» » দূর্গপতন

বর্ণাকার

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনা ব্যারাকে হুলস্থল পড়ে গেল। ঘুম থেকে তুলে সৈন্যদের জানানো হলো সুলতানের আগমন বার্তা ও নির্দেশ। সন্দেহভাজন অফিসারদেরকে সুলতান আইয়ুবীর হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হলো। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা ভাবাচেকা খেয়ে গেল। যেই তারা শুনল, সুলতান আইয়ুবী এসে গেছেন, অমনি তাদের বুক ধরফড় শুরু হলো।

তারা সুলতানের ঘোড়া চিনতে পারল এবং এখন তাদের করনীয় কি এ কথা ভাবার আগেই তাদের বলা হলো হেডকোয়ার্টারে সুলতানের কাছে রিপোর্ট করতে। তালিকাভুক্ত হলো, সুলতান গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছেন। আপনাদের তিনি জরুরীভাবে তলব করেছেন। আপনারা বসুন, কাজ শেষ হলেই তিনি আপনাদের সাথে দেখা করবেন।

উপস্থিত অফিসারদের কেউ এখনো সুলতান আইয়ুবীকে চোখে দেখেনি। সুলতান আইয়ুবীও এখনি অফিসারদের সঙ্গে দেখা দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি তাদেরকে এখানে ডেকে এনেছেন, যাতে সেনাবাহিনী যাত্রা করার আগ পর্যন্ত সৈন্যদের সাথে তাদের দেখা না হয় এবং কোন অফিসারের মনে কোন দুরভিসন্ধি থাকলেও তা বাস্তবায়নের সুযোগ না পায়।

তখনও ভোরের আলো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। সৈন্যদেরকে লাইন করে দাড় করিয়ে দেয়া হলো। প্রথমে পদাতিক বাহিনী, তারপরে অশ্বারোহী বাহিনী এবং তারও পিছে খাদ্য ও রসদ বহণকারী উটের কাফেলা।

সুলতান আইয়ুবী তার সেনাদের বিশেষভাবে ট্রেনিং দিয়েছিলেন। সেই ট্রেনিং অনুযায়ী জরুরী অভিযানের আহবান এলে সৈন্যরা এক ঘণ্টার মধ্যেই রসদ সামানসহ যাত্রা শুরু করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যেতে পারত।

সুলতান আইয়ুবী তার ঘোড়ার ওপর সওয়ার হলেন, তার সঙ্গে মিশরের প্রতিরক্ষা প্রধান। সুলতান আইয়ুবী সৈন্যদের এক একটি সারির সামনে দিয়ে যেতে লাগলেন এবং তাদের দেখতে লাগলেন। তার মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। তিনি সৈন্যদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগলেন, ‘সাবাস! সাবাস নওজোয়ান! হে আল্লাহর সেনাদল, তোমদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।

সুলতান সালাহউদিনের নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব ছিল। তার প্রভাব অনুভব করতো প্রতিটি সৈনিক। তাদের সঙ্গে সহাস্য বদনে কথা বলছেন তাদের আমীর ও সর্বাধিনায়ক, এ আনন্দের তৃপ্তির প্রভা ছড়িয়ে আছে প্রতিটি সৈনিকের চেহারায়। তাদের নিতে এসেছেন তাদের শ্রদ্ধেয় আমীর, এ কথা ভেবে গর্বে ফুলে উঠছিল তাদের বুক।

পর্যবেক্ষণ শেষ করে সুলতান আইয়ুবী সৈনিকদের সামনে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। সে ভাষণে যুদ্ধের জন্য উদ্বেলিত হয়ে উঠল প্রতিটি হৃদয়।

সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, হে আল্লাহর সৈনিকেরা! আল্লাহর নামে জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য হে পাগলপারা মুজাহেদিন! ইসলামের সুনাম তোমাদের অন্ত্রকে ডাকছে। সুবাকের ময়দানে তোমরা কাফেরের সুদৃঢ় দুর্গ বালির পাহাড়ের মত ধ্বসিয়ে দিয়েছো। তোমরা ক্রুসেডারদের মরুভূমিতে কবর দিয়ে নিজেদের জন্য জান্নাতুল ফেরদৌসে ক্রয় করে নিয়েছো। তোমাদের প্রিয় বন্ধুরা তোমাদের সামনে শহীদ হয়েছে। তোমরা নিজ হাতে তাদের দাফন করেছ।

সেইসব কমাণ্ডো সৈন্যদের কথা স্মরণ করো, যারা অবলীলায় শক্রর বেষ্টনী ভেদ করে ঢুকে গেছে তাদের মধ্যে এবং শাহাদাতের পেয়ালা পান করে চলে গেছে আল্লাহর দরবারে। জানাজার নামাজ পড়ার জন্যও তাদের খুঁজে পাওনি তোমরা। তাদের লাশ তোমরা দেখতে পাওনি। তোমরা একটু চিন্তা করো, সে লাশের সাথে কেমন ব্যবহার করেছিল দুশমন?

