বর্ণাকার

ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত রোদের তীব্রতা ছড়িয়ে সূর্য উঠল ক্রাক দুর্গের চারপাশে। মরুভূমির বালুতে ছড়িয়ে পড়ল প্রচণ্ড উত্তাপ। সংকল্পে অটল উভয় বাহিনী। খৃষ্টানরা শপথ নিয়েছে মেরীর নামে, এবার আইয়ুবিকে তারা কিছুতেই রেহাই দেবে না, জীবন নিয়ে ফিরতে দেবে না আইয়ুবীর একজন সৈনিককেও। সংকল্পে অটল সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীও। তাঁর শপথ, যে কোন মূল্যে ক্রাক দুর্গ সে দখল করবেই। ক্রাকের মুসলমানদের ওপর যে জুলুম করা হচ্ছে তার অবসান ঘটাতে না পারলে তাঁর আত্না কিছুতেই শান্তি পাবে না।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খৃস্টানদের দুর্ভেদ্য দুর্গ ক্রাকের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানলেন। তীব্রগতিতে ঝাপিয়ে পড়লেন দুর্গ রক্ষীদের ওপর। তাঁর ক্ষীপ্রতা ও দুঃসাহস দেখে স্তম্ভিত গয়ে গেল খৃস্টান সৈন্যরা। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের তীর প্রাচীর রক্ষীদের গায়ে আঘাত হানার আগ পর্যন্ত খৃস্টানরা বুঝতেই পারল না, তারা আক্রান্ত হয়েছে।

গোয়েন্দা বিভাগ সুলতান আইয়ুবীকে আশ্বাস দিয়েছিল, তিনি দুর্গে আঘাত হানলে ক্রাক শহরের মুসলমানরা ভেতর থেকে সহায়তা দেবে তাদের। সুলতান আইয়ুবীর যে সব কমান্ডো আগেই শহরে প্রবেশ করেছিল। তারাও ভেতর থেকে দুর্গের দেয়াল ভেঙে সুলতানের অভিযানকে সফল করতে সহায়তা দেবে।

ক্রমাগত চারদিন বিরতিহীন লড়াই চললো উভয় পক্ষে। জয়-পরাজয় এখনো অনিশ্চিত। সুলতান যত তীব্র থেকে তীব্রতর করছে আঘাত, প্রতিরোধও ততই তীব্র হচ্ছে।

অবরোধের পঞ্চম দিন। গোয়েন্দা এসে সুলতান আইয়ুবীকে সংবাদ দিল, ‘কয়েকজন মুসলমান ভেতর থেকে শহরের দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আফসোস! সফল হওয়ার আগেই তারা সবাই শহীদ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে কয়েকজন মেয়েও ছিল। সবচে অবাক ব্যাপার হচ্ছে, এদের মধ্যে একজন খৃস্টান মেয়েও ছিল। গোয়েন্দা আরও জানালো, তাদের এ বিপর্যয়ের মূল কারণ ছিল বিশ্বাসঘাতকতা। এ দলের মধ্যে একজন মুসলমান খৃস্টানদের গুপ্তচর ছিল। সে এ অভিযানের সংবাদ খৃস্টানদের জানিয়ে দেয়ার ফলেই শত্রুরা গোপনে ওঁৎ পাতার সুযোগ পায় এবং দলটি দেয়ালের কাছে পৌঁছলে অতর্কিতে তাদের ঘেরাও করে ফেলে। মুজাহিদরা প্রাণপণ মোকাবেলা করে একে একে সকলেই শহীদ হয়ে যায়, কিন্তু কেউ ময়দান ছাড়েনি। তাদের অভিযান ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর খৃস্টানরা আরো সতর্ক হয়ে যায় এবং শহরের প্রতিটি গলিতে গোয়েন্দা লাগিয়ে দেয় যাতে মুসলমানদের যে কোন তৎপরতা সম্পর্কে তারা জানতে পারে। ফলে এখন ভেতর থেকে দেয়াল ভাঙার আশা করা বৃথা।’

এ খবরে মুসলমানদের আশা নৈরাশ্যে রূপান্তরিত হওয়ার উপক্রম হল। ঘটনা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকলো না। খৃস্টানরা যখন মুসলমান যুবক ও যুবতীদের লাশগুলো সনাক্ত করতে পারল তখন টাটা বুঝতে পারলো, মুসলমান যুবক ও যুবতীরা জীবন বাজি রেখে আইয়ুবীকে মদদ দিতে এক পায়ে খাড়া। তারা তখন মুসলমানদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশী চালালো। মুসলিম যুবক-যুবতীদের এলোপাথারি ধরাপাকড় শুরু করলো। ধরাপাকড়ের সময় তারা মেয়েদেরকেও রেহাই দিল না। কেবলমাত্র বুড়োদেরকেই তারা নিজেদের ঘরে থাকার সুযোগ দিল। যুবকদেরকে ধরে এনে পাঠাল বেগার ক্যাম্পে আর যুবতীদেরকে দুর্গের সেনা ব্যারাকে নিয়ে বন্দী করে রাখলো। এই মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যা করে সম্ভ্রম বাঁচালো, বাকীরা শিকার হলো সৈনিকদের অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারে।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী গোয়েন্দার রিপোর্ট মনোযোগ দিয়ে শোনলেন। দুঃখ ও বেদনায় হাহাকার করে উঠলো তার হৃদয়। মুসলমানদের এমন কঠিন মূল্য ও কুরবানীর জন্য তাঁর নিজেকেই দায়ী বনে মনে হলো। মনে হলো, সে যদি এ অভিযান শুরু না করতো তবে শহরের মুসলমানদের এখুনি এ দুঃসহ পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।

নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদদের আত্মত্যাগের এ কাহিনী শুনে তিনি মনে মনে বললেন, এই দুঃখজনক ঘটনা পেরেছে কেবল একজন মুসলমানদের গাদ্দারীর কারণে। একজন গাদ্দার মুসলিম মুজাহিদদের এত বড় একটি দলকে অবলীলায় ধংস করে দিল। তিনি আফসোস করে বললেন, মুসলমানদের মধ্যে সবসময় এমন কিছু লোক থাকে যারা আল্লাহর পথে জীবন কুরবানী করে জীবনকে সফল করতে চায়। আবার কিছু মুসলমান এমনও থাকে যারা আল্লাহর ওপর তাদের যে ঈমান আছে সেই ঈমানকে কাফেরের পদতলে বিসর্জন দিয়ে জীবনকে বুরবাদ করে দেয়। স্বার্থের ফাঁদে আটকে পড়ে তারা ইসলামকে ক্ষতি করতে চায়। এই গাদ্দাররাই ইসলামের ইতিহাসের সবচে বড় দুশমন।

গাদ্দারদের কথা মনে হতেই সুলতান আইয়ুবীর চেহারায় ফুটে উঠল সীমাহীন ক্রোধের আগুন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে অন্য হাতে আঘাত করে বললেন, ‘যে কোন মূল্যে অনতিবিলম্বে ক্রাক দখল করতে হবে। আমি সেইসব গাদ্দারদের পাওনা কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে চাই। যাদের গাদ্দারীর কারণে জাতি বার বার জিল্লতির গর্তে পড়ে যায়।’

সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা সংস্থার অফিসার জাহেদার তাবুতে প্রবেশ করলো। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আজ রাতেই আমি চূড়ান্ত আঘাত হান্তে চাই। ক্রাকের পিছন দিকের কোন্ অংশ সবচে দুর্বল আমার জানা দরকার। এ ব্যাপারে তোমার পরামর্শ কি?’

