» » পাপের ফল

বর্ণাকার
🕮

কামরায় ফিরেই সে তার সঙ্গের মেয়েটিকে আলতো নাড়া দিয়ে ফিসফিস করে ডাক দিলো, ‘এই!’

ঘুম ভেঙ্গে গেলে মেয়েটির। সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ব্যাপার!’

মেয়েটি যা দেখেছিল বললো তাকে। দু’জনের কাছেই খঞ্জর ছিল। খঞ্জর হাতে নিয়ে ওরা বাইরে বেরিয়ে এলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো, কিন্তু তাদের চোখে সন্দেহজনক আর কিছুই পড়লো না। বারান্দা থেকে এবার উঠানে নেমে এলো তারা। সায়েকাকে তারা কিছুই জানালো না, তাকে জাগালোও না। কিন্তু কেমন করে যেন সায়েকারও ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে বিছানা হাতড়িয়ে দেখলো, যে দুই মেয়ে রাতে তার সাথে শুয়েছিল, ওরা কেউ বিছানায় নেই। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো সে। ঘরে বাতি জ্বালালো। দেখলো, ঘরের দরজা খোলা। সে বারান্দায় এসে নাম ধরে ডাকলো তাদের। তার ডাক শুনে মেয়েরা উঠোন থেকে তাড়াতাড়ি তার কাছে ছুটে এলো।

‘কি ব্যাপার! বাইরে কি করছো তোমরা?’ প্রশ্ন করলো সায়েকা। যে মেয়েটি বাথরুম করতে বেরিয়েছিল সে বললো, ‘বাথরুমে যেতে গিয়ে বাইরে উঠানের পাশে মানুষের ছায়া নড়তে দেখলাম। মনে হলো, এখানে কেউ ওঁৎ পেতে আছে।’

‘এখন কোথায় সে লোক?’

‘এখন তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না!’ হতাশ কন্ঠে বললো মেয়েটি। ‘যাও, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

সায়েকা তাদেরকে বললো, ‘তোমরা বাইরে এসে কি দেখতে কি দেখেছো, কে জানে! কোন ছায়া দেখলেই তাতে আঘাত হানতে হবে, এ বুদ্ধিই বা তোমাদের কে দিল?’

মেয়েটি ঘাবড়ে গিয়ে বললো, ‘মনে হয় এটা কোন মানুষের ছায়া না, হয়তো হুজুরের কোন ভক্ত জ্বীনের! নইলে ভোজবাজীর মত সে অদৃশ্য হয়ে গেল কি করে?’

‘যারই ছায়া হোক, ও নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। তোমরা নির্ভয়ে ঘুমুতে যেতে পারো।’ সায়েকা বললো। সায়েকার অভয় বাণীতে তারা বরং আরো ভয় পেলো। ভয় তাদের মানুষকে নয়, অন্য কিছুর। তবে কি সত্যি এটা জ্বীনের ছায়া ছিল? নইলে সায়েকা ছায়াকে আঘাত হানতে নিষেধ করলো কেন?

তিনজনই বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলো। এক মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘সায়েকা, সত্যি করে বলো তো, আসলেই কি ওটা জ্বীনের ছায়া ছিল?’

‘জানি না। তবে এরা আমার বাবার ভক্ত ও অনুসারী। তাদেরকে তোমরা জ্বীনই মনে করো, আর যা-ই মনে করো। আমি তাদের কাছে কোনদিন যাইনি। আমার বিশ্বাস, তারা আমাদেরকে পাহারা দিতেই রাতে বাড়ির চারপাশে ঘোরাফেরা করে।’

‘শ্রদ্ধেয় খতীব যেমন পরহেজগার, তেমনি সম্মানিত।’ একটি মেয়ে বললো, ‘তাঁর ভক্ত ও অনুসারী যেমন মানুষ, তেমনি জ্বীনেরাও তার ভক্ত হতে পারে।’

‘হতেই পারে!’ সায়েকা বললো, ‘সে জন্যই বলছি, তোমরা তাদের ভয়ও পেও না, আবার তাদের কাছেও যেও না।’

খতীব সাহেব কারাগারের এক কামরায় বন্দী। তিনি জানেন না, সাইফুদ্দিন তার সাথে কেমন ব্যবহার করবে। একজন প্রহরী টহল দিচ্ছিল তার কামরার সামনে। খতীব তাকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘আমাকে একটি কোরআন শরীফ দিতে পারো?’

‘কোরআন শরীফ? এখানে……..!’ প্রহরী অবাক হয়ে বললো, ‘এখানে তো হুজুর কোরআন পাঠের লোক আসে না! এই জাহান্নামে আমি কোরআন শরীফ কোথায় পাবো! এখানে শুধু পাপীরাই আসে। আসে চোর, ডাকাত, খুনী। ওদের তো কোরআনের দরকার হয় না! এখানে কোন কোরআন শরীফ নেই। আপনি শুয়ে থাকুন।’

প্রহরী ডিউটিতে চলে গেল। খতীব সাহেব কোরআনের হাফেজ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর অনেক সুরা ও আয়াত মুখস্ত ছিল। তিনি সুললিত কন্ঠে সুরা আর রাহমান পাঠ করতে শুরু করলেন। নিশুতি রাতের বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো খতীব ইবনুল মাখদুমের যাদুময় মিষ্টি কন্ঠের সুর। কারাগারের দুর্বহ পরিবেশে এক মোহময় আবহ সৃষ্টি হলো। কেবল সে কামরা নয়, সমগ্র কারাগারেই ভেসে বেড়াতে লাগলো হৃদয় উজাড় করা সে সুরের মুর্ছনা।

যখন সুরা পড়া শেষ হলো, তাঁর মনে হলো, ওখানে তিনি শুধু একা নন। তিনি দরজার দিকে তাকালেন, দেখলেন, উর্দি পরা জেল দারোগা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুর ধারা।

‘কে আপনি?’ জেল দারোগা খতীবকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি ছয় বছর ধরে এই জেলখানার দায়িত্বে আছি। এখানে কোরআন পাঠের শব্দ এই প্রথম শোনলাম।’ সে আরো বললো, ‘এমন সুললিত কন্ঠের কোরআন তেলাওয়াত আমি জীবনেও শুনিনি। কোরআনের বাণী এই প্রথম আমার মনের গভীরে প্রবেশ করলো। এ কিতাব আমার মাতৃভাষায় লিখিত, অথচ এমন করে কোরআনের অর্থ আর কোনদিন আমার অন্তরে ঢেউ তোলেনি।’

‘আমি মুসালের খতীব!’ খতীব তাঁর পরিচয় দিলেন।

‘আপনি এমন কি অপরাধ করেছেন যে, আপনার মত সম্মানিত ব্যক্তি আজ কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দী?’ জেল দারোগা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো।

