দ্বিতীয় শর্ত ছিল, যারা স্বেচ্ছায় মসজিদুল আকসা মুক্ত করার জেহাদে শরীক হতে চায় সে সব সৈন্যদের সুলতানের বাহিনীতে শামিল হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।’
উজির বোকতামিয়ার মাধ্যমে শাহ আরমান এই শর্ত মেনে নেয়ায় সুলতান আইয়ুবী সঙ্গে সঙ্গে অবরোধ উঠিয়ে নিলেন। তিনি তার এক সেনাপতিকে পাঠালেন উজিরের সাথে। উজিরসহ সেনাপতি গেলেন ইয়াজউদ্দিন ও শাহ আরমানের উদগ্রীব সৈন্যদের ওখানে। তিনি তাদের জানালেন সন্ধির শর্ত।
ইয়াজউদ্দিনের অধিকাংশ সৈন্য এবং শাহ আরমানের সৈন্যদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সুলতানের সাথে জেহাদে শরীক হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি সেই সব সৈন্যদের নিয়ে সেখান থেকে বিদায় হলেন।
সন্ধ্যার একটু পর। সুলতান আইয়ুবী যে পরিমাণ সৈন্য নিয়ে এই অভিযানে বেরিয়েছিলেন তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশী সৈন্য নিয়ে শাহ আরমানের সাথে সাক্ষাত না করেই আল খালিদের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
সন্ধির শর্ত মোতাবেক তিনি আল খালিদ থেকেও অবরোধ উঠিয়ে নিলেন। সেখান থেকেও শাহ আরমানের বিপুল সংখ্যক সৈন্য সুলতানের সহযোগী হলো।
সুলতান তাদের নিয়ে গেলেন আল খালিদের অদূরে এক বিশাল পাহাড়ের উপত্যকায়। সেখানেই তিনি সৈন্যদের ক্যাম্প করার নির্দেশ দিয়ে পরবর্তী অভিযানের পরিকল্পনা করতে বসলেন।
মরু আরবের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দাইয়ারে বাকা। সে যুগে অঞ্চলটি আরবের একটি উৎকৃষ্ট অঞ্চল বলেই বিবেচিত হতো। সামরিক দিক থেকে অঞ্চলটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আরো একটি কারণে সারা আরব জুড়ে এ এলাকাটি ছিল মশহুর। এ অঞ্চলের লোকেরা যুদ্ধ বিদ্যায় খুবই পারদর্শী ছিল। তাদের শারিরীক গঠনও ছিল মজবুত। সহজেই তারা যুদ্ধের রণকৌশল রপ্ত করে নিতে পারতো। ফলে যে কোন সেনাবাহিনীতেই ছিল তাদের বিশেষ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্য বিভাগেও এ অঞ্চলের অনেক সৈন্য শামিল ছিল। সুলতান তার সৈন্যদলের ঘাটতি এ অঞ্চল থেকেই পুরণ করতে চেষ্টা করতেন।
এখানকার জনসাধারণও সাধারণভাবে সুলতান আইয়ুবী সমর্থক। ছিল। কিন্তু এ অঞ্চলের শাসনকর্তা তার শাসন কার্যে কারো কর্তৃত্ব মেনে নিতে রাজি ছিলেন না।
তিনি স্বাধীনভাবে চলতে অভ্যস্ত ছিলেন এবং সুলতান আইয়ুবীকে মনে করতেন নিজের কর্তৃত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই তিনি সুলতান আইয়ুবীকে পছন্দ করতেন না। ফলে মুসলমান হয়েও তিনি খৃষ্টানদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব কায়েম রাখতে চেষ্টা করতেন।
রাতে সুলতান সেনাবাহিনীর উর্ধতন অফিসারদের নিয়ে বসলেন এবং তাদের জানালেন তিনি দাইয়ারে অভিযান চালাতে চান। সেনা কমাণ্ডাররা সবাই সুলতানের সাথে একমত পোষণ করলে তিনি তাদের বললেন, ‘তাহলে আমি আর এক মুহূর্তও কালনে করতে রাজি নই। তোমরা প্রস্তুত হও। আজ রাতেই আমর’ দাইয়ারে বেকারের দিকে রওনা হবো।’
শেষ রাত। সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনীকে দাইয়ারে বেকারের দিকে অভিযান চালানোর আদেশ দিলেন। সেনাপতিদের বললেন, ‘এটা হবে বিদ্যুৎ গতির এক অভিযান। আমরা এখানেও ঝটিকা আক্রমণ চালাবো এবং কোন রকম অবরোধে না গিয়ে সরাসরি আঘাত হেনে দাইয়ারে বেকারকে দখল করে নেবো।
দাইয়ারে বেকারের বর্তমান আমীর কোন রকম শর্ত আরোপ করতে চাইলেও সেদিকে কর্ণপাত করার দরকার নেই তোমাদের। তার কোন আবেদন বা শর্তই গ্রহণ করা হবে না।’
তিনি আরো বললেন, ‘তার প্রতি কোন রকম দয়া দেখানোরও দরকার নেই তোমাদের। সোজা আঘাত হানবে এবং তাকে, উৎখাত করবে।’
