» » ভণ্ডপীর

বর্ণাকার

ভণ্ডপীর

মুশেলের এক বয়োবৃদ্ধ দরবেশ। তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। এই বয়সে মানুষের মঙ্গল ছাড়া জীবনে তার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। এ জন্যই সবাই তাকে যথেষ্ট কামেল ও মুত্তাকী মনে করতো। লোকজন বলাবলি করতো, তার নেক নজরে পড়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।

নিজের এবাদত বন্দেগী নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তিনি। সবার মাঝে এই ধারনা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত এই পীর যদি কারো জন্য দোয়া করেন তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা মঞ্জুর করবেন। এ জন্য দলে দলে লোক আসতো তার কাছে। তিনি সবার সাথে কথা বলতেন না, সবাইকে তার সাথে কথা বলার সুযোগও দিতেন না। তবে তিনি যার সাথেই কথা বলতেন সে তোক নিজেকে বড় সৌভাগ্যবান মনে করতো। লোকের ধারনা, তিনি যার সাথে কথা বলেন তার সব আশা পূরণ হয়ে যায়।

এক লোক তাকে শহরের বাইরে একটি পর্ণকুটির দান করেছিল। সেই কুটিরেই থাকতেন তিনি। অল্পদিনের মাঝেই তার কেরামতির কাহিনী শহরের সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো। এমনকি দূর দূরান্তের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়লো তার কেরামতির খবর। ফলে প্রতিদিনই তার ভক্তের সংখ্যা বাড়তে লাগলো।

ক্রমে তার কুটিরের সামনে জনতার ভীড় লেগে গেলো। প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে আসতে লাগলো সমস্যাগ্রস্ত লোকজন।

তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ে কুটিরের বাইরে আসতেন। অবশিষ্ট সময় তিনি আপন হুজরায় বসে এবাদত ও ধ্যানে কাটিয়ে দিতেন। যখন তিনি বাইরে আসতেন তখন খাদেমরা ঘিরে রাখতো তাকে। তিনি বাইরে এসেই দু’হাত উপরে তুলে উপস্থিত জনতাকে শান্ত হতে ইশারা করতেন।

জনতা নিরব হলে তিনি তাদের নসীহত করতেন। তারপর দু’চার জনের সমস্যার কথা শোনার জন্য তাদের নিয়ে যেতেন কুটিরের ভেতরে।

তিনি তাদের দুঃখ কষ্টের কথা শুনে তাদের শান্ত্বনা দিতেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন। ভাগ্যবান এই লোক ক’জন প্রশান্ত মন নিয়ে কুটিরের বাইরে চলে যেতো।

তার সাথে কয়েকজন সুশ্রী ও স্বাস্থ্যবান খাদেম থাকতো। তাদের গায়ের রং ছিল ফরসা। তারা আপাদমস্তক সবুজ কাপড়ে সজ্জিত থাকতো।

একদিন তারা উপস্থিত জনতাকে বললো, ‘এই কামেল দরবেশ মুশেলবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ। তিনি তোমাদের জন্য সুসংবাদ বহন করে এনেছেন।’

এভাবে প্রতিদিন তারা দরবেশ সম্পর্কে নানা রকম কথা শোনাতো। এইসব কথা লোকদের অন্তরে গেঁথে যেতো।

দরবেশ যাদের সাথে কথা বলতেন তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে লোকদের শোনাতো নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তারা বলতো, ‘আমি অমুক বিপদে পড়ে হুজুরের কাছে এসেছিলাম। হুজুরের দোয়ায় আমার আশা পূরণ হয়েছে।’

এইসব প্রচারণার ফলে কিছুদিনের মধ্যেই লোকজন দরবেশকে ইমাম মেহেদী বলে মনে করতে লাগলো। কেউ কেউ বলতে লাগলো, হযরত ঈসা (আ.) আবার দুনিয়ায় নেমে এসেছেন।

একদিন লোকেরা দেখলো দরবেশ পালকিতে চড়ে মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনের মহলের দিকে যাচ্ছেন। সাথে আছে তার খাদেমবৃন্দ।

তারা অবাক হয়ে দেখলো, ইয়াজউদ্দিনের রক্ষী বাহিনী তাঁকে সম্বর্ধনা জানিয়ে অত্যন্ত তাজিমের সাথে মহলের ভেতরে নিয়ে গেলো। কয়েক ঘন্টা পর তিনি সেখান থেকে বের হয়ে এলেন এবং নিজের পালকি রেখে ইয়াজউদ্দিনের শাহী টাঙ্গায় চড়ে বসলেন।

লোকজন ভাবলো তিনি নিজের আস্তানায় ফিরে যাচ্ছেন। তারা হুজুরের সাথে রওনা হলো আস্তানায় গিয়ে হুজুরের কাছ থেকে দোয়া নেবে বলে।

খাদেমরা বললো, আপনারা হুজুরের সাথে থাকবেন না। হুজুরের আস্তানায় গিয়ে অপেক্ষা করুন। লোকজন হুজুরের আগেই তার আস্তানায় পৌঁছার জন্য যে যেভাবে পারে ছুটলো।

হুজুরের কুঁড়েঘরের কাছে গিয়ে জড়ো হয়ে বসে রইলো লোকজন। কিন্তু কোথায় হুজুর? সন্ধ্যা নাগাদ না হুজুর ফিরল, না তার খাদেমরা। তারা সেখানে কাউকে না পেয়ে সন্ধ্যার সময় নিজ নিজ বাড়ীর দিকে রওনা হলো। অতি উৎসাহী ভক্তবৃন্দ ফিরে গেল শাহী মহলের গেটে।

দরবেশকে মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনের শাহী গাড়ী দূরে কোথাও নিয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় সেই গাড়ী ফিরে এলো শাহী মহলে। কিন্তু গাড়ীতে হুজুর নেই, সেখানে বসে আছে গাড়ীর চালক ও দু’জন রুক্ষী।

জনতা গাড়ী থামিয়ে রক্ষীদের জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ‘দরবেশ কোথায়?’

‘আমরা বলতে পারবো না তিনি কোথায় গেছেন?’ এক রক্ষী বললো, ‘তিনি আমাদেরকে এক পাহাড়ের ধারে গাড়ী রাখতে বললেন। আমরা গাড়ী থামালে তিনি আমাদের দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমাদের আর কষ্ট করার দরকার নেই। এবার তোমরা চলে যাও।’

আমি খাদেমদের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দরবেশ আমাদের ছেড়ে কোথায় যাচ্ছেন?’

তিনি বললেন, ‘হুজুর এ পাহাড়ের কোন এক উপত্যকায় গিয়ে ধ্যানে বসবেন। মুশেলের আমীরের মঙ্গলের জন্য সেখানে তিনি প্রার্থনা করবেন। যতক্ষণ দিগন্তে তিনি কোন মঙ্গল নিশানা দেখতে না পাবেন তততক্ষণ চলবে এ প্রার্থনা। তারপর তিনি পাহাড় থেকে নেমে মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনকে বলবেন এখন তার কি করা উচিত।’

রক্ষী আরো বললো, ‘সেই খাদেম আমাকে আরো বলেছেন, হুজুরের প্রার্থনা শেষ হলে হুজুরের দোয়া নিয়ে মুশেলের সৈন্যরা যে দিকে যাবে সেদিকের পাহাড় তাদের চলার পথকে সহজ করে দেবে। তাদের সামনে মরুভূমি পড়লে সেই মরুভূমি শস্য শ্যামল প্রান্তরে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। শক্রর সৈন্য বাহিনী তাদের মুখোমুখী হলে দুশমন ফৌজ অন্ধ হয়ে যাবে।

মুশেলের আমীর এই বাহিনী নিয়ে যেখানে গিয়ে পৌঁছবেন সেখানেই তারা বিজয়ী হবে এবং সেখানে তার রাজত্ব কায়েম হবে। এমনকি যদি সুলতান সালাহউদ্দিনের বাহিনীও তাদের সামনে পড়ে তবে তারা আমীর ইয়াজউদ্দিনের সামনে অস্ত্র সমর্পন করতে বাধ্য হবে।’

তিনি আরো বললেন, ‘হুজুর স্বপ্নে দেখেছেন, খৃষ্টানরা আমাদের আমীরের গোলামে পরিণত হয়েছে এবং মুশেলবাসী অর্ধ পৃথিবীর বাদশাহ হয়ে গেছে। তারা সোনাদানা ও প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছে।’

লোকজন প্রশ্ন করলো, ‘তিনি কোন পাহাড়ের উপত্যকায় ধ্যানে বসবেন?’

‘সে কথা বলতে বারণ আছে। হুজুর চান না, তিনি যখন ধ্যান করবেন বা প্রার্থনা করবেন তখন কেউ তাতে বিঘ্ন ঘটাক। এ জন্যই তিনি জনপদ থেকে দূরে সরে গেছেন। তাই আমরা বলতে পারবো না, তিনি এখন কোন পাহাড়ের উপত্যকায় গিয়ে বসবেন।’

মুশেল থেকে কিছু দূরের পাহাড়ী এলাকা। শহরের কাছে হলেও সেখানে কোন জনবসিত নেই। সেখানে পাহাড়ের পর পাহাড় আর টিলার সমাহার। সেইসব টিলার ফাঁকে ছোট বড় খোলা প্রান্তর। তেমনি প্রান্তরের মাঝে হঠাৎ কোথাও দু একটি কুটির চোখে পড়ে। ওতে বাস করে কোন পাহাড়ী পরিবার। তেমনি একটি প্রান্তর।

প্রান্তরটি বেশ সবুজ শ্যামল। পাহাড়ী রাখালরা সেখানে মেষ ও উট চরাতো। একদিন রাখালদেরকে সেই প্রান্তরে আসতে নিষেধ করে দিল একদল সেনিক। এই প্রান্তরের পাশ দিয়ে যাতে কোন লোক চলাচল করতে না পারে সে জন্য মুশেলের সৈন্যরা সেখানে পাহারা বসালো। কোন পাহাড়ীও যাতে সে পথে পা না বাড়ায় সে জন্য তাদের বলা হলো দূর দিয়ে যাতায়াত করতে।

মুশেলের সৈন্যরা সেখানে পাহারা দিচ্ছিল। পাহাড়ী রাখাল ও লোকজন দেখলো, সেই সৈন্যদের সাথে আরো কিছু লোক আছে যাদের পোশাক ভিন্ন। তাদের সাথে বাইরের অজানা এই লোকগুলো কারা চিনতে পারলো না তারা।

পাহাড়ী এলাকার সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ওদের যাতায়াত নিষিদ্ধ হওয়ায় তাদের মধ্যে জাগলো কৌতুহল। সেখানে কি ঘটে জানার জন্য তাদের আগ্রহের কোন কমতি নেই। বরং নিষেধাজ্ঞার ফলে ওইসব পাহাড়ীদের আগ্রহের কেন্দ্র হয়ে উঠলো সেই প্রান্তর।

সে জায়গা সম্পর্কে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শুনতে লাগলো তারা। শোনা গেল, সেখানে এক দরবেশ এসেছেন। তিনি মুশেলবাসীর ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবেন।

এ কথাও সকলের মুখে মুখে গুজবের মত ফিরতে লাগলো যে, দরবেশ আকাশ থেকে কোন এক নিদর্শন দেখতে পাবেন। তারপর তিনি মুশেবাসীদের জন্য দোয়া করবেন। তার দোয়া নিয়ে যখন মুশেলের সৈন্যরা পথে নামবে তখন তাদের চলার পথের সব বাধা দূর হয়ে যাবে। তাদের সামনে যারাই পড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে তারা। এভাবেই মুশেলবাসী একদিন অর্ধ পৃথিবীর বাদশাহী পেয়ে যাবে।

মুশেল শহরেও এসব গুজব সমানে চলছিল। যেখানেই দু’চারজন লোক সমাগম হয় সেখানেই তাদের আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় দরবেশের কেরামতির কাহিনী।

একদিন এক রাস্তার মোড়ে চারজন লোক বসেছিল। তাদের মাঝেও দরবেশের অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে কথা হচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিল হাসান ইদরিস।

হাসান ইদরিস সুলতান আইয়ুবীর সেই গোয়েন্দা যে বৈরুত থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনের দুত এহতেশামুদ্দিন ও তার নর্তকী কন্যা সায়েরাকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে নিয়ে এসেছিল। তার এই তুলনাহীন সফলতায় সুলতান খুবই খুশী হয়েছিলেন এবং ইসলামের ইতিহাসে বড় ধরনের অবদান রাখার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।

এহতেশামুদ্দিন সুলতান আইয়ুবীকে জানিয়েছিলেন, খৃষ্টানরা মুশেলের কাছে কোন এক পাহাড়ের গহ্বরে অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য সামগ্রীর বিরাট ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। মুশলের সেই পাহাড়কেই তারা তাদের কমাণ্ডো বাহিনীরও আখড়া বানিয়েছে। এতে সুলতান আইয়ুবীর কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তারা পাহাড়ী এলাকায় তাদের সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। তিনি এই সত্যও উপলব্ধি করতে পারলেন, যুদ্ধের আগেই যে সৈন্য বাহিনী প্রতিপক্ষের অস্ত্র ও রসদপত্র হস্তগত করতে পারে তারা অর্ধেক যুদ্ধ আগেই জয় করে নেয়।

এ জন্যই সুলতান আইয়ুবীর কমাণ্ডো বাহিনী সব সময় খৃস্টানদের অজ্ঞাতে তাদের অস্ত্র ও রসদ ভাণ্ডারে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে তা ধ্বংস করে দিত। সুলতানের কমাণ্ডো বাহিনীর হাতে বার বার নাজেহাল হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল খৃস্টান সৈন্যদের। তাই খৃস্টান বাহিনী সব সময় এই কমাণ্ডো আতঙ্কে ভুগতো।

সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধের কিছু বিশেষ কৌশল ছিল। তিনি সব সময় মরুভূমির পানির উৎসগুলো নিজ অধিকারে রাখতেন। ঘাস ও চারণভূমিগুলোও নিজ অধিকারে রাখতেন। তার কমাণ্ডো বাহিনী খৃস্টানদের অস্ত্র ও রসদের ভাণ্ডার ধ্বংস করে দিত। এমনকি পশুর খাবারও নষ্ট করে ফেলতো যাতে তাদের ঘোড়া ও উটগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া যুদ্ধের জন্য তিনি সব সময় উঁচু স্থান বেছে নিতেন যাতে তার তীরন্দাজ বাহিনী পাহাড়ের চুড়ায় বসে সহজেই দুশমনকে টার্গেট বানাতে পারে।

সুলতান আইয়ুবী তার গোয়েন্দা প্রধান হাসান বিন আবদুল্লাহকে বললেন, ‘খৃষ্টান কমাণ্ডোরা কোথায় আস্তানা গেড়েছে তা খুঁজে বের করো।’ এরপর তিনি তার কমাণ্ডো বাহিনীর সেনাপতি সালেম মিশরীকে বললেন, ‘তাদের আস্তানা ও রসদ ভাণ্ডারের সন্ধান পেলে সাথে সাথে সেগুলো হস্তগত করবে অথবা ধ্বংস করে দেবে।’

সুলতান আইয়ুবী বুঝতে পারছিলেন, খৃস্টানরা আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতিতে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেছে। তারা চাচ্ছে তিনি যেন আগে আক্রমণ করেন। কিন্তু তিনি তাদের পাতা ফাঁদে পা দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি এহতেশামুদ্দিনের কাছ থেকে খৃষ্টানদের পরিকল্পনার সংবাদ পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, খৃষ্টান বাহিনীকে তিনি কোথাও স্থিরভাবে দাঁড়ানোর সুযোগ দেবেন না। আবার নিয়মিত যুদ্ধের সূচনাও করবেন না তিনি।

সুলতান আইয়ুবী তার কমাণ্ডো বাহিনীকে তৎপর হতে হুকুম দিয়ে বললেন, ‘মুশেলের আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ো এবং খোঁজ নাও কোথায় দুশমন আত্মগোপন করে আছে। খোঁজ পাওয়ার সাথে সাথে তাদের ওপর কমাণ্ডো হামলা চালাবে এবং ঝটিকা অভিযান চালিয়ে তাদের তছনছ করে দিয়ে মুহূর্তে আবার তাদের দৃষ্টির সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে।’

এরপর তিনি তার নিয়মিত বাহিনীকে আদেশ করলেন, “তোমরা সাঞ্জারের দিকে অভিযান চালাও এবং সাঞ্জার দূর্গ অবরোধ করে নাও।’

সাঞ্জার মুশেল থেকে কিছু দূরে একটি গুরুত্বপূর্ণ দূর্গ। মুশেলের প্রতিরক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান সাঞ্জার। এ কেল্লার অধিপতি ছিলেন শারফুদ্দিন বিন কুতুবুদ্দিন।

একটু আগে সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনাপতিদের বলেছিলেন, ‘এখন আমি আর কারো সাহায্য সহযোগিতার জন্য আবেদন জানাবো না বরং তলোয়ারের খোঁচায় তাদের সাহায্য আদায় করে নেবো।’ সাঞ্জার দূর্গ অবরোধ এই সংকল্প বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ।

তিনি জানতেন, এসব ছোট ছোট মুসলমান আমীররা স্বাধীন থাকার জন্য খুবই লালায়িত। এ জন্য তারা গোপনে খৃষ্টানদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে আছে।

সাঞ্জারের আমীর শারফুদ্দিন সম্পর্কে সুলতান আইয়ুবী খবর পেলেন, তিনি মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনের বন্ধু। তাদের বন্ধুত্বের ভিত্তি হলো সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে সে প্রাচীর গড়ে তুলবে।

হাসান বিন আবদুল্লাহ তাঁর গোয়েন্দাদের দিকে তাকালেন। মুশেলে তার গোয়েন্দা অনেকেই আছে। কিন্তু তিনি অনুভব করলেন, খৃষ্টানদের রসদ ভাণ্ডারের খোঁজ পেতে হলে তাকে একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও সাহসী গোয়েন্দাকে বৈরুত পাঠাতে হবে। এদিকে যখন খৃস্টান কমাণ্ডোদের অনুসন্ধান চলবে তখন সে চেষ্টা করবে তারা কোথায় আছে সে খবর বৈরুত থেকে সংগ্রহ করতে। তিনি হাসান ইদরিসকে এ জন্য বাছাই করলেন।

তখনি তার মনে হলো, এটা ঠিক হবে না। সে দীর্ঘদিন বৈরুতে ছিল, আবার ফিরে গেলে খৃস্টান গোয়েন্দারা তাকে চিনে ফেলতে পারে।

হাসান ইদরিস ছিল গুপ্ত বেশ ধারণে ওস্তাদ। বেশভূষার সাথে সাথে সে নিজের কণ্ঠও বদলে ফেলতে পারতো। হাসান বিন আবদুল্লাহর অভিপ্রায় এবং তা পাল্টে ফেলার কথা জানতে পেরে সে হাসান বিন আবদুল্লাহকে বললো, ‘আপনি আমাকে নির্দ্বিধায় বৈরুত পাঠাতে পারেন। আমি বৈরুত ফিরে গিয়ে এমন বহুরূপ ধারণ করবো যে, পরিচিত লোকও আমাকে চিনতে পারবে না।’

কিন্তু হাসান বিন আবদুল্লাহ এই ঝুঁকি নিতে সাহস পেলেন না। তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি বরং মুশেল যাও। ওখানে কেউ তোমাকে চেনে না। তুমি মুশেল থেকেই গোপন তথ্য বের করার চেষ্টা করো।’

হাসান ইদরিস মুশেল রওনা হলে সুলতান আইয়ুবী তাকে ডাকলেন এবং নিজে তাকে আরো কিছু উপদেশ দিলেন যাতে সে দ্রুত সাফল্য বয়ে আনতে পারে। তিনি তাকে বললেন, ‘হে প্রিয় বন্ধু! মনে রাখবে, ইতিহাস সব সময় সুলতান আইয়ুবীর নাম মনে রাখবে। পরাজিত হলে ইতিহাস আমাকে লজ্জা দেবে এবং একজন ব্যর্থ সেনানায়ক বলে তিরষ্কার করবে। আর যদি বিজয় লাভ করি বা শহীদ হই, তবে লোকে আমার কবরে ফুল ছিটাবে। ভবিষ্যত প্রজন্ম আমার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমাকে স্মরণ করবে গর্ব ভরে। কিন্তু এটা খুবই অন্যায়।’

তিনি হাসান ইদরিসকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘বিজয় মাল্য তো তোমাদের প্রাপ্য। প্রাপ্য তোমার সেইসব সঙ্গী সাথীদের, যারা শত্রুর দূর্গের ভেতর থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে আনে। এ তথ্যই তো আমাদের বিজয়ের পথকে সুগম করে। ইদরিস, দুনিয়া কিভাবে কাকে মূল্যায়ন করবে এটা বড় কথা নয়। আল্লাহ সব দেখছেন। তিনি জানেন এই বিজয়ের পেছনে কার অবদান কতটুকু। আমি বিশ্বাস করি, কাল কেয়ামতের মাঠে তোমাদের মাথায় আল্লাহ নিজ হাতে বিজয় মুকুট পরিয়ে দেবেন।

আমি যদি পরাজিত হই তবে তা ঘটবে আমার ভুলের কারণে। হয়তো দেখা যাবে তোমাদের সংবাদকে আমি যেভাবে গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল সেভাবে দিতে পারিনি। কিন্তু যদি জয়লাভ করি সে জয় হবে তোমাদের। কারণ আমার কান ও চোখ তোমরা।’

তিনি খানিক থামলেন। একটু পর হাসান ইদরিসের দিকে তাকিয়ে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘যদি আমি শহীদ হয়ে যাই তবু আমার আত্মা তোমাদের কবরের উপর ফাতেহা পাঠ করতে থাকবে। আমার আত্মা তোমাদের জন্য প্রতিনিয়ত মাগফেরাত কামনা করতে থাকবে। কারণ তোমরাই জাতির মহান বীর। মনে রেখো, একটি সমৃদ্ধ গোয়েন্দা বিভাগ সেই জাতির গৌরব ও গর্বের ধন।’

তিনি বললেন, “দেখো, এ যুদ্ধে প্রকৃত অর্থে আমার কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আমি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সাঞ্জার অভিযানে যাচ্ছি। আর তুমি? তুমি একা সেখানে যাচ্ছো যেখানে চারপাশে কিলবিল করছে তোমার দুশমন। আমি যদি বিজয়ী হই তা হবো আমার বাহিনীর জন্য, আর তুমি বিজয়ী হবে একা। তাহলে বলো, কার মর্যাদা বেশী হওয়া উচিত? যাও প্রিয় বন্ধু, তুমি যাও, আল্লাহ হাফেজ।’

সূর্য ডুবেছে একটু আগে। হাসান ইদরিস এক গরীব মুসাফিরের বেশে নসিবা ক্যাম্প ত্যাগ করলো। সঙ্গে শুধু নিজের বাহন উটটি, আর কোন সঙ্গী নেই।

অন্ধকার রাত। একাকী পথ চলছে হাসান ইদরিস। ভাবছে দায়িত্বের কথা। সুলতান আইয়ুবীর শেষ কথাগুলো এখনো তার কানে বাজছে। উট চলছে ধীর গতিতে।

নসিবা থেকে বহু দূরে চলে এসেছে সে। রাতও গড়িয়ে গেছে অনেক। ঘুম ঘুম একটা ভাব পেয়ে বসেছে তাকে। এ সময় অসংখ্য ঘোড়ার মৃদু পদধ্বনি শুনতে পেলো সে। অনেক দূর দিয়ে কোন কাফেলা যাচ্ছে।

এত রাতে কারা যায়? কার এ ঘোড়ার আরোহী? সুলতান আইয়ুবী কি স্বসৈন্যে সাঞ্জার দূর্গ অবরোধ করতে যাচ্ছেন? কান পেতে সে শুনলো ঘোড়ার ছুটে চলার শব্দ। এক সময় মিলিয়ে গেল সে ধ্বনি।

সুলতান আইয়ুবী নসিবা থেকে তার ক্যাম্প উঠিয়ে নেননি। নসিবায় অবস্থিত তার হেডকোয়ার্টারে কিছু সৈন্য ও অফিসার এবং সেই সাথে তাঁর রিজার্ভ বাহিনীকে সেখানে প্রস্তুত অবস্থায় রেখে তিনি নসিবা ত্যাগ করলেন।

এক সময় মুশেল এসে পৌঁছলে হাসান ইদরিস। সোজা গিয়ে রিপোর্ট করল মুশেলের গোয়েন্দা কমাণ্ডাবের কাছে।

‘তুমি এখানে জানতে এসেছো, খৃষ্টানরা তাদের সৈন্য, খাদ্য ও অস্ত্রসম্ভার পাহাড়ের কোন গুহায় লুকিয়ে রেখেছে?’ মুশেলের গোয়েন্দা কমাণ্ডার বললো, ‘আমরাও তো এখানে এ তথ্য জানার জন্যই আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

‘কিন্তু চেষ্টা তো সফল হতে হবে। সুলতান এ তথ্য জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন? কোন সূত্রই কি আপনারা সংগ্রহ করতে পারেননি?’

‘জানি না এ সূত্র কোন কাজ দেবে কিনা? এখানে এক দরবেশের আবির্ভাব হয়েছে। এতদিন তিনি শহরের কাছে এক কুটিরে বাস করতেন। এর মধ্যে এক ঘটনা ঘটলো।

একদিন দরবেশ মুশেলের শাসক ইয়াজুদ্দিন মাসুদের মহলে গিয়ে তার সাথে দেখা করলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি এক পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি ভবিষ্যতবাণী করে বলেছেন, ‘মুশেলবাসীরা একদিন অর্ধ পৃথিবীর শাসক হবে। অগাধ সম্পদের মালিক হবে।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘তিনি তাদের জন্য দোয়া করবেন। একদিন আকাশ থেকে তিনি ইশারা পাবেন। তখন তিনি মুশেলের ফৌজকে অভিযানের জন্য বলবেন। তার দোয়া নিয়ে মুশেলের ফৌজ যখন ময়দানে নামবে তখন পথের সমস্ত বাঁধা তাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।’

‘বলেন কি!’ হাসান ইদরিস অবাক হয়ে বললো, ‘এ লোক তো দরবেশ নয়। এ লোক খৃস্টানদের গোয়েন্দা। তাকে পাকড়াও করতে পারলেই খৃস্টান কমাণ্ডোদের হদিস বের করা সম্ভব।’

‘কিন্তু এ লোক তো এখন হাতের নাগালের বাইরে। পাহাড়ের কোথায় গিয়ে তিনি আসন নিয়েছেন জানা নেই আমাদের। তিনি পাহাড়ে আসন নেয়ার পর থেকে সৈন্যরা সে এলাকাটা ঘিরে রেখেছে। পাহাড়ের আশপাশ দিয়ে কারো চলাচলের অনুমতি নেই। এমনকি পাহাড়ী উপজাতিদেরও সেখান থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানকার চারণভূমিতে পশু চরাবার অনুমতিও নেই রাখালদের।’

‘দরবেশের নিরাপত্তার জন্য কারা পাহারা বসিয়েছে, মুশেলের সেনাবাহিনী?’

‘হ্যাঁ, তবে তাদের সাথে কিছু অচেনা মানুষও আছে। তারা কাউকে পাহাড়ে চড়তে দিচ্ছে না। এমন কি পাহাড়ের আশপাশেও ভিড়তে দিচ্ছে না।’

‘এখানে তার ভক্তের সংখ্যা কেমন?’

‘অনেক। কেউ কেউ তাকে ইমাম মেহেদী মনে করে। কেউ কেউ তাকে হযরত ঈসা (আ.) ভাবে। তাদের ধারনা, হযরত ঈসা (আ.) মুশেলবাসীর দুঃখ দূর করার জন্য আবার পৃথিবীতে নেমে এসেছেন।’

কমাণ্ডার হাসান ইদরিসকে আরো বললো, ‘এই দরবেশের সুখ্যাতি শহর ও তার আশপাশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি একজন পবিত্র ও কামেল লোক এ ব্যাপারে সাধারণ মুসলমানদের মনে কোন সন্দেহ নেই। রাতের বেলা শহরের লোকেরা বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। কোন তারকা ছিটকে পড়লে তারা চিৎকার দিয়ে উঠে এই সেই ইশারা। এভাবে লোকজন আল্লাহ ও তার রাসুলকে ভুলতে বসেছে।’

ওরা চারজনই আইয়ুবীর গোয়েন্দা। বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে তাদেরকে দরবেশের মুখোশ খোলার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদেরকে এ কথা ভাল করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ইসলামে আত্মপূজা হারাম। মুশেলবাসীর মন মগজ যখন দরবেশ আচ্ছন্ন করে নিয়েছে তখন এই চার গোয়েন্দা দরবেশের মুখোশ খোলার কাজে লিপ্ত হলো।

‘আমার প্রিয় বন্ধুগণ। আমার কথা যদি হেসে উড়িয়ে না দাও তবে বলি।’ হাসান ইদরিস বললো, ‘যেখানে দরবেশ আছে সেখানেই খৃষ্টানদের রণসম্ভার ও রসদ আছে। আর এটা কোন তুচ্ছ ভাণ্ডার হতে পারে না।

এমনিতেই জনসাধারণকে সরিয়ে তাদের নাগালের বাইরে গিয়ে দরবেশ তার আখড়া তৈরী করেনি। আমার বিশ্বাস, এতবড় বিস্তৃত পাহাড়ী এলাকায় যতই সৈন্যই পাহারায় বসানো হোক না কেন, ভেতরে যাওয়ার সুযোগ অবশ্যই সৃষ্টি করা সম্ভব। মানুষ এই ভয়ে সেখানে যায় না, ওখানে আল্লাহর এক দরবেশ বসে আছেন! তিনি চান না, তার আশেপাশে কেউ যাক। তাই লোকজন সেদিকে তাকানোর সাহস পায় না।’

কমাণ্ডার হাসান ইদরিসকে বললো, ‘তুমি কি শোননি চারদিকে কি গুজব রটিয়ে দেয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি সে এলাকায় যাবে এবং দরবেশকে দেখার দুঃসাহস করবে, সে লুলো হয়ে যাবে, তার সন্তানদের চোখ অন্ধ হয়ে যাবে।’

হাসান ইদরিসের অন্য সাথী বললো, “খৃষ্টানরা সেখানে অস্ত্রের গোপন ঘাঁটি গড়ে তুলেছে এতে আমাদেরও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্য মিথ্যা যাচাই না করে এ তথ্য আইয়ুবীর কাছে পাঠানোর কোন মানে হয় না। আমাদের জানা দরকার সেখানে কি আছে এবং তার পরিমাণ কেমন? সেখানে কি কেবল অস্ত্রই আছে নাকি সৈন্যও মজুদ করেছে খৃস্টানরা? এখন বলো, এ তথ্য উদ্ধারের জন্য আমরা কি করতে পারি? দরবেশ যে খৃষ্টানদের একটা সাজানো কাভার তোমার মত আমরাও তা বুঝতে পারছি?’

‘শুধু তথ্য আদায় নয় দরবেশকে তার সম্পদসহ ধ্বংস করতে হবে।’ হাসান ইদরিস বললো।

‘শুধু দরবেশকে ধ্বংস করলেই চলবে না, জনগণকেও বিভ্রান্তির হাত থেকে বাঁচাতে হবে। দরবেশের মুখোশ খুলে দিয়ে প্রমাণ করতে হবে এ লোক কোন পীর নয়, পীরের বেশ ধরে আছে মাত্র।’ অন্য সঙ্গী বললো।

গোয়েন্দা কমাণ্ডার বললো, ‘খৃষ্টানদের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। তারা শুধুমাত্র একজন দরবেশকে সেখানে বসিয়েই তাদের অস্ত্র ও রসদসম্ভার জনসাধারণের দৃষ্টির আড়ালে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর সেই দরবেশ মুশেলের জনগণকে আল্লাহর ইশারার কথা বলে তাদেরকে জিহাদ থেকে ফিরিয়ে রেখেছে। মনে হয় মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনও ছলনার শিকার। আল্লাহর ইশারার অপেক্ষায় মুসলমানদের বসিয়ে রেখে তারা প্রস্তুতি পূর্ণ করছে।’

‘দরবেশ সম্পর্কে মুশেলের আমীরের ধারণা কি?’ হাসান ইদরিস প্রশ্ন করলো।

‘দরবেশ যখন তাঁর মহলে গিয়েছিল তখন তাকে স্বসম্মানে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল ইয়াজউদ্দিনের মহলের রক্ষীরা।’ কমাণ্ডার প্রশ্নের উত্তরে বললো, ‘আর দরবেশ যখন বেরিয়ে আসে, তখন ইয়াজউদ্দিন তার ছয় ঘোড়ার শাহী পালকি দিয়েছিল দরবেশকে পৌঁছে দিতে। সেই গাড়ীতে করেই তিনি পাহাড়ী এলাকায় যান এবং সেখানে আস্তানা গাড়েন। এতেই প্রমাণ হয়, ইয়াজউদ্দিনও এই ষড়যন্ত্রের সাথে লিপ্ত।’

‘কিন্তু ষড়যন্ত্রটা কোন পর্যায়ের তা কিন্তু এতে পরিষ্কার হলো না। দরবেশ ও ইয়াজউদ্দিনের মধ্যে কি নিয়ে আলাপ হয়েছে। তা জানা দরকার ছিল।’

‘তারও ব্যবস্থা করা যাবে।’ কমাণ্ডার বললো, ‘যা কিছুই ঘটুক আমরা তা জানতে পারবো। মহলে রাজিয়া খাতুন আছেন। তিনি সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন মহলের ভেতর। তার কাছ থেকেই জানা যাবে মহলে দরবেশ কেমন খাতির যত্ন পেয়েছেন এবং তাদের মধ্যে কি নিয়ে আলাপ হয়েছিল।’

এরা সে এলাকায় সতর্ক দৃষ্টি রাখা শুরু করলো। গোয়েন্দা তৎপরতা ছড়িয়ে দিল পাহাড়, শহর এবং শহরতলী সংলগ্ন দরবেশের সেই কুটিরের আশপাশ পর্যন্ত।

সাঞ্জার দুর্গের প্রাচীরের উপর প্রহরীরা অলসভাবে পাহার দিচ্ছিল। যুগটা যুদ্ধের হলেও ওদের জন্য সময়টা ছিল শান্তির। কোন রকম বিপদ বা ঝুঁকির আশংকা না থাকায় পাহারায় কোন সতর্কতা ছিল না।

তাদের এ নিশ্চিন্ততার কারণ, সাঞ্জারের আমীর শারফুদ্দিন খৃষ্টানদের উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই খৃস্টানরা তার ওপর কোন আক্রমণ করবে না, এটা জানা কথা। এছাড়া তাদের জানা আছে, পার্শ্ববর্তী হলবের আমীর ইমামুদ্দিন ও মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনও খৃস্টানদের সাথে সমঝোতা করে নিয়েছে। তারা তাকে এ আশ্বাসও দিয়েছে, বিপদের সময় তারা একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ফলে প্রতিবেশী দুই অঞ্চলের সাথে এখন তার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যাচ্ছে। এ অবস্থায় তার ভয়ের কোন কারণ নেই। এ জন্যই শারফুদ্দিন ও তার সৈন্যর ছিল নির্বিকার ও নিশ্চিন্ত। তারা কল্পনাও করেনি, সুলতান আইয়ুবী কখনো তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারেন।

মধ্য রাত পেরিয়ে গেছে। মানুষ ঘুমিয়ে আছে শান্তির কোলে। কিন্তু যাদের হাতে সম্পদের পাহাড় জমে যায় তারা অত সহজে ঘুমাতে পারে না। ভোগের তৃষ্ণা তাদের ঘুম ঘুম চোখগুলোকে যেন কিছুতেই ঘুমোতে দেয় না। তাই ঘুম এলেও ঘুমোতে পারছিল না শারফুদ্দিন। শরাবের নেশায় মাতাল অবস্থায় ঢুলছিল সে। খৃষ্টানরা তাকে দুটি সুন্দরী মেয়ে উপহার পাঠিয়েছিল, তারা তখনো তার হাতে তুলে দিচ্ছিল শরাবের পাত্র।

কেল্লার উপর দিয়ে একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তীর বেগে ছুটে গেল। একটু পরেই আরো একটা প্রহরীরা বিস্মিত হলো। তখনো তারা ধারনাই করতে পারেনি, কেউ তাদের আক্রমণ করেছে। রহস্যময় স্ফুলিঙ্গের উড়াউড়ি দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওরা একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলো। তাদের চাহনি বলছিল, কি অবাক কাণ্ডরে বাবা! ভূতের পাল্লায় পড়লাম নাকি?

কেল্লার প্রহরীরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে এ নিয়েই কথা বলছিল। তাদের সবার মুখেই ভয় ও আতংকের স্পষ্ট ছাপ। তারা যেদিক থেকে ফুলিঙ্গ দুটো ছুটে এসেছিল সেদিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কিছু দেখা যায় কিনা। কিন্তু নাহ, সবকিছুই সুনসান, নিরব, নিস্তব্ধ।

হঠাৎ সবাইকে ভড়কে দিয়ে আরো একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছুটে এলো এবং সেটি তাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে দূর্গের ভেতরে পড়লো! স্ফুলিঙ্গটি উড়ে গিয়ে এমন জায়গায় পড়লো যেখানে পর শুকনো খাবার গাদা করে রাখা হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো।

গাদার পাশেই ছিল ঘোড়ার আস্তাবল। দেখতে দেখতে সেই আগুন কাঠের তৈরী আস্তাবল স্পর্শ করলো এবং মুহর্তে সেই আস্তাবল অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো।