টিলার ওপরে তিনি যেখানে শুয়েছিলেন মেয়েটিকে তিনি ওখানে নিয়ে গেলেন। শীতল বাতাস বইছে সেখানে। মাথার ওপর তারা ভরা আকাশ। সেদিকে তাকাল মেয়েটি। মাথা থেকে ওড়না লুটিয়ে পড়ল কাঁধে। বাতাসে এলোমেলো হয়ে গেলো চুলগুলি। চাঁদের আলোতে সে চুল সোনার আশের মত চমকাচ্ছিল। তিনি অনেকক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মেয়েটি আতাউল হাশেমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি খুবই অবাক হচ্ছি, আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন? আমাকে তো আপনার জন্যই এখানে আনা হয়েছে। আপনার যে কোন সাধ পূরণ করার জন্য আমি প্রস্তুত এ কথা কি আপনি বুঝতে পারছেন না?’
তিনি এ কথার কোন জবাব দিলেন না। শুধু নীরবে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। যেন তিনি এক নীরব পাথর হয়ে গেছেন।
মেয়েটি তার একটি হাত ধরল। বললো, ‘আমি জানি আপনি আমাকে কেন ডেকে এনেছেন ও কি চিন্তা করছেন।’
‘আমি চিন্তা করছি তোমার বাবা আমার মতই একজন পুরুষ মানুষ।’ আতাউল হাশেম তার থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলেন। বললেন, ‘আমিও বাপ। এই দুই বাপের মধ্যে কত আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এক বাপ কত নির্লজ্জ। আরেক বাপ সন্তানের নিরাপত্তা ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্যই তাদের ছেড়ে এই যুদ্ধের ময়দানে পড়ে আছে।’
‘আমার কোন বাবা নেই।’ মেয়েটি বললো, ‘তাকে কোনদিন দেখেছি বলেও মনে পড়ে না।’
‘তিনি কি মারা গেছেন?’
‘সে কথাও জানি না!’
‘আর তোমার মা?’
‘কোন কিছুই মনে নেই আমার।’ মেয়েটি বললো, ‘আমার এ কথাও মনে নেই যে, আমি বাড়িতে জন্মেছি না কোন যাযাবরের ঝুঁপড়িতে বা তাবুতে। কিন্তু পানি এ সময় বেরসিকের মত এ কথা বলছেন কেন?’
‘আমি আমার সৈনিক জীবনের রসেই ডুবে থাকতে পছন্দ করি।’ আতাউল হাশেম বললেন, ‘আমি চাচ্ছিলাম তোমাকে তোমার জীবনের অতীতের স্মৃতিময় জগতে ফিরিয়ে নিতে। যেখানে কে মা-বাপের স্নেহ আদরের জন্য কাঙাল থাকে।’
‘আমি তো নিজেই এক সৌন্দর্যময় স্মৃতি।’ মেয়েটি বললো, ‘যার সাথে আমি জীবনের সামান্য সময় কাটিয়ে দেই, সে সারা জীবন আমাকে স্মরণ করে। আমি অন্যের স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকি, আমার নিজের কোন স্মৃতি নেই।’
‘তুমি নিজেকে সৌন্দর্যের স্মৃতি না বলে বলো পঙ্কিলতার স্মৃতি।’ আতাউল হাশেম বললেন, ‘তোমার শরীরে লেগে আছে অসংখ্য পাপিষ্ঠের পাপের কলঙ্ক। তুমি ভাবছো ওদের মনে তোমার স্মৃতি টিকে থাকবে। ভুল, ভুল তোমার ধারনা। তোমার মত মেয়েদের কোন পুরুষ স্মরণে রাখে না। ওসব মেয়ে শিকারীরা আজ এখানে কাল ওখানে শিকার করে বেড়ায়। দ্বিতীয় শিকার পেলে প্রথমটার কথা ওরা বেমালুম ভুলে যায় চিরদিনের মত।
তোমার এউ রূপ যৌবন কচু পাতার পানির মত। কচুপাতা যেমন পানি ধরে রাখতে পারে না, এ দেহও পারে না যৌবন ধরে রাখতে। শৈশব ও কৈশোরে এ যৌবনের কোন ধারনা ছিল না তোমার। দুদিন পর যখন চেহারায় বয়সের ছাপ পড়বে তখন যৌবনের এ কয়েকটা দিন কেবল স্মৃতি হয়েই থাকবে। চেহারায় জৌলুশ নিয়ে অহংকার করো না। আমি এই মুহূর্তেই তোমার চেহারা চিরদিনের জন্য বিকৃত করে দিতে পারি। কিন্তু আমি তা করবো না। এই মরুময় পরিবেশ, মদ আর ব্যভিচার তোমাকে কয়েক বছরের মধ্যে নিঃশেষ করে দেবে। তখন তোমার অবস্থা হবে ঝরা ফুলের মত। মানুষের পায়ের তলায় পিষে গেলেও যে ফুলের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। আজ যারা তোমার রূপের মোহে ছুটে আসে তোমার কাছে, সেদিন তোমাকে রাস্তায় দেখে তোমার কাতর আবেদন শুনে এইসব সুদানী ও খৃস্টানরা ভিক্ষা দিতেও এগিয়ে আসবে না তোমার কাছে। তুমি যখন শহরের কোন ফুটপাতে পড়ে থাকবে, ওরা তখন ফুটপাত দিয়ে যাওয়ার সময় ঘৃণায় নাকে রুমাল চেপে ধরবে।’
আতাউল হাশেমের বলার মধ্যে ঘৃণা নয় এমন এক দরদমাখা ভাব ছিল যা মেয়েটিকে অস্থির করে তুলল। তার মনে হলো তার বুকের মধ্যে সাইমুম ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে ঝড়ে যৌবনের দুরন্তপনা উধাও হয়ে গেল। একজন মুসলমান একটু পিতৃস্নেহের। কেঁপে উঠল মেয়েটির শরীর। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে আতাউল হাশেমের পায়ের কাছে বসে পড়ল।