খতীব উত্তর দিলেন, ‘আমার অপরাধ বড় গুরুতর, আমি তোমাদের বাদশাহর আদেশ আমান্য করে কোরআনের আদেশকে প্রাধান্য দিয়েছি।’

‘আপনি আবার পড়ুন!’ দারোগার কন্ঠ থেকে ঝরে পড়লো বিগলিত অনুরোধ, ‘আমার মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে এক দুরারোগ্য ব্যাধি। এ এমন এক ব্যাধি, যার থেকে বাঁচার কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। যেই আপনি সুমধুর কন্ঠে তেলাওয়াত শুরু করলেন, আমার মনের বিষ ধীরে ধীরে বের হতে শুরু শুরু করলো। হুজুর, আমি কাতর কন্ঠে অনুরোধ করছি, আপনি আবার একটু কোরআন পড়ুন।’

খতীব আগের চেয়েও আবেগ ঢেলে এমন করুন স্বরে সূরা আর রাহমান পড়লেন, মনে হলো বিশ্ব প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে শুনছে এ তেলাওয়াত।

দারোগা কামরার মোটা লোহার শিক ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ থেকে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রু। খতীব সুরা শেষ করে চুপ করলেন।

দারোগা চোখ বন্ধ করে সুরা আর রাহমানের একটি আয়াত বার বার আওড়াতে লাগলো। এক সময় সে চোখ খুলে বললো, ‘আপনার কন্ঠ এত সুমধুর ও যাদুময়, এমন তেলাওয়াত শুনতে নিশ্চয় জ্বীনেরাও নেমে আসবে মাটির পৃথিবীতে।’ দারোগা বললো, ‘শুনেছি কোরআন মানুষের সব জিজ্ঞাসারই জবাব দেয়। আপনি কি কোরআন থেকে আমার একটি প্রশ্নের জবাব বের করে দেবেন?’ খতীব বললেন, ‘কোরআন তো শুধু ঈমানদারদের প্রশ্নেরই সমাধান দেয়।’

‘আর যাদের ঈমান দৃঢ় নয় তাদের?’

‘তাদের মনে ঈমানের আলো উজ্জল করে।’ খতীব বললেন, ‘তোমার প্রশ্নটা কি শুনি?’

দারোগা বললো, ‘আমার মনের মধ্যে এক প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা আছে! জানি না এটা ঈমানের আলো, না কি প্রতিশোধের অগ্নিশিখা! আমি সেই সৈন্য বিভাগে যোগ দিতে চাই, যারা জেরুজালেম জয় করবে। আমার এ আশা কি পূরণ হবে?’

‘যদি তুমি জেরুজালেম বিজয়ের অংশীদার হওয়ার আকাঙ্খী হয়ে থাকো, তবে শুনে রাখো, তুমি অতি সত্বর সেখানে পৌঁছে যাবে, যে বাহিনী জেরুজালেমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’ খতীব বললেন, ‘মুসলমানের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস শত্রু মুক্ত করার স্বপ্ন তো একজন খাঁটি ঈমানদারের স্বপ্ন! তুমি প্রতিশোধের কথা বলছো কেন?’

‘আমি কোন কয়েদীর সাথে এমনভাবে কথা বলি না।’ দারোগা বললো, ‘আপনি আমার আত্মায় যে প্রশান্তির প্রলেপ মেখে দিলেন, সে কারণে আপনার সাথে প্রাণ খুলে কথা বলছি। আমার আত্মার শান্তি প্রয়োজন।’ একটু থেমে সে বললো, ‘আমি বায়তুল মুকাদ্দাসের বাসিন্দা! আমার জন্মভূমি আজ খৃস্টানরা জবর দখল করে রেখেছে। মুসলমানদের সেখানে ভেড়া-বকরির চেয়েও নিকৃষ্ট পশু মনে করা হয়। খৃস্টনরা সেখানকার মুসলমানকে যখন ইচ্ছা গরু ছাগলের মত জবাই করছে। যাকে ইচ্ছা কারাগারে পাঠাচ্ছে। যাকে ইচ্ছা ধরে নিয়ে গিয়ে বেগার খাটাচ্ছে। যুবতী মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এরপরও আপনি জানতে চান কিসের প্রতিশোধ নিতে চাই আমি? জেরুজালেমের প্রতিটি মানুষ আজ অক্ষম আক্রোশে নিজেদের মাথার চুল ছিড়ছে। তাদের অন্তরে প্রতিনিয়ত ধিকিধিকি জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন।’

‘আমি জানি। সবই জানি আমি। তাইতো সেখানকার মুসলমানরা আজ সুলতান আইয়ুবীর পথ প্রাণে চেয়ে আছে।’ বললেন খতীব।

‘সাত বছর আগের ঘটনা।’ দারোগা বললো, ‘একদিন এক খৃস্টান আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল তার কাজের জন্য। কাজটি ছিল ভারী বোঝা বহন করে তার বাড়ীতে পৌঁছে দিতে হবে। আমি অভিজাত পরিবারের সন্তান। কখনো বোঝা বহন করিনি। তাই সে আমাকে বোঝা উঠাতে বললে, আমি অস্বীকার করলাম। সে আমার মুখের ওপর থাপ্পড় মেরে বললো, ‘মুসলমান হয়ে তুই আমার বোঝা উঠাতে অস্বীকার করিস! এত বড় সাহস তোর।’ আমারও মাথায় তখন রাগ চড়ে গেল। আমি তার মুখে জোরে একটি ঘুষি মারলাম। সে পড়ে গেল। আমি তার মাথার চুল ধরে টেনে তুলে আবার ঘুষি মারলাম। সে আবারও পড়ে গেল।

