» » উপকূলে সংঘর্ষ

বর্ণাকার

আক্রা থেকে বের হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার হয়ে গেল। সৈন্যদের অফিসার্স কোয়ার্টারে সেনাবাহিনীরই এক অফিসারের বাগদত্তা এবং শহরের নামকরা ব্যবসায়ীর একমাত্র যুবতী কন্যার খুন হয়ে যাওয়া এবং একজন গোয়েন্দার পলায়ন, কোন সাধারণ ঘটনা ছিল না। এ নিয়ে শহরে এক তুলকালাম বেঁধে গেল। সারা শহরে সাধারণ প্রহরীদের সাথে পুলিশ এবং সেনা সদস্যরাও পাহারা ও তল্লাশীতে নেমে পড়ল।

ইমরান বলল, ‘পাহারা যত জোরদারই হোক, যত বড় বিপদই থাক মাথার ওপর, এরই মধ্যে রাস্তায় নামতে হবে আমাদের এবং এখনি।’

‘তাহলে আমরা দু’জন আলাদাভাবে যাত্রা করি, যাতে একজন ধরা পড়লে আরেকজন অন্তত মুক্ত থাকতে পারি।’

ইমরান বলল, ‘না, আমরা একত্রেই বের হবো। যদি কেউ ধরা পড়ি বা দু’জনেই ধরা পড়ি, তবে কিছুতেই গোপন তথ্য প্রকাশ করবো না। রহিমের লাশ কোথায় আছে এবং সে যে মারা গেছে, এ কথাও প্রকাশ করবো না।

‘কিন্তু ঘোড়ার কি ব্যবস্থা করেছো?’ জানতে চাইল রেজাউল।

ইমরান রেজাউলকে সেই স্থানে নিয়ে চলল, যেখানে আটটি ঘোড়া বাঁধা ছিল। কিন্তু দূর থেকেই দেখা গেল, সেখানে একজন প্রহরী পাহারা দিচ্ছে।

ইমরান রেজাউলকে এক জায়গায় লুকিয়ে রেখে একাই আগে বাড়ল। প্রহরীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ব্যাপার! হঠাৎ করে এদিকে পাহারার ব্যবস্থা!’

প্রহরী ইমরানকে জন গিন্থার নামে চিনতো এবং বড় পাদ্রীর বিশেষ খাদেম হিসেবে তাকে যথেষ্ট সম্মান ও সমীহ করতো। সে ইমরানকে বললো, ‘আজ রাতে শহরে ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে। বিকেলে এক মুসলমান গোয়েন্দা ধরা পড়েছিল। তাকে জেরা করার জন্য রাখা হয়েছিল অফিসার্স কোয়ার্টারে। রাতে সে একটি মেয়েকে খুন করে পালিয়ে গেছে। সারা শহরে তন্ন তন্ন করে তাকে খোঁজা হচ্ছে। তাই সর্বত্র এত সতর্কতা।’

এই প্রহরীর সামনে ঘোড়া খোলা সম্ভব ছিল না। ইমরান তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। রেজাউল খুক করে একটু কাশল, প্রহরী কে কাশল দেখার জন্য যেই পিছন ফিরেছে অমনি তার গলা এমন শক্ত ভাবে চেপে ধরলো ইমরান, যে আর শব্দ করতে পারলো না। রেজাউল ছুটে এসে তার খঞ্জর প্রহরীর বুকে বসিয়ে দিল। মৃত্যু পর্যন্ত ইমরান প্রহরীর গলা শক্ত করে ধরেই রাখলো।

ইমরান নিহত প্রহরীর লাশ রেখে ছুটল ঘোড়ার উদ্দেশ্যে। রেজাউলও ছুটল তার পিছু পিছু। দ্রুত দুই ঘোড়ার পিঠে জিন এটে লাফিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসল দু’জন।

গির্জার সমস্ত লোক তখনো গভীর ঘুমে। ইমরান ও রেজাউল শহর থেকে বের হওয়ার নিরিবিলি ও নির্জন এক অন্ধকার গলি পথে টহল দেয়ার ভঙ্গিতে ঘোড়া চালিয়ে বেরিয়ে এল শহর থেকে। শহরের শেষ মাথায় এসে হঠাৎ তারা একদল পাহারাদারের সামনে পড়ে গেল। ইমরান ওদের দেখেই দূর থেকে চেঁচিয়ে বললো, ‘কোন খবর পেলে? বজ্জাতটার কোন হদিস পেলে?’

তিন-চারটি মশাল দ্রুত এগিয়ে এলো ওদের দিকে। একজন বলে উঠল, ‘তোমরা কারা?’

‘আমরা কমান্ডো ইউনিটের। আসামী এদিকে আসেনি?’

‘কিন্তু তোমাদের ড্রেস কোথায়?’

‘আহাম্মক, এখন কি ড্রেস খোঁজার সময়? তোমরা এদিকে ড্রেস পরার তালে থাকো, ততক্ষণে আসামী পগাড়পার হোক উজবুক কোথাকার।’ সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চলো।’

পাহারাদারদের মশালগুলোকে পাশ কাটিয়ে ওরা সামনে বাড়তে চাইলো। দেখলো, অদুরে একদল অশ্বারোহী দাঁড়িয়ে আছে। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরো কয়েকজন। এতেই তারা বুঝতে পারলো, সারা শহরে কেমন কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ইমরান তার কাপড়ের দিকে লক্ষ্য করেনি। তার কাপড়ে নিহত সেন্ট্রির রক্ত লেগে ছিল। মশালের আলোতে এক অশ্বারোহীর চোখে পড়ল সে রক্ত। সে দ্রুত তাদের পথ আগলে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কাপড়ে রক্ত কিসের?’