‘যে কোন পদক্ষেপের একটা অর্থ থাকা দরকার।’ জাহেদা বললো, ‘চূড়ান্ত আঘাত হানার সময় এখনো আসেনি বলেই আমি মনে করি। সম্ভবত আরো কিছু দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’

‘কেন, কেন এমনটি মনে হচ্ছে তোমার! তুমি কি কোন নতুন খবর পেয়েছ?’ সুলতান আইয়ুবীর প্রশ্ন।

‘আপনি যে সফলতার আশা নিয়ে শত্রুদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়েছিলেন তাতে আপনি পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। শত্রুরা এখনো যথেষ্ট মজবুত। চূড়ান্ত হামলার আগে তাদের মানসিকভাবে আঘাত করা দরকার।’

জাহেদান কথা বলেছিল নির্ভীকভাবে। সুলতান আইয়ুবী তাঁর সমস্ত অধস্তনদের বলে রেখেছিলেন, তারা যেন তাকে বাদশাহ মনে করে কুর্নিশ না জানায়। কখনও কোন পরামর্শ দিতে চাইলে বীরত্বের সাথে আত্মবিশ্বাস নিয়েই দেয়। আর সমালোচনার কিছু থাকলে তাও যেন তারা খোলাখুলি বলে ফেলে। জাহেদান সেই নির্দেশ অনুসারেই সাহসিকতার সাথে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করল।

জাহেদান গোয়েন্দা বিভাগের উর্ধতন অফিসার। তাদের চোখ-কান সজাগ সতর্ক থাকে। গোয়েন্দাদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, তারা অন্ধকারেও দেখতে পায় এবং দূরবর্তী শত্রুর কানাঘুষা শুনতে পায়।

সুলতান আইয়ুবী গোয়েন্দাদের মতামতের যথেষ্ট মূল্য দিতেন। তিনি জানতেন, গোয়েন্দাদের রিপোর্ট ছাড়া কোন যুদ্ধেই বিজয় অর্জন করা যায় না। আর যে সময় খৃস্টানরা মুসলিম রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরে গোয়েন্দাদের জালের মত ছড়িয়ে রেখেছে সে সময় গোয়েন্দাদের প্রয়োজন তা আরো অনেক বেশি। সুলতান আইয়ুবীর এখন প্রয়োজন অসাধারণ প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও পরীক্ষিত গোয়েন্দা। এ বিষয়টি তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন দক্ষ ও বিশ্বস্ত এক বিশাল গোয়েন্দা বাহিনী। এ ব্যাপারে তিনি পূর্ণ সফলতা লাভ করেছিলেন।

এ বাহিনীর হাসান বিন আব্দুল্লাহ ও জাহেদানের মতামতকে তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। তাদের তৎপরতা ও সুচিন্তিত পরামর্শের ফলেই তিনি খৃস্টানদের অনেকগুলো আঘাত ব্যর্থ করে দিতে পেরেছেন।

গোয়েন্দাদের তৎপরতার ফলেই তিনি জানতে পেরেছিলেন, খৃস্টানরা ক্রাকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার সাথে সাথে দুর্গের বাইরে মরুভূমিতে অনেক সৈন্য লুকিয়ে রেখেছে। মুসলমানরা চূড়ান্ত আঘাত হানার সাথে সাথে ওরা পেছন থেকে এসে মুসলিম বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

জাহেদান বললো, ‘মরুভূমি ও পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকা খৃস্টান সৈন্যদের উপস্থিতিই প্রমাণ করে খৃস্টানরা এবার কেল্লার বাইরে যুদ্ধ করতে চায়। তাদের কোন ব্যবস্থা না করেই কেল্লা অবরোধ করায় শত্রুরা যথেষ্ট লাভবান হয়ে গেল।’

‘তারা কি এরই মধ্যে আমাদের কোন বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে বসেছে?’ সুলতান সালাহউদ্দিন অস্থির হয়ে প্রশ্ন করেন।

‘না এখনো করেনি। তবে তাদের তৎপরতা দেখে বুঝতে পারছি, তারা আমাদের দুর্বল অংশে আঘাত করার জন্য আজ সন্ধ্যা নাগাদ রওনা হয়ে যাবে।’ জাহেদান উত্তর দিল, ‘খবর পেয়েছি, খৃস্টান অশ্বারোহী ও উষ্ট্রারোহীরা থাকবে এ অভিযানে। পদাতিক বাহিনীকে তারা খুব কম ব্যবহার করবে। তারা আমাদের ডান ও বাম দিক থেকে আক্রমণ চালাবে। খৃস্টানদের এক বিশাল বাহিনী এ অভিযানে অংশ নিচ্ছে। অসম্ভব নয়, এতে আমাদের অবরোধ ভেঙে যাবে।’

‘আমি তোমাকে ও তোমার গোয়েন্দা বিভাগকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি, যারা এ সংবাদ নিয়ে এসেছে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি জানি আমি যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি তা বড় কঠিন ও ভয়াবহ। তবু আমি তোমাদের সকলকে আশ্বাস দিচ্ছি, খৃস্টান সৈন্যরা আমাদের যে শূন্য স্থান পূরণ করতে ও অবরোধ ভাঙতে আসছে, আমি তাদেরকে সেই শূন্য স্থানেই নির্মূল করে দেব। আল্লাহ আমাদের নেগাহবান। যদি তোমাদের মাঝে কোন গাদ্দার না থাকে তবে আল্লাহ তোমাদেরকে অবশ্যই বিজয় দান করবেন।’

একজন সালার বললেন, ‘যদি আপনি আদেশ দেন তবে আমাদের সংরক্ষিত সৈন্যদের একটি বাহিনী খৃস্টানদের পৌঁছার পূর্বেই সেখানে পাঠিয়ে দেই। তাহলে অবরোধের শূন্য স্থান পূরণ হয়ে যাবে এবং খৃস্টানদের আক্রমণ ও পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে।’

সুলতান আইয়ুবীর মুখে কোন অস্থিরতা ও দুর্ভাবনার সামান্যতম ভাবও প্রকাশ পাচ্ছিল না। তিনি জাহেদানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার রিপোর্ট সম্পূর্ণ সত্যি হলে তুমি কি আমাকে আরো কিছু তথ্য দিতে পারবে? তুমি কি বলতে পারবে খৃস্টান সৈন্যরা কোন সময় আক্রমণস্থলে পৌঁছবে?’

‘এরই মধ্যে তারা তাদের গোপন আস্তানা গুটিয়ে রওনা হয়ে গেছে। তাদের অগ্রাভিযান খুবই দ্রুত।’ জাহেদান উত্তরে আরো বলল, ‘তাদের সাথে কোন তাবু বা খাদ্যশস্য আসছে না, তা পরে আসবে। মনে হয় তারা রাস্তায় কোথাও বিশ্রাম নিবে না। যদি তারা এ গতিতে আস্তে থাকে তবে তারা মধ্য রাতের সামান্য আগে বা প্রে এসে পৌঁছে যাবে।’

‘আল্লাহ করুক তারা যেন রাস্তায় কোথাও না থামে।’ সুলতান আইয়ুবি বললেন, তারা তো ক্লান্ত, অভুক্ত ও পিপাসার্ত ঘোড়া ও উট নিয়ে যুদ্ধ করবে না। সমারাঙ্গনে এসে পশুগুলোকে বিশ্রাম ও খাবার দেবে। সেই সুযোগে তারা দেখতে পাবে, আমরা যে অবরোধ করে রেখেছি তার মাঝে কোথাও কোন ফাঁক আছে কি না।’

সুলতান আইয়ুবী সালারদের বললেন, খৃস্টানরা আমাদের ফাঁদে পড়তে আসছে।’

