একদিন সে অফিসারকে এমন কিছু কথা বলে, যাতে অফিসার নিঃসন্দেহ হয়ে যায়, এ লোক একজন সমর বিশারদ না হলেও কোন মতেই তাকে একজন সহিস বলা যায় না। সহিসের মুখ থেকে এমন কথা বের হতে পারে না।
সেই অফিসার তাকে বললো, “তুমি কে? তোমার পেশা তো সহিস হতে পারে না।”
“আপনাকে কে বলেছি, আমার পেশা সহিস?” রেজাউল বললে, “আমি ক্রাকে ঘোড়ার মালিক ছিলাম। আমি যদিও সৈন্য বিভাগে ছিলাম না, তবে আমার দুই ঘোড়া যুদ্ধে গিয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আমি ঘোড়ার মালিক এখন আস্তাবলের সহিস।
এতে আমার কোন দুঃখ নেই। যে আমার এই দুৰ্গতির জন্য দায়ী আপনি যদি সেই সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করতে পারেন তবে আমার আর কোন আফসোস থাকবে না। বাকি জীবন আপনার জুতা পালিশ করে কাটিয়ে দেব।”
“সুলতান আইয়ুবীর ভাগ্যে পরাজয় লিখা হয়ে গেছে ফ্রান্সিস!’ অফিসার রেজাউলকে বললো।
“কিন্তু কেমন করে?” রেজাউল বললো, “যদি আপনারা ক্রাক ও সুবাকের উপর আক্রমণ চালিয়ে মুসলমানদের অবরোধ করে তাদের পরাজিত করার কথা ভেবে থাকেন তবে ভুল করবেন। মুসলমানরা আমাদের অবরোধ করে যেভাবে জয়ী হয়েছে সেরূপ করে আপনারা যুদ্ধে জয় লাভ করতে পারবেন না।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গী যুদ্ধের উস্তাদ! তারা আমাদের সৈন্যদেরকে কেল্লা থেকে অনেক দূরেই বাঁধা দেয়ার ব্যবস্থা করবে।
যদি এমন কোন আক্রমণ করা যায়, যা সুলতান আইয়ুবীর ধারণা ও কল্পনার বাইরে, তবেই সাফল্যের আশা করা যায়। তখন দেখা যাবে, আইয়ুবী ও জঙ্গী কেল্লাতেই বসে আছে আর আপনারা মিশরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছেন।”
“তাই হবে!’ অফিসার একটু অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বললো, ‘সমুদ্রে কোন দূর্গ থাকে না, মিশরের সমুদ্র তীরেও কোন দূর্গ নেই। অতএব আইয়ুবী জানার আগেই আমরা মিশরের উপরে খৃস্টীয় শাসন কায়েম করবো।”
এভাবেই তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়! তারপর রেজাউল ঐ অফিসারের কাছ থেকে গোপনে ও কৌশলে আরও অনেক তথ্য আদায় করে নেয়।
শক্ররা তাদের যুদ্ধের গোপনীয়তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলে বেড়ায় না। সতর্ক ও বুদ্ধিমান গোয়েন্দারা ইশারা ইঙ্গিত থেকেই অনেক বিষয় বুঝে নেয়। নিজের বুদ্ধি বিবেক কাজে লাগিয়ে এমন সব গোপন তথ্য উদ্ধার করে, যুদ্ধের ময়দানে যার মূল্য অনেক।
রহিম ও রেজাউল প্রতি রোববার সকালেই গির্জায় যেতো এবং ইমরানের সাথে সাক্ষাৎ করতো। ওখানেই তারা ইমরানের কাছে তাদের গত সপ্তাহের কাজের রিপোর্ট দিত।
রহিম ইমরানকে বললো, “বণিকের মেয়ে আলিসা আমাকে প্ৰচণ্ড ভালবেসে ফেলেছে।” ইমরান বললো, “তার ভালবাসায় আঘাত দেবে না। আবার এ ভালবাসার খবর পরিবারে জানাজানি হয়ে গেলে কি প্ৰতিক্রিয়া হবে তা না বুঝে এ প্রেমের কথা প্রকাশও হতে দেবে না। দিলে তোমাকে ওরা ওদের বাড়ী থেকে বের করে দিতে পারে।
