» » দূর্গপতন

বর্ণাকার

যে রাতে আলী বিন সুফিয়ান সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে বলছিলেন, যুদ্ধ থেকে আগত সেনাবাহিনী মিশরে অবস্থানরত সৈন্যদের ওপর রেগে আগুন হয়ে আছে, সেই রাতে এক রহস্যময় পীর কায়রো থেকে বহু দূরে একটি খেজুর বাগানে তাবু টানিয়ে বসেছিলেন। তার একটা নিয়ম ছিল, তিনি দিনের বেলা এবং চাদনী রাতে কারো সাথে দেখা করতেন না। অন্ধকার রাত তার কথা বলার ও সাক্ষাতের সময়। তার মাহফিল অসংখ্য মোমবাতির আলোয় এমনভাবে সাজানো হতো, যেখানে আলো-আধারীর রহস্যময় এক জগত তৈরী হয়ে যেতো। সেই আলোর প্রভাব উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে যাদুর মত কাজ করতো। –

তিনি যেখানে তাবু টানিয়ে দলবল নিয়ে বসেছিলেন, তার অদূরেই গ্রামের ভক্তকুল বসেছিল তাজিমের সাথে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল মিশরীয় মুসলমান, কিছু ছিল সুদানী হাবশী। সেই গ্রামে একটি মসজিদ ছিল। মসজিদের ইমাম ছিলেন একজন শান্তশিষ্ট নিরীহ আলেম। এক যুবক দু’মাস যাবত তার কাছে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করতে আসতো। যুবকের নাম মাহমুদ। সে দূরের একটি গ্রাম থেকে আসতো। পড়ার প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ।

তবে তার চেয়েও বেশি আকর্ষণ ছিল, সেই গ্রামের একটি মেয়ের প্রতি। মেয়েটির নাম সাদিয়া।

সাদিয়াও ভালবাসতো মাহমুদকে। প্রায় প্রতিদিনই মাহমুদের আসার পথে এক উপত্যকার ঢালে মেয়েটি বকরী চড়াতো এবং মাহমুদ এলে তাকে তার বকরীর দুধ পান করতে দিতো।

গ্রাম থেকে দূরে সেই নির্জন চারণভূমিতেই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। সাদিয়া সেখানে তার চারটি বকরী ও দুটি উটকে তখন পানি পান করাচ্ছিল। মাহমুদ পিপাসায় কাতর হয়ে পানি পান করার জন্য এগিয়ে গেল মেয়েটির কাছে। সাদিয়া তার হাতে পানি তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথেকে এসেছেন?’

‘আমি!’ বলল মাহমুদ, অই ওদিক থেকে।

যাবেন কোথায়?”

মাহমুদ উল্টো দিকে ইশারা করে বলল, ওদিকে।

সাদিয়া মাহমুদের কথা শুনে হেসে উঠল, বারে! জায়গার কোন নাম নেই?”

নাম দিয়ে কি করবে তুমি? এ দুনিয়ার সবটাই আল্লাহর, আর আমি তার খলিফা। মানে, এ দুনিয়াটাই আমার। ফলে আমার যেখানে খুশি সেখানে যাবো, তাতে তোমার কি?’ মাহমুদের এমন আজব উত্তরে খিলখিল করে হেসে উঠল সাদিয়া।

‘হাসলে কেন?”

“তওবা, তওবা! সাদিয়া তার দু’গালে মৃদু চাপড় দিয়ে বললো, তাইতো! কত বড় আস্পর্ধা আমার! ছোটখাট কোন দেশের বাদশার সামনে হাসাই যেখানে বেয়াদবী, সেখানে দুনিয়ার সম্রাটের পাশে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি! না, না, এ মহা অন্যায়। হুজুর আমাকে মাফ করে দিন। ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাত জোড় করল সাদিয়া।

এবার হেসে উঠল মাহমুদও, বাহ! আমাকে একেবারে সম্রাট বানিয়ে দিলে!’

এভাবেই ওদের প্রথম আলাপ পরিচয় হয়। মাহমুদ মুসলমান শুনে সাদিয়া তার সাথে অন্তরঙ্গ ব্যবহার করে। খুশি। হয়। তার চোখে মুখে সে খুশির ঝিলিক দেখতে পায় মাহমুদ। ঠোঁটে দেখতে পায় লাজরাঙা মধুর হাসি। দু’জনেরই দু’জনকে ভাল লেগে যায়। আলাপ জমে ওঠে।

মাহমুদের কথা শুনতে খুব ভাল লাগছে সাদিয়ার। ও তার বলার ভঙ্গিতে মুসলিম সৈন্যদের সম্পর্কে আগ্রহ ও সমর্থন প্রকাশ পাচ্ছিল। .

সে যখন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্পর্কে প্রশ্ন করলো, তখন মাহমুদ তার উচ্ছসিত প্রশংসা করলো। সাদিয়া জানতে চাইলো, যিনি,আকাশ থেকে নেমে এসেছেন এবং মৃতকে জীবিত করতে পারেন সেই পীরের চেয়েও কি তিনি বেশি কামেল ও মহাপুরুষ?

সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী কোন মৃতকে জীবিত করতে পারেন না। উত্তরে বলল মাহমুদ, তিনি পৃথিবী থেকে অন্ধকার ও অশান্তি দূর করে মানুষকে শান্তি ও আলোতে নিয়ে আসেন।

সাদিয়া বললো, তবে যে শুনেছি, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী একজন খুনি। তিনি নাকি হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর। সুযোগ পেলেই তিনি মানুষ হত্যা করেন?

তোমাকে কে বললো তিনি লোকজনকে হত্যা করেন?

‘আমাদের গ্রাম দিয়ে যে সব পথিক যাওয়া আসা করে তাদের মুখে শুনেছি। তারা বলে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খুব খারাপ লোক। তার দীলে কোন রহম নেই। এমনিতে সে নাকি খুব ভালো ভালো কথা বলে। আমাদের মত নামাজ রোজাও করে। কিন্তু হিংস্রতাই নাকি তার সব ভাল কাজ বরবাদ করে দিয়েছে।’

তোমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব কি বলেন?’ মাহমুদ প্রশ্ন করলো।

তিনি অন্য রকম বলেন, বলল সাদিয়া। তিনি বলেন সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী ইসলামের আলো সমগ্র মিশর ও সুদানে বিকশিত করতে এসেছেন। আর ইসলামই আল্লাহর একমাত্র সত্য দ্বীন।

সাদিয়ার কাছ থেকেই সে জানতে পারলো, তাদের গ্রামে ইদানিং এমন সব লোক আসা যাওয়া করে, যারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দিলেও তাদের আচার আচরণে ইসলামের নমুনা পাওয়া যায় না। তারা এমন সব কথা বলে, যাতে মানুষের মনে ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যায়। তারা বলে, সমাজ ও সভ্যতা কখনো এক জায়গায় বসে থাকে না। সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষের জীবন যাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে। পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে আমাদেরও সময়ের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। শুধু ইসলাম নিয়ে বসে থাকলে হবে না।

আমার এক চাচা জিজ্ঞেস করেছিল, কেন হবে না?’

তারা বললো, “কেমন করে হবে? আপনি কি কোরআনের কোন শব্দ পাল্টাতে পারবেন? যদি না পারেন তবে পুরোনো কোরআনকে জীবন বিধান মেনে নিয়ে আপনি কি করে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলবেন?

চাচা বললেন, “তাহলে কি আমরা কোরআন ছেড়ে দিব, ইসলাম ছেড়ে দিব”?

‘না, না, তা ছাড়বেন কেন? আমরা কি তাই বলেছি। আমরা কি মুসলমান নই? আমরা কোরআন পড়বো, নামাজ রোজাও করবো। কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্যসহ দুনিয়াবী কাজে ইসলামকে টেনে এনে অপবিত্র করবো না। রাজনীতিতে ইসলামকে জড়াবো না। তাহলে ইহকালও রক্ষা পাবে, পরকালও রক্ষা পাবে। রাসূল যখন দুনিয়ায় এসেছিলেন তখন তিনি সে সময়ের আলোকে জীবন ধারণ করেছেন, আমরাও আমাদের সময়ের দাবীকে উপেক্ষা করতে পারি না, এ কথাই আমরা বলতে চাচ্ছি।”

‘সময়ের দাবী কি?” চাচা জিজ্ঞেস করেছিলেন।

সময়ের দাবী হচ্ছে, এখন মানুষ অনেক সভ্য হয়েছে। পাঁচশো বছর আগে মানুষ যেমন বর্বর ছিল এখন আর তেমন নেই। এমন অনেক সমস্যা আছে যা আমরা আলাপ আলোচনা করে সমাধান করতে পারি। এ জন্য অহেতুক যুদ্ধের কোন দরকার পড়ে না। দুশমন বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে তা ফিরিয়ে দেয়া অনুচিত। দিলে তাতে নিজেরই ক্ষতি হয়। মারামারিতে কখনো এক পক্ষ মরে না, দু’পক্ষই মারা পড়ে তাতে। তাই কারো সাথে শক্রতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব এ নীতি গ্রহণ করে অশান্তির পরিবেশ থেকে ফিরে আসাই এখন সময়ের দাবী।”

মাহমুদ সাদিয়ার সাথে আলাপ করে অনেক কিছুই জানতে পারলো। বুঝলো, ইসলামের পক্ষে যারা কাজ করছে তাদের চরিত্র হননের কাজে নেমেছে দুশমন। আর কেউ না জানুক, মাহমুদ তো জানে সুলতান আয়ুবীর মনে মানুষের জন্য কী অপরিসীম দরদ নিজের জীবন বিপন্ন করে আইয়ুবী এত যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন তা কেবল মানুষ ও মানবতার কল্যাণের জন্য। ধন-দৌলত বা অন্য কিছুর জন্য তাঁর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কোন দরকার নেই।

সাদিয়াকে সে বলল, সাদিয়া, তুমি যা শুনেছো সবই ৷ ভুল। ইসলামের দুশমনদের মিথ্যা প্রচারণা। যারা এসব কথা বলেছে তারা মুসলমান কি অমুসলমান আমার জানা নেই। হয়তো জন্মসূত্রে তারা মুসলমান। কিন্তু মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেই কেউ মুসলমান হয়ে যায় না। তুমি জানো, নূহ নবীর সন্তান কেনান ইসলাম গ্রহণ করেনি। ফলে নবীর সন্তান হয়েও সে মুসলমান হতে পারেনি। অন্য দিকে হাজার হাজার কাফের ইসলামের নীতি ও আদর্শকে গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছে।

আজকে যারা ইসলামের শত্রুদের চক্রান্তে পড়ে কোরআন ও সুন্নাহর বিরুদ্ধে কথা বলছে, যতই তারা নামাজ রোজা করুক, নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করুক, তারা যে ইসলামের স্বপক্ষ শক্তি নয় এতে কোন সন্দেহ নেই! ইসলামের বিপক্ষ শিবিরে অবস্থান করে এবং ইসলামের বিপক্ষ শিবিরে থেকে কেউ মুসলমান থাকতে পারে বলে আমার জানা নেই। মোনাফিকদের অবস্থান নাকি কাফেরের চাইতেও নিচে। কাল হাশরের মাঠে এদেরকে মুসলমানের দলে রাখা হবে, না মোনাফিকের দলে, সে চিন্তা আমার নয়, যারা এ কাজ করছে তারাই করুক। আমি শুধু বলবো, এরা এখন যা করছে তা ইসলামের জন্য ক্ষতিকারক।

কিন্তু খুন খারাবি তো আসলেই খারাপ। তুমি কি মারামারি সমর্থন করে?

সাদিয়া তুমি তো জান পৃথিবীতে মহানবী (স) এর চেয়ে দয়ালু কোন মানুষ আজ পর্যন্ত আসেননি এবং ভবিষ্যতেও আসবেন না। কেবল মিত্র নয়, নিজের আত্মীয়স্বজন নয়, সঙ্গী সাহাবী নয়, পৃথিবীর সব মানুষকে ভালবাসতেন তিনি। এমনকি শক্রকেও। তাইতো তাঁকে কাহিনী ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। যে বুড়ি প্রতিদিন তাঁর চলার পথে কাঁটা দিত, অসুখের সময় তাকেও সেবা দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন রাসূল। তুমি কি খুনি বলে ঘৃণা করবে। এই মহামানবকে?’

মাহমুদের কথায় অবাক হয় সাদিয়া, কেন? তাঁকে ঘৃণা করবো কেন? তিনি তো দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম মানুষ। শুধু মুসলমানরাই নয়, অনেক অমুসলমানও তাঁকে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে।”

মাহমুদ বলে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যেমন মানুষ হত্যা করে, যুদ্ধ করে, তিনিও জীবনে তেমনি অসংখ্য যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ করলেই কেউ খুনি হয় না, বরং যুদ্ধ করে মানবতার শক্রদের বিনাশ না করলে অন্যায় হয়। আইয়ুবীও তেমনি মানবতার শক্ৰদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন। ইসলামের দুশমনরা তাই তাঁকে দেখতে পারে না, তাঁকে খুনি, সন্ত্রাসী বলে সমাজে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়।’

মাহমুদের কথায় সাদিয়ার মনের সব সন্দেহ দূর হয়ে যায় |

মাহমুদ বলে, ‘চলি সাদিয়া। আল্লাহ চাইলে আবার আমাদের দেখা হবে।’

মাহমুদের মিষ্টি ব্যবহার এবং তার ব্যক্তিত্ব সাদিয়ার কোমল মনে গভীর রেখাপাত করে। মাহমুদের ভাষার মাধুর্য ও চিন্তার স্বচ্ছতায় বিস্ময়বোধ করে সে। আবারো তার সাথে কথা বলার জন্য অধীর হয়ে উঠে তার মন। বলে, “আমি প্রতিদিন বেশির ভাগ সময় এখানেই বকরী ও উট চরাতে আসি। যদি এ পথে কখনো আসেন দেখা করে গেলে খুশি হবো।’

‘অবশ্যই তোমার সাথে দেখা করবো আমি।’ বলল মাহমুদ।

মাহমুদ সাদিয়ার হৃদয়ে এক অশান্ত ঢেউ তুলে চলে গেল সেখান থেকে। একাকী, পেরেশান অবস্থায় সাদিয়া তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ‘কে তুমি যুবক? কোথেকে এলে তুমি আমার মনোবীণায় সুর বাজাতে! আমার হৃদয় সাগরে অশান্ত ঢেউ জাগাতে? তোমার পোষাকপরিচ্ছদ এ অঞ্চলের মত হলেও তোমার চেহারা, তোমার আকৃতি, তোমার কথা বলার ভঙ্গি বলে, তুমি এ অঞ্চলের কেউ নও।

সাদিয়ার সন্দেহ সত্য ছিল। মাহমুদ বিন আহমদ কোন পল্লী এলাকার মানুষ ছিল না। সে ছিল আলেকজান্দ্রিয়া শহরের বাসিন্দা। আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগের একজন চৌকস কর্মী। কয়েক মাস ধরে তার দায়িত্ব পড়েছে সীমান্ত এলাকায়। সেই থেকে সে এই পল্লী অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

নিজের পরিচয় সে যথেষ্ট গোপন রেখেছিল। তার সাথে আরও কয়েকজন গোয়েন্দা এ অঞ্চলে কাজ করছে। তারাও বিভিন্ন বাহানায় ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামে গ্রামে। মাঝেমধ্যে তারা একত্রে মিলিত হয়। তারা যে সব খবর সংগ্রহ করতে পারে তা নিয়মিত এক সার্থীকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় কায়রো। এভাবেই আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দারা সীমান্ত এলাকায় এক অদৃশ্য গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে।

সাদিয়াদের পাশের গ্রামের দু’টি মসজিদের ইমামের ব্যাপারে সে এরই মধ্যে সন্দেহজনক খবর পেয়েছে। জানা গেছে, ওই দুই মসজিদে নতুন ইমাম এসেছে। আগে এই দুই মসজিদে কোন বাঁধাধরা ইমাম ছিল না। গ্রামের মরুকবীদের যিনি যখন উপস্থিত থাকতেন তিনিই নামাজ পড়াতেন।

নতুন ইমাম এসে জিহাদের বিরুদ্ধে ওয়াজ শুরু করল। কুরআনের আয়াত পাঠ করে তার ভুল তাফসীর ও ব্যাখ্যা দিতে লাগল। রহস্যময় পীরকে তারা সত্য বলে প্রচার করল এবং পীরের সাথে দেখা করে ফয়েজ ও বরকত লাভের উপদেশ দিতে লাগল জনগণকে। মাহমুদ এই ইমাম দু’জনের ব্যাপারে ইতিমধ্যেই কায়রো রিপোর্ট পাঠিয়েছে।

সাদিয়ার কাছ থেকে জানতে পারল তাদের গ্রামের ইমাম সুলতান আইয়ুবীর ভক্ত এবং ইসলামের নিশানবাহী। এ খবর শুনে সে খুব খুশি হলো। মনে মনে ভাবল, সাদিয়ার তথ্য কতটা সঠিক একটু খতিয়ে দেখা দরকার।

সে সাদিয়াদের গ্রামের মসজিদে গিয়ে ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করলো। ইমাম সাহেবকে মাহমুদ বললো, ‘আমি ধর্মীয় জ্ঞান লাভের জন্য উস্তাদ খুঁজে বেড়াচ্ছি। আপনি কি কষ্ট করে আমাকে একটু দ্বীনি তালিম দেবেন?

ইমাম সাহেব মাহমিদের প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়ে বললেন, যুবক, তোমার প্রস্তাব আমি সানন্দে কবুল করলাম। দ্বীনি তালিম নেয়ার প্রতি তোমার আগ্রহ দেখে আমি খুবই খুশি হয়েছি। ইচ্ছে করলে তুমি কাল থেকেই তালিম নিতে আসতে পারো।

পরের দিন থেকেই মাহমুদ নিয়মিত ইমামের কাছে তালিম নিতে শুরু করল।

ইমাম সাহেব মসজিদে একাই থাকতেন। ইসলামের সঠিক শিক্ষা জনগণের মধ্যে প্রচার করায় পীরপন্থী লোকেরা তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। মুসল্লীদেরকে উত্তেজিত করতে লাগল তারা। তিনি অনুভব করলেন, মুসল্লীদের উত্তেজিত করার এ কাজে খৃস্টানদের অনুচররাও সক্রিয়। ক্রমেই অবস্থার অবনতি ঘটতে লাগল। এক সময় জীবনের নিরাপত্তা নিয়েই শংকিত হয়ে পড়লেন তিনি। ভাবলেন, এখন তার একজন সঙ্গী দরকার।

একদিন তিনি মাহমুদকে বললেন তুমি ইচ্ছা করলে এখানেই থাকতে পারো। তাতে তোমার পড়াশোনার সুবিধা হবে।’

মাহমুদের পক্ষে সারাদিন মসজিদে আটকে থাকা সম্ভব ছিল না। সে ইমাম সাহেবকে বললো, দু’তিন দিন পর পর বাড়ী যাওয়ার সুযোগ পেলে এখানে থাকতে আমার আপত্তি নেই।’

ইমাম সাহেব একটু হাসলেন এবং জানতে চাইলেন, ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’

মাহমুদ ইমাম সাহেবের কাছে তার আসল ঠিকানা বলল না। সে বেশ দূরের সীমান্তবতী একটি গ্রামের নাম বলে দিল।

ইমাম সাহেব এবার জোরে হেসে ফেললেন এবং আস্তে করে বললেন মাহমুদ বিন আহমদ আমি তোমার বুদ্ধিমত্তায় ও তৎপরতায় খুবই খুশি। দায়িত্ব পালনের সময় আমাদের প্রত্যেকেরই এমন সজাগ ও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আমি আগেই শুনেছিলাম, আলেকজান্দ্রিয়ার মুসলমানরা দায়িত্বের ব্যাপারে খুবই নিষ্ঠাবান ও নির্ভরশীল হয়। তোমাকে দেখে এর সত্যতার প্রমাণ পেলাম।”

মাহমুদ এমন চমকে উঠলো যে, ভয় পেয়ে সে দাঁড়িয়ে গেল। সে মনে করল, ইমাম সাহেব ক্রুসেডের চর এবং তার কাছে তার পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে। সে মুহুর্তে আকস্মিক হামলা মোকাবেলা করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেল। ইমাম সাহেব কথা শেষ করলেও সে একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল এবং পেরেশান হয়ে ইমাম সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো, কোন দিক থেকে প্রথম আঘাতটা আসবে।

ইমাম সাহেব তাকে বেশীক্ষণ এই সন্দেহের রাজ্যে থাকতে দিলেন না। তিনি বললেন, আমি অনুভব করছি, কমপক্ষে তোমার কাছে আমার গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। আমিও তোমার মত আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগের একজন সামান্য খাদেম। তোমার যে সব সঙ্গী সাখী এ অঞ্চলে কাজ করছে তাদের প্রায় সকলকেই আমি চিনি। অবশ্য আমি জানি, আমাকে তোমরা কেউই চেনো না। কারণ, শক্রদের ওপর দৃষ্টি রাখার সাথে সাথে আমাদের গোয়েন্দাদের তৎপরতার ওপরও দৃষ্টি রাখা আমার দায়িত্ব। আমি আমার দায়িত্ব পালনের জন্যই ইমাম হিসাবে এখানে আছি।’ –

কিছু মনে করবেন না, আপনি যে পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করছেন তাতে আপনার আরো হুশিয়ার হওয়া উচিত। মাহমুদ আশ্বস্ত হয়ে বললো, ‘আমার কাজে আপনি খুশি হয়েছেন, কিন্তু আমার সামনে আপনি নিজেকে যেভাবে উন্মুক্ত করে দিলেন তাতে আমি খুশি হতে পারিনি। একটু অসতর্কতাই শত্রুর কাছে আপনার পরিচয় ফাঁস করে দিতে পারে।”

আমি অসতর্ক নই মাহমুদ, আমি তোমার পরিচয় জানি।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তোমার কাছে আমার আসল রূপ প্রকাশ করার। আমার আরও দু’জন সঙ্গী ছদ্মবেশে এখানে জনসাধারণের সাথে মিশে আছে। আমার আরও লোকের প্রয়োজন। তুমি আমার কাছে চলে আসায় ভালই হয়েছে।

এই গ্রামে শক্রদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। তুমি হয়তো সে পীর সম্পর্কে শুনেছো, যে অজ্ঞাত ভবিষ্যতের খবর বলতে পারে আর মৃতদের জীবিত করতে পারে বলে গুজব ছড়াচ্ছে। এই গ্রামও সেই গুজবে মেতে উঠেছে। আমি গ্রামবাসীদের বলেছি, এসব মিথ্যা প্রচারণা, মৃত লাশের মধ্যে কেউ প্রাণ দিতে পারে না।”

কিন্তু গুজব যাদুর মত ছড়িয়ে পড়ায় লোকেরা আমার কথায় কান দিচ্ছে না, আমার বিরুদ্ধে এখানে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। আমি এখন আরো সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি। ইদানিং তাই আর মসজিদ থেকে বেশি বের হই না। এ ব্যাপারেই তোমাকে আমার পাশে দরকার।

আমার এখন সঙ্গী প্রয়োজন। এখানকার যে সব লোককে ধোঁকায় ফেলে বিপথগামী করা হচ্ছে তাদেরকে ইসলামের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্যই এ সঙ্গী দরকার আমার। তোমাকে একটা ঘটনার কথা বলি, পনেরো বিশ দিন আগে রাতে আমার কাছে দু’জন লোক আসে। আমি তখন হুজরাখানায় একা ছিলাম। লোক দু’জনের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল। তারা আমাকে হুমকি দিয়ে বললো, এখান থেকে চলে যাও।

আমি বললাম, কোথায় যাবো! আমার যে কোন ঠিকানা নেই।’

তারা বললো, যদি এখানে থাকতে চাও তবে তালিম দেয়া বন্ধ করো আর সেই পীরের কথা বলো, যিনি আকাশ থেকে খোদার সঠিক দ্বীন নিয়ে এসেছেন।

আমি মুখোশপরা ওই আগন্তুক দু’জনের সাথে মোকাবেলা করতে পারতাম। অন্ত্র আমি সবসময় সাথেই রাখি। কিন্তু আমি দু’জনের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে তাদের হত্যা করলে কিংবা নিজে আহত বা নিহত হলে তো আর সমস্যা মিটে যাবে না। আমি তাই খুব ধীরস্থিরভাবে চিন্তাভাবনা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বললাম, ঠিক আছে, আজ থেকে তোমাদের কথা মতই চলবো। আমাকে নিজেদেরই একজন মনে করতে পারো এখন থেকে।

তারা বললো, এ ওয়াদা মত চললে তুমি তোমার কাজের যথাযোগ্য পুরস্কার পাবে। তোমাকে আর হত্যা করার দরকার হবে না। তার বদলে তুমি পাবে ধন-দৌলত, অঢেল স্বর্ণমুদ্রা।

‘তারপরে কি আপনি আপনার ওয়াজের স্টাইল পাল্টে ফেলেছেন?” মাহমুদ প্রশ্ন করে।

যতটুকু পারা যায়। ইমাম সাহেব বললেন, “আমি এমনভারে কথা বলি যাতে দু’কুলই রক্ষা পায়। স্বর্ণমুদ্রা লাভের আশায় নয়, সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনের স্বার্থেই এ কৌশল গ্রহণ করতে হয়েছে আমাকে।

তিনি আরো বললেন কি করে তোমাদের খবর দেবো এ নিয়ে আমি পেরেশান ছিলাম। তোমাকে ও তোমার সাখীদের খুঁজে বেড়াতে বাইরে গেলে তাতে সবারই জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যেতো। এ জন্য আল্লাহ নিজেই তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যেদিন থেকে আমার কাছে তুমি তালিম নেয়া শুরু করেছো সেদিন থেকেই আমার মস্তবড় একটা দুর্ভাবনা দূর হয়ে যায়।’

‘আপনি কি রাতে একাই থাকেন?”

‘হ্যাঁ, পরিস্থিতি এখন বেশ জটিল হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় আমার একা থাকা ঠিক হচ্ছে না। তার চেয়ে তুমি কেউ কিছু মনে করবে না।

জ্বি, আপনি ঠিকই বলেছেন।

গ্রামে দুশমনের তৎপরতা খুবই বেড়ে গেছে। এদের মোকাবেলা করার জন্য আমার এখন শক্তির প্রয়োজন। গ্রামে আমার কিছু ভক্ত আছে, ওরা আমার সাথে সহযোগিতা করবে। এদিকে তোমরা থাকায় সে শক্তি আরো বৃদ্ধি পেলো। কিন্তু অবস্থা যা তাতে বড় ধরনের বাহিনী দরকার হতে পারে। তাহলেই আমি বিপদে পড়ে যাবো। সীমান্তের কোন রক্ষী কমাণ্ডারের ওপর বিশ্বাস বা ভরসা করা এখন ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। শক্ররা স্বর্ণমুদ্রা ও সুন্দরী নারী দিয়ে তাদের হাত করে রেখেছে। তারা মাসিক বেতন নেয় আমাদের সরকার থেকে আর কাজ করে শক্রদের।”

সেদিন থেকে মাহমুদ বিন আহমদ তার কাছেই থেকে গেল। ইমাম সাহেব তাঁর কয়েকজন ভক্তের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাহমুদের।

কিছু দিন ধরে মিশরের পল্লী অঞ্চলে শুরু হয়েছে এক নতুন ফেতনা। গ্রামের অশিক্ষিত মূৰ্খ লোকদের কুসংস্কারকে কেরামতি দেখিয়ে সে কোমলমতি সরল লোবগুলোর ঈমান ক্রয়ের চেষ্টা করছে। ব্যবসাটা যথেষ্ট লাভজনক ; কেবল ভক্তি আর শ্রদ্ধাই নয়, দেদার মালকড়িও আসছে এতে।

এই পীর কোথাও আস্তানা গাড়ে না। আজ এখানে, কাল ওখানে ঘুরে বেড়ায়। গ্রামের লোকেরা তার পথের দিকে চেয়ে থাকে উন্মুখ হয়ে। একজন আরেকজনকে বলে, বড় কামেল পীর, আহা! কী দ্বীনদার, কত পরহেজগার। তিনি মানুষের মনের কথা পর্যন্ত বলে দিতে পারেন।’

আহা! শুধু তাই নাকি, উনি তো মানুষের ভবিষ্যতও দেখতে পারেন!

শুনেছি উনার কাছে গিয়ে কিছু বলতে হয় না? মানুষের চেহারা দেখেই নাকি সব কিছু বুঝে ফেলেন উনি। বলে দেন তার বিপদের কথা? অসুখ নিয়ে গেলে কিছু জিজ্ঞেস না করেই অসুধ দিয়ে দেন? আরেকজন জানতে চায়।

‘তো আর বলছি কি! তিনি মানুষের ভূত-ভবিষ্যত সব দেখেন, সব বলতে পারেন।

আমি তো শুনেছি তিনি মৃতকেও জীবিত করে দিতে পারেন | কেউ দেখে, কেউ না দেখেই এ পীরের ভক্ত হয়ে যায়। গ্রামের সরল মানুষগুলো তার কেরামতির কথা এমন অন্ধভাবে বিশ্বাস করে, এতটা ভয় ও ভক্তি তারা আল্লাহর কালামকেও করে না। তার কথার সত্যাসত্য যাচাই করার প্রয়োজনও মনে করে না কেউ। লোকজনের বিশ্বাস, এ পীর আকাশ থেকে নেমে এসেছে। খোদার সাথে তার সরাসরি যোগাযোগ। তার কাছে যা চাওয়া যাবে তাই পাওয়া যাবে।

পথিকরা পথ চলতে চলতে গল্প করতো এ পীরের পীর সাহেব কি কি কেরামতি দেখিয়েছে। অন্যজনই বা পেছনে পড়ে থাকবে কেন, সে আরো অবাক করা কাহিনী শোনাতো তাকে। এভাবে এ পীরের কেরামতির অদ্ভুতসব কাহিনী মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সীমান্ত এলাকার সর্বত্র।

কিছু লোক তাকে নবীর মত মানতে শুরু করল। কেউ বললো, ইনি বৃষ্টি দিতে পারেন। এভাবে আজগুবী গল্পে ভরে গেল দেশ-গ্রাম।

তারা পীর সাহেবকে এমন ভক্তি শ্রদ্ধা করতো যে, পীর পারতো। এমনকি নিজের জীবনটা দিয়ে দিতেও প্রস্তুত ছিল কেউ কেউ।

এ যাবত কেউ পীরের বিশ্বাস ও আকিদা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস করেনি। কারণ গ্রামের এ সব অশিক্ষিত মানুষরা তখনও আদিম যুগের মতই অন্ধ বিশ্বাসে বাস করত। তারা বিদ্যাবুদ্ধি থেকে বঞ্চিত ছিল বলে, যে তাদেরকে একটু আশার বাণী শোনাতে পারতো তার সামনেই সিজদায়পড়ে যেত।

এই জনগণের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। তাদের পূর্ব অভাবে সে আলোর আভা দিনে দিনে স্নান হয়ে গিয়েছিল। বাপ মুসলমান ছিল বলে তারা নিজেদেরও মুসলমান মনে করতো, কিন্তু ইসলামের সঠিক ধারনা না থাকায় যে যা বুঝায় তাকেই তারা ইসলাম বলে মনে করতে থাকে।

এসব গ্রামে মসজিদ ছিল। আল্লাহর ঘর কাবার দিকে ফিরে পাচ ওয়াক্ত নামাজও আদায় করতো অনেকে। কিন্তু ইসলামের সঠিক আকিদা ও বিশ্বাসকে জানার ও বুঝার জন্য কোন চেষ্টা ওদের ছিল না।

যেমন সমাজ তেমনি ছিল তাদের ইমাম। ইমাম সাহেব তার ইমামতি ঠিক রাখার জন্য এবং লোকদের ভক্তি শ্রদ্ধা আদায় করার জন্য নানা রকম আজগুবী ও অমূলক কথা শোনাতো মুসল্লিদের। ইমাম তাদের বললো, কুরআন এক মহাপবিত্র কিতাব, সাধারণ মানুষের উচিত নয় তা স্পর্শ করা। কুরআন পড়বেন ইমাম সাহেবরা। ইমামরা যা বলবেন, সাধারণ মানুষের উচিত সেই মত কাজ করা। তাহলেই পাবে। এটাই ইসলামের পথ, এ পথেই রয়েছে তাদের ইহ ও পরকালের মুক্তি ও কল্যাণ।

এই ইমাম সাহেবরা মানুষকে শোনাতো অদৃশ্য জগতের কথা। পরকালের নানা শাস্তি ও বিপদের কথা। তারা মানুষকে বলতো, সবকিছুরই একটা গোপন দিক আছে, আর ইসলামের যে গোপন তত্ত্ব তা কেবল ইমাম সাহেবই জানেন। মৃত্যুর পর তোমরা এক অনন্ত জীবনে প্রবেশ করবে। এ দুনিয়ার সুখ আসল সুখ নয়, পরকালের জীবনই মানুষের আসল জীবন। সেই জীবনে সফলতা লাভ করতে হলে তোমাদেরকে ইমাম সাহেবের কথা মতো চলতে হবে।’

এসব ইমামরা মানুষের মনে আল্লাহর ভয় না ঢুকিয়ে ইমামের ভয় ঢুকাতো। তারা এসব শিখেছিল সেই মহা ক্ষমতাবান পীর সাহেবের কাছ থেকে। এভাবে এই মূখ দুর্বল করে ফেলে। ফলে মানুষ ইমামদের ভয় করতে শিখল, ধর্মকে ভয় করতে শিখল। ইমামরা তাদের সত্য মিথ্যা যা বলতো, তারা তা সবই বিশ্বাস করতো।

এসব ভণ্ড ইমাম ও ইমামদের নেতা সেই ভণ্ড পীরের পাল্লায় পড়ে তারা নানা অমূলক কথা বিশ্বাস করতে লাগল। তারা বিশ্বাস করতো, অদৃশ্য শক্তি ক্ষেপে গেলে মরুভূমিতে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ অদৃশ্য শক্তির আর্তনাদ ও কান্নার শব্দ। মানুষের রোগ-ব্যাধি হয় জীন-ভূতের নজর থেকে। সাধারণ মানুষ এই অদৃশ্য শক্তিকে দেখতে পায় না। কেবল ইমাম ও পীরই পারেন এইসব ভূতপেত্নী ও অদৃশ্য শক্তিকে বশ করতে, তাদের খুশি করতে।

এভাবে একদল প্রতারক লোক মানুষের রোগ ব্যাধির চিকিৎসক হয়ে গেল। কোন হুজুর কয়টা ভূত তার কজায় রেখেছে তার ওপর নির্ভর করতো তার মর্যাদা।

আল্লাহর চেয়ে এই সব অজ্ঞাত শক্তির ভয়েই মানুষ বেশি ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। যে যতো গায়েবের ভয় দেখাতে পারতো মানুষ তার কথাই বেশি করে বিশ্বাস করতো। ফলে গ্রামের এসব অশিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত মানুষের অন্তরে ইসলামের মূল বিশ্বাস ছিল খুবই দুর্বল।

এই পীর ও পীরভক্ত ইমামরা মানুষকে কুসংস্কার ও অন্ধ। বিশ্বাসে এমনভাবে নিমগ্ন করে ফেলল, যার প্রভাব থেকে লোকজনকে মুক্ত করা এবং ইসলামের সত্য সঠিক পথে নিয়ে চাইতে পারে এ কথা তাদের জানা ছিল না। তারা বরং সেই পীর ও ইমামের আশায় বসে থাকতো, যে তার বকরীর গায়ে ফু দিলে বকরী দুধ বেশি দেবে, যার ফু দেয়া পানি খেলে তার অসুখ সেরে যাবে, যে ছুয়ে দিলে বন্ধ্যা নারীর সন্তান হবে এবং যাকে গাছের প্রথম খেজুরগুলো দিয়ে দিলে রুজি রোজগার বেড়ে যাবে।

সে যুগে দেশের সীমানা আজকের মত এত নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করা থাকতো না। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তার সাম্রাজ্যের সীমানা একটি কাগজের ওপর একে নিয়েছিলেন। তিনি হিসাব করে দেখলেন ধমীয় গোমরাহীর এই উৎপাত সীমান্ত অঞ্চলেই বেশি।।

রাষ্ট্রীয় সীমানার ব্যাপারে আইয়ুবী অবশ্য অন্য রকম ধারনা পোষণ করতেন। তিনি বলতেন, ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী সীমারেখা বলে কিছু নেই, যেখানে ইসলামী শাষন ব্যবস্থা চালু আছে সেটা ইসলামী রাষ্ট্র, আর যেখানে মানব রচিত মতবাদ চালু আছে সেটা অনৈসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য, তার অধিবাসী এবং শাসক যদি মুসলমান হয় তবুও।

মিশরের সীমান্তবতী গ্রামগুলোতে সুযোগ পেলেই খৃষ্টানরা সরাসরি আক্রমণ চালাতো। একদিন সে আক্রমণ বন্ধ করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করল। ইসলামী আদর্শের ঈমানী চেতনা নষ্ট করার জন্য তারা এক ব্যক্তিকে পীর বানিয়ে পাঠিয়ে দিল সেই সীমান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলে। এ আগ্রাসনের উদ্দেশ্য ছিল দুটাে, প্রথমত মুসলমানদের আকিদা নষ্ট করা। দ্বিতীয়ত নিজস্ব মতবাদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা।

খৃষ্টানদের প্রধান আক্রোশ ছিল কোরআনের ওপর। কারণ, কুরআন জিহাদকে মুসলমানের ওপর ফরজ করে দিয়েছে। মানুষের ওপর জুলুম, অত্যাচার হলে তা থেকে তাদের বাচানোর জন্য মুসলমানরা যে লড়াই করে, কোরআন তাকেই জিহাদ বলেছে। কোরআন মুসলমানদের ওপর এই জিহাদকে ফরজ, মানে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে।

যুদ্ধের ময়দানে মুজাহিদদের মধ্যে যে প্রচণ্ড আবেগ ও অনুপ্রেরণা দেখা যায়, তা কুরআনের এ ঘোষণারই ফল। অনুভূতি নিয়েই আসে। এ অনুভূতি তাদের অন্তরে জ্বলজ্বল করে জুলতে থাকে বলেই তারা হতে পারে এত বেপরোয়া, এত দুঃসাহসী। প্রাণের কোন মায়া নেই তাদের, কারণ কোরআন তাদের বলে দিয়েছে, মোজাহিদ কোনদিন মরে না। যে আল্লাহ তাকে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, লড়াই করতে করতে যুদ্ধের মাঠ থেকে জীবনের চূড়ান্ত কাছে। এদের বলা হয় শহীদ। আরেক দল যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে গাজী হয়ে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। ময়দান থেকে ওরা ফেরে শাহাদাতের গৌরব লাভের অপূর্ণ আকাঙ্খা নিয়ে।

গনিমতের মাল তাদের জন্য হালাল কিন্তু তারা গনিমতের মালের আশায় তারা কখনও যুদ্ধ করে না। অন্য দিকে খৃস্টানরা যুদ্ধ করে সাম্রাজ্য বিস্তারের লালসায়। যুদ্ধ জয়ের চেয়ে লুটপাটের দিকেই তাদের নজরটা থাকে বেশি।

সেই রহস্যময় পীর সম্পর্কে সীমান্তের গ্রামগুলোতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, আকাশ থেকে এসেছেন তিনি খোদার দ্বীন নিয়ে এসেছেন তিনি। তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারেন। মানুষের সেবা করার জন্য সঙ্গী সাখী নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।

যারা তাকে দেখেছে তারা বলে, হুজুরের দাড়ি উজ্জ্বল সাদা, গায়ের রং ফর্সা, মাথার চুল লম্বা ও ঢেউ খেলানো। তার টানা টানা চোখে যেন চাদের আলো, দাত মুক্তার মত। স্বচ্ছ। বীরের মত টান টান সিনা আর বলিষ্ঠ শরীর।

হুজুরের সাথে থাকে উটের লম্বা বহর আর অনেক খাদেম। মানুষ ভক্তি ভরে হুজুরকে যে নজরানা দেয় সে সব বহন করে এ উটের কাফেলা। তিনি শহর-বন্দরে যান না, দুঃখী মানুষের সেবা করার জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। গ্রামের পাশে তাবু খাটিয়ে কয়েকদিন সেখানে থাকেন। আশপাশের গ্রামের লোকদের দুঃখ দূর করে চলে যান অন্য এলাকায়।