ছোট বেগম
একদিন বিকাল বেলা। সূর্য অস্ত যাওয়ার সামান্য আগে সুলতান আইয়ুবী ফোরাতের কূলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তার সাথে অশ্বারোহী দলের সেনাপতি ও কমাণ্ডো বাহিনীর সেনাপতি সালেম মিশরী। তারা তাদের সামনে কিছু দূরে সাদা জোব্বা পরা এক লোককে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।
লোকটির দু’হাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে উপরে তোলা। সুলতান আইয়ুবী সেদিকে গেলেন এবং লোকটির কাছে পৌঁছে দেখতে পেলেন, সেখানে চারটি কবর রয়েছে।
এই কবরগুলোর মধ্যে দু’টি কবরের মাথার দিকে একটা করে লাঠি পোতা। তার সাথে কাঠের তক্তা লাগিয়ে কবর ফলক বানানো হয়েছে। সেই ফলকের একটিতে আরবী হরফে লাল রংয়ে লেখা, “উমরুল মামলুক, আল্লাহ তোমার শাহাদাত যেন কবুল করে নেন।” –নাছরুল মামলুক।
তার পাশের কবরের উপরেও একই ধরনের ফলক লাগানো। তাতে লেখা, “নাছরুল মামলুক, আল্লাহ আমার শাহাদাত কবুল করুন।”
সুলতান আইয়ুবী দু’টি লেখাই পাঠ করলেন এবং সেই লোকটির দিকে তাকালেন, যে লোক কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করছিলেন। চেহারা সুরতে বেশ অভিজাত ও লেবাস পোশাকে আলেম ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছিল। সুলতান আইয়ুবী তার দিকে তাকালে তিনি সালাম দিয়ে বললেন, ‘আমি এই গ্রামের ইমাম। যেখানেই আমি কোন শহীদের সন্ধান পাই সেখানে গিয়ে তাদের জন্য ফাতেহা পাঠ করি। আমি বিশ্বাস করি, যেখানে শহীদের রক্ত ঝরে সে জায়গা মসজিদের মতই পবিত্র।
আমি লোকদের বলি, ‘মুজাহিদরা সেই মহান ব্যক্তিত্ব যাদের ছুটে চলা ঘোড়ার খুরের আঘাতে যে ধুলো উড়ে সে ধুলোও আল্লাহ কাছে কদর পায়। মহান আল্লাহ তার পথে জেহাদকে উওম ইবাদত বলে গণ্য করে থাকেন।’
‘কিন্তু আল্লাহর নামে জীবন কোরবান করা মানুষ এমন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি যাদের পরিচয় কেউ রাখেনা। যেমন এখানে আপনি দেখছেন। ইতিহাসে তাদের নাম নয়, আমার নামই লেখা হবে। কিন্তু আমার সমস্ত গৌরবের পেছনে রয়েছে এদেরই ত্যাগ ও কোরবানী, রয়েছে অসামান্য অবদান।’ বললেন সুলতান আইয়ুবী।
তিনি তার সেনাপতিদের দিকে তাকালেন। তারপর এগিয়ে কবরের ফলক দুটিতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “এই দু’টি ফলকের লেখাই লাল রংয়ের। মনে হচ্ছে একজন লেখকই নিজের আঙ্গুল দিয়ে লেখা দুটো লিখেছে।”
‘লাল রং নয় সুলতানে মুহতারাম, এ যে রক্ত! উমরুল মামলুকের কবরের ফলক লিখেছেন নাছরুল মামলুক। তারপর নিজের রক্ত দিয়ে লিখেছেন তার কবরের ফলক এবং তিনিও শহীদ হয়ে গেছেন। আমিও প্রার্থনা করছি, আল্লাহ তাদের শাহাদাত কবুল করুন। এখানে যে চারটি কবর দেখছেন এদের চারজনই আমার কমাণ্ডো বাহিনীর সদস্য ছিল।’ বললেন কমাণ্ডো বাহিনীর সেনাপতি সালেম মিশরী।
সুলতান বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তাই! তুমি চিনতে তাদের?’
