» » ভয়াল রজনী

বর্ণাকার
🕮

পাগলটাকে আর আঘাত করলো না ওসমান। জুতা খুলে মসজিদের ভেতরে ঢুকল দু’জন। ক্রুশটা এখনও তার হাতে। ভেতরে গিয়ে বললো ‘তোমার নাম কি যুবক?’

‘ওসমান’।

‘আমি মুসলমান, তুমি কখন থেকে আমার পিছু নিয়েছো?’

‘সারা দিন তোমার পিছনে হেঁটেছি, কিন্তু সুযোগ হয়নি’।

‘আমাকে কেন মারতে চাইছো?’

‘কারণ আমি ইসলাম এবং সালাউদ্দীনের বিরুদ্ধে কোন কথা সহ্য করি না’। তুমি পাগল হও আর যেই হও আমি তোমাকে হত্যা করবো’।

‘কিন্তু আমাকে হত্যা করলে ইসলাম ও সালাহউদ্দীনের কি উপকার হবে?’

‘জানি না তবে ইসলাম ও সালাহউদ্দীনের একজন দুশমন কমবে’।

‘তুমি কি যে-ই  ইসলাম ও সালাহউদ্দীনের বিরোধীতা করবে তাকেই হত্যা করবে?’

‘অবশ্যই। সুযোগ পেলে আমি কাউকেই ছাড়বো না’।

‘তুমি কাকে ইসলামের বড় দুশমন মনে করো?’

‘অবশ্যই খৃষ্টানদের। তবে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত শক্তি এখনো আমার হয়নি। হলে তাদেরও আমি ছাড়বো না’।

‘ইসলাম ও সালাহউদ্দীনের বিরোধীতা করলে তাদের হত্যা করতে হবে এই বুদ্ধি তোমায় কে দিয়েছে?’

‘কেউ এ কাজ করতে আমাকে বলেনি। আমি নিজে থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি’।

‘তুমি কি একাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো, নাকি তোমার সাথে আরো কেউ আছে?’

‘আমি একাই’

আরো কয়েকটা প্রশ্ন করে পাগল লোকটা বললো, ‘তোমার মত একজন যুবকই আমার প্রয়োজন। তুমি নিজ থেকে এসেছো ভালই হয়েছে। ভেবেছিলাম এমন লোক পেতে আমার বেশ কষ্ট হবে’।

‘শোন, আমি সালাহুদ্দীনের একজন গোয়েন্দা। খৃষ্টানদের ধোকা দেয়ার জন্য পাগলের অভিনয় করছি। সফর করেছি এই পোষাকেই। তোমার সাথে কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শোন- মনে রেখ মসজিদে হঠাৎ কেউ এসে পড়লে আমি আগের মত আজেবাজে কথা শুরু করবো পাগিলরা যেমন করে আরকি’!

তুমি এমন ভাব করবে যেন আমার কথা মনযোগ দিয়ে শুনছো।

যা বলার আমি দ্রুত বলছি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মুসল্লীদের মধ্যেও ওদের গুপ্তচর থাকতে পারে, এজন্য নামাযের আগেই কথা শেষ করতে হবে’।

ওসমান কখনো গোয়েন্দা দেখেনি। ও জানতো না গোয়েন্দারা অসাধারন মেধবী হয়ে থাকে। ও অবাক হয়ে গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সামান্য কয়েকটা প্রশ্ন করেই গোয়েন্দা লোকটি যুবককে চিনে নিয়েছে। বুঝেছে এ যুবক যথেষ্ট হুশিয়ার, বিশস্ত এবং আবেগপ্রবণ।

‘শোন ওসমান তোমার মত আরো কয়েকজন যুবক ও যুবতী যোগাড় করো। তাদের মন্মানসিকতাও তোমার মত হতে হবে। তাদেরকে তোমার মতই হতে হবে সাবধান ও বিশ্বস্ত। তাদের মানসিকতা তৈরী হয়ে গেলে শুরু হবে তোমাদের আসল কাজ। তোমাদেরকে প্রতিটি মুসলমাওদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করতে হবে, সুলয়ান সালাহুদ্দীন বেচে আছেন এবং সুস্থ আছেন। তোমরা আরো প্রচার করবে, ক্রাক থেকে মাত্র কয়েক মাত্র কয়েক ঘণ্টার দুরত্বে অবস্থান করছেন তিনি। তার নেতৃত্বে ক্রাক আক্রমনের জন্য মুসলিম বাহিনী শুধু প্রস্তুতই নয়, ওরা খৃষ্টান বাহিনীর আহার নিদ্রা হারাম করে রেখেছে। কায়রোর পরিস্থিতিও এখন পুরপুরি শান্ত। ওখান থেকে সকল ষড়যন্ত্রের মূল উপড়ে ফেলা হয়েছে’।