তিনি নির্দেশ দিলেন, ‘কেল্লার পেছন দিকে আমরা অবরোধের যে ফাঁক রেখেছি সে স্থান আরও ফাঁক করে দাও। দু’পাশে দান ও বামের বাহিনীকে জানিয়ে দাও, তাদের ওপর পিছন থেকে আক্রমণ আসছে। তারা যেন তাদের বাহিনীকে আরও দৃঢ় ও সতর্ক করে নেয় এবং শত্রুদেরকে যেন মাঝখানে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়। আর কোন তীরন্দাজ যেন আমার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তীর না চালায়।’

এরপর সুলতান রিজার্ভ পদাতিক, অশ্বারোহী ও তীরন্দাজদের কয়েকটি দলে ভাগ করলেন। তাদের নির্দেশ দিলেন, ‘সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাহতে তোমরা অবরোধের দুর্বল স্থানের যতটা সম্ভব কাছাকাছি পৌঁছে যাবে, কিন্তু নিজেদের অবস্থান যেন দুশমন টের না পায়। তোমরা লক্ষ্য করেছো। যেখানে আমরা অবরোধ দুর্বল রেখেছি সে এলাকাটা সমান ময়দানও নয়, মরুভূমিতে মত বালুকা প্রান্তরও নয়। সে অঞ্চল টিলা, উপত্যকা ও গিরিখাদে পরিপূর্ণ। সহজেই তোমরা সেখানে আত্মগোপন করতে পারবে।’

সুলতান আইয়ুবী টহল গ্রুপের কমান্ডারকে ডাকলেন। বললেন, ‘খৃস্টান বাহিনীর পিছনে যে খাদ্যদ্রব্য ও রসদপত্র আসছে তা রাতেই রাস্তায় লুট করতে হবে।’ তিনি তাকে আরও কিছু জরুরী আদেশ দিয়ে তাবু থেকে বেরিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন। সঙ্গে নিলেন কয়েকজন সালারকে। চললেন রণক্ষেত্রের দিকে।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আত্মতুষ্টিতে বিভোর হওয়ার মত লোক ছিলেন না। তিনি সমস্ত পরিকল্পনা আবার খতিয়ে দেখলেন এবং অবরোধকে কেল্লার কাছ থেকে আরেকটু দূরে সরিয়ে নিতে বললেন। তিনি যুদ্ধরত অফিসারদের বললেন, ‘খৃস্টানদের অধিকার থেকে দুর্গ মুক্ত করা সহজ নয়। প্রয়োজনে দীর্ঘদিন ধরে অবরোধ টিকিয়ে রাখতে হবে।’

তিনি বললেন, দুর্গের প্রাচীরের ওপর থেকে বৃষ্টির মত তীর বর্ষণ করছে খৃস্টানরা। এ তীর বৃষ্টি ভেদ করে কেল্লার দরোজা পর্যন্ত পৌছা অসম্ভব। তিনি মুসলিম বাহিনীকে নিরাপদ দূরত্বে সরে আসতে বললেন। কারণ, এ তীরের মোকাবেলায় পালটা আক্রমণ করার কোন যুক্তি ছিল না।

সুলতান আইয়ুবী কেল্লার প্রধান ফটকের লড়াইয়ের অবস্থা দেখতে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। প্রচণ্ড উৎসাহ, উদ্দীপনা আত্নবিশ্বাস নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল ফটকের মুজাহিদরা। একদল মুজাহিদ তখন বিপুল বিক্রমে দ্রুত কেল্লার প্রাচীরের ওপরে তীর বর্ষণ করে যাচ্ছিল। ছয়টি মেনজানিক আগুন ছুঁড়ে মারছিল প্রাচীরের ওপর। দেয়ালের ওপরে যেখানে তীর ও অগ্নি বর্ষণ হচ্ছিল সেখানে কোন খৃস্টান সৈন্য দেখা যাচ্ছিল না। দেয়াল ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল। সুলতান আইয়ুবী দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন এসব।

তাঁর প্রায় চল্লিশজন সৈন্য হাতে বর্শা ও কোদালি নিয়ে দেয়ালের দিকে দ্রুত ছুটে গেল এবং দেয়ালের পাশে গিয়ে পৌঁছালো। কেল্লার প্রাচীর মাটি ও পাথরের গাথুনী দিয়ে তৈরি। তারা দেয়াল ভাঙা শুরু করলো। তাদের নিরাপদ রাখার জন্য কেল্লার ওপরে তীর ও অগ্নিবর্ষণ অব্যাহত রাখলো মুজাহিদরা, যাতে কেল্লার ওপর উঠে শত্রুরা তীর বর্ষণ করতে না পারে এবং কেল্লার দেয়াল ভাঙায় বাঁধা সৃষ্টি না হয়।

মুজাহিদদের এই সাহস ও তৎপরতা দেখে সুলতান আইয়ুবী বলে উঠলেন, ‘সাবাস! সাবাস মুজাহিদ!’

সহসা দুর্গের প্রাচীরের ওপর চিৎকার শোনা গেল। সুলতানের চোখ সেই স্থানে নিবদ্ধ হলো, যেখানে আইয়ুবীর নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদরা দেয়াল ভাঙছিল। তিনি দেখলেন, অসংখ্য খৃস্টান সৈন্যের মাথা ও কাঁধ দেখা যাচ্ছে। তাদের হাতে বড় বড় বালতি ও ড্রাম। তীর বৃষ্টির ফাঁক গলে তারা প্রাচীরের ওপর উঠে এল এবং বালতি ও ড্রামে কাঠ ভিজিয়ে তাতে আগুন দিয়ে তা ছুঁড়ে মারতে লাগল নিচে। প্রজ্জ্বলিত কাঠ ও জ্বলন্ত অঙ্গার সেইসব মুজাহিদের ওপর গিয়ে পড়ছিল, যারা নিচে দেয়াল ভাঙছিল। মুজাহিদরা আরো এগিয়ে গিয়ে তীর বর্ষণ শুরু করলে অসংখ্য খৃস্টান আহত হলো সে তীরের আঘাতে। দেয়ালের ওপর ছুটে আসা তীরে মুজাহিদদের তীরন্দাজ বাহিনীর কিছু লোকও আহত এবং শহীদ হয়ে গেলেন।

শেষে উভয় দিক থেকে এমনভাবে তীর বর্ষণ হতে লাগলো, যেন বাতাসে তীরের জাল বিছিয়ে রাখা হয়েছে। জানবাজ মুজাহিদরা তখনও দেয়াল ভাঙছিল।

দেয়াল ভাঙা কোন সহজ ব্যাপার ছিল না। কারণ কেল্লার দেয়াল যেমন চওড়া তেমনি মজবুত। এদিকে দেয়ালের ওপর থেকে এই জানবাজদের ওপরে তীর বর্ষণ করা সম্ভব ছিল না বলে তাদের ওপরে জ্বলন্ত কাঠ বর্ষিত হচ্ছিল। কিন্তু এই কাঠ বর্ষণের কাজও সহজ ছিল না। যারাই এগিয়ে আসতো এ কাজে তারাই মুসলিম তীরন্দাজদের তীরের নিশানায় পরিণত হতো।

ওপরে যখন প্রবল তীর বৃষ্টি হচ্ছিল তখনও নিচে প্রজ্জ্বলিত আগুন এড়িয়ে দেয়াল ভাঙায় অটল ছিল মুজাহিদরা। কিন্তু আগুন যখন তাদের ঘিরে ধরল তখন আর সেখানে টিকতে পারল না। মুজাহিদদের অনেকেই তখন এর মাঝে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শাহাদত বরণ করলেন। বাকীরা দৌড়ে ফিরে এলো মূল বাহিনীর কাছে। অনেকের কাপড়ে আগুন লেগে গিয়েছিল, পথের মাঝে মুখ থুবরে পড়ে গেল তাদের কেউ কেউ। কেউবা ফিরতে গিয়ে দুশমনের তীরের আঘাতে লুটিয়ে পড়লো মাঝপথে। বলতে গেলে এভাবে মুজাহিদদের প্রায় সকলেই শহীদ হয়ে গেলেন।

পাঁচিলের ওপরে পরিখা থাকায় খৃস্টানরা বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। মুসলিম বাহিনী সামান্য পিছিয়ে খৃস্টানদের তীরের আওতার বাইরে চলে এল।

লড়াই চলছিল মূল ফটককে কেন্দ্র করে। খৃস্টান বাহিনীর দৃষ্টি মুসলমানদের মূল বাহিনীর দিকে, মুসলমানরা তাকিয়ে ছিল খৃস্টানদের দিকে। হঠাৎ মুসলমানরা দেখতে পেল ফটকের অনেক দূর থেকে দশজন মুজাহিদ দেয়াল ঘেঁষে শত্রুদের দৃষ্টি এড়িয়ে ফটকের দিকে এগিয়ে আসছে। শত্রুর দৃষ্টি যাতে তাদের দিকে না পড়তে পারে সে জন্য মুসলমানরা আবার এগিয়ে এল এবং পুনরায় পূর্ণ উদ্যমে তীর বৃষ্টি শুরু করল। দশজনের মুজাহিদ দলটি এই সুযোগে দেয়ালের সাথে সেঁটে গিয়ে দ্রুত ফটকের পাশে পৌঁছে গেল। ওখানে পৌঁছে তারা দ্রুত দেয়ালের পাথর খুলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা অনেকগুলো পাথর খুলে দেয়ালের গায়ে বেশ বড় রকমের একটি গর্ত তৈরি করে ফেললো।

খৃস্টানরা টের পেয়ে আবার আগুনের গোলা ছুঁড়তে শুরু করল নিচে। কিন্তু এবার সে সব গোলা মুজাহিদদের তেমন ক্ষতি করলে পারল না। কারণ বিপদ দেখলেই ওরা দেয়ালের গর্তে সেঁধিয়ে গিয়ে আত্নরক্ষা করলে লাগল। দু’জন অগ্নি নিক্ষেপকারী ড্রামের আড়াল নিয়ে ঝুঁকে মুজাহিদদের দিকে আগুনের মশাল নিক্ষেপ করতে চাইল, অকস্মাৎ মুসলিম বাহিনীর তীর এসে বিদ্ধ করল তাদের। খৃস্টান সৈন্য দু’জন বিকে তীরের আঘাত খেয়ে পিছনে পড়ার পরিবর্তে দেয়াল থেকে ছিটকে সামনের দিকে পড়ল। তাদের শরীরের বাড়ি খেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল ড্রামটি এবং মুহূর্তে আগুনের স্তুপে পরিণত হলো আশেপাশে পুরো এলাকা। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য দু’জন সেই অগ্নিকুন্ডে পড়ে ভস্ম হয়ে গেল, সে সাথে মুজাহিদ দশজনও হারিয়ে গেল সেই বিশাল অগ্নিকুন্ডে

সুলতান আইয়ুবী ঘোড়া হাকিয়ে দ্রুত কমান্ডারের কাছে গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের ওপরে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। ইসলামের ইতিহাস এইসব জানবাজদের নাম সবসময় স্মরণ করবে যারা আল্লাহর নামে অগ্নিকুন্ডে ঝাপিয়ে পড়তেও পিছপা হয়নি। এখন তোমরা এ পথ ছেড়ে দাও এবং পিছু সরে আসো। এত তাড়াতাড়ি তীর ও সৈনিক নিঃশেষ করবে না। খৃস্টানরা এই কেল্লার জন্য এত বেশি আত্নত্যাগ করছে যার কোন ধারণাই আমরা করতে পারি না। আমরাও এত বেশি কুরবানী দিব যার ধারণা খৃস্টানদের কাছে নেই।’

কমান্ডার বললো, ‘আরেকটু চেষ্টা করলেই এখান দিয়ে দেয়াল ভাঙা যাবে আর আমরা এই পথে আপনাকে কেল্লার ভেতরে নিয়ে যেতে পারবো।’

‘আল্লাহ তোমার আশা পূরণ করুন।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তোমার মুজাহিদদেরকে বাঁচিয়ে রাখো। খৃস্টানরা এখন বাইরে থেকে আক্রমণ চালাবে। তোমাকে সম্ভবত বাইরেও যুদ্ধ করতে হবে। অবরোধ সুদৃঢ় রাখো। চোখ-কান খোলা রেখে খানিক জিরিয়ে নাও, আমরা খৃস্টানদের এবার ক্ষুধা-তৃষ্ণার সাথে লড়াই করতে পাঠাবো।’

সৈন্যদেরকে পিছনে সরিয়ে আনলেন কমান্ডার। কমান্ডার সুলতান আইয়ুবীকে বললো, ‘আপনার অনুমতি পেলে আমি শহীদদের লাশগুলো উঠিয়ে আনতে চাই।’

‘হ্যাঁ! সুলতান আইয়ুবি বললেন, ‘নিয়ে আসো। কোন শহীদের লাশ যেন বাইরে পড়ে না থাকে।’

সুলতান আইয়ুবী চলে এলেন ওখান থেকে। এই জানবাজ সৈন্যরা যেভাবে তাদের বন্ধুদের লাশগুলো উঠিয়ে আনলো, সেও এক কল্পনাতীত দৃশ্য। বন্ধুদের লাশ উঠাতে গিয়ে শাহাদাতের নজরানা পেশ করলো আরো কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদ।

সুলতান আইয়ুবী অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন। তিনি এমনভাবে চলাফেরা করলেন যাতে শত্রুরা বুঝতে না পারে তিনি কোথায় আছেন। তিনি তাঁর বাহিনী থেকে অনেক দূরে সরে গেলেন। একাধিক টিলা, উঁচু প্রান্তর ও গিরিপথ পার হয়ে তিনি এক টিলার ওপর ঘোড়া থেকে নামলেন এবং সাবধানে শুয়ে পড়লেন যাতে শত্রুরা তাকে দেখতে না পায়। টিলার ওপর থেকে তিনি কেল্লা ও শহর দেখতে পাচ্ছিলেন। অন্যদিকে প্রায় মাইলখানেক বিস্তৃত অঞ্চল নজরে ভাসছিল তাঁর। তিনি সাবধানে টিলার প্রতিটি এলাকা গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন এবং ঘুরে ফিরে সবকিছু দেখলেন।

এই গভীর পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করতে করতে সূর্য ডুবে গেল। তিনি সেখানেই অবস্থান করতে থাকলেন। সন্ধ্যার একটু পর তাঁকে সংবাদ দেয়া হলো, নির্দেশ মোতাবেক তীরন্দাজ ও পদাতিক বাহিনী আসছে। তিনি গুপ্তচরকে বললেন, ‘বাহিনীকে সাবধানে আত্নগোপন করতে বলো আর কমান্ডারদেরকে বলো আমার সাথে অবিলম্বে দেখা করতে।’

বিভিন্ন গ্রুপের কমান্ডাররা বাহিনীকে লুকিয়ে রেখে দেখা করলো এসে সুলতানের সাথে। সুলতান আইয়ুবী পথ-নির্দেশ দিয়ে তাদেরকে নিজ নিজ বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

রাত ক্রমে বাড়তে থাকলো। মরুভূমিতে নেমে এল নিশুতি প্রহর। চারদিক সুনসান নীরবতা। মাঝ রাতের দিকে এই নিস্তব্ধ নীরবতা ছাপিয়ে দূর থেকে ভেসে এল সম্মিলিত অশ্বখুরের মৃদু কিন্তু বলিষ্ঠ শব্দ। উন্মাতাল প্লাবন কোন বাঁধ ভেঙে ছুটে আসতে শুরু করলে যেমন শব্দ হয় অনেকটা সে রকম। শব্দ ক্রমে জোরালো হতে থাকল।

সুলতান সে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়েছিলেন অপলক নেত্রে। আকাশে ছিল ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। নরম জোসনায় ব্যপ্ত ছিল সমগ্র চরাচর। অনেকক্ষণ ধরে সুলতান শুনছেন সম্মিলিত অশ্ব খুরধ্বনি। অস্পষ্টতা থেকে সে শব্দ একসময় স্পষ্ট হলো। স্পষ্ট শব্দ ক্রমে আরো জোরালো হলো, কিন্তু এই ফকফকা জোসনায়ও কোন বাহিনী নজরে এল না তাঁর। ইয়িনি নিবিষ্ট মনে তাকিয়েছিলেন উন্মুক্ত মরুভূমির দিকে। বুঝতে পারছিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই ধেয়ে আসা বাহিনী তাঁর দৃষ্টিসীমায় আঘাত হানবে।

অবশেষে একসময় তাঁর অন্তহীন প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো। দূর দিগন্তে চলন্ত রেখা ফুটে উঠলো। ক্রমে সে রেখা বড় হতে থাকলো। একসময় খৃস্টান বাহিনীর অশ্বারোহী দলটি টিলা ও উচ্চভূমি অঞ্চল পেরিয়ে এল। তাদের পিছনে এল উষ্ট্রারোহী দলও। এদের সৈন্য সংখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন তিন হাজারের কম। তবে সে সময়ের ঘটনা প্রবাহের যা বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে দশ থেকে বারো হাজারের মত বলে উল্লেখ করেছেন অধিকাংশ ঐতিহাসিক।

বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন প্রসিদ্ধ খৃস্টান সম্রাট রিমান্ত। সে এই আক্রমণের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে পাহাড়ের আড়ালে তাবু টানিয়ে অপেক্ষা করছিল। তার পরিকল্পনা ছিল ভোর রাতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বাহিনীর ওপর সে অতর্কিত আক্রমণ চালাবে। কচুকাটা করবে আইয়ুবীর ঘুমন্ত প্রতিটি সৈনিককে। বার বার আইয়ুবী খৃস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীকে যেভাবে নাস্তানাবুদ করেছিল, এবার তার প্রতিশোধ নেবে রিমান্ত। চিরতরে মিটিয়ে দেবে আইয়ুবীর যুদ্ধের সাধ।

খৃস্টান সৈন্যরা ঘোড়া ও উটের পিঠ থেকে নেমে এলো নিচে। ঘোড়ার সাথে বাঁধা ঘোড়ার আহার্য দানার ব্যাগ ঘোড়ার সামনে ঝুলিয়ে দিল। আরোহীদের আদেশ দেয়া হলো সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে। রিমান্ত বললো, ‘মা মেরীর সন্তানেরা। তোমাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন আজ পূরণ হতে চলেছে। খৃস্টান জাতির সম্মান ও মর্যাদার বৃদ্ধি করার জন্য আল্লাহ তোমাদের মনোনীত করেছে। তোমরা মুসলমানদের ওপর আঘাত হানবে অতর্কিতে। ওরা যখন হাতিয়ার রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। তোমরা আক্রমণ চালাবে একদল নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর। ফলে তেমন কোন মোকাবেলার সম্মুখীন তোমাদের হতে হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আমি শুধু চাই, তোমরা এওম্ন দ্রুত ও তীব্র আঘাত হানবে, যাতে দুশমন কোনরকম প্রতিশোধের সুযোগ না পায়।’

সুলতান আইয়ুবী এবং তাঁর পর্যবেক্ষকগণ খৃস্টান সৈন্যদলকে ভালভাবেই লক্ষ্য করছিল। এতবড় বাহিনী দেখে আইয়ুবী ঠিক বুঝলো, খৃস্টানরা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।

ভোর রাত। আদম সুরাত হেলে পড়েছে আকাশের একদিকে। চাঁদ পশ্চিম দিগন্তে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। মধ্যরাতের উজ্জ্বল আলো এখন অনেকটা ম্রিয়মান। সারা রাত কুয়াসজা ঝরে সে আলো আরো ফিকে করে দিয়েছে। মরা জোসনায় এখন আর সবকিছু আগের মত স্পষ্ট দেখাও যায় না।

সে অস্পষ্ট আলোতেই সুলতান দেখলেন খৃস্টান বাহিনী তৎপর হয়ে উঠেছে। ঢিলেঢালা ভাব কাটিয়ে ওরা তৈরী হচ্ছে যুদ্ধের জন্য। অশ্বারোহীরা চেপে বসছে ঘোড়ায়। ওদের হাতে বর্শা ও তলোয়ার। ওরা সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালো। রিমান্ত দেখলেন তার বাহিনী প্রস্তুত। বললেন, ‘যিশুর সৈনিকরা, সামনে বাড়ো।’

নড়ে উঠলো বাহিনী। ঘোড়াগুলো পা তুললো সামনের দিকে, ঠিক এই সময় আইয়ুবী বললেন, ‘তীর ছুঁড়ো।’

সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো মুজাহিদদের তীর বর্ষণ। আইয়ুবীর হুকুম মত প্রথম পশলা গেল পিছন সারির ওপর দিয়ে। ঘোড়ার পিঠেই মুখ থুবড়ে পড়লো খৃস্টান সৈনিকদের সে সারিটি। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘোড়ার পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ল নিচে।

বিরতি ছাড়াই ছুটে এল দ্বিতীয় পশলা। আঘাত করল সাওয়ারহীন ঘোড়াগুলোকে। গায়ে তীর বিদ্ধ হতেই লাগামহীন ঘোড়াগুলো ছুট লাগালো এদিক ওদিক। ডানে, বায়ে, সারির মাঝখান দিয়ে, যেদিক পারলো ছুটলো উর্ধ্বশ্বাসে। বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়লো পুরো বাহিনী জুড়ে। বাহিনীর সামনে থেকে খৃস্টান কমান্ডার বুঝতেই পারলো না, ব্যাপারটা কি? কেন এত বিশৃংখলা?

সে রাগের মাথায় চিৎকার করে গালাগালি শুরু করে দিল। এর পরের আঘাতটা এল উটের বহরের ওপর। ঘোড়ার মতই উটগুলোও দৌড় লাগালো দিশেহারা হয়ে। ফলে মুহূর্তে সমস্ত সেনাবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ল সীমাহীন আতংক।

এরপর কখনো তীর ছুটে আসতে লাগলো ডান দিক থেকে, কখনো বাম দিক থেকে, কখনো পেছন থেকে। দলে দলে খৃস্টান ফৌজ তীরবিদ্ধ হতে লাগল। তাদের আর্ত চিৎকার প্রভাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে দিল। যখন ভোরের আলো ফুটে উঠল পাহাড় ও টিলার ফাঁক-ফোকর তখন রিমান্ত পরিষ্কার বুঝতে পারল, খৃস্টান বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর কঠিন বেষ্টনীর মধ্যে আটকা পড়ে গেছে।

সে জানতে পারল না, কি পরিমান মুসলমান সৈন্য এ অভিযানে অংশ নিয়েছে! তাদের সংখ্যা কি খুবই বেশি? তার মনে হলো, জীবনের অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে তার। জীবনে অনেকবারই মুসলমানদের মুখোমুখি হয়েছে রিমান্ত, কিন্তু এতটা অসহায় অ অনিশ্চয়তা আর কখনো তাকে গ্রাস করেনি। এ যেন এক অবধারিত মৃত্যু ফাঁদ। যে পথে তারা এই গিরি অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল সে পথ আগলে রেখেছে মুজাহিদরা। ডানে-বায়ে পাহাড়ে টিলায় মুসলিম তিরন্দাজ বাহিনী। পাহাড় ও টিলার ফোঁকড় গলে সামনে বেরিয়ে যাবার যে সংকীর্ণ পথ, সে পথও মুজাহিদদের দখলে। খোলা ও সমতল জায়গায় দাঁড়িয়ে মুসলিম তীরন্দাজদের নিশানা হওয়া ছাড়া যেন এখন তাদের আর কিছুই করার নেই।

রিমান্ত যে পথে এসেছিল সে পথে ফিরে যাওয়ার জন্য একবার ছুটে গেল সেদিকে, কিন্তু মুজাহিদদের প্রচন্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হলো। যাবার চেষ্টা করলো সংকীর্ণ পথে সামনের দিকে বেরিয়ে যাওয়ার, কিন্তু তাড়া খেয়ে সেখান থেকেও ফিরে এল বাঘের মুখে পড়া ভয়ার্ত হরিনীর মত। ময়দানের মাঝখানে ছুটে এলেই পাহাড়, টিলার পাথর অ ঝোপের আড়ালে থেকে ছুটে আসতো ঝাঁক ঝাঁক তীর।

মুজাহিদদেরকে আগেই আইয়ুবী সবকিছু বুঝিয়ে সাবধান করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘রিমান্ত আসছে বিপুল শক্তি নিয়ে এবং চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। অতএব তাকে তোমাদের সেভাবেই অভ্যর্থনা জানাতে হবে।’

সুলতানের কথায় মুজাহিদরা এই আক্রমণকে সানন্দে গ্রহণ করার মানসিকতা নিয়েই প্রস্তুত হয়েছিল। ফলে রিমান্তের বাহিনীর বিশালতা দেখে তারা মোটেও ঘাবড়ে যায়নি।

অবরোধকারী মুজাহিদরা এবার খৃস্টানদের সামনে যাওয়ার পথ থেকে সরে গেল। বিজয়ের আশা ছেড়ে ওই পথে পালিয়ে যাওয়ার জন্য রিমান্ত ঘোড়া ছুটালো। পাথর ও ঝোপের আড়ালে বসে মুজাহিদরা যখন দেখলো ধূলির মেঘ তুলে খৃস্টানরা ছুটছে বেস্টনী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তখন তারা সংকেত পাঠালো বেস্টনীর বাইরের মুজাহিদদের কাছে। প্রস্তুত হয়েই ছিল মুজাহিদরা। ধূলার মেঘ নিয়ে যখন অশ্বারোহী দল সেই ফাঁক গলে পরবর্তী বেস্টনীতে বেরিয়ে এল, দু’পাশ থেকে মুজাহিদরা টুটে পড়ল তাদের ওপর। তারা কোথা দিয়ে কেমন করে আক্রান্ত হলো, এ কোথা বুঝার আগেই চোখের পলকে বিপুল সংখ্যক খৃস্টান সৈন্য ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। খৃস্টান সৈন্যরা অনুভব করলো, তারা খাঁচায় বন্দী শিকারের মত অসহায়। এগুনোর পথ রুদ্ধ দেখে আবার পিছনে হটলো ওরা, চলে এল মাঠের ঠিক মধ্যিখানে।

সমতল এলাকাটি ছিল বেশ বড়সড়। মাঝখানের অনেকটা অংশ দু’পাশের পাহাড় থেকে মারা তীরের আওতার বাইরে থাকায় ওখানে আশ্রয় নিল ওরা।

সুলতান আইয়ুনী এই যুদ্ধের পরিচালনা ও তদারক নিজেই করছিলেন। সুলতান আইয়ুবীর কৌশল এবারও তাদেরকে ভয়, আতঙ্ক এবং নিরাশার অন্ধকারে ছুঁড়ে মারল। তারা যেদিকেই যায় দেখতে পায় সামনে বাঁধার পাহাড়। মধ্যিখানের ওই নিরাপদ অঞ্চলটুকু থেকে সামান্য এদিক ওদিক হলেই পাশ থেকে ছুটে আসতো ঝাঁক ঝাঁক তীর।

খৃস্টান সেনাপতি রিমান্ত তার বাহিনীকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ে চড়ার নির্দেশ দিল। হঠাৎ একযোগে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ওরা ছুটল পাহাড়ের দিকে। কিন্তু মুজাহিদদের তীর বৃষ্টি সব কটি দলকেই আবার ফেরত পাঠাল মাঠের মাঝখানে। সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডাররা তাঁর নির্দেশ অনুসারে সামনাসামনি যুদ্ধ করার কোন সুযোগই দিল না খৃস্টানদের।

বেলা গড়িয়ে চলল। রোদের উত্তাপ বাড়ল। সূর্য উঠে এল মাথার ওপর। খৃস্টানদের ঘোড়াগুলো ক্ষুধা অ পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল। সৈনিকরা হয়ে পড়ল ক্লান্ত অ বিপর্যস্ত। তারা চারণভূমি অ পানির সন্ধানে তৎপর হল। দুপুর পর্যন্ত কোন রসদ পৌঁছলো না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল রিমান্ত। কমান্ডারদের ডেকে বৈঠকে বসল। বলল, ‘খাদ্য শস্য তো সকালেই এসে যাওয়ার কথা ছিল!’

কয়েকজন অশ্বারোহী রসদ নিয়ে আসা বাহিনীর খবর নেওয়ার জন্য বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মুসলমান তীরন্দাজদের হাতে মারা পড়ল। কিন্তু যদি তারা জীবিত বেরিয়েও যেতে পারতো, তবু কোনদিন আর তাদের রসদ সামগ্রী নিয়ে আসা বাহিনীর সাক্ষাৎ পেতো না তারা। কারণ রাতের অন্ধকারেই সুলতানের পাঠানো টহল বাহিনী পথিমধ্যে তাদের পাকড়াও করে। তাদের অভিযান ছিল খুবই সফল। রসদবাহী দলটিকে তারা সহজেই ঘায়েল করতে সক্ষম হয়। কাফেলার রক্ষীদের হত্যা করে রাতের অন্ধকারেই তারা খৃস্টানদের সমস্ত রসদপত্র কব্জা করে নিয়ে আসে মুজাহিদ শিবিরে।

দুপুরের একটু পর সুলতান আইয়ুবী তার সংরক্ষিত সৈন্যদলকে ডেকে পাঠালেন এবং রিমান্তের বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে ঘিরে রাখার নির্দেশ দিতে রাত থেকে যে বাহিনী যুদ্ধ করছিল তাদের নিয়ে তাবুতে ফিরে গেলেন।

যদি মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা খৃস্টানদের সমানও হতো তবু তিনি সামনাসামনি খৃস্টানদের আক্রমণ করে নিঃশেষ করে দিতেন তাদের। কিন্তু বাহিনী স্বল্পতার জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত রইলেন সুলতান। তিনি মুজাহিদ বাহিনীর শক্তি ও সৈন্য অপচয় করতে চান না। তাই শত্রু সেনাদেরকে তিনি আতংকিত ও ব্যতিব্যস্ত রাখলেন ঠিকই কিন্তু তাদের জীবন বায়ু নিভিয়ে দেয়ার জন্য কোন বেপরোয়া পদক্ষেপ ও চূড়ান্ত যুদ্ধে জড়ালেন না। বরং বাঘ যেমন বাগে পাওয়া শিকার নিয়ে ওঁৎ পেতে বসে থাকে তেমনি তিনিও ময়দানে দুশমনকে সম্পূর্ণ বেষ্টনীর মধ্যে রেখে টিলা ও পাহাড় অঞ্চলের ঝোপের আড়ালে ওঁৎ পেতে বসে রইলেন। তিনি জানতেন, যতই সম্য অতিবাহিত হবে খৃস্টানরা ধীরে ধরে অকেজো হয়ে যাবে।