শহীদের এতিম শিশুদের কথা চিন্তা করো। তাদের বিধবা স্ত্রীদের কথা স্মরণ করো। স্মরণ করো সেই জিন্দাদিল তাদের দুনিয়াবী সব সাধ-আহলাদ, ধন-সম্পদ এবং এমনকি নিজের প্রাণটুকু।

আজ শহীদদের আত্মা তোমাদের ডাকছে যুদ্ধের ময়দানে। তোমাদের বীরত্বগাথা তোমাদের আহবান জানাচ্ছে আবার ময়দানে ঝাপিয়ে পড়তে। শক্ররা ক্রাক দুর্গের সুদৃঢ় পাঁচিলের ওপর থেকে আগুন ছুড়ে ভষ্মিভূত করেছে তোমাদের ভাইদের। তোমরা যদি সে দৃশ্য দেখতে তবে তোমরা মাথা ঠুকেই ভেঙে ফেলতে ক্রাকের দুর্ভেদ্য দুর্গ প্রাচীর।

‘হে ইসলামের নিশান বরদার! ক্রাক দুর্গের মধ্যে তোমাদের বোন ও কন্যাদের সতীত্ব নষ্ট করছে দুশমন। তোমাদের বৃদ্ধ পিতাদের থেকে পশুর মত শ্রম আদায় করা হচ্ছে। যুবকদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। মাকে তার শিশু সন্তানদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে।।

একদিন আমরা পাথরের দুর্গ ভেঙ্গেছি, আজ মাটির কেল্লা আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রাকের কেল্লার দেয়াল ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে আমি এসেছি তোমাদের কাছে।’

সুলতানের কণ্ঠে উপচে পড়া আবেগের জোয়ার। তিনি দুই হাত উর্ধে তুলে আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি, এই অপরাধে তোমরা আমার বুক তীর মেরে ঝাঝরা করে দিতে পারো, আমি কোন আপত্তি করবো না। কিন্তু আমার প্রাণ নেয়ার আগে আমি শুধু শুনতে চাই, তোমরা ক্রাকের দুর্গে ইসলামের বিজয় নিশান উড়িয়েছো। তোমাদের সতীত্ব নষ্ট হওয়া ময়ে ও বোনদের কান্না থেমে গেছে। তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে সান্তুনা দিচ্ছো তোমরা।”

শুনছিলো সেই জ্বালাময়ী ভাষণ। তাদের শিরায় শিরায় যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কেবল আরোহীরা নয়, আবেগ ও উন্মাদনায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে তাদের ঘোড়াগুলোও।

আরোহীরা সকলেই চুপচাপ। কিন্তু ঘোড়ার হেষা ও চঞ্চলতা বাড়ছিল। আরোহীরা জোরে লাগাম টেনে ধরে তাদের অস্থিরতা রোধ করছিল। জবান বন্ধ থাকলেও আরোহীদের চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল আবেগের রক্তিম আভা। সুলতান আইয়ুবীর প্রতিটি বাক্য যেন তীরের মত তাদের অন্তরে বিদ্ধ হচ্ছিল। জেহাদী জযবার বন্যা ধুয়ে মুছে ছাপ করে দিচ্ছিল তাদের মনে জমে থাকা বিদ্রোহের আগুন। সুলতান আইয়ুবীর উদ্দেশ্য সফল হচ্ছিল।

মুসলিম সাম্রাজ্যের ইজ্জত ও আবরু রক্ষীরা! তোমরা কাফেরদের মনে আতংকের ভয়ানক ঝড় সৃষ্টি করো বলে ওরা তোমাদের তলোয়ারের ধার ভোতা করতে চায়। এ জন্য তারা মদ, হাশিশ ও তাদের সুন্দরী মেয়েদের লেলিয়ে দিয়েছে তোমাদের পেছনে। তোমরা বুঝতে পারোনি, ক্রুসেডরা তাদের এক মেয়ের রূপের আগুন দিয়ে হাজার হাজার মুজাহিদের ঈমানী চেতনা পুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে। ওরা শত মেয়েকে বেহায়া বানিয়ে দিচ্ছে। আজ সময় এসেছে আমাদের মা বোন কন্যাদের সন্ত্রম রক্ষা করার। তোমরা দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যাও, তোমাদের মাতা ভগ্নি কন্যাদের মান সম্মান ইজ্জত রক্ষা করে প্রমাণ করো তোমরা মুসলিম।

তোমরা ক্রাকের রণাঙ্গণে রওনা হতে যাচ্ছে। ওখানে গেলে তোমরা দেখতে পাবে দুর্গের চারপাশে কুরআনের ছেড়া পাতা উড়ে বেড়াচ্ছে। সেখানকার মসজিদগুলো খৃস্টানরা বাথরুমে পরিণত করেছে। যে ক্রুসেডাররা তোমাদের ভয়ে সুবাক থেকে পালিয়েছিল, তারা আজ ক্রাকে বসে গলা ফাটিয়ে হাসছে। যে ঈমানের বলে সুবাক তোমরা দখল করেছিলে, সেই ঈমান ও জযবা নিয়ে এগিয়ে যাও, ক্রাকও তোমাদেরই হবে।’

সুলতান আইয়ুবী সেনাবাহিনীর ওপর এই দোষারোপ করলেন না, তারা বিভ্রান্ত হয়ে গেছে এবং তারা বিদ্রোহী বা গাদার। তিনি কারো ওপর কোন সন্দেহ করলেন না, ইশারা ইঙ্গিতেও কটাক্ষ করলেন না কাউকে। তার পরিবর্তে সৈন্যদের মনে জাগিয়ে দিলেন জেহাদী জযবা ও বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দুরন্ত সাহস।

ভোরের উত্তাপ তখনো তীব্র আকার ধারণ করেনি, কিন্তু সৈন্যদের আবেগ উত্তপ্ত হয়ে উঠল আইয়ুবীর বক্তৃতায়। অভিভূত হয়ে সৈন্যরা লক্ষ্য করলো সমস্ত সেনাদল একটি জ্বলন্ত মশালে পরিণত হয়েছে।