ওসমানের বুকের ধুপধুপানি বেড়ে গেল। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বললো, আপনি ঠিক বলছেন?

‘ওসমান, তোমার আর আমার স্বপ্ন এক। আমি যে স্বপ্নের বাস্তবায়নে পরিকল্পিতভাবে কাজ করছি আর তুমি আবেগে ভেষে বেড়াচ্ছ। এখন আর এভাবে ভেসে বেড়ালে চলবে না। আজ থেকে তুমি ভাববে, তুমিও আইয়ুবীর একজন সৈনিক। শোন আমি যা বলছি তা ঠিকই বলছি’।

‘আপনি সালাহুদ্দীন আইয়ুবীকে দেখেছেন?

‘হ্যা যুবক উনি আমাকে এখেনে পাঠিয়েছেন। আমার দায়িত্ব হচ্ছে, উনি সছেন এই খবর এখানকার জনগনকে জানিয়ে দেয়া। তোমাকে দিয়েই এই কাজ শুরু হলো’।

‘সুলতান কখন আক্রমন করবেন? আমর তার পথ চেয়ে বসে আছি। আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি, তিনি বাইরে থেকে আক্রমন করলে আমরা ভেতর থেকে খৃষ্টানদের উপর ঝাপিয়ে পড়বো। আল্লাহর দোহাই লাগে, তাকে তাড়াতাড়ি আক্রমন করতে বলুন’।

‘বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করতে হবে যুবক। প্রথমে শোন সুলতান আইয়ুবী কি বলেছেন। এরপত প্রতিটি যুবকের হৃদয়ে তা গেঁথে দাও। সুলতান বলেছেন, ক্র্যাকের মুসলিম যুবকদের বলে দাও তোমরাই ইসলামের রক্ষক। আল্লাহর দ্বীনকে রক্ষা করতে হলে তোমাদের জিহাদের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। তুমি তাদেরকে আমার জীবনের কাহিনী শুনাবে’।

তিনি তার জীবন কাহিনী বলতে গিয়ে আরো বলেছেন, আমি প্রথম যুদ্ধ করেছি শৈশবে। একটি দুর্গে অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। নেতৃত্বে ছিলেম আমার চাচা। তিনি আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন ‘ভয় পেয়ো না। এখন ভয় পেলে ভয়ে ভয়ে কেটয়ে যাবে সারাটা জীবন। ইসলামের পতাকাবাহী হতে চাইলে এখনি পতাকা তুলে নাও। বেরিয়ে যাও দুশমনের ব্যুহ ভেদ করতে। আবার ফিরে এসো। ঝাপিয়ে পড় শত্রুর উপর’।

সেদিন আমি ভয় পাইনি। তিনমাস অবরুদ্ধ ছিলাম। না খেয়ে থেকেছি। শেষ পর্যন্ত শত্রুর অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছিলাম। অবরুদ্ধ অবস্থায় আমরা প্রথমে খেয়েছি শত্রুর থেকে ছিনিয়ে নেওয়া খাবার। দানা পানির অভাবে আমাদের যে সব ঘোড়া মরে গিয়েছিল তা পুরন করেছি শত্রুর ঘোড়া দিয়ে।

সুলতান আরো বলেছেন, আমার জাতির সন্তানদের বলবে, শত্রু আমাদের ভালবাসার অস্ত্র দিয়ে আক্রমন করেছে। যদিও এটা মোটেও ভাল্বাসা নয়ব্রং ভালবাসার নামে প্রতারনার ফাদ মাত্র।

