» » ফেরাউনের গুপ্তধন

বর্ণাকার

ফেরাউনের গুপ্তধন

১১৭৪ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। কায়রো থেকে আঠারো মাইল দূরে এক জায়গায় এসে তিনটি উট দাঁড়িয়ে পড়ল। প্ৰত্যেক উটের ওপর একজন করে আরোহী, তাদের শরীর ও মুখ নেকাবে ঢাকা। একজন আরোহী পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজ বের করল। তারপর কাগজটির ভাঁজ খুলে গভীর মনযোগ দিয়ে দেখে সঙ্গীদের বললো, “এই সে জায়গা!’

সে সঙ্গীদের সামনে অগ্রসর হওয়ার ইশারা করে নিজেও এগিয়ে গেল। ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র সঙ্গীরাও তাদের উট সামনে বাড়ালো।

সামনে দুটি টিলা মুখোমুখি দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে। দুই টিলার মাঝখানে চিকন একটি রাস্তা। রাস্তাটি এতই সরু, একটি উট কোনরকমে যেতে পারে ওই পথে।

তিনজনই লাইন ধরে উটসহ ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরের অবস্থাও একই রকম। দু’পাশে সুউচ্চ দেয়াল। মনে হয়, কোন পাহাড়ি টিলা নয়, মানুষের তৈরী কোন শক্ত পাঁচিল। পাঁচলটি অনেক দিনের পুরোনো এবং এখানে ওখানে ভাঙা। সেই ভাঙা দিয়ে তাকালে দেখা যায় সীমাহীন বালির সমুদ্র এবং পাহাড়।

অঞ্চলটি তিন-চার মাইলব্যাপী বিস্তৃত। টিলা এবং পাহাড়গুলো কোথাও লম্বা, কোথাও গোল। সর্বত্র ছোট বড় অসংখ্য টিলা ও পাহাড়ের ছড়াছড়ি। তার মাঝে অল্প কিছু সমতল উপত্যকা।

টিলা ও পাহাড়ে দেবদারু গাছের মত কিছু খাঁড়া স্তম্ভ। স্তম্ভগুলো এত উঁচু এবং খাঁড়া যে, মনে হয়, কোথাও কোথাও তা হাজার ফিট উঠে গেছে।

সূর্য্য অস্ত যাওয়ার এখনও অনেক বাকী। অথচ এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে এখানে, আধাঁর ক্রমেই গ্ৰাস করছে এলাকাটি। স্তম্ভগুলো ভূতের আকৃতি নিতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, অসংখ্য ভূত এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

টিলার খাঁড়া পাহাড়গুলো দূর্গম। যেমন উঁচু তেমন দেয়ালের মত একটানা খাঁড়া। মনে হয়, দিনের বেলায়ও কোথাও কোথাও সূর্যের আলো প্রবেশ করে না।

এই ভূতুড়ে দুৰ্গম পাহাড়ি রাস্তায় অনেক দিন মানুষের পা পড়েনি। কোন কালে কেউ-প্ৰবেশ করেছিল কিনা তাও ঠিক বুঝা যায় না। ‘মনে হয়, এর ভেতরে কখনও কেউ প্ৰবেশ করার দুঃসাহস করেনি।” ঘাড় ফিরিয়ে সঙ্গীদের বলল ওদের দলনেতা।

‘কেন করবে? ভেতরে প্রবেশ করার প্রয়োজন হলে তবে তো করবে? মরুভূমিতে যাত্রীদের শুধু পানির প্রয়োজন হয়। এমন শুকনো নিরস বালির পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা যেখানে দিনের আলোও ঠিকমত পড়ে না সেখানে পানি খুঁজতে আসবে কোন পাগলে?”

এক সঙ্গী জবাব দিল নেতার প্রশ্নের। আরেকজন বলল, ‘জায়গাটা চলাচলের কোন পাশেও পড়ে না। বহু দূর দিয়ে যাওয়ার সময় কোন কাফেলার চোখে পড়লে বলে, কায়রো এখনো আঠারো মাইল দূরে রয়েছে। এই দূরত্ব মাপার কাজ ছাড়া এই মৃত্যু উপত্যকা কোন দিন কারো কাজে লেগেছে?’

