তকিউদ্দিন আগেবপ্রবণ হলেও বুদ্ধি বিবেক সবটাই গুলিয়ে ফেলেননি। তার মনে পড়ল সুলতান আইয়ুবীর নসিহত, ‘নিজেকে একজন বাদশাহ মনে করে কারও ওপর আদেশ চাপিয়ে দিও না। যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে নিজের ভুল গোপন করো না।’
তিনি কমান্ডারের রূঢ় আচরণে অপরাধ নিলেন না। বরং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সালাদের ডেকে পরামর্শে বসলেন। যুদ্ধের অবস্থা ও পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে খোলাখুলি আলোচনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো, যে কোন আকস্মিক হামলার যথাযথ জওয়াব দেয়া হবে। এ জন্য কমান্ডো বাহিনীকে মূল বাহিনী থেকে সরিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া হবে। তারাই মোকাবেলা করবে অতর্কিত আক্রমণের। রসদ আসার রাস্তা কমান্ডো বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া হবে। পুরো রাস্তায় টহল বসাবে কমান্ডো বাহিনী।
সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হবে। তিন দিক থেকে তারা আক্রমণ চালিয়ে যাবে শত্রুদের ওপর। তকিউদ্দিনের সাথে থাকবে রিজার্ভ বাহিনী। রিজার্ভ বাহিনীতে সৈন্য থাকবে খুবই কম।
এই বিভক্তি ও ব্যবস্থাপনায় উপকার হলো এই যে, সেনাবাহিনী দুর্গম ঊষর মরু এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার সুযোগ পেল। যে দুর্গম টিলা, পাহাড় ও বালির সমুদ্রে আটকা পড়ে পানির অভাবে মারা পড়ার অবস্থা হয়েছিল তাদের তীর থেক্র বাঁচার সম্ভাবনা উঁকি দিল এর ফলে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যার যার গ্রুপে শামিল হয়ে সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়ল মরুভূমিতে। শত্রুরা তিনটি দলের সাথেই মোকাবিলায় নামল এবং তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলল। মুজাহিদরাও শত্রুর সাথে তাল রেখে সুবিধাজনক অবস্থানের দিকে সরে যেতে লাগল।
কমান্ডো বাহিনী এবার নিজেদের ফর্মে চলে এল। তারাও বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে দুশমনের ওপর আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবী তাদের শিখিয়েছিলেন কেমন করে ঝটিকা হামলা চালাতে হয়। কেমন করে বিশাল বাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে মুহূর্তে সবকিছু তছনছ করে আবার ফিরে আসতে হয় নিরাপদ দূরত্বে। কমান্ডো বাহিনী এবার সেভাবেই আঘাত হানতে শুরু করল দুশমনদের ওপর। কিন্তু তারপরও স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিল, সুদানীদের বিশাল বাহিনীর সাথে এ যুদ্ধে সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
কারণ ইতিমধ্যেই মুজাহিদদের খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেনা সংখ্যাও নেহায়েতই অপ্রতুল। এ সময় বাইরে থেকে সেনা সাহায্য পাওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। বাধ্য হয়ে কমান্ডোরা রাতে আক্রমণ চালাতো আর খাদ্য ও পানীয় সংগ্রহ করে মুহূর্তেই সরে পড়তো সেখান থেকে। দুশমনদের বিনাশ করার চেয়ে তাদের দৃষ্টি থাকতো দুশমনদের খাদ্য ও রসদের দিকে। ফলে দুশমনকে ঘায়েল করার মত অবস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব হতো না তাদের পক্ষে। তারা যে খাদ্য ও পানীয় সংগ্রহ করতে পারতো তা পৌঁছে দিত অন্যান্য গ্রুপ ও সৈন্য দলে।
তকিউদ্দিনের আশংকা ক্রমেই সত্যে পরিণত হতে লাগল। কেন্দ্রীয় কমান্ড শেষ হয়ে গেল এরই মধ্যে। তকিউদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে ছুটে বেড়াতে লাগলেন এখান থেকে ওখানে। এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন, মুজাহিদরা তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে মরুভূমির বালুকারাশি শিক্ত করবে কিন্তু কোন একটি ক্ষুদ্র দলও শেষ পর্যন্ত আস্ত্র সমর্পণ করবে না।
লড়াই বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। মুজাহিদরা আরো ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গেল এবং লড়াই অব্যাহত রাখলো। ফলে সুদানের ব্যাপক এলাকায় এ খন্ড খন্ড লড়াই চলতেই থাকলো। কিন্তু কোন সেক্তর থেকেই এমন কোন সংবাদ এলো না, কোন সৈন্যদল অমুক জায়গায় অস্ত্র সমর্পণ করেছে।
মুজাহিদ বাহিনীর কমান্ডাররা নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকলো। নিয়মিত বাহিনীও এবার অতর্কিত আক্রমণের পথ ধরলো। সবারই অটুট সংকল্প, যে করেই হোক যতক্ষণ তারা বেঁচে থাকবে ততক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, কিন্তু কেউ সুদান ছেড়ে যাবে না বা আত্নসমর্পণ করবে না।