কিন্তু খৃস্টানদের এভাবে অবরোধ করে রাখতে গিয়ে তাদের নিজেদেরেও যতেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল। খৃস্টানদের বৃহৎ শক্তিকে বেঁধে রাখতে গিয়ে সুলতানও তার সমস্ত রিজার্ভ আটকে ফেলেছিলেন। এখন এসব সৈন্যদেরকে আর অন্য কোন কাজে ব্যবহার করার সুযোগ থাকল না।

সুলতান আইয়ুবী রিমান্তের বাহিনীকে আটক করার পর তানুতে ফিরে এসে মূল বাহিনীকে শহর অবরোধ আরো কঠোর ও জোরালো করার আদেশ দিলেন। খৃস্টানরা আর বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পেল না। প্রতিদিন কোন না কোন স্থানে মুজাহিদদের আক্রমণ হতেই থাকলো। এভাবেই অতিবাহিত হতে লাগলো একেকটা দিন। সুলতান আইয়ুবী শহর ও কেল্লার চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। কোন স্থান থেকেই দেয়াল ভাঙার কোন সুযোগ দেখা যাচ্ছিল না।

অবরোধ করার পর ষোল দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। সন্ধ্যার সময় সুলতান নিজের তাবুতে বসে অফিসার ও সহকর্মীদের সাথে কথা বলছিলেন। আলোচনা হচ্ছিল কেল্লায় প্রবেশ করার কি উপায় বের করা যায় এই নিয়ে। সুলতানের এক দেহরক্ষী তাবুর ভেতরে প্রবেশ করে সংবাদ দিল, ‘সুদান থেকে এক দূত এসেছে।’

আইয়ুবী বললেন, ‘তাকে জলদি ভেতরে নিয়ে এসো।’

রক্ষী বেরিয়ে যেতেই সুলতান স্বগতোক্তি করে বললেন, ‘আল্লাহ করুন যেন সংবাদ ভাল হয়।’

কাসেদ ভেতরে এলে সুলতান সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পারলেন। সে কোন সংবাদ বাহক নয়, একটি সেনাদলের কমান্ডার! সুলতান আইয়ুবী অস্থির হয়ে বললেন, ‘কি খবর, তুমি কি কোন সুসংবাদ নিয়ে এসেছো?’

কমান্ডার না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো, ‘প্রধান সেনাপতি যে সুসংবাদ প্রত্যাশা করছেন তেমন কোন সুখবর এখনো আনতে পারিনি, কারন সুদানে এখনও আমাদের বিজয় অর্জিত হয়নি। আবার এ কারণে সংবাদ খারাপও নয় যে, আমরা এখনও পরাজিত হইনি এবং পিছুও হটিনি।’

‘তার মানে পরাজয় অ পিছু হটার আলামত দেখা যাচ্ছে, তাই না?’ সুলতান প্রশ্ন করলেন।

‘অনেকটা সে রকমই।’ কমান্ডার উত্তরে বললো, ‘এ অবস্থায় এখন আমরা কি করব এ ব্যাপারে আপনার আদেশ জানার জন্যই আমি এসেছি। আমাদের এখন সেনা সাহায্য ভীষণ প্রয়োজন। যদি আমাদের এই প্রয়োজন পূরণ না হয় তবে পিছু হটা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না আমাদের।’

সুলতান আইয়ুবী ময়দানের বিশদ বিবরণ শোনার আগেই তার জন্য খাবার আনলেন এবং বললেন, ‘তুমি খেতে থাকো এবং খেতে খেতে ময়দানের খুঁটিনাটি সব আমাকে খুলে বলো।’

সুলতান আইয়ুবীর অনুপস্থিতিতে তাঁর ভাই তকিউদ্দিন মিশরের শাসক রূপে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি মিশর ও সুদানের সীমানার কাছে ফেরাউনের শাসনকালের কিছু ধ্বংসাবশেষের খবর পান। খৃস্টানরা তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য জঘন্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। তারা প্রচার করে যে, ‘এসব প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ দখল করার জন্য সুদান শিঘ্রই মিশর আক্রমণ করতে যাচ্ছে।’

এ গুজন শোনার পর তিনিই আগ বাড়িয়ে সুদান আক্রমণ করার সংকল্প ঘোষণা করলেন। তাঁর সেনাপতি অ উপদেষ্টাগণ তাকে তাঁর ভাই সুলতান আইয়ুবীর অনুমতি নিয়ে আক্রমণ করতে পরামর্শ দেন। কিন্তু তকিউদ্দিন বললেন, ‘ভাই এখন ক্রুসেডের বিশাল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছেন, এ অবস্থায় আমি তাঁকে বিরক্ত করতে চাই না।’ এই বলে তিনি সুদানের ওপর আক্রমণ করে বসলেন।

তকিউদ্দিন আবেগের উন্মাদনায় আক্রমণ করে বসলেন ঠিকই কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য যে বিচক্ষণতা অ দক্ষতা থাকা দরকারর তা তার ছিল না। সত্যি কথা বলতে কি, বিচক্ষণতা থাকলে তিনি এই অনাহুত যুদ্ধে জরিয়েও পড়তেন না! যাই হোক, যখন তকিউদ্দিন দেখলেন যুদ্ধের অবস্থা সুবিধের নয় তখন তিনি এই কমান্ডারকে ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। একজন কাসেদ না পাঠিয়ে কমান্ডারকে পাঠানোর কারণ, সে যুদ্ধ ক্ষেত্রের সবিশেষ বর্ণনা সুলতান আইয়ুবীর কাছে বুঝিয়ে বলতে পারবে।

সুলতান আইয়ুবী আগেই এই যুদ্ধের খবর পেয়েছিলেন। শুধু এতটুকু জানতে পেরেছিলেন, তকিউদ্দিন সুদানের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।

কমান্ডার সুলতান আইয়ুবীকে শোনাল যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ। বললো, ‘তকিউদ্দিন বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু আবেগ ও উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে সুদাম আক্রমণের আদেশ দিয়েছিলেন।’

সুলতান জানতেন, তকিউদ্দিনের চেতনা ও আবেগ সুলতান আইয়ুবীর থেকে ভিন্ন ছিল না, ভিন্ন ছিল দুই ভাইয়ের বিচার-বিবেচনা ও বিচক্ষণতা। তকিউদ্দিন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা সৎ উদ্দেশ্যে এবং ইসলামী প্রেরণা থেকেই নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছিলেন। নিজের গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্ট এবং উপদেষ্টাদের মতামতের ওপর পূর্ণ গুরুত্ব ও খেয়াল দেননি।

তিনি শুধু সেই রিপোর্টের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, যাতে সুদানীদের ট্রেনিং নেওয়া এবং আক্রমণের প্রস্তুতির কথা বলা হয়েছে। তকিউদ্দিন শত্রুদেরকে প্রস্তুত হওয়ার আগেই বশীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিন্তু এর শেষ পরিণাম কি তা জানার চেষ্টা করেননি। সুদানীদের সামরিক শক্তি কেমন ও কত বেশি তাও খতিয়ে দেখতে চেষ্টা করেননি তিনি। বুঝতে চেষ্টা করেননি, তারা যুদ্ধে কত শক্তি প্রয়োগ করবে এবং কত শক্তি রিজার্ভ রাখবে। তাদের কি পরিমাণ অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম আছে তারও খবর নেননি। জানতে চাননি তাদের অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী কত? তার চেয়েও বড় কথা, ময়দানে কি ধরণের প্রতিরোধের মোকাবেলা তাকে করতে হনে সে কথা না জেনেই তিনি আক্রমণের হুকুম দিয়েছিলেন। এমনকি মিশরের রাজধানী থেকে সে অঞ্চল কর দূরে এবং কেওম করে সেখানে নিজেদের রসদপত্র পাঠাবেন এর কিছুই না ভেবেই তিনি এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