‘হ্যাঁ সুলতান। ষোল সতেরো দিন আগে এক রাতে আমরা একটি নৌকা ধরেছিলাম। এই নৌকায় শত্রুর কমাণ্ডো বাহিনী তাদের সৈন্যদের জন্য রসদপত্র ও সাহায্য সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছিল।’
সালেম মিশরী বললেন, ‘এ খবর তখনই আপনাকে জানানো হয়েছিল। আমাদের আট জন কমাণ্ডো সেনা সেই নৌকাটিকে আটক করেছিল। কিন্তু আটক করার সময় শত্রুদের সাথে লড়াইয়ে তাদের চারজন শহীদ হয়ে যায়।’
‘ঘটনাটি আবার বলো তো কিভাবে কি ঘটেছিল?’ বললেন সুলতান।
‘আমরা আগেই গোপন সূত্র থেকে জানতে পেরেছিলাম, একটা বড় নৌকা রাতে এদিক দিয়ে যাবে। সে নৌকায় শত্রুদের রসদপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র থাকবে। আমি আমার আটজন কমাণ্ডোকে পাঠিয়ে দিলাম নৌকাটি আটক করার জন্য। তারা একটি ছোট নৌকায় ছিল। মধ্য রাতে তারা টের পায় অপর পাড় দিয়ে একটি নৌকা যাচ্ছে। আমাদের কাছে যে তথ্য ছিল তাতে আমরা জানতাম, নৌকায় বড়জোর চার পাচঁজন দুশমন সেনা থাকতে পারে। কিন্তু অপারেশনের পর জানা গেল, তাতে বিশজন শত্রু সেনা ছিল।
আমাদের কমাণ্ডো বাহিনী দ্রুত ওপাড়ে পৌঁছলো এবং শত্রুর নৌকাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শত্রুরা আগে টের পায়নি, পেলে তীর মেরে সহজেই তারা পালিয়ে যেতে পারতো।
আক্রান্ত হওয়ার পর ওরা যখন রুখে দাঁড়ালো, তখন দেখা গেল সংখ্যায় তারা অনেক। আমাদের কমাণ্ডোরা শত্রুর নৌকা কিছু দুরে থাকতেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল এবং নির্ভয়ে সাঁতরে গিয়ে চড়াও হয়েছিল শত্রুর ওপর।
সাঁতারে তারা যথেষ্ট পটু ছিল। তারা যখন দেখলো তাদের তুলনায় দুশমন অনেক তখন একজন গিয়ে নৌকার পালের রশি কেটে দিল। এরপর নৌকার ভেতর শুরু হলো এক ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আমাদের কমাণ্ডো বাহিনীর যুবকরা অসম সাহসিকতা প্রদর্শন করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। আমাদের দু’জন তখনই শহীদ হয়ে যায়, বাকীরাও কম বেশী সবাই আহত হয়।
আমাদের কমাণ্ডোরা শেষ পর্যন্ত শত্রুর নৌকাটি দখল করতে সমর্থ হয়। লড়াই শেষে তারা দেখতে পায় নৌকাটি দখল করার জন্য দুশমনের আঠারোটি লাশ তাদের ফেলতে হয়েছে। তারা শেষ মুহূর্তে দু’জনকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছে। ওই দু’জন সাতঁরে নদীর ওপাড়ে গিয়ে উঠলেও তাদের ধাওয়া করার মত অবস্থা ছিল না আমাদের কমাণ্ডোদের। তাই তাদের আর ধাওয়া করা হয়নি।
আমাদের কমাণ্ডোরা দুটো নৌকাই কিনারায় ভিড়িয়ে আমাকে এই বিজয়ের খবর দেয়। সংবাদ পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। ততোক্ষনে সকাল হয়ে গেছে।
আমি এসে দেখতে পেলাম এক নৌকায় উমরুল মামলুক ও তার দুই সঙ্গীর লাশ। জানতে পারলাম একটু আগে উমরুল মামলুক শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছে।
কমবেশী সবাই আহত হলেও নাছরুল মামলুকের অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়। তলোয়ারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত তার সারা শরীর। আমি তার কাছে গেলাম, দেখলাম তখনো তার জ্ঞান আছে। তার ক্ষতস্থানে পট্টি বাধার জন্য দ্রুত তাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো। এরপর যখন তাকে আমি ক্যাম্পে দেখতে গেলাম, সে আমাকে বললো, ‘আমাকে দুই টুকরো কাঠ দিন।’
বললাম, ‘এই শরীরে কাঠ দিয়ে তুমি কি করবে’?