ওরা জানে না প্রতারনা কি জিনিস, শুধু জানে ভালবাসার মিথ্যা অভিনয় করতে। মনে রেখ, কোন অমুসলিম মুসলমানের বন্ধু হতে পারে না।

খ্রীস্ট্রান শক্তি যুদ্ধের ময়দানে টিকতে পারে নি। ওদের সব পরিকল্পনা আমরা ধুলার সাথে মিশিয়ে দিয়েছি। ওরা এখন মুসলমান জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মের হৃদয় থেকে বের করে দিতে চাইছে ইসলামী জাতীয়তাবোধ।

সারা দুনিয়ার মুসলমান এক জাতি। এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। শত্রুরা এ ভ্রাত্বের বন্ধন ছিন্ন করার উস্কানী দিচ্ছে।

ওরা ধর্মের প্রতি প্রীতি ও ভালবাসার পরিবর্তে আমাদের কিশোর ও যুবকদের হৃদয়ে সৃষ্টি করতে চাচ্ছে পুঞ্জীভুত ঘৃনার পাহাড়। এ জন্য ওরা ব্যবহার করছে নানা রকম বিপজ্জনক অস্ত্র। ইসলামের কথা যারা বলে, ইসলামের পথে যারা চলে, তাদের ন্না অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। তাদেরকে গালি দেওয়া হচ্ছে মোল্লা, গোড়া, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এসব বলে। এভাবে আগামী প্রজন্মের মন বিষিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের ওপর।

মুসলিম যুবকদের বলবে, দুশমন আমাদের ওপর সর্বপ্লাবী হামলা শুরু করে দিয়েছে। সম্মুখ সমরের পাশাপাশি মানসিক চোরাগুপ্তা হামলা করছে। এর জন্য ব্যবহার করছে ভয়ংকর সব অস্ত্র। এ সব অস্ত্রের নাম হলো সম্পদের প্রতি মোহ, বিলাসিতা, আলস্য এবং দায়িত্বহীনতা।

এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য খ্রীস্টান এবং ইহুদী শক্তি সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। ইহুদীরা নিজেদের যুবতী মেয়েদেরকে লেলিয়ে দিয়েছে তোমাদের পেছনে। তারা তোমাদের পাশবিক শক্তিকে উসকে দিচ্ছে।

ওরা আমাদের যুবকদের হাতে তুলে দিচ্ছে নানা রকম নেশার দ্রব্য। সৃষ্টি করছে মাদকাশক্তি। কোন জাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য এ দুটো অভ্যাসই যথেষ্ট।

তুমি যুবকদের বলবে, পাপী মানুষের পরকালের জন্য নির্ধারিত রয়েছে নরকের কঠিন যন্ত্রণা। তুমি এ দুটো অভ্যাস পৃথিবীতেই তোমাদের জন্য নরক যন্ত্রণা নিয়ে আসবে। তোমরা যাকে আজ স্বর্গের আনন্দ ভাবছো, দু’দিন বাদে দেখবে তা আসলে জাহান্নামের শাস্তি।

এখনি সচেতন না হলে একদিন তোমরা হবে খ্রীস্টানদের গোলাম। ওরা তোমাদের বোনদের আব্রু নষ্ট করবে। শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকবে কোরানের ছেঁড়া পাতা, মসজিদ হবে ঘোড়ার আস্তাবল। চোখের সামনে তোমাদের বাড়িঘর জ্বলবে দাউ দাউ করে।

সুলতান আরো বলেছেন, মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে বেঁচে থাকতে চাইলে নিজের ঐতিহ্য কখনো ভুলে যেয়ো না। দুশমন একদিকে তোমাদেরকে উত্যক্ত করছে, অন্যদিকে সম্পদ আর নারীদের লোভ দেখাচ্ছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে,  মুসলমান কোন বিলাসপ্রিয় জাতি নয়। মুসলমান সম্পদের দাস হয় না, বরং সম্পদকেই তারা দাসে পরিনত করে। প্রয়োজন হলে খেজুর পাতার চাটাইতে বসে আমরা পৃথিবরী শাসন করতে পারি।

রোম ও পারস্যের সম্রাটদের সুবিশাল প্রাসাদ আর অতুলনীয় শানশওকত ও তৈজসপত্রের চেয়ে আমাদের কাছে বেশী প্রিয় তেজী ঘোড়া আর জং হীন তলোয়ার। আমাদের মূলধন কোরআন আর হাদীস, আমাদের আসল সম্পদ ঈমান আর আমল। সহায় আমাদের আল্লাহ। বিশ্বাস ও কর্মের দৃঢ়তাই আমাদের রক্ষাকবচ।

তুমি ওদেরকে বলবে, বিলাসদ্রব্য, সম্পদ আর নারী দেহের লোভ দেখিয়ে ওরা তোমাদেরকে গোলামীর শিকলে বাঁধতে চাইছে। তলোয়ারকে ভয় পেয়েই এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে ওরা।

হে আমার জাতির সন্তানেরা, নিজের হাতে নিজের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ো না।

হে আমার জাতির সন্তানেরা, নিজের হাতে নিজের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ো না। আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাও।

মনে রেখো, অত্যাচারী শাসক সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকে। প্রতিপক্ষকে জুলুম অথবা অর্থ দিয়ে পরাভূত করতে চায়। অত্যাচারকে ভয় পেয়ো না। পা দিও না লোভের ফাঁদে।

তোমরাই জাতির ভবিষ্যত। আমরা অতীত হয়ে গেছি। জাতির অস্তিত্ব এখন নির্ভর করছে তোমাদের হাতে। তোমরা সচেতন হলে জাতি বাঁচবে, তোমরা ঘুমিয়ে থাকলে জাতি মারা যাবে।

শত্রু তোমাদের মন-মানসিকতার সোনালী ঐতিহ্য অপবিত্র চিন্তা ধারার কালো নেকাবে ঢেকে দিতে চায়। ওরা চায় পৃথিবরীর বুক থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। এর মোকাবেলায় চাই অফুরন্ত সাহস আর হিম্মত।

তোমরা যদি সাহসের সাথে সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতে পারো বুকের ভেতর, আর প্রতিটি মুহুর্ত সে স্বপ্নকে বুকে নিয়ে নির্ভয়ে পথ চলতে পারো, দেখবে, প্রতিটি সূর্যোদয় তোমাদের জন্য সফল ও বিজয়ের বার্তা বয়ে আনবে।

তোমাদেরকে ভয় পায় বলেই এ কুটিল পথ বেছে নিয়েছে ওরা। শুরু করেছে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। মুমীন ঈমান বিকিয়ে দেয় না বলেই তো অস্ত্রের লড়াইতে নামতে হয় ওদের। কিন্তু যদি তোমাদের ঈমানী চেতনা নষ্ট করা যায় তবে আর অস্ত্রের লড়াইকে প্রয়োজন কি?

মনে রেখো, যে হৃদয়ে ঈমানের আগুন নেই সে দেহে ওদের আঘাত করারও প্রয়োজন নেই। কারণ, কোন দেহ কাঠামোর সাথে ওদের কোন বিরোধ নাই, ওদের বিরোধ তো বিশ্বাসের সাথে, ঈমানের সাথে, তাওহীদের সাথে।

তোমাদের হিরন্ময় বিশ্বাস ও চেতনার বিনাশ সাধনই ওদের একমাত্র টার্গেট। সে টার্গেটে পৌঁছার জন্যই ওদের এতসব সাংস্কৃতিক হামলা।

দুঃখের বিষয়, প্রাণে না মেরেও যে আমাদের হত্যা করা যায় এ কথা ওরা বুঝলেও আমরা সহজে বুঝতে চাই না। তাই মুসলমানদের মত জীবন যাপন করা করেও আমরা মুসলমান বলে দাবী করতে পারি নিজেদেরকে।

হে যুবক বন্ধুরা, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, ভবিষ্যতে ওদের প্রতিটি কাজের ওপর নিবদ্ধ রেখো তোমাদের সজাগ দৃষ্টি। তাহলেই দেখতে পাবে ওদের প্রতিটি কাজের পেছনে এক অন্তর্গুঢ় লক্ষ্য রয়েছে। আর সে লক্ষ্যটি হচ্ছে তোমাদের ইসলামী চেতনার বিনাশ সাধন করা, ধর্মীয় ভাবধারার প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করা। তোমরা যে মিশনারী জাতি, তোমাদের ওপর যে খেলাফতের কঠিন দায়িত্ব রয়েছে সে কথা তোমাদের ভুলিয়ে দেয়।