লোক মুখে এই এলাকা সম্পর্কে কিছু ভয়ংকর গল্প প্রচলিত আছে। এলাকাটাকে কেউ বলে মৃত্যু উপত্যকা, কেউ বলে শয়তানের পাহাড়। লোকজন বলাবলি করে, এই অঞ্চলে শয়তানের প্ৰেতাত্মারা বাস করে। অভিশপ্ত শয়তানকে যখন আল্লাহ আকাশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তখন শয়তান নাকি এখানে এসে অবতরণ করেছিল। তারপর থেকে শয়তানের প্রেতাত্মারা এই অঞ্চলটিকে তাদের স্থায়ী ঘাঁটি বানিয়ে নেয়।

এই অঞ্চল সামরিক দিক থেকেও এমন কোন গুরুত্বপূৰ্ণ স্থান নয় যে, সৈন্যদের তা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে, ফলে কখনো কোন সৈন্য বা সেনাবাহিনীও এর ভেতরে প্রবেশ করেনি।

অঞ্চলটি শুধু দুৰ্গম নয়, নানা কুসংস্কারপূর্ণ গল্পের কারণে ভীতিপ্ৰদও। ফলে মানুষজন কখনো বালুকারাশিতে পরিপূর্ণ এই মৃত্যু উপত্যকায় আসতে সাহস পায়নি; মরুভূমির হিংস্র প্রাণী ছাড়া এখানে আর কিছুই নেই। এই প্রথম তিনজন আগন্তুক এই ভয়ংকর অঞ্চলে প্রবেশ করল। এখানে তাদের কতটা বিপদের মোকাবেলা করতে হবে তার কোন পরোয় করল না তারা।

পায়ে সংকীর্ণ পথে এগিয়ে চলল। কারণ, উট তিনটি নিরূপায়। তাদের চালক যেখানে তাদের চালিয়ে নিয়ে যায় সেখানে তাদের যেতেই হবে।

হাজার হাজার বছর আগের পুরোনো একটি নকশা আছে এই অভিযাত্রীদের কাছে। নকশাতে যে জায়গার চিত্র আকা তার সাথে এলাকাটি হুবহু মিলে যায়। শুধু একটি রেখা সামান্য সন্দেহের সৃষ্টি করে। রেখাটি একটি নদীর। কিন্তু তারা প্রচুর ইতিহাস ঘেটে দেখেছে, কোন কালেও এখানে কোন নদী ছিল না।

বিষয়টি তাদের ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জায়গাটি এক নজর ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্যই তাদের আজকের এ অভিযান।

কিছু দূর এগুনোর পর, তারা দেখতে পেল অপেক্ষাকৃত একটি নিচু অঞ্চল লম্বালম্বিভাবে এগিয়ে গেছে। অঞ্চলটি দুই টিলার মধ্যবতী সংকীর্ণ রাস্তা থেকে বেশি দূরে নয়।

একটি ফোকড় গলে সংকীর্ণ জায়গা দিয়ে বেড়িয়ে এল অভিযাত্রী দল। এখন তারা সেই দীর্ঘ নিচু অঞ্চলটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অঞ্চলটি পাশে দশ বারো গজের বেশি নয়।

দলনেতা উটের ওপর থেকে নেমে এল নিচে। হেঁটে নিচু অঞ্চলের বালিয়াড়ির মধ্যে নেমে গেল। সঙ্গী দু’জন উটের ওপর বসে থেকে দেখতে লাগল নেতার কাজকর্ম।

মাঝামাঝি এসে দলনেতা নিচু হয়ে একমুঠো বালি তুলে নিল হাতে। গভীর মনযোগ দিয়ে পরীক্ষা করল। হাতের বালি ফেলে দিয়ে লম্বা করে দৃষ্টি মেলে দিল বালির সমুদ্রে। খুশিতে ভরে উঠল তার হৃদয়-মন। সে নিশ্চিত, শত শত বছর আগে এখান দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো। এই নিম্নাঞ্চল নিশ্চয়ই কোথাও আটকে না গিয়ে কোন গতিপথ ধরে নীলনদের দিকে চলে গেছে।

সে ফিরে এল উটের কাছে। সঙ্গী আরোহীদের আশ্বস্ত করে বললো, “আমরা ঠিক জায়গায়ই এসে পৌঁছেছি।”

এই আরোহীদের দলনেতা ইটালীর মার্ক লী। সে নিজে এবং সঙ্গী দুজনও খৃস্টান। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিশ্বস্ত কমান্ডার আহমদ দারবীশ গোপনে খৃস্টানদের সাথে হাত মিলিয়ে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবর অনুসন্ধানে পাঠিয়েছে এদের।

নকশা অনুযায়ী ঠিক জায়গাতেই এসে পৌঁছেছে ওরা। এই মৃত্যু উপত্যকাতেই আছে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের কবর।

এতে আরোহীদের খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু মার্ক লী খুশি হতে পারলো না। অঞ্চলটি লম্বা এবং প্রস্থ উভয় দিকেই কয়েক মাইল এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে কয়েক হাত লম্বা একটি কবর খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়।

মার্ক লী তার সঙ্গীদের বললো, “এই সে জায়গা, নিজেকে খোদা বলে দাবী করত যে ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্স, তার শেষ আশ্রয়স্থল। তাকিয়ে দেখো এর বিপুল বিস্তৃতি। আহমদ, দরবীশ ও হরমন আমাদেরকে এক ব্যর্থ অভিযানে পাঠিয়ে দিয়েছে। এত বড় এলাকা চষে একটি কবর খুঁজে বের করা কেবল কঠিন নয়, বলতে গেলে অসম্ভব। তারা আমাদেরকে দিয়ে এমন এক অসাধ্য সাধন করতে চায়, হাজার বছর ধরে চেষ্টা করেও মানুষ যা জয় করতে পারেনি।”