মুহুর্তে ইমরান বুঝে ফেললো তারা ধরা পড়তে যাচ্ছে। সে দ্রুত ঘোড়ার লাগাম টেনে তীর বেগে ঘোড়া ছুটালো। রেজাউলও সঙ্গে সঙ্গে তার পিছনে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। কিন্তু চোখের পলকে এক অশ্বারোহী তার পথ আগলে দিল। পাশেই দাঁড়ানো অশ্বারোহীরা ছুটে এসে ঘিরে ফেলল তাকে। ইমরান বেরিয়ে যেতে পারলেও রেজাউল তাদের ঘেরাওয়ের মাঝে আটকা পড়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারজন অশ্বারোহী ইমরানের পিছু ধাওয়া করলো। সে রেজাউলের উচ্চ কন্ঠের চিৎকার শুনতে পেল, ‘ইমরান, তুমি পালাও। খবরদার পিছনে লাকাবে না, থামবে না কোথাও। আল্লাহ হাফেজ।’

ইমরানের কানে বহু দূর পর্যন্ত এই শব্দ বাজতে থাকল। এক সময় মনে হলো, সে অবরোধ মুক্ত হতে পেরেছে।

ইমরানের ঘোড়া ছিল খুবই তাজাদম, বুদ্ধিমান এবং দ্রুতগতি সম্পন্ন। এখানকার রাস্তাঘাটও ছিল তার পুর্ণ নখদর্পনে। সে তার আরোহীর বিপদ টের পেয়ে পিছু ধাওয়াকারীদের দ্রুত পিছনে ফেলে তাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। তার ডান ও বাঁ পাশ দিয়ে অসংখ্য তীর শাঁ শাঁ করে ছুটে গেলো, ভাগ্যগুনে তার একটিও আরোহী বা ঘোড়ার গায়ে লাগেনি।

ঘোড়া ইমরানকে নিয়ে ক্রাকের দিকে ছুটে চললো। ধাওয়াকারীরা এখন কত দূরে, কোথায়, বুঝার কোন উপায় নেই। কিন্তু ঘোড়া তার গতি কমালো না। তার সারা শরীর ঘামে জবজব করছে। তারও অনেক পরে ইমরান উপলব্ধি করলো ঘোড়ার গতি আস্তে আস্তে কমে আসছে। তার মনে হলো, এবার ঘোড়া বদলানো প্রয়োজন। আর বেশিক্ষণ সে চলতে পারবে বলে মনে হয় না।

ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। যখন চারদিক একদম ফকফকা ফর্সা হয়ে গেল, তখন আর ঘোড়া চলার অবস্থা রইল না।

সে পানির সন্ধান করলো, কিন্তু আশেপাশে পানির কোন উৎসই তার নজরে এলো না। সামনে উঁচু বালির পাহাড়। ক্লান্ত ঘোড়া এ পাহাড় কিভাবে অতিক্রম করবে ভাবছিল ইমরান, হঠাৎ তার সামনে দুটি তীর এসে পড়লো। তাতে সংকেত ছিল, ‘থেমে যাও’। সে থেমে গেল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই তার সামনে এসে উপস্থিত হলো একদল লোক। তাদের দেখে তার বুকে জান ফিরে এলো। সে দেখলো, যারা তার গতিরোধ করেছে তারা সবাই নিজেদের লোক।

তাকে সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। কমান্ডার তার কথা শুনে বললেন, ‘এখন কি করতে চাও?’

ইমরান বললো, ‘প্রথমে ক্রাকে গিয়ে সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর সাথে দেখা করে আক্রার অবস্থা তাকে অবগত করাবো, পরে কায়রোতে গিয়ে সুলতান সালাহউদ্দিনকে জানাবো।’

তার কথা শুনে কমান্ডার তাকে সতেজ ঘোড়া এবং সঙ্গে আরও দু’জন সৈনিক দিয়ে ক্রাকের পথে যাত্রা করিয়ে দিলেন।

❀ ❀ ❀

ইমরান যখন ক্রাকের কেল্লায় বসে সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর সামনে তাদের অভিযানের বিবরণ পেশ করছিল এবং অভিযানের শেষলগ্নের করুণ ঘটনাবলী বর্ণনা করছিল, নুরুদ্দিন জঙ্গী তন্ময় হয়ে শুনছিলেন সেই অভাবিত কাহিনী। তার চেহারায় খেলা করছিল মুগ্ধতার আবেশ। তিনি এমনভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন যেন অন্তরের অন্তস্থলে খোদাই করে নিচ্ছেন এক সুন্দর যুবকের ছবি।

ইমরানের বলা শেষ হলে তিনি উঠে অধীরভাবে ইমরানকে বুকে চেপে ধরলেন এবং তার দুই গালে চুমু খেলেন। তারপর নিজের তলোয়ার খাপমুক্ত করে তলোয়ারে চুম্বন করলেন। এরপর তলোয়ারটি দুই হাতে ধারণ করে ইমরানের দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, ‘বর্তমানে ক্রুসেডাররা যখন ভয়ঙ্কর শকুনের মত চাঁদের সুষমা ঢেকে দিতে চাচ্ছে তখন এক মুসলমান ভাই অপর ভাইকে তলোয়ার ছাড়া আর কি দিতে পারে?

তুমি বাগদাদে বলো, দামেস্কে বলো, আর যেখানেই বলো না কেন, তোমাকে আমি এর যে কোন স্থানে একটি মহল দিতে পারি। তুমি যে সাহসিকতা দেখিয়েছ তার বিনিময়ে তোমাকে অর্থ সম্পদের আশ্বাস দান করা যায়। কিন্তু হে বন্ধু! আমি তোমার জন্য কোন মহল তৈরী করবো না। কারণ এই অর্থই অনর্থের মূল। যে জিনিস মুসলমানকে অন্ধ ও অকর্মন্য করে দেয়। তারচেয়ে তুমি এই তলোয়ার গ্রহন করো। এটা আমার তলোয়ার। আর মনে রেখো, এই তলোয়ার খৃস্টানদের অনেক মহারথী জালিমের রক্ত পান করেছে, এই তলোয়ার খৃস্টানদের বহু কেল্লার উপরে ইসলামী পতাকা উড্ডিন করেছে। এই তলোয়ার ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী।’

ইমরান নুরুদ্দিন জঙ্গীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার হাত থেকে তলোয়ারটি গ্রহন করে চুমু খেল। তারপর তা চোখে গালে স্পর্শ করলো গভীর আবেগ ও তৃপ্তি নিয়ে। শেষে তলোয়ারটি কোমরে ধারণ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সে ‘ধন্যবাদ’ জাতীয় কিছু বলতে চাইল কিন্তু আবেগে তার গলা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাই সে কিছু বলতে পারলো না। কোন রকমে হাতের পাতা দিয়ে দু’চোখের আনন্দাশ্রু মুছে চোখ তুলে তাকালো নূরুদ্দিন জঙ্গীর দিকে।

