পাপের ফল
মেয়েদের সাথে ভেতরের কামরায় বসে কথা বলছিলেন শামস বখত ও সাদ বখত। বডিগার্ড এসে খবর দিল, ‘কাজী সাহেব এসেছেন।’ মেয়েদের বসিয়ে রেখে দুই ভাই ড্রইং রুমে চলে এলেন কাজী সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। মধ্য বয়সী লোক কাজী আবুল ফজল ইবনুল খাশিব। হারান প্রদেশের প্রধান কাজী তিনি, গুমাস্তগীনের খুব প্রিয়ভাজন ব্যক্তি। ওদের প্রবেশ করতে দেখেই কাজী সাহেব উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘শুনলাম হলব থেকে দূত এসেছে! সে নাকি খাসা উপহারও এনেছে?’
‘হ্যাঁ!’ সাদ বখত বললেন, ‘কেল্লা প্রধান শুয়ে আছেন বলে দূতকে আমরা এখানেই বসিয়ে রেখেছি। উনি উঠলেই ওখানে পাঠিয়ে দেবো।’
‘ভাল করেছো! আমি খলিফার পাঠানো উপহার দুটোই দেখতে এসেছি।’ ইবনুল খাশিব চোখ টিপে বললেন, ‘ওগুলো এক নজর দেখিয়ে দাও না আমায়।’
দুই ভাই কাজীর স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে ভালই জানতো! গুমাস্তগীনের উপর তার কি রকম প্রভাব তাও অজানা ছিল না ওদের। মেয়ে দু’টিকে না দেখালে সে যে ঝামেলা করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই ঝামেলা এড়াতে শামস বখত মেয়ে দু’জনকে তার সামনে এন দেখালেন। কাজী মেয়েগুলোকে যখন দেখলো তখন তার চোখে অবাক করা ঘোর লেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘বাহবা, তোফা! তোফা! এত সুন্দরী!’ শামস বখত মেয়ে দু’টিকে আবার ভেতরের কামরায় পাঠিয়ে দিলেন। কাজী বললেন, ‘এদেরকে আমার কাছে দিয়ে দাও। আমি নিজেই ওদেরকে গুমাস্তগীনের কাছে নিয়ে যাব।’ তার চোখে তখন শয়তান নাচছে।
‘আপনি কাজী মানুষ!’ শামস বখত বললেন, ‘জাতির কাছে আপনার মর্যাদা গুমাস্তগীনের চেয়েও উর্ধে। আপনার হাতে রয়েছে ন্যায় বিচারের মানদন্ড। একি বলছেন আপনি!’
‘তুমি তো এক সামরিক বোকা পাঠা।’ কাজী সাহেব হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘তুমি নগর জীবনের স্বাদ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, আনাড়ি! এসব তুমি বুঝবে না। সেই কাজী বা বিচারক মরে গেছে, যাদের হাতে আল্লাহর আইন, ইনসাফ ও ন্যায়দন্ড ছিল। তারা শাসককে ভয় করতো না, ভয় করতো শুধু আল্লাহকে। বরং শাসকগোষ্ঠীই ভয় পেতো কাজীদের, কখন জনসাধারণের ওপর অন্যায়-অবিচারের জন্য তাদের ধরে বসে! এখন শাসকরা তাকেই কাজী বানায়, যারা সরকারের অন্যায়-অবিচারকেও জায়েয বলে ঘোষনা দিতে পারে। আইনকে নয়, শাসককে খুশী রাখাই এখন কাজীদের কাজ। ভুলে যাচ্ছো কেন, আমি আল্লাহর মনোনীত কাজী নই, আমি কাজী হয়েছি আমার শাসক সম্মানিত গুমাস্তগীনের ইচ্ছায়।’
‘এ জন্যই তো তোমাদের মন মগজে এখন কুফরী বাসা বেঁধে আছে।’ সাদ বখত বললেন, ‘তোমার আর দোষ কি, শাসকই যেখানে ঈমান বিক্রি করে বসে আছে সেখানে তার কাজী তো ঈমান নিলামে তুলবেই! তোমার মত কাজীও আজ রাসূলের উম্মত, এটাই জাতির দূর্ভাগ্য। তোমাদের মত কাজীদের প্রশ্রয় পেয়েই আমাদের শাসক ও আমীররা আজ মেয়েদের সম্ভ্রম ও সতীত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার পায়।’
তিনি আরো বললেন, ‘এ মেয়েরা তোমার মতই কোন মুসলমান ঘরের কন্যা! নিজের কন্যাদের সাথে কেউ অশালীন ব্যবহার করে?’