সঙ্গীরা অভিযানের গুরুত্ব অনুধাবন করে কেমন বিমর্ষ ও চিন্তিত হয়ে পড়ল। এ অভিযানে তাদের ব্যক্তিগত কোন আগ্ৰহ ছিল না। তারা চাচ্ছিল ফিরে যেতে। কিন্তু কমাণ্ডারকে এমন কোন পরামর্শ দেয়ার সাহস ছিল না তাদের। তারা তো হুকুমের গোলাম। মার্ক লী এক কঠিন হৃদয়ের কমাণ্ডার। সহজে হার মানার পাত্র সে নয়। নিজের বুদ্ধি ও সাহসের ওপর যথেষ্ট আস্থা নিয়েই কাজ করে সে। কাজের সময় অহেতুক বাগড়া দেয়াকে সে পছন্দ করে না।

আগে আগে যাচ্ছে মার্ক লী, পেছনে সঙ্গী দু’জন। ওরা যত এগুলো ততই ওরা দেখতে পেলো পার্বত্য অঞ্চলের রূপ ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। এখানকার মাটির রঙ ঘন বাদামী। কোথাও তা পাল্টে গিয়ে দেখা যাচ্ছিল খয়েরী, কোথাও বা লাল মেটে-রঙ।

বালির পাহাড়ের পাশেই কোথাও ছোট্ট একটু উপত্যকা। তার পাশেই হয়ত কোন টিলা সোজা খাঁড়া হয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে।

ধীর পায়ে এগুচ্ছে দলটি। এগুচ্ছে আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে আশপাশের পরিবেশ।

হঠাৎ ডান দিকে টিলার মাঝখানে একটি ফাটল নজরে পড়ল মার্কালীর। দেখে মনে হয় কোন প্রবল ভূমিকম্প এসে দেয়াল ফাঁক করে দিয়ে গেছে।

মার্ক লী ফাটলটির কাছে এসে বাইরে চোখ রাখল; দেখল, সে ফাটল একটি সরু গলি তৈরী করেছে। গলিটি বহুদূর পৰ্যন্ত চলে গেছে, এত দূর যে শেষ মাথা দেখা যায় না।

গলিটিতে প্ৰবেশ করার সিদ্ধান্ত নিল মার্ক লী। কিন্তু গালিটি এতই চিকন যে, ওই পথে উট নিয়ে প্ৰবেশ করা কষ্টকর।

মার্ক লী কোন বাধাই মানলো না, সে তার উট সেই ফাটলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।

উটের হাঁটু দুই পাশের দেয়ালে ঘষা খাচ্ছে। মার্ক লী নিজের পা গুটিয়ে উটের পিঠের ওপর তুলে দিল। অন্য আরোহীরাও তাই করল।

আরোহীর নির্দেশে এগিয়ে যাচ্ছে উট, তাতে দেয়ালের গায়ে বার বার ঘষা খাচ্ছে তার শরীর। উটের হাঁটুর বাড়ি ও গায়ের ঘষার ফলে দেয়ালের মাটি নিচে খসে পড়ছে।

ফাটলের দু’পাশের দেয়াল অনেক উঁচু। উটের ধাক্কা খেয়ে কেঁপে উঠতে লাগল সে দেয়াল। আরোহীদের মনে হতে লাগল, এই বুঝি তা ভেঙে ওদের ঘাড়ের ওপর পড়বে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তেমন কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি।

একবার যদি তাতে ধ্বস নামে। তবে আরোহীসহ পিষে যাবে সবাই। তাই, মার্ক লীসহ সবাই খুব সাবধানে অগ্রসর হতে লাগল।

পথটা ক্রমেই উপরের দিকে উঠে গেছে। যথেষ্ট সতর্কতার সাথে অনেকটা পথ এগুনোর পর ওরা দেখতে পেল, দূরে, অনেক উপরে টিলার দুই পাশ এক হয়ে মিশে গেছে।

দুপাশের দেয়াল উঁচু থাকায় ওদের পথটা ছিল অন্ধকার, তবে উপরের দিকে আলো দেখা যাচ্ছে। এ থেকে তারা বুঝতে পারলো, দিনের আলো এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আর যেখানে পথটা শেষ হয়েছে তারপরে নিশ্চয়ই প্ৰশস্ত কোন উপত্যকা আছে।

গলি ক্রমশঃ সুড়ঙ্গের আকার ধারণ করলো। উটের পায়ের শব্দ ধ্বনি-প্ৰতিধ্বনি তুলে ভীতিকর আওয়াজে রূপান্তরিত হলো। এতেও মার্ক লী থামলো না, সঙ্গীদের নিয়ে এগিয়েই চললো।