এ ধরণের আক্রমণের ফলে শত্রুদের সমূহ ক্ষতি হচ্ছিল। শেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে গেল যে, শত্রুরা মুসলিম সেনাদের সুদান থেকে বের করে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। মুসলিম সেন দল মরুভূমি, পাহাড়, জঙ্গল এমনকি লোকালয়েও ছড়িয়ে পড়লো। তবে বাহিনীর কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আর বজায় থাকল না। কোন গ্রুপ কোথায় কিভাবে আক্রান্ত হচ্ছে বা আঘাত হানছে অন্য গ্রুপ সে খবর জানতে পারছে না। বিশেষ করে তকিউদ্দিন যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে পুরোপুরি বেখবর হয়ে পড়লেন। তার কাছে এখন আর যুদ্ধের কোন সংবাদ আসছে না। সৈন্যদের জান-মালের ক্ষতির পরিমাণ কত, কত সৈন্য বেঁচে আছে এ ব্যাপারেও তিনি এখন আর কিছুই জানেন না। কিন্তু শত্রুদের পেরেশানি দেখে বুঝা যায়, তারা এখন মুজাহিদদের সামাল দিতে গিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে। তারা যে আর মিশর আক্রমণ করবে না তাদের অবস্থা দেখেই এ কথা বলে দেয়া যায়। কিন্তু এ পদ্ধতির যুদ্ধে কোন বড় ধরনের লাভের আশা করা সম্ভব না। কারণ, এভাবে কোন এলাকায় নিজেদের দখল কায়েম করা যায় না, অথচ যুদ্ধে সৈন্য সংখ্যা ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যায়।
এই অবস্থায় এসেই তকিউদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর কাছে জরুরী খবর পাঠানোর তাগিদ অনুভব করেন। ফলে একজন কমান্ডারকে সবকিছু বুঝিয়ে সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
কমান্ডার সুলতানকে বললো, ‘সুদানে সফলতা তখনি সম্ভব যখন ওখানে সেনা সাহায্য পাঠানো যাবে। ওখানকার সমস্ত সৈন্যই এখন পরষ্পর বিচ্ছিন্ন। সবাই কমান্ডো স্টাইলে লড়াই চালিয়ে গেলেও সম্মিলিত বাহিনী হিসাবে তাদের এখন একত্রিত করা সম্ভব নয়। বিক্ষিপ্ত এ বাহিনীকে রক্ষা করতে হলে অনতিবিলম্বে ওখানে একটি সেনাদল পাঠানো প্রয়োজন।’
কমান্ডার সুলতান আইয়ুবীকে আরো জানালো, ‘তকিউদ্দিন এ কথাও জেনে যেতে বলেছেন, যদি সেনা সাহায্য পাওয়া সম্ভব না হয় তবে কি তিনি এই বিচ্ছিন্ন বাহিনীকে মিশরে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন?’
মিশরে যে সৈন্য ছিল সে সৈন্য দ্বারা মিশরের অভ্যন্তরীণ ও বর্ডার নিয়ন্ত্রনই যথেষ্ট নয়। ফলে সেখান থেকে সৈন্যদের সমর সেক্টরে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আবার সুলতান আইয়ুবী সৈন্যদের পিছু হটারও সমর্থক নন। ফলে তাঁর জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে গেল যে, তিনি তাঁর ভাইকে পিছু হঠার আদেশ দেবেন্ম না দেবেন না। যেখানে এখন তাঁর নিজেরই সেনা সাহায্য প্রয়োজন সেখানে তিনি কিছুতেই তাঁর ভাইকে সেয়া সাহায্য দিতে পারেন না। আর যদি তাই হয় তাহলে তাদের পিছু হটার আদেশ দেয়া ছাড়া এ মুহূর্তে তিনি আর কি করতে পারনে? বাস্তবতা বলছে, মুজাহিদ কখনো ময়দানে পিঠ দেখাতে পারে না, এমন হুকুম তিনি কিছুতেই দিতে পারেন না। তিনি গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন।
তকিউদ্দিনের কাসেদ সুলতান আইয়ুবীর কাছে যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলো। কিন্তু সেখানে যে এরই মধ্যে গুপ্ত হত্যা শুরু হয়ে গেছে সে কথা তার জানা ছিল না, ফলে এ ব্যাপারে সে সুলতানকে কিছুই বলতেও পারেনি। এসব কথা আরো অনেক পড়ে সুলতানের গোচরে আসে।
তকিউদ্দিনের বাহিনী তখন বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। কোথাও এক জায়গায় সুস্থির হয়ে বসে না থেকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল ওরা। কখনো তাদের সামনে পড়তো যাযাবরদের ঝুঁপড়ি ও তাবু। কোথাও সবুজ শ্যামল মাঠ ও শস্য ক্ষেত। তবে অধিকংশ এলাকাই ছিল অনুর্বর, জনবসতিহীন এবং নিরেট মরুময় অঞ্চল।
এক সন্ধ্যায় মুজাহিদ বাহিনীর তিনজন কমান্ডো তাদের এক সিনিয়ির অফিসারের কাছে ফিরে এলো। তাদের মধ্যে দুজন আহত। তারা বললো, ‘একুশজন মুজাহিদ ও একজন কমান্ডার নিয়ে মোট বাইশজনের একটি দল ছিল ওদের। দিনের বেলা দলটি এক জায়গায় লুকিয়ে ছিল। দলের কমান্ডার পাহারা দেয়ার ছলে এদিকে ওদিক টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল।
এক সুদানী উষ্ট্রারোহী সেখান দিয়ে যাবার সময় কমান্ডারকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কমান্ডার তার কাছে গেলে তারা পরস্পর কথা বলল। কিন্তু দলে থেকে অনেক দূরে থাকায় তারা কি কথা বলেছে জানা গেল না। উষ্ট্রারোহী চলে গেলে দলের কমান্ডার এসে সুসংবাদ দিলো, দুই মাইল উত্তরে নাকি একটি গ্রাম আছে, সেখানে শুধু মুসলমানরাই বসবাস করে। উটের আরোহী সে গ্রামেরই বাসিন্দা। তিনি আমাদের সবাইকে তাদের গ্রামে দাওয়াত করেছেন। বলেছেন, গ্রামের কাছেই নাকি দুশমনের একটি ঘাঁটি আছে। আমরা গেলে শত্রুর সে ঘাঁটি নাকি তারা চিনিয়ে দেবে। আমি তার দাওয়াত কবুল করেছি।’