সেনাপতি শামস বখত যত গুরুত্ব দিয়েই কথাগুলো বলুক না কেন, কাজীর মনে তা কোন রেখাপাত করলো না। কাজী তার কথাকে হাসি ঠাট্টা দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইলো। শয়তান তাকে এতদূর অগ্রসর করে দিল যে, সে সেনাপতিকে তিরষ্কার করতেও ছাড়লো না। হেসে বললো, ‘হিন্দুস্তানী মুসলমানরা যে এত নিরস জানতাম না। তোমরা ভারতবর্ষ ছেড়ে এখানে মরতে এলে কেন?’ কাজীর এ তিরষ্কারে সত্যি সত্যি আহত হলেন শামস বখত। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘শোন কাজী! আমাকে তিরষ্কার করো আর যা-ই করো, আমার কথাগুলো একটু মন লাগিয়ে শোনো! আমি তোমাকে শুধু এ জন্যই সম্মান করছি, তুমি একজন বিচারক। কিন্তু ভুলে যেওনা, তুমি আমার অধীনস্ত একজন কমান্ডার ছিলে! এই তো তোমার পরিচয়! শুধু তোষামোদ ও চাটুকারিতার জোরে তুমি এই পদে উন্নিত হয়েছো। আমি তোমার সম্মানকে অক্ষুন্ন রেখেই বলছি, আমরা কেন হিন্দুস্তান থেকে এসেছি তা শুনে নাও।
ছয়শ বছর আগে মুহাম্মদ বিন কাশিম নামে এক যুবক তার এক মুসলিম বোনের আর্ত চিৎকার শুনে সুদূর আরব থেকে ভারতের মাটিতে পদার্পন করে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন। নারীর ইজ্জত ও সতীত্বকে মুসলমান কতটা গুরুত্ব দেয় সেই যুবকের আবেগের দিকে তাকালে তা তুমি বুঝতে পারতে! তুমি কি জান, ভারতবর্ষ এখান থেকে কত দূরে ও কোথায়? তুমি অনুমান করতে পারো, ঐ যুবক কেমন করে তার সৈন্য বাহিনী উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে সেখানে গিয়ে পৌছেঁছিলো? তুমি তো নিজেও একজন সৈনিক ছিলে! চিন্তা করতে পারো, কেন্দ্র থেকে এত দূরে, কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার যেখানে কোন সুযোগ নেই, খাদ্য ও রসদের কান ব্যবস্থা নেই, সেখানে কোন প্রেরণা ও শক্তি বলে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন? শুধু ছুটে যাননি, যুদ্ধ করে সেখানে বিজয় লাভ করেছিলেন?
স্থূল কামনা বাসনা ত্যাগ করে এর প্রকৃত রহস্যটা একটু বুঝতে চেষ্টা করো! তিনি এমন সব অসুবিধা ও বাঁধা অতিক্রম করে বিজয় লাভ করেছিলেন, যেখানে বিজয়ের কথা চিন্তাই করা করা যায় না! তিনি শুধু বিজয় লাভই করেননি, তিনি ভারতবাসীর মনও জয় করেছিলেন। আর কোন প্রকার অত্যাচার ও আগ্রাসন ছাড়াই সেই কুফরিস্তানে ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
আমরা কেন এখানে এসেছি এবার সেই কথা বলি।
যিনি এক বোনের সম্ভ্রম বাঁচাতে ও ইসলামের আলো জ্বালাতে হিন্দুস্তান গিয়েছিলেন আল্লাহর সেই মুজাহিদদের মৃত্যুর পর এলো তাদেঁর উত্তরসূরীদের যুগ। ধীরে ধীরে তাদের ঈমানী চেতনায় ঘুণ ধরলো। মানবতা ও সভ্যতার বাহকরা হয়ে পড়লো অলস ও বিলাসপ্রিয়। এমন লোকেরা ক্ষমতায় চলে এলো, যারা মুসলিম নামধারী কিন্তু ইসলামের অনুসারী নয়। স্বার্থান্ধ বাদশাহদের হাতে ভুলুন্ঠিত হলো মুজাহিদদের আদর্শ। ইসলাম সীমিত হয়ে পড়লো মানুষের ব্যক্তিগত আচার আচরণ। আবার অন্যায় ও অবিচার চেপে বসলো মানুষের কাঁধে। মানবতা হলো বিপর্যস্ত।
ক্রমে আরো অবনতি ঘটলো সেখানকার। হিন্দু রাজারা অথর্ব মুসলমান শাসকদের ওপর প্রধান্য বিস্তার করলো, যেমন এখানে খৃস্টানরা মুসলমানদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। ইসলামী শাসনের বিলোপ ঘটলো। মুসলিম সাম্রাজ্য ক্রমশঃ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে লাগলো। যখন আমরা যুবক হলাম, সেখানকার মুসলিম শাসনের অবস্থা দেখে দুঃখ ও হতাশায় ছেয়ে গেল আমাদের মন। মুহাম্মদ বিন কাশিম ও তাঁর সাথীদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র থেকে ইসলাম বিতাড়িত। বিশ্ব ইসলামী খেলাফতের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। তারা শুধু আরবের কেন্দ্রীয় শাসন মুক্ত নয়, ইসলামের সামাজিক ন্যায়নীতি থেকেও মুক্ত হয়ে গেল। সামাজিক সুবিচার ও শান্তি থেকে বঞ্চিত মানুষের আত্মার ক্রন্দন আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুললো। আমরা যোদ্ধা বংশের সন্তান। এসব অনাচার ও অশান্তি যখন আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করলো, মুহাম্মদ বিন কাশিমের মত আরেকজন সেনাপতির সন্ধানে আমরা দুই ভাই দেশ ছাড়লাম।
আমরা হিন্দুস্তানের সেই নির্যাতীত মানুষের দূত, যারা ব্যাকুল চিত্তে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে কাশিমের মত এক ত্রাণকর্তার।
আরবের সাথে ভারতের মুসলমানদের যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে, ভ্রাতৃত্বের দাবী নিয়ে আবার তা জোড়া দিতে এসেছি আমরা। আমরা যখন সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর সাথে দেখা করলাম, তিনি বললেন, ‘এখন আমরা হিন্দুস্তানের দিকে কেমন করে অগ্রসর হই? তাকিয়ে দেখো, আরবের ভূমি ভরে গেছে বিশ্বাসঘাতক ও গাদ্দারে। কয়েকটা দিন সবুর করো, এসো এই আরবকে গাদ্দার মুক্ত করে সাচ্চা মুজাহিদদের হাতে তুলে দেই এই শাসনভার। তারপর তোমাদের নিয়ে আমি ছুটে যাব ভারতের সেই মজলুম ভাইদের পাশে।’ কিন্তু আরবে এত বেশী গাদ্দার তৈরী হয়ে গেছে আমাদের জানা ছিল না। নুরুদ্দিন জঙ্গী এক সেক্টরে দুশমনকে পরাজিত করতে না করতেই আরো পাঁচ জায়গায় বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠে। গাদ্দারদের মোকাবেলা করতে গেলে আঘাত হানে কাফের খৃস্টানরা। খৃস্টানদের মোকাবেলা শুরু করলে মাথা তুলে দাঁড়ায় গাদ্দাররা।
এই করে করেই তিনি নিঃশেষ হয়ে গেলেন। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো খৃস্টানরা। তাদের মোকাবেলায় জেহাদের ঝান্ডা তুলে ধরলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। এসব দেখে শুনে আমাদের আফসোস ও দীর্ঘশ্বাস আরো দীর্ঘ হলো। ভারতের ভূখন্ডে মুসলমানদের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে হিন্দুরা, আর এ ভূখন্ডে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে খৃস্টানরা। মরহুম জঙ্গী আমাদেরকে তাঁর সামরিক বিভাগে ঠাঁই দিয়েছিলেন। যখন গুমাস্তগীন, সাইফুদ্দিন ও আজিম উদ্দিনরা গোপনে খৃস্টানদের সাথে আঁতাত করলো, তখন সুলতান জঙ্গী আমাদের দু’ভাইকে গুমাস্তগীনের সৈন্য বিভাগে পাঠিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য, আমরা যেন তাঁর ওপরে সতর্ক দৃষ্টি রাখি। সে গোপনে কি করে, কাদের সাথে যোগাযোগ রাখে এসব দেখার জন্যই আমরা এখানে আছি। নিশ্চয় ভারতবর্ষ থেকে আমরা কেন এখানে এসেছি এ প্রশ্নের জবাব পেয়েছো তুমি?’