সুদানীরা তকিউদ্দিনের বাহিনীকে সীমান্তে কন বাঁধা প্রদান করল না। তারা তাকে সুদান সীমান্ত থেকে দূর পর্যন্ত ভেতরে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দিল। শেষে এমন এক স্থানে এনে ফেললো, যেখানে নিষ্ঠুর মরুভূমি তাদের মৃত্যুর জন্য ভয়াল ফাঁদ পেতে রেখেছে। যেখানে প্রাণের কোন অস্তিত্ব নেই, নেই এক ফোটা পানির ব্যবস্থা।

তকিউদ্দিনের বাহিনী প্রকৃতপক্ষে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর রণ কৌশল অনুযায়ী যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার এবং সংখ্যায় কম হয়েও শত্রুর বড় বড় বাহিনীকে তছনছ করে দেয়ার সামর্থ্য রাখতো। তবে এ জন্য কুশলী সেনানায়কের নেতৃত্বের প্রয়োজন। এ সৈন্যদলকে শুধুমাত্র সুলতান আইয়ুবীই কমান্ড ও ব্যবহার করতে পারতেন।

সুলতান আইয়ুবী সম্মুখ যুদ্ধের সংঘর্ষ সবসময় এড়িয়ে চলতেন। তিনি সৈন্যদের প্রস্তুত করেছিলেন কমান্ডো লড়াইয়ের উপযুক্ত করে। ক্ষিপ্রতা, গতিশীলতা ও অতর্কিতে আঘাত হানা *** এ বাহিনীর কোন জুড়ি ছিল না। কিন্তু তকিউদ্দিন কৌশলবিহীন শুধু সৈন্য সমাবেশ করে যুদ্ধ করায় অভ্যস্ত ছিলেন। এ বাহিনীতে দক্ষ, পরীক্ষিত ও জানবাজ সৈন্য ছিল। কিন্তু তাদের সঠিক ব্যবহার করার নেতা একমাত্র সুলতান আইয়ুবীই ছিলেন।

সুদানে আক্রমণ করা মানে, সুলতান আইয়ুবীর এক বিরাট বাহিনীকে বেহুদা বন্দী করে রাখা। খৃস্টানরা এটাই চাচ্ছিল। আর এ জন্যই তারা এরকম চাল চেলেছে। তকিউদ্দিনের বাহিনীকে কৌশলে সুদানের গভীর অভ্যন্তরে নিয়ে তাদের মনোপুত স্থানে কার্যত বন্দী করে রেখেছে। আর তাদের ওপর সুলতান আইয়ুবীর কৌশল অবলম্বন করে রাতের অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমণ চালাচ্ছে। তকিউদ্দিন উট, ঘোড়া এবং সৈন্যদের জন্য এক ফোটা পানিও পাচ্ছে না কোথাও।

কমান্ডো বাহিনীর সালার অবস্থার নাজুকতা উপলব্ধি করে এক সময় বললো, ‘আমাদেরকে আপনি মরুভুতিতে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিন। আমরা মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের মত সরে পড়বো। এরপর অতর্কিত হামলার মোকাবেলায় আমরাও ওদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাবো এবং কাছ থেকেই ছিনিয়ে আনবো আমাদের খাদ্য ও পানীয়।’

কিন্তু তকিউদ্দিন এতে বাহিনী সংকোচিত হয়ে পড়বে বলে আশংকা করলেন। ভাবলেন, এতে কেন্দ্রীয় কমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সম্মিলিত শক্তি দুর্বল হয়ে যাবে। ফলে, তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং এ ধরনের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিতে বললেন তাকে।

যখন রসদপত্র বা খাদ্যশস্যের প্রশ্ন উঠে তখন তাদের মনে জেগে ওঠে অজানা শংকা। তারা বর্ডার থেকে এত দূরে চলে এসেছে যে, স্বাভাবিক অবস্থায়ও এখানে রসদ পৌছতে কয়েক দিন লেগে যাওয়ার কথা। আর এখন তো রাস্তায় রসদ বহর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ষোলআনা। যে কোন জায়গায়, যে কোন সময় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা আছে। এ আতংকজনক অবস্থায় পথ চলা নিরাপদ নয় বলেই বহরের প্রতিটি সৈনিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে।

কমান্ডো বাহিনীর এ আশংকা অচিরেই সত্য প্রমাণিত হলো। একদিন তারা খবর পেলো, তাদের খাদ্যশস্যবাহী বহর আক্রান্ত হয়ছে এবং শত্রুরা সমস্ত খাদ্যশস্য, রসদপত্র ও বাহনের জন্য নিয়ে আসা পশু লুট করে নিয়ে গেছে। এ ঘটনার পর কমান্ডো বাহিনীর প্রধান আবারো তকিউদ্দিনের কাছে তার প্রস্তাব পেশ করল। কিন্তু তকিউদ্দিন এ প্রস্তাব তো গ্রাহ্যই করলেন না বরং এ জন্য তাকে তিরষ্কার করলেন। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও তকিউদ্দিনের সাথে তার বাকবিতণ্ডা হলো এবং তকিউদ্দিন তাকে কড়া ধমক লাগালেন।

কমান্ডার বললো, ‘আমরা আপনার নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে এসেছি, যুদ্ধ করবো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, শত্রুরা রাতের আঁধারে এসে আমাদের খাদ্যশস্য লুট করে নিয়ে যাবে আর আমরা তা চুপ করে দেখবো। লড়াইয়ের স্বার্থে আপনাকে কোন পরামর্শ দিতে পারবো না।’

তকিউদ্দিন ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘তুমি সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছো। তোমার কাছ থেকে আমার যুদ্ধ করা শিখতে হবে না।’

কমান্ডার উত্তরে বললো, ‘আমাকে মাফ করবেন, আপনি সুলতান তকিউদ্দিন, সুলতান সালাহউদ্দিন নন। আমরা যুদ্ধ করতে শিখেছি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছ থেকে, আপনার কাছ থেকে নয়। সিপাহসালার হিসেবে তিনি আমাদেরকে যুদ্ধ করতে শিখিয়েছেন আমরা সে ভাবেই যুদ্ধ করতে চাই। সা জীবন আমরা কমান্ডো ট্রেনিং পেয়েছি। আমরা শিখেছি কি করে শত্রুর পেটের মধ্যে ঢুকে তাদের পেট কেটে বেরিয়ে আসতে হয়। আপনার সৈন্যরা ক্ষুধায় মরছে আর তাদের খাবার ও রসদপত্র শত্রুরা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা শত্রুদের রসদ ছিনিয়ে নিয়ে নিজের সৈন্যদেরকে পেট ভরাতে অভ্যস্থ।’

তকিউদ্দিনের চোখে পানি এসে গেল। তিনি জানতেন কমান্ডার কি প্রেরণা ও আবেগ নিয়ে কথা বলছে। রাগের পরিবর্তে তার মাঝেও এসে ভর করলো আবেগ। তিনি সেই আবেগ দমন করে বললেন, ‘আমি সেই জাতি বারিতালাকে ভয় করি। নিজে নিরাপদ অবস্থানে থেকে আমি এই জানবাজদের কি করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেই বলো?’

‘এ কথা আপনার আগেই ভাবা উচিত ছিল। এভাবে আপনার আক্রমণ করা উচিত হয়নি। কিন্তু এখন আর এ কথা ভেবে লাভ নেই। আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে আল্লাহর নামে জীবন কুরবানী করতে ভয় পায়। মুজাহিদ যতবেশী মৃত্যুর কাছাকাছি হয় ততই সে আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করে। আমরা এখন দুশমনদের ফাঁদে পড়ে আছি। এ অভিযানে আমরা যদি বিজয় অর্জন করতে না পারি তবে শাহাদাতের গৌরব থেকে কেউ আমাদের বঞ্চিত করতে পারবে না।’