‘তাহলে তো ভালই। পেটও ভরবে হাতও লড়বে।’
‘হ্যাঁ, রাতে গ্রামবাসী সবাইকে মেহমানদারী করার পর অভিযানের সময় যুবকরা নাকি আমাদের সঙ্গ দিতেও রাজি হবে।’
মুজাহিদরা সকলেই খুব খুশি হলো এই ভেবে যে, সেখানে খাওয়া-দাওয়া, আদর-আপ্যায়ন ছাড়াও শত্রুদের ওপরে আক্রমণের সুযোগও থাকবে।
সূর্য ডোবার সাথে সাথেই তারা সেই গ্রামের দিকে রওনা হলো। সেখানে দিয়ে দেখতে পেল শুধু তিনটি যাযাবার ঝুঁপড়ি। ঝুঁপড়ির আশেপাশে গাছপালা ও পানির ব্যবস্থাও আছে। সৈন্যদেরকে ঝুঁপড়ির বাইতে তাবু টানাতে বলা হলো।
সুদানী লোকটি কমান্ডারকে একটি ঝুঁপড়ির মধ্যে নিয়ে গেল। বাইরে মশাল জ্বালিয়ে দেয়া হলো এবং সকলকে বেশ আদর আপ্যায়ন করেই খাওয়ানো হলো। দলের কমান্ডার বললো, ‘তোমরা সবাই শুয়ে পড়ো। যখন আক্রমণের সময় হবে তখন তোমাদের জাগিয়ে দেয়া হবে।’
ক্লান্ত সৈনিকরা শুয়ে পড়লো। এই আগত তিনজনের মধ্যে একজনে তখনও ঘুম আসেনি, হঠাৎ পাশের ঝুঁপড়ির মধ্যে নারী কণ্ঠের হাসির ঝংকার শুনতে পেয়ে সে উঠে বসলো। উঁকি মেরে দেখলো, তাদের কমান্ডার সুন্দরী দুই নারীর সাথে হাসাহাসি করছে আর শরাব পান করছে। মেয়েরা যাযাবরদের পোশাক পড়ে থাকলেও স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিল, তারা যাযাবর কন্যা নয়।
এ সময় সৈনিকটির কানে ভেসে এল দূর থেকে লোকজনের কথা বলার অনুচ্চ শব্দ। সেদিকে তাকাতেই চাঁদের আলোতে সে দেখতে পেল, মরুভূমির ঠাণ্ডা বালি মাড়িয়ে কিছু লোক বর্শা ও তলোয়ার হাতে এদিকেই আসছে। একবার ভাবলো অভিযানে অংশ নেয়ার জন্য আসছে ওরা, তারপরই তার মনে কেন যেন সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সে ঝুঁপড়ির পিছনে গাছের ছায়ায় অন্ধকারে দিয়ে লুকিয়ে পড়লো। দেখতে দেখতে লোকগুলো ঝুঁপড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো।
যে ঝুঁপড়িরতে কমান্ডার মদপান করছিল তার থেকে একটু দূরে আরেকটা ঝুঁপড়িতে ঢুকল একজন লোক। ওখানে কি হচ্ছে দেখার কৌতূহল জাগলো লুকিয়ে থাকা সৈনিকটির মনে, সে গাছের ছায়ার আড়াল নিয়ে অন্ধকারে সন্তর্পনে তার কাছে গিয়ে বেড়ার ফুটোতে চোখ রাখল।
দেখল, লোকটা ঘরে ঢুকেই সেই সুদানীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সুদানী বললো, ‘তোমরা এসে পড়েছো?’ ভালই হল, সবাই ঘুমিয়ে আছে। যাও, শেষ করে দাও সব কজনকে।’
কমান্ডারের ঘর থেকে মেয়েদের হাসির ফোয়ারা ছুটছে যেন। রিনিঝিনি চুড়ির আওয়াজ ও হাসির কলাকাকলিতে মনে হয় ওখানে উৎসব জমে উঠেছে। মেয়েদের হাসির সাথে কমান্ডারের হাসিও বেরিয়ে আসছে বাইরে
লোকটি বেরিয়ে এল বাইরে। সঙ্গীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘুমন্ত মুজাহিদদের ওপর। কেউ কেউ ঘুমন্ত অবস্থায়ই ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। কেউ হয়তো হাঙ্গামা শুনে জেগে উঠে বিস্ময়বিস্ফারিত চোখ মেলে রেখেই পাড়ি জমাল পরপারে। যারা এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারল, মুহূর্তেই তারা তলোয়ার বের করে প্রতিহত করল আততায়ীদের আঘাত। পুরো ঘতনাটি ঘটে গেল যেন চোখের পলকে। সৈনিকটি তার সঙ্গীদের সতর্ক করারও সময় পেল না।
ঘটনার আকস্মিকতায় সৈনিকটি সম্বিত হারিয়ে ফেলেছিল। তলোয়ারের ঠোকাঠুকি, আহতদের চিৎকার ও আততায়ীদের অট্টহাসি শোনা ছাড়া সে এখন কি করবে কিছুই ঠিক করতে পারছিল না। হঠাৎ দেখল, দুজন আহত মুজাহিদ তাবু থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে পালিয়ে যাবার জন্য ভো-দৌড় লাগিয়েছে একদিকে। সম্বিত ফিরে এল তার। সেও ছুটলো তাদের পিছু পিছু। যখন সে তাদের সাথে মিলিত হলো ততক্ষণে তারা অনেক দূরে চলে এসেছে। ও দেখল, সঙ্গীরা দু’জনই আহত, তবে কেউ তাদের অনুসরণ করছে না দেখে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।
অফিসারের এক প্রশ্নের জবাবে সে আরো বললো, ‘কমান্ডার উটের আরোহীর দেয়া লোভ লালসায় পড়ে গিয়েছিল, নাকি সে আগে থেকেই শত্রুদের এজেন্ট ছিল এবং নিজের বাহিনীকে ধংস করার সুযোগ খুঁজছিল এ ব্যাপারে আমার কোন ধারনা নেই।’
অফিসার বুঝল, ঘটনা যা-ই হোক, শত্রুরা যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সৈন্যদেরকে নির্মূল করতে বাঁকা পথ ধরেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। সম্মুখ লড়াই রূপান্তরিত হয়েছিল চোরাগুপ্তা হামলায়, এবার সে হামলা রূপান্তরিত হলো কুটিল সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্রে। এ লড়াইয়ের অস্ত্র এখন মেয়ে আর মদ। মুজাহিদ তীর, তলোয়ার আর বর্শার আঘাত মোকাবেলা করতে পারে, কিন্তু মেয়ে আর মদের মোকাবেলা করবে কি দিয়ে?
এ বড় কঠিন যুদ্ধ। সুলতান আইয়ুবী এ লড়াই সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাই তার বাহিনীতে অস্ত্র প্রশিক্ষণের সাথে সাথে নৈতিকতারও প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। কিন্তু ক্ষুধা সহ্য করা বড় কঠিন কাজ। পেটের খিদে আর দেহের খিদে বার বার মানুষকে আক্রমণ করে। শত্রুরা মানুষের এই প্রাকৃতিক দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে শুরু করেছে। সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করছে পাশবিক ক্ষুধা উস্কে দেয়ার কাজে। মুজাহিদদেরকে তারা প্রাণে না মেরে ঈমানে মারার ফন্দি এঁটেছে। এ ভয়ংকর যুদ্ধে আত্নরক্ষার একমাত্র অস্ত্র শাণিত ঈমান। ইমানের বর্মে দেহকে আবৃত করতে না পারলে এর থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। কোন অফিসার যাতে এ বর্ম দেহ থেকে খুলে রাখতে না পারে সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন সুলতান।
অফিসার ভাবলেন, আমাদেরও এবার এদিকে নজর দেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ এরই মধ্যে এ ধরনের আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথম ঘটনাটি শোনার পর সালার এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করেছিলেন। কিন্তু একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকাই প্রমাণ করে এসব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আতাউল হাশেমের ঘটনাটিও তেমনি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।
আতাউল হাশেম কমান্ডো গ্রুপের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন। সেদিন তিনি এক জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তার বাহিনী কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে আরাম করছিল। এ রাস্তাটিই মিশর থেকে রসদ নিয়ে আসার রাস্তা। রসদ নিয়ে আসার পথের নিরাপত্তা বিধানের জন্য নিয়োজিত করা হয়েছিল ওদের। ইতিমধ্যে কয়েকবারই রসদবাহী দলের ওপর চোরাগুপ্তা হামলা হয়েছে। তাদের নিরাপত্তা বিধান করাই ছিল দলটির কাজ।
রসদ বহনকারী দলের ওপর শত্রুরা হামলা করলে তাঁর জানবাজ কর্মীরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করতো তাদের। সুদানীরা অনেক চেষ্টা করেও এই কমান্ডোদের নিঃশেষ করতে পারেনি। বর্তমানে আতাউল হাশেমের নেতৃত্বে একশোর কিছু কম কমান্ডো কাজ করছে। রাস্তার একটি দীর্ঘ এলাকায় তারা টহল দেয়ারও ব্যবস্থা নিয়েছে।
আতাউল হাশেম রাস্তা থেকে একটু দূরে টিলার মধ্যে এক গোপন আস্তানা গেড়েছিলেন। আস্তানার বাইরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। সঙ্গে তাঁর ছয় সাতজন জানবাজ সৈনিক। আস্তানাটিকে তিনি আঞ্চলিক ফাঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করছিলেন।
রাস্তা দিয়ে যাযাবর পোষাকে দুইটি মেয়ে ও একজন মধ্যবয়সী লোককে যেতে দেখলেন ওরা। ওরাও দেখল তাদের। কি মনে করে মেয়ে দুজন ও লোকটি আতাউল হাশেমের কাছে এগিয়ে এলো। মেয়ে দুটি সুদানী মনে হলেও তাদের পরণে ছিল বিচিত্র পোশাক। তাদের চেহারায় ধুলাবালি লেগেছিল। মুখ ছিল মলিন ও উদাস। তাদের খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। মধ্য বয়সী লোকটির পিছনে মেয়ে দু’টি এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল, যেন পর-পুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে বলে তারা লজ্জায় মরে যাচ্ছে।
লোকটি কিছু মিশরীয় কিছু সুদানী ভাষায় জগাখিচুড়ি পাকিয়ে কথা বললো। জানালো, তারা মুসলমান। মেয়ে দুটি তার কন্যা। পথে ডাকাতের কবলে পড়ে সবকিছু খোয়া গেছে তাদের। এখন ক্ষুধা তৃষ্ণায় তারা এতটাই কাহিল যা বলার মত নয়। লোকটি বললো, ‘বাপ হয়ে সন্তানের কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। জীবনে কোনদিন কারো কাছে হাত পাততে হবে এ কথা কখনো কল্পনাও করিনি। আমি আমার জন্য কিছুই চাই না, শুধু এই কচি মেয়ে দুটোকে যদি কিছু খেতে দেন তবে সারা জীবন আপনার জন্য দোয়া করবো।’
আতাউল হাশেম সুদানী ভাষা জানতেন। কারণ তিনি কমান্ডো দলের লিডার। সুদানী অঞ্চলে কমান্ডারের দায়িত্ব সফলভাবে পালনের জন্য তাকে সুদানী ভাষা শিখতে হয়েছিল। তার কাছে খাবারের কোন অভাব ছিল না। এরই মধ্যে মিশর থেকে দু’তিনবার রসদ আমদানী হয়েছে। তিনি তার অংশের সৈন্যদের রেশন এ আস্তানায়ই মজুদ রেখেছিলেন।
আতাউল হাশেম ওদের তিনজনকেই আস্তানার ভেতর নিয়ে গেলেন এবং খেতে দিলেন। খাওয়া শেষ হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?’
লোকটি একটি গ্রামের নাম উল্লেখ করে বললো, ‘গ্রামটির এখন খুবই দুরাবস্থা। কখনও সুদানীরা এসে চড়াও হয়, কখনও মুসলমানরা। উভয় পক্ষেরই ঘরের খাবার জিনিসের ওপর প্রচণ্ড লোভ।’
লোকটি আরো বলল, ‘একে তো যুদ্ধাবস্থা, হুটহাট সেনাবাহিনী চড়াও হয় গ্রামে। ঘরে যুবতী মেয়ে, কখন কি অঘটন ঘটে যায় এই ভয়ে সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হতো। মেয়েদের লুকিয়ে রাখতে রাখতে শেষে বিরক্তি ধরে গেল। অবশেষে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কন্যা দুটিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। বাপের কাছে মেয়েদের মানসম্ভ্রমই বড় কথা।’
‘তা, এখন কোথায় যাবেন আপনারা?’
‘ভেবেছিলাম মিশরে চলে যাবো। সুদানে মুসলমানদের জা-মাল, ইজ্জত-আব্রু মোটেই নিরাপদ নয়। কিন্তু যুদ্ধের যা অবস্থা, এখন তো দেখছি পথ চলাও নিরাপদ নয়।’
‘জ্বি, আপনি ঠিকই বলেছেন। যুদ্ধের সময় বাড়ি বা পথ কোন জায়গাই নিরাপদ থাকে না।’
‘বাবা, তুমি আমার ছেলের মত। মা মরা মেয়ে দুটোকে নিয়ে আমি যে কি পেরেশানীর মধ্যে আছি সে কথা তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না। তুমি একজন মুজাহিদ, মুসলমানের জা-নাল, ইজ্জত-আব্রু রক্ষক। আমরা তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তুমি কি আমাদের মিশর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার কোন ব্যবস্থা করতে পারবে?’
‘দেখুন, এখন আমরা যুদ্ধের ময়দানে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো আমাদের পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব নয়। তবে কয়েকদিন পরপর আমাদের কাছে রসদ আসে। আপনারা চাইলে তাদের সাথে আপনাদেরকে পাঠিয়ে দিতে পারি।’
লোকটির চোখ আশায় চকচক করে উঠল। যেন ডুবন্ত তীর তীরের নাগাল পেল। চোখে-মুখে সীমাহীন প্রত্যাশা নিয়ে জানতে চাইল, ‘সত্যি পারবে বাবা! যাক, আল্লাহর হাজার শোকর। তিনি আমাদেরকে এই মুসীবত থেকে বাঁচানোর জন্য তোমাকে উসিলা হিসেবে পাঠিয়েছেন। তা বাবা, ওরা আবার কবে নাগাদ আসবে?’
‘এসে যাবে কয়েক দিনের মধ্যে।’ আতাউল হাশেমের নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর।
‘কিন্তু বাবা, এ কয়দিন আমরা কোথায় থাকবো? হায় আল্লাহ, দুটি তরতাজা যুবতী নিয়ে এখন আমি কোথায় যাই!’
‘আপনি অস্থির হবেন না। যতদিন ওরা না আসবে ততদিন আপনাদের জিম্মাদার আমি। আপনারা আমাদের সাথেই থাকবেন।’ আতাউল হাশেম বললেন।
লোকটি বলল, ‘বুঝতে পারছি, যুদ্ধের মধ্যে আমি তোমাকে বেশ বিপদের মধ্যেই ফেলে দিলাম। তারচে এক কাজ করি, ডাকাতের পাল্লায় পড়ে সবকিছু তো আমি খুইয়ে ফেলেছি। আমি না হয় বাড়ি গিয়ে কিছু হাত খরচ নিয়ে আসি। মিশর গিয়ে কিছু করতে হলেও তো টাকা পয়সা দরকার। ওরা থাক তোমার হেফাজতে, আমি দু’তিন দিনের মধ্যেই ফিরে আসবো।’
মেয়েরা কেঁদে উঠল, ‘না বাবা, আমাদের একা ফেল তুমি যেও না।’
‘ধূর পাগলী! একা কোথায়? উনি আছেন না! এরা মুজাহিদ, তোদের ভাই। ভাইয়ের কাছে বোনের থাকতে সংকোচ কিসের? আর আমি তো দু’তিন দিনের মধ্যেই ফিরে আসছি।’
‘হ্যাঁ বোন, এখানে ইনশাআল্লাহ তোমাদের কোন বিপদ হবে না।’
লোকটি বলল, ‘ঠিক আছে, পথে নামার আগে তাহলে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিএ, তোমরা কথা বলো।’ লোকটি বিদায় নিয়ে ওখান থেকে চলে এল।
মেয়ে দুটি ভয়ে ভয়ে চাইল আতাউল হাশেমের দিকে। একজন বললো, ‘ভাই, আমি কিন্তু আমাদের বলেছেন এখানে আমাদের কোন বিপদ নেই, কিন্তু আপনরাই তো মহাবিপদে জড়িয়ে আছেন।’
‘সৈনিকের কাছে যুদ্ধ কোন বিপদ নয়, এটা তার স্বাভাবিক কাজ। যুদ্ধ দেখে ভয় পেলে কি মুজাহিদ হওয়া যায়?’
‘কিন্তু আমার মনে হয় আপনাদের এই জীবন বড় ভয়ংকর। সারাক্ষণ হয় ভাবেন কখন কাকে কিভাবে মারবেন, নইলে ভাবেন কখন কে মেরে বসে। কি, ঠিক বলিনি আমি?’
‘কি যে বলো! মৃত্যু নিয়ে আমরা মোটেও ভাবি না। মানুষ তো জন্মগ্রহণই করে মরার জন্য। মানব জীবনে মৃত্যুর চাইতে সহজ সত্য আর কি আছে! মরণ অবধারিত, আমরা চাই সে মরণ সুন্দর ও মহান করতে। জেহাদের ময়দানে গাজী হতে পারা গৌরবের আর মৃত্যুবরণ করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই ও নিয়ে আমাদের কোন দুশ্চিন্তা নেই।’
একটি মেয়ে শিশুর মত সরল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘তাহলে আপনারা কি ভাবেন? বাড়ির কথা, স্ত্রি-সন্তানদের কথা?’
‘না, সব সময় তাও ভাবি না। যখন সময় পাই তখন আমরা মনে মনে কি করে দুশমনের মোকাবেলা করবো, কি করে বিজয় ছিনিয়ে আনবো এইসব ভাবি।’
‘তার মানে বাড়ির কথা, আপনজনদের কথা আপনাদের মনে পড়ে না?’
‘তা মনে পড়ে বৈকি!’ আতাউল হাশেম বললেন, ‘কিন্তু আমি আমার ফরজ দায়িত্বের কথা কখনো ভুলে যাই না।’
কথা বলতে বলতে পরিবেশ কেমন সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠল। মেয়েদের মধ্যে যে সংকোচ ও জড়তা ছিল আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল সে সব। মনে হলো পেটে দানাপানি পড়ায় তাদের শরীরেও ফিরে এসেছে নতুন শক্তি, নতুন প্রাণ। সৈনিক জীবনের অজানা কথা আজানার কৌতূহল যেন তাদের চলচঞ্চল ও চপল করে তুলল। কথার পিঠে কথা জুড়ে দিল ওরা, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করল। একজন থামলে অন্যজন মুখ খোলে। এ ভাবেই এগিয়ে চলল তাদের আলাপচারিতা।
তাদের উচ্ছল কৌতূহল আর প্রশ্নের পর প্রশ্নে আতাউল হাশেম তার নিজের ও সঙ্গীদের জীবনের অনেক করুণ কথা তুলে ধরল তাদের কাছে। স্মৃতির পাতা হাতড়ে সে সব কথা তুলে আনতে গিয়ে কখন যে হারিয়ে গেল অতীতের বুকে, ভেসে গেল আবেগের বন্যায়, আতাউল হাশেম তা টেরি পেল না।
মেয়েরা ভাবল, এটাই সময়, এ আবেগের স্রোতে ফেলেই তাকে নিয়ে যেতে হবে অজানা বন্দরে। তাই তারা আসল জায়গায় ঘা দিল, বললো, ‘আপনারা দেশ ছেড়ে এত দূর এসে কেন নিজের জীবন নষ্ট করছেন?’
‘কি বললে! জীবন নষ্ট করছি?’ বিস্মিত আতাউল হাশেম।
‘তা নয়তো কি! জেনে শুনে মৃত্যুর কোলে ঝাঁপ দেয়ার বোকামী কেন করছেন আপনারা আমার বুঝে আসে না।’
হঠাৎ ঘোর কেটে গেল আতাউল হাশেমের। রাগে জ্বলে উঠল সর্ব অঙ্গ। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ডাকলেন সাথীদের। বললেন, ‘এই মেয়ে দুটো এবং এদের নিয়ে আসা লোকটির পা রশি দিয়ে বেঁধে আমার ঘোড়ার পিছনে বেঁধে দাও।’
সঙ্গীরা সাথে সাহতে হুকুম তামিল করল। তাদের মাটিতে ফেলে দিয়ে পা শক্ত করে বেঁধে ঘোড়া নিয়ে এলো। রশির এক প্রান্ত ঘোড়ার জ্বিনের সাথে শক্ত করে বাঁধতেই আতাউল হাশেম এক সৈন্যকে বললেন, ‘ঘোড়ায় আরোহন করো।’
সে সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ায় আরোহন করলো।
আতাউল হাশেম মেয়ে দু’টিকে দাঁড় করালনে। দুই তীরন্দাজকে বললেন, ‘আমার ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র মেয়ে দুটির চোখের মাঝে একটি করে তীর বিদ্ধ করবে আর ঘোড়ার আরোহী সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে দিবে।’
ঘোড়ায় বাঁধা লোকটির ব্যাপারে তিনি কিছু বললেন না। লোকটি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছিল। সে তখন ভাবছিলো, ঘোড়া যখন দৌড়াবে তখন মেয়েদের সামনে কি কেয়ামতই না নেমে আসবে!
তীরন্দাজরা তাদের ধনুক তীর জুড়ল, আরোহীরা লাগাম টেনে ধরলো।
আতাউল হাশেম সুদানী মেয়ে দুটি ও লোকটিকে বললেন, ‘আমি তোমাদের তিনজনকে মাত্র একবারই বলবো, তোমাদের আসল পরিচয় দাও। যে উদ্দেশ্যে এসেছো পরিষ্কার করে বলো, নতুবা তোমাদের শেষ পরিণামের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও।’
সবাই নীরব হয়ে গেল। মেয়েরা তাদের সঙ্গী লোকটিকে দেখলো। সেও নীরব। তারা চোখে চোখে কিছু একটা পরামর্শ করে নিল। সুদানী লোকটি মনে মনে বললো, ‘এ বেটা তো বড় হুশিয়ার। মেয়েরা কি শেষ পর্যন্ত এর সামনে টিকতে পারবে?’
আতাউল হাশেম লোকটির পাশে বসে পড়ে বললেন, ‘যদি তুমি সত্য কথা বলো তবে তোমার বাঁধন খুলে দেয়া হবে।’
লোকটি চুপ করে থাকলো। আতাউল হাশেম একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। লোকটি তবু চুপ। এবার ক্ষেপে গেলেন আতাউল হাশেম। বললেন, ‘শেষ বারের মত বলছি, তুমি কি মুখ খুলবে?’
মুখ খুলল লোকটি। এতক্ষণের গোবেচারা ভাবটি উধাও হয়ে গেছে তার চেহারা থেকে। সেখানে ক্ষোভ ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।
‘তুমি কি মানুষ না পাথর! তোমার কাছে আমি এমন মেয়ে নিয়ে এলাম, যাদের দেখলে ঋষির ধ্যান ভেঙে যায় আত তুমি তাদেরকে তীরের নিশানা বানাচ্ছো? আমার পরামর্শ শোন, তাদেরকে তোমার কাছে রেখে দাও আর সৈন্যদল নিয়ে এখান থেকে চলে যাও। যদি এ প্রস্তাব তোমার মনপূত না হয় তাহলে বলো, আমাদের মুক্তির বিনিময়ে তুমি কি চাও? যদি সোনা চাও তাহলে বলো তার ওজন কত, আর যদি অন্য কিছু চাও তাহলে তাও বলো। সন্ধ্যার আগেই তোমার সব দাবী পূরণ করা হবে।’
আতাউল হাশেম উঠে দাঁড়ালেন। ঘোড় সওয়ারকে বললেন, ‘ঘোড়া নিয়ে দুলকি চালে পনেরো বিশ কদম এগিয়ে যাও।’
ঘোড়া কয়েক কদম এগুতেই লোকটি ছটফট করে উঠলো। পনেরো বিশ কদম যাওয়ার পর আতাউল হাশেম বললেন, ‘থামো।’
ঘোড়া থামালো সহিস। আতাউল হাশেম এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এখনও সঠিক কথা বলো।’
অবশেষে সব স্বীকার করলো সে। বলল, সে সুদানী গোয়েন্দা সদস্য। খৃস্টানরা তাকে ট্রেনিং দিয়েছে। মেয়ে দুটি জন্মগতভাবে মিশরী। তাদেরকেও খৃস্টানরা সব ধরনের অপকর্ম ও ধ্বংসাত্মক কাজের ট্রেনিং দিয়েই এখানে পাঠিয়েছে।
আতাউল হাশেম তার বাঁধন খুলে দেয়ার হুকুম দিলেন। বাঁধন মুক্ত হওয়ার পর তাকে নিজের পাশে বসিয়ে নরম সুরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। বললেন, ‘আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে চাই না। তুমি যে জবানবন্দী দিয়েছো তোমাকে যে কোন কঠিন শাস্তি দেয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। এখন সব কথা খোলাখুলি ও সত্য বললে তুমি আমার দয়ার আশা করতে পারো। মনে রেখো, সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার মত ট্রেনিং আমারও আছে।’
‘জনাব, সুদানে ছড়িয়ে পড়া মুসলিম বাহিনীর কম্যান্ডারদের বশীভূত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে।’ লোকটি বললো, ‘এই কাজে চোখ ধাঁধানো সুন্দরী নারী এবং যত খুশি সোনা রূপা ব্যয় করার অনুমতি আছে আমার। এসব নারী ও অর্থ দিয়ে আমাদের প্রথম চেষ্টা তাহকবে আপনাদেরকে আমাদের দলে ভেড়ানো। এতে ব্যর্থ হলে আমাদের ওপর নির্দেশ আপনাদের বন্দী করার। আর যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলে আপনাদের হত্যা এবং শেষ করে দেয়ার হুকুম আছে আমাদের ওপর।’
‘যারা নিয়মিত যুদ্ধ করছে তাদের পিছনে না লেগে তুমি আমার কাছে এলে কেন?’
‘তাদের কাছে অন্যেরা যাবে। আমাকে বলা হয়েছে, আতাউল হাশেম মুজাহিদদের রসদপত্র আসার রাস্তা এমনভাবে পাহারা দিচ্ছে, যার কারণে আমাদের কমান্ডোরা একাধিকবার রসদের ওপর হামলা চালিয়েও কোন সুবিধা করতে পারেনি। এই লোকটির কারণে আমাদের লোকেরা রসদপত্র তো সংগ্রহ করতে পারলোই না, উল্টো আমাদের বহু মূল্যবান প্রাণের ক্ষতিও হয়েছে। তাই তোমার কাজ হচ্ছে, কমান্ডার আতাউল হাশেমের কাছে মেয়ে দুটিকে পৌঁছে দেয়া। তারা ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে আমাদের দলে ভেড়াতে চেষ্টা করবে। কিন্তু তার ঈমান যদি খুব মজবুত হয় তাহলে এতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে তাকে বন্দী করার সুযোগ বের করে দেয়া তোমার দায়িত্ব। তাকে এমন ফাঁদে ফেলবে যেন সে নিরূপায় হয়ে বন্দী হয় অথবা নিহত হয়। যদি এটাও বিপদজনক মনে করো তবে তোমরা তিনজনে মিলে তাকে যে করেই হোক হত্যা করবে।’
লোকটা খুবই আশ্চর্য হলো এই ভেবে যেম আতাউল হাশেম এমন অসামান্য সুন্দরী দুই যুবতীর প্রতি কোনই আগ্রহ প্রকাশ করলো না। আতাউল হাশেম অন্তরঙ্গভাবে তার সাথে কথা বলছে দেখে সে তাকে জিজ্ঞেসই করে বসলো, কেন এমন সুন্দরী মেয়ে ও স্বর্ণ রৌপ্যের প্রস্তাব তিনি হেলায় ঠেলে দিলেন।
আতাউল হাশেম হেসে বললেন, ‘তার কারণ আমি দুর্বল ঈমানাদার নই।’
আতাউল হাশেম এবার মেয়ে দু’টির কাছে গেলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘ও যা বলেছে সে ব্যাপারে তোমাদের কোন বক্তব্য আছে?’
মেয়েরা না সূচক মাথা নাড়ল।
একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি সবই শুনেছেন। এখন আমাদের সঙ্গে কেম ব্যবহার করবেন?’