‘অর্থাৎ তোমরা দুই ভাই এখানে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছো?’ কাজী ইবনুল খাশিবের কন্ঠ থেকে ব্যঙ্গাত্মক সুর ভেসে এলো।
‘কাজী! আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করো।’ শামস বখত ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, আমাদের মুসলমান আমীররা সেই বীর মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, যারা খৃস্টানদের নাগপাশ থেকে মুসলমানদের মুক্ত ও রক্ষা করতে চায়। আজকের দূত মারাত্মক সংবাদ বহন করে এনেছে।’
তিনি চিঠির সারমর্ম তাকে শুনিয়ে বললেন, ‘গুমাস্তগীনের ওপর তোমার প্রভাব রয়েছে, তুমি তাকে বাঁধা দিতে পারো। তুমি যদি আমাদের সাথে একমত হও, তবে এসো, আমরা গুমাস্তগীনকে বুঝাই, তাকে আমাদের মতে ফিরিয়ে আনি। এসো, গাদ্দারদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেয়ে সুলতান আইয়ুবীর সাথে মিলে যাওয়ার জন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করি। তা না হল তাকে এমন পরাজয় বরণ করতে হবে, যার বেদনা তাকে সারা জীবন ভোগ করতে হবে। এমনও হতে পারে, তাকে সারা জীবন কারাগারে বন্দী কাটাতে হবে। এখনও চিন্তা করার সময় আছে।’
‘তার আগে আমি তোমাদের দুই ভাইকে সারা জীবনের মত কারারুদ্ধ করবো।’ কাজী ইবনুল খাশিব বললো, ‘মেয়ে দুটিকে আমার কাছে দিয়ে দাও।’ কাজী সেই কামরার দিকে পা বাড়ালো, যেখানে মেয়ে দু’টি বসে ছিল।
সাদ বখত তার পথ আগলে দাঁড়ালো। সে সাদ বখতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে ক্ষীপ্ত সাদ বখত রাগে তার মুখে জোরে এক ঘুঁষি মারলো। প্রচন্ড ঘুঁষি খেয়ে উল্টে পড়ে গেল কাজী ইবনুল খাশিব। শামস বখত সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি তার একটি পা কাজীর গলার উপরে চেপে ধরলেন। কাজী কিছুক্ষণ ছটফট করে ঠান্ডা হয়ে গেল। মারা গেল কাজী। কাজীকে হত্যা করার কোন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছিল না এ দুই ভাইয়ের। কিন্তু ঘটনাক্রমে তাই ঘটে গেল।
দুই ভাই চিন্তা করে দেখলো, এখন গ্রেফতার হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই তাদের। শামস বখত তার দুই অফিসারকে ডাকলেন। একজনকে বললেন, ‘জলদি চারটি ঘোড়া প্রস্তুত করো।’ অন্য জনকে বললেন, ‘ঘোড়া প্রস্তুত হলে মেয়েদেরকে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিও।’ তিনি দ্রুত সাদ বখতের সাথে কিছু জরুরী আলাপ সারলেন। ততক্ষণে চারটি ঘোড়ায় জিন চাপিয়ে সেখানে হাজির করা হলো। অন্য অফিসার মেয়েদের নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন শামস বখতের দরজায়। ঘোড়া ও মেয়েদের প্রস্তুত দেখে দুই ভাই এগিয়ে গেলেন সেখানে। শামস বখত মেয়েদের বললেন, ‘তোমাদের সাথে আর আলাপ করার সময় নেই। জলদি ঘোড়ায় চড়ে বসো। আমার লোক তোমাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেবে।’
মেয়েরা পরিস্থিতির নাজুকতা বুঝতে পারল। তারা কথা না বাড়িয়ে দ্রুত গিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসলো। দু’জন বিশ্বস্ত কমান্ডোকে তীর-ধনুক ও তলোয়ার নিয়ে অপর দু’টি অশ্বে আরোহন করতে নির্দেশ দিলেন সেনাপতি শামস বখত। সঙ্গে সঙ্গে হুকুম তামিল করলো ওরা। এরপর সেনাপতি শামস বখত ও তার ভাই সাদ বখত তাদের সাথে করে কেল্লার ফটক পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। সেনাপতির নির্দেশে প্রহরীরা কেল্লার ফটক খুলে দিল। পুরো দলটিকে নিয়ে তিনি কেল্লার বাইরে বেরিয়ে এলেন।
প্রহরীদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে তিনি তাদের চারজনকে বিদায় জানালেন। দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে তাদের বললেন, ‘তোমরা সোজা সুলতান আইয়ুবীর কাছে চলে যাবে। ওখানে পৌঁছে বলবে, আমি পাঠিয়েছি তোমাদের।’
গুমাস্তগীনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতো কমান্ডোরা। চারটি ঘোড়া প্রাণপ্রণে ছুটে চললো আর রিস্তানের দিকে। সেনাপতি দু’জনেরও ওদের সাথেই পালিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু কি চিন্তা করে ওরা আবার দূর্গে ফিরে এলো।
গুমাস্তগীন ততক্ষণে জেগে উঠেছিল। সেনাপতির মহল খালি থাকায় খালিফার দূত ওখান থেকে বেরিয়ে চলে এলো গুমাস্তগীনের মহলে। মহলের প্রহরী গুমাস্তগীনকে খবর দিল, ‘এক দূত আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চায়।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘ঠিক আছে, তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’
দূত ভেতরে প্রবেশ করলে গুমাস্তগীন তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে তুমি? কোত্থেকে এসেছো?’