রহিম প্ৰেম করো আর যা-ই করো, সব সময় মনে রেখো তুমি একজন গোয়েন্দা অসাবধানে তুমি আবার তার ভালবাসায় তলিয়ে যেও না।”
কিন্তু রহিম আলিসার যৌবন ও সৌন্দর্য্যে প্রায় তলিয়েই যাচ্ছে। আলিসা তাকে এ কথাও বলে দিয়েছে, তাদের বিয়ে শুধু তখনই সম্ভব, যদি সে বাড়ী ও আক্রা শহর থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও যেতে পারে। কেননা তার বাবা কোন এক সামরিক অফিসারের সাথে সম্পর্ক করার তালে আছে।
এ অবস্থার কথা অবশ্য রহিম ইমরানকে জানায়নি।
অল্প দিনেই ইমরান পাদ্রী সাহেবের একান্ত আপন ও ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠল। সে এমন নৈকট্য লাভ করল যে, সে পাদ্রীর একজন গোপন পরামর্শদাতা হয়ে গেল।
পাদ্রীকে সে যে সব প্রশ্ন করতো, তার মধ্যে বুদ্ধিমত্তার ছাপ থাকতো। পাদ্রী সাহেব তার জানার আগ্রহ দেখে অবাক হয়ে যেতেন। পাদ্রী অবসর সময়েও তাকে ধর্মীয় পাঠ দান করতেন।
তিনি ইমরানের মনে এই কথা বদ্ধমূল করতে চেষ্টা করতেন যে, খৃষ্টীয় মতবাদের দায়িত্ব হলো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্ৰান্ত পর্যন্ত ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা। এ উদ্দেশ্য নিয়েই ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। আর এ জন্য যে উপকরণ প্রয়োজন তাই ব্যবহার করা হবে।
প্ৰয়োজনে মুসলমানদেরকে হত্যা করা হবে। তাদেরকে যে কোন পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাদের খৃস্টীয় ধর্মে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
যদি তারা খৃস্টধর্ম গ্ৰহণ না করে তবে তাদেরকে ইসলামের আদর্শ থেকে সরাতে হবে। মুসলমানদেরকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে দিতে পারলেও এ উদ্দেশ্য সফল হয়।
এর জন্য প্রথম কাজ হলো নিজেদের নারীদেরকে এ পথে এগিয়ে দেয়া! এই নারীরা মুসলিম নারী সমাজকে পথে নামাবে। যুবতী নারীদের লেলিয়ে দিতে হবে মুসলমান যুবক, শাসক, সমাজপতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের পিছনে।
এই নারীরা তাদের সকল মহৎ কার্যকলাপ ও শুভ উদ্যোগ বানচাল এবং ধ্বংস করে দেবে।
পাদ্রী ইমরানকে জানাল ইহুদিরাও মুসলমানদের শত্রু। তারাও তাদের নারী সমাজকে এ কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।
মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য ইহুদি নারীদের এ কাজে সহযোগিতা করতে হবে। মুসলমানদের মুসলিম জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে দিতে হবে। দৈহিকভাবে সম্ভব না হলে এভাবেই মুসলমানদেরকে মানসিকভাবে দুনিয়া থেকে উচ্ছেদ করতে হবে।
এজন্যে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়, তাই করতে হবে। এ পদ্ধতি খারাপ, নাজায়েজ, উৎপীড়নমূলক, লজ্জাজনক এ ধরনের কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না।