‘কিন্তু আপনি যেভাবে ইয়াজউদ্দিন ও শাহ আরমানের সাথে আচরণ করেছেন তাতে কিন্তু আমরা যথেষ্ট লাভবান হয়েছি। আমার মনে হয়, দাইয়ারে বেকারের আমীরের সাথেও একই রকম আচরণ করা যেতে পারে।’ এক সেনাপতি বললো।
সে আরো বললো, ‘তাতে করে তার সৈন্য বাহিনীকেও আমরা সহজেই নিজের বাহিনীর সাথে যুক্ত করে নিতে পারবো। তখন তাকে নাম মাত্র আমীর রাখলে সে আমাদের কিছুই করতে পারবে না।’
‘আমি এখন আর কোন সাপকে আস্তিনের ভেতর রেখে পালন করার পক্ষপাতি নই।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি সংবাদ পেয়েছি, এই ব্যক্তি তার এলাকা থেকে কোন লোককে আমার সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে দিচ্ছে না। সে প্রকাশ্যে বাগদাদের খেলাফতের অধীন প্রচার করলেও গোপনে খেলাফতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
সব সময় মনে রাখবে, কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা দাবী করা ও গোপনে গোপনে পৃথক হওয়ার ষড়যন্ত্র করা লোক জাতির গাদ্দার হয়। আর এ গাদ্দাররা খুবই ভয়ংকর হয়। তারা জাতির শত্রুদের থেকে সাহায্য কামনা করে এবং জাতির খেলাফতের বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করে।
আমি এ ধরনের লোকদের মাথা গুড়িয়ে দিতে চাই। যাতে যখন আমাদের আসল শত্রু খৃস্টান আমাদের সামনে আসবে তখন আমাদের পিঠে এইসব কাল সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে ছোবল মারতে না পারে।
দাইয়ারের বাকার আল্লাহর সৈনিকদের এলাকা। আমার সৈন্য বিভাগের এক চতুর্থাংশ সৈন্যই এ এলাকার লোক। যদি আমি এই গাদ্দার সরকারকে ক্ষমা করে দেই তবে এ এলাকার লোকদের ঈমান নষ্ট হতে থাকবে। সেই সাথে তাদের জেহাদী জযবাও নষ্ট হয়ে যাবে।’
তিনি আরো বললেন, ‘একটি দেশের বা কোন জাতির সমস্ত লোক গাদ্দার বা বেঈমান হয় না। বেঈমান হয় কতিপয় লোক, যারা শাসন ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত থাকে। এই শাসক গোষ্ঠী গাদ্দার হলে ক্ষতি হয় সমগ্র জাতির। মাত্র ক’জন লোকের জন্য নষ্ট হয়ে যায় জাতির গৌরব।
একটি গৌরবময় জাতি তখন তার সম্মান ও মর্যাদা হারিয়ে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। যখন তাদের মহৎ হওয়ার আবেগ ও প্রেরণা নষ্ট হয়ে যায়, তখন সে জাতি আর স্বাধীন ও মর্যাদাবান জাতি হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে না।
আমাদের মধ্যে এ ধরনের শাসক ও আমীরদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলে জাতি হিসাবে আমরা শেষ হয়ে যাবো। আজ খেলাফাতের কেন্দ্রীয় শাসন শীথিল হয়ে গেছে। যদি খেলাফাতের শাসন দৃঢ় ও অটুট থাকতো তবে আমাকে এভাবে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে হতো না।
এটা সৈনিকদের নৈতিক দায়িত্ব যে, তারা রাজ্যের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী, গাদ্দার ও অযোগ্য শাসককে প্রশ্রয় দেবে না। আমি আবারও তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যদি তোমরা এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হও তবে ইতিহাস বলবে, তোমরা ছিলে অকর্মন্য, অলস ও অথর্ব। তোমরা ইসলামী খেলাফত টিকিয়ে রাখতে পারোনি। পারোনি জাতির সম্মান ধরে রাখতে, পারোনি শক্রদের মুকাবেলা করতে।’
দাইয়ারে বাকার। আইয়ুবীর বাহিনী এত দ্রুত দাইয়ারে বাকারে আঘাত হানলো যে, ভেতরের সৈন্যরা তাদের গতি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবী সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, ‘আঘাত এলে অবশ্যই তার মোকাবেলা করবে কিন্তু অযথা রক্তক্ষয় করবে না। সব সময় খেয়াল রাখবে, বেসামরিক নাগরিকরা যেন ক্ষগ্রিস্ত না হয়।’
দাইয়ারে বাকারে সুলতানের নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী আগে থেকেই মজুত ছিল। তাদের মাধ্যমে সুলতান আইয়ুবী পূর্বেই জেনে নিয়েছিলেন কোথায় আছে শহরের সরকারী স্থাপনা, আর্মি হেড কোয়ার্টার এবং সরকারী গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলো।
তিনি দাইয়ারে বাকারে পৌঁছেই সেই সব জায়গায় মেনজানিক দিয়ে পাথর ও পেট্রোল বোম নিক্ষেপ করার আদেশ দিলেন যেখানে শুধু সেনা ছাউনি, সরকারী অফিস ও মহল ছিল।
মেনজানিক নিক্ষেপের ফাঁকে ফাঁকে তিনি সেনাপতিদের মাধ্যমে এই ঘোষণা প্রচার করতে লাগলেন, ‘শহরের আমীর, অস্ত্র সমর্পণ করে বাইরে চলে এসো নইলে শহর গুড়িয়ে দেয়। হবে।’
কিন্তু কেল্লার অধিপতি যেমন ছিল উচ্চাভিলাষী তেমনি ছিল একগুঁয়ে ও গোয়ারগোবিন্দ। তিনি অস্ত্র সমর্পন না করে প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘অস্ত্র সমর্পন করা হবে না। তোমরা পারলে যুদ্ধ করে শহর দখল করে নাও।’
সেনাপতির অনুপ্রেরণায় দাইয়ারে বাকারের সৈন্যরা প্রাণপণে যুদ্ধ করলো। সুলতান আইয়ুবী প্রতিরোধের ধরণ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। এতটা দৃঢ়তা তিনি আশা করেননি।
অবরোধ কর্মে নিপুন ও অভিজ্ঞ আইয়ুবী দাইয়ারে বাকারের সৈন্যদের প্রবল বাঁধা দেখে চিন্তায় পড়ে গেলেন। তার অভিজ্ঞতা তাকে বললো, এ অবরোধ দীর্ঘায়িত হবে এবং এ জন্য একটু বেশী কোরবানী দিতে হবে।
তিনি রাতের অন্ধকারে একদল সৈন্যকে শহরের দেয়াল ভাঙ্গার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। এই দলটি ছিল আকারে ক্ষুদ্র। মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক দূর দিয়ে এই বাহিনী শহরের মূল ফটকের উল্টো দিকে চলে গেল।
তারা পেছন দিকের দেয়াল ভেঙ্গে শহরে প্রবেশ করতে চাইলো। কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হলো। শহরের সৈন্যরা পাঁচিলের ওপর থেকে দেয়াল ভাঙ্গা বাহিনীর উপর অগ্নি-তীর ও ভারী পাথর বর্ষণ করতে লাগলো। বাধ্য হয়ে সেখান থেকে পিছু হটতে হলো ওদের।
এরপর আইয়ুবী বড় গেটের উপর মেনজানিক দিয়ে পেট্রোলের হাড়ি নিক্ষেপ শুরু করলেন। সলতেওয়ালা অগ্নি তীর বর্ষণ করায় দরজার কাঠের অংশ পুড়ে গেল। কিন্তু তার লোহার কাঠামোটি অক্ষতই রয়ে গেল।
কাঠ পুড়ে যাওয়ায় যেটুকু ফোঁকড় তৈরী হলো সেখান দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা কঠিন। তবুও আইয়ুবীর সৈন্যরা সেদিক দিয়ে বার কয়েক প্রবেশের চেষ্টা করলো।
তাদের এ চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। কারণ শহরের সৈন্যরা প্রতিবারই প্রবল তীর বর্ষণ করে ওদের তাড়িয়ে দিল।
সুলতান আইয়ুবী আশ্চর্য হলেন ভেতরের সৈন্যদের এমন মরণপণ লড়াই দেখে। এর রহস্য পরে জানা গেল। দাইয়ারে বাকারের আমীর অবরোধের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে ঘোষণা দিয়ে দিলেন, ‘খৃষ্টান সৈন্যরা শহর অবরোধ করেছে।’
এই ঘোষণা শোনার সাথে সাথে জনগণ ও সৈন্যদের মাঝে জেহাদী জযবা জেগে উঠে। তারা মরণপণ করে যুদ্ধ করার শপথ নিয়ে ময়দানে নেমে আসে।
ফলে সৈন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের সহযোগিতা করতে থাকে শহরের জনগণ। দেয়ালের উপর থেকে অবরোধকারীদের উপর তীর বর্ষণ চলতে থাকে অবিরাম।
শহরের চারদিকেই সৈন্যদের সাথে হাত মিলায় জনতা। ফলে সৈনিকদের উৎসাহ বেড়ে যায় বহুগুণ। সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা তীরের সাথে কাগজের টুকরো বেঁধে কৌশলে এই খবর জানিয়ে দেয় সুলতানকে।
শহরের জনতার এই উদ্দীপনার খবর পেয়ে সুলতান আইয়ুবী নিজের বাহিনীকে সংযত করে নেন। তিনি নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ রোধ করার জন্য যুদ্ধরত সৈন্যদের শহরে অগ্নিবর্ষণ বন্ধ করতে আদেশ দেন। ফলে অবরোধের সময় বেড়েই চললো।
অবরোধের আজ আট দিন। এক সপ্তাহ ধরে অবরোধ করেও সুবিধা করতে পারেননি আইয়ুবী। বরং বেশীর ভাগ ক্ষয় ক্ষতি সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদেরই হচ্ছিল। কারণ তারা সামনে অগ্রসর হলেই প্রতিপক্ষের তীর ছেকে ধরতো তাদের।
অষ্টম দিনে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা দুঃসাহসিক এক কাজ করে বসলো। এ কয়দিন সেও শহরের সৈন্যদের সাথে লড়াইতে অংশ নিয়ে তাদেরই একজন হয়ে উঠেছিল।
সে দেয়ালের উপর উঠে বাইরের সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো, “এরা খৃস্টান বাহিনী নয়, সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী!’ সে সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললো, “তাদের পতাকা দেখো, ওই যে ইসলামী নিশান উড়ছে?’
পাঁচিলের ওপর দাঁড়ানো সৈনিকরা গভীর আগ্রহ ও কৌতুহল নিয়ে তাকালো সেদিকে। সত্যি তো, এ যে আইয়ুবীর বাহিনী!
সে উপস্থিত সৈন্যদের লক্ষ্য করে বললো, ‘মুসলমান বন্ধুগণ! আমরা এতদিন আপোষে লড়াই করেছি। ওদের কাছে আসতে দাও। ওরা কি বলতে চায় শুনি।’
সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা এরপর আবার এগুলে পাঁচিলের ওপর থেকে তাদের ওপর তীর বর্ষণ না করে তাদের কাছে আসতে দিল। তারা নিকটবর্তী হলে এক সৈনিক চেঁচিয়ে বললো, ‘তোমরা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈনিক? তোমরা এখানে কি জন্য এসেছো, কি চাও তোমরা?’
এই এলাকার যেসব সৈন্য সুলতানের বাহিনীতে ছিল তারা এ প্রশ্নের জবাবে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো, ‘হ্যাঁ, আমরা সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য। আমরা তোমাদেরই সন্তান, তোমাদের ভাই।’
তারা চিৎকার করে বললো, ‘তোমাদের আমীর খৃস্টানদের সাথে হাত মিলিয়েছে। সুলতান আইয়ুবী নিজে এই গাদ্দারকে শায়েস্তা করতে এসেছেন। দয়া করে দরজা খুলে দাও। আমরা যুদ্ধ করেই কেল্লা দখল করতে পারতাম। কিন্তু তোমাদের জানমালের ক্ষতি হবে বলে সুলতান আমাদেরকে চরম আঘাত হানার অনুমতি দিচ্ছে না।’
এ ঘটনায় যুদ্ধের মোড় পুরোপুরি পাল্টে গেল। সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা এ কয়দিন ধরে গোপনে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে লোকদের বুঝাতে চেষ্টা করছিল, আক্রমণকারীরা খৃষ্টান নয়, মুসলমান।
তারা জনসাধারণকেও বলতে চাচ্ছিল, এরা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যবাহিনী। কিন্তু গোয়েন্দাদের পক্ষে প্রকাশ্যে এ কথা বলা সম্ভব ছিল না। এতে তাদের জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু নতুন এই বুদ্ধি তাদের সাফল্য এনে দেয়।
এ ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর শহরের লোকদের, এমনকি সৈন্যদেরও চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন দেখা দেয়। তারা দাইয়ারে বাকারের আমীর ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের শাসানি ও ধমক অগ্রাহ্য করে শহরের দরজা খুলে দিল। সুলতান আইয়ুবী শহরে স্বসৈন্যে প্রবেশ করলেন।
শহরের জনতা অধীর আগ্রহে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানালো। শহরের মহিলারা জানালা ও ছাদের উপর থেকে তাদের রুমাল নেড়ে ও ফুল ছুড়ে সম্বর্ধনা জানালো আইয়ুবীকে।
সুলতান আইয়ুবী দাইয়ারে বাকারের আমীরকে তার সাঙ্গ পাঙ্গসহ শহর ছেড়ে চলে যেতে বললেন। দাইয়ারে বাকারের আমীর তাকে হত্যা না করে এভাবে ছেড়ে দেয়ায় নিজেই বিস্মিত হয়ে গেলেন। ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে দাইয়ারে বাকার ত্যাগ করলেন তিনি। সুলতান আইয়ুবী তার স্থলে নুরুদ্দিন ইবনে কারা আরসালানকে দাইয়ারে বাকারের নতুন আমীর নিয়োেগ করলেন।
এই নূরুদ্দিন ছিলেন মরহুম নুরুদ্দিন জঙ্গীর বংশের লোক। সুলতান তাকে বললেন, ‘জরুরীভাবে এই এলাকা থেকে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করো।’
সুলতান আইয়ুবী দাইয়ারে বাকারের সমস্ত সৈন্য নিজের সৈন্য বাহিনীর মধ্যে শামিল করে নিয়ে বললেন, ‘ওদের আমি নিয়ে গেলাম। নতুন সৈন্য ভর্তি করে ওদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। তোমার এলাকার হেফাজতের জন্য তারাই যথেষ্ট হবে। আমি সৈন্যদের প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকজন দক্ষ প্রশিক্ষক রেখে যাচ্ছি।’
১১৮৩ সালের মে মাস। সুলতান আইয়ুবী দাইয়ারে বাকার এলাকাকে তার অধীনস্ত প্রদেশ ঘোষণা করে পরবর্তী অভিযান চালালেন হলবের দিকে।
ততোদিনে হলব ও মুশেল ছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমস্ত আমীর ও কেল্লা প্রধানরা আইয়ুবীর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। হলবের আমীর ইমাদুদ্দিন ও মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিন তখনো দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে পড়ে নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারছিল না।
একদিকে আইয়ুবীর ভয় তাদের বলছিল, এখনো সময় আছে, গাদ্দারীর পথ ছেড়ে আইয়ুবীর বশ্যতা মেনে নাও। আবার ক্ষমতার মোহ ও খৃস্টানদের আশ্বাস বলছিল, যতক্ষণ খৃষ্টানদের বিশাল বাহিনী তোমাদের পাশে থাকবে ততোক্ষণ নিজের ক্ষমতার মোহ তোমরা ত্যাগ করতে পারো না।
সুলতান মনে মনে ভেবে দেখলেন, এই দুই কালসাপকে এবার উচিত শিক্ষা দেয়ার সময় এসেছে।
বিজয় লাভের পর মানুষের চেহারায় আনন্দের দ্যুতি খেলা করাটাই স্বাভাবিক। সুলতান আইয়ুবীও কোন যুদ্ধে বা অবরোধে জয়লাভ করলে তার চেহারায় ফুটে উঠতো আনন্দের আভা। তার সৈন্যদের মাঝেও দেখা যেতো উৎসব মুখরতা।
সৈন্যরা খুশীতে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরতো। আয়োজন করা হতো নানা রকম অনুষ্ঠান। সৈন্যরা সেখানে জেহাদী গান গাইতো। শারিরীক কসরত ও কৌশল দেখাতো। খাসি, দুম্বা ও উট জবেহ করে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হতো।
সৈন্যরা স্বেচ্ছায় গিয়ে সে রান্নায় নিজেরা হাত লাগাতো। তারপর যখন সৈন্যরা সে খাবার তৃপ্তি সহকারে খেতে বসতে সুলতান আইয়ুবী ঘুরে ঘুরে তা তদারক করতেন। কখনো অংশ নিতেন পরিবেশনায়। সৈন্যদের পাতে এটা ওটা তুলে দিতেন। কারো কিছু লাগবে কিনা খোঁজখবর নিতেন। এতে সৈন্যদের আনন্দ যেনো দ্বিগুণ হয়ে যেতো।
কিন্তু ১১৮৩ সালের উপর্যুপরি সাফল্যে সুলতানের মুখে কোন আনন্দের আভাস দেখা গেল না। এই এক বছরে তিনি অনেকগুলো কেল্লা ও এলাকায় অভিযান চালিয়েছেন। প্রতিটি অভিযান থেকেই তিনি বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। শাহ আরমানের মত পরাক্রমশালী শাসককে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য করেছেন। বাধ্য করেছেন তাকে লিখিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বশ্যতা স্বীকার করতে।
ঐতিহাসিকরা এই সময়টাকে সুলতান আইয়ুবীর বিজয়ের যুগ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু তার আবেগ ও প্রেরণায় এই বিজয়ের কোন প্রভাব পাওয়া যেতো না।
বরং প্রতিটি বিজয়ের পর তার চেহারায় আনন্দের পরিবর্তে দেখা দিত বিমর্ষতার ছাপ। উদাসীনতায় মলিন হয়ে যেতো তাঁর পৌরুষদীপ্ত চেহারা। তিনি এর একটাকেও সফলতা বলে মনে করতে পারতেন না। কমাণ্ডো বাহিনীর সেনাপতি সালেম মিশরী কখনো বিজয়ীর ভঙ্গিতে সুলতানকে রিপোর্ট দিতেন, গতরাতে আমাদের কমাণ্ডো সৈন্যরা অমুক স্থানে হামলা চালিয়ে শত্রুদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে।
সুলতান আইয়ুবী রিপোর্ট শুনে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে তার সন্তোষ প্রকাশ করতেন। কিন্তু দেখা যেতো পরক্ষণেই তাঁর চেহারা দুশ্চিন্তা ও বিমর্ষতায় ছেয়ে গেছে। মনে হতো তার অন্তরে বেদনারা কিলবিল করছে। তিনি এমন কষ্ট পাচ্ছেন যা তিনি সহ্য করতে পারছেন না।
একদিন তিনি সালেম মিশরীকে বললেন, ‘সালেম, এভাবে ভাইদের ওপর বিজয়ী হওয়ার খবর তুমি আর কত শোনাবে আমাকে? আমি তো তোমার কাছ থেকে সেই সুসংবাদ শুনতে চাই, তোমরা তোমাদের দুশমন খৃষ্টানদের পরাজিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করে এসেছে।
দাইয়ারে বাকার বিজয়ের পর সেই এলাকার জনগণ সুলতান আইয়ুবীকে মোবারকবাদ জানাতে এলে তাঁর চোখ অশ্রুতে ভরে উঠলো। অনেক কষ্টে তিনি তার চোখের অশ্রু সংবরণ করলেন। জনতা বিদায় নিলে তিনি তার এক সেনাপতিকে বললেন, ‘তোমরা কেন এ কথা অনুভব করতে পারছে না, তোমরা ঘর থেকে বেরিয়েছিলে খৃষ্টানদের পরাজিত করতে এবং তাদেরকে আমাদের দেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করতে। কিন্তু এ কয়টি বছর তোমরা শুধু তোমাদের ভাইদের সাথেই যুদ্ধ করছে।
এখন তোমরা হিসাব করে দেখো, শত্রুর রক্ত ঝরানোর পরিবর্তে আমরা এ যাবত একে অন্যের কত রক্ত ঝরিয়েছি? একে তোমরা বিজয় বলো? আমাদের এই গৃহযুদ্ধে যে-ই সফলতা লাভ করুক, সে বিজয় খৃস্টানদের। যখন দুই ভাইয়ের মধ্যে মারামারি ও লড়াই হয় তখন তা দেখে খুশী হয় শক্ররা। সাফল্য যেটুকু তার সবটুকুই জমা হয় শত্রুর ভাণ্ডারে। এটাকে আমি সফলতা বা বিজয় বলতে পারি না যেগুলো আমি আমার মুসলমান ভাইদের থেকে লাভ করেছি।’
‘খৃষ্টানরাও কম শিক্ষা পায়নি। এক সেনাপতি বললো, ‘এরপর আমরা তাদেরও পরাজিত করে দেখাবো ইনশাআল্লাহ।’
‘কবে, আর কেমন করে? নিজেরা নিজেরা মারামারি করে?’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যুদ্ধের প্রথম নিয়মটা কি? সৈন্যদের সামরিক শক্তি ধ্বংস করা। খৃস্টানরা আমাদের সামরিক শক্তি আমাদের ভাইদের দিয়েই ধ্বংস করতে চেষ্টা চালাচ্ছে।’
তিনি কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করে শেষ হয়ে যাচ্ছি। খৃষ্টানরা আমাদের এই অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।’
সুলতান আইয়ুবী আরো বললেন, ‘নিজেদের দুর্গ থেকে বের হয়ে যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন আছে তাদের? তারা তো দূর্গ থেকে বের না হয়েই আমাদের শক্তি দুর্বল করতে পারছে! ফিলিস্তিনের উপরও তাদের অধিকার ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে।’
এ প্রশ্নের কোন উত্তর ছিল না অফিসারের কাছে। তিনি চুপ করে রইলেন। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘শাসন ক্ষমতা সর্বদা আল্লাহর হাতে। কিন্তু ক্ষমতার নেশা যখন মানুষের উপর চেপে বসে তখন ধর্ম ও জাতির সম্মান তো দূরের কথা, সে তার যুবতী মেয়ের ইজ্জতও বিকিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। মিথ্যা ও প্রতারণাকে সে বৈধ বা জায়েজ করে নেয়।
তাইতো আজ খৃস্টানরা রাসুল (সা.)-এর মিল্লাতকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। এর মোকাবেলায় আমরা কি করছি? কি করতে পারছি।’
এক সেনাপতি বললো, ‘এই এলাকা থেকে সৈন্য ভর্তি বেশ ভালই চলছে। এখানকার যুবকরা স্বত:স্ফুর্তভাবেই সৈনিকের খাতায় নাম লেখাচ্ছে।’
‘কিন্তু এতে আমার কোন আনন্দ নেই।’ সুলতান আইয়ুবী সকলকে বিস্মিত করে বললেন, ‘এসব লোকেরা হয়তো আমাদের দলে শুধু এ জন্যই ভর্তি হচ্ছে যে, আমাদের সৈন্য বাহিনী যে শহর দখল করবে সেখানে তারা লুটতরাজ করতে পারবে। তাদের কেউ কেউ হয়তো নারীর ইজ্জত নিয়েও টানাটানি করতে চাইবে।’
‘আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে এমন লুটপাট ও অপকর্মের কোন প্রশ্রয় কখনও দেই না।’ সেনাপতি বললো, ‘আপনার বাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোেগ স্রেফ শত্রুদের মিথ্যা প্রচারণা। তারা আমাদের সেনাবাহিনীর সুনাম নষ্ট করার জন্য এমন প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।’
‘কিন্তু তারা কি বলছে? তারা বলছে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যরা লুটতরাজ করে এবং বিজিত এলাকার যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়।’
‘শত্রুরা আমাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন কুৎসা রটিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মুসলমান জনগণের কাছে ইসলামী সৈন্যদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যই এ অপপ্রয়াস চালাচ্ছে তারা। যাতে তাদের মনে আমাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জন্মে, যাতে আমরা জনগণের সমর্থন না পাই, সহযোগিতা না পাই।’
সুলতান বললেন, ‘এ কাজে কি তারা সফলতা পায়নি? আমরা যে শহর ও কেল্লা অধিকার করি সেখানকার সিপাই ও জনসাধারণ সবাই মুসলমান। তারপরও তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। অথচ আমাদের বাহিনী লড়াই করছে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য, আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ায় বিজয়ী করার জন্য। অথচ এদের যারা মোকাবেলা করছে তারাও মুসলমান।’
সুলতান আরো বললেন, ‘হে আমার বন্ধুরা! তোমরা শত্রুদের চিনে রাখো। তোমাদের শত্রুরা খুবই হুশিয়ার। তারা আমাদের সেনাবাহিনীকে জনগণের কাছে ঘৃণিত ও হেয় করার পথ বেছে নিয়েছে।
আল্লাহ তার কোরআনে মুসলিম মিল্লাতকে শিশা ঢালা প্রাচীরের মত অটুট থাকতে বলেছেন। জনগণ ও সেনাবাহিনীর মিলিত ঐক্যই এ শক্তি সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রাচীরে ফুটো করার পদ্ধতি হলো, জাতির কাছে ইসলামী শক্তিকে অযোগ্য, কাপুরুষ, ব্যভিচারী ও খুনী প্রমাণ করা। শত্রুরা এখন তাই করছে।’
‘কিন্তু দাইয়ারে বাকারের লোকদের মাঝে এমন কোন প্রভাব তো দেখলাম না।’ সালেম মিশরী বললো, ‘তারা যখনই জানতে পারলো, ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ বাহিনী তাদের শহর অবরোধ করেছে এবং তাদের সরকার তাদেরকে দিয়ে সেই ইসলামী বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করাচ্ছে, তখনই শহরের সিপাহী জনতা শহরের গেট খুলে দিল।’
‘ওখানে আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ গোয়েন্দা ও সমর্থক ছিল।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘সেখানকার সব বড় বড় মসজিদগুলোর ইমাম আমাদের লোক। সেখানে তারা শুধু নামাজ, রোজা, হজ্জ ও জাকাতই শিক্ষা দেন না, সেখানে তারা খৃষ্টানদের পরিকল্পনা ও বেঈমান শাসকদের সম্পর্কেও ওয়াজ করে থাকেন।
তারা জনগণকে এ সত্য বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের রক্ত প্রবাহিত করলে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। আল্লাহ সেই জনপদে তার গযব নাজিল করেন যেখানে মুসলমানরা পরস্পর যুদ্ধ ও খুন খারাবী করে।
তোমরা জানো না, দাইয়ারে বাকারে খৃষ্টান গোয়েন্দারাও দরবেশ, সুফি ও আলেমের ছদ্মবেশে আছে। তারা মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেও আমাদের আলেমদের সাথে তারা কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
আমাদের গোয়েন্দারাও গোপনে ও সুকৌশলে তাদের আওয়াজ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আমরা এখন যে এলাকায় যাচ্ছি সেখানে খৃস্টান ষড়যন্ত্রকারীদের প্রভাবই বেশী এবং তারা সেখানকার জনগণকে এরই মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে।’
এক সেনাপতি সুলতানকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আপনি বলেছেন, এখানকার যুবকরা লুটপাটের আশায় সেনাবাহিনীতে ভর্তি হচ্ছে। যদি তাই হয়, তবে এরা কি সমস্ত সেনাবাহিনীকেই খারাপ করে ফেলবে না?’
‘তুমি কি দেখছো না তাদের কি ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে?’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি তোমাকে প্রশিক্ষণ ও রণ কৌশলের যে নতুন পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছি তাতে তাদের চিন্তা চেতনা সঠিক পথেই ফিরে আসবে বলে আশা করছি। আমি তাদের এমনভাবে সৈন্য বিভাগে বিন্যস্ত করার ব্যবস্থা করেছি যে, ওরা সৈন্যদের উপর নয় বরং সৈন্যরাই তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে।’
তিনি আরো বললেন, ‘তুমি শীঘ্রই আমার লিখিত আদেশ পেয়ে যাবে। বিজিত অঞ্চলে আমাদের কোন সোনা লুটপাট করলে বা কোন নারীর প্রতি অশালীন আচরণ করলে তাকে সোজা তীরের নিশানা বানিয়ে নেবে। আর যদি তাকে হাতের কাছে পাও তবে তলোয়ার দিয়ে তার মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে ফেলবে। শত্রুদের ভিত্তিহীন দোষারোপ এভাবেই মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে।
বিজিতদের সাথে সেনাবাহিনীর আচরণ হবে আপনজনদের মত। আন্তরিকতা দিয়েই আমরা ওদের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করবো। মনে রেখো, খৃষ্টান ও ইহুদীরা প্রত্যেক যুগে ইসলামী শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য সচেষ্ট থাকবে। তারা মুসলিম জাতির মধ্যে ব্যবধান ও ঘৃণা সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। মুসলমানদের ঈমানী শক্তি ও জাতীয় প্রেরণা ধ্বংস করার জন্য তারা মুসলমানদেরই ব্যবহার করবে।’
সুলতান আইয়ুবী এখন ফোরাত নদীর কুলে ক্যাম্প করে বসে আছেন। এরই মধ্যে তিনি ছোট ছোট মুসলমান রাজ্যের শাসকদের তাবেদার বানিয়ে নিয়েছেন এবং বহু কেল্লার উপর আধিপত্য বিস্তার করেছেন। এরা সেই মুসলমান শাসক যারা গোপনে খৃস্টানদের বন্ধু ও সুলতান আইয়ুবীর বিরোধী ছিল।
সুলতান আইয়ুবীর দু’চোখে তখনো ভাসছে বায়তুল মুকাদ্দাস। যার উপর আজো আধিপত্য বিস্তার করে আছে খৃষ্টানরা। মুসলমানদের প্রথম কেবলা মসজিদুল আকসা উদ্ধারে অভিযান পরিচালনার পথে যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার অনেকটাই আজ অপসারিত হয়েছে।
বড় ধরনের অভিযান চালানোর আগে সৈন্যদের একটু বিশ্রাম দেয়া প্রয়োজন। সুলতান আইয়ুবী সে জন্যই ফোরাত নদীর কুলে ক্যাম্প করেছেন। তবে তিনি বসে থাকার লোক নন। এই অবসরে তিনি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন। ঘোড়া ও উটের খোরাক এবং রসদপত্রের ঘাটতি পূরণ করাই হচ্ছে এই প্রস্তুতির মূল কাজ। প্রস্তুতি শেষ হলেই তিনি তাঁর চুড়ান্ত টার্গেট মসজিদুল আকসা উদ্ধার অভিযানে পড়বেন। কিন্তু কখন? সৈন্য ও সেনাপতিরা তারই প্রতীক্ষা করতে লাগলো।
সমাপ্ত