দূত তার পরিচয় দিয়ে বললো, ‘আমি মহামান্য খলিফা আল মালেকুস মালেহের দরবার থেকে এসেছি।’ সে খলিফার চিঠির কথা বললো এবং সঙ্গে যে সব উপহার সামগ্রী নিয়ে এসেছে সেগুলোর কথাও বললো গুমাস্তগীনকে।
শামস বখত ও সাদ বখত ফিরে এসে গুমাস্তগীনের মহলে গেল। গুমাস্তগীন তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়ে দুটি কোথায়?’
শামস বখত জবাব দিলেন, ‘ওরা নিরাপদ স্থানে চলে গেছে।’
গুমাস্তগীন রক্ত চক্ষু মেলে ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললেন, ‘তার মানে?’
‘তার মানে খুব সোজা। এ দুই মেয়ে ছিল মুসলিম পরিবারের সন্তান। আমি চাইনি ওদের ইজ্জত নষ্ট হোক। তাই আমি ওদেরকে এমন স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছি, যেখানে তাদের ইজ্জত-আবরু রক্ষা পাবে।’
গুমাস্তগীন রাগে তার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। দূত বললো, ‘শুধু তাই নয়, এ দু’জন মিলে আপনার কাজীকেও খুন করে ফেলেছে!’
‘হোয়াট?’ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গুমাস্তগীন তার প্রহরীদের ডাকলো। বললো, ‘এদের পাকড়াও করো।’ দূতকে নিয়ে গুমাস্তগীন সেনাপতি শামস বখতের বাসায় গেলো। দেখলো, সত্যি, সেখানে কাজীর লাশ পড়ে আছে। দূত পাশের কামরায় বসে সেনাপতিদের সাথে কাজী সাহেবের যে বদানুবাদ ও আলোচনা শুনেছিল, সে সব কথা গুমাস্তগীনকে খুলে বললো। গুমাস্তগীন সেনাপতি শামস বখত ও তার ভাই সাদ বখতকে সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন।
হারানের দূর্গ থেকে বের হয়ে চার অশ্বারোহী যখন প্রানপণে ছুটছিল সুলতান আইয়ুবীর দিকে, সুলতান আইয়ুবী তখন হাসান বিন আবদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘এখনও হারানের সেনাপতিদের কাছ থেকে কোন সংবাদ এলো না?’
সেনাপতি শামস বখত ও সেনাপতি সাদ বখতের সংবাদের জন্য সুলতান আইয়ুবী যখন পেরেশান, ওরা তখন কাজী ইবনুল খাশিবের হত্যা এবং আস সালেহের দরবার থেকে নিয়ে আসা দুই মেয়েকে দূর্গ থেকে বের করে দেয়ার অপরাধে কারাগারে বন্দী। ঠিক সে সময় আস সালেহের আর একজন দূত মুসাল দূর্গের অধিপতি গাজী সাইফুদ্দিনের কাছে গিয়ে পৌঁছলো। গাজী সাইফুদ্দিন খেলাফতের অধীনে মুসাল প্রদেশ ও তার আশেপাশের এলাকার শাসক ছিলেন। কিন্তু নুরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে মুসালের স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষনা দেন।
সাইফুদ্দিন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বংশের লোক হলেও তার বিরোধী ছিলো। সাইফুদ্দিন নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করায় মুসাল আর ইসলামী সাম্রাজ্যের অংশ রইল না। নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তিনি সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে পরিচালিত জোটে যোগ দিয়েছিলেন।
তার ভাই আজিম উদ্দিন একজন দক্ষ ও পরীক্ষিত জেনারেল। সাইফুদ্দিনের সেনা বাহিনীর হেড অব দ্যা কমান্ড এই আজম উদ্দিন। অন্যান্য মুসলিম আমীরদের মতই সাইফুদ্দিনও ছিলো ভোগ বিলাস প্রিয় এক শাসক। তার হেরেমেও ছিল দেশী বিদেশী সুন্দরী মেয়ের ছড়াছড়ি। ছিল নর্তকী ও গায়িকার দল।
এ ছাড়া তার ছিল পাখী পোষার এক অদ্ভুত শখ। অসংখ্য মেয়ের মত অসংখ্য পাখীতে ভরা ছিল তার মহল। রং-বেরংয়ের বিচিত্র পাখী খাঁচায় সাজিয়ে তাদের সাথে গল্প করতো সে। সুন্দরী নারী ও রং বেরংয়ের পাখী, দুটোই ছিল তার আনন্দ ও চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম। আজিম উদ্দিনের সামরিক যোগ্যতা ও নৈপূন্যের ওপর আস্থা ছিল তার। তার আশা ছিল, সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করে তার রাজ্য আরো বাড়িয়ে দিতে পারবে আজিম উদ্দিন। এই আশায় সাইফুদ্দিন ও হারান দূর্গের অধিপতি গুমাস্তগীন এবং তথাকথিত খলিফা আল মালেকুস সালেহের মত খৃস্টানদের সাথে বন্ধুত্ব রাখতো। খৃস্টানরা সাইফুদ্দিনকে আশ্বাস দিয়েছিলো, সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তারা তাকে সামরিক সাহায্য দিবে যাবে।
