালাবার ব্যাপারে সে এক নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরী করল। রহিমকে তার মনোভাব কিছুই জানতে না দিয়ে সেও শুয়ে পড়ল তার সাথে। রহিম যখন গভীর ঘুমে মগ্ন তখন আলিসা ঘোড়ার ওপর আরোহন করে এমন চুপিসারে পালিয়ে আসে যে, রহিম তার কিছুই টের পায়নি।

যে পথে গিয়েছিল সেই পথেই ফিরে এলো আলিসা। ভোর হওয়ার আগেই আক্রা এসে পৌঁছলো। বাবার কাছে গিয়ে সব অপরাধ স্বীকার করে রহিম সম্পর্কে সব কথা বলে দিলো তাকে।

তার পিতা তখনই কমান্ডার ওয়েস্ট মেকর্ডকে এই ঘটনাটি জানালো। কমান্ডার তিনজন সৈন্য সাথে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল রহিমের সন্ধানে।

সকালে ঘুম থেকে জেগে রহিম দেখে ঘোড়াসহ আলিসা উধাও। অগত্যা সে মরুভূমি থেকে লোকালয়ে পৌঁছার জন্য পায়ে হেঁটেই রওনা দিল। কিন্তু পায়ে হেঁটে সে আর কতদুর যাবে? মেকর্ড-এর হাতে অচিরেই ধরা পড়লো সে। এখন সেই প্রেমিক গোয়েন্দা আমাদের হাতে।’

‘কিন্তু রহিম জানে না, আলিসা তাকে ধোঁকা দিয়েছে?’

‘না। এ জন্যই আমি এখন আলিসাকে ব্যবহার করতে চাই। আমি রহিমকে খুব ভাল খাবার খেতে দেবো এবং আরাম আয়েসে রাখবো যাতে সে বিভ্রান্ত হয়।’

সেনানিবাসের অফিসার্স কোয়ার্টার। সকল চাকর-বাকর ও লোকজনের মুখে একই কথা, একজন মুসলিম গোয়েন্দা ধরা পড়েছে। রেজাউলও ফ্রান্সিস পরিচয়ে সেই চাকরদের সঙ্গে আছে। অন্যদের সাথে সেও সমান তালে মুসলিম গোয়েন্দাকে গালমন্দ করে যাচ্ছে।

সে গালমন্দ করছে, আর জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে, ‘এই গোয়েন্দাকে ফাঁসি দেয়া হোক। আর তা না হলে তাকে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে ঘোড়া ছুটানো হোক।’

রেজাউল জানে রহিম এখনও সেই কামরাতেই আছে। রেজাউলের মত অন্যরাও বন্দীকে কয়েদখানায় পাঠানো হচ্ছে না দেখে আশ্চর্য হচ্ছিল। বাবুর্চীখানার এক লোক বললো, ‘কয়েদীকে আজ অফিসারের খাবার দেয়া হবে।’

যখন সে সত্যি সত্যি কয়েদীর জন্য অফিসারের খাবার নিয়ে গেলো তখন সকলেই একে অন্যের মুখের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো।

রেজাউলের বিস্ময় তখন চরমে। সে বাবুর্চীখানার লোককে এক সময় আড়ালে পেয়ে জিজ্ঞেস করে বসলো, ‘এর মানে কি? মুসলমান গোয়েন্দাকে এত জামাই আদর করা হচ্ছে কেন? যে খাবার আমাদের ভাগ্যে জুটে না সে খাবার দেয়া হচ্ছে কয়েদীকে! তবে কি এ লোক আসলে কোন গোয়েন্দা নয়?’

‘কি বলছো তুমি! তুমি তো জানো না, এ বড় ভয়ংকর গোয়েন্দা!’ চাকর তার বিদ্যা জাহির করে বললো, ‘অফিসার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, আমি নিজে তার মুখ থেকে শুনেছি, এ কয়েদীকে কেবল ভাল খাবারই দেয়া হবে না, তার জন্য নাকি রুপসী কোন মেয়েও জোগাড় করা হয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পর সেই মেয়েকে তার কামরায় পাঠিয়ে দেয়া হবে।’

‘বলো কি!’ চোখে মুখে চরম বিস্ময় ফুটিয়ে বললো রেজাউল।

‘হ্যাঁ, এই মেয়ে নাকি গোয়েন্দার পেট থেকে কথা বের করবে।’ বলল চাকর।

রহিমের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আলিসাকে নিয়ে তার কামরার দিকে এগিয়ে গেল অফিসার দু’জন। কামরার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। আলিসাও দাঁড়াল তাদের সাথে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল অফিসারের দিকে।