পরের দিন যখন হিশামের ছোট ভাইয়ের সাথে মিলিত হলো তখন বললো, ‘ ছেলেটা আবারও আমাকে উত্যক্ত করতে এসেছিল। আমি তাকে বলেছি, খবরদার, আমার একজন ভালবাসার মানুষ আছে, তুমি বেশি বিরক্ত করলে আমি কিন্তু সবকিছু তাকে বলে দেবো। ও বলে কি জানো! বলে, তুমি তো তোমার ছায়া। তুমি যেখানেই যাও, আমিও সেখানে যাই। কখনো আমাকে দেখতে পাও, কখনো পাও না। তোমার ভালবাসার ছেলেকে আমি চিনি, ওকে তোমার কাছ থেকে সরে যেতে বলো, নইলে তাকে আমি দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবো। আলম, তুমি খুব সাবধান থেকো। আমার বয় হচ্ছে ও না আবার তোমার কোন ক্ষতি করে বসে!’
হো হো করে হেসে উঠল আলম। ‘ঠিক আছে, ওকে বলো, পারলে সে চেষ্টা একবার করে দেখতে। কিন্তু ধমক দিয়ে আমাকে সরানোর চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না।’
এভাবে দুই ভাই একই মেয়ের জালে আটকা পড়ে গেল। দু’জনের কেউ আসল সত্য সম্পর্কে কিছুই জানতে পারল না, শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী অদৃশ্য শত্রুকে খুন করার নেশায় ধারাল ছুরি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। মেয়েটি দুই ভাইয়ের সাথেই আলাদাভাবে প্রেমের অভিনয় করে যেতে লাগলো সমান তালে। সপ্তাহ শেষে দেখা গেক, ব্যবসার প্রতি কোন মনোযোগ নেই বড় ভাইয়ের, আর ছোট ভাউ লেখাপড়া লাটে তুলে বন্য জন্তুর মত হিস্র পশু হয়ে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরের অলিগলিতে।
একদিন সন্ধ্যায় মেয়েটি হিশামকে শহর থেকে একটু দূরে তাদের যে খেজুর বাগান আছে ওখানে জরুরীভাবে দেখা করতে বললো। তারপর এল ছোট ভাইয়ের কাছে। তাকেও ঠিক একই সময়ে একই জায়গায় দেখা করার কথা বললো মেয়েটি।
‘ওখানে কেন?’ জানতে চাইল আলম।
‘সেই ছোকরা এখনো আমার পিছু ছাড়েনি। বলেছে, আজ আমি যেখানেই যাবো আমাকে অনুসরণ করবে সে। আর আমি যদি আমার পছন্দের প্রেমিকের সাথে দেখা করি তাহলে আমার সামনেই আমার প্রেমিককে হত্যা করবে। আমি তাকে বলেছি, তুমি যদি এতই বীর হও তবে সন্ধ্যায় আমাদের হেজুর বাগানে এসো। যদি তুমি তাকে হত্যা করতে পারো তবে আমি চিরদিনের জন্য তোমার হয়ে যাব। আর যদি না পারো তবে কোনদিন আর তুমি আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না। কিন্তু আলম, আমার ভয় হচ্ছে, তোমার যদি কোন বিপদ হয়! নাকি না করে দেবো ওকে আসতে?’
‘কি যে বলো! এই দিনটির জন্যই তো এতদিন ধরে আমি অপেক্ষা করছি। তোমার প্রেমই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে, এ নিয়ে তুমি কোন চিন্তা করো না।’
‘এলাকাটা নির্জন। সন্ধ্যায় অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে। আমার যেতে ভয় করছে।’
‘তুমি কিচ্ছু ভেবো না। তুমি রওনা হওয়ার পর আমি ধারেকাছেই থাকবো এবং তোমাকে পাহারা দেবো।’
শায়লা হিশামকে ঠিক একই কথা বলেছিল। দুই ভাই প্রতিদ্বন্দ্বীকে খুন করে প্রিয়াকে আপন করে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রক্তাক্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল।
সন্ধ্যায় বড় ভাই খঞ্জর হাতে নিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলো। সূর্য ডুবেছে এইমাত্র। বাগানটিকে ঘিরে ফেলেছে অন্ধকার। হিশামের মনে হলো, প্রতিটি গাছের গোঁড়ায় একজন করে ঘাতক ওঁৎ পেতে বসে আছে।
মেয়েটি ওখানে পৌঁছে দেখতে পেলো হিশাম আগেই এসে পৌঁছেছে। শায়লা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো, ‘যাক বাবা, তুমি এসে গেছো! আমার বুকটা এখনো ধরফর করছে। শয়তানটাকে দেখলাম আমাকে অনুসরণ করে পিছু পিছু আসছে।’
বড় ভাই খঞ্জর বের করে প্রস্তুত হয়ে রইল। দেখতে পেলো, দূর থেকে একটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। মেয়েটি বললো, ‘ওই যে সে এসে গেছে। কিন্তু আমি চাই না কোন খুনখারাবী হোক। ও যদি ভয় পেয়ে ফিরে যায় এবং আর আমাকে বিরক্ত না করার ওয়াদা করে তবে এবারের মত তাকে মাফ করে দিতে চাই। তুমি বসো, আমি ওকে এ প্রস্তাব দিয়ে দেখি ও কি করে।’
বড় ভাইকে রেখে ছোট ভাইয়ের কাছে এগিয়ে গেল শায়লা। বললো, ‘ওই হারামী তো আগেই এসে হাজির। কিন্তু ওর হাতে খঞ্জর আছে। তুমি বরং দিরে যাও। শেষে আবার কি না কি ঘটে যায়!’
ছোট ভাইয়ের মাথায় খুন চড়ে গেল। সে এ কথার কোন জবাব না দিয়ে খঞ্জর বের করে অন্ধের মোড় ছুটলো অপর আগন্তুকের দিকে। বড় ভাই যখন দেখলো সেই ছায়ামূর্তি ধেয়ে আসছে তার দিকে, সেও তেড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপর। প্রেমে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে শক্তি পরীক্ষায় মেতে উঠলো দুই যুবক, কিন্তু ওরা কেউ জানতেও পারল না এই প্রতিদ্বন্দ্বী তারই সহোদর ভাই, একই রক্ত বইছে ওদের শরীরে, একই মায়ের দুধ পান করেছে দু’জনে। দু’ভাই পরষ্পরকে ভালওবাসে প্রাণের অধিক।
প্রবল বিক্রমে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। দু’জনের চোখেই বন্য আক্রোশ, প্রতিহিংসার প্রবল উত্তাপ। ফলে কেউ কাউকে চিলতে পারল না, কেউ কাউকে রেহাইও দিল না। একের পর এক একে অন্যকে প্রবলভাবে আঘাত করেই চললো। সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে উঠল দু’জনের। নিস্তেজ হয়ে এল উভয়ের শরীর। জড়াজড়ি করে উভয়েই মুখ থুবড়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আবার উঠল। আবার পড়ল। মেয়েটি বার বার চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘লাগাও, খুন করে ফেলো, শেষ করে ফেলো।’
উভয়েই ভাবছিল শায়লা তাকেই উৎসাহ দিচ্ছে। এ কথা ভাবতেই নিস্তেজ শরীরে আবার একটু ছলকে উঠতো শক্তির বিদ্যুৎ। উভয়েই আরো উত্তেজিত হতো তার উৎসাহে।
আলী বিন সুফিয়ানের এক অশ্বারোহী ওই পথ দিয়ে গ্রাম থেকে শহরে ফিরে আসছিল, হঠাৎ তার নজরে পড়ে গেল ওরা। অশ্বারোহী দ্রুত তাদের নিকটবর্তী হলো। মেয়েটি ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেয়ে চট করে মুখ ফিরাতেই দেখতে পেল অশ্বারোহীকে। ভয় পেয়ে ওখান থেকে ছুটে পালালো সে। ঢুকে গেল বাগানের ভেতরে, আরো অন্ধকারের দিকে। কিন্তু অশ্বারোহী তাকে বেশি দূর যেতে দিল না। ধাওয়া করে ধরে ফেললো তাকে। মেয়েটিকে নিয়ে লড়াইয়ের ওখানে ফিরে এল অশ্বারোহী।
ততক্ষণে লড়াই শেষ। দু’জনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। অশ্বারোহী মেয়েটির হাত বেঁধে ঘোড়ার জিনের সাথে আটকে দিল। এরপর ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করল আহত যুবক দু’জনকে।
তখনো মারা যায়নি দু’জনের কেউ। তবে অবস্থা একেবারেই শেষ পর্যায়ে। কারোরই সংজ্ঞা আছে কি নেই ভুঝা যায় না, নিঃশ্বাস বইছে খুবই আস্তে।
‘কি হচ্ছিল এখানে? এ যুবকেরা কারা?’ মেয়েটিকে প্রশ্ন করলো অশ্বারোহী।
‘আমি চিনি না।’ ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল মেয়েটি।
‘বাজে কথা রাখো। শহর থেকে দূরে এই নির্জন স্থানে অন্ধকার রাতে তুমি কি তবে হাওয়া খেতে এসেছো? বলো যুবকদের নিয়ে এখানে কি করছিলে তুমি? কেমন করে যুবকদের এ মরণাপন্ন অবস্থা হলো?’
মেয়েটি এবার জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল, কিন্তু প্রহরী তাকে ছাড়লো না। বলল, ‘আমার প্রশ্নের জবাব দাও। বলো, তুমি কে, আর এই যুবকদের পরিচয় কি?’
মেয়েটি এবার খিল খিল করে হেসে উঠল।
ধমকে উঠল অশ্বারোহী, ‘খবরদার! হাসবে না, যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দাও।’
‘একজন যুবতীর কাছে যুবকরা কি চায় বুঝ না! কে আগে তাই নিয়ে ঝগড়া করে এবার দু’জনেই মরেছে। হায় আমার কপাল!’
প্রহরী আবার নাড়ি পরীক্ষা করল আহত যুবকদের। মেয়েটির কথা এবার আক্ষরিক অর্থেই সত্য প্রমাণিত হলো, দেখলো দু’জনই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে প্রায় একই সময়ে।
লাশ দু’টি ঘোড়ার পিঠে তুলে লাগাম হাতে নিয়ে মেয়েটিকে বললো, ‘চলো।’
মেয়েটি অশ্বারোহীর গ্রেফতার এড়ানোর জন্য তাকে লোভ দেখালো। অনুনয় করে বললো, ‘যারা আমাকে ভোগ করার জন্য এখানে এনেছিল তারা নেই, আপনি আমার সাথে যা খুশি ব্যবহার করুন, কিন্তু দোহাই খোদার, আমাকে গ্রেফতার করবেন না।’
কিন্তু অশ্বারোহী তার কোন কথাই শুনল না, তাকে নিয়ে গেল আলী বিন সুফিয়ানের কাছে।
লাশ দু’টিও আনা হলো। যখন আলোয় আলান হলো লাশ দু’টি, চমকে উঠলো সবাই, আরে! এরা তো দুজনেই হাকিম আল ইদরিসের ছেলে!
আল ইদরিসকে সংবাদ দেয়া হলো। তার মাত্র দুটিই সন্তান, দু’জনই একই সাথে মারা গেছে এ দৃশ্য দেখলে তার কি অবস্থা হবে এ কথা ভেবে পেরেশান হলেন আলী বিন সুফিয়ান।
মেয়েটি উল্টা-পাল্টা কথা বলতে লাগলো। কোন প্রশ্নেরই সে সন্তোষজনক জবাব দিল না। সে কার মেয়ে, কোথায় থাকে, এসব সাধারণ প্রশ্নের জবাবও এড়িয়ে গেল মেয়েটি।
আল ইদরিস এলেন। দুই সন্তানের লাশের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন তিনি। কিছুই বললেন না, কোন প্রশ্নও করলেন না। বাড়ি দিয়ে ওদের মাকে কি বলবেন সে কথাও জানতে চাইলেন না কারো কাছে।
সব ঘটনা খুলে বলা হলো তাকে। তিনি বললেন, ‘সন্তান হারানোর বেদনায় ব্যথিত নই আমি, আফসোস তাদের অপমৃত্যুতে। একটি সামান্য মেয়েকে নিয়ে দু’ভাইয়ের মাঝে মালিন্য হয়েছে এবং সেই মনোমালিন্য প্রথমে ঝগড়ায় এবং পড়ে খুনখারাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে এমনটি আমি ভাবতে পারছি না। এর মধ্যে কোন ঘাপলা অবশ্যই আছে। দু’ভাইয়ের মধ্যে খুবই সুসম্পর্ক ছিল। আজও সকালে ওরা এক সাথে বসে নাস্তা করেছে, খোশগল্প করেছে, কারো আচরণেই কোন ক্ষোভ বা রাগের কোন আলামত ছিল না। অথচ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ওদের মাঝে এমন কি ঘটল যে, ওরা একে অন্যকে খুন করে বসলো! আমার মনে হয় এ রহস্য এখনই উদ্ঘাটন না করলে জাতিকে তার জন্য বিরাট মাশুল দিতে হবে।’
আলী বললেন, ‘আমরা রহস্য আবিষ্কারের চেষ্টা করছি। মেয়েটা উল্টা পাল্টা বলে যতই বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করুক, সত্য তাকে প্রকাশ করতেই হবে।’
‘ভাল করে চেপে ধরুন। আমাদের জানতে হবে আমার এম্ন সুবোধ দুটোর এ হাল কেমন করে হলো?’