ইমরান পাদ্রীর কাছে এসব কথা শুনত এবং আর এমন ভাব দেখাত যে এতে সে খুবই খুশি। সুযোগ পেলেই সে এ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।
পাদ্রীর কাছে সামরিক অফিসার, সরকারী অফিসার সহ সব শ্রেনীর লোকেরাই আসত।
সে সময় ক্রুসেডদের বড় দুর্দিন। তারা একের পর এক দুটি যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেছে।
সেখান থেকে পালাতে হয়েছে খৃস্টানদের। সে জন্য ক্রাক শহর ও দূর্গের প্রতিটি লোকের মুখে এক কথাই গুঞ্জরিত হতো, কবে প্রতিশোধ নেয়া হবে। আক্রমণ করা হবে দুৰ্বত্ত মুসলমানদের।”
পাদ্রীর মহফিলে এ ছাড়া অন্য কোন আলোচনাই ছিলো না। ইমরান সেখান থেকে মূল্যবান তথ্য সংগ্ৰহ করতে লাগলো। সে এটাও জানতে পারুল, মুসলমানদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত উদ্যোগে খৃস্টানরা সক্রিয় হলেও আসলে খৃস্টান সরকারগুলোর মধ্যে কোন ঐক্য নেই।
তাদের বহু সম্রাট ও বহু রাষ্ট্র। সকলেই এক ধর্মের অনুসারী বলে সবাই ক্রুশ চিহ্নের উপরে হাত রেখে শপথ করেছে। ইসলামকে ধ্বংস ও নির্মূল করার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের মধ্যে রয়েছে বিশাল ফাটল।
তাদের মধ্যে এমন দেশও ছিল, যারা গোপনে মুসলমানদের সাথে শান্তিচুক্তি করতো আর প্রকাশ্যে খৃষ্টান ভাইদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতো।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল স্যার জেমিনুয়েল। সে একটি যুদ্ধের ময়দানে সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর সাথে আপোষ জ্ঞচুক্তি করে যুদ্ধবন্দী বিনিময় করে নেয়।
এরপর স্যার জেমিনুয়েল অন্যান্য খৃষ্টান সরকারকেও এ জন্য গোপনে উস্কানী দিতে থাকে এই আশায় যে, এতে সফল হলে খৃস্টানরা তাকে এককভাবে আপোষকামী বলে অভিযুক্ত করতে পারবে না।
অন্যদিকে সকলের সাথে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ চালানোর প্রচেষ্টার সাথেও সে সম্পৃক্ত রইল। এ আক্রমণকে দুটি অংশে ভাগ করা হলো। একটি আক্রমণ হবে নূরুদ্দিন জঙ্গীর ওপর, দ্বিতীয়টি মিশরের ওপর।
এ সময় নূরুদ্দিন জঙ্গী ক্রাক শহরেই অবস্থান করছিলেন।
পাদ্রী খৃস্টান শাসকদের ফাটলের খবর সবই জানতেন। এ কারণে তিনি খুবই পেরেশানীর মধ্যে ছিলেন।
ইমরান তাদেরকে এ কথা বলতে পারেনি, যে জাতি তার আপন কন্যাদেরকেও নিজ স্বাৰ্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে আপত্তি করে না, সে জাতি একে অপরকে ধোঁকা দিতে আপত্তি করবে কেন?
যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত হয়ে যারা ধোঁকা প্রতারণার মাধ্যমে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখে, তারা তাদের ভাইদের সাথে ধোঁকা ও প্রতারণার খেলা না খেললে এ খেলায় তারা পারদর্শী হবে কিভাবে?
ইমরান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, সে সুলতান আইয়ুবীকে জানাবে, যদি মুসলমানদের মধ্যে গাদ্দার না থাকতো, তবে মুসলমানরা খৃস্টানদের পরাজিত করে এতদিনে ইউরোপও জয় করে ফেলতে পারতো। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ও দুশমন হচ্ছে গাদ্দার।
আক্রার পাদ্রী ও খৃস্টান রাজন্যবর্গ এই দুর্বলতায় খুবই সন্তুষ্ট ও তৃপ্তিবোধ করছে। ইমরান জানতে পেরেছে, ক্রুসেডাররা মুসলমানদের মাঝে পাপাচার আরও বেশী করে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আপ্ৰাণ চেষ্টা করছে। তাদের এ মিশন দ্রুত এগিয়ে চলছে।
তারা মুসলমানদের ছোট ছোট রাজ্যগুলোর শাসকদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে। এই মুসলিম রাজ্যগুলোর শাসকরা গোপনে খৃস্টানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এদেরকে খৃস্টানরা নির্বিবাদে ইউরোপের মদ, অর্থ ও যুবতী সুন্দরী নারী সরবরাহ করে চলেছে।
ইমরান ও রেজাউল সদা সতর্ক থেকে তাদের গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু রহিম দিন দিন দায়িত্ব থেকে গাফেল হয়ে যাচ্ছে। সে এখন সারাদিন চেষ্টা করে, কি করে সব সময় বণিকের বাড়ীর কাজে ব্যস্ত থাকা যায়। আলিসার ভালবাসা তাকে অন্ধ করতে শুরু করেছে। কয়েকদিন পর আলিসা তাকে বললে, “বাবা এমন এক সামরিক অফিসারের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে, যার বয়স তার দ্বিগুণ হবে।’
আলিসা রহিমকে আরও বলল, “যত বড় অফিসারই হোক, আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।”
আলিসা তার মাকে বুঝিয়েছে, সে ঐ অফিসারের সাথে বিয়েতে রাজী নয়। কিন্তু তার বাবা সে কথা মানছে না; কারণ সে এই অফিসারকে দিয়ে প্রচুর অর্থকড়ি রোজগার করছে। এখন তার কন্যাকে তার হাতে তুলে না দিয়ে তার উপায় নেই। একদিন আলিসা তার গলায় পরা ক্রুশটি রহিমের হাতে রেখে সেখানে তার হাত চেপে ধর্মে বলল, “রহিম, কসম এই ক্রুশের, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।”
রহিমও তার হাতের ওপর হাত রেখে কসম খেয়ে বলল, ‘আলিসা, আমিও তোমাকে বাঁচবো না।”
একদিন পাদ্রীর কাছে চার পাঁচজন সামরিক অফিসার এলো এবং তার খাস কামরায় গিয়ে বসলো। ইমরান তাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারলো, কোন গুরুত্বপূর্ণ গোপন বিষয় আলোচনার জন্য এসেছে তারা। তারা কামরায় প্রবেশের কিছুক্ষণ পর ইমরানও পাদ্রীর কামরায় প্রবেশ করল। এক ফৌজি অফিসার কথা বলছিল, ইমরানকে কামরায় ঢুকতে দেখেই মাঝপথে কথা থামিয়ে চুপ হয়ে গেল!
পাদ্রী বললেন, “জন গিন্থার! তুমি কিছুক্ষণ বাইরেই থাকো! আমরা কিছু জরুরী কথা বলছি।”
ইমরান পাশের কামরায় চলে গেলে অফিসার আবার তার কথা শুরু করল। পাশের কামরায় গিয়ে ইমরান দরোজার সাথে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
তারা কথা বলছিল নিচু স্বরে, তবুও কিছু দরকারী কথা ইমরান বুঝতে পারলো। আর যেটুকু বুঝলো তাতেই তার দফা রফা হওয়ার অবস্থা হলো। ফৌজি অফিসাররা চলে যেতেই ইমরানও সেখান থেকে সরে গেল যাতে পাদ্রীর সন্দেহ না হয়।
সে শুধু কামরার বাইরেই এলো না, গির্জারও বাইরে চলে এল। তার মনে হলো, এখনি তার এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত এবং কোথাও না থেমে সোজা কায়রো গিয়ে পৌঁছা দরকার। সুলতান আইয়ুবীকে এ সংবাদ জানানো দরকার যে, আপনার ওপর কঠিন আঘাত আসছে। যাতে তিনি এ আক্রমণ প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিতে পারেন।
তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হলো এবং অস্থিরতা নিয়েই সে পূনরায় গীর্জায় ফিরে এল।
পাদ্রী তাকে দেখে ডেকে এমন এক কাজে লাগিয়ে দিল যে, সে আর তখন পালাতে পারলো না। তা ছাড়া তার মনে পড়ল, যাওয়ার আগে রহিম এবং রেজাউলের রিপোর্টও জেনে যাওয়া দরকার। সে ধারণা করল, এ সংবাদ তাদের কানেও নিশ্চয়ই এসেছে। যদি তাদের কাছে এ খবরের সত্যতা যাচাই হয়ে যায় তবে আর এখানে কারোরই থাকার দরকার নেই। তাহলে তিনজনই একসাথে আক্রা থেকে বের হয়ে যেতে পারে।
পরক্ষণেই তার মনে হলো, এক সাথে রওনা দিতে গেলে দু’একদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। কিন্তু অপেক্ষা করা কি ঠিক হবে? এসব নানা চিন্তা তাকে অস্থির করে তুলল।
পরের দিনই সে রেজাউলের সাথে দেখা করল। রেজাউল তখন আস্তাবলেই ছিল।
“নতুন কোন খবর পেয়েছিস?” তাকে জিজ্ঞেস করলো ইমরান।
রেজা বললো, “এখানে অসাধারণ তৎপরতা চলছে। যতদূর বুঝতে পারছি, ক্রুসেডাররা এবার স্থলপথে আক্রমণ চালাবে না। মনে হয়, তারা সমুদ্র পথেই আক্রমণ করবে। কিন্তু এর বেশী আর কিছু জানতে পারিনি।’
ইমরান যতটা জানতে পেরেছিল তার কিছু বললো তাকে। বললো, “খৃস্টানরা ফয়সালামূলক যুদ্ধ করার জন্যই এ আক্রমণ চালাবে।” সে রেজাউলকে এই আক্রমণের বিস্তারিত তথ্য সংগ্ৰহ করার জন্য বলল। ইমরান শুধু তার জানা কথাগুলোর সত্যতার প্ৰমাণ পেতে চায়। নতুবা বিস্তারিত সে মোটামুটি জেনেই গেছে।
সে রেজাউলকে বললো, “দু’এক দিনের মধ্যেই এখান থেকে পালাতে হবে। যে দায়িত্ব দিয়ে আমাদের এখানে পাঠানো হয়েছিল বলতে গেলে তা পূর্ণ হয়েছে। এখন ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের তিনটি ঘোড়া বা উটের প্রয়োজন।”
‘কোথাও থেকে চুরি করা ছাড়া সে প্রয়োজন পূরণের কোন ৷ উপায় তো দেখছি না।” বলল রেজাউল।
ইমরান রহিমের সাথেও দেখা করতে চাইলো। তাকেও সতর্ক করে পালানোর কথা বলতে হবে। কিন্তু রাত হয়ে গিয়েছিল বলে সে তার ঠিকানায় যাওয়া ঠিক মনে করল না। কারণ বণিকের বাড়ির ঠিকানায় অন্য কারো যাওয়া উচিত নয়।
সে রহিমের কাছে গেলেও তার দেখা পেত না। কারণ রহিম তখন তার নির্দিষ্ট ঠিকানায় ছিল না। এমনকি সে আক্রা শহরেও ছিল না। যখন ইমরান তার দায়িত্ব পালনে পেরেশান, সে সময় রহিম পেরেশান আলিসাকে নিয়ে।
এক অবাঞ্ছিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিল রহিম। খৃস্টানদের এক ভোজ সভায় মেহমানদের জন্য একটি নাচের আসরের আয়োজন করা হয়েছিল! এ আসরে শরিক ছিল আলিসাও। আলিসার বাগদত্তা তাকে তার সাথে নাচার জন্য বলল। কিন্তু আলিসা তার সাথে নাচতে অস্বীকার করে বসলো এবং তার চেয়ে অল্প বয়স্ক এক যুবকের সাথে নাচতে শুরু করলো। এ নিয়ে সেই অফিসার তার বাবার কাছে অভিযোগ করলো। তাঁর বাবাও সে মহফিলে ছিল।
সেখানে সমানে মদের বোতল খালি হচ্ছিল। আলিসার বাবা মেয়েকে গিয়ে সতর্ক করল। বললো, ‘কেন তুমি তোমার হবু স্বামীর সাথে নাচছে না, কেন তাকে অপমান করছো?”