ইতিমধ্যে কয়েকজন খৃস্টান এসে পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরলো। দেখতে দেখতে সেখানে ভীড় জমে গেল খৃস্টানদের। ছুটে এলো খৃস্টান সিপাইরা। তারা আমাকে মারতে মারতে বেগার ক্যাম্পে নিয়ে গেল। সেখানে আমি তিনদিন কাটালাম। তৃতীয় দিন রাতের বেলা এক প্রহরীকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরে তার খঞ্জর কেড়ে নিয়ে তাকে খুন করে সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। তারপর ছুটলাম বাড়ির দিকে। রাতেই বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম। আমার ভয় ছিল, রাতারাতিই আমার গোষ্ঠির সমস্ত লোককে সে এলাকা থেকে সরিয়ে আনতে না পারলে পুরো গোষ্ঠীর ওপরই ওরা ব্যাপক ধ্বংসলীলা শুরু করে দেবে। কিন্ত বাড়ি পৌঁছে দেখি, আমি পৌঁছার আগেই আমার বাড়িটা ওরা ধ্বংস করে দিয়েছে। আমার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে মাটির সাথে মিশে আছে। ওখানে আমার পরিবারের কোন লোককেই পেলাম না। আমি আমার এক মুসলিম প্রতিবেশীর দরজায় গিয়ে করাঘাত করলাম। সে ভয়ে ভয়ে দরজা খুললো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার বাড়ির ওরা সব গেছে কোথায়?’ সে যা বললো তাতে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। সে বললো, ‘খৃস্টানরা আমাদের পরিবারের সব পুরুষকে ধরে বেগার ক্যাম্পে নিয়ে গেছে।’ আমার দু’টি অবিবাহিত বোন ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওদের কি হয়েছে?’ সে জানালো, ‘খৃস্টানরা ওদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। যতক্ষণ ঘরে আগুন জ্বলছিল ততক্ষণ একদল সৈন্য বাড়ির চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়েছিল, যাতে কেউ আগুন নেভাতে না পারে।’

তখন আমার মনের কি অবস্থা হয়েছিল তা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন। আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমার বোনদের আর ফিরে পাবো না। পরিবারের অন্যান্যদের মুক্ত করাও আমার সাধ্যের বাইরে। যদি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি, আমাকেও ধরা পড়তে হবে। আর আমাকে আবার ধরতে পারলে আমার মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে। সেখানে আমার ওপর কি পরিমাণ নির্যাতন ও অত্যাচার করা হবে ভাবতেই শিউরে উঠলাম আমি।

আমি কোন মুসলমান ঘরে আশ্রয় নেয়ার মত বোকামী আর করলাম না। কারণ আমি জানি, এখন আমি যার ঘরেই আশ্রয় নেবো, খৃস্টানরা টের পেলে তার সমস্ত বাড়ী ধ্বংস করে দেবে। সে বাড়ীর লোকজনদের খুন করবে, নয়তো গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে বেগার ক্যাম্পে। আমি আর দেরী না করে সে রাতেই জেরুজালেম থেকে বের হয়ে এলাম। রক্ত আমার টগবগ করছিল, কিন্তু আমি অসহায়। আমি কোথায় যাবো, কি করবো তার কোন ঠিক ছিল না। কোনকিছু না ভেবেই আমি একদিকে হেঁটে চললাম। ভোর হয়ে এলো। সূর্য উঠলো ফাঁকা রাস্তায়। আমি হেঁটেই চলেছি। বিপর্যস্ত অবস্থা আমার। দেখতে দেখতে ভোরের কুয়াশা ও রোদের মিষ্টি আমেজ সরে গিয়ে তেতে উঠল সূর্য। এ সময় এক খৃস্টানকে দেখলাম ঘোড়ায় চড়ে আমার দিকেই আসছে। এ লোক সৈনিক ছিল না, সাধারণ এক নাগরিক। লোকটি কাছে এলে আমি তাকে থামিয়ে একটু পানি চাইলাম। সে ঘোড়ার পিঠে বাঁধা চামড়ার থলে থেকে যেই আমাকে পানি দিতে হাত বাড়াল, আমি হেঁচকা টানে তাকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিলাম। লোকটি এমন অতর্কিত হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে মাটিতে উঠে বসার আগেই তার কোমর থেকে তলোয়ার কেড়ে নিলাম। লোকটি খালি হাতে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু আমি তার তলোয়ার দিয়েই তাকে হত্যা করে ফেললাম। তারপর তার ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত ছুটলাম খৃস্টান অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে দ্রুত পলিয়ে যাওয়ার জন্য।

এই নিয়ে দু’জন খৃস্টানকে আমি হত্যা করলাম। কিন্তু তাতেও আমার মনের আগুন নেভেনি। আমার মনে হচ্ছিল, অত্যাচারী সব খৃস্টানকে আমি একাই শেষ করে ফেলি। এই রাগ ও ক্ষোভ নিয়ে আমি পাগলের মত ছুটছিলাম। সারাদিন, সারারাত কত যে ঘুরে বেড়ালাম তার ইয়ত্তা নেই। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়িয়েছি মনে নেই আমার। ক্ষৃধা ও পিপাসার অনুভূতি মরে গিয়েছিল আমার। বারবার কেবল মনে হচ্ছিল, বাপ-মার কথা, ভাই-বোনদের কথা। নিজের কথা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। কখনো ঘোড়া থামিয়ে খৃস্টানদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া তলোয়ার উঁচিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার শরীর কাঁপতে শুরু করতো। চোখ ঝাপসা হয়ে যেতো। কতক্ষণ এভাবে কেটে যেতো খেয়াল থাকতো না। আমি বারবার আল্লাহকে ডাকলাম। বললাম, ‘হে আল্লাহ, আমাদের কোন পাপের জন্য এ শাস্তি দিচ্ছো আমাদের? আমি পাপী হলে তার শাস্তি তো আমারই পাওয়া উচিত! আমার ছোট্ট দু’টি বোন ও শিশু ভাইটি তো নিষ্পাপ। তাদের কেন শাস্তি দিচ্ছো আল্লাহ!’ কিন্তু আমার কোন প্রশ্নেরই কোন জবাব পেলাম না আমি। আমি বারবার সিজদায় পড়ে আল্লাহকে ডাকলাম। কিন্তু মনের আগুন তাতেও নিভলো না। শেষে আমি আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা শুরু করলাম, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার মন থেকে প্রতিশোধের আগুন নিভিয়ে দাও। আমার সব স্মৃতি ভুলিয়ে দাও। আমার মনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে দাও। আমার অন্তরকে অনুভূতিশূন্য করে দাও।’ ঘুরতে ঘুরতে এক সময় আমি মুসালের এক গ্রামে এসে পৌঁছলাম। এখানে ভয়ের কোন আশংকা ছিল না। কোন খৃস্টান ধরে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দেবে, এখন আর এ ভয় নেই। কিন্তু তারপরও আমার মনে কোন শান্তি ও স্বস্তি ফিরে এলো না। প্রতিটি মুহূর্ত অশান্ত ও অধীর চিত্তে কাটতে লাগলো আমার। আমি গ্রামের মসজিদে চলে গেলাম। ইমাম সাহেবকে বললাম, ‘আল্লাহকে পাওয়ার পথ দেখিয়ে দিন আমায়। বলুন, কোথায় গেলে আমি আমার আত্মার শান্তি ফিরে পাবো?’ কিন্তু ইমাম সাহেবও ব্যর্থ হলো আমাকে শান্ত করতে।

আমি সেখান থেকে ছুটে গেলাম অন্য গ্রামে, সেখান থেকে ছুটলাম আরেক গ্রামে। ছুটতে ছুটতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। রাত হলে মসজিদে কাটিয়ে দিতাম রাত। দিনের বেলা ছুটে বেড়াতাম এখান থেকে ওখানে। প্রায় রাতেই বোনদের স্বপ্নে দেখতাম। তাদের ফোঁপানো কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেতো আমার। মনে হতো, ওরা আমাকে তিরষ্কার করছে, অভিশাপ দিচ্ছে আমাকে। একদিন এক লোক আমাকে বললো, ‘খৃস্টানদের ওপর প্রতিশোধ নিতে হলে সেনাবাহিনীতে যোগ দাও।’ সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গী ফিলিস্তিন মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করছেন, এ কথা তো আমার জানাই ছিল। তার নেতৃত্বে খৃস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে তখন ঘোরতর যুদ্ধ চলছে। আমরা বায়তুল মুকাদ্দাসে বসে খবর পেতাম কোন ময়দানে কে হারলো, আর কে জিতলো। জেরুজালেমে খৃস্টানরা যখন আমাদের ওপর অত্যাচার, উৎপীড়ন চালাতো তখন আমরা তাদের অত্যাচারের ধরণ দেখে বুঝতাম, যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে ওরা কেমন মার খেয়েছে। মুজাহিদদের হাতে মার খেয়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়তো নিরস্ত্র মুসলমান প্রজাদের ওপর। এরপর আমরা শুনতে পেলাম গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নাম। এই নাম শুনলেই খৃস্টানদের চেহারায় ভয়ের বিভীষিকা নেমে আসতো। তারা তার নিন্দা ও গালমন্দ করতো। সেখানে আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল, সুলতান আইয়ুবী ঝড়ের মত ছুটে আসছে। কিন্তু দিনের পর দিন গেল, সেই ঝড় আর আঘাত হানলো না বায়তুল মোকাদ্দাসে। সেখানকার মুসলমানদের আশার প্রদীপ হয়ে তাদের অন্তরে তখনো জ্বলছিল একটি নাম, গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।

আমি মুসালের সেনা দলে ভর্তি হয়ে গেলাম। কিন্তু কোন সমর ক্ষেত্রে না পাঠিয়ে আমাকে এই কারাগারের দায়িত্বে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এখানে এসে দেখলাম আমি উৎপীড়ন ও নির্যাতনের আরো অনেক নতুন রূপ। এত বিচিত্র উপায়ে মানুষের ওপর অত্যাচার চালানো যায়, এই দায়িত্বে না এলে আমি জানতেই পারতাম না।’ দারোগা আরো বললো, ‘এখানে আমি মানুষের ওপর এমন উৎপীড়ন হতে দেখেছি, তাতে আমি নিজেই কেঁপে উঠেছি। জেরুজালেমে খৃস্টানরা মুসলমানদের ওপর যেমন উৎপীড়ন চালাচ্ছে, এখানে মুসলমানরাই মুসলমানের ওপর সেই উৎপীড়ন করছে। এখানেও নিরাপরাধ ব্যক্তিকে ধরে এনে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আর সে শাস্তি দিতে হচ্ছে আমাকেই। আমি বুঝতে পারছি, কেন আপনাকে এখানে এনে বন্দী করা হয়েছে। আপনাকে শাস্তি দেয়ার কাজও হয়তো আমাকেই দেয়া হবে। আপনি জানেন না, আমরা কত ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারি। আমাদের নিষ্ঠুরতার বিবরণ শুনলে আপনি বেহুশ হয়ে যাবেন। আমার সহকর্মীদের স্বভাব পশুর মতই নিষ্ঠুর ও নির্বোধ। তাদেরকে মানুষ বলতে হয় এ জন্য যে, তারা মানুষের মত চলতে ও কথা বলতে পারে। নইলে মানবিক বোধ বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই তাদের মধ্যে। আমি এখনো ততটা পশু হয়ে উঠতে পারিনি। বন্দীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করার পর এখনো গোপনে আমি কষ্ট ও বেদনা অনুভব করি। অত্যাচার করার আগে তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, কি তাদের অপরাধ? কিন্তু সহানুভূতির এই প্রেরণা আমার মনকে হালকা করার পরিবর্তে আরও ভারী করে দেয়। আমার মনে শান্তি আসে না, আমার চোখের সামনে থেকে আমার বোনদের সেই স্মৃতিও সরে যায় না। আমার মনে শুধু এই অনুভবই জাগে, যতদিন পর্যন্ত খৃস্টানদের ওপর প্রতিশোধ নিতে না পারছি, ততদিন আমি অশান্ত ও অধীর থাকবো।

আজ আপনার মুখে কোরআনের যে বাণী শুনলাম, ‘তোমরা তোমার প্রতিপালকের কোন কোন দানকে অস্বীকার করবে?’ জানিনা এ কথা শুনে আমার মনে কেন তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। আমার মনে হচ্ছে, আপনি আমাকে সেই পথ বলে দিতে পারবেন, যেখানে আমি একটু শান্তির পরশ পাবো।’ সে গরাদের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে খতীব ইবনুল মাখদুমের জোব্বার প্রান্ত ধরে অধীর কন্ঠে বললো, ‘হুজুর, বলুন, কোথায় গেলে আমি একটু শান্তি পাবো? কেমন করে আমি প্রতিশোধ নেবো? আমার মাথায় সব সময় রক্ত চড়ে থাকে। আমি কি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যাবো?’ খতীব বললেন, ‘তুমি তো আল্লাহর কালাম শুনেছো! আল্লাহর সীমাহীন দান থেকে নিরাশ হতে নেই। তুমি প্রতিশোধের নেশায় অধীর হয়ে আছো। কিন্তু এখানে থেকে তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। তুমি যে সেনাপতির অধীনে আছো, সে কোনদিন বায়তুল মুকাদ্দাস যাবে না।’

‘কেন! কেন যাবে না?’

‘কারণ সাইফুদ্দিনের সৈন্য বাহিনী সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।’ খতীব উত্তর দিলেন, ‘খৃস্টানদের সাথে আঁতাত করে সে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফায়সালা করেছে।’

দারোগার দৃষ্টি খুলে গেল। খতীব তাকে বুঝিয়ে বললেন, মুসলমান শাসকরা এখন কি করছে।

দারোগা বললো, ‘আমি বেশ কিছুদিন ধরে এ ধরনের কথা শুনে আসছি, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, আমাদের শাসকরা আমাদের সেই সব বোনদের আর্তনাদের কথা ভুলে যাবে, যারা খৃস্টানদের পশুত্বের শিকার হয়েছিল এবং এখনও হচ্ছে।’

‘তারা সব ভুলে গেছে।’ খতীব বললেন, ‘তারা তাদের কথা শুধু ভুলে যায়নি, নিজেদের ঈমান এবং বিবেককেও হারিয়ে ফেলেছে। এরা এখন নিজেরাই মুসলমান মেয়েদেরকে অপহরণ করে উপহার ও উপঢৌকন হিসেবে বিভিন্ন আমীরদের কাছে পাঠাচ্ছে। এসব মেয়েদের ওরা উপভোগের বস্তু বানিয়ে নিয়েছে। নিজেদের অন্দর মহল ও দরবারের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করছে ওদের। সুলতান আইয়ুবী এই বিলাসিতা ও বেহায়াপনার বিরোধীতা করেন। তাই এ বিলাসপ্রিয় আমীর ও শাসকদের শত্রু তিনি। সুলতান আইয়ুবী কোরআনের নির্দেশ অমান্য করে যারা জাতির মান সম্মান ও ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তিনিই এখন মুসলিম মিল্লাতের শেষ আশা ভরসার স্থল। এই দায়িত্ব পালনে তিনি এমনি নিবেদিতপ্রাণ, তাঁর কোন বাড়ী বা ঠিকানা আছে কি না সে দিকে তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁর জীবন ও যৌবনকে তিনি মরুভূমি ও পাহাড় পর্বতের রণক্ষেত্রেই অতিবাহিত করে দিচ্ছেন। আমার অপরাধও তাই, আমি মুসালের আমীরকে কোরআনের নির্দেশ মত চলতে বলেছিলাম। তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, কোন মর্দে মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে তোমার পরাজয় নিশ্চিত। কোরআনের যে পবিত্র বাণী একটু আগে তোমাকে শুনিয়েছি, যে বাণী তোমার ওপর যাদুর মত প্রভাব ফেলেছে, আমি সেই কালামই মুসালের আমীরকে শুনিয়েছিলাম। তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, তোমার মত পাপিষ্ঠদেরই মাথার চুল ও পা ধরে পাকড়াও করা হবে। আমি তাকে কোরআনের এ আদেশও শুনিয়েছিলাম, যদি তুমি মন মগজ থেকে ক্ষমতার মোহ ত্যাগ না করো তবে জাহান্নামের গরম পানির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলা হবে তোমাকে। কিন্তু সে আল্লাহর আদেশ মানতে অস্বীকার করলো, আর আমাকে এ উপদেশ দেয়ার অপরাধে কারাগারে নিক্ষেপ করলো।’

‘আপনার এখানে খুব কষ্ট হবে।’ দারোগা তাঁকে বললো, ‘দেখি, আমি আপনার কোন উপকারে আসতে পারি কিনা।’

‘পার্থিব কোন দন্ড বা শারীরিক শাস্তি আমাকে কোন কষ্ট দিতে পারবে না।’ খতীব বললেন, ‘দুনিয়ার এই জাহান্নামে আমি কষ্ট স্বীকার করতে রাজী আছি। আল্লাহর পথের মুসাফির এসব কষ্টকে কষ্ট মনে করে না। হ্যাঁ, একটি বিষয়ে আমি বেশ মনোকষ্টে আছি। আমার একটি মাত্র কন্যা, সে যুবতী! অনেক দিন হলো আমার স্ত্রী মারা গেছে। আমি শুধু ওই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। আমার সেই কলিজার টুকরার নিরাপত্তা নিয়ে আমি বড়ই দুশ্চিন্তায় আছি। ও একদম একাকী অবস্থায় কি করে যে একটি বাড়ীতে থাকবে এটাই আমার বড় ভাবনা!’

‘আমি তার দেখাশোনা করবো।’ দারোগা বললো।

‘সকলেরই মোহাফেজ এক আল্লাহ।’ খতীব বললেন, ‘আমি তোমাকে আমার বাড়ীর ঠিকানা বলে দিচ্ছি। আমার একমাত্র কন্যা সায়েকাকে বলবে, সে যেন মন শক্ত করে বাড়ীতেই থাকে। আমার ব্যাপারে যেন কোন চিন্তা না করে। যদি এখানে কোরআন পাঠে কোন বিধিনিষেধ না থাকে তবে আমার মেয়েকে বলবে, সে যেন আমার কোরআন শরীফটা তোমার কাছে দিয়ে দেয়।’

দারোগা ভোরেই খতীবের বাড়ী চলে গেল। তাঁর কন্যা সায়েকাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘তুমি তোমার পিতার সর্ম্পকে কোন দুশ্চিন্তা করো না। তিনি ভালো আছেন এবং আল্লাহর পথে আছেন।’ দারোগা সায়েকাকে আরো বললো, ‘তোমার বাবার মত মহৎ ও নেককার লোক আর হয় না। আমি একদিনেই তোমার বাবার ভক্ত হয়ে গেছি। তাঁকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করবো আমি। কিন্তু সরকারী সিদ্ধান্তও আমাকে মানতে হবে। কারণ আমি সরকারের একজন সামান্য কর্মচারী মাত্র। সাধ্য থাকলে আমি তাকে মুক্ত করে দিতাম।’ সে সায়েকাকে বললো, ‘তোমার বাবা বলেছেন তার কোরআন শরীফটা নিয়ে যেতে।’

সায়েকা বললো, ‘বসুন। আমি কোরআন শরীফ এনে দিচ্ছি।’

দারোগা বসলে সে তার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বললো। এ আলাপের মাধ্যমে সে আশ্বস্ত হলো, দারোগা অন্তর থেকেই তার বাবার মঙ্গল কামনা করে। এক পর্যায়ে দারোগা আবেগময় কন্ঠে বললো, ‘তোমার বাবার জন্য আমি জীবনের ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত।’

সায়েকা বললো, ‘আপনি তো জানেন, কি অপরাধে বাবাকে কারাগারে আটকে রেখেছে। আমার ভয় হয়, সাইফুদ্দিন তাকে না নির্যাতন সেলে নিয়ে যায়! বাবা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সহযোগী এটা কিছুতেই বরদাস্ত করবে না সাইফুদ্দিন। আচ্ছা, তাকে কি কারাগার থেকে পালানোর সুযোগ করে দেয়া যায় না? আমরা পিতা ও কন্যা দু’জনই মুসাল থেকে পালিয়ে যেতাম তাহলে?’