‘আর তুমি তোমার নিজের মূল্য বুঝে নাও বন্ধু।’ জঙ্গী বললেন, ‘একজন গোয়েন্দা শত্রু সেনাদের পরাজিত করতে পারে, আর একজন গাদ্দার তার জাতিকে পরাজিত ও ঘৃণিত করতে পারে। তুমি শত্রুদের পরাজিত করে এসেছো; কারণ তুমি যে সংবাদ নিয়ে এসেছো এ খবরই হবে শত্রুদের পরাজয়ের কারণ। ক্রুসেড বাহিনী ইনশাআল্লাহ ফিলিস্তিন ও মিশরের সাগর তীরে ঠাঁই করতে পারবে না। এ বিজয় তোমাদেরই বিজয়। আর তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমাদের দুনিয়াবী কল্যাণ ও আখেরাতের সাফল্য দান করবেন।’

‘আমার জলদি কায়রো পৌঁছা দরকার।’ ইমরান বললো, ‘কারণ সময় বেশী নেই। মিশরের গভর্ণরকে আরো আগেই সংবাদ জানানো উচিত ছিল।’

‘তুমি এখনি যাত্রা করো।’ নূরুদ্দিন জঙ্গী বললেন, ‘আমি তোমাকে ভাল জাতের ঘোড়া দিচ্ছি।’

তিনি ইমরানকে কায়রো যাওয়ার নিরাপদ ও সহজ রাস্তা বাতলে দিলেন। বললেন, ‘এ রাস্তায় কয়েক জায়গায় সেনা চৌকি আছে। সেসব চৌকিতে সংবাদ বাহকদের জন্য বিশ্রাম এবং ঘোড়ার ব্যবস্থাও আছে।’

ইমরান যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে তিনি বললেন, ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে বলবে, ‘রেজাউল ও রহিমের পরিবারকে যেন নিজের পরিবার মনে করেন। তাদের ভরণ-পোষন ও তত্বাবধান করেন। তাদের ব্যয়ভার বহনের জন্য বায়তুলমাল থেকে মাসোহারার ব্যবস্থা নেন।’

‘জ্বী। বলবো।’ ইমরান আদবের সাথে জওয়াব দিল।

তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি শুধু গোয়েন্দাগিরিই করো, না যুদ্ধ করার ট্রেনিংও পেয়েছো?’

‘জ্বী, পেয়েছি। যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও আমার আছে। আপনার কোন আদেশ থাকলে বলুন।’ বললো ইমরান।

‘চিঠি লেখার তো সময় নেই!’ জঙ্গী বললেন, ‘সালাহউদ্দিনকে বলবে, ক্রাক দূর্গটি তার দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে আমার তাড়াতাড়ি দামেস্কে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে সংবাদ এসেছে, সেখানে খ্রীস্টান দুস্কৃতকারীদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। আর আমাদের ছোট ছোট রাজ্যের শাসকগণ তাদের হাতের খেলার পুতুল হয়ে গেছে।

কিন্তু তোমার কাছে থেকে আমি যে তথ্য পেলাম তাতে আমার সে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হচ্ছি। চার-পাঁচ বছর আগে সালাহউদ্দিন যে ক্রুসেডারদের নৌবহরকে ফাঁদে ফেলে রোম সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিল এবার সে ফাঁদে তারা পা দেবে না। এখন তারা সাবধান হয়ে গেছে। সে কারণেই তারা আলেকজান্দ্রিয়ায় উত্তর সমুদ্রতীর বেছে নিয়েছে। যদি আইয়ুবী আলেকজান্দ্রিয়ায় সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তবে ভুল করবে। কারণ তার কাছে ক্রুসেডারদের মত শক্তিশালী নৌশক্তি নেই। তাদের জাহাজ বড় আর প্রতিটি জাহাজে পাল ছাড়াও অসংখ্য দাঁড় ও বৈঠা আছে। সেই দাঁড় টানার মত তাদের কাছে রয়েছে অসংখ্য গোলাম। আইয়ুবীর তা নেই।

তার জাহাজে দাঁড় টানার মত মাল্লা আছে, সৈন্যও আছে। কিন্তু সামদ্রিক যুদ্ধে তারা দু’দিকে সামাল দিতে পারবে না। সে জন্য আইয়ুবীকে বলবে, খৃস্টান বাহিনীকে তীরে নামার সুযোগ দিতে। এতে করে আলেকজান্দ্রিয়ার জনসাধারণ ভয় ও আতংকের মধ্যে পড়ে যাবে। কারণ ওরা তীরে নেমেই অগ্নিগোলা ছুঁড়ে শহরে আগুন ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করবে। আইয়ূবীকে এ ব্যাপারেও সতর্ক করে দেবে।

যদি শত্রুরা তুমি যেমন সংবাদ নিয়ে এসেছো সেভাবেই আক্রমন চালায় তবে আমি শত্রু সেনাদের পাশ থেকে আক্রমন চালাবো। তারা আমার আক্রমণের বাম পাশে থাকবে। সালাউদ্দিনকে বলবে ডান পাশ থেকে আক্রমণ চালাতে। আর তার দায়িত্ব থাকবে, যেন তাদের একটি জাহাজও ফিরে যেতে না পারে। আগুন লাগিয়ে পুড়ে ছাই করে দিতে হবে সব জাহাজ। তার কাছে যে প্রশিক্ষিত কমান্ডো বাহিনী আছে তারা ভাল করেই জানে কিভাবে তা করতে হবে।

আরেকটি কথা, তাকে সুদানীদের দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের সীমান্ত যেন খোলা না থাকে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সুসজ্জিত ও সতর্ক থাকতে বলবে। আমি জানি, তার কাছে যে সৈন্য আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আমি সে ঘাটতি পূরণ করতে চেষ্টা করব। সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন গোপন তথ্য জানা ও তার আদান প্রদান। গোপনীয়তা রক্ষার খাতিরেই লিখিত চিঠি পাঠালাম না। বিজয় লাভের পর আমি ক্রাকের শাসন ক্ষমতা সৈন্যদের হাতে দিয়ে দামেস্কে চলে যাব।

সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর প্রতিটি কথা ভালমত অন্তরে গেঁথে নিয়ে ইমরান কায়রোর দিকে যাত্রা করলো।

❀ ❀ ❀

খৃস্টীয় ১১৭৩ সাল। আলী বিন সুফিয়ান সালাহঊদ্দিন আইয়ুবীকে সংবাদ জানালেন, ‘আক্রাতে একজন মুসলিম গোয়েন্দা শহীদ হয়েছে, একজন ধরা পড়েছে আর তাদের কমান্ডার ইমরান ফিরে এসেছে।’

সুলতান আইয়ুবী এ খবর শুনে বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। আলী বিন সুফিয়ান তাকে জানালেন, ‘ইমরান খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে এসেছে।’

এতেও সুলতানের বিষণ্নতা দূর হলো না। তিনি আলী বিন সুফিয়ানের সাথে সংক্ষিপ্ত কথা সেরে ইমরানকে ভেতরে ডেকে নিলেন। ইমরান ভেতরে প্রবেশ করতেই সুলতান উঠে এগিয়ে এসে তাকে আলিঙ্গন করলেন।

‘আগে বলো, তোমার সঙ্গী কেমন করে শহীদ হলো, আর দ্বিতীয়জন কেমন করে ধরা পড়লো?’

ইমরান সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলো। যখন সে আক্রার সামরিক বিভাগের গোপন সিদ্ধান্ত ও তথ্য বর্ণনা শুরু করলো, সুলতান আইয়ুবীর চোখ বড় বড় হয়ে উঠলো। ইমরান বললো, ‘আমি ক্রাকে নূরুদ্দিন জঙ্গীকে এ সংবাদ জানিয়ে এসেছি।’

সুলতান বললেন, ‘তিনি কেমন আছেন?’

‘জ্বী, তিনি ভাল আছেন। আপনার জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠিয়েছেন।’

‘কই সে বার্তা? দাও।’ উদগ্রীব হয়ে বললেন আইয়ুবী।

‘না, তিনি কোন লিখিত বার্তা পাঠানো ঠিক মনে করেননি, যা বলার সব আমাকে বলেছেন, আর বলেছেন, আমি যেন তা ঠিক মত আপনাকে জানাই।’

ইমরান সুলতান আইয়ুবীকে নূরুদ্দিন জঙ্গীর বার্তা শোনালো। তাতে সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধ প্লানের অনেক সময় বেঁচে গেল। তিনি প্রথমেই রহিম ও রেজাউলের পরিবারের ভাতা নির্ধারণ করলেন। তাদের জানালেন, তারা যেন যে কোন অভাব অভিযোগ সঙ্গে সঙ্গে সুলতানকে জানায়। তিনি তাদের শান্তনা দিয়ে বললেন, ‘এখন থেকে তোমাদের অভিভাবক আমি। তোমাদের যে কোন সুবিধা অসুবিধার কথা অন্য জানার আগে যেন আমি জানতে পারি।’

তিনি ইমরানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরো অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন। সুলতানের প্রশ্নের জবাবে ইমরান আরো বললো, ‘চার পাঁচ বছর আগের তুলনায় ক্রুসেডারদের নৌবহর আরো বেড়েছে। তাদের যুদ্ধ জাহাজও এখন অনেক বেশি।’

‘আক্রমণের কোন দিন তারিখ কি তারা নির্ধারণ করেছে?’

‘আক্রমণ এক মাসের মধ্যেই হবে। ইউরোপ থেকে সম্পুর্ণ নতুন সৈন্য আমদানি করা হয়েছে। ওদেরকে আলেকজান্দ্রিয়ার উত্তর সমুদ্রতীরে নামানো হবে। দ্বিতীয় বাহিনী বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মিশরের দিকে অগ্রসর হবে। আলেকজান্দ্রিয়ায় অবতরণকারী বাহিনী সে স্থান দখল করে সেখানে তাদের ঘাঁটি ও রসদপত্রের কেন্দ্র বানাবে। তারপর তারা উত্তর দিক থেকে মিশরে আক্রমণ চালাবে।’

ইমরানের বর্ণনা শুনে সুলতান আইয়ুবী খৃস্টান বাহিনীর কৌশল যথার্থই আঁচ করতে পারলেন। তারা আক্রমণের এমন পরিকল্পনা করেছে যাতে সুলতান আইয়ুবী আক্রমণের আগে কিছুই টের না পান। তাছাড়া আক্রান্ত অবস্থায় নূরুদ্দিন জঙ্গী ক্রাক থেকে তাকে যেন কোন সাহায্য পাঠাতে না পারেন সে জন্যই বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে বাহিনী পাঠাচ্ছে। এ বাহিনী পথেই জঙ্গীর বাহিনী এগিয়ে এলে বাধাঁ দিতে পারবে। ফলে বিপুল বাহিনী ও আধুনিক অস্ত্রের মোকাবেলায় আইয়ুবীর পতন যে নিশ্চিত এতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয় খৃস্টানদের।

সুলতান আইয়ুবী অনুভব করলেন, এ এমন এক তুফান, যদি তারা সুলতানের অজ্ঞাতে এসেই যেতো, তবে মিশর খৃস্টানদের দখলে যেতো।

সুলতান তখনি সেনাবাহিনীর সিনিয়র সেনাপতিদের জরুরী অধিবেশন ডাকলেন। আলী বিন সুফিয়ানকে নির্দেশ দিলেন, ‘শত্রুর গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে সতর্ক দৃষ্টি দাও। চারদিকে চোখ-কান খোলা রাখো। সব ব্যাপারেই সাবধানতা অবলম্বন করবে, সতর্ক থাকবে যেন নিজের সেনাবাহিনীর কোন খবরই বাইরে শত্রুদের কাছে যেতে না পারে।’

তিনি আলীকে আরো বললেন, ‘আলেকজান্দ্রিয়ার দিকেও বিশেষ নজর রেখো।’