ও বললো, ‘আমি আমার শহীদ বন্ধুর কবরে নাম ফলক লাগাতে চাই।’
আমি তাকে কাঠ সরবরাহ করলাম। সে তার আহত আঙ্গুলের ব্যাণ্ডেজের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া রক্ত দিয়ে উমরুল মামলুকের নাম ও এই লেখাগুলো লিখলো। আমি নামফলকটি একটি লাঠির সাথে বেঁধে উমরুল মামলুকের কবরের শিয়রে লাগিয়ে দিলাম।
নাছরুল মামলুকের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছিল না। তৃতীয় দিনে তার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি তাকে দেখতে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক হতাশা প্রকাশ করে বললো, ‘নাছরুল মামলুককে বোধহয় বাঁচানো গেল না।’
নাছরুল মামলুক নিজেও অনুভব করলো, সে আর বাঁচবে না।
সে পুনরায় আমাকে বললো, ‘আমাকে আরেক টুকরো কাঠ দিন।’
আমি তার ইচ্ছা পূর্ণ করে দিলাম। সে কাঠের টুকরোটি নিজের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে আমি সংবাদ পেলাম, ‘নাছরুল মামলুক শহীদ হয়ে গেছে।’
আমি যখন সেখানে গেলাম এক আহত রুগী আমাকে কাঠের টুকরোটি দিয়ে বললো, ‘নাছরুল মামলুক তার ক্ষত স্থানের রক্ত দিয়ে এই ফলকটি লিখেছে।’
আমি তাকিয়ে দেখলাম তাতে লেখা আছে, ‘নাছরুল মামলুক, আল্লাহ আমার শাহাদাত কবুল করুন।
আহত রোগীটি আমাকে বললো, ‘নাছরুল মামলুক বলেছে, তাকে যেন তার বন্ধু উমরুল মামলুকের পাশে দাফন করা হয়।’
‘এরা দু’জনেই মামলুক ছিল সম্মানিত ইমাম। আপনি কি জানেন এই মামলুক বংশ সম্পর্কে? এরা সেই গোলামদের বংশধর, ইসলামের আগমন যাদের দিয়েছিল মুক্তির স্বাদ। আমাদের প্রিয় নবী রাসূল (সাঃ) ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষনা করলে আরবে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়।’ সুলতান আইয়ুবী ইমামকে বললেন।
মহানবী (সাঃ) বলেছেন, মানুষ মানুষের গোলাম হতে পারে না। আমরা গোলাম শুধু এক আল্লাহর। তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে যারা আমাদের দায়িত্বশীল আমরা তাদের মান্য করি।
একটু খেয়াল করে দেখুন, একদিন যারা ছিল সামান্য গোলাম, জাতির জন্য তারা আজ কেমন ত্যাগ ও কোরবানীর নজরানা পেশ করছে। এরা মাত্র আটজন ছিল, কিন্তু বিশজনের কাছ থেকে নৌকা কেড়ে নেয়ার সাহস তারা কোথা থেকে পেল? এই শক্তি তারা পেয়েছে ইসলাম থেকে। আমার সৈন্যদের মধ্যে মামলুক ও তুর্কী সেনারা সাহস, বীরত্ব ও বিশ্বস্ততায় অনন্য।’
‘কিন্তু এখন মানুষ আবার মানুষের গোলামে পরিণত হচ্ছে,’ ইমাম সাহেব বললেন। ‘ক্ষমতার রাজনীতির মূল কথাই হচ্ছে মানুষকে আবার গোলামে পরিণত করা। কিন্তু মানুষ জানে না, ক্ষমতার স্বাদ বেশীদিন উপভোগ করা যায় না। ফেরাউনও মাটিতে মিশে গেছে। তেমনি প্রত্যেক জালিম শাসক, যারা ক্ষমতা ও গদি আঁকড়ে ধরে জনগনকে শোষণ ও নির্যাতন করতো তাদের পরিণতি কখনো শুভ হয়নি। সাধারন মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাদশাহী ধরে রাখতে গিয়ে তারা নিজেরাই রক্তাক্ত হয়েছে।’
সেই সন্ধায় তারা যখন ফোরাতের কূলে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তখন সুলতান আইয়ুবীর রক্ষী বাহিনীর কমাণ্ডার এক লোককে সঙ্গে নিয়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছিল। লোকটির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল সে দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত। কমাণ্ডার তাদের কাছে এসে সুলতানকে লক্ষ্য করে বললো, ‘কায়রো থেকে কাসেদ এসেছে।’
‘কোন খারাপ খবর?’ সুলতান আইয়ুবী তাকে বললেন, ‘কি খবর নিয়ে এসেছো তুমি?’