বেঈমানরা তোমাদেরকে কি অবস্থায় নিয়ে এসেছে তা তো আজ নিজেরাই দেখতে পাচ্ছো। হে আমার যুবক বন্ধুরা, তোমরা মানসিকভাবে ওদের গোলামীর নিগড়ে একবার বন্দী হলে সমগ্র মুসলিম জাতিরও একই পরিণতি হবে। কারণ, মুসলিম উম্মাহ আর কিছুই নয়, সে তো তোমাদের সমষ্টি মাত্র।

সময়ের এক চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে আজ তাই তোমাদের কাছেই আমি আকুল আহবান জানাচ্ছি, এসো, সংকীর্ণতা পরিহার করো। ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে বাঁচানোর কোন চিন্তা মনেও এনো না, সেটা হবে আত্মহত্যার শামিল। জোট বাঁধো, ঐক্যবদ্ধ হও, এক হয়ে রুখে দাঁড়াও শত্রুর বিরুদ্ধে’।

সুলতানের বাণী শোনানোর পর মুসলিম গোয়েন্দাটি এবার ওসমান সালেমকে তার কাজ ও কর্মপদ্ধতি কি হবে সে বিষয়ে বলতে লাগল।

‘আমাদের প্রধান সেনাপতি বলেছেন, আবেগ তাড়িত হয়ে কোন কাজ করো না। কেবল আবেগ দিয়ে সময়ের গতিকে রোধ করা যায় না। সব সময় খেয়াল রাখবে, আবেগ যেন দূরদর্শীতার উপর বিজয়ী না হয়।

কখনো এত্তজিত হবে না। সংযম এবং সতর্কতার সাথে কাজ করবে। এই সংযম ও সতর্কতাই বিজয়ের চাবিকাঠি।

আমার আরও দু’জন সঙ্গী বিভিন্ন রূপ নিয়ে তোমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে।

এবার শোন তোমার কাজ কি হবে। এ মুহুর্ত থেকে বিশ্বস্ত মুসলমানদের বাড়িতে গোপনে তীর, ধনুক এবং বর্শা তৈরী করে লুকিয়ে রাখবে।

যুবক, বৃদ্ধ, কিশোর সবাইকে অস্ত্রের ট্রেনিং নিতে হবে। তবে সাবধান, এ কাজ করতে হবে গোপনে। শত্রুরা যেন কোন মতেই তোমাদের প্রস্তুতির টের না পায়।

ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে নারীদেরকেও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেবে। জেহাদ কেবল পুরুষের জন্যই নয়, নারী পুরুষ সবার জন্য ফরজ।

ইহুদী মেয়েদের কথা যেন কেউ কানে না তোলে। তাদের কোনো কথা বিশ্বাস করবে না। ওরা মুসলমানদের মনোবল নষ্ট করার জন্য এবং জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য নানা কৌশলে নানা কথা প্রচার করবে।

সন্দেহ করতে পারে এমন কোন কথা ওদের সাথে বলবে না। কারও সাথে ঝগড়াঝাটি করবে না। ফালতু ঝগড়ায় জড়িয়ে নিজেদের শক্তি ও সময় অপচয় করবে না।

প্রথমে সঙ্গঠিত হয়ে একজনকে নেতা নির্বাচন করে নিও। প্রত্যেকের তৎপরতা নেতার নজরে থাকবে। তার অনুমতি ছাড়া কেউ কোনো পদক্ষেপ নেবে না। নেতা বানাবে এমন একজনকে, যে পরহেজগার, যে তোমাদের মধ্যে সবচে ত্যাগী, নির্লোভ আর বিচক্ষণ।

শত্রুর গতিবিধির ওপর ভালভাবে লক্ষ্য রাখবে। তুমি কি করছো সেটা বড় কথা নয়, শত্রু কি করছে সেটাই বড় কথা। কারণ শত্রুর ক্ষমতা ও শক্তি খর্ব করার ওপর নির্ভর করছে তোমার বিজয়।