‘আমার এক মেয়ে আছে, তোমার চেয়ে দু’তিন বছরের ছোট হবে সে। তার বিয়ে হবে এক সম্মানী ঘরের যুবকের সাথে। যে ছেলে আমার মতই কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে ভাল জাতের ঘোড়ার চেপে ছুটে যাবে যুদ্ধের মাঠে। আমার মেয়ে জায়নামাজে বসে তার জন্য দোয়া করবে আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকবে পথের দিকে, কখন ফিরে আসবে তার স্বপ্নের শাহজাদা, এই আশায়। সে তার স্বামীর কাছে হবে স্বপ্নের রাণী। সে তার ভালবাসা দিয়ে জয় করে নেবে শ্বশুর-শ্বাশুরি, দেবর-ননদ সকলের ভালবাসা। পড়শি মহিলারা আমার মেয়েকে এক নজর দেখতে চাইবে তার গুণের কথা শুনে। আমি এই জন্য গর্ববোধ করব যে, আমার মেয়ে ও তার স্বামী পরষ্পর প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। সে এক এমন প্রীতি যা সারা জীবনেও শেষ হবার নয়। বুড়ী হয়ে গেলেও তাদের ভালবাসা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকবে। দিন যত যাবে তার সম্মান বাড়বে বৈ করবে না। তোমাকে দেখার জন্য কি কেউ আগ্রহ প্রকাশ করবে? তুমি তো তারই মত এক মেয়ে। তোমাকে দুদিন না দেখলে কেউ কি তেমন অস্থিরতা বোধ করবে? করবে না। কারণ তুমি এক বেপর্দা নারী, মরুভূমির মতই খোলামেলা উন্মুক্ত প্রান্তর। যেখানে কোন রহস্য নেই, পরিচর্যার মত উদ্যান নেই, আবিষ্কারের মত আকর্ষণ নেই। ফলে তোমার কোন সম্মান নেই। কারো কাছে জমা নেই তোমার জন্য একটু স্নেহ বা প্রেম। কেউ নেই যে তোমাকে ভালবাসার যোগ্য মনে করবে।’
‘আপনি আমার সাথে এমন সব কথা বলছেন কেন?’ মেয়েটি এমন কাতর স্বরে জিজ্ঞেস করলো যেন সে স্বরটি তার নয়।
‘আমি তোমাকে বলতে চাই, তোমার মত মেয়ের পবিত্র হওয়াই উচিত!’ আতাউল হাশেম উত্তরে বললেন, ‘মুসলমানরা নারী জাতিকে আল্লাহর রহমত মনে করে। প্রেম প্রীতি আর ভালবাসার যে পবিত্র বন্ধনে আমাদের পরিবার গঠিত তুমি যদি তার সন্ধান পেতে তবেই তুমি বুঝতে পারতে, সতীত্ব ও ধর্মের অনুপম মাহাত্ম। শান্তি ও সুখের কি অপূর্ব নেয়ামতে ধন্য আমাদের জীবন সে কথা তুমি বুঝতে পারবে না। কারণ তুমি সে ভালবাসার সুবাস কোনদিন পাওনি। যে ভালবাসা অন্তরের অন্তস্থলে শান্তির বাগান রচলা করে। দুর্ভাগ্য তোমাদের, তোমরা পুরুষের লোভ-লালসা দেখেছ কিন্তু ভালবাসা দেখোনি।’
মেয়েটির মনে হচ্ছিল, স্নিগ্ধ শীতল নিস্তব্ধ রাতের উন্মুক্ত পটভূমিকায় টিলার ওপর যেন কোন অদৃশ্যলোক থেকে ভেসে আসছে অপার্থিব শব্দমালা। আতাউল হাশেম একটা উপলক্ষ মাত্র।
মেয়েটি অবাক বিস্ময় নিয়ে আতাউল হাশেমের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখতে আর দশজন পুরুষের মতই একজন পুরুষ বৈ তো নয়! কিন্তু অন্যেরা তার রূপ দেখে যেমন পতঙ্গবৎ ঝাপিয়ে পড়ে, তাঁর মধ্যে তাঁর সামান্যতম আগ্রহও নেই। আতাউল হাশেম কোন নিশ্চল পাথর নয়। তাঁর শরীরেও রক্ত মাংশ আছে, আবেগ উত্তেজনা আছে, কিন্তু তাকে সংযত সংহত করার কি অসামান্য শক্তি রাখে এই লোক!
মেয়েটি অস্থির হয়ে বললো, ‘আপনার কথার মধ্যে এমন নেশা ধরানো মাদকতা রয়েছে যে, এমন আমি শরাবে বা হাশিসেও পেয়েছি। আমি আপনার সব কথা বুঝতে পারিনি, তবে সব কথাই আমার অন্তরে খোদাই হয়ে গেছে।’
মেয়েটি ছিল বুদ্ধিমতি। কারণ হাবাগোবা লোকদের গোয়েন্দা বিভাগে নেয়া যায় না। পুরুষদেরকে আঙ্গুলের ওপরে নাচানোর ট্রেনিং তাকে শিশুকাল থেকেই দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে সব ট্রেনিং আজ আর কোন কাজেই এলো না, বরং এই পুরুষটি সাপের বিষ দাঁত ভাঙার মত তার এতদিনের গর্ব ও অহংকার যেন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
এরপর আতাউল হাশেমের সাথে তার আরো অনেক কথাই হলো। ইসলামের অনুপম সৌন্দর্যের অনেক কিছুই সে জানতে পারল এ আলোচনা থেকে। পেশাদার সুন্দরীর পরিবর্তে মমতাময়ী এক নারীর মহিমা ফুটে উঠল তার কথাবার্তা ও আচরণে। এক সময় সে প্রশ্ন করলো, ‘আমাকে আপনারা কেমন শাস্তি দেবেন?’
‘আমি তোমাকে কোন শাস্তিই দিবো না।’ আতাউল হাশেম বললেন, ‘কাল সকালে তোমাদেরকে আমি প্রধান সেনাপতির কাছে পাঠিয়ে দেবো।’
‘তিনি আমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবেন?’
‘যা আমাদের আইনে লেখা আছে তাই।’
‘আপনি কি আমাকে ঘৃণা করছেন?’