সুলতান আইয়ুবী এরপর কমাণ্ডারদের নিয়ে বসলেন। ‘এখান থেকে সোজা ক্রাকের পথ ধরবে না। প্রথমে সুদানের পথে কিছু দূর এগিয়ে যাবে। মরুভূমিতে নেমে যখন বুঝবে কোন অনুসরণকারী পিছু নেয়নি, তখন বাহিনীর মুখ ঘুরিয়ে দেবে ক্রাকের দিকে।’

তিনি তাদেরকে কায়রো থেকে ক্রাকের দিকে যাওয়ার এমন এক রাস্তা বাতলে দিলেন, যাতে ক্রাকের রণাঙ্গণ থেকে আসা সৈন্যদের সামনে তাদের পড়তে না হয়। ক্রাক থেকে আসা বাহিনীর যে সব অফিসারকে তিনি সঙ্গে এনেছিলেন। তাদেরকে তিনি এই বাহিনীর সঙ্গে পাঠালেন। যাত্রার পূর্বে এইসব কমাণ্ডারকে আরো কিছু গোপন নির্দেশ দিলেন।

সৈন্যরা ক্রাকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। কায়রোর আকাশ বাতাস ধ্বনিত করে আওয়াজ উঠলো, ‘আল্লাহু আকবার’। সুলতান আইয়ুবী প্রশান্ত চেহারায় খেলা করতে লাগলো কৃতজ্ঞতা ও সহমর্মিতার আবেগ।

যখন সৈন্যরা তার চোখের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন তিনি এক কাসেদকে দিয়ে কায়রোর অদূরে ক্রাক রণাঙ্গণ থেকে আগত সেনা ক্যাম্পে চিঠি পাঠালেন। কাসেদ দ্রুত রওনা হয়ে গেল ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। চিঠিতে বলা হলো, ‘পয়গাম পাওয়া মাত্র সেনাবাহিনী নিয়ে দ্রুত কায়রো চলে এসো।”

কায়রো থেকে ক্যাম্পের দূরত্ব ছিল মাত্র আট দশ মাইল। অল্প সময়ের মধ্যেই কাসেদ ওখানে পৌছে গেল। চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেনাবাহিনী রওনা হলো কায়রোর উদ্দেশ্যে। সূর্যোদয়ের ঘন্টা দুই পরে সৈন্যদের প্রথম দলটি কায়রো এসে পৌছল এরপর একে একে সব দলই কায়রো সেনানিবাসে প্রবেশ করল।

এ সৈন্যদের সেই সব সিটে থাকার ব্যবস্থা হলো, যেগুলো আজ সকালে ক্রাক অভিমুখে রওনা হয়ে যাওয়া সৈন্যরা খালি করে দিয়ে গেছে। আগত সৈন্যরা খুব উত্তেজিত ছিল। আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে শান্ত করার ব্যবস্থা করলেন। তিনি তাদের জানালেন রণাঙ্গণে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’

তারা যখন শুনল, একটু আগে বিদ্রোহের অপরাধে যাদের খুন করার জন্য তারা পাগলপারা ছিল, বিদ্রোহের পরিবর্তে সেই সব সৈনিকরা জেহাদের ময়দানে রওনা হয়ে গেছে তখন তারা তাদের ভুল বুঝতে পারল এবং সুলতান আইয়ুবীর বিচক্ষণতায় অভিভূত হয়ে গেল।

আলীর সহযোগিতায় এভাবেই সুলতান আইয়ুবী সুকৌশলে মিশরে সেনা বিদ্রোহের পথ বন্ধ করলেন এবং সেনা বিদ্রোহের কারণে মিশরে গৃহযুদ্ধের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তা নিঃশেষ করে দিলেন।

কিন্তু সুলতানের কাছে সমস্যার কোন অভাব ছিল না। একটি সমস্যা থেকে তিনি মুক্তি পেলেন ঠিকই, কিন্তু আরো অসংখ্য সমস্যার পাহাড় তাঁর মাথায় বোঝা হয়ে রইল। তিনি উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারদের ডেকে সেনাবাহিনীকে নতুন করে বিন্যাস করতে বললেন।

এরপর ডাকলেন প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানকে। তার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, সীমান্ত রক্ষীরা কোথায় কি পরিমাণ আছে?

প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধান সুলতানের কাছে সীমান্ত এলাকার বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করল। সুলতান বললেন, বিভিন্ন জায়গায় আরো সৈন্য পাঠাও। তিনি কোথায় কত সৈন্য পাঠাতে হবে সব বুঝিয়ে দিলেন তাকে।

সুলতানকে বলা হয়েছিল, সীমান্ত রক্ষীরা দেশের সম্পদ আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানের কাছ থেকে সীমান্তের দুনীতিপরায়ণ কমাণ্ডারদের তালিকা নিলেন এবং তাদেরকে সীমান্ত এলাকা থেকে প্রত্যাহার করে কায়রো আসার পরিবর্তে ক্রাকের যুদ্ধ সেক্টরে যোগ দেয়ার হুকুম দিলেন।

সেনা বিদ্রোহ দমন এবং গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা নাকচ করার পরও সুলতান আইয়ুবীর সামনে কয়েকটি গুরুতর সমস্যা রয়েই গেল। যেমন, ক্রাক থেকে ফিরে এলেও ক্রাক জয়ের চিন্তা তাঁর মাথায় রয়েই গেল। ওদিকে সুদানের রণাঙ্গণে ভাই তকিউদ্দিন যে গ্যাঁড়াকলে আটকে পড়েছে তাকে উদ্ধার করার কঠিন দায়িত্বও তাকেই পালন করতে হবে। গোয়েন্দা প্রধানের রিপোর্ট অনুযায়ী মিশরের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে এ মুহুর্তে তাকে আরো কয়েকটি কাজ করতে হবে।

প্রথমত, কায়রোয় খৃস্টানরা যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করেছে এবং যে আগ্রাসনের ফলে মুসলিম তরুণ ও যুব সমাজে ইতিমধ্যেই ব্যাপক ধ্বস নেমে এসেছে তার সয়লাব রোধ করা।

দ্বিতীয়ত সীমান্তের সেনা বিভাগে যে ফুটাে সৃষ্টি হয়েছে সে ফুটো বন্ধ করে সীমান্তের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করা।

তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে ভয়ংকর ও জটিল সমস্যা হচ্ছে সীমান্তবতী অঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলোতে যে ধর্মীয় ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার মোকাবেলা করা। কাজ অনেক, কিন্তু সময় কম।

আইয়ুবী অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করলেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করলেন। বিশেষ করে মিশরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তিনি যে যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন তা দেখে তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব এবং একান্ত বিশ্বস্ত ভক্ত অনুরক্তরাও চমকে উঠল।

গত রাতে ক্রাকের রণাঙ্গন থেকে আসা বাহিনীকে কায়রো থেকে আট দশ মাইল দূরে অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে ফিরে এসেই সুলতান আইয়ুবী গোয়েন্দা বাহিনী প্রধান আলী বিন সুফিয়ান এবং পুলিশ বাহিনী প্রধান গিয়াস কামালের দেয়া রিপোর্ট নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকেছিলেন এবং দরজা বন্ধ করে গভীর মনোনিবেশ সহকারে তা পাঠ করেছিলেন। এইসব রিপোটে ইতিমধ্যে সীমান্তের কোন কোন সেনা অফিসার ও কমাণ্ডার খৃস্টানদের খপ্পরে পড়ে গেছে তার বিস্তারিত তালিকা ছিল।

আরেকটি তালিকায় ছিল প্রশাসনের সেই সব উচ্চ পদস্থ অফিসার ও কর্মকর্তাদের নাম ঠিকানা, যারা খৃষ্টানদের বন্ধুত্ব কবুল করে নিয়েছিল এবং খৃষ্টানদের অর্থ, নারী ও মদের প্রভাবে নৈতিক অধপতনের শিকার হয়েছিল। এই তালিকায় এমন সব ব্যক্তিদের নামও ছিল, যারা রাষ্ট্রের মজলিশে শুরা এবং প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি।

সারারাত ধরে খুটিয়ে খুটিয়ে তিনি প্রতিটি নাম পরীক্ষা করলেন। ভোরে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মিশরের বাহিনীকে ক্রাকে পাঠিয়ে দিয়ে এবং অন্য দলকে সীমান্তে প্রেরণ করে অতর্কিত অপারেশন চালিয়ে গ্রেফতার করলেন রাষ্ট্রের ও প্রশাসনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে। তাদের মধ্যে দুই তিনজন কেন্দ্রীয় মজলিশে সুরার সদস্য এবং উচ্চ পর্যায়ের সচিবও ছিলেন।

তাদের বাড়ী থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ, স্বর্ণ, মনিমুক্তা ও মূল্যবান বিদেশী সামগ্ৰী উদ্ধার হলো। প্রত্যেকের বাড়িতে পাওয়া গেল ইহুদী এবং খৃষ্টান মেয়ে। তাদেরও থেকেও অনুরূপ মালপত্র, মেয়ে এবং চাকর-চাকরানী বেশে লুকিয়ে থাকা সুদানী, ইহুদী এবং খৃষ্টান গোয়েন্দাদের উদ্ধার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতদের কোন রকম জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই কারাগারে প্রেরণ করা হলো। সুলতান আইয়ুবী কারারক্ষীকে আদেশ দিলেন, ‘এরা কেউ রাজবন্দীর মর্যাদা পাবে না। এরা সবাই রাষ্ট্রীয় ক্রিমিনাল, কারাগারে ক্রিমিনালদের সাথে যে ব্যবহার করা হয় এদের সাথেও সেই ব্যবহারই করবে।’

এই গ্রেফতারীর ফলে কেন্দ্রীয় কমাণ্ড কাউন্সিল ও মজলিশে শূরার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য হয়ে গেল। এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে মিল্লাতে ইসলামিয়ার সেবা করে যাচ্ছিলেন। সমাজে তারা আইয়ুবীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হিসাবে পরিচিত এবং সম্মানিত ছিলেন। বিভিন্ন পদে কেউ কেউ এমনও ছিলেন যাদের কোন বিকল্প নেই বলে মনে করা হতো। কিন্তু গোয়েন্দা বিভাগের সুস্পষ্ট অভিযোগের ফলে এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গ্রেফতারের ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত ও দ্বিধাৰিত হলেন না।

এই গ্রেফতারী তৎপরতা শেষ করতে মাত্র ঘন্টা দুই সময় নিলেন তিনি। দুপুরের আগেই সমুদয় কাজ শেষ করে তিনি যখন খেতে এলেন তখন কোন কোন উপদেষ্টা উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বললেন, ‘সুলতান! যে ভয়ংকর পদক্ষেপ আপনি নিলেন এর পরিণতি কি হবে তাই ভাবছি আমরা। আমাদের এখন যে কোন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’

সুলতান উপস্থিত উপদেষ্টাদের দিকে তাকালেন। বললেন, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতীক্ষা ও বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে ইসলামী সাম্রাজ্যের এই ভিত গড়ে তুলেছিলাম, দীর্ঘদিনের সেইসব পরীক্ষিত বন্ধু ও সার্থীদের নিজ হাতে প্রেফতার করে কারাগারে পাঠাতে আমার চেয়ে আর কারো বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন যেখানে ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থের, সেখানে ব্যক্তিগত অনুভূতির কোন মূল্য নেই। এর পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে বলে আপনারা যে আশংকা করছেন আমি সে আশংকা উড়িয়ে দেই না। কিন্তু আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ব্যক্তি যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, সে যখন মূল স্রোতধারা থেকে ছিটকে পড়ে তখন সেখানে আর কোন স্রোত থাকে না। ডোবার পানির মতই তখন তা বন্ধা ও দূষিত হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে তার স্থলে নতুন করে যিনি দায়িত্বে আসেন, যদি তার যোগ্যতা আগের ব্যক্তির তুলনায় কিছু কমও হয়, কিন্তু তার মধ্যে থাকে ঈমানের মজবুতি, দায়িত্বে আন্তরিক ও নিবেদিতপ্রাণ, তবে আল্লাহর রহমত তার সেই ঘাটতি পূরণ করে দেয়। কোন গাড়ি তার লাইনে ঠিক ভাবে চলতে থাকলে কেবল ড্রাইভার বদলের কারণে তার চলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই।’

এরপর সুলতান আইয়ুবী আক্রমণ চালালেন সেই নাজুক অঙ্গনে, যেখানে আক্রমণ চালাতে পৃথিবীর সকল কালের সকল শাসক অসংখ্যবার চিন্তা ভাবনা করে নেন। সবকিছু জেনেশুনেও যেখানে আঘাত হানতে সাহস পান না অনেক শাসকই। ধর্মের নামে নানা কুসংস্কার তারা মুখ বুজে সয়ে নিতে কিছুতেই রাজি হন না।

সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর চরিত্রে কোন অস্পষ্টটা ও আপোষকামীতা ছিল না। ফলে ইসলামের নামে মুসলিম সমাজে যে ধর্মীয় ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সেখানে দ্বিধাহীন চিত্তে আঘাত হানলেন তিনি।

সুলতান আইয়ুবীর উপদেষ্টারা অত্যন্ত খালেছ দীলে সুলতানকে এ পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘ধর্ম একটি নাজুক ও সেনসেটিভ ব্যাপার। আপনি কোন মসজিদের ইমামের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে তার মুসল্লিরা ক্ষেপে যাবে আপনার বিরুদ্ধে। কোন খানকা বা পীরের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে ক্ষেপে যাবে তার ভক্ত ও মুরীদরা। ধর্মীয় ব্যাপারে সরাসরি পদক্ষেপ নেয়ার মধ্যে প্রচণ্ড ঝুঁকি আছে।’

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এদের সংখ্যা কত যারা ধর্মের প্রাণ বলে গণ্য? জনগণ কেন তাদের মুরীদ হয় এ কথা কখনো ভেবে দেখেছেন? তারা মানুষকে ইসলামের দিকে যত না আহবান করে তার চেয়ে বেশি প্রচেষ্টা চালায় তাকে মুরীদ বানাতে। আমি জানি, এই জাতীয় ইমাম ও পীরেরা তাদের শ্ৰেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে গিয়ে লোকদেরকে ধর্মের মূল বিষয় থেকে দূরে রাখে।

মুসলিম জাতির মূল শিক্ষাকেন্দ্র হলো মসজিদ। মসজিদের চার দেয়ালের মাঝে বসে যাই শোনানো হোক, তাই মানুষের অন্তরে বসে যায়। এটা হয় মসজিদের পবিত্রতার গুণে। আল্লাহর ঘরকে যা্রা আল্লাহর শ্ৰেষ্ঠত্ব ঘোষণার কাজে ব্যবহার না করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষনার কাজে ব্যবহার করবে তাদের হাতে আমি জাতিকে তুলে দিতে পারি না। মসজিদের ইমাম হবেন তিনি, যিনি ইসলামের সঠিক শিক্ষা জনগণের সামনে তুলে ধরবেন। কিন্তু জনগণের মধ্যে ভুল আকীদা বিশ্বাস তুলে ধরা ব্যক্তি যত সম্মানিতই হোক, যত বড় পীর, বুজুর্গ ও মুর্শিদ হিসাবে পরিচিতি লাভ করুক, ইসলামের স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।’

তিনি আরো বললেন, যদি আজ মসজিদে সঠিক দ্বীনী চেতনা সম্পন্ন আলেম ও ইমাম না রাখি, তবে কিছুকাল পরে লোকেরা ইমাম ও পীরদেরই পূজা শুরু করে দেবে। একদিন এই মূৰ্খ আলেম ও আমলবিহীন ইমামরাই ইসলামের ধ্বংসের কারণ হয়ে যাবে।’

সুলতান আইয়ুবী প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম জয়নুদ্দিন আলী বিন আল ওয়ায়েজকে তাঁর নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করলেন। এই মশহুর আলেম তাঁর ছাত্রদের দিয়ে একটি নিজস্ব গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে বিশেষভাবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতেন। তাঁর ছাত্ররা বড় বড় মাদ্রাসায় শিক্ষক হতেন, নামকরা মসজিদের ইমাম হতেন এবং নিয়মিত তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতেন।

তার গোয়েন্দা বিভাগ একবার খৃস্টানদের একটি বড় চক্রান্ত উদ্ঘাটন করে প্রশাসনকে সতর্ক করেছিল। প্রশাসন তদন্ত করে দেখল, ঘটনা সত্য। সাথে সাথে এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হলো। ফলে মুসলমানরা ভয়াবহ এক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেলো।

তিনি ধর্মের নামে সারা দেশে যে সব নিত্য নতুন ফেতনা তৈরী হতো তার খোঁজ রাখতেন এবং নিজের সামর্থ অনুযায়ী তার মোকাবেলা করার চেষ্টা করতেন।

তিনি সুলতান আইয়ুবীকে বললেন, যদি এখনই আপনি ধর্মের সর্বনাশকারী এইসব ফেতনার কবল থেকে ইসলামকে মুক্ত না করেন তবে ভবিষ্যতে আপনাকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। তখন আল্লাহর কালামের পরিবর্তে এই সব তথাকথিত ধর্মীয় নেতাদের আদেশকেই জনগণ ইসলামী আইন বলে ধরে নেবে। খৃষ্টানরা এরই মধ্যে মুসলমানদের মনে সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিপূজাকে ইসলামের অঙ্গ বানিয়ে ফেলেছে। ফেতনাবাজরা কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে, কেউ জেনে, কেউ না জেনে খৃস্টানদের পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। অতএব, এদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা বা দেরী করার কোন অবকাশ নেই।’

আল্লামা জয়েনউদ্দিনের পরামর্শের প্রেক্ষিতে সুলতান আইয়ুবী এক জরুরী ফরমান জারী করলেন। এ ফরমানে জয়নুদ্দিন আলী বিন আল ওয়ায়েজের নেতৃত্বে দেশের হাক্কানী আলেমদের সমন্বয়ে ইমাম নিয়োগ বোর্ড গঠন করা হলো। দেশের সমস্ত মসজিদের ইমামদের ইসলামী জ্ঞান সম্পর্কে এ বোর্ড পরীক্ষা গ্রহণ করবে। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের আমল আখলাক ও নিজ পরিবারে কি ধরনের ধর্মীয় অবস্থা বিরাজ করছে বোর্ড তা তদন্ত করে দেখবে। তদন্ত কমিটির রিপোটের ভিত্তিতে এবং সুপারিশক্রমে সারাদেশের সকল মসজিদের ইমাম নতুন করে নিযুক্ত হবে।”

আল্লামা জয়েনউদ্দিন নতুন ইমাম নিযুক্তির ব্যাপারে নিম্নোক্ত শর্ত আরোপ করলেন। যিনি ইমাম হবেন:

১. তিনি অবশ্যই ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী হবেন।

২. তিনি প্রয়োজনীয় সামরিক জ্ঞান ও ট্রেনিং প্রাপ্ত হবেন।

৩. তাঁর আমল স্বচ্ছ, পরিষ্কার ও অনুকরণীয় হতে হবে।

৪. তাঁর পরিবারে ইসলামী আমল আখলাক থাকতে হবে।

৫. তিনি কখনোই খৃস্টানদের মত ‘ধর্ম ও জীবন আলাদা তার মুসল্লিদের এ শিক্ষা দেবেন না। বরং ইসলাম যে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা এ সত্য তুলে ধরবেন।

৬. প্রতিটি মুমীনের অন্তরে শাহাদাতের তামান্না ও জেহাদী জযবা সৃষ্টির ব্যাপারে সর্বদা সজাগ থাকবেন।

সাদিয়া প্রতিদিন দুই বেলা মসজিদের ইমামের জন্য খাবার নিয়ে আসে। মাহমুদ বিন আহমদও ধর্মীয় শিক্ষা লাভের কথা বলে সেখানেই অবস্থান করতে থাকে। ইমামের সাথে মাহমুদের খাবারও নিয়ে আসে সাদিয়া। অনেক কথা হয় তাদের। সময় পেলেই মাহমুদ চলে যায় সেই চারণভূমিতে, যেখানে সাদিয়া বকরী ও উট চরায়।

জায়গাটা গ্রাম থেকে বেশ একটু দূরে। স্থানটি সবুজ শ্যামলে ভরা। সেখানে পানির ব্যবস্থা আছে, আছে উচু নিচু মাটির ঢিবি। সেখানে দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কেটে যায় তাদের। মাহমুদ একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দার চোখ দিয়ে সাদিয়াকে অনেক পরীক্ষা করেছে, কিন্তু শক্রদের সাথে তার কোন দূরতম সম্পর্কও আবিষ্কার করতে পারেনি।

এখন তাদের অবস্থা এমন, সাদিয়া মাহমুদকে তার মোহাফেজ মনে করে। সে বিশ্বাস করে, মাহমুদ তাকে কাফেরের হাত থেকে রক্ষা করবে। আর মাহমুদের অবস্থা হচ্ছে, তার ঘাড়ে চেপে আছে দায়িত্বের বোঝা। নইলে যে কোন সময় সাদিয়াকে নিয়ে সে পালিয়ে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু একজন মুজাহিদ রাষ্ট্ৰীয় দায়িত্বের চাইতে ব্যক্তিগত সমস্যাকে কখনো বড় করে দেখে না। ফলে সাদিয়াকে নিয়ে তার পালিয়ে যাওয়াও হয়না।

তাছাড়া আরো একটি বিষয় মাহমুদ ভেবে দেখেছে। সাদিয়ার বিষয়টি মসজিদের ইমাম সাহেব জানেন। তিনি উর্ধতন গোয়েন্দা অফিসার এবং এ অঞ্চলের দায়িত্বশীল কর্মকতা। তার নির্দেশেই সে এ মসজিদে আছে। সাদিয়ার সমস্যা নিয়ে তিনিও পেরেশান। সাদিয়ার হেফাজত করাকে তিনি তার ঈমানী ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসাবে নিয়েছেন। অতএব সাদিয়ার কোন বিপদ দেখা দিলে তিনি তার মোকাবেলা অবশ্যই করবেন। ফলে সাদিয়াকে নিয়ে মাহমুদের খুব বেশি দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে।

একদিন রাতে সহসা গ্রামে আলোর ছড়াছড়ি দেখা গেল। অন্ধকার ভেদ করে অপূর্ব সব দৃশ্য দেখা যেতে লাগলো গ্রাম জুড়ে। লোকজন ছুটাছুটি করতে লাগলো মশাল হাতে। সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ল অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য। প্রত্যেকের মুখে একই কথা, তিনি আসছেন! আকাশ থেকে নেমে আসছেন জামানার পীর। তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারেন। মানুষের অসুখ সারাতে পারেন। তিনি সব অভাব দূর করতে পারেন! মানুষের মনোবাসনা পূরণ করতে পারেন। তিনি আসছেন!

গ্রামের প্রতিটি মানুষ খুশি। তারা বলাবলি করতে লাগল, আমাদের আশা পূরণকারী আসছেন!

রাতের আঁধারের তোয়াক্কা না করেই সাদিয়া দৌড়ে গেল মসজিদে। মাহমুদকে বললো, শুনেছো, তিনি আসছেন! তুমি জান আমি তার কাছে কি চাইব? আমি তার কাছে আরজ করে বলবো, মাহমুদ যেন শীঘ্রই এখান থেকে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যায়।।

মাহমুদ এ কথার কোন উত্তর দিল না। কেন যেন এ পীরের কাছে কিছু চাইতে তার মন সায় দিচ্ছে না। তার বিবেক, বুদ্ধি, শিক্ষা বলছে, এর মাঝে কোথায় যেন একটু ফাঁক আছে। লোকটির আচরণ রহস্যময়, যদিও সবাই তাকে পয়গম্বরের মত ভক্তি করে।

মাহমুদ এ অঞ্চলে আসার পর রহস্যময় পীরের এই প্রথম আগমন। তার কেরামতি ও মোজেজার কাহিনীতে তাই এখন মুখর এ অঞ্চল। মাহমুদ বলল, বাড়ি যাও, রাতের আঁধারে মেয়েদের এভাবে একাকী বাইরে বেরোনো ঠিক নয়।’

সাদিয়াকে এগিয়ে দিতে বাইরে বেরিয়ে এল মাহমুদ। তাকিয়ে দেখল, যে প্রান্তরে সাদিয়া বকরী চরায় সেখানে অনেক মশাল। ওখান থেকে ভেসে আসছে লোকজনের শোরগোল ও কোলাহল। সাদিয়াকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে মাহমুদ এগিয়ে গেল সেদিকে।

ওখানে পৌছে সে দেখতে পেল অনেক অপরিচিত লোকের ভীড় সেখানে। এই ভীড়ের মধ্যে সে তার দুজন সহকমীকেও দেখতে গেল। এ দুজনের ডিউটি এ অঞ্চলে ছিল না, অন্য অঞ্চল থেকে এরা এসেছে। মাহমুদ তাদের জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা এ এলাকায় এসেছো কেন?’

‘আমরা পীর সাহেবকে এক নজর দেখতে এসেছি।

মাহমুদ ওদের সাথে আলাপ করে বুঝলো, গোয়েন্দা হিসেবে নয়, পীরের প্রতি ভক্তিবশত ওরা তাকে দেখতে এসেছে।

তারা পীরের কেরামতির নানা কাহিনী মাহমুদের কাছে বলতে লাগলো। তাদের কথায় মাহমুদ বুঝলো, এরা দু’জনেই রহস্যময় পীরকে সঠিক ও কামেল পীর বলে বিশ্বাস করে। মাহমুদ চিন্তা করতে লাগলো, আলী বিন সুফিয়ানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দারাও তার ভক্ত হয়ে গেছে। তবে কি তিনি আসলেই কোন কামেল দরবেশ?

পরদিন ভোর। ফজর পড়েই মাহমুদ দ্রুত সে প্রান্তরে গিয়ে হাজির হলো। প্রতিদিন সাদিয়া এ প্রান্তরে বকরী ও উট চরায়। মাহমুদ এসে তার সাথে দেখা করে, গল্প করে সময় কাটায়। কিন্তু আজ এখানে অনেক অপরিচিত লোকের ভীড়। লোকজন ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলাফেরা করছে। তাবু খাটানোর সামগ্রী পড়ে আছে এখানে ওখানে। দু’জন লোককে সামনে পেয়ে মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো, এখানে কি হচ্ছে?”

একজন জবাব দিল, ‘পীর সাহেব এখানে থাকবেন, এ জন্য এ জায়গা আমরা পরিষ্কার করছি।

মাহমুদ দেখলো, একটু দূরে এক টিলার পাশে গর্ত করছে কয়েকজন লোক। মাঠের উচু নিচু জায়গা যতটা সম্ভব কেটে সমান করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট একটা এলাকায় সীমানা খুটি বসানো হচ্ছে। ওখানে এখন বাইরের কারো যাওয়ার অনুমতি নেই। |

গ্রামের লোকেরা কাজকর্ম ফেলে সেখানে জড়ো হয়ে তামাশা দেখতে লাগলো। অচেনা লোকগুলো ঘুরে ঘুরে ওদের কাছে পীর সাহেবের কেরামতির গল্প করতে লাগলো। লোকেরা এইসব গল্প শুনে আনন্দে পুলকিত হচ্ছিল, উত্তেজনার রোমাঞ্চ অনুভব করছিল। লোকজন ওদের প্রশ্ন করতে লাগল, পীর সাহেব কখন আসবেন?’

এ প্রশ্নের জবাবে লোকগুলো বলল, তিনি যে কোন সময় চলে আসবেন।’

সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকেরা পীর দর্শনের উত্তেজনা নিয়ে সেখানে দাড়িয়ে থাকল। কিন্তু তিনি এলেন না।

পরদিন ভোর হওয়ার সাথে সাথেই লোকেরা আবার সেখানে গিয়ে ভীড় করলো। আগের ঘেরাও করা এলাকার বাইরে আরও একট বড়সর জায়গা ঘেড়াও করা হয়েছে। লোকজনকে সে ঘেরাও করা সীমানার বাইরেই থামিয়ে দেয়া হলো। উৎসুক জনতা গভীর আগ্রহ নিয়ে ওদের কাজকর্ম দেখতে থাকলো। বিকাল থেকে পীর সাহেবের লোকদের আনাগোনা ও সমাগম বাড়তে লাগল। কিছু কিছু লোক এলো উটের পিঠে চড়ে। সে সব উটের পিঠে মালপত্র বোঝাই করা। তারা উট থেকে নেমে মাল-সামান নামানো শুরু করলো। আরেকদল সেইসব মালপত্র, তাবুগুলোতে নিয়ে যেতে থাকলো। *.

সন্ধ্যা পার হয়ে রাত গভীর হতে লাগলো। মাঝ রাতেরও বেশ পরে আকাশে চাঁদ উঠলো। সেই চাদ পশ্চিম দিকে গড়িয়ে যেতে থাকলো। রাতের শেষ প্রহর। ক্ষীণ চাঁদ অনেক পথ অতিক্রম করে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকলো। চাঁদের আলো ঘোলাটে হয়ে এল। লোকজন বলাবলি করতে লাগলো, “এই বার তিনি আসমান থেকে নেমে আসবেন। দেখা দেবেন ভক্তদের ‘

তারা এসব বলাবলি করছিল, কারণ পীরের খাদেমরা আঁধারীতেই তিনি নিজেকে ভক্তদের সামনে হাজির করেন।’ কিন্তু আজও তিনি দেখা দিলেন না।

পরদিন দিনভর লোকজন পীরের লোকদের সাথে গল্প করে কাটালো। সন্ধ্যার পর আজ আর কেউ বাড়ি গেল না। তারা গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগল পীর সাহেবের লোকদের কাজকর্ম, আর অপেক্ষা করছিল, কখন পীর সাহেব তশরিফ আনবেন!

সারাদিনের কাজের পর গ্রামের মেয়েরা রাতে একটু অবসর পেল। সেই অবসরে দল বেঁধে ওরা গেল সেই তামাশা দেখতে |

মাঠের একদিকে গ্রামের মেয়েরা জটলা বেধে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্ধকারে কেউ কাউকে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিল না। সেই মেয়েদের সাথে মিশে সাদিয়াও দাড়িয়েছিল ওখানে। তাকিয়ে ছিল পীর সাহেবের জন্য ঘেরাও করা জায়গার দিকে। ওখানে অনেকগুলো মশালের আলো জ্বলছে।

ওরা ভাবছিল, গতকাল যখন পীর সাহেব আসেননি, তখন আজ নিশ্চয়ই আসবেন। ওরা পীর দর্শনের গভীর প্রত্যাশা নিয়ে ঘেরাওয়ের বাইরে দাঁড়িয়েই রইল। কিন্তু ওদের কারো জানা ছিলনা, একটু পর কি ঘটনা ঘটবে।

দু’জন অচেনা লোক পিছন থেকে মেয়েদের দিকে এগিয়ে গেলো। দু পাশ থেকে এলো দু’জন করে মোট চারজন। মেয়েরা তাদের আগমন খেয়াল করেনি। ওদের কাছে এসে তারা চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো, এই, তোমরা এখানে কি করছো? সরো, সরে যাও এখান থেকে।

অন্ধকারে মেয়েরা হুড়োহুড়ি শুরু করল। একজন আগন্তুক ছোট একটা মশাল ধরিয়ে তাড়া করলো মেয়েদের। মেয়েরা ভয়ে চিৎকার চেচামেচি করে এদিক ওদিক পালাতে লাগলো। লোকটার মশালের আলোয় বাকী পাঁচজন মেয়েদের মধ্যে কাউকে খুঁজতে শুরু করলো। হঠাৎ একজন সাদিয়াকে দেখতে পেয়ে আস্তে চিৎকার দিল; এই এদিকে।

লোকগুলো খোঁজাখুজি বাদ দিয়ে ছুটে এল সেই চিৎকার লক্ষ্য করে। এই হট্টগোলের মধ্যে একজন সাদিয়ার ওপর একটা কম্বল ছুড়ে মারল। কালো কম্বলের নীচে ঢাকা পড়ে গেল সাদিয়া এক লোক দ্রুত কম্বল ঢাকা সাদিয়াকে তার শক্ত বাহু দিয়ে পেচিয়ে ধরে অন্য হাতে মুখ চাপা দিয়ে তাকে কাঁধের ওপর উঠিয়ে নিল।

একে তো অন্ধকার, তার ওপর মেয়েরা সবাই পালিয়ে যাওয়ার হুড়োহুড়িতে ব্যস্ত থাকায় কেউ খেয়ালই করল সাদিয়াকে কেউ অপহরণ করছে।