আতাউল হাশেম বললেন, ‘আগামীকাল সকালে তোমাদের হেডকোয়ার্টারে তকিউদ্দিনের কাছে পাঠিয়ে দেবো। তোমাদের ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেয়ার তিনিই নিবনে।’
তিনি সুদানী লোকটি ও মেয়ে দু’জনকে সঙ্গীদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এদেরকে পৃথক পৃথক স্থানে রাখবে।’
তাদের তল্লাশী নেয়া হলো। প্রত্যেকের কাছে পাওয়া গেল একটি করে ছুরি। আর লোকটির কাছে অতিরিক্ত পাওয়া গেল এক পুটলি নেশার দ্রব্য, হাশিস।
সূর্য তখন ডুবে যাচ্ছে। একটি টহল দল ফিরে এসে রিপোর্ট করলো তার কাছে। সন্ধ্যা হলো। মাগরিবের নামাজ পড়ে তিনি তার বাহিনীর সদস্যদের বললেন, ‘রাতের ডিউটির জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আমার সাথে দেখা করবে। আমি তোমাদের বলে দেব কে কোথায় ডিউটিতে যাবে।’
সৈন্যরা চলে গেল। একটু পরই ফিরে এলো সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে। তিনি সৈন্যদের বিভিন্ন দলকে দূর দূরান্ত পর্যন্ত পাঠিয়ে দিলেন। প্রত্যেককে বলে দিলেন, ‘সুদানীরা গোয়েন্দা ও চর ছড়িয়ে দিয়েছে ব্যাপকভাবে। তিনজন ধরা পড়েছে। ওরা মারাত্মক ধ্বংসাত্মক কাজে নিয়োজিত। ফলে চোখ কান খোলা রাখবে। সাবধান থাকবে এদের ব্যাপারে। আর অস্বাভাবিক কোন কিছু চোখে পড়লেই খবর পাঠাবে আমার কাছে।’
আস্তানায় পাহারায় নিয়োজিতদের ডেকে বললেন, ‘এমনও হতে পারে, এদের সাথী ও দলের লোকেরা এদের আটকে পড়ার খবর পেয়ে যেতে পারে। তাহলে এদের ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করবে ওরা, হামলা করতে পারে আস্তানায়। পাহারা জোরদার রাখবে। বিশ্রামরত রিজার্ভ সৈন্যদেরও শোয়ার সতর্ক করে দেবে যেন সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে শোয়।’
সবার দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে রাতের খাবার সেরে শুয়ে পড়লেন তিনি। আস্তানার ভেতরে না শুয়ে টিলার চূড়ায় উঠে গেলেন। জায়গাটা উঁচু নিচু। শোয়ার আগে লোকটি ও মেয়ে দুটির কি ব্যবস্থা করেছে দেখে নিলেন। এরপর তিনি টিলার ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
সেখান থেকে তিনি আস্তানার সৈন্যদের আর দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি চোখ বন্ধ করলেন। ঘুম আসছিল না সে চোখে। কিছুক্ষণ ওভাবে শুয়ে থাকার পর আবার চোখ মেললেন তিনি। মেয়ে দু’টির কথা ভাবছিলেন। আহা! কি কমনীয় চেহারা মেয়ে দু’টির! কি নিষ্পাপ মাসুম কচি মেয়ে! অথচ তাদের দিয়ে কেমন জঘন্য ও ভয়াবহ কাজ করানো হচ্ছে। যদি এরা কোন মুসলমান ঘরের মেয়ে হতো তবে কোন সম্মানী ঘরের বউ হয়ে সসম্মানে থাকতো।
স্ত্রীর কথা স্মরণ হলো তার। যখন সে তার ঘরে বউ হয়ে এসেছিল তখন সে তাদের মতই নব যৌবনা ও আকর্ষণীয়া ছিল। তিনি স্ত্রীর সাথে প্রথম জীবনের সেই রোমান্টিক স্মৃতিতে বিভোর। হয়ে গেলেন। এই বিরাণ মরুভূমিতে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন সেইসিব দিনগুলিতে। চারদিকে এত যুদ্ধ, এ মৃত্যু, অস্ত্রের ঝনঝনানি, তলোয়ারের চমক কছুই এখন আর তাকে স্পর্শ করছে না। যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যরা কখনো কখনো এমনিভাবে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়, মনোহর স্মৃতির মাঝে ভুলিয়ে রাখে মনকে।
চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। মরুভূমির মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে কোমল জোসনা। এটাই মরুভূমির বৈশিষ্ট্য। দিনের বেলা এখানে যেমন থাকে সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপ তেমনি তাদের চাঁদনী থাকে স্বচ্ছ ও শীতল। এই শীতলতা যেন তার হৃদয় ও মন থেকে মৃত্যুর বিভীষিকা শুষে নিয়েছে। আতাউল হাশেম উঠে বসলেন। তাকিয়ে রইলেন দূর দিগন্তে। তারপর উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন আস্তানার দিকে। ঘুরে ঘুরে দেখছেন সবকিছু। দেখলেন পাহারাদাররা টহল দিচ্ছে নিয়মমাফিক। সৈন্যরা শুয়ে আছে নিজ নিজ বিছানায়। তিনজন সৈন্যের সাথে শুয়ে আছে সুদানী লোকটি। মেয়েরা শুয়ে আছে ওদের বিছানায়।
আতাউল হাশেম একজন মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন। নিজের পা দিয়ে চাপ দিলেন মেয়েটির পায়ে। মেয়েটির চোখ খুলে গেল। আতাউল হাশেমকে চিনতে পেরে উঠে বসলো সে। আতাউল হাশেম তাকে উঠে দাঁড়াতে ও তার সাথে যেতে ইঙ্গিত করলেন। মেয়েতি আনন্দ চিত্তে উঠে দাঁড়ালো। তার আরো আনন্দ হলো এই ভেবে যে, যৌবনা নারীর যাদুর প্রভাব শেষে এই পাথরের মত কঠিন প্রাণ কমান্ডারের মনেও ঢেউ তুলতে পেরেছে!
আতাউল হাশেম হাঁটা দিলেন। মেয়েটি তার পিছু পিছু পা চালালো। সৈন্যরা বেহুশের মত ঘুমিয়ে আছে। তারা কেউ জানতে বা বুঝতেও পারল না, তাদেরই মাঝ থেকে কোন এক ব্যক্তি একটি মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আতাউল হাশেম সৈন্যদের দিকে তাকালেন। তাদের জন্য তাঁর একটু করুণা হলো। কারণ তিনি তো এক অবিশ্বাস্য ধরনের নফসের যুদ্ধে নেমেছেন। এ যুদ্ধেও গাজী হতে চান তিনি।