প্রতিপক্ষ আগামীকাল কি পদক্ষেপ নেবে তা যদি তুমি আজ জানতে না পারো তবে তার আগামীকালের অগ্রযাত্রাকে কিছুতেই তুমি প্রতিহত করতে পারবে না। ফলে নিজে কি করছো তা যেমন তোমানের নখদর্পনে থাকবে ঠিক একই ভাবে শত্রুর প্রতিটি পদক্ষেপও তোমাদের নখদর্পনে থাকতে হবে’।

সূর্য ডুবো ডুবো। মসজিদের পেশ ইমামা এলেন। তাকে দেখে ক্রশ হাতে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল পাগলা। মসজিদের ভেতর তার কণ্ঠ ভেসে এল, ‘মুসলমান! ক্রুশের আশ্রয়ে এসো। তোমাদের ইসলাম মরে গেছে’।

ওসমানের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন বৃদ্ধ ইমাম।

‘এখানে কি করছিলে’ ঝাঝের সাথে ওসমানকে প্রশ্ন করলেন ইমাম।

‘ওকে ভেতরে বসিয়ে রেখেছিলে কেন? কেন তাকে শেষ করে দাওনি? তোমার দেহে কি মুসলিম পিতার রক্ত নেই? আমি বৃদ্ধ না হলে ওকে জীন নিয়ে পালিয়ে যেতে দিতাম না’।

‘ওকে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই আমি ওর পিছু নিয়েছিলাম’।

ইমামকে খঞ্জর দেখিয়ে বললো ওসমান। ‘আল্লাহর শোকর ও আমার আঘাত ক্রুশ দিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে। লোকটা পাগল নয়। ইহুদী বা খ্রিষ্টানও নয়। ও মুসলমান। সুলতান সালাহুদ্দীনের বাণী নিয়ে এসেছে’।

ইমামকে সুলতানের পয়গাম শুনিয়ে ওসমান বললো, ‘আমি এর বাস্তবায়ন করবো। আজ সন্ধ্যা থেকৈই নেমে পড়বো কাজে’।

একটু ভেবে নিয়ে ওসমান আবার বললো, ‘কিন্তু আমাদের একজন নেতা প্রয়োজন। আপনি কি আমাদের নেতৃত্ব দেবেন? ভেবে দেখুন! সরকার জানতে পারলে প্রথমেই নেতার মস্তক উড়িয়ে দেবে’।

‘আমি এ জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকব মসজিদে দাঁড়িয়ে এমন কথা কি বলতে পারি? তবে আমি নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য কি না সে ফয়সালা করবে জাতি’।

‘আমি মসজিদের এ পবিত্র অংগনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, আমার জীবন, সন্তান-সন্ততি এবং ধন-সম্পদ ইসলামের জন্য উৎসর্গ করে দেবো’।

সামান্য বিরতি নিয়ে তিনি আবেগের সাথে বললেন, ‘প্রিয় সন্তান, সালাহ উদ্দীন সালাহুদ্দীনের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কথা গভীরভাবে মনে গেঁথে নাও। তিনি ঠিকই বলেছেন, যুবকরাই হচ্ছে দ্বীন এবং জাতির ভবিষ্যত রক্ষক। ইচ্ছে করলে এর আশার আলো জ্বালাতে পারে আবার ইচ্ছে করলে সমাজকে আঁধারেও ঢেকে দিতে পারে’।

তিনি আরো বললেন, ‘কোন মুসলমান যুবক যখন কোনো ইহুদী বা খ্রিষ্টান যুবতীর দিকে তাকিয়ে থাকে তখন সে এ কথা ভাবে না যে, তার বোনও অন্যের কু দৃষ্টির শিকার হতে পারে।

প্রিয় যুবক! খোদার এই ঘরে দাঁড়িয়ে আজ এই মুহুর্ত থেকে প্রতিজ্ঞা করো, সালাহ উদ্দীনের পয়গাম কার্যকরী করার জন্য জীবনপণ চেষ্টা করবে’।

                                               

নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে গেল ওসমান। বাড়ি গিয়েই ছোট বোন আল নূরকে নিরালায় ডেকে নিল। তাকে শোনাল সুলতান সালাহুদ্দীনের বাণী।