❀ ❀ ❀

খৃস্টান মহলে যুদ্ধের জোর প্রস্তুতি চলছে। বৃটেন এখনো এ যুদ্ধে অংশ নিতে রাজী হয়নি। ইংরেজদের আশা, তারা কোন এক সময় একাই মুসলমানদের পরাজিত করে তাদের অঞ্চলগুলো অধিকার করে নেবে। সম্মিলিত আক্রমণের ব্যাপারে তাই তাদের কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু পোপের অনুরোধে ইংরেজরা ক্রুসেড বাহিনীতে কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ দান করলো।

স্পেনের সমস্ত জাহাজ এ যুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত হল। সবার আগে এগিয়ে এল ফ্রান্স, জার্মানী ও বেলজিয়ামের যুদ্ধ জাহাজ। এরপরই সম্মিলিত নৌবাহিনীতে শরীক হলো গ্রীস ও সিসিলির রণতরী। রসদ ও অস্ত্রসস্ত্র বহনের জন্য বড় বড় জেলে নৌকা সঙ্গে নিল ওরা।

এ নৌবহরে ইউরোপের প্রতিটি দেশের চৌকস সৈন্যদের শামিল করা হলো। যুদ্ধ যাত্রার আগে পবিত্র ক্রুশ ছুঁয়ে শপথ করানো হলো তাদের। সকলেই শপথ করলো, ‘বিজয় লাভ করতে না পারলে আর কোনদিন স্বদেশে ফিরবো না। একমাত্র মরণ ছাড়া আর কোন কিছু আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করতে পারবে না। সুলতান আইয়ুবী যদি তার যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে আমাদের মোকাবেলা করতে চায় তবে আমাদের হাতে মিশর তুলে দেয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় থাকবে না।’

ফ্রান্সের এডমিরাল বললেন, ‘আমি জানি তাদের নৌবহর কত ছোট আর দুর্বল।’ তিনি ভুমধ্য সাগরের পারে দাঁড়িয়ে সম্মিলিত বাহিনীর জওয়ানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন, ‘সালাহউদ্দিন ও নূরুদ্দিন জঙ্গী শুধু স্থলে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত। যদি আমাদের এ আক্রমণের সংবাদ মুসলমানদের কানে সময়ের আগে না পৌঁছে তবে কারো বাপেরও সাধ্য নেই আমাদের মোকাবেলা করে। আর সালাহউদ্দিন তখনই এ আক্রমণের খবর পাবে, যখন আমরা তার ঘাড়ের ওপর গযবের মত আপতিত হবো। তখন মিশর থাকবে আমাদের অবরোধের আওতায়। আর নূরুদ্দিন জঙ্গী শত ইচ্ছা থাকলেও তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারবে না, কারণ তাকে পথেই বাঁধা দেয়ার জন্য বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে আমাদের বাহিনী রওনা হয়ে গেছে। এবার আমাদের আক্রমণ হবে একতরফা, বিজয়ও হবে একতরফা।’

রিনাল্ট একজন প্রসিদ্ধ খৃস্টান শাসক ও বীর যোদ্ধা। তিনি বললেন, ‘আমি আবারও বলছি, সুদানীদের এ লড়াইয়ে ব্যবহার করা দরকার।’

বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে স্থল পথে এগিয়ে আসা বাহিনীর সাথে তার থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি শুরু থেকেই জিদ ধরেছিলেন, মিশরের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণকারী বাহিনীর সাথে থাকার জন্য। তার কথা হলো, ‘এই সুযোগে সুদানীরা মিশরের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করুক।’

‘আপনি অতীতের শিক্ষা ভুলে গেছেন।’ ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু ফিলিপ আগাস্টাস বললেন, ‘১১৬৯ সালে আমি সুদানীদের পর্যাপ্ত সাহায্য দিয়েছিলাম। ভরসা ছিল, আমরা যখন সাগর পথে মিশর আক্রমণ চালাবো তখন সুদানীরা দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালাবে। আর সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদলে যে সব সুদানী রয়েছে তারা বিদ্রোহ করবে। কিন্তু তখন তারা কিছুই করেনি। দু’বৎসর পর তাদের আবার সাহায্য দেয়া হলো, তাও বিফলে গেল। এখনও তারা আমাদের নিরাশ করবে। কেন আমরা তাদেরকে আমাদের পরিকল্পনায় শামিল করবো?’

‘মিশর আমরা আমাদের শক্তিতে অধিকার করলেও, সুদানীরা আমাদের কাছে অংশ দাবী করবে।’

‘আপনি ভুল করছেন। সুদানীদের মধ্যে মুসলমান কম নেই। আর মুসলমানদের উপরে ভরসা করা মহা ভুল। আপনি যদি ইসলামের অস্তিত্ব মিটিয়ে দিতে চান তবে কোন মুসলমানকেই অন্তর থেকে বন্ধু মনে করবেন না। তাদেরকে প্রলোভন দিয়ে অনুগত দাস বানাবেন কিন্তু তাদের জন্য সারাক্ষণ শত্রুতা পোষণ করবেন।’

‘আপনি সত্য কথাই বলেছেন।’ এক খৃষ্টান রাজা বললেন, ‘আমরা ফাতেমীদের বন্ধু বানিয়েছিলাম। তারা সালাহউদ্দিনের শত্রু হয়েও তাকে হত্যা করলো না। আমরা তাদেরকে বড় বড় গোয়েন্দা এবং সাহসী যোদ্ধা দিয়েও সাহায্য করেছিলাম। অথচ তারা তাদেরকে ধরিয়ে দিয়ে হত্যা করালো। তাহলে আমরা কার উপর ভরসা করবো?’

‘এখন আমাদের নিজস্ব সামরিক শক্তির উপরই ভরসা করতে হবে, তা হলেই আমরা সফল হবো।’

এ যুদ্ধে খৃস্টানদের সামরিক শক্তি অহংকার করার মতই ছিল, এবং তাদের মধ্যে এ অহংকার যথেষ্ট প্রকটও ছিল। সামুদ্রিক যুদ্ধে নৌ শক্তির কোন হিসাব ছিল না। বায়তুল মোকাদ্দাসের দিক থেকে যে সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছিল, তারা ছিল নৌবাহিনীর দ্বিগুনেরও বেশী।

এ নৌযুদ্ধে খৃস্টানদের ছ’জন সম্রাট সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্টের শাসকরাও সেনাবাহিনীর সাথে একাত্ব হয়ে চলে এসেছিলেন ময়দানে। তাদের একটিই ত্রুটি ছিল, সম্মিলিত বাহিনীর কোন ঐক্যবদ্ধ একক কমান্ড ছিল না। তাদের ঐক্যবদ্ধ কমান্ড থাকলে নূরুদ্দিন জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবীকে তারা সহজেই পরাস্ত করতে পারতো বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।

সুলতান আইয়ুবীর সামনে সমস্যা ছিল তিনটি। তার সৈন্য সংখ্যা কম। মিশরে গাদ্দাররা অনৈক্য ও বিশৃংখলা সৃস্টি করে রেখেছে। সুদানীরা সুযোগ পেলেই আক্রমণ চালাতে পারে।

নূরুদ্দিন জঙ্গীরও কিছু অসুবিধা ছিল। ইসলামী জগত ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ সকল রাজ্যের আমীররা আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। খৃস্টানরা তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে একরকম অধীনই বানিয়ে রেখেছিল। খৃস্টানদের কূটচক্রান্তে পড়ে তারা পরস্পর শত্রু হয়ে উঠেছিল এবং নিজেদের মধ্যে সংঘাত শুরু করে দিয়েছিল। ইসলামের গৌরব বৃদ্ধির চেষ্টা করার অনুভূতিও তারা হারিয়ে ফেলেছিল। এসব সমস্যা নিয়েই খৃস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন তারা।

সুলতান আইয়ুবী সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করলেন। এক দলকে সুদানের সীমান্তে চলে যেতে বললেন। তার কমান্ডারকে নির্দেশ দিলেন, ‘সীমান্ত থেকে অস্পষ্টভাবে দেখা যায় এতটা দূরত্বে তাঁবু টানিয়ে ক্যাম্প করবে। কিন্তু পুরো সীমান্ত এলাকায় সৈন্যদেরকে এমন ভাবে কর্মতৎপর ও ব্যতিব্যস্ত রাখবে যেন সব সময় বাতাসে অশ্ব ক্ষুরের ধূলি উড়তে দেখা যায়। যাতে মনে হয়, সীমান্তে অসংখ্য সৈন্য মোতায়েন রয়েছে।’

সুলতান আইয়ুবী সৈন্যদেরকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিলেন যেন তারা কোন অবস্থাতেই অসতর্ক অবস্থায় না থাকে।

দ্বিতীয় দলকে আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে যাত্রা করতে আদেশ দিলেন। কিন্তু তাদের নির্দেশ দিলেন, ‘দিনের বেলায় যুদ্ধ যাত্রা করবে না। রাতের আধাঁরে পথ চলবে, আর দিনে গোপন স্থানে ক্যাম্প করে বিশ্রামে থাকবে।’

তাদের কমান্ডারকে আরো বললেন, ‘আলেকজান্দ্রিয়ায় তোমাদের শিবির ও যুদ্ধ ক্যাম্প কোথায় হবে সে নির্দেশ পরে জানানো হবে।’

তৃতীয় দলটিকে সুলতান আইয়ুবী নিজের কমান্ডে রাখলেন। কিন্তু কেন এই প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা তা কাউকে বললেন না। উর্ধতন অফিসারদের শুধু বললেন, বিশেষ প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে জরুরী কিছু কাজ দেয়া হচ্ছে। যাকে যে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে এবং যেভাবে চলতে বলা হচ্ছে, আমি চাই সে তার দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করুক।’

সুলতানের এ নির্দেশের পর সৈন্যরা এ নিয়ে আর কোন প্রশ্ন তোলেনি। তবে সবাই এ দেখে বেশ অবাক হলো, সমস্ত মিনজানিক ও ভারী অস্ত্রগুলো আলেকজান্দ্রিয়াগামী সৈন্য দলকে সাথে নেয়ার জন্য দিয়ে দিলেন।

এ নির্দেশের সাত আট দিন পর সুলতান আইয়ুবীকে আর কায়রোতে দেখা গেল না, আর নূরুদ্দিন জঙ্গীও ক্রাকে ছিলেন না। তারা দু’জনই আলেকজান্দ্রিয়ার নিজ নিজ গোপন আস্তানায় অবস্থান করছিলেন। মাঝে মাঝে আস্তানা থেকে বেরিয়ে তারা পুরো এলাকায় টহল দিয়ে বেড়াতেন। কিন্তু তখন তারা থাকতেন ছদ্মবেশে। ফলে কেউ তাদের চিনতে পারতো না। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও কেউ বলতে পারতো না, এ ব্যক্তিই একটি দেশের শাসক ও সেনা বিভাগের প্রধান!

জনসাধারণ এ দুই মহান ব্যক্তিকেও তাদের মতই সাধারণ মানুষ মনে করতো। অথচ এ দুই ব্যক্তি ছিল ক্রুসেড ও খৃস্টান জগতের জন্য ভয়ংকর ভয় ও আতংকের কারণ। তাঁরা দু’জনই সাধারণ গরীব উষ্ট্র চালকের বেশে ছিলেন। কেউ তাদের ব্যাপারে এই আগ্রহও প্রকাশ করলো না যে, এই উষ্ট্রচালকরা কোথেকে এসেছে আর কোথায় যাচ্ছে।

তারা দুজনই সাগর তীরে গিয়ে রোম সাগরের সূদুর বিস্তৃত জলরাশি অবলোকন করতেন আর অনুসন্ধান করতেন কোথাও কোন রণতরী দেখা যায় কিনা।

তারা তিন চার দিন ধরে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ঘুরে ফিরে বেড়ালেন। শেষে সুলতান আইয়ুবীকে আলেকজান্দ্রিয়ায় রেখে নূরুদ্দিন জঙ্গী ক্রাকে চলে গেলেন। সুলতান আইয়ুবীও তার কয়েকদিন পর সেনাবাহিনীকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে চলে গেলেন কায়রো।