এভাবে সুলতান আইয়ুবীর অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছলো, তার বিরুদ্ধে মুসলানদেরই তিনটি শক্তি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলো।
হলবে আল মালেকুস সালেহ, হারানে গুমাস্তগীন ও মুসালে সাইফুদ্দিন। এই তিনটি মুসলিম শক্তির কেউ কারো চেয়ে কম ছিল না, সামরিক বিচারে এদের কাউকে উপেক্ষা করার মতও ছিল না। এ তিনটি বৃহৎ শক্তি ছাড়াও এদের প্রভাবাধীন ছোট ছোট শেখদের রাজ্য, মুসলিম নবাবদের পরগনার সংখ্যা ছিল অসংখ্য। এরাও সবাই এই তিন শক্তির সাথে ঐক্যজোটে শামিল হয়েছিল। তারা সবাই ঐক্যজোট হয়েছিল বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই একে অন্যকে ভয় করতো।
স্বার্থের ঐক্য তাদের মানসিক দূরত্ব ঘুচাতে পারেনি। তারা কেউ চায়নি, অন্যেরা তার চেয়ে বেশী শক্তিশালী হোক। তাদের অবস্থা ছিল সেই পুকুরের মাছের মত, যেখানে ছোট বড় সব মাছ একত্রে থাকে ঠিক, কিন্তু ছোট মাছগুলো সব সময় বড় মাছগুলোকে ভয় পায়। কোন সুযোগে কে তাকে গিলে ফেলে এই ভয়ে তটস্ত থাকে সব সময়। আর আশা করে, বেঁচে থাকলে সেও একদিন বিশাল মাছ হবে।
সুলতান আইয়ুবী তার ছড়িয়ে দেয়া গোয়েন্দাদের মাধ্যমে বিরোধীদের এ অনৈক্যের সব খবরই নিয়মিত পেয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি কোন বিপদের ঝুঁকি নিতে রাজী ছিলেন না বলে সব সময়ই এ সত্যও স্বরণে রাখতেন, তাঁর সামনে তিনটি বড় সামরিক শক্তি দাঁড়িয়ে আছে। তারা আক্রমণের সুযোগ খুঁজছে। যে কোন মুহূর্তে ওরা একা একা বা এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তার বাহিনীর উপর।
এ কথাও সব সময় মনে রাখতেন, এ তিনটি বাহিনীর সেনাপতি, কমান্ডার ও সৈন্যরা সবাই মুসলমান। তাদের সামরিক শিক্ষা, নৈপূন্য ও বীরত্বও একই ধরনের। এ গুনগুলো ওরা মুসলমান বলেই পেয়েছে। এসব গুন ও যোগ্যতা আল্লাহ অন্য কোন জাতিকে দেননি।
চার-পাঁচ গুন খৃস্টান বাহিনীকে এ মুসলিম বাহিনীর যে কোন দল পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারবে। সেই খৃস্টানরা যতই উন্নত সামরিক অস্ত্র, লৌহ বর্ম, শিরস্ত্রান ও তাজাদম ঘোড়াই ব্যবহার করুক না কেন, তাতেও তাদের পরাজিত হওয়ার কোন আশংকা নেই। সুলতান আইয়ুবী হলব অবরোধ করে মর্মে মর্মে এ সত্য উপলব্ধি করেছেন। এটাই প্রথম ঘটনা, যেখানে মুসলিম সৈন্য মুসলিম সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।
হলব শহরের মুসলমান জনসাধারণ ও সৈন্যরা যেখানে যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছে, শহরের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে যেভাবে জীবন উৎসর্গ করেছে, তার নজীর শুধু মুসলমানই দেখাতে পারে। এই বীরত্বের কথা সুলতান আইয়ুবী তার মন থেকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
সুলতান আইয়ুবীর কেবলি মনে পড়ছে, তিনি ‘মুসলমান হয়ে মুসলমানদের ওপর অভিযান চালিয়েছেন’, এই অপবাদের কথা।
আব্বাসীয় খেলাফতের এক আমীর এ অপবাদ ছড়াচ্ছিল। তাকে মিশর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল খৃস্টানদের সাথে যোগসাজশের অভিযোগে। অথচ প্রকৃত ঘটনা ছিল ভিন্ন রূপ।
সুলতান আইয়ুবী খৃস্টানদের কবল থেকে ফিলিস্তিন ও বাইতুল মুকাদ্দাস মুক্ত করার অভিযানে বেরোলে খৃস্টানদের পদলেহী শাসকরা তার পথ আগলে দাঁড়ায়। ফলে তিনি বাধ্য হন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে।
এ সত্য গোপন করে তার বিরুদ্ধে ইসলামী জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এ অপবাদ ছড়াচ্ছিল দুশমন। ক্ষমতার লোভে অন্ধ শাসকরা এভাবেই চেষ্টা করছিল ইসলামী জনতাকে জেহাদের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে।
মুসলমানদের প্রথম কেবলা এখানে কাফেরের অধীন, সুলতান আইয়ুবী কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। জেরুজালেমকে শত্রুমুক্ত করার চিন্তা অহর্ণিশ ঘুরপাক খেতো তার মাথায়। তার প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনে কাজ করতো এই চিন্তা। এ চিন্তা কখনো তাকে এক জায়গায় শান্তিতে বসতে দেয় নি।
পথের প্রতিটি বাঁধা সরিয়ে তিনি কেবল সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। দুশমনের বাঁধা, গাদ্দারের গাদ্দারী তার পথ রোধ করতে পারেনি কখনো। তার প্রতিটি পদক্ষেপের পেছনে ছিল জেরুজালেমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দুর্মর আকাঙ্খা।