‘না।’
‘আমি শুনেছি, মুসলমানরা একের অধিক স্ত্রী রাখতে পারে।’ মেয়েটি বললো, ‘যদি আপনি আমাকে আপনার স্ত্রী বানিয়ে নেন তবে আমি আপনার ধর্ম গ্রহন করবো। সারা জীবন আপনার খেদমতে নিয়োজিত থাকবো।’
‘আমি তোমাকে স্ত্রী নয়, কন্যার মর্যাদা দিতে পারি।’ আতাউল হাশেম বললেন, ‘কারণ তুমি আমার কন্যার বয়সী।’
তারা তখনো আলাপে মগ্ন। মেয়েদের সঙ্গী পুরুষ লোকটি তিনজন সৈন্যের সাথে শুয়েছিল। ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে থাকলেও সে আসলে জেগেই ছিল। সে দেখেছিল আতাউল হাশেম একটি মেয়েকে জাগিয়ে নিয়ে গেছে। এতে সে খুব খুশি হয়েছিল। তার ধারনা হয়েছিল, মেয়েটি আতাউল হাশেমকে প্রেমের জালে ফাসিয়ে দিতে পারবে। আর যদি তা না পারে অন্তত ধোঁকা দিয়ে তাকে হত্যা করতে পারবে।
সে শুয়ে শুয়ে মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করছিল। অনেকক্ষণ পরেও ফরে না আসায় মেয়েটি কি করছে দেখার কৌতূহল জাগলো তার মনে। সে ঘুমন্ত সৈনিকদের দিকে তাকালো। বেহুশ হয়ে ঘুমিয়ে আছে তারা। হাসল লোকটি। মনে পড়ল, সন্ধ্যার পর সৈন্যদের সাথে গল্প করার ছলে সে তাদেরকে কিছু হাশিস পান করিয়েছিল।
গ্রেফতার করার সময় তার কাছ থেকে হাশিসের পুটলিটা ছিনিয়ে নিয়েছিল সৈন্যরা। কিন্তু জোব্বার চোরা পকেটে যে হাশিস ছিল সেটা তারা টের পায়নি। সেখান থেকে কিছু হাশিস বের করে তাদেরকে কৌশলে পান করিয়ে দিয়েছিল সে। তারা তো আর এ ধরনের নেশায় অভ্যস্থ ছিল না, তাই অল্প হলেও কাজ দিয়েছে বেশি। তারই প্রভাবে সৈন্যরা এখন মরার মত বেহুশ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। সুদানী লোকটি এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইল। পালানোর পরিকল্পনার করল সে।
বিছানায় উঠে বসল, তাকালো এদিক ওদিক। আলতো করে উঠে এল বিছানা ছেড়ে। মেয়েটিকে খুঁজতে খুঁজতে টিলার চূড়ায় হঠাৎ সে তাদের দেখতে পেল।
দেখলো, মেয়েটি আতাউল হাশেমের পাশে বসে আছে এবং গল্প করছে। বুঝলো, কমান্ডারকে হত্যা করার কোন সুযোগ সে এখনো তৈরি করতে পারেনি। সুতরাং কমান্ডারকে হত্যা করার দায়িত্ব এখন তাকেই নিতে হবে এবং এখনই। পায়ে পায়ে ওখান থেকে ফিরে এল সে আস্তানায়। সৈন্যদের ব্যবহার্য ধনুক ও তিন চারটা তীর নিয়ে বেরিয়ে এল ওখান থেকে। পাহারাদারদের দৃষ্টি এড়িয়ে চূড়ার দিকে উঠতে শুরু করল। এমন একটা জায়গায় সে পৌঁছতে চায় যেখান থেকে কমান্ডারকে সে স্পষ্ট দেখতে পাবে এবং বেশি দূরেও হবে না। আতাউল হাশেম যেদিকে পিঠ দিয়ে বসেছিলেন সেদিক দিয়ে খুব সন্তর্পণে টিলার চূড়ার প্রান্তে পৌঁছে গেল সে। আস্তে আস্তে মাথা তুলে দেখল মাত্র আট দশ হাত দূরে পিছন ফিরে নিশ্চিন্তে বসে গল্প করছে আতাউল হাশেম। মুখোমুখি বসে আছে বলে মেয়েটির মুখ তার দিকে ফেরানো।
ধীরে সুস্থে ধনুতে তীর জুড়ল লোকটি। কেউ তাকে দেখে ফেলবে বা প্রতিরোধ করবে এমন কোন সম্ভাবনা তার কল্পনাও এলো না। মেয়েটি তাকে দেখে ফেললেও তার কোন ক্ষতি নেই, কারণ ও-তো তারই সহযোগী। তাই তার মধ্যে কোন তাড়াহুড়ার লক্ষণ দেখা গেল না।
নিশানা ঠিক করতে যাবে এমন সময় মেয়েটির চোখে পড়ে গেল লোকটি। আতাউল হাশেম এ সবের কিছুই টের পেল না। অকস্মাৎ মেয়েটি আতাউল হাশেমের কোমরে ঝুলানো ছুরিটির ওপর ঝাপিয়ে পড়ল এবং চোখের পলকে তা ছিনিয়ে নিয়ে সর্ব শক্তি দিতে ছুঁড়ে মারল লোকটির গলায়। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল লোকটি, তার আগেই ধনুক থেকে ছুটে গিয়েছিল তীর। তীরটা ছুটে এসে বিদ্ধ হলো মেয়েটির বুকে।
মেয়েটির আচমকা ধাক্কায় আতাউল হাশেম মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। উঠে বসার আগেই ‘আহ’ বলে বুক চেপে ধরল মেয়েটি। মেয়েটির ছুঁড়ে মারা খঞ্জর সুদানী লোকটির শাহরগ কেটে দু’ফাঁক করে দিল। তার হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল নিশানাহীন তীর।
বিদ্যুৎ বেগে উঠে বসলেন আতাউল হাশেম। পেছনে ঘাড় না ফিরিয়েই ঝাপ দিলেন সেদিকে। দুই গড়ান খাওয়ার আগেই যেখান থেকে তীরটি নিক্ষেপ করা হয়েছিল সেখানে পৌঁছে গেলেন। লোকটি দুহাতে গলা চেপে ধরে সেখান থেকে খঞ্জর টেনে বের করার চেষ্টা করছিল।
আতাউল হাশেম দেখলেন লোকটির চেহারা বিকট ও ভয়ংকর আঘাত ধারণ করেছে। চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। এ অবস্থায় কন্ঠার হাড়ে আটকেপড়া ছুরিটি সে কোনমতে ছুটিয়ে ফেলতে সক্ষম হলো এবং সামনেই আতাউল হাশেমকে দেখতে পেয়ে আক্রমণের ভঙ্গি করে এক পা এগোল। আতাউল হাশেম জোড়া পায়ে লাথি মারলো তার বুকে। লোকটি দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল, কিন্তু আর উঠতে পারল না। আতাউল হাশেম সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে পড়ল লোকটির বুকের ওপর। দেখলো, তার শাহরগ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
আতাউল হাশেম খঞ্জরটি তুলে নিলেন। লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে এলেন মেয়েটির কাছে। তীরটি ছুটে এসেছিল খুব কাছ থেকে। মেয়েটির বুকে তা এমনভাবে গেঁথে ছিল যে, তা টেনে বের করার কোন উপায় রইল না। মেয়েটির প্রাণ বায়ু তখনো বেরিয়ে যায়নি। ডাগর দুটি চোখ মেলে সে তাকিয়েছিল শূন্য পানে।