আলিসা এ কথার কোন জবাব না দিয়ে রাগ করে সেখান থেকে বাড়ী চলে গেল। আসার আগে তার হবু স্বামীকে আসর থেকে সরিয়ে এনে বলল, “খবরদার বুড়ো, আমাকে বিয়ে করার আশা ছেড়ে দে, কোন বুড়োভামকে আমি বিয়ে করবো না। আরেকবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকালে তোর চোখ আমি তুলে ফেলবো।”
এ কথা বলে সে আর সেখানে দাঁড়ায়নি, হতভম্ব অফিসারের নাকের ডগার ওপর দিয়ে সোজা হেঁটে বাড়ি চলে এসেছিল।
এ অপমান সইতে পারলেন না অফিসার। তিনি আলিসার বাবাকে খুঁজে বের করে তাকে নিয়ে তাদের বাড়ীতে এলেন। বয়স হওয়ার কারণে অফিসার রাগকে চরমে পৌঁছতে দেননি, বরং মনে মনে কিছুটা মজাও পাচ্ছিলেন! ভাবছিলেন, মেয়ে মানুষ একটু তেজী না হলে জমে না।
বাড়ী গিয়ে বণিক মেয়েকে খুঁজতে গেল তার কামরায়, কিন্তু দেখলে সেখানে সে নেই। খুঁজতে খুঁজতে তাকে গিয়ে পাওয়া গেল রহিমের কামরায়। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে, গভীর রাতে হবু স্বামী ও পিতার সামনে অলিসা ধরা পড়ল রহিমের ঘরে। ক্ষিপ্ত বাপ পারলে মেয়েকে চুল ধরে টেনে নিয়ে আসে এমন অবস্থা। কর্কশ কণ্ঠে সে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো, “এখানে কি করছিস?”
মেয়েও তেজের সাথেই উত্তর দিল, “আমার যেখানে মন চায় যাবো, যার কাছে ইচ্ছা বসবো। আমাকে নিয়ে কারো মাথাব্যথার দরকার নেই।’
এ রকম জবাব সেই সামরিক অফিসারটির পছন্দ হলো না। তার মনে সন্দেহ জাগল ডাল মে কুচ কালা হ্যাঁয়। আলিসার বাবাকে সে বলল, “ওর সাথে রাগারাগি করার দরকার নেই। মেয়েকে নিয়ে ঘরে চলে যান।”
রহিমের ঘর থেকে ওরা বেরিয়ে যেতেই সেই অফিসার রহিমকে জিজ্ঞেস করলে, “এই মেয়েটি এত রাতে এখানে এসেছিল কেন?”
রহিম উত্তরে বলল, “সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? যে এসেছিল তাকে জিজ্ঞেস করুন?”
“ও কি আজই প্রথম এখানে এসেছে, নাকি আগেও আসতো?”
‘তার জায়গায় সে যতবার খুশি আসবে যাবে, সে জন্য কি যার তার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে?”
লোকটি ছিল সামরিক বিভাগের বড় অফিসার। এতক্ষণ সে যে ধৈর্য ধরে রেখেছিল একজন চাকরের এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে তা আর ধরে রাখতে পারলো না। রহিমকে ধমক দিয়ে বলল, “খবরদার বেতমিজ, সওদাগরের সম্মানে এখনো তোর লাশ পড়েনি, নইলে এতক্ষণে তুই লাশ হয়ে যেতি। কাল ভোরেই তুই এখান থেকে চলে যাবি, নইলে আর কোনদিন জীবিত যাওয়ার সুযোগ পাবি না।”
রহিমের শরীরেও ছিল যৌবনের রক্ত ও ভালবাসার উন্মাদনা। সেও অফিসারের মুখের ওপর জওয়াব দিল, “আমি এখানে থাকবো কি থাকবো না তা নির্ধারণ করবে আমার মুনীব। আমার ব্যাপারে অন্য কারো নাক গলানো আমি পছন্দ করি না।”
এ উত্তপ্ত কথাবার্তা হয়তো আরো চলতো, কিন্তু বণিক এসে দু’জনের মধ্যে মিটমাট করে দিল। যাওয়ার আগে অফিসার আলিসার বাবাকে বলে গেল, “এই লোক যেন আগামী কালের পর আর এখানে না থাকে৷”
পরের দিন আলিসার বাবা এসে রহিমকে বলল, “বাবা, এ ঘটনার পর আর তোমাকে চাকুরীতে রাখা সম্ভব নয়। কারণ সৈন্য বিভাগের এত বড় অফিসারকে অসন্তুষ্ট করলে কেবল যে আমার কারবার নষ্ট হবে তা নয়, প্রাণ নিয়ে বাঁচাও দায় হয়ে যাবে।”