আলী বিন সুফিয়ানের সামনে হাজির করা হলো মেয়েটাকে। আলী বললেন, ‘সরকারী গোয়েন্দা বিভাগ যে কারো মনের কথা বের করার ক্ষমতা রাখে। আমি সহজভাবে তোমার কাছ থেকে আসল ঘটনা শুনতে চাই। যদি নিজে থেকে বলো, ভালো, না হলে কারো পেট থেকে কথা বের করার জন্য যেসব কৌশল প্রয়োগ করা হয় তা একে একে শুরু হবে। আমি চাই না তুমি সেই পর্যন্ত যেতে আমাকে বাধ্য করো। তুমি কি তোমার পরিচয় এবং সব ঘটনা খুলে বলবে?’
‘সবই তো বলেছি।’ মেয়েটি বড় ভাইয়ের লাশের দিকে ইশারা করে বললো, ‘এই লোকটা প্রথমে আমাকে ডাকে। আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ওখানে যাই। এমন সময় ওই লোকটা আসে। সম্ভবত শহত থেকেই ও আমাদের ফলো করছিল। আমরা ওখানে গিয়ে বসতেই ও খঞ্জর বের করে প্রথম খঞ্জর বের করে উঠে দাঁড়াল। শুরু হয়ে গেল দু’জনের মধ্যে লড়াই। আমি ভয়ে একদিকে সরে গেলাম। এমন সময় একজন ঘোড়সওয়ার এল। ওকে আসতে দেখেই আমি ছুটে বাগানের গভীরে ঢুকে গেলাম। কিন্তু একজন সৈনিকের সাথে আমি পারবো কি করে? লোকটি আমাকে ধরে ফেললো এবং এখানে নিয়ে এলো।’
‘কি নাম তোমার? তোমার বাবার নাম ও ঠিকানা বলো।’
‘আমি আমার ও বাবার নাম এ জন্য বলবো না, এতে আমার ও বাবার নামে কলংক ছড়িয়ে পড়বে।’
আলী বিন সুফিয়ানের স্মরণ হলো, আরসালান ও আলা ইদরিসের মধ্যে যে কথা কাটাকাটি হয়েছিল তখন একাধিকবার সে আল ইদরিসের যুবক সন্তানদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল।
আরসালান আগে থেকেই আলীর সন্দেহভাজনদের তালিকাভুক্ত ছিল। তিনি তার মহলের মধ্যে একাধিকবার সন্দেহভাজন বহিরাগতদের নিয়ে বৈঠক করেছেন বলেও রিপোর্ট করেছে তার ইনফরমার।
তিনি আল ইদরিসকে ইশারা করে বললেন, ‘এ মেয়ে তার পরিচয় বলতে চাচ্ছে না। আমিও মনে করি এই মেয়ে সত্য কথাই বলেছে। সে একজন নারী হয়ে একা দু’জন যুবককে হত্যা করতে পারে না। এমন দোষে তাকে কেউ অভিযুক্ত করলেও আমি তা মেনে নিতে পারি না।’
তিনি মেয়েটিকে বললেন, ‘যাও তুমি মুক্ত। ভবিষ্যতে আর যেন কারো সাথে রাতের অন্ধকারে নির্জনে ঘুরাফেরা করতে না দেখি। এমন করলে কখন নিজেই খুন হয়ে যাবে ঠিক নেই।’
মেয়েটি দ্রুত কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। আলী বিন সুফিয়ান দু’জন ইনফরমারকে ডাকলেন। একজনকে বললেন, ‘তুমি দ্রুত আরসালানের মহলের ফটকের কাছাকাছি কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকো।’ অন্যজনকে মেয়েটির পিছনে এমনভাবে অনুসরণ করতে বললেন, যেন মেয়েটি টের না পায়। আর সে যেখানেই যাক তার সংবাদ যেন সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে পৌঁছে দেয়।
লোক দু’জন বেরিয়ে গেল। মেয়েটি দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সন্তর্পনে তাকে অনুসরণ করলো আলীর গোয়েন্দা। আলী বিন সুফিয়ানের সন্দেহই সত্য প্রমাণিত হলো। মেয়েটি আরসালানের মহলে প্রবেশ করলো।
সঙ্গে সঙ্গে এ খবর পৌঁছে দেয়া হলো আলীর কাছে। আর ইদরিস এ খবর শুনে আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘আরসালান আমাকে আমার দুই যুবক ছেলে সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। তখন আমি তার ইশারা বুঝতে পারিনি। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি, এই ষড়যন্ত্র আরসালানের কাজ। কিন ভয়ংকর আর কুটিল তার পরিকল্পনা। দুই ভাইকে সে কেমন নিখুঁতভাবে একে অন্যকে দিয়ে হত্যা করিয়েছে।’
আল ইদরিস প্রধান হাকিমকে এ সংবাদ জানালেন। আলী বিন সুফিয়ান সিদ্ধান্ত নিলেন। আরসালানের বাড়িতে অতর্কিতে পুলিশের আক্রমণ চালিয়ে সবাইকে গৃহবন্দী করতে হবে। পুলিশ সুপার গিয়াস কামালকে সে কথা বললেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে ঘেরাও করে ফেলল আরসালানের মহল।
‘এখন আমি আল ইদরিসকে বলবো, কেন আমি এত সাহসিকতার সাথে কথা বলছিলাম সেদিন।’ আরসালান মেয়েটির মুখে সমস্ত কাহিনী শুনে বললো, ‘আমি তাকে আরো বলবো, দেখ আমি কি করতে পারি?’
সে মেয়েটির হাতে তুলে দিল শরাবের গ্লাস। তারপর দু’জনই সফলতার অপার আনন্দে মেতে উঠলো উৎসবে।
তাদের সে আনন্দ উৎসব তখনো শেষ হয়নি, হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত সেখানে প্রবেশ করলো এক লোক। এ ব্যক্তির নাম আল ইদরিস। তিনি আরসালান ও মেয়েটিকে নেশায় মত্ত বেহাল অবস্থায় দেখতে পেলেন।
আরসালান নেশা জড়ানো কন্ঠে বললো, ‘আরে বাবা! এ যে দেখছি আল ইদরিস। কি মনে করে এলে? ছেলেরা তোমাকে না বলেই মরে গেছে! এ্যা, তুমি বাবা আবার কেন এলে? আমি তো তোমাকে এখনি খুন করবো বলে ঠিক করিনি।’
তারপর হঠাৎ যেন তার হুশ ফিরে এল। সে চিৎকার করে ডাকলো, ‘দারোয়ান! দারোয়ান কোথায়? এই লোক আমার বিনা অনুমতিতে আমার জান্নাতে কেমন করে প্রবেশ করেছে?’
‘তোমাকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য!’ আল ইদরিস বললেন, ‘আমি আমার সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নিতে আসিনি। আমি তোমাকে গাদ্দারদের কি পরিণতি হয় তাই দেখাতে এসেছি।’
ইতিমধ্যে শহরের প্রধান হাকিম, যিনি এখন ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করছেন, ভেতরে প্রবেশ করলেন। তার সাথে পুলিশ প্রধান গিয়ান কামাল ও গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান। মেয়েটিকে গ্রেফতার করা হলো। আরসালানের সমস্ত চাকর-চাকরানী ও বাড়ির অন্যান্য লোকদেরকে মহলে নজরবন্দী করে সেখানে সেনা প্রহরা বসানো হলো। মহলের ভেতর পাওয়া গেল একটি গোপন কক্ষ। কামরাটি গভীর ও প্রশস্ত। সেখানে তীর, ধনুক ও বর্শার স্তূপ। তলোয়ার ও খঞ্জরের ছড়াছড়ি। খৃস্টানদের উদ্ভাবিত নতুন এক জাতের আগ্নেয়াস্ত্র। কয়েকটি সিন্দুক ভরা গাঁজা, হাশিস, হেরোইন ও বিষ। আরেকটি কামরায় পাওয়া গেল সোনার ইট ও আশরাফীর থলি।
আরসালান তার দুই স্ত্রী ও সন্তানদেরকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছিল। বাড়িতে পাওয়া গেল অনিন্দ্য সুন্দর তিনটি যুবতী মেয়েকে। এদের মধ্যে কে যে কার চেয়ে বেশি সুন্দরী সে বিচারের ভার কাউকে দিলে সে সাত দিন পর্যন্ত গালে হাত দিয়ে বসে থাকবে, কিন্তু মুখ খুলবে না। তিনটি মেয়েই খৃস্টান।
রাতের মধ্যেই মহলের চাকর-বাকরদের জবানবন্দী নেয়া হলো। দেখা গেল তাদের মধ্যে তিনজন খৃস্টানদের গোয়েন্দা।
‘তুমি কি স্বেচ্ছায় বলবে তোমার ইচ্ছা ও পরিকল্পনা কি?’ প্রধান হাকিম আরসালানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ধন-দওলত, এই অস্ত্রশস্ত্রে স্তূপ তোমার মৃত্যুদণ্ডের জন্য যথেষ্ট।’
‘তবে মৃত্যুর শাস্তিই দিয়ে দাও।’ সে নেশার ঘোরে বললো, ‘যদি মরতেই হয় তবে নীরব থেকেই মরি না কেন?’
‘সেটা তোমার ইচ্ছা। মৃত্যু মানেই তুমি আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে যাচ্ছো। আল্লাহ বড় মেহেরবান। এমনও তো হতে পারে, আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে তোমার যেসব বন্ধুরা কাজ করছে তাদের নাম এবং পরিকল্পনার কথা যদি বলে যাও, তিনি তোমাকে মাফও করে দিতে পারেন।’ প্রধান হাকিম বললেন, ‘আমি দোয়া করবো, তোমার এই পূন্য কাজের জন্য আল্লাহ যেন তোমাকে এতবড় পাপ থেকেও ক্ষমা করে দেন।’
‘তোমরা তো আর আমাকে ক্ষমা করবে না?’ আরসালান বললো।
‘সুলতান আইয়ুবী এর চেয়েও বড় পাপীকে ক্ষমা করেছেন এমন দৃষ্টান্তের কথা তোমার জানা আছে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তোমার বাঁচার পথ বের হতে পারে যদি তুমি বলে দাও এখানে কি ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ চলছে এবং যারা করছে তাদের ধরার ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করো।’
আরসালান মদের প্রভাবে ঠিকমত দাঁড়াতে পারছিল না। সে এদিক-ওদিক টলছিল আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল সবাইকে। আল ইদরিসের কোমরে ক্ষুদে তলোয়ারের মত লম্বাটে খঞ্জর ঝুলছে।’
আরসালান টলতে টলতে এক সময় তার কাছাকাছি হলো এবং অকস্মাৎ কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই দ্রুতবেগে সে খঞ্জর টেনে বের করে নিজের বুকে বসিয়ে দিল।
আলী বিন সুফিয়ান ঝাঁপিয়ে পড়ে খঞ্জরটি কেড়ে নিতে চেষ্টা করলেন কিন্তু হাতের বেকায়দা চাপে তা পেটের আরও গভীরে ঢুকে গেল। আরসালান রক্তাক্ত বুকে লুটিয়ে পড়ল তার মূল্যবান লাল গালিচার ওপর।
পুলিশ সুপার খঞ্জরটি টেনে বের করতে চাইলে আরসালান হাত ইশারায় তাকে নিষেধ করে বলল, ‘আগে আমার কথা শোন, আমি মরে গেলে তখন ওটা বের করে নিও।
আমি আমার পাপের শাস্তি নিজেই নিলাম। আমি আর জীবিত অবস্থায় সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সামনে উপস্থিত হতে চাই না। কারণ তিনি আমাকে একজন পরম বিশ্বাসী ও একান্ত বন্ধু বলে মনে করতেন। আমি যা বলছি তার বাইরে আমি তোমাদের কোন প্রশ্নের জবাব দেবো না। মিশর এক ভয়াবহ সংকটে পড়ে গেছে। মিশরে যে সেনাবাহিনী আছে তারা বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সৈন্যদের রসদপত্রের ঘাটতির ব্যবস্থা আমিই করেছি। সৈন্যদের খাবারের কোন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না এই প্রচারণা ছড়াচ্ছে খৃস্টানরা। আমার দলে অনেক ভাল লোকও আছে। আমি কারো নাম বলবো না। ফেদাইন ও ফাতেমীয় দল ঐক্যবদ্ধ ভাবে মিশরের ধ্বংসের পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে। তোমরা বিদ্রোহকে ঠেকাতে পারবে না। নতুন সৈন্য নিয়ে এসো তোমাদের নিয়ন্ত্রনের ………’ আর কোন কথা সে বলতে পারলো না, তার প্রাণবায়ু শেষ হয়ে গেল।
তার বাড়িতে যে তিনজন মেয়ে পাওয়া গেলো, তাদের সম্পর্কেও সে কিছু বলতে পারলো না। ফলে মেয়েদের জবানবন্দীই গ্রহণ করতে হলো সত্য বলে। তারা নিজেদের সম্পর্কে বললো, তাদেরকে নৈতিক চরিত্র ধ্বংস করার জন্য পাঠানো হয়েছে।
আরসালানের বাড়িতে রাতে গোপন আসর বসতো। এ আসরে বিভিন্ন সরকারী কর্মকর্তা ও সামরিক অফিসাররা আসতো। এরই ফাঁকে চলতো তাদের গোপন বৈঠক। আসরকে মাতিয়ে রাখার কাজে ব্যবহার করা হতো মেয়েদের।
যে মেয়েটি দুই ভাইকে পরষ্পরের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে তাদের খুন করিয়েছে সে হত্যার পুরো ঘটনা বর্ণনা করলো। সে বললো, সে প্রথমে আল ইদরিসের বড় ছেলেকে তার ভালবাসার জালে ফাঁসিয়ে নেয়। আরসালান প্রথমে তার ছেলেদেরকে আল ইদরিসের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পরে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে মেয়েটিকে বলে, ‘তার দুই সন্তানকে হত্যা করার ব্যবস্থা করো।’
এক রাতে প্রায় আড়াইশ উট কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা অফিসের সামনে এনে হাজির করা হলো। এগুলোর ওপরে খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন সামগ্রী বোঝাই। এই উটগুলো কয়েকটি কাফেলায় বিভক্ত ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে দের ধরে আনা হয়েছে। দেশের খাদ্যসামগ্রী ও জিনিসপত্র দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ করার জন্য সর্বত্র ঠল বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছিল। এটাই এই টহলদার বাহিনীর প্রথম সফলতা।
এইসব কাফেলার সঙ্গে যেসব লোক পাওয়া গেল তারা শহরের কয়েকজন বড় বড় ব্যবসায়ীর নাম বললো। এই ব্যবসায়ীরা সবাই ছিল আড়তদার। তারা খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে সেগুলো মাটির তলে গোপন কক্ষে লুকিয়ে রাখতো। এরপর গভীর রাতে অচেনা বেপারীরা এসে ওদের কাছ থেকে সেসব মাল চড়া দামে কিনে নিতো।
লোকগুলো এমন কিছু ঠিকানাও দিল যেখানে এ সকল অপরিচিত ব্যবসায়ীরা গোপনে বাস করতো এবং খাদ্যশস্য ও জিনিসপত্র মজুত করে পরে সুযোগমত দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতো।
উটের আরোহীরা সীমান্তের কয়েকটি স্থানের কথা বললো, যেখান থেকে এইসব মালামান সুদানে পাচার করা হয়। সেখানে সীমান্ত পারাপার করার জন্য বিশেষ বাহিনী সর্বদা উপস্থিত থাকে। এরা সীমান্তে নিয়োজিত বিভিন্ন কমান্ডারদের সাথে আঁতাত করে এবং তাদের মোটা রকমের ঘুষ দিয়ে কাফেলা পারাপারের ব্যবস্থা করে। এসব কাজ আরসালানের ছত্রছায়ায় এবং তারই পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পন্ন হতো।
আল ইদরিসের সন্তানদের বিপথগামী করার ঘটনা যে সব শত শত ঘটনার একটি, যা সুলতান আইয়ুবির অনুপস্থিতির সুযোগে মিশরে বন্যার মত ছড়িয়ে পড়েছিল।
আল ইদরিস এবং অন্যান্য সকল হাকিম মিশরের এ অরাজক অবস্থা, আরসালানের বিশ্বাসঘাতকতা ও আল ইদরিসের দুই যুবক সন্তানকে হত্যা করার প্রতিবাদের এক প্রতিবাদ সভা আহ্বান করলো। বক্তৃতায় আলী বিন সুফিয়ান, গিয়াস কামালসহ সকলেই বললো, মিশরের অবস্থা এখন চরম বিশৃংখলা হয়ে পড়েছে। এর নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা, মিশরে যদি বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে কিংবা ফাতেমী ও ফেদাইনরা যদি প্রভাবশালী লোকদের হত্যা করতে শুরু করে তবে এর দায়দায়িত্ব আমাদের ঘাড়েই পড়বে। এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই সমস্ত পরিস্থিতি সুলতান আইয়ুবীকে অবগত করানো উচিত। সুলতানকে অনুরোধ করা দরকার, যেন তিনি কারো ওপর যুদ্ধের দায়িত্ব ন্যস্ত করে কায়রো চলে আসেন।
সে বক্তব্যের সূত্র ধরে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আলী বিন সুফিয়ান যুদ্ধ সেক্টরে সুলতান আইয়ুবীর কাছে যাবেন পরিস্থিতি তুলে ধরতে।
ক্রাক অবরোধের দুই মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। খৃস্টানদের পক্ষ থেকে আক্রমণ বা আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তারা দুর্গের মধ্যে বসে আত্মরক্ষামূলক লড়াই চালিয়ে যেতে লাগল। আইয়ুবী রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলেও তাতে ওদের তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। আইয়ুবী ক্রাক অবরোধ করতে আসছে শুনেই দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মত প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও রসদের মজুত তারা গড়ে তুলেছিল দুর্গের ভেতর।
দুর্গের ভেতরে আইয়ুবীর যে কমান্ডো বাহিনী আগেই ঢুকে পড়েছিল তাদের একজন আইয়ুবীকে এ সংবাদ সরবরাহ করল।
একটা তীরের মাথায় চিঠি বেঁধে সে তীর ছুঁড়ে মারল মুসলিম বাহিনীর দিকে। সে চিঠিতে লেখা ছিলঃ ভেতরে এদের খাদ্য এবং রসদপত্রের কোন ঘাটতি নেই। খৃস্টানরা এখানকার মুসলমানদের ওপর কড়া নজর রাখছে। মুসলমানরা এখন জানে, দেয়ালেরও কান আছে। ফলে ভেতর থেকে কোন কিছু কড়া এখন সম্ভব নয়। সুযোগ পেলে ভেতরের মুসলমানরা তাদের রসদপত্র ধ্বংস করে দিতে পারত, কিন্তু এখনো এমন কোন সুযোগ সৃষ্টি হয়নি।’
রাতের নির্জন প্রহরে তীরের সাথে চিঠি বেঁধে এভাবে মাঝেমধ্যেই সংবাদ পাঠাতো ভেতরের গোয়েন্দারা। সৈন্যদের প্রতি নির্দেশ ছিল, এমন কোন তীর এলে যেন সাথে সাথেই কমান্ডারের কাছে পৌঁছে দেয়।
খৃস্টানরা চাচ্ছিল, অবরোধ দীর্ঘতর হোক। এতে সুলতান আইয়ুবীর শক্তি ক্ষয় হবে। সুলতান আইয়ুবী তাদের এ চাল বুঝতে পারলেন। ফলে তিনি যুদ্ধের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলেন।
এর আগে বাইরে থেকে আক্রমণের যে পরিকল্পনা তাদের ছিলও তাও তিনি যথাসময়ে জানতে পেরেছিলেন এবং কৌশলে সে আক্রমণ ব্যর্থ করেননি বরং যে বাহিনী এ অভিযানে অংশ নিয়েছিল তাদেরকে এক নাজুক জায়গায় আজো ঘেরাও করে রেখেছেন। ক্রুসেড বাহিনীর এই দলটি দীর্ঘ দেড় মাস ধরে ঘেরাওয়ের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। তারা ঘেরাও থেকে বের হওয়ার জন্য যতবার চেষ্টা করেছে ততবারই বিপুল ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
ঘেরাওয়ের মধ্যে আটকেপড়া সৈন্যরা খাদ্যাভাবে কাতর হয়ে পড়ল। এ অভাব দূর করার জন্য তারা তাদের কোন পশু মারা গেলে ফেলে না দিয়ে কেয়ে ফেলতো। কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হলো না। হাজার হাজার ঘোড়া ও উটের জন্য চরণভূমি ছিল সংকীর্ণ। পানিরে জন্য সেখানে কোন নদী বা কোন ঝর্ণা ছিল না। তিন চারটি নালা ছিল পানি পাওয়ার একমাত্র সম্বল। তা এ কদিন ব্যবহারের ফলে শুকিয়ে গেল।
এসব দেখে আটকেপড়া সৈন্যদের মধ্যে হতাশা ও নৈরাশ্যের মেঘ জমতে শুরু করল। এর সাথে দেখা দিল আরেক নতুন বিপদ। রাতের বেলা মুসলিম কমান্ডোরা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাদের ব্যাপক ক্ষতি করতে শুরু করল। কয়েকদিনের মধিয়ে এ সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেল। খেতে না পেয়ে তাদের পশুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ল। এ বাহিনীর প্রধান রিমান্ত প্রচণ্ড অশান্তি ও অস্থিরতার মধ্যে সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছিল। একই অশান্তি ও অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করছিল বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা। কখন মিত্ররা এসে সুলতান আইয়ুবীর বেষ্টনী থেকে বের করে নেবে তাদের, এই আশায় তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কিন্তু এই অপেক্ষা তাদের হতাশা ছাড়া আর কিছুই দেয় না।
সুলতান আইয়ুবী ইচ্ছা করলে চারদিক থেকে আক্রমণ করে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারতেন। কিন্তু আইয়ুবী তা করলেন না। ফাঁদে পড়া ইঁদুর মারার ব্যাপারে তার কোন তাড়াহুড়া নেই, তাঁর চিন্তা দুর্গ জয়ের পথে যারা অবিরাম প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে তাদের নিয়ে। এতে অবশ্য তাঁরও ক্ষতি হচ্ছিল, নিজের বাহিনীর সৈন্যদের ব্যস্ত রাখতে হচ্ছিল তাদের পাহারায়।
তিনি রিজার্ভ সৈন্যদের নিয়ে চিন্তা করলেন। দুর্গটি ভাঙার কাজে কি তাদের ব্যবহার করবেন? তিনি অবরোধ আর বেশিদিন দীর্ঘ করতে চান না। সে সময় যুদ্ধে বছরের পর বছর অবরোধ দীর্ঘ করার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এ কৌশল তার পছন্দ ছিল না।
সুলতান আইয়ুবী কোন রাজ্যে লোলুপ সেনাপতি ছিলেন না। তিনি কখনো কোন দেশের রাজধানী অবরোধ করে শহর কর্তৃপক্ষের এ কথা বলেননি, এত পরিমাণ সোনা, হীরা, জহরত, এত হাজার ঘোড়া ও এতগুলো নারী এনে দাও, আমি অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে চলে যাবো।