‘সংবাদ ভালো নয় সুলতান।’ কাসেদ এ কথা বলে কোমর থেকে একটি কাগজ বের করে সুলতানের হাতে তুলে দিল।
সুলতান আইয়ুবী চিঠি হাতে নিয়ে তার তাঁবুর দিকে রওনা হলেন। সঙ্গীদের বললেন, ‘চলো।’
তাঁবুতে বসে তিনি চিঠিটা খুললেন। চিঠিটি তার গোয়েন্দা বিভাগের সর্বাধিনায়ক আলী বিন সুফিয়ানের হাতের লেখা।
আমাদের সবচেয়ে ধার্মিক ও বীর সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস দশদিন যাবত নিখোঁজ রয়েছেন। খৃস্টানদের সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা এখানে গোপন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাসঘাতক গাদ্দারদের সংখ্যা দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবু বলবো, এ সমস্যা নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। আমরা এখানে শত্রুদের ষড়যন্ত্র সফল হতে দেব না।
কিন্তু আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস। তার কোন সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তার সন্ধান না পাওয়াটাই পেরেশানীর একমাত্র কারন নয়। দুশ্চিন্তার আরো কারন আছে।
আপনিতো জানেন, হাবিবুল কুদ্দুস তার বাহিনীর সৈন্যদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তারা তাদের প্রিয় সেনাপতির ইশারায় জান দিতেও কুন্ঠাবোধ করবে না। যদি তিনি স্বেচ্ছায় শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে থাকেন তবে ভয় হচ্ছে, তার বাহিনী যার দ্বারাই পরিচালিত হোক না কেন, তার ইশারা পেলে তারা বিদ্রোহ করে বসতে পারে।
আমি এখনো তার সন্ধান চালাচ্ছি। তার ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিরাশ নই। তবে আমি আপনার কাছ থেকে একটি ব্যাপারে নির্দেশনা চাই। যদি তার খোঁজ পাওয়া যায় এবং তাকে হত্যা করা জরুরী হয়ে পড়ে, তবে হত্যা করবো কিনা? আপনার নিয়োজিত মিশরের আমীর এ সম্মতি দিতে নারাজ। তিনি আমাকে শুধু এই অনুমতি দিয়েছেন যে, আমি আপনার কাছে পত্র প্রেরণ করে অনুমতি নিতে পারি।
আমি তার সন্ধান করতে ব্যর্থ হই এটা যেমন আপনি চাইবেন না, তেমনি তিনি মনে করেন, সে আমার হাতে মারা যাক এটাও আপনি চাইবেন না। কিন্তু আমাদের এক সেনাপতির শত্রুর হাতে থাকাটাও বিরাট ভয়ের কারন।’
চিঠি পড়া শেষ করে সুলতান আইয়ুবী সঙ্গে সঙ্গে কাতিবকে ডাকলেন। কাতিব এলে চিঠির উওর লিখতে বসে গেলেন তিনি। তিনি লিখলেনঃ
প্রিয় আলী বিন সুফিয়ান, তোমার উপর আল্লাহর করুনা বর্ষিত হোক। হাবিবুল কুদ্দুসের উপর আমার আস্থা ও বিশ্বাস এমন ছিল, যেমন তোমার উপর আছে। যে ব্যক্তি বেইমানী করতে প্রস্তুত হয়ে যায় সে কখনো আল্লাহকে ভয় পায় না। আর যে আল্লাহকে ভয় পায় না সে আমার মতো একজন নগণ্য মানুষকে কেন ভয় পাবে?
তুমি এতে বিস্মিত হয়ো না যে, হাবিবুল কুদ্দুসের মত লোকও ধোঁকা দিতে পারে। ঈমান একটি শক্তি, কিন্তু সেটা হীরা ও পান্নার মত চকচক করে না। এতে সুন্দরী নারীর মত সৌন্দর্য ও আকর্ষণও থাকে না। আর ঈমান গদি ও রাজমুকুটও নয়। যখন মানুষের মধ্যে দুনিয়ার লোভ লালসা বেড়ে যায় ও ধন সম্পদের আকাঙ্খা সৃষ্টি হয় তখন মানুষের বেঈমান হতে বেশী সময় লাগে না।
হাবিবুল কুদ্দুসকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করো। যদি কখনো মনে করো যে তাকে হত্যা করা দরকার, তবে অবশ্যই তাকে হত্যা করবে। এতে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। কিন্তু এটা জানার চেষ্টা করবে, তাকে তো ছিনতাই করা হয়নি?
এ বিষয়টা তোমার লক্ষ্য ও দৃষ্টিপটে রাখবে। তারপর যেটা ভালো মনে করো তাই করবে। দ্বীন ও দেশের কল্যাণের বিষয়টিই সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাবে। একজন মানুষের জীবন বা মৃত্যুকে এ পথে বাধা হিসেবে মেনে নেয়া যায় না।
দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য যেখানে বিপুল সংখ্যক সৈন্য অকাতরে মারা যাচ্ছে, সেখানে একজন গাদ্দারকে হত্যা করতে তোমার দ্বিধা করা উচিত নয়। যেখানে আল্লাহকে খুশি করার জন্য সৈন্যরা হাসি মুখে তাদের জীবন দিয়ে দিচ্ছে, সেখানে কোনো গাদ্দারকে দয়ামায়া দেখানোর প্রশ্নই উঠে না। সে গাদ্দার এটা নিশ্চিত হতে পারলে কালবিলম্ব না করে ফায়সালা করে ফেলবে।
আলী, আল্লাহর কাছে পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে থাকো, কারণ আমরা সবাই গোনাহগার বান্দা। পাক ও পবিত্র একমাত্র আল্লাহ ও তার রাসূল (সা:)। যদি তোমরা সত্যের উপরে থাকো তবে আল্লাহ তোমাদের সাথেই আছেন। শেষ পর্যন্ত তোমরাই জয়ী হবে।’
সুলতান আইয়ুবী চিঠিতে সিলমোহর মেরে চিঠিটা কাসেদের হাতে দিয়ে বললেন, ‘আজ রাতে এখানেই বিশ্রাম নাও। কাল ঘুম থেকে উঠে খুব ভোরে যাত্রা করবে।’
সে যুগটা ছিল ইতিহাসের অশুভ যুগ। একদিকে আরবের মাটি মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছিল, অন্যদিকে ইহুদী ও খৃস্টানরা মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি করছিল গাদ্দার ও ষড়যন্ত্রকারী। মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে তাদের ধ্বংস করাই ছিল এ প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য।
মিশরেও চলছিল দুশমনের এ তৎপরতা। ইহুদী ও খৃস্টানরা মুসলিম নেতাদের মধ্যে গাদ্দার সৃষ্টির চেষ্টা চালানোর সাথে সাথে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলারও চেষ্টা করছিল। তারা মিশরের সৈন্য বিভাগকেও অকেজো করে দিতে চাচ্ছিল। সৈন্য বিভাগের ব্যাপারে নানারকম বদনাম ছড়িয়ে জনগনকে বিভ্রান্ত করার জন্য ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ওরা এ কাজ করছিল অত্যান্ত গোপনে ও কৌশলে।
আলী বিন সুফিয়ান ও কায়রোর পুলিশ সুপার গিয়াস বিলকিস শত্রুদের এসব অপতৎপরতা বন্ধ ও অপরাধীদের খুঁজে বের করার জন্য আরামকে হারাম করে চষে ফিরছিলেন মিশরের সর্বত্র। তাদের বাহিনী কেবল কায়রো নয়, মিশরের বিভিন্ন পরগনা ও শহরে ছুটে বেড়াচ্ছিল।
সেনাবাহিনীর একজন সেনাপতির নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, আলী বিন সুফিয়ানের প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত যে গোয়েন্দা বাহিনীর সুনাম সমগ্র আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, তারা নিজেরাই তাদের এক সেনাপতিকে খুঁজে বের করতে পারছে না, এরচেয়ে লজ্জার বিষয় আলীর জন্য আর কিছুই হতে পারে না।
হাবিবুল কুদ্দুস সম্পর্কে এ কথা ভাবাও মুশকিল যে, তিনি গাদ্দারদের দলে চলে যাবেন। কিন্তু এটা এমনই এক যুগ, এখন কে গাদ্দার আর কে নয় তা নির্ণয় করাই দুষ্কর হয়ে উঠেছে। গাদ্দারী এখন একটা সাধারণ ও সুবিধাজনক উপার্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাবিবুল কুদ্দুস যখন নিখোঁজ হলো তখন সবাই বলতে বাধ্য হলো, ‘তিনিও তো মানুষ, কোন ফেরেশতা তো নন।’
হাবিবুল কুদ্দুসের স্ত্রী ছিল তিনজন। অবশ্য সে যুগে এটা কোন গর্হিত কাজ বলে গণ্য করা হতো না। তার সমসাময়িক অন্যান্য অফিসাররা বরং এ ক্ষেত্রে একটু এগিয়েই ছিল। তাদের বরং বিবি ছিল চারজন করে। যারা আরেকটু সৌখিন ছিল তাদের দু’একজন দাসীও থাকতো।