সে রহিমকে উপদেশ দিল, “তুমি আজই এখান থেকে চলে যাও। কারণ সামরিক অফিসার তোমাকে তার কথামত খুন না করলেও বিনা অপরাধেই কয়েকখানায় পাঠিয়ে দিতে পারে।’
রহিম অতীতের সব কথা ভুলে গিয়েছিল। ভয়ংকর বর্তমান মুছে দিয়েছিল তার সব স্মৃতি। ভুলে গিয়েছিল, সে এখানে কোন দায়িত্ব নিয়ে কেন এসেছিল। সে আলিসাকে তার জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলেছিল। আলিসার বাগদত্তার ধমকের উচিত জওয়াব দেওয়ার জন্য তার যুবক রক্ত টগবগ করে উঠল। বণিকের দোকান থেকে বেরিয়ে এল রহিম।
প্রথমে রহিম বণিকের বাড়িতে গেল। আলিসার সঙ্গে দেখা করে বললো, “তোমার বাবা আমাকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করেছে।”
আলিসা বলল, “আমি তোমাকে বরখাস্ত করিনি। আমার হৃদয়ে তুমি ছিলে, আছো এবং থাকবে। আমি বুঝতে পারছি এখানে আমাদের থােক, ঠিক হবে না। আমরা দূরে কোথাও পালিয়ে যাবো।”
“কিন্তু কখন, কিভাবে?”
তুমি আজি সন্ধ্যার সময় এখানে চলে এসো। সে সময় আব্বা বাড়ীতে থাকেন না। লোকজনও সান্ধ্য ব্যস্ততায় থাকে। আজই সন্ধ্যার অন্ধকারে পালিয়ে যাবো আমরা।”
“কিন্তু তোমার আব্বা বরখাস্ত করার পর এখানে আমাদের দু’জনের এক সাথে পথচলা নিরাপদ নয়।’
“তাহলে তোমাকে আমি শহরের বাইরে একটি ঠিকানা দিচ্ছি, সময় মতো ওখানে চলে যেও। আমি আমার বাবার ঘোড়া নিয়ে যথাসময়ে চলে আসবো।”
রাতে যখন ইমরান রেজাউলের কাছে বসেছিল। আর গোপন তথ্য নিয়ে আলোচনা করছিল, রহিম তখন গোপনে শহর থেকে বেরিয়ে আলিসার দেয়া ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। যখন ওরা কি করে জীবনের ঝুঁকি এড়িয়ে তিনজনে একত্রে এখান থেকে পালানো যায় সে চিন্তা করছিল, রহিম তখন আলিসাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য শহরের বাইরে তার বলে দেয়া একটি নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করছিল।
আলিসা বলেছিল, সে তার বাবার ঘোড়া নিয়ে আসবে। আর তারা একই ঘোড়ার পিঠে দু’জন একত্রে পালাবে। রহিম অধৈৰ্য ভাবে আলিসার জন্য অপেক্ষা করছিল, আর ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। সে ভেবে পাচ্ছিল না, আলিসা তার বাবার ঘোড়া কেমন করে চুরি করবে।
আলিসা সময়মতই তার বাবার ঘোড়ার পিঠে জিন বেধে তার উপর লাফিয়ে উঠল এবং দ্রুত বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।
রহিম যখন তাকে দেখলো, তখনো তার বিশ্বাস হচ্ছিল না, আলিসা এসে গেছে।
আলিসা ঘোড়া নিয়ে রহিমের কাছে পৌঁছলো এবং বলল, “রহিম, তাড়াতাড়ি উঠে এসো।”
আলিসার আহবানে রহিম তার পিছনে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলো। কিছু দূর তারা ধীর গতিতে অগ্রসর হলো। শহর ও শহরতলী অতিক্রম করে ঘোড়া থামাল আলিসা। বলল, “এবার ঘোড়ার বাগ তুমি হাতে নাও।”
রহিম আলিসার হাত থেকে ঘোড়ার বাগ হাতে নিল এবং তীব্ৰ গতিতে ঘোড়া ছুটলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আক্রা থেকে অনেক দূরে চলে গেল।