❀ ❀ ❀

খৃস্টানদের নৌবহর অশেষ গোপনীয়তা রক্ষা করে সম্পূর্ণ নিরবে এগিয়ে চললো। বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে স্থল বাহিনীও অনুরুপ গোপনীয়তা রক্ষা করে সামনে বাড়লো। দুই বাহিনীর যাত্রার সময়ের মধ্যে কিছু হেরফের ছিল প্রয়োজনের তাগিদেই। খৃস্টানরা সুবিধা মত তাদের জন্য অনুকুল মৌসুম বেছে নিয়েছিল। এ মৌসুমে রোম সাগর অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকে, বিশেষ করে সাগরে তুফান ও সমুদ্র ঝড়ের আশংকা থাকে না।

খৃস্টান নৌবাহিনীর চোখের সামনে মিশরের সমুদ্র তীর ভেসে উঠল। কিন্তু তাদের চোখের সামনে সুলতান আইয়ুবীর নৌবহর বা কোন প্রতিরক্ষা বাহিনী চোখে পড়ল না। নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন সমুদ্রে মাছ ধরা একটি জেলে নৌকা দেখতে পেল। ক্যাপ্টেন জাহাজটি তার নিকটবর্তী করে উপর থেকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাদের যুদ্ধ জাহাজ কোথায়? যদি মিথ্যা বলো, তবে ডুবিয়ে মারবো।’

জেলে অবাক হয়ে বললো, ‘মিশরের জাহাজ! নৌবাহিনীর কোন যুদ্ধ জাহাজ তো এদিকে রাখা হয় না! সে সব থাকে এখান থেকে অনেক দূরে, ডকে। তবে মাঝে মধ্যে নৌবাহিনীর টহল জাহাজ এদিকে টহল দিতে আসে।’

খৃস্টান নোবাহিনী জাহাজ থামিয়ে সেখানেই নোঙ্গর ফেললো। ক্যাপ্টেন তাদের ইশারা করলো জাহাজে উঠতে। দুই জেলে নোঙ্গর করা রশি বেয়ে জাহাজে উঠে গেল।

ক্যাপ্টেনের প্রশ্নের জবাবে তারা মিশরের যুদ্ধ জাহাজের যে বর্ণনা শোনালো তা হলো, ‘কয়েকটি জাহাজ এখন মেরামত করা হচ্ছে। আর যেগুলো ভাল আছে সেগুলো আলেকজান্দ্রিয়া থেকে অনেক দূরে নিয়ে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে জাহাজ আলেকজান্দ্রিয়া আসতে কম করেও দুই দিন সময় লাগবে। কারণ সেগুলোর পাল ছেঁড়া। দাঁড় এবং বৈঠার অবস্থাও ভাল নয়। আর তাতে মাল্লা এত কম যে, এত কম মাল্লা নিয়ে তাদের পক্ষে দ্রুত এগিয়ে আসা সম্ভব নয়।’

জেলেরা যে রিপোর্ট দিলো, তাতে খুবই মূল্যবান তথ্য পেল খৃস্টান বাহিনী। জেলেরা আরো বললো, ‘সমুদ্র পথে আক্রান্ত হওয়ার কোন ভয় নেই দেখে সুলতান আইয়ুবী এদিকে কোন নজরই দেন না। তিনি নিজে কায়রো থাকেন বলে আলেকজান্দ্রিয়ার নিরাপত্তার দিকেও তার খেয়াল কম। যে সামান্য ক’জন সৈন্যকে এখানে পাঠিয়েছেন বেশ আরাম আয়েশেই দিন কাটাচ্ছে তারা। তারা সাগর তীরের জেলেদের গ্রামগুলোতে চলে যায় এবং তাদের মাছ লুট করে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।’

এডমিরাল জেলেদের ডেকে নিয়ে প্রচুর বকশিশ দিয়ে বললেন, ‘শহরে কি পরিমাণ সৈন্য আছে যদি তোমরা খোঁজখবর নিয়ে আমাদের জানাতে পারো তবে আরো অঢেল বকশিশ ভাগ্যে জুটবে তোমাদের। আমি তোমাদের অপেক্ষা করবো।’

খৃস্টান নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেনের জন্য এ তথ্য সুসংবাদ ছাড়া আর কি হতে পারে? ক্যাপ্টেন জাহাজ থামিয়ে একটি নৌকা নিয়ে নৌবাহিনীর এডমিরালের কাছে গেলেন। তিনি যে তথ্য জেলেদের কাছ থেকে পেয়েছেন তা এডমিরালকে বললেন।

এডমিরাল বললো, ‘ভালই হলো, ময়দান একেবারে পরিস্কার। এমনটিই হওয়া স্বাভাবিক। অহেতুক নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেইবা জোরদার করে।’

এডমিরাল সকল যুদ্ধ জাহাজকে সেখানেই নোঙ্গর করতে আদেশ দিয়ে বললেন, ‘সন্ধ্যার পর আমরা তীরে নামবো।’

সব জাহাজেই তিনি খবর পাঠালেন, ‘জাহাজ এমন জায়গায় নিয়ে তীরে ভেড়াবে, যেখানে পানি গভীর, জাহাজ বালিতে আটকাবে না। আর সেখানে সৈন্যরা খুব নিরাপদে অবতরণ করতে পারবে।’

আলেকজান্দ্রিয়া পোতাশ্রয় থেকে একটি নৌকা মুক্ত সাগরের দিকে চলে গেল। এই নৌকাটি দেখতে জেলেদের নৌকার মতই।

তখনও সূর্য ডুবে যায়নি। নৌকাটি খৃস্টান নৌবহরের নিকটবর্তী হলো। কম-বেশি প্রায় আড়াইশ যুদ্ধ জাহাজ সমুদ্রের দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে নোঙ্গর করা আছে। জেলে নৌকাটি জাহাজগুলোর মাঝখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে করে এডমিরালের জাহাজ পর্যন্ত পৌঁছলো।

জেলেরা এডমিরালকে বললো, ‘আলেকজান্দ্রিয়া শহরে কোন সৈন্য নেই, শুধু শহরবাসী নাগরিকরা আছে। মিশরের যুদ্ধ জাহাজ এখান থেকে বহুদূরে নিরাপদ স্থানে রয়েছে।’

