» » ভণ্ডপীর

বর্ণাকার

হাসান অজ্ঞান রায়াদীকে কাঁধে তুলে নিল। তারপর প্রাণপণে দৌড় দিল গুহার মুখের দিকে। গুহার ভেতর তখন প্রলয় চলছে। ভীষণ শব্দ করে ফাটছে তেলের ড্রাম ও হাড়ি।

এক ড্রাম থেকে আরেক ড্রামে এক হাড়ি থেকে আরেক হাড়িতে ছুটছে আগুন। মাটির মটকা ও হাড়িগুলো ভীষণ শব্দে ফাটছে আর তাতে কেঁপে উঠছে মাটি ও পাহাড়। হাজার হাজার মন পেট্রোলের মটকা ও হাড়ি যখন একই সঙ্গে ফাটতে লাগলো তখন গুহায় মাটি ও পাথর খসে খসে পড়তে লাগলো তার ওপর। খৃষ্টানদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, তাঁবু ও খাদ্য সামগ্রী তাতে পুড়ে ভষ্ম হয়ে গেল।

বোমার মত বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো মুশেল শহরও। মুশেলবাসীদের মনে সৃষ্টি হলো অজানা আতংক। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল গুহার মুখ। ভাগ্যিস রায়াদীকে কাঁধে নিয়ে হাসান ইদরিস ততোক্ষণে বেরিয়ে এসেছিল গুহা থেকে।

নিষিদ্ধ এলাকার বাইরে যাওয়ার গোপন পথ জানা ছিল হাসানের। সে রায়াদীকে কাঁধে নিয়েই ছুটলো। ইচ্ছে, এই অভিশপ্ত পাহাড়ের ধ্বংসের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালানো। ফলে পেছনে কি ঘটছে না ঘটছে দেখার সুযোগ রইলো না তার। সে ছুটছে তো ছুটছেই।

শহরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারলো না হাসান। কারণ শহরের দরজা তখন বন্ধ। সে মুশেল শহরকে পাশ কাটিয়ে ছুটলো নসিবার দিকে।

এক সময় তারা বিপদসীমা অতিক্রম করে গেলো। তখনো তার কাঁধে চেপে আছে রায়াদী। একজন সোমত্ত মেয়েকে কাঁধে নিয়ে এত দূর দৌড়ে এসে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়লো হাসান ইদরিস। সে রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর রায়াদীকে মাটিতে শুইয়ে দিল।

রায়াদী ফিস্ ফিস্ করে কি যেন বলছিল। হাসান মাটিতে বসে পড়ে কান পাতলো সেদিকে। রায়াদী তখন বলছে, ‘আগুন! আমাকে পবিত্র করে দিয়েছে!’

আকাশে ততোক্ষণে চাঁদ উঠেছে। সেই আলোয় সে রায়াদীর চেহারায় দৃষ্টি ফেললো। তার মনে হলো সে হাসছে এবং স্বপ্নের ঘোরে বিড় বিড় করে বলছে, ‘হেজাযের দিকে চলেছে কাফেলা, সেখানে গিয়ে আমার বিয়ে হবে।’

‘রায়াদী! রায়াদী!’ হাসান ইদরিস তাকে ডাকলো।

‘আল্লাহ আমার গোনাহ ক্ষমা করেছেন তো?’ রায়াদী চোখ খুলে জিজ্ঞেস করলো।

হাসান ইদরিস বললো, “রায়াদী, তুমি ঠিক আছে তো? আল্লাহর হাজার শোকর যে তোমার জ্ঞান ফিরে এসেছে।’

রায়াদী উঠে বসলো এবং তার বাহু সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, “দেখো! দেখো! সে যাচ্ছে। দেখো, হেজাযের কাফেলা যাচ্ছে। আমিও যাবো তাদের সাথে।

রায়াদী একদিকে ঢলে পড়লো। হাসান ইদরিস তার বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে ডাকলো, ‘রায়াদী! রায়াদী!’

কিন্তু রায়াদীর সময় তখন ফুরিয়ে গেছে। তার নাড়ীর স্পন্দন থেমে গেল। রায়াদীর আত্মা দেহের খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিল হেজাযের কাফেলার সাথে।

হাসান ইদরিস বালি খুঁড়ে কবর খোদাই করলো রায়াদীর জন্য। সকাল হওয়ার আগেই রায়াদীর শরীরের মাপে সে আড়াই ফুট গভীর এক গর্ত খনন করে সেই গর্তে শুইয়ে দিল রায়াদীকে এবং তাকে মাটি চাপা দিয়ে আবার পথে নামলো।

কয়েকদিন পর।

সুলতান আইয়ুবী একদিন সংবাদ পেলেন, খৃষ্টানদের সামরিক সম্ভার ও রসদপত্র সব ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি তখন আল খালিদের দিকে অভিযান চালাচ্ছিলেন।

আল খালিদ একটা বড় রাজ্য। এর শাসক ছিলেন শাহ আরমান।

সুলতান একদিন খবর পেলেন আল খালিদের শাসক শাহ আরমান মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনকে হারজাম নামক স্থানে দাওয়াত দিয়েছেন। তাদের এ সাক্ষাতের উদ্দেশ্য, সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় পরস্পরকে সাহায্য করার সন্ধিচুক্তি করা।

সুলতান আইয়ুবী এ সংবাদ জানতে পেরে আল খালিদে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি যখন আল খালিদ অবরোধ করার জন্য অভিযান নিয়ে যাচ্ছেন তখনই তিনি পথিমধ্যে খবর পেলেন, খৃস্টানদের সমুদয় সামরিক রসদ সম্ভার ধ্বংস হয়ে গেছে।

খৃষ্টানদের জন্য এ আঘাত ছিল বড় মর্মান্তিক ও মারাত্মক। তাদের পরিকল্পনা ছিল, মুসলমানদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কোন পাহাড়ের গুহায় বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তোলা যাতে লড়াইয়ের সময় সেখান থেকে আশাতীত সাহায্য পাওয়া যায়।

এ জন্য তারা অনেক খুঁজে এ পাহাড়ের গুহাটি আবিস্কার করে। তারপর তাদের অনুগত এক আলেমকে দরবেশ সাজিয়ে ওখানে প্রেরণ করে পরিবেশ তৈরীর জন্য। এরপর তারা গোপনে সেখানে এনে অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের যাবতীয় রসদ সম্ভার জমা করতে থাকে।

তারা এই গহ্বরে এত অধিক সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র, জ্বালানী ও পেট্রোলের মটকা লুকিয়ে রেখেছিল, যা দিয়ে আশপাশের সমস্ত মুসলিম রাজ্যগুলোর কেল্লা ও সেনানিবাস ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা সম্ভব ছিল।

ইয়াজউদ্দিন এখন সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে খৃস্টান বাহিনীর আগমনের অপেক্ষা করছিল। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর দরবেশ পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। কথা ছিল খৃস্টান বাহিনী এলে তিনি মুশেলের সৈন্য বাহিনীকে অভিযানের ইঙ্গিত দেবেন।

খৃস্টানদের পরিকল্পনা ছিল, ইয়াজউদ্দিন অভিযানে বেরোলে তাদের সহায়তা করবে খৃস্টান বাহিনী। যুদ্ধ পরিচালিত হবে ইয়াজউদ্দিনের নামে কিন্তু মূল যুদ্ধ করবে খৃস্টানরা। এদিকে ইয়াজউদ্দিন মুশেল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর তার রাজধানী পাহারা দেয়ার নাম করে মুশেলে থেকে যাবে খৃস্টান বাহিনীর একটা অংশ এবং তখন থেকে তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে মুশেল। ইয়াজউদ্দিন একবার বেরিয়ে যাওয়ার পর আর কোন দিন যেন সে মুশেল প্রবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করবে এই বাহিনী।

কিন্তু খৃস্টানদের সমস্ত পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেল। আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা তাদের সমস্ত রসদ সামগ্রী ধ্বংস করে দিয়েছে। যেহেতু এসব যুদ্ধাস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম পাহাড়ের গভীরে বিশাল ও প্রশস্ত গহবরে সঞ্চিত ও রক্ষিত ছিল সে জন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না সে রাতে পাহাড়ে কি ঘটেছে। বিস্ফোরণের ফলে দূর দূরান্ত পর্যন্ত মাটি কেঁপে উঠেছে। বিকট আওয়াজে ভূকম্পন হয়েছে। মানুষ ভেবেছে, বড় রকমের ভূমিকম্প ঘটে গেছে পাহাড় ও সন্নিহিত এলাকায়।

এতে সবচেয়ে বেশী ক্ষগ্রিস্ত হয়েছে খৃস্টানরা। তারা কাউকে বলতেও পারছে না তাদের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। কারণ পুরো ব্যাপারটাই ছিল গোপন। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুশেলের শাসক ইয়াজউদ্দিন। তিনি জানতেন, তার সবচেয়ে বড় বন্ধু খৃস্টানরা তাকে সহায়তা করার জন্য পাহাড়ে অস্ত্রের মজুত গড়ে তুলছে। এ অস্ত্র আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়াইতে তার কাজে আসবে। কিন্তু তিনি জানতেন না, কি পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা বারুদ খৃস্টানরা ওখানে জমা করেছে।

এই ঘটনায় ইয়াজউদ্দিনের কোমর ভেঙে গেল। খৃস্টানদের সাথে তার যে চুক্তি হয়েছিল এ ঘটনার পরও তারা তাকে সেই সহায়তা দেবে কিনা তা অনিশ্চিত হয়ে পড়লো। ফলে জোটের বন্ধন শিথিল হয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যে গোপন চুক্তি ছিল খৃস্টানদের সাথে তা যদি তারা রক্ষা না করে তবে ইয়াজউদ্দিনের পায়ের তলে আর মাটি থাকে না।

এদিকে খৃস্টানদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারাই এ কাজ করেছে। কিন্তু তারা ভেবে পেলো না, এত গোপনীয়তার পরও সুলতানের গোয়েন্দারা এই অস্ত্রভাণ্ডারের খবর পেলো কেমন করে আর তাতে অভিযানইবা চালালো কি করে? তারা স্বপ্নেও ভাবেনি, এমন আকস্মিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে তারা। কিন্তু আল্লাহ যখন কারো সাহায্যকারী হয়ে যান তখন অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটতে পারে।

কিন্তু আল্লাহ তাদেরই সাহায্য করেন যারা জানপ্রাণ দিয়ে তার পথে লড়াই করে। হাসান ইদরিস যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুশমনের আস্তানায় প্রবেশ করেছিল তখনো সে জানতো না, কিভাবে এই ঘাঁটি সে ধ্বংস করবে। কিন্তু তার চেষ্টা ও প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করে নিলেন। তাকে সহায়তা করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন রায়াদী নামের এক অসহায় নারীকে। আর একটি মাত্র মেয়ের সহযোগিতা নিয়ে হাসান ইদরিস এক অসম্ভবকে সম্ভবু করে তুললো। বরং বলা চলে, এক অসহায় নারী জীবন দিয়ে খৃস্টানদের অস্ত্রগার ও রসদভাণ্ডার ধ্বংস করে দিল।

মানুষকে ওই এলাকা থেকে দূরে রাখার জন্য যে দরবেশকে ওরা ব্যবহার করছিল হাতিয়ার হিসাবে, জাতির সাথে গাদ্দারী করার শাস্তিও সে পেয়ে গেল সাথে সাথেই।

এই দরবেশ লোকদের বলেছিল, এই পাহাড়ের উপর বসে আমি মুশেলবাসীর জন্য প্রার্থনা করবো। আমি খোদার ইশারায় মুশেলের বাহিনীকে জানাবো অভিযানের সময়। আমার ইশারা মেনে নিলে মুশেলবাসীর বিজয় সূচিত হবে। তারা যে পথ দিয়ে যাবে সে পথই তাদের পদচুম্বন করবে। ইয়াজউদ্দিনের রাজ্য দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।’ কিন্তু দরবেশের সে আশা আর পূরণ হলো না। খোদার ইশারা পাওয়ার আগেই খোদার গজব এসে তাকে পাহাড়ের সাথে মিশিয়ে দিল।

পরবর্তী দিনগুলো ছিল মুশেলবাসীর জন্য ভয়ানক আতংকের কিন্তু এ কথা বুঝানোর কেউ ছিল না যে, রাতের বিস্ফোরণ ও ভূকম্পনের কারণ কি ছিল।

এই বিস্ফোরণ এরপর পরবর্তী বেশ কিছু দিন থেকে থেকে ছোট ছোট বিস্ফোরণ চলতেই থাকলো। পাহাড় থেকে কালো ধোঁয়া সোজা উঠে যেতো আকাশে। অনেক দূর থেকেও মানুষ সে ধোঁয়া দেখতে পেতো।

এর কারণ ছিল পাহাড় ধ্বসের কারণে জায়গায় জায়গায় আটকা পরে থাকা আগুন জ্বালানোর পেট্রোল। ফলে সব জায়গায় একই সাথে পৌঁছতে পারেনি আগুণ।

যখনই নতুন করে গোলাবারুদে আগুন লাগতো তখনই বিস্ফোরণ ঘটতো। তার সঙ্গে পুড়তো গুহার মধ্যে রাখা আসবাবপত্র, পুড়তো জমানো খাদ্যভাণ্ডার। ফলে ভয়ে ও অাতংকে সেদিকে যেতে কেউ সাহস পেতো না।

লোকজনের মনে পড়তো দরবেশের কথা। তারা সেই দরবেশকে ভণ্ড ভেবে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করার জন্য আফসোস করতে লাগলো। দরবেশের কেরামতি তাদের জন্য কল্যাণ নয়, বয়ে এনেছিল অভিশাপ। মুশেলবাসীর মনে তখন আতংক আর বেদনা।

এ অবস্থায় তারা একদিন শুনতে পেলো নতুন এক বাণী, ‘ভণ্ড পীর জাহান্নামের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সে ধ্বংস হয়েছে তার নিজের গড়া জাহান্নামের আগুনে।’

এ বাণী যিনি উচ্চারণ করছিলেন বেশভূষায় তিনিও এক দরবেশের মত। তার পরণে সবুজ রংয়ের জোব্বা। মাথার বাবড়ি চুল সবগুলোই সাদা। দাড়িও সাদা এবং লম্বা। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। লোকটির এক হাতে লম্বা লাঠি অন্য হাতে কোরআন।

তিনিও আগের দরবেশের মতই হঠাৎ করে উদয় হলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, তাকেও আল্লাহ পাঠিয়েছেন এবং তিনিও আকাশ থেকে ইশারা পাবেন।

নতুন দরবেশের আগমনে মানুষ ভয়ে যেন এতটুকু হয়ে গেল। তারা আবার দরবেশের ফাঁদে পা দেবে কিনা ভাবতে লাগলো। দরবেশ হাটে বাজারে বিভিন্ন সমাগমে ঘুরে ঘুরে বলতে লাগলো, ভণ্ড পীর জাহান্নামের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সে ধ্বংস হয়েছে তার নিজের গড়া জাহান্নামের আগুনে।’

লোকজন একজন দু’জন করে ভয়ে ভয়ে জমা হতে লাগলো তার পাশে। তিনি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সে জাহান্নামের আগুনকে ভয় করো, যা আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে। ভণ্ড লোকের পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো! ঐ কালো ধোঁয়া দেখো, আল্লাহর অভিশাপকে ভয় করো। এই কিতাবের কথা মানো, যে কিতাব আমার হাতে আছে। এটা আল্লাহর বাণী, এটা পবিত্র কোরআন!

কোন পীর দরবেশ তোমাদের মুক্তি দিতে পারবে না। তোমাদের মুক্তি সনদ এই কোরআন। কোরআনকে মানো, কোরআন তোমাদের সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে। তোমাদের ইহ ও পরকালীন কল্যাণের জামিন এই কোরআন। তোমরা কোরআন ছেড়ে মানুষের কাছে তোমাদের ভাগ্য তুলে দিয়েছিলে। তাই এই বিপর্যয় তোমাদের ঘিরে ধরেছে। এখনো সময় আছে, সাবধান হও। বাঁচতে হলে কোরআনের ছায়াতলে আশ্রয় নাও।’

‘আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের সবকিছু খুলে বলুন! এক বৃদ্ধ তার সামনে গিয়ে প্রশ্ন করলো, ব্যাপারটা কি বলুন তো? ওই লোকটা কে ছিল? রাতে এমন বিস্ফোরণ ও ভূকম্পন কেন হলো? এই কালো ধোঁয়াই বা কিসের?’

‘সে উন্মাদ! সে একটা বদ্ধ পাগল ছিল এমন কথা আমি তোমাদের বলতে পারি। কিন্তু তা সত্য নয়।’ নতুন দরবেশ বললো, ‘সে ছিল এক গাদ্দার আলেম। খৃস্টানরা তাকে পয়সার বিনিময়ে কিনে নিয়েছিল। তোমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য সে নানা কেরামতির কথা বলে বেড়াতো! কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, আল্লাহর গোপন রহস্যের খবর কেউ জানে না। আল্লাহ ছাড়া বিজয়ের সুসংবাদ কেউ দিতে পারে না। জয়-পরাজয়, আনন্দ বেদনা সবই আল্লাহর হাতে।

সে নিজেকে আল্লাহর দূত বলতো, কিন্তু শেষ নবী হযরত, মোহাম্মদ (সা.)ই ছিলেন আল্লাহর শেষ দুত। এরপর দুনিয়ায় আল্লাহর অনেক প্রিয় ব্যক্তি জন্ম নিতে পারে কিন্তু তারা কেউ আল্লাহর দূতের মর্যাদা পাবে না। তোমাদের বিভ্রান্ত করতে গিয়ে সে আল্লাহর বিরাগভাজন হয়েছিল।

পাপিষ্ঠ আলেম তার দুনিয়ার শাস্তি পেয়েছে, পরকালের শাস্তি তো তার এখনো জমাই রয়ে গেছে। তোমরা সেখানে গিয়ে দেখো, তার একটি হাড্ডিরও অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না। সে যে পাহাড়ে বসেছিল সেই পাহাড়ও ধ্বংস হয়ে গেছে। কালো ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে দেখো, পাহাড় এখনো জ্বলছে। প্রতারক দরবেশকে যদি তোমরা সত্য বলে মানো তবে তোমরাও জ্বলবে। জ্বলবে দুনিয়ায়, জ্বলবে আখেরাতে।’

‘আমাদের বলুন তবে সঠিক কে? আমরা কার কথা মানবো? কাকে বিশ্বাস করবো? তিনিও দরবেশ ছিলেন, আপনিও দরবেশ। কোন দরবেশকে আমরা সত্য বলবো?’

‘না!’ তিনি উত্তর দিলেন, “উনি দরবেশ ছিলেন না, ছিলেন ভণ্ড দরবেশ। আমিও দরবেশ নই, তোমাদের জন্য এক সামান্য সাবধানকারী মাত্র। চেহারা সুরত আর বেশ দেখে সত্য বিচার করো না। সত্য বিচারের মাপকাঠি হচ্ছে এ কোরআন।’

তিনি কোরআন উঁচু করে ধরে বললেন, ‘আল্লাহর এই বাণীই সত্য। তোমরা দরবেশের কথা ভুলে যাও! কোরআনকে যারা মনগড়া ব্যাখ্যা করে তাদের কথা ভুলে যাও; যারা কোরআনের এক অংশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে আরেক অংশ গোপন করে তাদের কথা ভুলে যাও। কেবল এই কিতাবের কথা মান্য করো। মানো কোরআনের সব কথা।

এই কোরআন আল্লাহ পাঠিয়েছেন তার বান্দাদের মঙ্গলের জন্য। মঙ্গল ও কল্যাণ কেবল এই কোরআনেই নিহিত আছে। কোন পণ্ডিত, আলেম বা বুজুর্গানে দ্বীন এই কোরআনের সমকক্ষ হতে পারে না। আল্লাহর এই কালাম তোমাদের যে সৎ ও সত্য পথের সন্ধান দিতে পারবে কোন মানুষ তা দিতে পারবে না। তোমরা ব্যক্তি নয়, দল নয়, আঁকড়ে ধরো এই কোরআন। যে তোমাদের কোরআনের পথে পরিচালিত হতে বলবে, মেনে চলবে কেবল তার কথা।’

সারা দিন মুশেলে ঘুরে ঘুরে এই কথাই তিনি বলে বেড়াতে লাগলেন। লোকজন কোথাও জমা হয়ে গেলে তিনি কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে তাদের নসিহত করতেন। তিনি বলতেন, ‘অদৃশ্যের খবর একমাত্র আল্লাহই জানেন। তিনি ছাড়া মানুষের কোন ক্ষমতা নেই আল্লাহর ইশারা সম্পর্কে কিছু বলে। আল্লাহর ইশারা সব লিপিবদ্ধ আছে কোরআনে। কোরআন পড়ে তোমরা সে ইশারা জেনে নাও।’

তিনি এক মসজিদে জোহরের নামাজ পড়লেন। নামাজের পর মুসল্লীরা তাকে ঘিরে ধরলো। তিনি তাদের সামনেও একই নসিহত করলেন। বললেন, ‘আলেমদের কথা তোমরা শুনবে। তবে তা মানার আগে নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করবে, তিনি যে কথা বলেছেন তা বিবেক সম্মত কি না? দযি নিজের বিবেক সায় দেয় তাহলেই তা মানবে, নচেৎ অন্য আলেমের কাছে যাবে সত্য আবিস্কারের জন্য। তাকে বলবে তার কথার পক্ষে কোরআনের আয়াত পেশ করার জন্য।

তার কথা বিবেক সম্মত না হলে যাবে অন্য আলেমের কাছে, যে তোমাকে কোরআন থেকে পথের দিশা দেখাতে পারবে। এভাবে কোরআন থেকেই তুমি তোমার পথের নিশানা জেনে নেবে।’

তিনি এশার নামাজের পরও এভাবে বক্তৃতা করে যখন মসজিদ থেকে বের হলেন তখন অনেক রাত। তিনি এক নির্জন স্থানে যাচ্ছিলেন, লোকেরাও তার পিছনে পিছনে চললো।

তিনি তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখন আমার পিছনে আ কেউ আসবে না। আমি সারা রাত নির্জনে একাকী এবাদত বন্দেগী করবো। তোমাদের পাপের জন্যও আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইবো।’

তিনি জনগণের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলেন যে, জনগণের মন থেকে আগের দরবেশের ভয় ও শংকা দূর হয়ে গেল।

তিনি লোকজনকে থেমে যেতে বললে জনগণ সেখানেই থেমে গেল। তিনি আস্তে আস্তে হেঁটে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। লোকজন কেউ কেউ নিজ নিজ বাড়ীর দিকে রওনা হলো, বাকীরা সেখানে দাঁড়িয়ে জটলা করতে লাগলো। তারা বলাবলি করতে লাগলো, ‘এখন তারা কি করি?’

লোকেরা তার পিছনে যাওয়ার সাহস পেলো না। কিন্তু এই জটলার মধ্যে এমন একজন ছিল, যে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে অন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং চুপিসারে দরবেশের পিছু নিল।

দরবেশ বেশ কিছু দূর চলে গিয়েছিল। তাকে ধরার জন্য পেছনের লোকটি যখন দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো তখন স্বাভাবিকভাবেই তার পদধ্বনি বেড়ে গেল। নির্জন পথে সামান্য পদধ্বনিই দরবেশের কানে অনেক বড় হয়ে বাজলো। তিনি বুঝতে পারলেন, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। তিনি থেমে পেছনে তাকালেন।

একটি অন্ধকারে দরবেশকে ছায়ার মত অনুসরণ করছিল। দরবেশ দাঁড়াতেই সে সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল এবং যাতে দরবেশের চোখে ধরা না পড়ে সে জন্য বসে পড়লো। দরবেশ কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার চলতে লাগলেন। কিন্তু আবারও তিনি অনুভব করলেন, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। তিনি বার বার পেছন ফিরে দেখলেন, কিন্তু অনুসরণকারীকে দৃষ্টিসীমায় দেখতে পেলেন না তিনি।

এভাবেই পথ চলছিলেন তিনি। শেষে কাউকে দেখতে না পেয়ে অনেকটা বেপরোয়া ভঙ্গিতে হাঁটা ধরলেন। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর লোকটি চাপা পায়ে দ্রুত দূরত্ব কমিয়ে দরবেশের একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেল।

দরবেশ উচ্চস্বরে কোরআনের আয়াত পাঠ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। লোকটি দরবেশের কাছে পোঁছেই কোমরবন্ধ থেকে খঞ্জর বের করে আনলো। সে যখন পিছন থেকে দরবেশকে আঘাত করার জন্য উদ্যত তখনি দরবেশ কি মনে করে বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে দাঁড়ালেন।

লোকটি খঞ্জর বাগিয়ে হাত দুটো সবে উপরে তুলেছিল কিন্তু তা নামিয়ে আনার আর সুযোগ পেলো না, দরবেশ ঘুরে দাঁড়িয়েই তার হাতের লাঠিটি এমনভাবে ঘুরালো যে, লোকটির খঞ্জর ধরা হাতের কব্জির উপরে জোরে আঘাত লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে ছিটকে পড়লো খঞ্জর। দরবেশ আততায়ীকে কোন রকম সুযোগ না দিয়ে তার পেট বরাবর জোরে লাথি চালালেন, লোকটি ‘অক’ শব্দ করে ভেঙ্গে পড়ে গেল।

দরবেশের এক হাতে ছিল কোরআন, তাই এক হাতেই তাকে লড়াই করতে হলো। লোকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তিনি তার শরীর ও মাথায় কয়েক ঘা বসিয়ে দিলেন। মাথার আঘাতটি ছিল মারাত্মক, লাঠির আঘাতে লোকটির মাথা ফেটে গেল। তিনি কয়েক কদম দূরে খঞ্জরটিকে ঝিলিক মারতে দেখলেন। কোরআন ও লাঠি এক হাতে নিয়ে অপর হাতে তিনি তুলে নিলেন ছুরিটি।

আঘাত খাওয়া লোকটি ধীরে ধীরে উঠে বসতে লাগলো। দরবেশ তাকে বললেন, ‘খঞ্জর এখন আমার হাতে। চালাকি না করে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকো।’

লোকটি উঠতে গিয়েও আর উঠলো না, পেটের ওপর ভর করে শুয়ে পড়লো।

দরবেশ মুখ দিয়ে পাখীর ডাকের মত শব্দ উচ্চারণ করলেন। দূর থেকেও অবিকল সেই ডাকের প্রতিধ্বনি শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার ডাকলেন।

অনতিদূরে অন্ধকারে দৌঁড়ানোর শব্দ শোনা গেল। দু’জন লোক মুহূর্তে দরবেশের কাছে ছুটে এলো। দরবেশ হেসে বললেন, ‘আমি যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে। এই হতভাগা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ভাগ্যিস সতর্ক ছিলাম।’

‘আমি তো ভেবেছিলাম দিনের বেলায়ই মুশেলের কোন বাড়ীর জানালা থেকে আপনার দিকে তীর ছুটে আসবে।’ আগন্তুক বললো, ‘কিন্তু হতভাগারা সে সাহস করেনি।’

‘ভেবেছিল, রাতের অন্ধকারে হত্যা করাটাই সুবিধাজনক। নাও, এখন শয়তানটার মেহমানদারীর ব্যবস্থা করো।’ দরবেশ খঞ্জরটি আগন্তুকের হাতে তুলে দিল।

‘ওঠ শয়তান! তুই কি মুসলমান না খৃষ্টান?’ আগন্তক তার গায়ে একটি লাথি দিয়ে প্রশ্ন করলো।

‘আমি মুসলমান! লোকটি উঠে বসে বললো, হুজুর, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আসলে আপনাকে মারতে চাইনি। আমি দেখতে চাচ্ছিলাম আপনি খাঁটি দরবেশ নাকি আগের হুজুরে মতই ভণ্ড পীর। আপনি তো এক মহান বুজুর্গ।’

দরবেশ ও তার সঙ্গী দুজনেই হেসে উঠলো। দরবেশ বললো, ‘ফের চালাকি? আমাকে দরবেশ বা বুজুর্গ বলে পার পেতে চাস? আমি পীর নই আর বুড়োও নই, আমি তোর চেয়েও যুবক।’

“তোমার বহুরূপী সাজা সফল হয়েছে।’ দরবেশের সাথী বললো।

তিনজন মিলে সে লোককে দূরে এক তাঁবুর মধ্যে নিয়ে গেল। সেখানে চারটি উট বাঁধা। জায়গাটি এক পাহাড়ের ঢালে।

লোকটিকে তাঁবুর মধ্যে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে প্রদীপ জ্বলছিল। লোকটি কথিত দরবেশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। দরবেশের চেহারার চামড়া আশি বছরের বুড়োর মত। বক্তৃতার সময় তার কণ্ঠও ছিল এক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির। কিন্তু এখন তার কণ্ঠস্বর যুবকের মত ভরাট ও বলিষ্ঠ।

দরবেশ তার সাদা দাড়ি খুলে ফেললো। তার এক সঙ্গী তাকে একটি ভেজা কাপড় এনে দিল। দরবেশ সেই কাপড় দিয়ে তার মুখটা মুছে নিল। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের বার্ধক্যের ছাপ মুছে গেল। সেখানে বেরিয়ে এলো এক তরতাজা যুবকের চেহারা। আক্রমণকারীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন দরবেশ।

‘তুমি আসলে কে?’ আক্রমণকারী জিজ্ঞেস করলো।

‘একটু আগে আমি ছিলাম এক দরবেশ, যাকে তুমি হত্যা করতে চাচ্ছিলে।’ তিনি বললেন, ‘এবার তুমি বলল, তুমি কে? তোমাকে কে বা কারা আমাকে হত্যা করতে পাঠিয়েছে কোন কথা গোপন করার চেষ্টা করলে তার দায় দায়িত্ব তোমার। সে জন্য যদি তোমার মৃত্যুও হয়, আমাকে দায়ী করতে পারবে না।’

‘আমার কাছে গোপন করার কিছুই নেই।’ লোকটি উত্তর দিল। ‘আমাকে মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনের মহলের এক অফিসার আহমদ বিন উমরু বললো, শহরে এক নতুন দরবেশ ঘোরাফেরা করছে। সম্ভবত, সে ছদ্মবেশে আছে। তুমি তাকে অনুসরণ করো।’

তিনিই আমাকে বলেছেন, ‘রাতের অন্ধকারে এই দরবেশকে হত্যা করতে হবে। কাজটা এমনভাবে সারবে যাতে কেউ কিছু জানতে না পারে।’

‘তাতে তোমার লাভ?’

‘আহমদ বিন উমরু এ কাজের জন্য আমাকে অগ্রীম একশো দিনার দিয়েছে। কাজ শেষে আরো একশো দিনার দেবে।’

‘আহমদ বিন উমরুর কি ধারনা, আমি এক জইফ দরবেশ?

‘তা আমি জানি না। তিনি এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেননি।’ লোকটি উত্তরে বললো, ‘তিনি শুধু বলেছেন, বাজারের মোড়ে বা মসজিদে তুমি নতুন দরবেশকে পেয়ে যাবে। তাকে হত্যা করতে পারলে দুশো দিনার ইনাম পাবে।’

‘আর তুমি আমাকে এক বৃদ্ধ মনে করে দুশো দিনারেই রাজি হয়ে গেলে!’

লোকটি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। দরবেশের রূপ ধারণকারী ও তাঁর সাথীরা ছিল সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বাহিনীর পরীক্ষিত সৈনিক। এরা তখন মুশেলে কাজ করছিল। আগের দরবেশের কারণে লোকদের মনে কুসংস্কার ঢুকে গিয়েছিল। কেরামতি ও অলৌকিকতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল মুশেলের অধিকাংশ জনগণ। লোকদের মন থেকে সেই কুসংস্কার দূর করার জন্যই আইয়ুবীর গোয়েন্দারা এই কৌশল নিয়েছিল। তারা সুলতান আইয়ুবীর জানবাজদের মধ্য থেকে একজনকে দরবেশ বানিয়ে তাকে শহরে ছেড়ে দিল।

প্রথম দরবেশকে নিয়োগ করেছিল খৃষ্টানরা। জনগণকে প্রতারিত করার জন্য ময়দানে নামিয়েছিল তাকে। ‘বিষে বিষ ক্ষয়’ নীতি অনুযায়ী সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারাও তাদের দলের এক যুবককে বুড়ো সাজিয়ে দরবেশের ছদ্মবেশে ময়দানে পাঠিয়ে দিল। তার কাজ হলো জনগণের মনে ইসলাম সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারনা তৈরী হয়েছে তা অপনোদন করা। তাই তিনি হাতে কোরআন নিয়ে জনগণকে সেই কোরআনের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে বললেন।

আহমদ বিন উমরু মুশেলে বিন উমরু নামেই বেশী খ্যাতিমান ছিল। মুশেলের আমীর ইয়াজউদ্দিনের ব্যবস্থাপনা বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার ছিল সে। তার পদমর্যাদা ছিল মন্ত্রীর সম পর্যায়ের।

কুটনীতিতে পারদর্শী এ লোক জানতে পারলো, মুশেলে নতুন এক দরবেশের আবির্ভাব হয়েছে। এই দরবেশ আগের দরবেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে এবং তাকে ভণ্ড বলে আখ্যায়িত করছে।

তার বুঝতে বাকী রইলো না, এই লোক সুলতান আইয়ুবীর পক্ষ হয়ে ময়দানে নেমেছে। সে মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারলে তাদের ষড়যন্ত্র সব বানচাল হয়ে যাবে। তাই সে এই দরবেশকে হত্যা করা জরুরী মনে করলো? কিন্তু তার খুনের বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে তার প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেড়ে যাবে এবং তার পক্ষ হয়ে আবার কেউ মাঠে নামলে জনগণ তাকে লুফে নেবে। সে ক্ষেত্রে আগের দরবেশের আসল রূপ জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। তখন জনগণ জেনে যাবে পাহাড়ে কি জ্বলছে। বিশেষ করে ইয়াজউদ্দিন যে খৃস্টানদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব করেছে এবং তারই ছত্রছায়ায় তারা এখানে অন্ত্রের মজুদ গড়ে তুলেছিল তা আর গোপন থাকবে না।

সুলতান আইয়ুবীর এই ছদ্মবেশী দরবেশকে হত্যা করার জন্য সে মহলের প্রতিরক্ষা বিভাগের এক সৈন্যকে বাছাই করলো। দুইশত দিনারের লোভ দেখিয়ে দরবেশকে গোপনে হত্যা করার জন্য পাঠিয়ে দিল তাকে।

ভাড়াটে খুনী দরবেশকে দুর্বল এক বৃদ্ধ মনে করে কাজটা সহজেই সারতে পারবে ভেবেছিল। কিন্তু আসলে সে যে যুবক এবং আইয়ুবীর গোয়েন্দা ও কমাণ্ডো দলের এক চৌকস যোদ্ধা এ কথা সে কল্পনাও করতে পারেনি। ফলে দরবেশকে খুন করতে এসে সে নিজেই ফেঁসে গেছে।

বিন উমরুর পাঠানো এই খুনীকে প্রদীপের আলোয় বসিয়ে জেরা করা শুরু করলো আইয়ুবীর গোয়েন্দারা। তাকে অনেক কথাই জিজ্ঞেস করা হলো, কিন্তু তার কাছে আসলে তেমন কোন গোপন তথ্য ছিল না। সে এক সাধারণ নিরাপত্তা কর্মী, সৈনিক হলেও গোয়েন্দা বিভাগের লোক না হওয়ায় সে নিরাশ করতে বাধ্য হলো আইয়ুবীর গোয়েন্দাদেে।