আতাউল হাশেম মেয়েটির পাশে ঝুঁকে পড়লেন। মেয়েটি আতাউল হাশেমের একটি হাত আঁকড়ে ধরল নিজের হাতে। বলল অস্ফুটস্বরে, ‘আপনি আমার জন্য দোয়া করুন। যে শান্তির বাণী আপনি আমাকে শুনিয়েছেন একটু আগে, আল্লাহ যেন আমার আত্মাকে সে শান্তি আশ্রয়ে ঠাঁই দেন। আমার আত্মা যেন আমার দেহের মত এই মরুভূমির আর পথহারা হয়ে ছুটে না বেড়ায়। আমার এ দেহ পাপের সাগরে হাবুডুবু খেয়েছে সারা জীবন। আমাকে আশ্বাস দিন, আমার এই ক্ষুদ্র নেক কাজের বিনিময়ে আল্লাহ আমার সমস্ত গোনাহখাতা মাফ করে দেবেন। আমার মাথার ওপর ঠিক তেমনিভাবে হাত বুলিয়ে দিন, যেমন নিজের মেয়ের মাথার হাত বুলাতেন আপনি।’
আতাউল হাশেম তার মাথাটা টেনে নিলেন নিজের কোলে। তারপর সেখানে স্নেহের পরশ বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘আল্লাহ, তুমি আমার এই অবুঝ কন্যার জীবনের সমস্ত গোনাহখাতা মাফ করে দাও। আমার এ মেয়ে তো নিষ্পাপ ছিলো, তোমার অবাধ্য গোলামরা তাকে দিয়ে পাপ করিয়েছে। তাকে কেউ কোনদিন সৎ ও নেক পথের আলো দেখায়নি।’
মেয়েটি যন্ত্রণায় কাতর হয়ে কাৎরাচ্ছিল। আতাউল হাশেমের হাত শক্ত করে ধরে দ্রুত বলে উঠল, ‘আমার কথা শুনুন, এখান থেকে তিন ক্রোশ পূর্বদিকে সুদানীদের একটা ক্যাম্প আছে। সেখানকার প্রতিটি সৈনিক আপনাদের নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর। শুনুন, আপনার সৈনিকরা চারদিকে বেশি করে ছড়িয়ে পড়তে গিয়ে পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার জোগাড় করেছে। ওরা এভাবে ছড়িয়ে থাকলে তাদের ভাগ্যে মৃত্যু অথবা বন্দী ছাড়া গতি নেই। আপনাদের প্রতিটি দল ও কমান্ডারের পিছনে আমার মত মেয়ে লেগে রয়েছে। আমার সাথে যে মেয়েটি এসেছে তার সাথে মিলে এ পর্যন্ত আমি আপনার চারজন গ্রুপ কমান্ডারকে ফাঁসিয়ে শেষ করেছি।
মিশরের চিন্তা করুন! ক্রুসেডাররা সেখানে খুব ভয়াবহ ও সুপরিকল্পিত জাল বিস্তার করে রেখেছে। আপনার জাতির অভিজাত শ্রেণী ও সেনাদের মধ্যে এমন কিছু নেতৃস্থানীয় লোক রয়েছে যারা খৃস্টানদের বেতনভুক কর্মচারী। সেই সব চর ও গাদ্দাররা সবাই প্রকাশ্যে আপনাদের বন্ধু সেজে থাকে কিন্তু তারা মূলত খৃস্টানদের আজ্ঞাবহ। তারা আমার মত সুন্দরী মেয়ে ও অর্থ সম্পদের গোলাম হয়ে বিকিয়ে দিয়েছে নিজেদের ঈমান। মিশরকে বাঁচান। সুদান ত্যাগ করে চলে যান যদি মিশরকে বাঁচাতে চান। দুশমনদের শায়েস্তা করার আগে গাদ্দারদের নির্মূল করুন! আমি কারো নাম জানিনা, যেটুকু জানা ছিল বলে দিলাম।
আপনিই আমার কাছে প্রথম পুরুষ যিনি আমাকে মেয়ের মর্যাদা দিয়েছেন। আপনি আমাকে পিতার স্নেহ দিয়েছেন। তার বিনিময়ে আমি আপনাকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে গেলাম। আমি আপনাকে বিচ্ছিন্ন বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করুন এবং আসন্ন আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। দু’তিন দিনের মধ্যেই আপনার ওপর বড় ধরণের আক্রমণ হবে। ফাতেমীয় ও ফেদাইন দলের লোকদের থেকে খুব সাবধান! এই দু’টি দল মিশরের বহু নামীদামী লোককে হত্যা করার পরিকল্পনা তৈরী করে রেখেছে। জাতির কল্যাণ চিন্তায় যারা সব সময় অস্থির, যারা ত্যাগী ও সৎ, তাদের প্রায় সকলেই তাদের টার্গেটে আছে। সবার ওপরে আছে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর নাম, আপন দেশ ও জাতির জন্য যার ত্যাগ ও কোরবানীর পরিমাপ করার সাধ্য আমার নেই।’
মেয়েটির আওয়াজ ক্রমশঃ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেল সে।
ততক্ষণে রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। একটু পর সকাল হল। আতাউল হাশেম লাশ দু’টি ও জীবিত মেয়েটিকে নিয়ে প্রধান সেনাপতি তকিউদ্দিনের কাছে চলে গেলেন। তিনি প্রধান সেনাপতিকে সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে খুলে বললেন। মেয়েটি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাকে যে সতর্কবাণী শুনিয়েছে তাও জানালেন তাকে। তকিউদ্দিন আগে থেকেই যুদ্ধের বিপর্যস্ত অবস্থায় যথেষ্ট পেরেশান ছিলেন, এসব কথা শুনে তিনি আরও অস্থির হয়ে গেলেন।
‘আমি আমার ভাইয়ের আদেশ ছাড়া পিছু হটতে পারি না।’ বললেন তকিউদ্দিন, ‘আমি একজন দায়িত্বশীল ও বিচক্ষণ কমান্ডারকে ক্রাকে পাঠিয়েছি। তার ফিরে না আসা পর্যন্ত সকলকেই নিজ নিজ সেক্টরে দৃঢ় হয়ে অবস্থান করতে হবে।’
সুলতান আইয়ুবী কমান্ডারের কাছ থেকে শোনা যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছিলেন। সামরিক উপদেষ্টাদেরও ডেকে সামগ্রিক পরিস্থিতি তাদের সামনে সবিস্তারে উপস্থাপন করলেন। তিনি ভাবছিলেন, ছড়িয়ে পড়া সৈন্যদের আবার ঐক্যবদ্ধ করে পিছু হটানো সহজ ব্যাপার নয়। শত্রুরা তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে দেবে না। আর পিছু ফিরাতে গেলে ঐসব সৈন্যদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। যেমন মিশরে হয়েছে। এতে কেবল ওখানকার সৈন্যদের মন ভাঙবে এমন নয়, এখানে যারা আমার সঙ্গে আছে তাদেরও মন ভাঙবে, এমনকি সমগ্র মিশরেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। কিন্তু বাস্তবতা থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখাও মুশকিল।
নিজেকে নিজে ধোঁকা দেয়া ভয়ংকর ব্যাপার। বাস্তবতার দৃষ্টিতে তকিউদ্দিনের সৈন্যবাহিনী নিয়ে ময়দান থেকে ফিরে যেতে বলাই আমাত উচিত। কারণ আমি তাকে কোন সেনা সাহায্য পাঠাতে পারছি না। নিজেও ক্রাকের অবরোধ উঠিয়ে তার সাহায্যে এগিয়ে যেতে পারব না। আমার ভাই বিরাট ভুল করে ফেলেছে। তার মূল্যবান সেনাবাহিনীর ক্ষতি সাধন করেছে।
‘এটা জাতীয় সম্মানের প্রশ্ন হতে পারে না।’ একজন উপদেষ্টা বললেন, ‘আমাদের এখন সুদানের যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া উচিত। নেতা ও শাসকদের ভুল সিদ্দান্তের জন্য সেনাবাহিনীর বদনাম হচ্ছে। এখন জাতিকে এই কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া উচিত যে, সুদানে আমাদের সৈন্যদের ব্যর্থতার দায়িত্ব শুধু সৈন্যদের ওপর বর্তায় না, শাসকরাও এর অংশীদার।’
‘নিঃসন্দেহে এটা আমার ভাইয়ের ভুলের কারণেই ঘটেছে।’ সুলতান আইয়ুবি বললেন, ‘আর এ ভুলের শরীক আমিও। কারণ আমি তকিউদ্দিনকে এ ধরণের পদক্ষেপ নিতে নিষেধ করিনি। আমি তাকে বলেছিলাম, অবস্থার প্রেক্ষিতে তুমি যে কাজ করা উচিত মনে করো, তা তুমি করতে পারো। সবকিছু আমাকে না জানালেও চলবে। ও যে এতবড় একটা কাজ বাস্তবতা যাচাই না করেই করে ফেলবে ভাবিনি। এখন সে নিজেকে শত্রুর দোয়া ও করুণার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। আমি আমার ও আমার ভাইয়ের ক্রুটির কথা জাতির কাছে এবং নূরুদ্দীন জঙ্গীর কাছে গোপন করব না। আমি ইতিহাসকে ধোঁকা দিতে পারি না। আমি লিখিতিভাবে স্বীকার করব, এই পরাজয়ের দায়িত্বভার সৈন্যদের ওপর নয়, আমাদের ওপরই বর্তায়। নইলে আমাদের ইতিহাস পরবর্তী শাসকদের সর্বদা ধোঁকা দেবে। আমি মুসলিম রাজ্যের পরবর্তী সুলতান, বাদশা ও আমীরগণের জন্য এ দৃষ্টান্ত রেখে যেতে চাই যে, তারাও যেন নিজের ভুলক্রুটি গোপন করে তার দায়দায়িত্ব নিরপরাধ সৈন্য ও জনতার ওপর না চাপায়। এটা এমন এক ভুল, যা বিশ্বের বুকে ইসলাম প্রসারিত করার পরিবর্তে ইসলামকে খাটো করে দেবে।’
সুলতান আইয়ুবীর চেহারা লাল হয়ে গেল। তাঁর কন্ঠস্বর কাঁপতে লাগলো। মনে হল, নিজের মুখে পিছু হটার শব্দ উচ্চারণ করতে তাঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে। কারণ, তিনি কখনও পিছু হটেননি। প্রচণ্ড অসুবিধার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করতে আপত্তি নেই তার, তার আপত্তি পরাজয় মেনে নেয়ায়। কিন্তু এখন অবস্থা তাঁকে জীবনের দুঃসহ কাজটি করতে বাধ্য করছে।
তিনি তকিউদ্দিনের প্রেরিত কমান্ডারকে বললেন, ‘তকিউদ্দিনকে দিয়ে বলবে, তোমার ভাই তোমাকে তোমার বাহিনী সুসংহত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন গ্রুপকে আবার একত্র করতে বলবে। তারপর তাদেরকে একটু একটু করে মিশরের সীমান্তের দিকে সরিয়ে নিয়ে আসরে বলবে তাকে। শত্রুদের পিছ ধাওয়া করার সুযোগ দেবে না। পেহনে হটবে লড়াই করতে করতে। যেন তারা ভাবে তোমরা তাদেরকে এমন কোন জায়গায় নিয়ে আসতে চাও, যেখানে এলে তোমরা তাদেরকে চূড়ান্ত আঘাত হানবে। সীমান্তে পৌঁছে তোমরা সংঘবদ্ধভাবে মজবুত হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। কোন অবস্থাতেই দুশমনকে মিশরের মাটিতে পা দেয়ার সুযোগ দেবে না।
যদি শত্রুরা সীমান্ত পেরিয়ে মিশরের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে তবে তাদেরকে প্রবলভাবে বাঁধা দেবে। সীমান্তে একবার দাঁড়ানোর পর দুশমনকে কোণঠাসা করার জন্য কমান্ডো বাহিনীর সহযোগিতা নিতে বলবে তাকে।
কোন দলকে যেন অন্য দল শত্রুদের আক্রমণের মধ্যে ছেড়ে না আসে। যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক, সর্বাবস্থায় সবাই এক সাথে থাকবে। আমি পিছু সরে আসাকে সহ্য করতে পারি কিন্তু কারো অস্ত্র সমর্পণ করাকে আমি মোটেই বরদাশত করবো না। পিছু হটা সহজ ব্যাপার নয়। অগ্রসর হওয়ার মাঝে যে ঝুকি থাকে পিছনে সরে আসার ঝুঁকি তারচে কোন অংশে কম নয়। যে কোন অবস্থার দিকে কড়া দৃষ্টি রাখার জন্য দ্রুতগতিসম্পন্ন সশস্ত্র গোয়েন্দাদের সব সময় কাজে লাগাবে।
আমি তোমাকে কোন লিখিত পয়গাম বা চিথি দেবো না। যদি পথে শত্রুর হাতে ধরা পড়ো তবে সবকিছু প্রকাশ হয়ে পড়ার আশংকা আছে। সাবধানে পথ চলবে। কারণ পথে বিপদে পড়ার ঝুঁকি আছে।’
সুলতান আইয়ুবী কমান্ডারকে আরো কিছু নির্দেশনা দিয়ে বিদায় দিলেন। তখনও তার অশ্বখুরের খটাখট শব্দ শোনা যাচ্ছিল, এমন সময় জাহেদান তাবুর মধ্যে প্রবেশ করে বললেন, ‘কায়রো থেকে এক কাসেদ এসেছে।’
‘তাকে এখুনি ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’ বললেন সুলতান আইয়ুবী।
ভেতরে প্রবেশ করলেন সুলতানের গোয়েন্দা বিভাগের এক পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি মিশরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এক হতাশাব্যঞ্জক খবর নিয়ে এসেছেন।
তিনি বললেন, ‘মিশরে শত্রুদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ খুবই বেড়ে গেছে। আলী বিন সুফিয়ান শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সর্বত্র রাত দিন ছুটে বেড়াচ্ছেন। অসম্ভব ব্যস্ততায় কাটছে তার সময়। তিনি আশংকা করছেন, যে কোন মুহূর্তে মিশরে সেনা বিদ্রোহ ঘটে যেতে পারে।’
সুলতান আইয়ুবীর চেহারার রঙ যেন একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। যদি তিনি এখন মিশরে থাকতেন তবে তিনি এ সব ব্যাপার নিয়ে কোন পরোয়াই করতেন না। তিনি মিশরকে খুবই ভয়ংকর অবস্থা থেকে বাঁচিয়েছিলেন। খৃস্টান ও ফাতেমীয়দের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের কঠিন আঘাতক্র তিনি ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। সমুদ্রের দিক থেকে ক্রুসেড বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। বিলাসপ্রিয় এবং দেশ ও জাতির ব্যাপারে উদাসীন খলিফাকে পদচ্যুত করে জাতির সামনে যে কঠিন বিপদ ঘনিয়ে এসেছিল সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথেই তার মোকাবেলা করেছিলেন। কিন্তু এখন ক্রাক শহর অবরোধ করে তিনি নিরূপায় হয়ে পড়েছেন। এখন এখান থেকে অনুপস্থিত থাকার অর্থ যুদ্ধের গতি শত্রুদের হাতে তুলে দেয়া।
তিনি শুধু ক্রাক দুর্গই অবরোধ করেননি, শহরের বাইরে ক্রুসেড বাহিনীর এক বিরাট দলকেও ঘেরাওয়ের মধ্যে দেলে রেখেছেন। এই ক্রুসেড বাহিনী আবেষ্টনী ভেদ করার জন্য হামলার পর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে এক রক্তাক্ত যুদ্ধ চলছে প্রতি মুহূর্তে। সুলতান আইয়ুবীর রণকৌশল ও কুশলী চালের ফলে বিপদের ঘেরাটোপ পড়ে ছটফট করছে খৃস্টানদের বিশাল বাহিনী। যুদ্ধ এখন এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যখন তাঁর কমান্ড ও নির্দেশনা ছাড়া এই যুদ্ধ সন্তোষজনক পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
ওদিকে সুদানের অবস্থাও মিশরকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এটা একটা বাড়তি সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সুলতান আইয়ুবীর কাছে এটা পরিষ্কার, যদি তকিউদ্দিন পালানোর মনোভাব নিয়ে পিছু হটা শুরু করে তবে শত্রুরা তাদেরকে পথেই শেষ করে দেবে এবং তারপর তারা সোজা মিশরে ঢুকে যাবে।
এদিকে ক্রাকের অবরোধের আশু কোন সমাধানের সম্ভাবনা নেই। এই দুই সেক্টরের নাজুক অবস্থার মধ্যে মিশরে সেনা বিদ্রোহের আশংকা খুবই বেদনাদায়ক।
ও সংবাদ সুলতান আইয়ুবীর পা কাঁপিয়ে দিয়েছে। তিনি কিছুক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে তাবুর মধ্যে পায়াচারী করলেন। এক সময় বলে উঠলেন, ‘আমি ক্রুসেডারদের সমস্ত সৈন্যদের মোকাবেলা করতে পারি। তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে বাহিনী প্রস্তুত করে রেখেছে তাদের মোকাবেলার জন্য আমার এ ক্ষুদ্র বাহিনীই যথেষ্ট। কিন্তু জাতির গুটিকয় গাদ্দার আমাকে পরাজিত করার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তার মোকাবেলা করা আমার জন্য খুব কষ্টের ও দুঃখের।’
যে সব মুসলমান খৃস্টানদের হয়ে কাজ করছে তারা যদি ধর্ম পরিবর্তন করে খৃস্টান হতে চায় তবে খৃস্টানরা তাদের বাঁধা দিয়ে বলে, ‘না না, তোমরা তোমাদের ধর্মেই থাকো। তোমরা আমাদের কাছ থেকে বেতন নেবে জাতির সাথে গাদ্দারী করবে।’
তিনি নীরব হয়ে গেলেন। তাবুর মধ্যে যারা বসেছিল তারাও নীরব হয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবী সকলকে বার বার লক্ষ্য করলেন। মনে হলো তিনি কিছু বলতে চান কিন্তু কিভাবে বলবেন স্থির করতে পারছেন না। অবশেষে এ ধারনাই সত্য প্রমাণ হলো। তিনি সবার দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ আমাদের থেকে কঠিন পরীক্ষা নিতে চান। যদি আমরা সকলেই সেই পরীক্ষার জন্য তৈরী থাকি তবে অবশ্যই আল্লাহ আমাদের সাফল্য দেবেন। এটা আল্লাহর ওয়াদা। শর্ত হলো, ঈমানের দাবী পূরণের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের। এরপর সকল মুসিবতে সে সিদ্ধান্তের ওপর অনড় অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর ওয়াদা পূরণ করেন। আমরা যদি আমাদের সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকতে পারি, ময়দানে যদি আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের কদমকে মজবুত রাখতে পারি, তাহলে আল্লাহ তাঁর ওয়াদা পূরণ করবেনই। আল্লাহর ওয়াদা মিথ্যা হতে পারে না, প্রশ্ন হলো আল্লাহর ফয়সালা আসার আগ পর্যন্ত আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো কি না?’
তিনি তাঁর সামনে বসা সামরিক উপদেষ্টা ও সেনা অফিসারদের দিকে তাকিয়ে তাঁর বিশ্বাস ও একীনের কথা বললেন। বললেন, ‘কোন ঈমানদার আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হতে পারেন না। আর আল্লাহ যাদের মোহাফেজ হন তাদের পরাজিত করে দুনিয়ায় এমন কোন শক্তি নেই। এখন প্রয়োজন আপনাদের সুচিন্তিত পরামর্শ ও সঠিক সিদ্ধান্ত। আমি বিশ্বাস করি, বিজয় ও সাফল্য সো সময় লুকিয়ে থাকে সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর।’ থামলেন সুলতান।
একটু আগে যে দুঃশ্চিন্তা এসে ভর করেছিল তাবুর ভেতর, সকলের চেহারা থেকে সে দুঃশ্চিন্তা বিদায় নিয়ে সেখানে সংকল্পের এক অনড় দৃঢ়তা ফুটে উঠল। প্রত্যেকের চেহারায় সে দৃঢ়তার ছবি অটল ভাস্কর্যের মত স্থির হয়ে আছে।
সুলতান আইয়ুবীকে বলা হয়েছিল, মিশরে ক্রুসেডারদের ধ্বংসাত্মক কাজ বেড়ে গেছে এবং সেখানে বিদ্রোহের আশংকা আছে। কিন্তু পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তার কিছুই তাঁকে খুলে বলা হয়নি। প্রকৃত ঘটনা আরও ভয়াবহ! তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে খৃস্টানরা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করে। সেনাবাহিনী, সরকারী অফিসার এবং শাসকদেরকে বিভিন্ন দল-উপদলে ভাগ করে ওদেরকে খেলাচ্ছে খুব।
তকিউদ্দিন সুদানে অভিযান নিয়ে চলে যাওয়ার কয়েক দিন পরই তিনি খাদ্য ও রসদ পাঠান। সংবাদ বাহককে বলে দেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রসদ পাঠাতে বলবে। কিন্তু দুদিন চলে যাওয়ার পরও রসদ পাঠানোর কোন উদ্যোগ না দেখে সে সরকারী রসদ ভান্ডারের প্রধান নির্বাহীর সাথে দেখা করে। তার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রসদ না থাকলে পাঠাবো কোত্থেকে? এক সাথে দুই সমরাঙ্গনে পাঠানোর মত পর্যাপ্ত রসদ আমার কাছে জমা নেই। এক পারা যায় আইয়ুবীর সৈন্যদের ক্ষুধার্ত রেখে ওদের চাহিদা মিটানো, আর পারা যায় কায়রোর বাজারের সমস্ত খাদ্যশস্য কিনে সেখানে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। তুমি আমাকে এর কোনটা করতে বলো?’
এরপর সে খাদ্য বিভাগের সচিবের সাথে দেখা করে। সচিব সুলতান আইয়ুবীর এক সময়ের সঙ্গী ও বন্ধু ছিলেন। তিনিও প্রায় একই ধরনের কথা বললেন। তার বক্তব্যে আর সন্দেহ করা চলে না। দলে খাদ্য শস্যের ঘাটতি আছে স্বীকার করেও তাকে অনুরোধ করা হলো, যে কোন প্রকারেই হোক সমর সেক্টরে খাদ্য পাঠানোর।
এ অনুরোধের পর সচিব রসদের ব্যবস্থা করলেন বটে তবে তাতে পাঁচ দিন সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। পঞ্চম দিন রসদ নিয়ে কাফেলা রওনা হলো। উট ও খচ্চরের বিরাট এক কাফেলা। তকিউদ্দিন খাদ্যশস্য পাহারা দেয়ার জন্য কাফেলার সাথে অশ্বারোহী সৈন্য পাঠানোর জন্য বলে দিয়েছিলেন। সচিবকে বলা হলো সে কথা। তিনি তাতে আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘এর কোন প্রয়োজন নেই। রাস্তাঘাট যথেষ্ট নিরাপদ আছে। তাছাড়া মিশরে এখন যে পরিমাণ সৈন্য আছে এখানেই তাদের প্রয়োজন রয়েছে।’
ফলে কোন রকম পাহারা ছাড়াই রসদপত্র পাঠিয়ে দেয়া হলো। রসদ পাঠানোর ছয় দিন পর সংবাদ এল, রাস্তায় সুদানী শত্রুরা সমস্ত রসদ ও রসদবাহী উট, গাধা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে আর আরোহীদের সকলকে হত্যা করেছে।
কায়রোর প্রশাসক ও সেই সচিব এ সংবাদে খুব অস্থির হয়ে উঠলেন। রসদ নষ্ট হয়ে যাওয়া কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। সুদানের যুদ্ধ (______) সৈন্যের প্রয়োজন অনুভব করেও তাঁর অস্থিরতা বেড়ে গেল। তিনি ভান্ডার কর্মকর্তাকে বললেন, ‘জরুরী ভিত্তিতে সেই পরিমাণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে পাঠাও।’
উত্তরে সে বললো, ‘বাজারে খাদ্যশস্যের ঘাটতি আছে। ব্যবসায়ীদের খাদ্যশস্য আমদানী করতে বলতে হবে। মজুতদারদের গুদাম খুলে আমি দেখেছি, সব গুদাম খালি। মাংসের জন্যও দুম্বা ও বকরির কোন ব্যবস্থা নেই।’
খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, মিশরে যে সৈন্য আছে তারাও পুরোপুরি রেশন পাচ্ছে না। ফলে সৈন্যদের মধ্যে অস্থিরতা ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
ব্যবসায়ীরা বললো, ‘গ্রাম থেকে কোন খাদ্যশস্য বাজারে আসছে না।’
আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগকে হঠাৎ করে এ খাদ্য ঘাটতির কারণ অনুসন্ধানের জন্য তৎপর হতে বলা হলো। তারা খোঁজ নিয়ে দেখলো, কায়রোর বাইরে থেকে লোকজন গ্রামে আসে আর বাজার দরের বেশি দাম দিয়ে সকল পশু ও খাদ্যশস্য কিনে নিয়ে যায়। এর অর্থ হলো দেশ থেকে খাদ্যশস্য অন্য দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। তখনই আলী বিন সুফিয়ানের মনে পড়লো, তিন চার বছর আগে সুলতান আইয়ুবী মিশরের সেনাবাহিনীতে ব্যাপক রদলবদল করেছিলেন। তখন অধিকাংশ সেনা সদস্যই সুদানী বাসিন্দা। বিদ্রোহের অপরাধে তাদের তিনি বরখাস্ত করেন। পড়ে সীমান্ত এলাকার কৃষিযোগ্য জমিতে তাদের পুনর্বাসিত করেন। তারা তাদের উৎপাদিত শস্য মিশরের বাজারে বিক্রি করা বন্ধ করে দেয়ার ফলেই এ পরিস্থিতিএ সৃষ্টি হয়েছে।
এ তথ্য উদ্ঘাটিত হওয়ার পর খাদ্যশস্য সংগ্রহের কাজ সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত হলো। রাত দিন দৌড়াদৌড়ির পর তারা যে যৎসামান্য খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে পারলো তা সুদনের সেক্টরে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
খাদ্য সচিবের কাছে এ সমস্যা জটিল হয়ে দেখা দিল। এর আগে এমন খাদ্য ঘাটতি আর কোনদিন হয়নি। তার ভয় হলো, যদি সুলতান আইয়ুবী রসদ চেয়ে পাঠান তবে কি জওয়াব দেবেন? সুলতান আইয়ুবী কিছুতেই স্বীকার করবেন না মিশরে খাদ্য ঘাটতি আছে, দেশে দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে।
এই সমস্যার সমাধান করার জন্য তিনি সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হলো। এই কমিটির একজন ছিলেন হাকিম আল ইদরিস। তিনিই এ কমিটির প্রধান ছিলেন। অন্য দুজন ছিলেন বেসামরিক প্রশাশনের দুই পদস্থ কর্মকর্তা।
কমিটি বৈঠকে বসলো। আর ইদরিসকে অপর দুই সদয় বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী একই সাথে দুই দিকে রণাঙ্গন খুলে ভীষণ ভুল করেছেন। তকিউদ্দিনে সুদানে গিয়ে এখন আত্নরক্ষার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।’
‘ফিলিস্তিন মুসলমানদের জন্মভূমি।’ আল ইদরিস বললেন, ‘সেখান থেকে ক্রুসেডারদের বের করা মুসলমানদের জন্য ফরজ। সেখানে পর্দানশীল মুসলিম মহিলাদের ইজ্জত আবরু নিরাপদ নয়। মসজিদসমূহ ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত হয়েছে।’
‘এ সবই মিথ্যা দোষারোপ।’ একজন বললো, ‘আপনি কি সচক্ষে দেখেছেন। খৃস্টানরা মুসলমানদের ওপরে জুলুম করেছে, অত্যাচার করেছে?’