ইহুদীদের পরিকল্পনাও তার অজ্ঞাত ছিল না। তিনি ভালমতই জানতেন, ইহুদীরা ধুরন্ধর ও অসম্ভব কূটকৌশলী। এমন ধুরন্ধর জাত পৃথীবিতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছিলেন, কেন পবিত্র কোরাআন একমাত্র ইহুদীদেরকেই মুসলমানদের প্রকাশ্য শত্রু বলে ঘোষনা করেছে।
তারা কখনো সম্মুখ যুদ্ধে উপস্থিত হয় না। যুদ্ধের ময়দানে তারা লেলিয়ে দেয় মাথা মোটা খৃস্টানদেরকে। বিনিময়ে তাদের দেয় অঢেল আর্থিক সুবিধা। এই সুবিধার পরিমাণ চিন্তা ও কল্পনারও অতীত। এভাবেই খৃস্টনদের বন্ধুত্ব ক্রয় করে নিয়েছে ওরা। আর এই বন্ধুত্বের উসিলায় তাদের বিবেক এবং মাথাগুলোও তারা কিনে নিয়েছে।
খৃস্টানরা এখন বিশ্বময় দৃশ্যতঃ সবচেয়ে বেশী বিত্ত বেসাতের মালিক। ইহুদীরা তাদের শুধু এই সম্পদই দান করেনি, তাদের অসাধারণ সুন্দরী, রূপসী মেয়েদেরকেও তুলে দিয়েছে ওদের হাতে। এই মেয়েরা কেবল রুপে গুণেই অনন্যা নয়, ইহুদীদের জাতীগত কুটবুদ্ধি এবং চাতুর্যেও এরা অতুলনীয়া।
খৃস্টানদের জাতীগতভাবে কব্জা করার পর এবার এসব মেয়েদের ওরা লেলিয়ে দিচ্ছে গাদ্দার মুসলিম আমীরদের পেছনে। নিজেরা না এসে ওদের পাঠাচ্ছে খৃস্টানদের মাধ্যমে। সেই সাথে সেই একই লোভ, সম্পদ ও ক্ষমতার প্রলোভন!
এ ষড়যন্ত্রের কথা যখনই মনে হয় তখনই সুলতান আইয়ুবী কাতর হয়ে পড়েন। খৃস্টানরা তাদের পেছনে ছায়ার মত লেগে আছে। উচ্চ পদস্থ সামরিক আফিসার, দুর্ধর্ষ সেনা কমান্ডার, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, রাজ্যের আমীর ওমরা, এমন কে নেই, যাদের পেছনে ওরা লাগেনি! এরা শত্রুর বেশে আসে না, আসে বন্ধুর বেশে। ফলে ওদের মোকাবেলা করা কত যে দূরূহ তা কেবল ভুক্তভোগীই জানে! কত ভাবে ও কত কায়দায় যে ওরা মুসলমানদেরকে মুসলমানের বিরুদ্ধে কাজে লাগায় তার কোন ইয়ত্তা নেই।
যাদের টোপ গেলাতে পারে না, তাদের কাজে লাগায় একভাবে, যারা টোপ গেলে তাদের অন্যভাবে। মোট কথা, ওদের নজরে পড়লে কারো রেহাই নেই। আজ মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধের উস্কানী দিচ্ছে তাদেরই নিয়োজিত লোকজন। তাদেরই নীলনকশায় মুসলমানরা পরষ্পরের বিরুদ্ধে তাক করেছে অস্ত্র।
এমন কঠিন সময়ে সব সময় চোখ-কান খোলা না রাখলে পতন অনিবার্য। সুলতান আইয়ুবী তাই তার বাহিনীকে সদা সতর্ক ও সর্বদা প্রস্তুত অবস্থায় রেখেছেন। সামরিক বিভাগকে তিনি এমন ট্রেনিং দিয়েছেন এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে এমন সচল রেখেছেন, দুশমনের যে কোন চাল ও পরিকল্পনা চাইতে যা সবসময় অধিক কার্যকর ও ফলপ্রসু। ফলে শত্রুরা কোন ময়দানেই মুজাহিদদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তারা তাদের মেধা, মনন, শ্রম ও যোগ্যতাকে এমনভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিল যে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য লাভের হকদার হয়ে উঠেছিল তারা।
মুসাল প্রদেশে গিয়ে পৌঁছলো হলবের দূত। সঙ্গে তার সুলতান আল মালেকুস সালেহের চিঠি ও উপহার সামগ্রী। এখানেও উপহার হিসাবে পাঠানো হয়েছে অন্যান্য সামগ্রীর সাথে হারানের মত দুই সুন্দরী মেয়েকে।
হারান কেল্লার অধিপতি গুমাস্তগীনের কাছে পাঠানো মেয়ে দুটিকে সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখত নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের পাঠাতে গিয়ে হত্যা করেছিলেন কাজী ইবনুল খাশিবকে। আর সেই অপরাধে নিজেরা বরণ করেছিলেন করাগারের বন্দী জীবন। কিন্তু মুসালের গভর্ণর সাইফুদ্দিন তার উপহার ও পয়গাম ঠিকমতই পেয়েছিলো। মেয়ে দুটি তার অন্দর মহলের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুললো। হলবের দূত তাকেও সে রকম চিঠিই দিলো, যে রকম চিঠি গুমাস্তগীনকে দিয়েছিলো।
তাতে আরো উল্লেখ ছিল, ‘খৃস্টানরা হলববাসীদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পূরন করেনি। ওরা একবার যেহেতু ধোঁকা দিয়েছে, আবারো দিতে পারে। ফলে তাদের আশ্বাসের ওপর ভরসা করা যায় না।