দারোগা একটু হেসে বললো, ‘আল্লাহর যা মঞ্জুর হয় তাই হবে। আমি তো তাকে আমার শ্রদ্ধেয় পিতার আসনে বসিয়ে নিয়েছি। তার চোখে ঈমানের যে জ্যোতি দেখেছি তাতে তিনি পালাতে রাজি হবেন কিনা জানি না। যদি তিনি রাজি হন, তবে তাকে কারগার থেকে মুক্ত করার নেক ইচ্ছা আমার আছে। দোয়া করো, আল্লাহ যেনো আমাকে আমার এ নেক ইচ্ছা পূরণ করার সুযোগ দেন।’

‘আমি আপনার জন্য দোয়া করবো এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও করবো।’

‘তুমি মেয়ে মানুষ। বয়সে তরুণী। তুমি কিছু করতে যেয়ো না এবং এ গোপন কথা কারো কাছে প্রকাশও করতে যেয়ো না।’

‘আমি আব্বা হুজুরের জন্য কোরআন শরীফ নিয়ে আসছি।’

সায়েকা ভেতরে চলে গেল। দারোগা বসে রইলো। অনেকক্ষণ পর ফিরে এলো সায়েকা। তার হাতে কোরআন শরীফ। সে কোরআন শরীফটি দারোগার হাতে দিয়ে বললো, ‘আমি মুসালের আমীরের কাছে যাচ্ছি, বাবার সাথে দেখা করার অনুমতি চাইবো তার কাছে।’

‘হ্যাঁ, যাও। দেখা করার এটাই নিয়ম।’ দারোগা বললো। তারপর কোরআন নিয়ে চলে গেল সে।

সায়েকা প্রস্তুত হয়ে সাইফুদ্দিনের দরবারে রওনা হলো। দরবারের বাইরে শাহী ফটকে থামিয়ে দেয়া হলো তাকে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মত সাইফুদ্দিন সবাইকে প্রকাশ্যে ও খোলাখুলি দেখা করার সুযোগ দিতো না। গভর্ণর হলেও তার চালচলন ছিল রাজার মত। মদ পান ও অন্দর মহলে আমোদ-স্ফুর্তি করেই সময় কাটাতো তার। মহলে চলতো নাচ-গানের জমজমাট আসর। বাকী সময় কাটাতো সুলতান আইয়ুবীকে কি করে মোকাবেলা করবে সেই পরিকল্পনা করে। দেশের জনগণের কোন খবর সে রাখতো না। তাদের অভাব অভিযোগ শোনার মত অবসরও ছিল না তার। পাপ-পূণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের ব্যাপারে তার কোন বাছবিচার ছিল না। এ নিয়ে কোন ভয়ও ছিল না তার। জনসাধারণের কাছে তার একটাই প্রত্যাশা ছিল, তারা যেন তার নিরঙ্কুশ আনুগত্য করে।

সায়েকা সাইফুদ্দিনের সাথে দেখা করতে গেলে দারোয়ান তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে তুমি?’

‘আমি মুসালের খতীব ইবনুল মাখদুমের কন্যা সায়েকা।’

দারোয়ান শুনেছিল, খতীব হঠাৎ পাগল হয়ে গেছেন এবং তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। খতীবকে সবাই সম্মান ও শ্রদ্ধা করতো। এ খবর শুনে সবাই যেমন বিস্মিত হয়েছিল তেমনি সমবেদনাও অনুভব করেছিল অন্তরে। দারোয়ার তাকে বললো, ‘তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি দেখি তিনি তোমাকে দেখা করার অনুমতি দেন কিনা?’ দারোয়ান একজনকে দিয়ে সাইফুদ্দিনের কাছে খবর পাঠালো, ‘খতীব ইবনুল মাখদুমের কন্যা আপনার সাথে দেখা করতে চায়।’

একটু পর ফিরে এলো প্রহরী। বললো, ‘মনিব তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিতে বলেছে।’

সাইফুদ্দিনের অনুমতি পেয়ে গেট খুলে দিল দারোয়ান। প্রহরী সায়েকাকে বললো, ‘আসুন আমার সাথে।’ সে সায়েকাকে সাইফুদ্দিনের দরবারে নিয়ে গেলো।

সাইফুদ্দিন বসেছিল দরবারে। সায়েকাকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। মানুষ নয়, যেনো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক পরী। সে এ মেয়ের রূপ ও সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। সাইফুদ্দিন ছিল এক ধুরন্ধর মেয়ে শিকারী। সে সায়েকাকে সাগ্রহে পাশে বসার ইঙ্গিত করে বললো, ‘আরে! দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো!’ সে বুঝতে পারলো মেয়েটা কেন তার কাছে এসেছে। সায়েকা তার বাবার মুক্তির আবেদন জানানোর আগেই সাইফুদ্দিন বলে উঠলো, ‘দেখো মেয়ে! আমি জানি, তুমি কেন এসেছো। আমি নিরুপায় হয়েই তোমার বাবাকে কারাগারে বন্দী করেছি।’ সে সায়েকার কাছে তার আগমনের কারণ জিজ্ঞেস না করেই বললো, ‘যদি তাকে দু’এক দিনের মধ্যে মুক্তি দেয়া সম্ভব হতো তবে তাকে আমি বন্দীই করতাম না। আমি তাকে মুক্তি দিতে পারব না।’

সায়েকার চেহারা মলিন হয়ে গেল, কিন্তু সে কেবল মুহুর্তের জন্য। সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে জ্বলে উঠলো ঈমানের জ্যোতি। সায়েকা নির্ভয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো সাইফুদ্দিনের দিকে, ‘তার অপরাধটা কি?’

‘তার অপরাধ গাদ্দারী।’ সাইফুদ্দিন বললো।

‘তিনি কি খৃস্টানদের সাথে হাত মিলিয়েছেন?’

‘না, তিনি খৃস্টানদের সাথে হাত মিলাননি, তবে আমার শত্রুর পক্ষ নিয়েছেন।’

‘আমি তো জানতাম মুসলমানের শত্রু হচ্ছে খৃস্টান! তিনি যদি খৃস্টানের সাথে হাত না মিলিয়ে থাকেন তবে তিনি আপনার বিরুদ্ধে গাদ্দারী করলেন কিভাবে?’

‘রাজ্যের শত্রু, সে খৃস্টান হোক বা মুসলমান, তার সাথে যোগসাজস মানেই রাজ্যের ক্ষতি করা। এটা রাষ্ট্রীয় অপরাধ এবং এমন অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।’ সাইফুদ্দিন প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার বাবা কি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সমর্থক নন?’

সায়েকা উত্তরে বললো, ‘আমি বলতে পারবো না, তিনি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সমর্থক কিনা। তবে তিনি যদি আইয়ুবীর সমর্থকও হন, আমি সেটাকে দোষের মনে করি না।’

‘আমি বুঝতে পারি না, তোমরা বাপ-বেটি এমন আহাম্মকের মত কথা বলছো কি করে? তোমরা কি জানো না, তিনি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মিশর থেকে ছুটে এসেছেন? যে লোক আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায় তার পক্ষে কথা বলা কি অন্যায় নয়?’

তৎক্ষণাৎ এ প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারলো না সায়েকা। কিভাবে সে বুঝাবে, সুলতান আইয়ুবী এক মর্দে মুজাহিদ। তিনি মুসলমানদের শত্রু নন, বরং তিনিই এখন মুসলিম মিল্লাতের আশা ভরসার শেষ আশ্রয়, একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু! ভাবছিল সে।

সাইফুদ্দিন বললো, ‘আমি আশ্চর্য হই, লোকেরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে ফেরেশতা মনে করে কেমন করে? সে তো মেয়েদের ব্যাপারে একটা পশু! দামেশক ও কায়রোতে তার অন্দর মহল তোমার মত শত শত যুবতী মেয়েদের দিয়ে ভরে রেখেছে সে। কোন মেয়েকেই সে তিন চার মাসের বেশী কাছে রাখে না। একটু পুরনো হলেই হলেই ওদেরকে সে দিয়ে দেয় সেনাপতিদের হাতে। যুদ্ধের সময় তার সেনাবাহিনী যখন কোথাও আক্রমণ করে, তখন তারা মোটেও ভাবে না, এটা মুসলমানের বাড়ী, নাকি অমুসলমানের। বিজিত প্রতিটি বাড়ীঘরে সে লুটপাট করে, যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায় সঙ্গে। তোমার মত সুন্দরী মেয়ে তার চোখে পড়লে রেহাই নেই।’ সাইফুদ্দিন আরো বললো, ‘তুমি আমার প্রজা, তোমার মানসম্মান রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। তোমার বাবার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই। আমি তাকে যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে আমার বন্দী করতে হলো।

তিনি ছাড়া তোমার তো আর কেউ নেই, তাই না? আমি তোমার অসহায়তা বেশ বুঝতে পারছি। তুমি যে তোমার নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছো, তাও বুঝতে পারছি। আমার তো মনে হচ্ছে, তোমাকে আর তোমাদের বাড়িতে পাঠানো ঠিক হবে না। একা একা খালি বাড়ীতে থাকা ঠিক কবে না তোমার।’ সাইফুদ্দিন সায়েকাকে অভয় দিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে, কোন চিন্তা করো না তুমি। তোমার আব্বার মুক্তির আগ পর্যন্ত প্রয়োজন হলে তোমাকে আমার মহলেই রাখার ব্যবস্থা করে দেবো।’

‘আমার হেফাজত আল্লাহই করবেন।’ সায়েকা বললো, ‘আমি আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করছি না। আপনার কাছে আমার ছোট্ট একটি আরজি, আমাকে শুধু কিছুক্ষণের জন্য আমার বাবার সাথে দেখা করার অনুমতি দিন।’

‘এ ধরনের অপরাধীদের সাথে কাউকে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয় না। যতক্ষণ কাজী তার শাস্তির রায় ঘোষনা না করছে, ততক্ষণ এমন আদেশ আমি দিতে পারবো না।’

‘এ ধরনের অপরাধীদের শাস্তির কি রায় হতে পারে?’ সায়েকা জিজ্ঞেস করলো।

‘মৃত্যুদন্ড!’

সায়েকা বুঝলো, তার আব্বা এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অপেক্ষা করছেন। সে এমন এক দুরাচারের পাল্লায় পড়েছে, কন্যা হয়ে বাপের সাথে শেষ বারের মত একটু দেখা করার সুযোগও তাকে দেবে না এই পাষান্ড। সায়েকা খুবই শক্ত মনের মেয়ে ছিল। কিন্তু এবার আর সে নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারলো না। তার চোখ থেকে ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

তাকে আরও ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলার জন্য সাইফুদ্দিন বললো, ‘কিন্তু সে মৃত্যু সহজভাবে হবে না। তলোয়ার দিয়ে এক কোপে মাথাটা কেটে নিলো বা হঠাৎ দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এমন নয়। তার মৃত্যু ঘটবে ধীরে ধীরে। আস্তে আস্তে নির্যাতন করে মারা হবে তাকে। প্রথমে তার চোখ উপড়ানো হবে। তারপর সাড়াশি দিয়ে টেনে তোলা হবে দাঁত। তারপর তার হাত পায়ের আঙ্গুল কাটা হবে। এরপর তার গায়ের চামড়া খুলে নেয়া হবে। এভাবে কঠিন শাস্তি দিয়ে মারা হবে তাকে।’

ভয়ে সায়েকার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। সে তার ঠোঁট কামড়ে ধরলো দাঁত দিয়ে। তার চেহারার রং ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে কম্পিত স্বরে বললো, ‘আপনি কি তার প্রতি এতটুকু দয়া করতে পারেন না, তার মাথাটা তলোয়ার দিয়ে এক কোপে কেটে দেবেন? যদি তাঁকে মৃত্যুদন্ডই দেয়া হয়, তবে তাকে মুহূর্তের মধ্যে হত্যা করতে অসুবিধা কোথায়?’

‘কেন তাকে আমি দয়া করবো? তার প্রতি কি দায় ঠেকেছে আমার? সে রাজদ্রোহী, উপযুক্ত শাস্তিই কি তার প্রাপ্য নয়! তবে তুমি যদি দয়া করতে বলো, সে আলাদা কথা। তোমার মত পাগল করা রূপসীর আবেদন অগ্রাহ্য করার মত অমানুষ আমি নই। তোমার বাবার প্রতি যদি তোমার দয়া হয়, তবে তুমি আমার কাছে তোমার বাবার প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারো। বিনিময়ে আর যাই হোক, তোমার কাছে আমি তোমার প্রাণ দাবী করবো না।’

সায়েকা বাঁকা চোখে চাইলো তার প্রতি। ব্যঙ্গ আর তিরষ্কার মিশিয়ে বললো, ‘তাহলে কি চাইবেন?’

সাইফুদ্দিন বললো, ‘বাবার মৃত্যুর পরে তুমি হবে এক অনাথ এতীম। তোমার মত গরীব ও দুঃখী মেয়েকে কেউ বিয়েও করতে চাইবে না। তার চেয়ে এটাই কি ভাল নয়, তোমার বাবা আবার মুসালের খতীব হয়ে যাক, আর তুমি হয়ে যাও মুসালের রাণী?’