হাবিবুল কুদ্দুসের কোন দুর্ণাম ছিল না। তার জীবনে মদ ও নাচগানের সামান্যতম প্রভাবও কেউ লক্ষ্য করেনি। তিনি নামাজ রোজার পাবন্দ ছিলেন এবং যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন সত্যিকারের বীর মুজাহিদ। তিনি কেবল শত্রুর উপর কঠোর ছিলেন না, বরং বীরত্ব প্রদর্শন ও রণকৌশলেও ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তিনি যুদ্ধ পরিচালনায় এতই নিপুণ ছিলেন যে, সামান্য সৈন্য নিয়ে বিপুল সংখ্যক শত্রু সেনার বাহিনীকেও তিনি বার বার পরাজিত ও ধ্বংশ করেছেন।
তার সবচেয়ে বড় গুন ছিল, তিনি সবাইকে সহজেই আপন করে নিতে পারতেন। লোকেরাও তাকে ভালোবাসতো। তার অধীনস্ত সৈন্য ও কমাণ্ডাররা যখন যুদ্ধ করতো তখন তাদের আবেগ এমন হতো যেন তারা কারো নির্দেশে যু্দ্ধ করছে না, বরং নিজের ঈমানের দাবী পূরণের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। বাহিনীর সদস্যরা তাকে বুঝতে পারতো এবং তার ইশারাকেই তারা হুকুম মনে করতো।
সে তার বাহিনী এমনভাবে পরিচালনা করতো যে, কখনো কখনো মনে হতো যেন এটা তার একান্ত নিজস্ব বাহিনী। যেন এরা সুলতান আইয়ুবীর নয়, হাবিবুল কুদ্দুসের আদেশে যুদ্ধ করছে।
এত যে প্রিয় লোকটি, প্রশিক্ষন বা যুদ্ধের মাঠে তার রূপ ছিল সত্যি ভয়াবহ। সৈন্যদের তিনি কঠোর প্রশিক্ষন দিতেন এবং তাদের শৃঙ্খলার প্রতিও রাখতেন কড়া নজর।
তিনি তার সৈন্যদের এমনভাবে প্রশিক্ষন দিতেন যাতে তারা অন্যদের তুলনায় ক্ষীপ্র ও কৌশলী হয়। তার সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজার পদাতিক, দুই হাজার অশ্বারোহী ও দুই হাজার তীরন্দাজ। তীরন্দাজদের তিনি এমন নিপুণ তীর চালানো শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, রাতের অন্ধকারে শুধু সামান্য আওয়াজ শুনেই তার সৈন্যরা যে তীর ছুঁড়তো তা গিয়ে শব্দকারীর বুকে বিদ্ধ হতো।
আলী বিন সুফিয়ানও ছিলেন গোয়েন্দাগিরীতে ওস্তাদ। গিয়াস বিলকিসও ছিলেন দক্ষ পুলিশ সুপার। এদের দু’জনেরই ধারনা, হাবিবুল কুদ্দুসকে শত্রুরা যেভাবেই হোক তাদের বশে নিতে সক্ষম হয়েছে, যাতে তার সাত হাজার সৈন্যকে বিদ্রোহী করে তুলতে পারে।
সাত হাজার সৈন্য কোন তুচ্ছ ও নগন্য সৈন্য ছিল না। এ সৈন্যদের বিদ্রোহের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখার উপায় তালাশ করছিলেন দু’জনই। গিয়াস বিলকিস বললেন, ‘এদের নিরস্ত্র করে দিলে কেমন হয়?’
আলী বিন সুফিয়ান অনেক চিন্তা ভাবনা করে এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন। কিন্তু তারা যে কোন সময় বিদ্রোহ করে বসতে পারে গিয়াস বিলকিসের এ আশঙ্কা তিনি উড়িয়ে দিতে পারলেন না। তারা দু’জনই একমত হলেন, আজ না হলেও ভবিষ্যতে তারা বিদ্রোহ করবে।
আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আপাতত তাদের নিরস্ত্র না করে বাহিনীর মধ্যে কিছু গোয়েন্দা ছড়িয়ে দিই। তারা সৈন্য ব্যারাকে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াবে এবং তাদের আলাপ আলোচনা শুনবে। কমাণ্ডারদের উপরও তারা দৃষ্টি রাখবে।’
তাই করা হলো। কড়া দৃষ্টি রাখা হলো হাবিবুল কুদ্দসের বাড়ীর উপর। তার তিন স্ত্রীর মধ্যে একজনের বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। অন্য দু’জনের মধ্যে একজনের বয়স বিশ, অন্যজনের পঁচিশ। তাদের জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘হাবিবুল কুদ্দুস কোথায়?’