আবার চারদিকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন, তাদের বন্ধুত্ব সরাসরি অস্বীকার করাও এ মুহূর্তে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার উত্তম পন্থা হলো, নিজেরা পরষ্পর ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও ঐক্যবদ্ধভাবে সুলতান আইয়ুবীর ওপর আক্রমণ চালানো। সাফল্যের সম্ভাবনা দেখলে তারা যে তাদের দুয়ার খোলা রাখবে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু রিস্ক নিয়ে তারা আমাদের বিজয়ী করতে আসবে না।
সুলতান আইয়ুবী এখন আর রিস্তান পর্বতের দূর্গম শৃঙ্গের ওপর তাঁবু টানিয়ে বসে আছেন। ভাল খেলোয়াড়ও খেলতে খেলতে এক সময় ভুল করে বসে। পাগল গাছের মাথায় চড়ে ভাবে, কেউ আর তার নাগাল পাবে না। আমাদের জন্য এ এক মহা সুযোগ! আমরা একসাথে তাঁকে আক্রমণ করলে আর খৃস্টানরা একটু সহায়তা করলে তাকে সহজেই পরাস্ত করা সম্ভব।
আমি তো মনে করি, তার সাথে যুদ্ধ করার ও প্রয়োজন হবে না, কেবল অবরোধ করে বসে থাকলে একদিন খাদ্যাভাবেই ধরাশায়ী হয়ে যাবে।
এ চিঠিতেও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সেখানে বরফ গলতে শুরু করেছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সুলতান আইয়ুবীর সামরিক শৃংখলা বরফ গলা পানির প্রবাহে তছনছ হয়ে গেছে। আমাদের ঐক্যজোটের তিন শরীক একত্রে সামরিক অভিযান চালালে, পাহাড়ী প্রান্তরেই সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত ও চিরতরে ধ্বংস করে দিতে পারবো।’
চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘গুমাস্তগীনকেও অনুরূপ চিঠি দেয়া হয়েছে। আশা করি আমাদের ঐক্যবদ্ধ সামরিক জোটকে কার্যকরী করতে আপনিও সচেষ্ট হবেন। সময় নষ্ট না করে আপনার সৈন্য বাহিনী ঐক্যজোটের কমান্ডে নিয়ে আসুন, যাতে সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করে আমরা আমাদের নিজ নিজ রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।’ সাইফুদ্দিন এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে তার ভাই আজিম উদ্দিন, দু’জন সিনিয়ার জেনারেল এবং মুসালের সম্মানিত খতিব ইবনুল মাখদুম কাকবুরীকে ডেকে পাঠালেন। সকলে সমবেত হলে তিনি খলিফার চিঠি সবার সামনে পুনরায় পাঠ করলেন। এরপর তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনারা সকলেই জানেন, আমরা সুলতান আইয়ুবীর বিরোধী। তার আনুগত্য করার কোন ইচ্ছে আমাদের নেই। আমার দেহের শিরায় যে রক্ত প্রবাহিত, তার দেহের শিরাতেও ঠিক একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এখন আপনারা বলুন, এ পত্রের আমি কি জবাব দেবো?’
‘এ ব্যাপারে আপনার ইচ্ছা কি?’ জানতে চাইলেন খতীব ইবনুল মাখদুম কাকবুরী। ‘আমার ইচ্ছে, প্রকাশ্যে এই ঐক্যজোটে যোগ দেয়া। কিন্তু শর্ত থাকবে, যে এলাকা আমাদের সৈন্য দ্বারা বিজিত হবে সে এলাকা আমাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। সেখানে অন্য কেউ আধিপত্যের দাবী করতে পারবে না।’
এক সেনাপতি বললো, ‘আপনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারচেয়ে উত্তম আর কোন সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আমাদের সৈন্যরা যে এলাকা জয় করবে, সে এলাকার হকদার আপনি, এতে কারো কোন আপত্তির প্রশ্ন উঠতে পারে না।’
‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খৃস্টান ও সুদানীদের পরাজিত করতে পারলেও আমাকে পারবে না। কারন আমাদের উভয়ের শরীরে একই রক্তধারা প্রবাহিত এবং আমি তার যুদ্ধ কৌশল ভাল করেই জানি।’ বললো সাইফুদ্দিন।
অপর এক সেনাপতি বললো, ‘আপনি আপনার সৈন্য বাহিনী ঐক্যবদ্ধ জোটে শামিল করে দিন কিন্তু সৈন্য পরিচালনার কমান্ড আপনার হাতেই রাখবেন। আপনি আপনার সৈন্য বাহিনীকে এমনভাবে পরিচালনা করবেন, যেন আমাদের সফলতা হলব ও হারানের থেকে সম্পূর্ন পৃথক থাকে।’
‘শাহানশাহে মুসাল! আমি আপনার আদেশের ওপর জীবন কোরবানী করে দেবো।’ প্রথম সেনাপতি বললো, ‘আমরা আপনাকে এই মুসলিম সাম্রাজের শাহানশাহ বানিয়ে দেবো, যে স্বপ্ন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী দেখছেন।’