আসলে এই জেলে দু’জন ছিল মুসলমানদের গোয়েন্দা বাহিনীর দুই সদস্য।

রাতের প্রথম প্রহর, খৃস্টান নৌবাহিনীর প্রথম জাহাজটি কূলের দিকে অগ্রসর হলো এবং কোন বাঁধা ছাড়াই আলেকজান্দ্রিয়ার পোতাশ্রয়ে নোঙ্গর করলো। প্রথম সারির পেছনে দ্বিতীয় সারির জাহাজগুলো নোঙ্গর করলো। এরপর এগিয়ে এলো তৃতীয় সারির জাহাজগুলোও। সৈন্য অবতরণের জন্য প্রত্যেক জাহাজের কূলে ভেড়ার কোন প্রয়োজন পড়ল না, বরং পেছনের জাহাজের সৈন্যরা সামনের জাহাজ হয়ে তীরে নেমে এলো।

এভাবেই আলেকজান্দ্রিয়াতে অত গোপনে ও নীরবে নেমে এলো একদল খৃস্টান সৈন্য। চুপিসারে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। তাদের কাছে যে তথ্য ও সংবাদ আছে তাতে তারা জানে, এখানে কোন সৈন্য নেই। ফলে বন্দর নগরী অধিকার করা তাদের জন্য কোন ব্যাপারই না।

কমান্ডিং অফিসার সৈন্যদের সরাসরি আলেকজান্দ্রিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার নির্দেশ দিয়ে বললো, ‘এ শহর এখন আমাদের। এখানে প্রবেশ করতে এখন আর কোন বাঁধা নেই। অতএব যাও, যার যেভাবে খুশি প্রবেশ করো শহরে। ভোগ করো, লুট করো। শহরবাসীকে বুঝিয়ে দাও তারা এখন কাদের রাজত্বে বাস করছে।’

খৃস্টান সৈন্যরা আনন্দে চিৎকার করতে করতে ছুটল শহরের দিকে। খুশি আর ধরে না তাদের। যার ঘরে খুশি ঢুকে লুট করবে, উপভোগ করবে নারীদের। লোভে চকচক করে উঠল ওদের চোখগুলো।

যখন খৃস্টান সৈন্যদের ভীড় শহরের নিকটবর্তী হলো, কেউ কেউ ঢুকে পড়ল শহরের গলিতে, তখন সহসা তাদের ডানে ও বামে আগুনের শিখা জ্বলে উঠলো। শুকনো ঘাস ও খড়ের স্তুপে, কাঠ-খড়ির গাদায় তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল কারা যেন। সঙ্গে সঙ্গে রাতের অন্ধকার দূর হয়ে গেল। এতে করে খৃস্টান সৈন্যদের লোভাতুর বীভৎস চেহারাগুলো স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল। দেখা গেল, পঙ্গপালের মত দল বেঁধে ওরা হুড়মুর করে শহরে প্রবেশ করছে। এই সুযোগের জন্যই যেন অনন্তকাল অপেক্ষা করছিল মুসলিম ফৌজ।

শহরের অলিতে গলিতে মশালের আলো জ্বলে উঠলো। বাড়ীর ছাদ থেকে শুরু হলো বৃষ্টির মত তীর বর্ষণ। হতচকিত হয়ে থমকে দাঁড়াল খৃস্টানরা। রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়লো অতি উৎসাহী অগ্রগামী বাহিনী। তাদের দিশেহারা ভাব কাটতে যে সময়টুকু লাগলো তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলো তীরন্দাজরা।

খৃস্টানরা যখন বুঝতে পারলো তারা আক্রান্ত হয়েছে তখন পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চাইল তারা। পিছন ফিরে ছুটলো সমুদ্রের দিকে। রাস্তার দু’পাশে তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সেই আলোতে রাস্তার ছুটন্ত অবয়বগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রাস্তা থেকে একটু দূরে গেলেই আবার সেই সীমাহীন অন্ধকার। সেই অন্ধকারে কারা ওঁত পেতে বসে আছে কিছুই দেখার সুযোগ পেল না তারা।

সৈন্যরা পিছন ফিরে দৌড় শুরু করতেই রাস্তার ডান দিক থেকে তাদের ওপর তীর বর্ষণ শুরু হলো। নিখুঁত নিশানা প্রতিটি তীরের। রাস্তার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে লাগল খৃস্টান সৈন্যরা। পেছনে সরে যাওয়ারও এখন আর কোন উপায় রইল না তাদের।

আহতদের চিৎকার ও আর্তনাদে রাতের বাতাস প্রকম্পিত ও ভারী হয়ে উঠলো। নতুন করে যারা তীরবিদ্ধ হচ্ছিল তাদের গগনবিদারী চিৎকারে কেঁপে উঠছিল শহর।

এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল কম করেও দুই হাজার খৃস্টান সৈন্য। তাদের খুব কমই জীবিত ফিরে যেতে পারল। খৃস্টানদের যেসব সৈন্য জাহাজে ছিল তাদেরকে পাল্টা আক্রমণের হুকম দিল সেনাপতিগণ। একদলকে নেমে সামনে অগ্রসর হওয়ার আদেশ দেয়া হলো। জাহাজের মধ্য থেকে খৃস্টানরা মেনজানিক দিয়ে অগ্নি গোলা ও দুরপাল্লার তীর বর্ষণ করতে লাগলো।

হঠাত খৃস্টানদের সবচেয়ে পিছন সারির দু-তিনটি জাহাজে দেখা গেল প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা। দেখতে দেখতে আরো দুতিনটি জাহাজে আগুন লেগে গেল। কিভাবে এ অসম্ভব কান্ড ঘটলো কিছুই বুঝতে পারলো না খৃস্টানরা। তারা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল সেই অগ্নিশিখার দিকে। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার, দেখা গেলো, সমস্ত সাগরে দৈত্যের মত আগুন জ্বলে উঠেছে আর সেই আগুন ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে।

খৃস্টানরা এমন অতর্কিত ও বেপরোয়া হামলার আশংকা করেনি। তারা তাদের যুদ্ধ জাহাজগুলো এক জায়গায় জড়ো করে রেখেছিল সৈনিকদের নামার সুবিধের জন্য। এই সুবিধা যে একটু পর তাদের জন্য ভয়ংকর বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে তা ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। এ ছিল রণনিপুণ সুলতান আইয়ুবীর এক দৃষ্টান্তমূলক রণকৌশল। সহজেই খৃস্টানরা তার পাতা ফাঁদে পা দিল।