এক সময় অন্ধকার কমে গিয়ে আলোর বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করল। মার্ক লী বুঝল, সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে এসেছে প্ৰায়। একটু পরেই তারা সুরঙ্গের মুখে গিয়ে উপস্থিত হল।

উটের পিঠে থাকায় সুড়ঙ্গের মুখের সমতল জায়গাটি তারা হাতের নাগালের মধ্যে পেয়ে গেল সহজেই। তারা নেমে এল সেখানে। কিন্তু উটকে উপরে তোলা তত সহজ হলো না। অনেক কসরত করে, রশি দিয়ে বেঁধে টেনে হিঁচড়ে অনেক কষ্টে উটকে টেনে আনা হল।

মানসিক চাপ ও শারীরিক কসরতের কারণে সবাই খুব কাহিল হয়ে পড়েছিল। তিনজনই বসে পড়ল মাটির ওপর।

একটু সুস্থির হয়ে নজর বুলালো আশপাশে। দেখলো সেখানে একটি বড় দুর্গের দেয়াল এখনো মাথা খাঁড়া করে দাঁড়িয়ে আছে।

মার্ক লী দুর্গটির কাছে গেল। এটি কোন মানুষের সৃষ্ট দুর্গ ছিল না, বরং এ ছিল প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এক কেল্লা। চারপাশের পাহাড়ের আকৃতি এমন ছিল যে, বাইরের দিকটা ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে। ফলে, চারদিক থেকে আবদ্ধ হয়ে এলাকাটি দুর্গের রূপ নিয়েছে। পাহাড়ের উঁচু নিচু চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছিল দুর্গের গম্বুজ।

মার্কলী সঙ্গীদেরকে উটগুলো সেখানেই বসিয়ে দেয়ার জন্য বলল।

উটগুলো বসিয়ে দেয়ার পর ওরা পায়ে হেঁটে দুর্গ এলাকাটা ঘুরে দেখতে শুরু করলো।

পাহাড় ঘেরা দুর্গটা গোলাকার। পা টিপে টিপে হাঁটতে হচ্ছে ওদের। কারণ, বালি মিশ্ৰিত মাটিতে পা দিলেই ঢালুর দিকে হড়কে যাচ্ছিল পা। কোন চলাচলের রাস্তা ছিল না ওখানে। এই বালি ও মাটিই প্ৰমাণ করছে, শত শত বছর ধরে কোন পা পড়েনি এখানে।

আগে আগে চলছে মার্কালী, সঙ্গীরা তার পিছনে। হঠাৎ প্ৰাণ ছ্যাৎ করে উঠল মার্ক লীর। সে কথা বলতে চাইল, কিন্তু কণ্ঠনালী স্তব্ধ হয়ে গেছে তার। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে, পা দুটো যেন মাটির সাথে গেথে গেছে।

সঙ্গীরাও থমকে দাঁড়াল। মার্ক লী কেন দাঁড়িয়েছে বুঝার চেষ্টা করছে তারা। মার্ক লী যেদিকে অবাক করা চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে তাকাল তারা। দেখল, সামনে, এখান থেকে সোজা নিচের দিকে পাহাড়েরই একটা অংশের ওপাশে একটা মন্দির দাঁড়িয়ে আছে।

মার্কলী বলল, “ওটা কি কোন মন্দিরের চূড়া।”

‘চোখের সামনে জ্বলজ্যান্ত একটা মন্দির দেখেও আপনি জিজ্ঞেস করছেন!’ সঙ্গীদের চোখে অজানা আশার ঝিলিক খেলে গেল।

ওরা পাহাড়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে পা টিপে টিপে চলছিল। বাম দিকে বহু দূর খাঁড়া নেমে গেছে পাহাড়ের শক্ত দেয়াল। ওদিকে তাকালে মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। অনেক নিচে দেখা যায় এবড়ো থেবেড়ো বালি ও পাথরের স্তুপ। পা পিছলে কোন রকমে সেখানে একবার গড়িয়ে পড়লে হাড়গোড় ছাতু হয়ে যাবে। তাই খাদের উল্টো দিক দিয়ে পা টিপে টিপে এগুচ্ছিল ওরা।

রাস্তাটা ভয়ানক দুৰ্গম। বিপদজনকভাবে সরু ও খাঁড়াভাবে নেমে গেছে বেশ কিছুটা পথ। মার্ক লীর সঙ্গীদের বুকটা দুরুদুরু করে উঠল। একজন তো তাকে জিজ্ঞেসই করে বসলে, “আপনি কি মনে করেন, ফেরাউন দ্বিতীয় রিম্যান্সের লাশ এই বিপদসংকুল পথ দিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?’