‘আমি অত্যন্ত বাস্তব ও সত্য কথা বলেছি।’ ইদরিস বললেন।
‘আপনি যা জানেন তা সত্য নাও হতে পারে। আমার মনে হয়, আমাদের কাছে সত্য গোপন করা হচ্ছে।’ অন্য সদস্য বললো।
‘সুলতান আইয়ুবী সম্মানিত ও প্রশংসাযোগ্য ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তাই বলে আমাদের সত্য কথা বলতে ভয় পাওয়া উচিত নয়। সুলতান আইয়ুবীকে সাম্রাজ্যবাদী নেশা পেয়ে বসেছে। তাঁকে এই নেশা কোথাও স্থির হয়ে শান্তিতে বসতে দিচ্ছে না। তিনি আইয়ুবী বংশকে রাজ বংশে পরিণত করতে চান।’ সেই সদস্য আরো বলল, ‘ক্রুসেড বাহিনী এক সর্বজয়ী বাহিনী। আমরা তার মোকাবেলা করতে পারবো না। আর ওরা যে আমাদের শত্রু এমনও নয়। যদি ক্রুসেড বাহিনী আমাদের শত্রুই হত তবে তারা মিশরের ওপরেই আক্রমণ চালাতো। তাদের কাছে এত বেশি সৈন্য আছে যে, আমাদের এই ক্ষুদ্র বাহিনীকে কবেই পদদলিত করতে পারতো। তারা সুলতান সালাহউদ্দিনের শত্রু হতে পারে, আমাদের শত্রু নয়।’
‘আপনাদের কথা আমার কাছে ক্ষমার অযোগ্য।’ আল ইদরিস বললেন, ‘বরং ভাল হত যদি আমরা যে সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসেছি সে সম্পর্কে কথা বলতাম।’
‘এ কথাও আমাদের কাছে সহ্যের বাইরে।’ অন্য একজন বললো, ‘কেননা একজন মানুষের ইচ্ছার কাছে সমগ্র জাতির কল্যাণ ও শান্তি আমরা কুরবানী দিতে পারি না। আপনি মাত্র দুটি সেক্টর নিয়ে চিন্তিত, আমরা সমগ্র জাতির কথা চিন্তা করছি। রসদপত্রের অবস্থা আপনি নিজেই দেখছেন, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সুদানের সেক্টর থেকে আমাদের সৈন্যরা ফিরে আসছে। আমরা মনে করছি, সুদানে রসদ পৌঁছানো বন্ধ রাখা হোক। তাতে সুবিধা হবে এই যে, তকিউদ্দিন দ্রুত পিছু সরে আসবেন। তিনি যত দ্রুত সরে আসবেন ততই আমাদের সৈন্যরা মরার হাত থেকে বেঁচে যাবে।’
‘এমনও তো হতে পারে, আমরা যদি রসদ না পাঠাই তবে আমাদের সৈন্যরা ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে যুদ্ধ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে এবং তকিউদ্দিন তাদের নিয়ে দুশমনের ঘেরাওয়ের মধ্যে আটকা পরে যাবেন!’ বললেন আল ইদরিস।
‘এতেও আমি অকল্যাণের কিছু দেখি না। শুধু শুধু লড়াই করে আমাদের সৈন্যরা এখন ক্রমাগত মরছে। রসদ না পেলে তারা আত্মসমর্পণ করবে। ফলে প্রাণে বেঁচে যাবে তারা, আমরা ওদের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়েও আনতে পারবো।’
‘আপনারা কি চিন্তা করে কথা বলছেন?’ আল ইদরিস বেশ রাগত স্বরেই বললেন।
‘আমরা যথেষ্ট চিন্তা করছি এবং আমাদের চিন্তা খুব স্বচ্ছ ও পরিষ্কার।’ উত্তরে বললো একজন, ‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী আমাদের ওপরে সামরিক শাসন চালাতে চান। তিনি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অনবরত যুদ্ধ চালিয়ে জাতিকে বুঝাতে চান যে, জাতির শান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষক শুধু সামরিক বাহিনী। জাতির ভাগ্য নির্ভর করছে এখন তাদেরই হাতে। যদি সুলতান আইয়ুবী শান্তি ও নিরাপত্তা চাইতেন, তবে একই সাথে দু’দুইটি শক্তির সাথে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ না বাঁধিয়ে আপশ মীমাংসার প্রচেষ্টা চালাতে পারতেন, শান্তিচুক্তি করতে পারতেন।’
আল ইদরিস এদের কথা শুনে ছটফট কর উঠলেন। তিনি কল্পনাও করেননি, সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে এবং ক্রুসেডারদের পক্ষে মিশরের মাটিতে দাঁড়িয়ে কী প্রকাশ্যে এ ধরনের শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। বৈঠকের পরিবেশ ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো এবং উচ্চস্বরে কথা কাটাকাটি শুরু হলো ওদের মধ্যে। কমিটির দুই সদস্য তাঁকে কথা বলার সুযোগই দিয়ে চায় না। শেষে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আমি এ বৈঠক বাতিল করে দিচ্ছি। আগামীকালই আমি আজকের আলোচনা ও আপনাদের লিখিত মন্তব্য লিখিতভাবে যুদ্ধ সেক্টরে মিশরের আমীরের কাছে পাঠিয়ে দিব।’ তিনি রাগে দাঁড়িয়ে গেলেন।
বৈঠক শেষে একজন সদস্য সাথে সাথে সেখান থেকে চলে গেল। অন্যজন, যার নাম আরসালান, বসে রইল আল ইদরিসের সঙ্গে। আরসালান বংশীয়ভাবে সুদানীদের সঙ্গে সম্পর্কিত। সে আল ইদরিসকে বললো, ‘আপনি ব্যক্তি পুজারী ও আবগে দ্বারা পরিচালিত। আমি কিছু কঠিন বাস্তবতা ও নিরেট সত্য আপনার সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি, আর এতেই আপনি রেগে গেলেন। আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি, আমার বিরুদ্ধে সুলতান সালাহউদ্দিনকে লিখবেন না, তাতে আপনারই ভাল হবে।’
তার বলার ভঙ্গি এবং স্বরে প্রচ্ছন্ন হুমকি ও চ্যালেঞ্জ ছিল। আল ইদরিস তার দিকে বাঁকা নজরে তাকালেন কিন্তু এর কোন জবাব দিলেন না।
আরসালান আবার বললো, ‘আপনি যদি ইচ্ছা করেন তবে আমি আপনার সাথে এ নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলবো।’
‘না! তোমার যা বলার এখনই বলতে পারো।’ আল ইদরিস বললেন।
‘আপনি আমার বাড়িতে চলুন।’ আরসালান বললো, ‘বেশ রাত হয়ে গেছে। খিদে পেয়েছে আমার। চলুন, এক সাথে বসে খেতে খেতে আলাপ করা যাবে। আপনার সাথে আমি কিছু জরুরী গোপন কথা বলতে চাই। আলোচনা শুনলেই বুঝবেন বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ।’
আল ইদরিস তার সঙ্গে তার বাড়িতে গেলেন। তিনি যখন বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলেন, মনে হলো কোন রাজা যখন বাদশাহর মহলে প্রবেশ করছেন। কিন্তু আরসালান তেমন কোন খান্দানী বড় ঘরের লোক ছিল না।
দু’জনে বাড়ির ভেতর এক কামরায় গিয়ে বসলেন। একটু পর এক সুন্দরী যুবতী রোপোর জগ, গ্লাস ও দু’টি পিয়ালা নিয়ে প্রবেশ করলো সেখানে। মেয়েটি কামরায় এসে সবকিছু রাখল ওদের সামনে। আল ইদরিস ঘ্রাণেই বুঝে নিলেন, এ শরাবের পিয়ালা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরসালান, তুমি তো মুসলমান! তুমি মদ পান কর?’