বলল, ‘বোন! আমাদের দ্বীন এবং জাতি তোমার কাছে অনেক বড় ত্যাগের প্রত্যাশী। তুমি অন্তপুরবাসী নারী –আজ থেকে এ চিন্তা ছেড়ে দাও। মুসলিম নারীদের জেহাদের জন্য প্রস্তুত কর’।

ওসমান তাকে আরো বলল, ‘আমি তোমাকে খঞ্জর এবং তীর, ধনুক ও তলোয়ারের ব্যবহার শিখাবো। তবে কাজ করতে হবে খুব সাবধানে, কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে আমরা কি করছি’।

আজ নূর আবেগে ওসমানের হাত চেপে ধরল।

‘আমি যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ভাইয়া।

আমার বান্ধবীরাও দেশ এবং জাতির জন্য কি করা যায় সে ভাবনায় বেশ কিছুদিন যাবত অস্থির। আমরা তো এতকাল পুরুষের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, এবার ভাবছিলাম আমরাও কিছু করতে পারি কি না’।

ওসমান বললো, ‘সুলতান এবং মুসলিম বাহিনীর ব্যাপারে এতদিন আমরা যা শুনেছি সব মিথ্যা, সব গুজব। প্রতিটি মুসলমানের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের কানে সঠিক খবর পৌঁছে দিতে হবে। তবে মনে রেখো, মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট গাদ্দার এবং খ্রিষ্টানদের গোয়েন্দাও রয়েছে’।

কয়েকটা বাড়ির উল্লেখ করে ওসমান বললো, ‘আগে এসব বাড়ির মেয়েদের হাত করে নাও। এরপর সতর্কতার সাথে তাদেরকে বলো, তোমাদের পুরুষগুলি জাতির সাথে গাদ্দারী করছে। ওদের বলো, খ্রিষ্টান এবং ইহুদী মেয়েদের ভালবাসার অভিনয় নিরেট প্রতারণা মাত্র। এ হচ্ছে আমাদের জাতির বিরুদ্ধে এক ধরনের ফাঁদ’।

‘রিনিকে এখানে আসতে বারন করবো? তোমার সাথেও তো ওর সম্পর্ক রয়েছে’। বলল আল নুর।

‘ওকে যা বলার আমিই বলবো। তুমি কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেল

বে, শেষে আবার ঝামেলায় পড়ে যাই’।

‘ঠিকই বলেছেন, ও ভীষণ বুদ্ধিমতি এবং সতর্ক’।

‘ওকে কিছু বলার দরকার নাই, যা বলার আমি নিজেই বলবো’।

ওস্মান নিজের ঘর থেকে কাজ শুরু করে দিল।

রিনি একজন খৃস্ট্রান যুবতী।সুন্দরী। ওসমানদের বাড়ির অল্প দূরে ওদের বাড়ি। রিনির পিতা বর্তমানে এখানকার পুলিশ প্রধান। ওর পুরো নাম রিনি আলেকজেণ্ডার। রিনি আল নুরের বন্ধু। কিন্তু ওসমানকে দেখলে ওরচোখে মুখে আনন্দের দ্যুতি হেসে উঠতো। ওসমান এড়িয়ে চলতো তাকে।তার ধারনা খৃস্ট্রান মেয়েটা এখানে গোয়েন্দাগিরি করতে আসে। তবে ও যেন ওসমানকে সন্দেহ না করে করে এ জন্য কখনও কখনও তার সাথে হাসি ঠাট্টাও করতো।

ওসমান ভাবলো, এখন রিনিকে এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করা উচিত। ছোট বোনকে সামরিক ট্রেনিং দিতে হবে, রিনিকে তা জানানো যাবে না।

রিনিকে কিভাবে এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করবে এ নিয়ে ওসমান সারাদিন ভাবল। গভীর ভাবনা চিন্রাত পর একটা বুদ্ধি এল তার মাথায়।

পরদিন ওসমান আল নূরকে ডেকে বললো, ‘রিনি যখন আমাদের বাড়িতে আসে তখন তুমি তাকে কোন ছুতো দেখিয়ে বাইরে নিয়ে যেও। এভাবে কয়েকদিন এড়িয়ে চললে দেখবে একদিন ও নিজে থেকেই এখানে আসা বন্ধ করে দেবে’।