‘আহমদ দরবেশের নক্সা তো তাই বলে,’ মার্ক লী বললো, ‘যে পর্যন্ত আমি নকশা বুঝতে পেরেছি। তাতে যাওয়ার রাস্তা এটিই। রিম্যান্সের লাশের বাক্সটি হয়তো অন্য কোন পথে নেয়া হয়েছে। হয়ত পাহাড়ের খাঁজের ভেতরে সুরঙ্গ পথ থাকতে পারে। সে সব গোপন পথের সন্ধান পরে করবো। আগে নকশার নির্দেশ মত কত দূর যাওয়া যায় দেখতে চাই।”

“এ ধরনের অভিযানে গোপন পথই সাধারণত অভিযাত্রীকে তার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে কেউ গুপ্তধন বয়ে বেড়ায় না।” এক সঙ্গী তার মতামত ব্যক্ত করল।

“আমারও মনে হয় যে, গোপন রাস্তা দিয়েই সম্রাটের লাশ বহন করা হয়েছে। আমাদের তা খুঁজে পেতে হবে। তাহলেই কেবল তার কবর পর্যন্ত যাওয়ার আশা করতে পারি আমরা।”

“তোমাদের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করছি না। তবে মনে রাখতে হবে, শত শত বছর ধরে প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞা এবং বাতাসের তোড়ে পৃথিবীর মানচিত্র অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এতকাল পর সে সব গোপন রাস্তা আদৌ আছে কি নেই, তাই তো আমরা জানি না! আমি তোমাদের নিয়ে অন্ধের মত মরুভূমিতে সুই খুঁজতে চাই না। তারচেয়ে নিশানা ধরে এগিয়ে দেখতে চাই এই সব নকশা আসলেও কোন কাজের কিনা? নকশা ঠিক থাকলে কবর পর্যন্ত আমরা পৌঁছেও যেতে পারি।” বলল মার্ক লী।

“যদি বেঁচে থাকি!” হতাশ কণ্ঠে বলল তার এক সঙ্গী।

‘কোন সন্দেহ নেই।” মার্ক লী বললো, ‘তবে কবর খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকলে আমাদের আর কোন অভাব থাকবে না।’

একটা পাথরের সাথে রশি বেঁধে, রশি ধরে ঝুলে তারা অনেক কষ্টে সেই বিপদজনক পথটুকু পার হয়ে এল।

আস্তে আস্তে রাস্তার প্রশস্ততা ও গভীরতা বাড়তে লাগল। কিছু দূর নিচে নামার পর রাস্তা আবার ওপর দিকে উঠতে শুরু করল।

এখন তারা পাহাড়ের এমন জায়গা পাড়ি দিচ্ছিল, যেখানে দুটি পাহাড় একত্রে মিশে চূড়ার দিকে এগিয়ে গেছে এবং সেখান থেকে আবার শুরু হয়েছে বিপদজনক ঢাল। মার্ক লী সেখানে পৌঁছে ঢাল বেয়ে সোজা নিচে না নেমে বাম দিকের পাহাড়ে আরোহণ করতে লাগলো।

প্ৰায় একশো গজের মত উপরে উঠার পর তাদের সামনে একটি সুড়ঙ্গ পথ চোখে পড়লো। মার্ক লী সঙ্গীদের নিয়ে সেই সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে পড়ল। পথটি ক্রমশ: নিচের দিকে চলে গেছে।

সুড়ঙ্গ পথে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল ওরা। তারপর সহসাই সুড়ঙ্গ শেষ গেল এবং তারা ছোট একটুখানি ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এল।

ফাঁকা জায়গায় এসেই তারা সামনে তাকিয়ে দেখতে পেল দূর দূরান্ত পর্যন্ত পাহাড়ের অসংখ্য ছোট বড় স্তম্ভ আকাশের দিকে মুখ ব্যাদান করে দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভগুলো নিরেট পাথরের এবং পরস্পর গায়ের সাথে লাগানো। প্রতিটি স্তম্ভ থেকেই অসংখ্য চোখা মাথা বেরিয়ে আছে। দৃশ্যটা খুবই ভীতিজনক। এসব স্তম্ভ না মাড়িয়ে সামনে এগুনোর আর কোন পথ নেই। অথচ তা মাড়াতে গেলে হাত-পা জখম হওয়ার আশংকা ষোল আনা।

খুবই সতর্কতার সাথে কঠিন পাথরের ফাঁক গলে ওরা ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগলো। কয়েকবার বাঁক ঘুরে ডানদিকে আবার একটু খোলা জায়গা পেল ওরা। জায়গাটুকু গোলাকার। একটা মঞ্চের মত। এখানকার আবহাওয়াই শুধু নয়, পায়ের নিচের মাটিও অসম্ভব গরম বোধ হলো। আশপাশের পাহাড়গুলোতে শেষ বিকেলের রোদ চমকাচ্ছে।

মার্ক লী অনুভব করলো, এখানকার মাটিতে এমন কোন ধাতু মিশ্ৰিত আছে যে কারণে এলাকাটা উত্তপ্ত হয়ে আছে। গোল মঞ্চসদৃশ এই উপত্যকার চারদিকই পাহাড় ঘেরা। এক পাশে কয়েক গজ লম্বা একটি ফোঁকড়া। ওরা সেই ফোঁকড়ের কাছে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে তিনজনই পিছনে সরে এল। ওরা দেখল, ফোঁকড়ের মুখ পর্যন্ত অনেক গভীর ও বিশাল এক খাদ। খাদের তলদেশে উত্তপ্ত বালুকা রাশি চমকাচ্ছে এবং সেখান থেকে একেবেঁকে কম্পমান ধোঁয়া উঠে আসছে উপর দিকে। ইটের ভাটায় আগুন জ্বালাবার সময় যে কালো ধোঁয়া বেরোয় এর ধোঁয়া তেমন কালো নয়, বরং ডায়িং ফ্যাক্টরীর বাম্পের মত সাদা।

এই গভীর খাদের মাঝখানে একটি প্রাকৃতিক দেয়াল। দেয়ালটি চওড়ায় মাত্র এক গজ, নিচে উপরে সমান চওড়া। যদি মার্ক লীদের ওপারে যেতেই হয় তবে এ প্রাচীর পার হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। দু’পাশের পাহাড়চূড়া এত উঁচু যে তা টপকানোর প্রশ্নই উঠে না।

মার্কালীর মনে হল, সে এখন পুলসিরাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই পথটুকু পার হতে পারলেই সামনে বেহেশত। বেহেশতে তাকে যেতেই হবে এবং পঞ্চাশ গজের মত দীর্ঘ এই দেয়াল পার হতে হবে তাকে।

মার্ক লীর এক সাথী বললো, “এই দেয়ালের ওপর দিয়ে যাওয়ার চেয়ে আমাকে আত্মহত্যার অন্য কোন উপায় বলে দিন।’

‘গুপ্তধনের ভান্ডার রাজপথে পড়ে থাকে না!” মার্ক লী বললো, “আমাদের এ রাস্তা পার হতেই হবে।’

“কিন্তু টুপ করে নিচের জাহান্নামে গিয়ে পড়লে ওই গুপ্তধন খাবে কে?” অপর সঙ্গী বললো।

“আমরা কি পবিত্র ক্রুশ ছুঁয়ে শপথ করিনি, ইসলামের ধ্বংস সাধনের জন্য আমরা এ জীবন উৎসর্গ করবো?” মার্ক লী বললো, ‘যুদ্ধের ময়দানে কি আমাদের সঙ্গীরা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে না?”

‘লড়াইয়ের ময়দানে জান দেয়া আর বেহুদা আগুনে ঝাপ দেয়া এক কথা নয়। আমরা ইচ্ছে করলেই এখান থেকে ফিরে গিয়ে আহমদ দারবীশকে বলতে পারবো, শত শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এখন আর নকশার রাস্তা খুঁজে পাওয়ার কোন উপায় নেই। সে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। যেখানে নদী ছিল সেখানে ধুধু বালি ও পাহাড়ী প্রান্তর। আর নক্সার যেখানে পাহাড়ী উপত্যকা দেখানো হয়েছে সেখানে এখন কিছুই নেই।”

“কিন্তু আমি কাপুরুষ হতে পারবো না। মিথ্যা কথাও বলতে পারবো না। এই দেয়াল আমার মনেও ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমি সে ভয় তাড়িয়ে দিয়েছি। তোমরাও ভয় ডর মুছে ফেলো মন থেকে। এ প্রাচীর বেয়ে আমি ওপারে যাবোই। আমাকে সঙ্গ না দিলে তোমরা ক্রুশের কাছে প্রতারক বলে সাব্যস্ত হবে। আর প্রতারকদের শাস্তি খুব বেদনাদায়ক হয়। আমি আগে আগে যাচ্ছি, তোমরা আমাকে অনুসরণ করো। মাথা চক্কর দিলে বা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে বসে পড়ে আত্মরক্ষা করবে। এমনভাবে বসে যাবে, যেন ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে। সাহস ফিরে এলেই আবার এগুতে থাকবে।”

সহসা সেই গরম বাতাস জোরে বইতে শুরু করল। বালি উড়তে লাগলো। সেই সাথে খাদের ভেতর থেকে ভেসে এল মেয়েদের কান্নার স্বর। যেন দু’তিনজন নারী এক সাথে কান্না জুড়ে দিয়েছে।

মার্কলী ও তার সঙ্গীরা কান খাঁড়া করে শুনতে লাগলো সে কান্নার ধ্বনি। কান্না শুরু হয়েছিল মিহি সুরে বিলাপের মত, এখন তার পরিবর্তে ভেসে আসতে লাগল বিকট আওয়াজ। মার্ক লী ও তাঁর সঙ্গীরা ভয় পেয়ে গেল।

‘এই জাহান্নামে কোন মানুষই বেঁচে থাকতে পারে না। নিশ্চয়ই এসব প্রেতাত্মার কাণ্ড!” ভয়ে ভয়ে বলল এক সঙ্গী।

‘না, এ কোন মানুষের কান্না নয়।’ মার্ক লী বললো, “কোন প্ৰেতাত্মা বা কোন জীবিত প্রাণীর স্বরও নয়! এটা বাতাসের খেলা। বাতাস একটু জোরে বইতে শুরু করায় কোথাও আঘাত খেয়ে ঐ সুরের সৃষ্টি হয়েছে। বাঁশিতে যেমন বাঁশরিয়া ফু দিয়ে সুর তোলে, তেমনি কোথাও এমন কোন ছিদ্র বা সুড়ং আছে যাতে বাতাস ঢুকে এ রকম সুর ও আওয়াজ তুলছে। বাতাস যত জোরে বইবে সুর তত বিকট হবে। এতে ভয় পাবার কিছু নেই।’

মার্ক লীর কথাই সত্যি, এ অঞ্চলের বিভিন্ন টিলার মধ্যে লম্বা লম্বা সুডুং ছিল। বাতাস সে সুডুংগুলোর এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতো। যখন এ বাতাস তোছরাভাবে বইতো তখনি এ ধরনের ধ্বনি শোনা যেতো। দমকা বাতাস প্রবল বেগে বইতে শুরু করলে মনে হতো প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করছে একদল ডাইনী।

নিচে গভীর ও বিস্তৃত খাদ। চারপাশে ভয়ালদৰ্শন উলঙ্গ পাহাড় আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো কান্নার আওয়াজ যে কাউকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মার্ক লীকে তা ভীত সন্ত্রস্ত করতে ব্যর্থ হলো।

কিন্তু তার সাথীদের উপর ভীতি এমন প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করল যে, মার্ক লীর এত কথার পরও তাদের মন থেকে সে ভয় দূর হলো না। তারা এই আওয়াজকে বাতাসের কারসাজি বলে মানতে পারছিল না। তাদের মনে হচ্ছিল, পাশেই কোথাও নারী ও প্ৰেতাত্মারা ক্ৰন্দন করছে। যে কান্নার ধ্বনি তারা নিজ কানে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। মার্ক লীর যুক্তিতর্ক এ সত্যকে আড়াল করতে পারছে না।

বাতাস প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল কান্নার কোরাস।

বাতাসের তোড়ে উড়ে আসা ধুলোবালির ঝাপটা লাগছিল ওদের চোখে মুখে। সেই সাথে ছিল স্নায়ুতন্ত্রে আঘাতকারী কুয়াশা রঙের ধোঁয়া। জমিন থেকে উড়ে আসা হালকা ধুলোবালির মেঘ আর ধোঁয়ার কারণে বেশি দূর দৃষ্টি যাচ্ছিল না। মার্ক লী ও তার সঙ্গীরা এই প্রাকৃতিক দুৰ্যোগ মাথায় নিয়ে ওভাবেই ওখানে দাঁড়িয়ে রইল।”

বেশ কিছুক্ষণ ওখানে অপেক্ষা করার পরও মার্ক লী যখন দেখল দুৰ্যোগ মোটেই কমছে না। তখন সে সঙ্গীদের বলল, “এখানে বেশীক্ষণ থাকলে তোমরা পাগল হয়ে যাবে। এর থেকে নিস্তার পেতে চাইলে ওপারে চলো।”

এই দুর্যোগের মধ্যেই মার্ক লী দেয়ালের উপর প্রথম পা রাখল। দুর্যোগের ফলে একটা সুবিধা হলো তার, ভয়াবহ খাদের নিচ পর্যন্ত দৃষ্টি গেলে মাথায় যে চক্কর দিত। তার হাত থেকে বেঁচে গেল সে।

মার্ক লী পা দিয়েই বুঝল, দেয়ালটি খুবই কাঁচা এবং দুর্বল। প্রাচীরের বালি ও মাটির মধ্যে পা দেবে গেলো তার। কিন্তু তাতে তার সংকল্পে কোন বিঘ্ন ঘটলো না। সে তার দ্বিতীয় পাটিও তুলে আনলো প্রাচীরের ওপর। নিজের অজান্তেই নিচের দিকে দৃষ্টি চলে গেল তার। খাদের গভীরতার কথা মনে হতেই আপাদমস্তক কেঁপে উঠলো সর্ব শরীর। কিন্তু তলদেশ চোখে না পড়ায় ভয়কে সে তাড়িয়ে দিতে পারলো।

মার্ক লী কয়েক কদম এগিয়ে গেল। ক্ৰন্দনের আওয়াজ আরও বেড়ে গেল মনে হয়। এখন তার পায়ের নিচে ভঙ্গুর দেয়াল, দুই পাশে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন গভীর খাদ। ডানে-বায়ে ধরার মত কোন কিছু নেই। প্রবল বাতাসের ঝাপটা লাগছে মার্ক লীর গায়ে। দমকা হাওয়ার ধাক্কায় একদিকে কাত হয়ে যাচ্ছে শরীর। দেহের ওজন মনে হচ্ছে কমে যাচ্ছে।

সে ঘাড় ঘুরিয়ে সাথীদের বললো, “ভয় নেই, সাহস করে পা রাখো, দেখবে আমার মতই চলতে পারছো! ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে অগ্রসর হও! নিচের দিকে মোটেই তাকাবে না। মনে মনে কল্পনা করো, তোমরা মাটির উপর দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে চলছো।’

সঙ্গী দু’জন অসহায়ভাবে একে অন্যের দিকে তাকাল। মার্ক লীকে ছাড়া একাকী ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় হচ্ছিল ওদের, আবার মার্ক লীর মত দেয়াল পাড়ি দিতেও ওদের বুক দুরুদুরু করে কাঁপছিল।

মার্ক লীর তাগাদা পেয়ে একজন অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মত দেয়ালের উপরে পা তুলে দিল। তার দেখাদেখি অন্যজনও। উঠে এল প্রাচীরের ওপর। কয়েক কদম এগুনোর পর যখন সে। বুঝতে পারল দেয়ালের ওপর উঠে এসেছে তখনই একজনের গা কাঁপুনি শুরু হল। কাঁপতে কাঁপতেই কয়েক কদম অগ্রসর হয়ে গেল লোকটি। তারপর দুলতে দুলতে যখন মনে হলো সে পড়ে যাচ্ছে, দেয়ালের ওপর বসে পড়ে আঁকড়ে ধরল।

সঙ্গীর অবস্থা দেখে অন্যজনের মনেও এ ভয় সংক্রামিত হল, সাথে সাথে কাঁপতে কাঁপতে সেও বসে পড়ল প্রাচীরের ওপর। অবস্থাটা এখন আরো নাজুক হয়ে উঠল। সামনে এখনো অনেক পথ বাকী, পেছনে ফিরে যাবে সে উপায়ও নেই, কারণ দেয়াল এতই সংকীর্ণ যে এখানে ঘুরে বসার ঝুঁকিও নিতে পারছে না। উপায়ান্তর না পেয়ে সঙ্গী দু’জন স্থবির হয়ে মরার মত পড়ে রইল দেয়ালের ওপর।

মার্ক লী তাদের মনোেবল বাড়াতে চাইল। বলল, “ঠিক আছে, তোমাদের আর উঠে দাঁড়াবার দরকার নেই। হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আস।”

ওরা সম্মোহিতের মত মার্ক লীর হুকুম তামিল করল। প্ৰায় অর্ধেক পথ এগিয়ে এসেছে ওরা। মাঝামাঝি পৌঁছে, মার্ক লী দেখলো, মাঝখানে দেয়াল একটু ভাঙ্গা ও নিচের দিকে ঢালু হয়ে গেছে। সেখানে চওড়া এত কম যে, দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এবার মার্ক লীও বসে পড়লো।

সঙ্গীরা বসে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছিল, সে তাদের মত বসলো না। ঘোড়ার আরোহীরা যেভাবে দুই, ঠ্যাং দুই দিকে বুলিয়ে দিয়ে বসে সেভাবে দেয়ালের দুদিকে পা বুলিয়ে বসলো সে। দেয়ালের চওড়া ক্রমশ কমে আসছিল। মার্ক লী দুহাত দুদিকে দিয়ে লেংড়া মানুষের মত ঘষটে ঘষটে আস্তে করে নিচে নেমে গেল এবং ভাঙা অংশটুকু পার হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তাকে অনুসরণ করে তার এক সাথীও পার হয়ে এল ভাঙা অংশ। কিন্তু তৃতীয়জন ভাঙা জায়গায় নামতে গিয়ে হঠাৎ পিছলে গেল। তাল সামলাতে গিয়ে পাশ থেকে ছুটে গেল তার হাত। ভয় ও আতংকে আর্ত চিৎকার করে উঠল লোকটি, মার্ক লী আমাকে ধরো।”

কিন্তু তার কাছে এগিয়ে যাওয়ার সময় পেল না কেউ। তার আগেই সে একদিকে ছিটকে পড়ল। “বাঁচাও” বলে বুক ফাটা একটা আর্ত চিৎকার শুধু শুনতে পেল ওরা, কিন্তু তাকে আর দেখতে পেল না। সেই চিৎকারের শব্দ আস্তে আস্তে নিচের দিকে নেমে গোল এবং ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এক সময় মিলিয়ে গেল।

তারা তার পতনের শব্দ শোনার জন্য কান পেতে রইল, কিন্তু তেমন কোন শব্দ শুনতে পেল না। বাতাসে ভেসে বেড়ানো নারী কণ্ঠের আর্ত চিৎকারের নিচে চাপা পড়ে গেল তার পতনের শব্দ। মার্ক লী নিচে তাকালো, কিছুই দেখা গোল না।