তারা বললো, ‘কয়েকদিন আগে এক সন্ধায় তার কাছে দু’জন লোক এসেছিল। হাবিবুল কুদ্দুস তাদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু তারপর আর ফিরে আসেন নি।’
চাকর বাকরদেরও সন্দেহমূলকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কিন্তু তাতে কোন কাজ হলো না, কোনভাবেই তার সন্ধান পাওয়া গেল না।
তার বিবিদের সম্পর্কেও গোপনে অনুসন্ধান করা হলো। কিন্তু তাদের ব্যাপারেও সন্দেহ করার মতো কোন তথ্য পাওয়া গেল না। শুধু এটুকু জানা গেল যে, অল্পবয়সী দুই বিবির মধ্যে একজনের প্রতি হাবিবুল কুদ্দুসের টান একটু বেশী ছিল।
এই বিবির নাম জোহরা। জোহরা তারই অধীনস্ত অশ্বারোহী বাহিনীর এক কমাণ্ডারের মেয়ে। মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দরী ছিল। এ রকম সুন্দরী বিবি থাকলে তার প্রতি টান একটু বেশী থাকাই স্বাভাবিক।
একদিন জোহরার পিতা সেই কমাণ্ডারকে তলব করা হলো গোয়েন্দা অফিসে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কেন এত অল্পবয়সী মেয়েকে তোমার সমবয়সী লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছো? হাবিবুল কুদ্দুস কি তোমাকে তার অধীনস্ত পেয়ে বাধ্য করেছিল?’
‘না। সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস ইসলাম ও জিহাদের ব্যাপারে এতই আন্তরিক যে, তা দেখেই আমি তার প্রতি অনুরাগী হই।’ বললেন সেই কমাণ্ডার।
তিনি বললেন, ‘আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করেছি। তিনি বলতেন, মুমিনের তলোয়ার একবার উন্মুক্ত হলে সে তলোয়ার ততোক্ষণ পর্যন্ত কোষবদ্ধ হবে না, যতোক্ষন তার সামনে একজন দুশমনও বর্তমান থাকে। তিনি আরো বলতেন, ‘যতোক্ষন কাফেরদের ফেতনা শেষ না হবে ততোদিন জিহাদ চালু থাকবে।’
তিনি দেশের গাদ্দারদের প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। যখন সীমান্ত যুদ্ধে সুদানীরা আকস্মাৎ আক্রমন চালালো, তখন আমাদের দুই অশ্বারোহী পালানোর চেষ্টা করেছিলো। তিনি টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাদের দু’জনকে পাকড়াও করার হুকুম দেন।
দু’জনকে ধরে আনা হলে তাদেরকে ঘোড়ার পিছনে দু’হাত রশি দিয়ে বেঁধে দুই অশ্বারোহীকে ঘোড়া ছুটাতে বললেন। তিনি অশ্বারোহীদের বললেন, ‘ঘোড়া ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত ঘোড়া থামাবে না।’
যখন ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলো তখন ঘোড়াগুলো হাফাচ্ছিল। ঘোড়ার পেছনে বাঁধা দুই সৈন্যের অবস্থা তখন শেষ পর্যায়ে। তাদের সমস্ত শরীরের কোথাও কাপড় ছিল না। তাদের শরীরের চামড়া উঠে গিয়েছিল। শরীরের মাংসও উঠে গিয়েছিল।
যুদ্ধে অধিকাংশ সুদানী মারা গিয়েছিল। কিছু ধরা পড়ে বন্দী হয়েছিল। অন্যরা পালিয়ে গিয়েছিল। হাবিবুল কুদ্দুস সমস্ত সৈন্যদের একত্রিত করে সেই পলাতক সৈন্যদ্বয়ের লাশ দেখালেন।
তিনি তাদের বললেন, ‘আল্লাহর পথে যুদ্ধরত সৈন্যদের পালানোর শাস্তি দুনিয়ায় এমনই হয় আর পরকালে তাদের দেহ হবে আগুনের খোরাক।’
হাবিবুল কুদ্দুসের শ্বশুর বললো, ‘আমরা সবাই জিহাদে শহীদ হওয়ার জন্য প্রেরনা পেয়েছি তার কাছ থেকে।’
‘তোমার মেয়ে সম্পর্কে বলো, কেন তুমি তাকে হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে বিয়ে দিয়েছিলে?’