‘যদি আমার বাবা আমাকে আত্মসম্মানবোধ না শিখাতেন তবে রাণী হওয়া তো অতি সৌভাগ্যের ব্যাপার! আমি আপনার এক রাতের রাণী হওয়াকেও গর্ব ও অহংকারের বিষয় মনে করতাম! কিন্তু আমি জানি, আমার পিতা আমার সম্ভ্রম রক্ষার্থে হাসতে হাসতে তার গায়ের চামড়া খুলে দেবেন। এ দরাদরি আপনি আমার বাবার সাথেই করবেন। তাঁকেই জিজ্ঞেস করবেন, ‘তুমি জল্লাদের কাছে যেতে চাও ,নাকি তোমার মেয়েকে আমার কাছ পাঠাতে চাও?’ এ ব্যপারে আপনি তার সাথেই ফায়সালা করবেন। বাপজান যে ফায়সালা দেবেন, সেটিই আমার ফায়সালা। তবে আমি জানি, তিনি অবশ্যই বলবেন, ‘আমাকে জল্লাদের কাছেই পঠিয়ে দাও।’

সাইফুদ্দিন তাকিয়ে ছিল সায়েকার দিকে। বললো, ‘তোমার নিজের কোন ফায়সালা নেই?’

‘আমার কথা আমি বলেছি। এখন আমি আপানার ফায়সালা শুনতে চাই। আমি শুধু একটি আবেদন নিয়ে এসেছি, কিছুক্ষণের জন্য আমার বাবার সাথে দেখা করার সুযোগ দিন। আপনি আমার আবেদন প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন, কবুলও করতে পারেন। আমি ওয়াদা করছি, এরপর আর কোনদিন আমি এ নিয়ে আপনার সাথে দরকষাকষি করতে আসবো না।’

‘এটাই কি তোমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, আর কোনদিন তুমি আমার কাছে আসবে না?’ সাইফুদ্দিন জিজ্ঞেস করলো।

‘হ্যাঁ, এটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’ সায়েকা বললো, ‘জানি, আপনি মুসালের বাদশাহ! ইচ্ছে করলে আমাকে জোর করে আপনার হেরেমে আটকে রাখতে পারেন। কিন্তু তাতে আমার সিদ্ধান্ত নড়চড়ে হবে না।’

‘সায়েকা, আমাকে আর অপরাধী বানিয়ো না। তোমার ওপর জুলুম করবো এমন কোন ইচ্ছে আমার নেই।’ সাইফুদ্দিন বললো।

সায়েকা উঠে দাঁড়ালো। সে যা জানতে ও বুঝতে এসেছিল, তা তার জানা হয়ে গেছে। সে তো শুধু জানতে চেয়েছিল, কারাগারে তার বাবার সাথে কেমন ব্যবহার করা হচ্ছে? আর জানতে চেয়েছিল, বাবাকে নিয়ে সাইফুদ্দিন কি করতে চায়? এটা তো এখন সে ভাল মতই জানতে পেরেছে। সায়েকার বিশ্বাস ছিল, দারোগা তার বাবাকে মুক্ত করে পালিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ অবশ্যই করে দেবে। সে সাইফুদ্দিনকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।

সাইফুদ্দিন তাকে যেতে দেখে বললো, ‘দাঁড়াও! মুসালের আমীর একটি মেয়ের ছোট্ট একটি আবেদন মঞ্জুর করতে ব্যর্থ হয়েছে, এমন অপবাদ আমি শুনতে চাই না। তুমি আজই তোমার বাবার সাথে দেখা করতে পারবে।’

সায়েকা ঘুরে দাঁড়ালো। বললো, ‘কখন?’

‘আজ রাতে।’

‘কেমন করে দেখা করবো?’

‘রাতে একজন লোককে তোমার বাড়ী পাঠাবো। সে তোমাকে কারাগার পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।’

‘কতক্ষণ কথা বলার সময় পাবো?’

‘তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা তোমার বাবার সাথে কথা বলতে পারবে। কারারক্ষীকে আমি জানিয়ে দেবো এ খবর।’

সায়েকা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলো দরবার থেকে।

সায়েকা বেরিয়ে গেলে সাইফুদ্দিন তার বডিগার্ডের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এই সুন্দর পাখিটাকে আমি আমার খাঁচায় চাই। আমি তাকে ভয় দেখানোর জন্য তার বাবাকে কঠিন শাস্তি দিয়ে মারা হবে বলেছিলাম। কিন্তু মেয়েটি এত শক্ত, সহজে বশে আনা মুস্কিল! জানো, আমি তাকে কেন বলেছি, আজ রাতে তোমার বাড়ীতে একজন লোক পাঠাবো। সে তোমার কারাগারে পৌঁছে দেবে?’

‘আমি আহাম্মক, কিন্তু এমন গাধা তো নই যে, আপনার ইঙ্গিত বুঝি না?’ বডিগার্ড মুখে শয়তানী হাসি টেনে বললো, ‘সে লোক আমিই হবো। আমিই তাকে রাতে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তার বাড়ী থেকে বের করে অন্যত্র নিয়ে যাবো।’

‘আর তুমি কি জানো, তাকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে?’

এবারও হাসলো বডিগার্ড, ‘সবই জানি! এ কাজ তো আর নতুন করছি না! আমি তাকে এমন গোলক ধাঁধাঁয় ফেলে আপনার কাছে পৌঁছাবো, সে বুঝবে, এ দুনিয়ায় আপনিই একমাত্র ব্যক্তি, যে তার প্রেমিক ও দরদী। কি করে অবাধ্য পাখিকে খাঁচায় পুরতে হয় আমি ছাড়া কে তা বেশী জানে?’

সাইফুদ্দিন বডিগার্ডের কানে কানে আরো কিছু কথা বললো। বডিগার্ডের চোখে যেন শয়তান নাচতে লাগলো, হাসতে লাগলো সে।

কারাগারের দারোগা সায়েকাকে সান্ত্বনা দিয়ে কোরআন নিয়ে চলে গেল। আজও তার রাতেই ডিউটি। সন্ধ্যার পরপরই সে ডিউটিতে এসে যোগ দিল। দিনে যার ডিউটি ছিল সে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। দারোগা অফিস থেকে বেরিয়ে খতীব ইবনুল মাখদুমের কামরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এদিক-ওদিক ভালভাবে ল

লক্ষ্য করে কোরআন শরীফটি আদবের সাথে খতীবের হাতে তুলে দিয়ে বললো, ‘মেয়েকে নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না। সে ভাল এবং নিরাপদেই আছে। আপনার মেয়ে যথেষ্ট ধৈর্যশীল ও বুদ্ধিমতী।’

‘সে কিছু বলেছে?’

‘সে আপানাকে দোয়া করতে বলেছে আর বলেছে…..’ কথা শেষ না করে চুপ করে গেল দারোগা।

‘আর কি বলেছে?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চাইলেন খতীব।