‘গাজী সালাহউদ্দিনের মাথা এনে আপনার পদতলে রেখে দেবো।’ বললো অপর সেনাপতি, ‘তার সৈন্য বাহিনীকে আর রিস্তানের পাহাড়ী এলাকা থেকে বেরই হতে দেবো না। আপনি সত্বর যুদ্ধ যাত্রার আদেশ দিন। আমাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধ যাত্রার জন্য সম্পূর্ন প্রস্তুত হয়ে আছে।’
দুই সেনাপতিই উচ্ছাস ও আগ্রহে টইটম্বুর। কার চেয়ে কে বেশী তাবেদারী ও খোশামুদি করতে পারে তার যেন প্রতিযোগিতা চলছিল। সেনাপতি আজিম উদ্দিন চুপচাপ বসে শুনছিলো ওদের বক্তব্য। খতীব ইবনুল মাখদুম কখনও সেনাপতিদের মুখের দিকে, আবার কখনো সাইফুদ্দিনের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন ওদের মনোভাব।
‘আজিম উদ্দিন, তোমার কি ধারনা?’ সাইফুদ্দিন তাঁর ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনার এই সিদ্ধান্তে আমরা একমত, আমরা সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।’ আজিম উদ্দিন বললো, ‘কিন্তু আমাদের সেনাপতিদের এমন আবেগপ্রবণ কথা শোভা পায় না, যেমন আমাদের দুই সেনাপতি বলেছেন। সুলতান আইয়ুবীকে এতটা হালকভাবে দেখা কোন অভিজ্ঞ সেনাপতির কাজ নয়।
আমি বলছি না, সুলতান আইয়ুবীকে আমরা পরাজিত করতে পারবো না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, যিনি অল্প ক’জন সৈন্য নিয়ে খৃস্টানদের বহুগুণ সৈন্যের মোকাবেলা করে তাদের পরাজিত করেছেন, যিনি মরুভূমির সৈন্য নিয়ে পাহাড়ের বরফ ঢাকা প্রান্তরে যুদ্ধ করে শত্রুদের পরাজিত করতে পারেন, যিনি সম্রাট রিমান্ডের সৈন্য বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছেন, তিনি বরফ গলা পানি প্রবাহের মধ্যেও ভালমতই যুদ্ধ করতে পারবেন, এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।
আমাদের আগেই খুশী হওয়ার কোন কারন নেই। শক্রকে কোন সময় দুর্বল ভাবতে হয় না। আপনি নিজেই চিন্তা করুন, যাঁর সঙ্গে আপনি যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন, তার সামরিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কেমন? চিন্তা করুন সেই যুদ্ধের ময়দানের কথা, যেখানে কেবল তার সৈন্যরাই যুদ্ধ করবে না, জিততে হলে আপনাকেও সেখানে যুদ্ধ করতে হবে। তার সৈন্যদের মোকাবেলায় আপনার সৈন্যরা সে ময়দানে যুদ্ধ করতে কতটা বেশী পারঙ্গম, সেটাও আপনাকে চিন্তা করতে হবে।’
এরপর আজিম উদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের যোগ্যতা ও গুণের প্রশংসা শুরু করলো। সুলতান আইয়ুবীর রণকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করলো বিজ্ঞ সেনাপতির মতো।
এরপর যে ময়দানে যুদ্ধ হচ্ছে সে ময়দানের অবস্থার ওপর আলোকপাত করে বললো, ‘বরফ গলতে শুরু করেছে এবং বসন্তের ঋতুতে প্রবল বর্ষনের সম্ভাবনাও আছে। এ বৎসর বৃষ্টি একটু দেরিতেই হচ্ছে। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যরা এখনও তাঁবুতেই আছে। কিন্তু ঘোড়া তো আর তাঁবুর মধ্যে নেই। এ সময় তাদের সামরিক অশ্বগুলো নিশ্চয় পর্বতের গুহায় ও গাছের নিচে আছে। উট ও ঘোড়া এ অবস্থায় বেশীক্ষণ সবল ও সুস্থ থাকে না।
আমরা এ আশাও করতে পারি, আইয়ুবীর সৈন্যরা পাহাড়ী অঞ্চলের ভয়ংকর শীতে থাকতে থাকতে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে। আবার এ কথাও খেয়াল রাখতে হবে, যদি আমাদের সৈন্য হলব ও হারানের সৈন্যদের সাথে মিশিয়ে ফেলি, তবে সুলতান আইয়ুবী আমাদের সকলকে অবরোধ করে ফেলতে পারে।
বিশেষ করে এ কথাও স্মরণ রাখা দরকার, মুসলমান সৈন্যরা যখন অন্য মুসলিম বাহিনীর সামনা-সামনি হবে, তখন এমনও হতে পারে, তারা পরষ্পর যুদ্ধ করার পরিবর্তে আপোষে মিলেও যেতে পারে।
তারা একে অপরের বিরুদ্ধে তলোয়ার উন্মুক্ত করবে, কিন্তু সেই তলোয়ার সহসাই আবার কোষবদ্ধও হয়ে যেতে পারে। রক্ত প্রবাহের পরিবর্তে এক অন্যের সাথে মেতে উঠতে পারে কোলাকুলিতে।’
‘আজিম উদ্দিন!’ সাইফুদ্দিন তার কথার মাঝখানে বলে উঠলেন, ‘তুমি একজন সৈনিক! তুমি শুধু রক্ত, তীর ও তলোয়ারের চমক সম্পর্কেই চিন্তা করতে পারো, বাকী খবর আমার কাছে শুনে নাও। যুদ্ধের চাল আমারাও কম জানি না। মুসলমান সৈনিককে কেমন করে মুসলমানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করানো যায় শিখে নাও আমার কাছ থেকে।