সুলতান আইয়ুবী ছিলেন এক মর্দে মুজাহিদ। ইসলামকে বিজয়ী দ্বীন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন তিনি। আরবের মাটি থেকে ইসলাম বিরোধী সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র নির্মূল করার জন্য ঝলসে উঠতো তার তলোয়ার। তিনি যা বিশ্বাস করতেন জনগণের সামনে তা অত্যন্ত খোলামেলা ও পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতেন। তিনি যা করতে চাইতেন তাই তিনি বলতেন, আর যা তিনি বলতেম তাই করতেন। সব সময় কথা ও কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখাই ছিল তার নীতি। এ ব্যাপারে তার কোন দ্বিধা সংকোচ ছিল না বলেই জনগণও তাঁর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখতো, তাঁকে পছন্দ করতো এবং ভালোবাসতো।
তিনি বলতেন, ‘এই আরবভূমিতে মহানবী (সা.) ইসলামের যে আলো জ্বেলেছিলেন সে আলো কেবল আরবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিশ্বের দিকদিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সেই আরবের পবিত্র ভূমিতে বিকৃত হয়ে পড়েছে ইসলাম। ইহুদী ও খৃস্টানরা ইসলামের আলো নিভিয়ে দেয়ার জন্য একের পর ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। অত্যাচার চালাচ্ছে মুসলমানদের ওপর। এ অবস্থা কিছুতেই চলতে দেয়া যায় না। রাসূল যেমন এক হাতে কোরআন নিয়েছিলেন সত্যের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এবং অন্য হাতে অন্যায় ও অসত্যকে নির্মূল করার জন্য তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র, সেই পথই মুসলমানের চলার পথ। যারা রাসূলের এ সুন্নাতকে অস্বীকার করে অন্য কোন তরীকা গ্রহণ করবে, তাদের সাহায্য সহযোগিতা কড়া কোন মুসলমানের জন্য জাইয়েজ হতে পারে না।’
তিনি সময়ের গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশি। বলতেন, ‘মানুষের জীবন বড়ই সংক্ষিপ্ত। কোন মহান কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য নির্ধারিত হায়াতের বেশি সময় কেউ পাবে না। আই আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কা আমি অল্প সমইয়ে শেষ করতে চাই। প্রতিটি মুহূর্তকে আমি চাই প্রজ্ঞার সাথে এ কাজে ব্যয় করতে।’
তিনি বলতেন, ‘আমার এ সংগ্রাম কেবল ইহুদী ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে ন্য, সেইসম মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধেও, যারা নিজেদের ক্ষমতা, অর্থ এবং প্রতিপত্তির লোভে এ মাটি বিধর্মীদের কাছে বিক্রি করতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে আমি অনড় এবং আপোষহীন। আর কেবলমাত্র আপোষহীনদেরই আমি আমার সঙ্গী হওয়ার আহ্বান জানাই।’
তিনি আরো বলতেন, ‘আমার এ মনোভাবের ফলে খৃস্টানরা আমাকে মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা এটাকে গালি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। এক শ্রেণীর মুসলমানও চায় আমি আপোষকামী হয়ে যাই। কিন্তু আমার পক্ষে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। আমি বরং মৌলবাদী হতে পারায় গর্ববোধ করি।
কারণ, মৌলবাদী হওয়া মানে মূলের অনুগামী হওয়া, মূলের সাথে সম্পৃক্ত থাকা। মুল কেটে ফেললে বৃক্ষ বাঁচে না, মৌলবাদী না হলে মানবতা বাঁচে না।
এ পৃথিবীর মূলে আছেন আল্লাহ। এ মূলের সাথে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারি না। আমি আল্লাহকে আল্লাহ, রাসূল (সা.)কে নেতা এবং ইসলামকে আমার জীবন বিধান মানি বলেই ওরা আমাকে মৌলবাদী বলছে। তার মানে, ইসলামই যে মানুষের জন্য মৌলিক জীবন বিধান তাঁর সার্টিফিকেট তো ওরাই দিচ্ছে। ওরাই তো স্বীকার করছে, পৃথিবীতে যত মতবাদ আছে তার মধ্যে একমাত্র ইসলামই মৌলিক। আমি মৌলবাদী, কারণ আমি এ মৌলিক সত্যের ধারক, বাহক। আর ওরা যার পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে তা অ-মৌলিক অর্থাৎ ভেজালে পরিপূর্ণ। এ ভাবেই আল্লাহ দুশমনদের মুখ দিয়ে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘কোন ছেলে কি তার মাকে অস্বীকার করতে পারে? এ পৃথিবীর আলো বাতাসে আমি যে আসতে পেরেছি তার মূলে আছে আমার মা। মৌলবাদীকে অস্বীকার করা মানে এই মা-কে অস্বীকার কড়া। আর মায়ের স্নেহ মমতায় সিক্ত হওয়ার মানে মৌলবাদী হওয়া।
আল্লাহর বান্দা মৌলবাদী না হলে হয় বেঈমান, সন্তান তার জন্মের মূল না জানলে হয় জারজ সন্তান, দেশের নাগরিক মৌলবাদী না হলে হয় দেশদ্রোহী। আমি এর কোনটাই হতে চাই না। আমি আমার মাটি ও দেশের সাথে সম্পৃক্ত থেকে হতে চাই দ্রেশপ্রেমিক, মায়ের স্নেহ মমতাকে ধারণ করে হতে চাই মানবতাবাদী, আল্লাহর গোলামী কবুল করে হতে চাই ঈমানদার।
মৌলবাদী হওয়া মানে আল্লাহ ও রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত থাকা। ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত থাকা। মানবতার সাথে সম্পৃক্ত থাকা। ইসলামের যে মৌলিক বিধান আছে তাকে যে গ্রহণ করে তাকেই ওরা মৌলবাদী বলছে। আমি আংশিক ইসলামের অনুসারী হতে চাই না। অ-মৌলিক বা দু’নম্বর কোন কিছুও গ্রহণ করতে চাই না। ফলে, যে যাই বলুক, আমি তো আসলেই মৌলবাদী।
মানুষের মন থেকে মৌলবাদী হওয়ার চেতনা লোপ পাওয়ার ফলেই আজ বিশ্বব্যাপী পশুত্ব ও বর্বরতার বিস্তার ঘটেছে। মানুষের মন থেকে মনুষত্ব লোপ প্যেছে। মানবিকতা লোপ পেয়েছে। কারণ, মৌলবাদীকে অস্বীকার করলে মানবিকতাকে অস্বীকার কড়া হয়, মানবতাকে অস্বীকার করা হয়। কোন মুসলমান, যে নিজেকে আল্লাহর বান্দা বলে দাবী করে, সে কি করে মৌলবাদী হতে অস্বীকার করবে?
মুসলমান তো বিশ্বাস করে, এই পৃথিবী আল্লাহর এক বিশাল পরিবার। আমরা আল্লাহর খলিফা, মানে তাঁর প্রতিনিধি। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই পৃথিবীর দেখভাল করা। এই অনুভূতির কারণেই আমরা কেবল নিজেদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করি না, চিন্তা করি না কেবল আপনজনের কথা। বরং আমরা কল্যাণ চাই বিশ্বের প্রতিটি মানুষের। কল্যাণ চাই সমস্ত সৃষ্টিকুলের। কারণ, এ সবই আল্লাহত এবং আল্লাহর এ সৃষ্টিকুলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রতিনিধি হিসাবে আমাদের।
আল্লাহই আমাদের জানিয়েছেন, এ পৃথিবীতে তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন এর সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে কেবলমাত্র মানুষের জন্য। তিনি আরো জানিয়েছেন, আর এই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র তাঁর এবাদত করার জন্য।
আল্লহর এবাদত মানে কেবল নামাজ, রোজা নয়, আল্লাহর এবাদত মানে আল্লাহর খলিফার দায়িত্ব পালন করা, তাঁর এ সৃষ্টির সেবা করা, রক্ষণাবেক্ষণ করা। যেখানেই এর ব্যতিক্রম ঘটে সেখানেই বিপর্যয় দেখা দেয়, সেখানেই অশান্তির সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি জুগতের শান্তির স্বার্থেই আল্লাহর বিধানকে আমাদের পরিপূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। তাহলেই আর কোথাও অশান্তি থাকবে না, অনৈক্য থাকবে না, অসাম্য থাকবে না।
আল্লাহর মনোনীত এই একমাত্র দ্বীন ইসলাম ছাড়া আর যত মতবাদ সবই অ-মৌলিক, বিভ্রান্ত বা খন্ডিত মতবাদ। ইসলামের সৌন্দর্য ধার করে পরগাছার মত টিকে থাকে তারা। তা যারা চায় না তারাই মৌলবাদী এবং আমি এ মৌলবাদী হয়েই চিরদিন বেঁচে থাকতে চাই।
যাদের মনে এ চেতনা ও বিশ্বাস নেই মানবতার কল্যাণের কোন চিন্তা করার দয়াও নেই তাদের। তাদের পক্ষে আত্মসুখে বিভোর হওয়াই স্বাভাবিক। ‘খাও, দাও, ফুর্তি করো, দুনিয়াটা মস্ত বড়ো’ বলে পৃথিবীর যতটুকু পারে নিজের ভাগে নেয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে তারা। অন্যের জন্য ভাববার কি দায় ঠেকেছে তাদের! তাই, যেখানে ইসলাম নেই, সেখানে মানবতা নেই; যেখানে মানবতা নেই, সেখানে মৌলবাদ নেই। মৌলবাদ থাকলে ইসলাম থাকবে, ইসলাম থাকলে মানবতা থাকবে। মৌলবাদ, ইসলাম, মানবতা বৃহত্তর অর্থে এক ও অভিন্ন চেতনার নাম।
এক রাতে তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। কি করে দুর্গে প্রবেশ করা যায় ভাবছিলেন তিনি। অদ্ভুতসব চিন্তা এসে মাথায় ভর করছিল। একবার ভাবলেন, মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খনন করে দুর্গে প্রবেশ করলে কেমন হয়! আবার ভাবলেন, যদি অবরোধ উঠিয়ে সরে পড়ি এবং পড়ে পিছন দিক দিয়ে ঘুরে এসে অতর্কিতে হামলা করি! তিনি যখন এমনি সব ভাবনার রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাবুতে প্রবেশ করলেন আলী বিন সুফিয়ান। তাকে দেখে সুলতান আইয়ুবী খুশি না হয়ে আরও ঘাবড়ে গেলেন। কারণ আগেই খবর পেয়েছিলেন, মিশরের অবস্থা আশংকাজনক।
সুলতান আইয়ুবী মুখে বিষণ্ন ভাব নিয়ে আলী বিন সুফিয়ানের সাথে কোলাকুলি করলেন এবং বললেন, ‘তুমি আমার কাছে নিশ্চয়ই কোন সুসংবাদ বহন করে আননি?’
‘সবটাই অমঙ্গলের নয়।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘কিন্তু সুসংবাদও কিছু নেই।’
তিনি সুলতান আইয়ুবীর কাছে মিশরের অবস্থা বলা শুরু করলেন। কোন কথাই গোপন করলেন না।
আলী বিন সুফিয়ানের কাছে আরসালানের বিশ্বাসঘাতকতার কথা ও আল ইদরিসের দুই যুবক ছেলের মৃত্যুর করুণ কাহিনী শুনে সুলতানের চোখে অশ্রু নেলে এলো। যদি আরসালান মরে না যেতো তবে তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা সুলতান আইয়ুবী কখনও বিশ্বাস করতেন না। আলীর কথা শুনে তার মনে পড়ল, আগেও তার দুই বন্ধু এমনিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।
‘যদি আরসালান আরও কিছুক্ষণ বেঁচে থাকতো তবে সে আরও গোপন রহস্য প্রকাশ করতে পারতো।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তার শেষ বাক্য, তা সে পূর্ণ করে যেতে পারেনি তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, মিশরে বিদ্রোহ আসন্ন প্রায়। মিশরে আমাদের যে সৈন্য আছে তাদেরকে মানসিক ও চারিত্রিক দিক থেকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। আমার গোয়েন্দা বিভাগ বলেছে, কমান্ডাররা পর্যন্ত ভুল ধারনা ও অশান্তির শিকার হয়েছে। সেনাবাহিনীর রেশন কমিয়ে দিয়ে তাদেরকে আরো অস্থির করে তোলা হয়েছে। যে সমস্ত খাদ্যশস্য সৈন্যদের জন্য পাঠানো হচ্ছে, তা পাচার করে অর্থ আত্নসাত করছে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মচারী। এইভাবে শত্রুরা ষড়যন্ত্র পূর্ণ করে আনতে চাইছে।’
‘শত্রুদের ষড়যন্ত্র সেই দেশেই সফল হয়, যে দেশের প্রশাসনযন্ত্রের কিছু লোক শত্রুদের সাহতে গোপন যোগসাজশ রাখে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যদি আমার এক ভাই শত্রুদের সহকর্মী হয়ে যায় তবে আমরা শত্রুদের কিভাবে মোকাবেলা করতে পারি? আমি যেভাবে আল্লাহ-ভক্ত সেনাবাহিনী নিয়ে খৃস্টানদেরকে যুদ্ধের ময়দানে নাকানী চুবানী খাওয়াচ্ছি, যদি আমার সহকারী অফিসাররাও তাদের মত খাঁটি ঈমানদার হতো তবে আজ মুসলমানদের প্রথম কাবা মুসলমানদেরই হাতে থাকতো। আমাদের আজান আজ ইউরোপের গীর্জাতে ধ্বনিত হতো। কিন্তু এদের দুর্নীতিপরায়ণ অফিসারদের কারণে আমি মিশরেই বন্দী হয়ে রইলাম। আমার আবেগ, আমার প্রেরণা, বিরাট বিরাট সংকল্প সবই এই শিকলে আটকা পড়ে গেল।’
তিনি কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তারপর বললেন, ‘আমাকে সবার আগে গাদ্দারদের শেষ করতে হবে নতুবা এই জাতিকে তারা উঁইপোকার মত খেয়ে শেষ করে ফেলবে।’
‘আমি এই পরামর্শ নিয়েই এসেছি, যদু যুদ্ধ ক্ষেত্র আপনাকে পারমিশন দেয় তবে করে মিশর চলুন।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন।
‘আলী! আমি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারি না।’ সুলতান আইয়ুবী বল্লেন, ‘কিন্তু আমার আফসোস! আমার হাত যখন খৃস্টানদের ঘাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তখন তাদের মুক্ত করার জন্য এগিয়ে এসেছে আমারই জাতির ভাইয়েরা। আলী, যদি আমি ইসলামের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্বকারী মুসলমানদেরকে এখনি শেষ না করি তবে এই উঁইপোকা আর কখনও শেষ হবে না। আমাদের ইতিহাসকে এই গাদ্দার দল চিরদিনের জন্য লজ্জিত করতে থাকবে। জাতির মধ্যে সব কালেই এই গাদ্দা দল সক্রিয় ও বর্তমান থাকবে, যারা আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলুল্লাহর (সা.) শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করে ইসলামের মূল কেটে শেষ করবে।’
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সুদানের যুদ্ধ ক্ষেত্রে খবর কি? আমি তকিউদ্দিনকে সংবাদ পাঠিয়েছি যুদ্ধ গুটিয়ে আনতে।’
‘মিশরে কেউ জানে না, আপনি এমন আদেশ দান করেছেন।’
গভীর রাত পর্যন্ত আলীর সাথে আলাপ করলেন তিনি। মাঝ রাতের একটু পর আলীকে বিদায় দিলেন সুলতান। কামরা থেকে আলী বেরিয়ে যেতেই সুলতান আইয়ুবী গার্ডকে ডাকলেন। বললেন, ‘কাতিবকে জলদি ডেকে আনো।’
কাতিব কাগজ কলম সঙ্গে করে তাবুতে প্রবেশ করলো। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘লেখো’
‘মুহতারাম নূরুদ্দিন জঙ্গী ………’
তিনি যখন চিঠি শেষ করলেন তখন রাত প্রায় শেষ।
পরদিন ভোর। কাসেদকে ডাকলেন সুলতান আইয়ুবী। তাকে বললেন, ‘প্রত্যেক স্টেশনে তোমার জন্য নতুন সজ্জিত ঘোড়া প্রস্তুত থাকবে। ক্লান্ত ঘোড়া দেখে রেখে নতুন ঘোড়া বদলাতে যে সময়টুকু লাগবে তার বেশি কোথাও থামবে না। কোন বিশ্রামের সুযোগ নেই। আহার করবে ঘোড়ার পিঠে বসে। কোথাও যেন ঘোড়ার গতি শ্লথ না হয়ে পড়ে। যদি গভীর রাতেও তুমি বাগদাদ গিয়ে পৌঁছো, সঙ্গে সঙ্গে নূরুদ্দিন জঙ্গীর সামনে গিয়ে হাজির হবে। তিনি ঘুমিয়ে থাকলে দারোয়ানকে বলবে জাগিয়ে দিতে। যদি সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী রাগ করেন, বলবে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বলেছেন, আমরা সবাই জেগে আছি।’
গত রাতে লেখা চিঠি নিয়ে কাসেদ ছুটল বাগদাদের দিকে। কোন জায়গায় না থেমে পরের রাতের শেষ প্রহরে গিয়ে সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর ঠিকানায় পৌঁছে দিল সে চিঠি।
কাসেদ যখন নূরুদ্দিন জঙ্গীর দরোজায় গিয়ে উপস্থিত হলো, রক্ষী বাহিনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘চিঠি খুব ভোরেই তার কাছে পৌঁছানো হবে।’
কাসেদ পথে কয়েকবার ঘোড়া বদলালেও এক চুমুক পানি পান করার জন্যও কোথাও থামেনি। পর পর দু’টি রাত জাগা এবং ক্ষুধা-পিপাসায় তার অবস্থা এখন মরার মত। সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু শুকনো খরখরে গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও তার লোপ পেল। সে ওখানেই বেসে পড়ে ইশারায় বললো, ‘এটা খুবই জরুরী চিঠি।’
সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীও সুলতান আইয়ুবীর মত কিছু বিশ্বস্ত ও বিচক্ষণ অফিসার এবং বডিগার্ড রাখতেন, যারা জরুরী অবস্থা বুঝতে পারে এবং গুরুত্ব অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে। প্রয়োজন মনে করলে তাঁর ঘুম ও বিশ্রামের চিন্তা না করে তাঁকে যে কোন সময় ডেকে দেয়ার অনুমতি ছিল তাদের।
কাসেদের এমন করুণ অবস্থা দেখে একজন বডিগার্ড ভেতরে দিয়ে নূরুদ্দিন জঙ্গীর শয়ন কক্ষের দরোজায় খটখট শব্দ করলো। নূরুদ্দিন জঙ্গী বাইরে এসে কাসেদকে দেখে চিঠিসহ তাঁকে ভেতরে বিয়ে গেলেন। কাসেদ ভেতরে প্রবেশ করেই পড়ে গেল। সুলতান জঙ্গী তার চাকর-বাকরকে ডেকে কাসেদের সেবাশুশ্রুষার জন্য তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে চিঠি পড়া শুরু করলেন।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী লিখেছেনঃ
মুহতারাম নূরুদ্দিন জঙ্গী! আপনার ওপরে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আমার চিঠি আপনাকে খুশি করতে পারবে না। কিন্তু খুশি ও সান্ত্বনার বিষয় শুধু এই যে, আমি এখনও আশা ছাড়িনি, আপনার সঙ্গে চুক্তির বিষয় পূর্ণ করছি। আপনি আমার কাছে শুভাগমন করলে আপনাকে বিস্তারিত জানাব। আমি ক্রাক দুর্গ অবরোধ করে রেখেছি। এখনও বিজয় আসেনি, তবে এতটুকু সাফল্য লাভ করেছি যে, খৃস্টানদের এক বিরাট সৈন্যদল সম্রাট রিমান্তের নেতৃত্বে বাইরে থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল, আমি তাদেরকে নিরাপদ আবেস্টনীর মধ্যে আটকে রেখেছি। এ পর্যন্ত তাদের অর্ধেক সৈন্য শেষ হয়ে গেছে। ওদের ক্ষুধার্ত সৈন্যরা এখন ঘোড়া ও উট খেয়ে জীবন ধারণ করছে। আমি সেনাপতি রিমান্তকে জীবিত বন্দী করার চেষ্টায় আছি। কিন্তু ক্রাকের অবরোধ দীর্ঘ হতে চলেছে।
দুর্গের অভ্যন্তরে খৃস্টানদের অবস্থা যথেষ্ট মজবুত। আমি সফলতার জন্য কিছু পদ্ধতি ও কৌশল চিন্তা করেছি। আমার আশা আছে, আমার নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদরা দুর্গের পত্ন ঘটাবেই। তারা যে জযবা নিয়ে লড়াই করছে তা দেখলে আপনি আশ্চর্য হয়ে যাবেন।
কিন্তু আমার ভাই তকিউদ্দিন সুদানের রণাঙ্গনে ব্যর্থ হতে চলেছে। তার ভুল একটাই, সে মরুভূমিতে তার সৈন্যদের ছড়িয়ে দিয়ে এখন দিশহারা হয়ে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে। আমি তাকে রণাঙ্গন থেকে সরে আসতে আদেশ দিয়েছি। মিশরের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ভাল না। গাদ্দার ও বিশ্বাসঘাতকরা ঈমান বিক্রি করার প্রতিযোগিতা করছে। এর ফলে মিশরে সেনা বিদ্রোহের আশংকা দেখা দিয়েছে। সেনা বিদ্রোহ ঘটলে খৃস্টানদের আক্রমণের পথ সুগম হবে।
আলী বিন সুফিয়ানকে আপনি ভালমত জানেন। সে নিজেই আমার কাছে এসেছে। আমি তার পরামর্শকে উপেক্ষা করতে পারছি না। তার পরামর্শ, আমি মিশরে ফিরে যাই। এখন আমি কি মিশরে চলে যাবো?
মুহতারাম! আমি এখন ক্রাক থেকে অবরোধ উঠাতে পারছি না। সালাহউদ্দিন পিছু হটতেও জানে এ কথা বলার সুযোগ আমি খৃস্টানদের দিতে চাই না। এখন শত্রুর ঘাড় গর্দান আমাদের মুঠোর মধ্যে। আসুন, শত্রুদের এই ঘাড় গর্দান আপনি নিজের মুঠোয় ধারণ করুন।
আপনি আপনার সৈন্যবাহিনী সঙ্গে আনবেন। আমি আমার সৈন্য মিশরে নিয়ে যাব। তা না হলে মিশর বিদ্রোহীদের করতলগত হতে যাবে। আশা করি আমার দ্বিতীয় চিঠির অপেক্ষায় থাকবেন না।
ইতি
আপনার বিশ্বস্ত
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।
সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী আর এক মুহূর্তও দেরী করলেন না। তিনি রাতের পোশাকেই বাইরে বেরিয়ে গেলেন। রাতেই সেনাবাহিনীর অফিসার ও উপদেষ্টাদের নিয়ে বসলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ করলেন বৈঠক। সৈন্যদের আদেশ দিলেন প্রস্তুতি নিয়ে ব্যারাক ছাড়তে। বললেন, ‘দুপুরের আগেই ক্রাকের দিকে যাত্রা করবো আমি।’
কথামত দুপুরের আগেই তাঁর বাহিনী ক্রাকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেল।
সুলতান আইয়ুবী নূরুদ্দিন জঙ্গী সেই মর্দে মুজাহিদ, যার নাম শুনেই কেঁপে উঠতো দুশমনের অন্তর। তিনি ছিলেন রণকুশলী বীর। বুকে ছিল ঈমানের প্রজ্জ্বলিত আলো।
বাহিনী নিয়ে তিনি রাস্তায় কমই বিশ্রাম নিলেন। সুলতান আইয়ুবীর ধারনাও অনেক আগে তিনি ক্রাকের রণক্ষেত্রে এসে পৌঁছেন। যদি সংবাদ বাহক তাঁকে আগেই না জানাতেন যে, নূরুদ্দিন জঙ্গী আসছেন, তবে বহু দূর থেকে ধূলার মেঘ দেখে মনে করতেন, নতুন কোন ক্রুসেড বাহিনী আসছে।
সুলতান আইয়ুবী দ্রুতগামী অশ্ব নিয়ে এগিয়ে গিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন। নূরুদ্দিন জঙ্গী সালাহউদ্দিনকে দেখে ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নামলেন। ইসলামের মহান দুই নেতা যখন কোলাকুলি করছিলেন তখন আবেগে সুলতান আইয়ুবীর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো।
সুলতান আইয়ুবী নূরুদ্দিন জঙ্গীকে যুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতি, গাদ্দারদের অপতৎপরতা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে শোনালেন। সুলতান জঙ্গী বললেন, ‘সালাহউদ্দিন! ইসলামের জন্য এটা বড়ই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে, বিশ্বাসঘাতকরা আমাদের জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়ে গেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, জাতি এই গাদ্দারদের থেকে কোন দিন পরিত্রাণ পাবে না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এখনি এর প্রতিকার না হলে এমন এক সময় আসবে যখন এ গাদ্দাররাই সুকৌশলে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বসবে। তারা জাতিকে ধোঁকা দেয়ার জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাদের মোকাবেলা করার কঠিন সংকল্প ঘোষণা করবে, এমনকি শত্রুদের পদদলিত করার হুংকারও দিতে থাকবে, কিন্তু জাতি গেলেন ক্রাকের অবরোধ স্থলে। সুলতান আইয়ুবীর কাছ থেকে বুঝে নিলেন দায়িত্ব। আইয়ুবীর বাহিনীর স্থলে মোতায়েন করলেন নিজের বাহিনী।
আইয়ুবীর বাহিনী দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে পিছু সরে এসে একত্রিত হলো। তাদেরকে দ্রুত কায়রো যাওয়ার নির্দেশ দিলেন আইয়ুবী।
এদিকে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। রিমান্তের যে সৈন্য দলকে ঘেরাও করে রেখেছিল আইয়ুবীর বাহিনী সেখান থেকে তার বাহিনী মুসলিম বাহিনীর দুর্বল দিকে হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বেষ্টনী কেটে বেরিয়ে গেল এবং দ্রুত ময়দান ছেড়ে পালিয়ে গেল। অবশিষ্ট সৈন্যরা তখনো ঘেরাওয়ের মধ্যে, কিন্তু যখন তারা জানতে পারলো, সেনাপতি রিমান্ত পালিয়ে গেছে, তখন তারা ভীতবিহবল হয়ে এলোমেলো পালাতে শুরু করলো। তারা জীবন বাঁচানোর আশায় প্রাণপণ লড়াই শুরু করে দিল। এ লড়াইয়ে অনেকে মারা পড়লো, কেউ কেউ বন্দী হলো। পরিস্থিতি যখন মুসলিম বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে এলো ততক্ষণে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে, রিমান্ত পালিয়ে গেছে।
নূরুদ্দিন জঙ্গী এ ক্ষতি মেনে নিয়ে অবরোধ আবার দৃঢ় করলেন। সৈন্যদের সংহত করে দুর্গ অবরোধ ও বাইরের বাহিনীর বেষ্টনী, সর্বত্র মুসলিম বাহিনীর অবস্থান মজবুত করলেন।
সুলতান আইয়ুবী কায়রোর দিকে যাত্রা করেছেন, কিন্তু জানতেও পারবে না, এই শাসকগোষ্ঠী প্রকৃতপক্ষে জাতির ও দ্বীনের দুশমনদের সাথে তলে তলে কি গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। শত্রুরা এই কপট মুসলমানদেরকে কখনো ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে, কখনো তলোয়ারও বানাভে এবং এই তলোয়ার দিয়েই জাতির ঘাড় ও শিরা কাটবে।
না, আমি তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য এ কথা বলছি না সালাহউদ্দিন! ভয় পাওয়া মুমিনের কাজ নয়। আমি কেবল বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে তোমাকে সতর্ক করছি। কাফেরের চাইতে ঘরের শত্রু এইসব বিভীষণরা মিল্লাতে ইসলামিয়ার জন্য বেশি ক্ষতিকর। কারণ সামনাসামনি যারা লড়তে আসে জাতি তাদের চিনে এবং তাদের হাত থেকে নিজের দেশ ও ঈমান বাঁচানোর জন্য জীবন বিলিতে দিতেও পিছপা হয় না, আর চিনলেও তাদের বিরুদ্ধে কিছু করার জন্য নৈতিকভাবে সাহসী হয় না।
না সালাহউদ্দিন, এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। আমরা এ অবস্থার অবসাত ঘটাবো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে হবে। তুমি জলদি মিশরে চলে যাও। তকিউদ্দিনকে সহযোগিতা দিয়ে সুদান থেকে বের করে আনো। ডানে-বামে আক্রমণ করে শত্রু সেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখো যাতে তকিউদ্দিনের বাহিনী কোথাও ঘেরাও হয়ে না পড়ে। মিশরে যেসব সৈন্য রয়েছে তাদেরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও, আমি তাদের মাথা থেকে বিদ্রোহের পোঁকা বের করে দেবো।’
সন্ধ্যার পর নূরুদ্দিন জঙ্গী তাঁর সেনাবাহিনীকে নিয়ে ক্রাকের কথা ভুলতে পারছেন না তিনি। বার বার পিছন ফিরে দেখছেন, সে চোখে রাজ্যের নৈরাশ্য। নূরুদ্দিন জঙ্গীর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তিনি বললেন, ‘ইতিহাস একথা তো আবার বলবে না যে, আইয়ুবী যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছু হটে গেছে? আমি অবরোধ তো উঠিয়ে নেইনি?’
‘না! সালাহউদ্দিন, তুমি উঠাওনি।’ নূরুদ্দিন জঙ্গী তাঁকে বললেন, ‘তুমি কখনও পরাজয় বরণ করোনি, তুমি বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গেছো। যুদ্ধ শুরু আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয় না।’
‘হে আমার ফিলিস্তিন! আমি আবার আসবো।’ সুলতান আইয়ুবী ক্রাকের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আমি আবার আসবো।’
তিনি ঘোড়ার লাগাম ধরে নাড়া দিলেন এবং দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেলেন মিশরের দিকে, আর পিছু ফিরে তাকালেন না।
নূরুদ্দিন জঙ্গী তাঁর পথের দিকে চেয়ে রইলেন। তিনি যখন তার ঘোড়াসহ দূরে দিগন্তের অন্তরালে হারিয়ে গেলেন, তখন সুলতান নূরুদ্দিন তাঁর নায়েবে সালারকে বললেন, ‘ইসলামের জন্য প্রত্যেক যুগেই সুলতান আইয়ুবীর মোড় মর্দে মুজাহিদ প্রয়োজন।’
এই ঘটনা ১১৭৩ খৃস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়কার। সে সময় প্রত্যেক যুদ্ধক্ষেত্রে খৃস্টানদের সামরিক শক্তি পাঁচ থেকে দশ গুন বেশি হতো কিন্তু তারা অধিকাংশ সময় মুষ্টিমেয় মুসলমান মুজাহিদদের হাতে পরাজয় বরণ করতো। কখনো তারা পরাজিত না হলেও জয়লাভ করতে পারতো না। তারা জানতো, কুরআনের আদেশ মুসলমানদের মধ্যে এমন এক যুদ্ধের জযবা সৃষ্টি করে যার শক্তি অন্যরকম। তারা আল্লাহর নামে যুদ্ধ করে এবং এ পথে জীবন কুরবানী করাকে সাফল্য মনে করে।
খৃস্টানদের মধ্যে এমন কিছু জেনারেল ছিল যারা মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় এ জযবাকে প্রতিরোধ করার চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা শুরু করেছিল এবং সে অনুযায়ী কাজও শুরু করে দিয়েছিল। তারা এও জানত, একজন মুসলমান দশজন অমুসলিমের সাথে লড়াই করেও বিজয় লাভ করতে পারে। এটা কোন জ্বীন বা ভূতের কাজ নয় বরং তাদের মধ্যে আল্লাহর শক্তি ও বিশ্বাস কাজ করে বলেই তারা এ সাফল্য লাভ করে। এ সব মুজাহিদরা কোন কিছু পাওয়ার লোভ বা লালসায় যুদ্ধ করে না বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রাণ বিলিয়ে দেয়।
সুতরাং সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর অনেক আগে থেকেই ইহুদী ও খৃস্টান পণ্ডিতরা মুসলমানদের সামরিক শক্তি ও জেহাদী জযবাকে দুর্বল ও নিঃশেষ করার জন্য যাবতীয় কৌশল ও প্রচেষ্টা শুরু করেছিল। এ প্রচেষ্টার মূল ছিল ধর্মীয় বিশ্বাসের দৃঢ়তা নষ্ট করা এবং ঈমান ও আকিদায় ভেজাল মিশ্রিত করা।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী এ দু’জনের দুর্ভাগ্য ছিল এই, তাঁরা যখন খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন, তার আগেই খৃস্টানরা ক্রুসেডের অভিযান শুরু করে দিয়েছিল এবং তাদের এ অভিযান সফলতা লাভ করতে শুরু করেছিল। ইসলামের শত্রুরা এ অভিযান দু’দিক থেকে শুরু করে। একদিকে শাসক, আমীর, উজির এবং সেনা কমান্ডরা, অন্য দিকে সাধারণ মানুষ। প্রথম শ্রেণীকে ওরা ঘায়েল করতো অর্থ, নারী ও শরাবে ডুবিয়ে, দ্বিতীয় শ্রেণীকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করতো জুয়া, নেশা, লোভ এবং ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ও কুমন্ত্রণা।
সুলতান জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবী যেমন নিত্যনতুন রণকৌশল আবিষ্কার করতেন তেমনি খৃস্টানরাও তৎপর থাকতো মুসলমানদের বিপথগামী করার অভিনব কৌশল আবিষ্কারে।
এই আবিষ্কার প্রক্রিয়ায়ই আবিষ্কৃত হয়েছিল এক নতুন কৌশল, যাকে তারা অভিহিত করেছে সাংস্কৃতিক কৌশল বলে, সাংস্কৃতিক কৌশল এতটাই কার্যকরী প্রমাণিত হলো যে, এক স্ময় খৃস্টীয় শাসকবর্গ প্রকাশ্য ময়দানে যুদ্ধ করার পরিবর্তে এ পদ্ধতিকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে লাগল। তারা এই দর্শনের সমর্থক হয়ে গেল যে, যুদ্ধ এমন পদ্ধতিতে কর যেন মুসলমানদের যুদ্ধ করার জযবা ও আবেগ নষ্ট হয়ে যায়। তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রবল আক্রমণ চালাও এবং তাদের মনে এমন সন্দেহ সৃষ্টি করে দাও, যাতে মুসলমানরা তাদের ধর্মভীরুদেরকে ঘৃণা করে এবং মুজাহিদদেরকে যুদ্ধবাজ বলে ভাবতে বাধ্য হয়।
এ চিন্তাধারার লোকদের মধ্যে প্রথমেই আসে ফিলিপ অগাস্টাসের নাম। সে এই চিন্তাধারায় খৃস্টান শাসকবর্গকে উজ্জীবিত করে তোলে। ফলে এইসব খৃস্টান শাসকরা সৈন্যদেরকে বলতে থাকে, আমাদের যুদ্ধ সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গীর সাথে নয়, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের সাথে।
এই যুদ্ধের সফলতা আমরা আমাদের জীবনে দেখে যেতে না পারলেও কোন না কোনদিন এর সফলতা আসবেই। সে জন্য প্রয়োজন মুসলমানদের নতুন প্রজন্মকে মানসিক দিক দিয়ে এমনভাবে গড়ে তোলা, যেন তার যৌন উন্মাদনা ও বিলাসিতার জন্য পাগলপারা হয়ে যায়।
ফিলিপ অগাস্টাস তার মিশনকে সফল করার জন্য যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানদের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করে সন্ধি করতেও আপত্তি করেনি। এটা ১১৬৯ খৃস্টাব্দের কথা। এ সময় সে নূরুদ্দিন জঙ্গীর হাতে পরাজিত হয়ে অধিকৃত অঞ্চল সন্ধির মারফতে ফেরত দিয়েছিল এবং নূরুদ্দিন জঙ্গীর দাবী অনুযায়ী জরিমানাও দিয়েছিল। সেই সাহতে আর কোনদিন যুদ্ধ করবে না বলে অঙ্গীকার করে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরও করেছিল। জিজিয়া দিতেও রাজী হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবন্দী মিনিময়ের সময় সে প্রকাশ্যে বন্দী বিনিময় করল ঠিকই, কিন্তু সে এমন সব সৈন্যদেরকে বন্দী হিসাবে দেখাল যারা আর যুদ্ধ করার যোগ্য ছিল না। সুস্থ সবল সৈন্যদের সে হত্যা করে ফেলল। ফলে, তাদের যে সে কখনো বন্দী করেছিল তার আর কোন প্রমাণই রইল না।
কোন কোন খৃস্টান শাসক ও জেনারেল তাকে সন্দেহের চোখে দেখতো। কেউ কেউ তাকে দোষারোপ করতে লাগল কেটে খাচ্ছে ওরা। এই চক্রান্তের ফলেই মিশরে এখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠছে, যে আগুন ঠান্ডা করতে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে ক্রাক দুর্গের অবরোধ ছেড়ে ছুটে আসতে হলো মিশরে।
যে আইয়ুবী কখনো বিজয় ছাড়া ময়দান থেকে পা তোলে না, সেই আইয়ুবীকে শেষ পর্যন্ত সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর ওপর অবরোধের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সসৈন্য কায়রো ফিরে আসতে হলো। তিনি কোন দুর্বল হৃদয় মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তবু তাঁর চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল নিরাশার ছায়া।
সেনাবাহিনী দেশে ফেরার আনন্দে খুশিই ছিল। তাদের ধারনা ছিল, বিশ্রামের জন্যই তাদেরকে কায়রো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু অভিজ্ঞ সালাররা সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধের ধারা বুঝতে পারতেন। তারা সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীকে সৈন্যসহ ডেকে পাঠানোয় অবাক হলেও এটা বুঝেছিলেন, আইয়ুবীর মনে কোন গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা আছে। যিনি বিজয়ের সংকল্প নিয়ে দুর্গ অবরোধ করেছিলেন, বিনা কারণে তিনি সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে পারেন না।
মিশরের অবস্থা যে খুব খারাপ এবং সুদানে তকিউদ্দিনের আক্রমণ ব্যর্থ হয়ে গেছে এ কথা সুলতানের দু’একজন ঘনিষ্ঠ সেনাপতি ছাড়া আর কেউ জানতো না। সুলতান আইয়ুবীর সাথে আলী বিন সুফিয়ানকে দেখে অভিজ্ঞ সালাররা কিছু না জানলেও এটুকু অন্তত বুঝেছিলেন, মিশরে কোন গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে। (________) যে, সে ভেতরে ভেতরে মুসলমানদের বন্ধু হয়ে গেছে।
তার এক বন্ধু তার কাছে এ অভিযোগ করলে উত্তরে অগাস্টাস বললো, ‘একজন মুসলমান শাসককে ফাঁসানোর জন্য আমার কুমারী মেয়েকে তার কাছে নিবেদন করতেও আমি আপত্তি করবো না। তোমরা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করে যা আদায় করতে পারবে, আমার আনাড়ী এক কুমারী কন্যা তারচে বেশি আদায় করার ক্ষমতা রাখে। তোমরা মুসলমানদের সাথে সন্ধি ও আপোষ চুক্তি করতে ভয় পাও। এতে তোমরা অপমান বোধ কর। কিন্তু তোমরা এ কথা কেন চিন্তা করো না, মুসলমানদেরকে যুদ্ধের ময়দানে মারার চেয়ে সন্ধির মাধ্যমে মারা সহজ। প্রয়োজন হলে তাদের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করে শান্তি চুক্তি কর, আর বাড়ি ফিরে এসে আরামে বসে সে চুক্তির বিরুদ্ধে কাজ করতে থাকো।
আমাকে দেখে শেখো। আমি কি ঠিক তাই করছি না? তোমরা জান, আমার দুই মেয়েকে দামেস্কের এক শেখের হেরেমে রেখেছি। সেই শেখের সাথে যুদ্ধ না করেই তোমরা কি তোমাদের সমস্ত অঞ্চল ফেরত পাওনি? সে কি বন্ধুত্বের মূল্য আদায় করেনি? সে আমাকে তার আপন জ্ঞাতি ও বন্ধু মনে করে। অথচ আমি যে তার জীবনের সবচে বড় শত্রু এ কথার প্রমাণ কি তোমরা পাওনি? আমি প্রতিটি খৃস্টানের লামে লামে বলতে চাই, যতো পারো মুসলমানদের সঙ্গে চুক্তি করো আর সুযোগ মত ধোঁকা দিয়ে নিঃশেষ করে দাও তাদের।’
সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনী নিয়ে ক্রাক দুর্গ থেকে মার্চ করে কায়রোর দিকে এগিয়ে চলেছেন। রাস্তায় তিনি খুব কমই বিশ্রাম নিলেন এবং সেনাবাহিনীকেও বেশি বিশ্রামের অবকাশ না দিয়ে হাকিয়ে নিয়ে চললেন। এতেও অভিজ্ঞদের মনে সন্দেহ হলো, নিশ্চয়ই মারাত্নক কিছু ঘটেছে মিশরে।
সারাদিন পথ চলার পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সন্ধ্যার পরও কিছুটা পথ চললেন তারা। এরপর সুলতান সৈন্যদের থামার নির্দেশ দিলেন। আইয়ুবীর জন্য তাবু টানানো হলো। তিনি এশার আযান পর্যন্ত বিশ্রাম নিলেন তাবুতে। নামাজের পর উপদেষ্টা ও অফিসারদের ডেকে পাঠালেন।
বৈঠকের শুরুতেই তিনি বললেন, ‘আপনাদের মধ্যে অনেকেরই জানা নেই, কেন আমি অবরোধ উঠিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে কায়রো যাচ্ছি। আসলে আমি অবরোধ উঠাইনি। আমরা কী ময়দান ছাড়িনি, বলতে পারেন সাময়িক পিছু হটেছি। কিন্তু কেন আমরা পিছু সরে এসেছি সে কথা শুনলে আপনারা আশ্চর্য হয়ে যাবেন। আপনাদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে আপনাদেরই কিছু ভাই, আপনাদের কিছু বন্ধু!
তারা এখন ক্রুসেডের বন্ধু হয়ে গেছে। তারা বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করেছে, যদি আলী বিন সুফিয়ান ও তাঁর নায়েব এবং পুলিশ সুপার গিয়াস কামাল সজাগ না থাকতেন তবে আপনারা আজ মিশর ফিরে যেতে পারতেন না। সেখানে এখন খৃস্টান ও সুদানীদের রাজত্ব কায়েম থাকতো। আরসালানের মত হাকিম খৃস্টানদের দালাল হয়ে গিয়েছিল। সে আল ইদরিসের দুই যুবক ছেলেকে হত্যা করেছে। ধরা পড়ার পর নিজেও আত্নহত্যা করেছে। যদি আরসালানের মত লোক গাদ্দার হতে পারে তবে আর কার ওপর ভরসা করা যেতে পারে?
উপস্থিত সবার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। নীরবতা ছেয়ে গেল সকলের মাঝে। ক্ষোভ ও ক্রোধে শ্রোতাদের চোখে মুখে ফুটে উঠল অস্থিরতা ও অশান্তি। সুলতান আইয়ুবী চুপ করে সবার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেন। মোমবাতির কম্পমান আলোতে সকলের চেহারা এমন দেখা যাচ্ছিল, যেন তারা একে অন্যের অপরিচিত। তাদের চোখে কোন পলক ছিল না। সুলতান আইয়ুবীর কথার চেয়ে তারা ভাষার গাম্ভীর্য সকলের মনে ভয় ধরিয়ে দিল, ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল সবাই।
তিনি বললেন, আমি গাদ্দারদের ক্ষমা চাইতে বলবো না। এ কথাও বলবো না, ইসলাম ও মুসলিম সাম্রাজ্যের অনুগত থাকার জন্য সকলেই কোরআন ছুয়ে শপথ করো। ঈমান বিক্রি করার লোকেরা কোরআন হাতে নিয়ে শপথ করেও বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে। আমি শুধু আপনাদের বলতে চাই, অমুসলমান কখনো মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না। যারা আল্লাহ ও রাসূলের শত্রু তারা আমার আপনারও শত্রু। শত্রু যখন আমাদের সঙ্গে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের ভাব দেখায় তখন তার মধ্যে শত্রুতা গোপন থাকে। অন্তরের গভীরে সে যে শত্রুতা লুকিয়ে রাখে সময় ও সুযোগ মত সে তা ব্যবহার করে। তারা ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়, বন্ধুর ক্ষতি করতে ব্যবহার করে বন্ধুকে। এসব কুচক্রীরা ধর্মের ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার করে ধর্মের অনুসারীদের। ইসলামের ক্ষতি করার জন্য তারা বেছে নেয় মুসলমানদের। স্বার্থপর ও লোভীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে ওরা। তারপর এইসব বিশ্বাসঘাতক মুসলমানদের দিয়ে ইসলামের সর্বনাশ করতে থাকে।
আমরা আমাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যুদ্ধ করছি না, ঈমানের দাবী পূরণের জন্য জিহাদের ডাকে সাড়া দিয়েছি। নিজস্ব শাসন ক্ষমতা কোন দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য নয়, আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য এ জিহাদ। দুই ভিন্ন মতবাদ ও বিশ্বাসের যুদ্ধ এটা, যার একদিকে ইসলাম অন্য দিকে কুফর। এই যুদ্ধ ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে, যে পর্যন্ত না দুনিয়ার বুক থেকে কুফর মিটে যাবে এবং ইসলাম বিজয়ী হবে।’
উপস্থিত সালারদের চেহারা তখন টগবগ করে ফুটছিল। অত্যধিক রাগের কারণে কথা বলতে পারছিল না কেউ। শেষে একজন সেনাপতি কোন অমতে নিজকে সংযত করে বললো, ‘আমার বেয়াদবী ক্ষমা করবেন সালারে আজম! যদি মনে করে আমরা বিশ্বাসঘাতক নই, তবে আমাদেরকে মিশরের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। কারা এই গাদ্দার আমরা জানতে চাই।’
‘আরসালান সেয়ান বিভাগের কেউ নয়, সে প্রশাসনের হাকিম ছিল। আপনি প্রশাসন বিভাগেই গাদ্দার পাবেন, সেনা বিভাগে নয়।’ বললেন আরেকজন উত্তেজিত সালার।
‘ক্রাক দুর্গের অবরোধ আপনি উঠিয়ে নিয়েছেন, আমরা উঠাইনি। সম্মানিত জঙ্গী সাহেবকে আপনিই ডেকে এনেছেন, আমরা নই। আমাদের পরীক্ষা যুদ্ধের ময়দানেই হতে পারে, ঘোরে বসে নয়। আমরা শুধু জানতে চাই, এখন মিশরে কি হচ্ছে?’
সুলতান আলী বিক সুফিয়ানের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আলী, এদের বলো, সেখানে কি হচ্ছে?’
আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘গাদ্দাররা শত্রুদের সাথে মিশে সুদানের যুদ্ধ সেক্টরে পাঠানো রসদপত্র লুট করে। হাট বাজার থেকে খাদ্যশস্য উধাও করে ফেলে। পল্লী এলাকায় অচেনা লোক এসে খাদ্যশস্য কিনে নিয়ে যায়। বাজারে গোশত পাওয়া যায় না। অথচ এ অবস্থাও প্রশাসনের লোকেরা খাদ্য ও রসদ সরবরাহের সময় কোন পাহারার ব্যবস্থা রাখে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা আগেই শত্রুদেরকে এ সংবাদ জানিয়ে দেয়। ফলে শত্রুরা রাস্তায় কাফেলা থামিয়ে লুট করে নিয়ে যায় সব মালামাল।’
আলী আরো বললেন, ‘শহর মাজারে নিষিদ্ধ কাজ বেড়ে গেছে। জুয়া খেলা এমন আনন্দদায়ক বিষয় হিসেবে চালু হয়ে গেছে যে, আমাদের যুবকরা সে দিকে ঝুঁকে পড়ছে। পল্লী অঞ্চল থেকে কোন যুবক সেনাবিভাগে ভর্তি হতে আসে না। এদিকে সৈন্যদের মাঝেও অশান্তি বেড়ে গেছে। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংহতি ধ্বংস করার পায়তারা চালাচ্ছে তারা। দেশে ছোট ছোট রাজ্যের শাসকরা স্বাধীন শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তাদেরকে এ লচ দেখিয়েছে খৃস্টানরা। এদের কাছে বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ আসছে। কেন্দ্রীয় শাসন ও খেলাফত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে এইসব কুচক্রীরা।
সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে পল্লী অঞ্চল। পল্লীর সাধারণ জনসাধারণ এমনিতেই মূর্খ, অশিক্ষিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সম্প্রতি তার অদ্ভুত অদ্ভুত আকিদা বিশ্বাসে জড়িয়ে পড়ছে। ওখানে নতুন নতুন পীরের আবির্ভাব ঘটছে। তারাই এইসব অদ্ভুত আকীদা বিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে জনগণ অমুসলিমদের মত আচার আচরণ ও চাল চলনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। সবচেয়ে ভয়ের কারণ হচ্ছে, এর ফলে পল্লী এলাকা থেকে যে অগণিত যুবক সৈন্য দলে ভর্তি হতে আসতো তারা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অথচ সেনাবাহিনীতে একদিন এই পল্লী অঞ্চলের যুবকরাই বেশি করে ভর্তি হতো। এখন নানা অমূলক ও অনৈসলামিক ধারণা-বিশ্বাস পল্লী অঞ্চল থেকে ভর্তি হওয়া সৈন্যদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।’
‘আপনি এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি?’ একজন উত্তেজিত সালার প্রশ্ন করল।
‘নিয়েছি।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমার গোয়েন্দা বিভাগ অপরাধীদের সনাক্ত করা ও ধর পাকড়ে ব্যস্ত আছে। আমার চর প্রত্যন্ত পল্লী এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু শত্রুদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এত বেশি বেড়ে গেছে যে, দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতার করাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। বেশি অসুবিধা হচ্ছে, মুসলমানরা শত্রুদের গোয়েন্দা এবং দুষ্কৃতিকারীদের সহযোগী হওয়ায়। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন, পল্লী অঞ্চলের কিছু কিছু মসজিদের ইমামও দুষ্কৃতিকারীদের সহযোগী হয়ে পড়েছে।
একজন অফিসার প্রশ্ন করল, ‘প্রশাসন দুর্নীতিবাজ হয়ে পড়ায় এখন কি সেনাবাহিনীকে সেখানে নেয়া হচ্ছে প্রশাসনিক কাজ করানোর জন্য?’
‘না, বেসামরিক কাজে আমি সামরিক লোক নিয়োগ করবো না।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘সৈন্য বিভাগ যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছে তারা সেই দায়িত্বই পালন করবে। এতে রাজ্যের জন্যও মঙ্গল, সৈন্যদের জন্যও মঙ্গল। একজন কোতোয়াল কখনও সেনাপতি হতে পারে না, তেমনি কোন সেনাপতিও কোতোয়ালের দায়িত্ব পালন করতে পারে না।’
তিনি আরো বললেন, ‘আমাদের উচিৎ প্রশাসন কি কাজ করছে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। তারা দায়িত্ব পালনে কোন অবহেলা ও ক্রুটি করছে কিনা দেখা। বন্ধুগণ! আল্লাহ আমাদেরকে ইতিহাসের এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। এ পরীক্ষায় পাশ করতে হলে আমাদেরকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে।
মিশরের অবস্থা আপনারা শুনেছেন। সুদানের অভিযানও ব্যর্থ হয়েছে। তকিউদ্দিন তার পরিকল্পনার ভুলের জন্য মরুভূমিতে আটকে গেছে। তার সৈন্যদল ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মরুভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছে। পিছু হটারও কোন সুযোগ পাচ্ছে না তারা। আমি বলতে পারি না, মুহতারাম নূরুদ্দিন জঙ্গী ক্রাক জয় করতে পারবেন কি না। কিন্তু এটাও আমারই ব্যর্থতা বলবো।
তিনি হয়ত প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকবেন এবং শত্রুদের পরাজিত করতে পারবেন। কিন্তু শত্রুরা যে অদৃশ্য সেক্টরে আমাকে আহ্বান করেছে সে সেক্টরে শত্রুদের পরাজিত করা আসলেই খুব কঠিন হবে। জঙ্গী অস্ত্র ধারণে পটু, মরুভূমির বুক চিরে চিতা বাঘের মত ছুটতে পারেন তিনি, কিন্তু আমি কোথায় ছুটে যাবো, কার ঘাড়ে অস্ত্র চালাবো?’ থামলেন সুলতান।
একটু বিরতি নিয়ে সুলতান আইয়ুবী আবার বললেন, ‘এখন যে সমস্ত সৈন্য মিশরে আছে, তারা যখন সুবাক রণক্ষেত্রে গিয়েছিল, তখন তাদের মধ্যে ঈমানী জযবা এমনিই ছিল, যেমন আজ আপনাদের মধ্যে আছে। কিন্তু কায়রোর নিরাপদ সেনা ছাউনিতে বসে আজ তারা বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এখন অবস্থা এমন যে, এই সৈন্যদের আর বিশ্বাস ও ভরসা করার উপায় নেই।’
‘দ্বীনের প্রতি ভালবাসা নেই, জাতির প্রতি দরদ নেই এমন প্রতিটি সৈনিককে আমরা হত্যা করবো।’ একজন অফিসার আবেগে কাঁপতে কাঁপতে বললো।
‘আমরা সর্বপ্রথম সেইসব অফিসার ও গাদ্দারদের থেকে পবিত্র হবো যারা দুশমনের জালে পা দিয়ে নিজের ঈমান বিক্রি করে দিয়েছে।’ বললো অন্যজন।
‘যদি আমার সন্তানও দুশমনের বন্ধু প্রমাণিত হয়, তবে আমি নিজ হাতে তার মাথা কেটে আপনার পদতলে সমর্পণ করবো।’ একজন বৃদ্ধ সালার বললো।
বৈঠকে উপস্থিত প্রতিটি চেহারায় প্রত্যয় ও সংকল্পের দৃঢ়তা টগবগ করে ফুটছিল। সুলতান আইয়ুবী তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের এসব আবগেময় ও উত্তেজিত কথাবার্তা সমর্থন করতে পারি না।’
উপস্থিত লোকগুলোর চোখে মুখে দেখা গেল প্রচণ্ড ক্রোধ ও ক্ষোভের চিহ্ন। এরা এমনসব লোক ছিল, সুলতান আইয়ুবীর দিকে চোখ তুলে তাকাতেও যারা ভয় পেত। কিন্তু এখন তারা আগুন ঝরা চোখ নিয়ে সুলতানের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিটি চোখ যেন বলছে, একদিন যারা আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতো, দ্বীনকে বিজয়ী করার স্বপ্ন দেখতো আমাদেরই মত, সে ঈমানদীপ্ত মোজাহিদদের অন্তরকে যারা কলুষিত করেছে তাদের কোন ক্ষমা নেই।
তরুণ অফিসারদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হলো সবচে ভয়াবহ। সৈন্যরা বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করছে শুনে তাদের মাথায় রাগে আগুন ধরে গেল। একজন তো সুলতানকে বলেই ফেললো, ‘আপনি আমাদেরকে সবসময় ধৈর্য সহকারে চিন্তা করার ও ধীরস্থিরভাবে কাজ করার উপদেশ দিয়ে এসেছেন। আমরা কখনো আপনার আদেশ অমান্য করিনি এবং উত্তেজিতও হইনি। আমাদেরকে আপনি এই হুকুম দিন, কায়রো পৌঁছার আগ পর্যন্ত আমরা রাস্তায় আর কোথাও থামবো না। আমরা আহার, নিদ্রাম বিশ্রাম ত্যাগ করে লাগাতার পথ চলে কায়রো পৌঁছবো এবং দুষ্কৃতিকারীদের শায়েস্তা করে তবেই ছাউনিতে ঢুকবো।’
সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পক্ষে এই উত্তেজিত অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। তিনি আরও কিছুক্ষণ তাদের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে বৈঠক শেষ করলেন।
ভোরে সেনাবাহিনী আবার কায়রোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। এ যাত্রা যথারীতি কমান্ডেই হচ্ছিল। সুলতান আইয়ুবীও আগের মতই অফিসারদের সাথে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, আলী বিন সুফিয়ান তাঁর সঙ্গে নেই।
সন্ধ্যা পর্যন্ত সৈন্যদের দুইবার থামানো হলো। সন্ধ্যার পরও সৈন্যরা চলতেই থাকলো। রাতের প্রথম প্রহর শেষ হয়ে গেলে সুলতান আইয়ুবী বিশ্রামের জন্য সৈন্যদের থামতে বললেন। খেতে বসে সুলতান আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে আলী বিন সুফিয়ানকে তালাশ করলেন, কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না।
খাওয়ার পর তিনি যখন তাবুতে ফিরে এলেন তখন আলী বিন সুফিয়ান এসে সেখানে হাজির হলেন।
‘সারাদিন কোথায় ছিলে আলী?’ সুলতান জিজ্ঞেস করলেন।
‘গত রাতে আমার মনে একটা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল।’ আলী বিন সুফিয়ান উত্তরে বললেন, ‘সেই সন্দেহ সঠিক কিনা জানার জন্য সারাদিন সৈন্যদের মাঝে ঘোরাফেরা করলাম।’
‘কি সন্দেহ হয়েছিল?’
‘আপনি কি লক্ষ্য করেননি, আমি যখন মিশরের অবস্থা বর্ণনা করলাম তখন সেনাপতি, কমান্ডার ও সমস্ত অফিসাররা কেমন আগুন হয়ে গিয়েছিল।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছিল, এরা নিজেদের গ্রুপের সৈন্যদেরকেও এ ব্যাপারে উত্তেজিত করে তুলবে। আমার সন্দেহই সত্য প্রমাণিত হলো। তারা সত্যি সত্যি তাদের দলের সাধারণ সৈন্যদেরকে মিশরের প্রশাসন ও সৈন্যদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছে। আপনি সৈনিকদের যতটা স্বাভাবিক দেখছেন তারা ততটা স্বাভাবিক নেই। এখনকার এই নিস্তরঙ্গ পরিবেশ আসলে প্রচণ্ড ঝড়েরই পূর্বাভাস। প্রতিটি সৈনিকদের ভেতর এখন প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।
আমি সৈন্যদের বলতে শুনেছি, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ ও আহত হচ্ছে আর আমাদের সাথীরা কায়রোতে আরামে বসে ইসলামের পতাকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চায়? কায়রো গিয়ে প্রথমেই এই গাদ্দারদের শেষ করবো, তারপর রওনা দেবো সুদানে আটকে পড়া সৈন্যদের সাহায্যে। সম্মানিত সুলতান! যদি আমরা পথে আর কোথাও বিশ্রাম ও বিরতি না নিয়ে সোজা কায়রো গিয়ে পৌঁছি, তবে পৌঁছার সাথে সাহতেই সেখানে গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আমাদের সৈন্যরা ক্ষীপ্ত, উত্তেজিত। তারা প্রতিশোধের নেশায় পাগলপারা। আর মিশরে অবস্থানকারী সৈন্যরাও বিদ্রোহের বাহান খুঁজছে। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় সম্পর্কে একটু চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন।’
‘আমি এ বিষয়ে খুবই খুশি যে, আমাদের সৈন্যরা ঈমানী জযবায় এখনো অটুট। তাদের এ আবেগকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।’ সুলতান আইয়ুবী বললে, ‘কিন্তু আমাদের শত্রুরাও এটাই চায়। তারা চায় আমাদের সেনাবাহিনী পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক।
তিনি গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। আলী বললেন। ‘সুলতান, আমাদের এ ফৌজ কায়রো পৌঁছার আগেই মিশরের ব্যারাকে অবস্থানরত সৈন্যদের অন্য রাস্তায় ক্রাকের সেক্টরে যাত্রা করিয়ে দিতে হবে। অবিলম্বে কাসেদ ও দায়িত্বশীল অফিসার পাঠিয়ে এর ব্যবস্থা করুন।’
সুলতান একটু চিন্তা করলেন। বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছো। তবে দূত পাঠিয়ে আদেশ দিলে হবে না। ভেতরের কথা বলা যাবে না তাদের। ফলে আমার সৈন্য কায়রো পৌঁছার আগেই তাদের বেরিয়ে পড়তে হবে, এমন কোন তাড়া ওদের থাকবে না। এর মধ্যে আমার বাহিনী ওখানে পৌঁছে গেলে পরিস্থিতি আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না। তারচে বরং আমি নিজে সেখানে চলে যাই এবং ওদেরকে ক্রাক যাত্রার নির্দেশ দিয়ে সবকিছু নিজে তদারক করি। আমি নিজে গিয়ে আদেশ দিলে তারা মনে করবে তারা আমার কমান্ডে যাত্রা করেছে।’
সুলতান উঠে দাঁড়ালেন। ডাকলেন গার্ডকে। বললেন, ‘আমার ঘোড়া তৈরী করো।’ এরপর ডাকলেন নায়েবে সালারকে। বললেন, ‘আলীকে নিয়ে আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। সকালে বাহিনী নিয়ে তুমি কায়রো রওনা দেবে। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ওখানে পুছহেই সৈন্যদের অভিযানে নেমে পড়তে হবে, তাই যতটা সম্ভব বিশ্রামের সুযোগ দেবে ওদের। পথে তোমাদের সাথে আর দেখা হবে না, কায়রোয় তোমাদের জন্য আমি অপেক্ষা করবো।’
তখন গভীর রাত। আলীকে নিয়ে পথে নামলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। মাথার ওপর ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের ঘোলাটে জোসনা। দূর দিগন্তে আবছা দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট পাহাড়ের চূড়া। বালিয়াড়ি ভেঙে এগিয়ে চলেছে দুটো ঘোড়া, একটিতে সুলতান আইয়ুবী, অন্যটিতে আলী বিন সুফিয়ান।
সুলতানের দৃষ্টি সামনের দিকে প্রসারিত। চেহারায় চিন্তার ছাপ সুস্পষ্ট। সুলতান ভাবছেন, ‘ক্রাকে নূরুদ্দিন জঙ্গী কি সফল হতে পারবেন? তকিউদ্দিন এখন কেমন আছে, সে কি তার বাহিনীকে সংগঠিত করতে পেরেছে? নাকি এরই মধ্যে সুদানীরা তাদের ঘেরাও করে তাদের ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা শুরু করে দিয়েছে? মিশরের পরিস্থিতি না জানি কি এখন। এরই মধ্যে বিদ্রোহ তো শুরু হয়ে যায়নি! আল ইদরিসের ছেলেদের মত কেউ তো আর খুন হয়নি! তিনি কি প্রশাসনের যে সব গাদ্দাররা ঘাপটি মেরে আছে তাদের সবাইকে সনাক্ত করতে পারবেন? পারবেন কি তাদের কবল থেকে মিশরের জনগণকে রক্ষা করতে? সীমান্ত এলাকায় যে নতুন ফেতনা শুরু হয়েছে কি দিয়ে তিনি তার মোকাবেলা করবেন? যে ক্ষীপ্ত সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছে তার পিছনে, কায়রো পৌঁছে তারা কি এমন কোন পদক্ষেপ নেবে যার মোকাবেলা করা তাঁর পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে? এরকম হাজারটা চিন্তা মাথায় নিয়ে পথ চলেছেন সুলতান। পাশাপাশি ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে আলী।
‘আলী, বিপদ একটা আসলে সামাল দেয়া যায়। চতুর্দিক থেকে বিপদের এমন পাহাড় ভেঙে পড়লে কোনটা রেখে কোনটা সামাল দেবো?’
‘এ নিয়ে খুব কি দুশ্চিন্তা করার দরকার আছে সুলতান! বিপদ যত ভয়ংকর হোক, আল্লাহ নিশ্চয়ই তারচে অনেক বেশি সামর্থ্য রাখেন। বিপদের তুফানে পড়ে আপনি কি অসংখ্যবার আল্লাহর সাহায্যে তা থেকে মুক্তি লাভ করেন নি? আগে যেমন তিনি সাহায্য করেছেন এবারও মুশকিল আসান তিনিই করবেন।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
আরো একটি রাত মরুভূমিতেই কাটলো তাদের। শেষ রাতের দিকে কায়রো শহরের আবছা অবয়ব ভেসে উঠল দূর থেকে। একটু পরই সূর্য উঠলো। আঁধারের বুক চিরে স্পষ্ট হলো কায়রোর শহর। সুলতান ভাবলেন, ঘুমের অতল অল থেকে শহরের মানুষ নিশ্চয়ই জেগে উঠছে। একটু পরই তাদের কলকাকলিতে মুখরিত হবে জনপদ। শান্তিপ্রিয় নিরুদ্বিগ্ন এইসব মানুষগুলোকে কিছুতেই কুচক্রীদের দয়ার ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না। যে করেই হোক, সমস্ত প্রতিকূলতার মোকাবেলা আমাকে করতেই হবে।
তিনি স্বগতস্বরে বললেন, ‘ভাইয়েরা আমার! আমি আসছি। ইসলামের আলো দিয়ে আমি দূর করে দেবো সকল আঁধার। পেঁচা আর বাদুর যেমন দ্বীনের আলোয় পালিয়ে যায়, তেমনি পালিয়ে যাবে কুচক্রী দল। ফেতনা ও ফ্যাসাদের মূল আমি ওপড়ে ফেলে দেবো নীল দরিয়ায়। পিড়ামিডের নিচে মাটি চাপা দেবো গাদ্দারদের। একটু অপেক্ষা করো, কটা দিল সময় দাও আমায়।’