‘একদিন আমার মেয়ে আমার সাথে ছিল। আমি মেয়েকে সেই শিক্ষাই দিয়েছিলাম যে শিক্ষা আমার পিতা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমার ছেলেও সে সময় সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদলে সিরিয়াতে ছিল।
আমি আমার মেয়েকে বললাম, ‘আমাদের সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুসও সুলতান আইয়ুবীর মত বীর মুজাহিদ।’
সেদিনই তিনি আমার মেয়েকে দেখলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ মেয়েটা কে?’ আমি বললাম, ‘এ আমার মেয়ে এবং একজন তরুণী মুজাহিদ।’
বেশ কিছুদিন পর তিনি আমাকে জানালেন, যদি আমার আপত্তি না থাকে এবং আমার মেয়ে সম্মত হয় তবে তাকে তিনি বিয়ে করতে চান। আমি মেয়ের মাকে কথাটা বললাম। মেয়ের মা বলল, ‘মেয়ে আগে থেকেই বলে আসছে সে এমন ব্যক্তিকে বিয়ে করতে চায় যে ইসলামের খেদমতে নিজের জীবনকে বাজী রাখতে প্রস্তুত।
আমি খুশী মনে সেনাপতির সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলাম এবং আমার মেয়েও তাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিল। এখন শুনছি তিনি নিখোঁজ।
আমি আপনাকে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলছি, তার এই নিরুদ্দেশে যদি কেউ অন্তর থেকে ব্যাথিত হয়ে থাকে, তবে সে একমাত্র আমার মেয়ে। আমি শুনেছি, সে তাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। তার নিরুদ্দেশ হওয়ার পরও তার ভালবাসা বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি।
তার ধারনা, দুশমনরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে মেরে ফেলেছে বা কোথাও বন্দী করে রেখেছে। আমি এও শুনেছি, তার অন্য দুই স্ত্রী বলেছে, সে যদি মারা যায় তবে তারা অন্যখানে বিয়ে করে নেবে। কিন্তু আমার মেয়ে এ রকম চিন্তা করাও পাপ মনে করে।’
‘এখন আমার বিশ্বাস হচ্ছে, তাদের পরিকল্পনা আমাদের হাতে এসে গেছে।’
এই আওয়াজ কায়রো থেকে দূরে, বহু দূরে এক ধ্বংসাবশেষে উচ্চারিত হলো। এখানে কোন ফেরাউন তার সময়ে রাজমহল তৈরী করেছিল। সে যুগে এ স্থানটি খুব সুন্দর শহর ও মনোরম বাগবাগিচায় সাজানো ছিল। অঞ্চলটি পাহাড়ী হওয়ার পরও নীল নদের তীরে অবস্থিত হওয়ার কারনে এখানে গড়ে উঠেছিল জমজমাট শহর। আর ফেরাউন সেই শহরকে এমন অপরূপ সাজে সাজিয়েছিল, মনে হতো এটি কোন রূপকথার রাজ্য।
পাহাড়ের উপরে ও আশেপাশে ছিল সবুজ গাছপালা। নদীতে খাল কেটে শহরের ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছিল নদীর পানি। সেই পানিতে চলতো সেচ কাজ। এভাবেই সেই রুক্ষ্ম পাহাড়কে বানানো হয়েছিল নয়নাভিরাম সবুজ উদ্যান।
কোন এক ফেরাউন এখানে শহর ও মহল বানালেও তার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে তার জৌলুশ। তারপর কালক্রমে একদিন তা ধ্বংশস্তুপে পরিণত হয়।
সুলতান আইয়ূবীর আমলে এই ধ্বংসাবশেষ এক ভয়ংকর স্থানে পরিণত হয়। শহরের প্রাসাদগুলো রূপ নিয়েছিল ভূতুরে আস্তানায়। মহলের স্তম্ভগুলো জরাজীর্ণ হয়ে বুনো লতাপাতায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিল। আবর্জনায় ভরে গিয়েছিল তার কামরাগুলো।
বাদুড়, চামচিকা ও চিলেরা বাসা বেঁধেছিল সেই ধ্বংশস্তুপে। পাহাড়গুলো এত উঁচু ছিল যে, কালো মেঘ যখন উড়ে যেত, দূর থেকে মনে হতো সেগুলো পাহাড়ের গা ছুঁয়ে যাচ্ছে।
এই জনপদ কিভাবে ধ্বংশ হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে ধ্বংসাবশেষ দেখলে মনে হয় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আকস্মিক বিস্ফোরনে শহরটি ধ্বংশপ্রাপ্ত হয়। কারন পুরাতন এই ধ্বংসাবশেষের বাইরে ও ভিতরে মানুষের মাথা ও অঙ্গ-প্রতঙ্গের হাড় হাড্ডি ছড়িয়ে আছে। অতীত যুগের অনেক অস্ত্রসস্ত্রও এদিক ওদিক পড়ে আছে।
এখন এই ভূতুরে জায়গায় কেউ যায় না। লোক মুখে গুজব রটে গেছে, এখানে জ্বীন, ভূত ও খারাপ মানুষের প্রেতাত্মারা বাস করে। তারা এর আশেপাশে কোন জীবিত মানুষ পেলে তাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে।