পাল্টা ধাওয়া
ত্রিপলীর খৃস্টান রাজ দরবার। বিভিন্ন খৃস্টান সম্রাটরা এসে এখানে মিলিত হয়েছেন। উদ্দেশ্য, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত ও সর্বপ্লবী হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা। মুসলমানদের ওপর চূড়ান্ত হামলার লক্ষ্যেই এ সম্মেলন। সম্মেলনে অতিথিদের আপ্যায়নের দায়িত্ব পালন করছে দুই বিশ্বস্ত খৃস্টান, ভিক্টর ও চেঙ্গিস।
রাজকীয় উর্দি পরে দু’জনই মেহমানদের সামনে ঘোরাফেরা করছিল। এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছিল তাদের। মেহমানদের অনেকেই এদের আগে থেকে চেনে। ওরা মেহমানদের বিশ্বাসভাজন তো বটেই, কারো কারো প্রিয়ভাজনও।
ক্রুসেডদের গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান হরমন। তিনিই অনেক যাচাই-বাছাই করে ওদেরকে এ চাকরীতে নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু আসলে এরা দু’জনই ছিল সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা। গোয়েন্দা হিসাবে তারা দু’জনই ছিল চৌকস। অসম্ভব বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ না হলে হরমনের মত উস্তাদ গোয়েন্দার সন্ধানী দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে তাদের পক্ষে এখানে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না।
দেখতে শুনতেও দু’জনই ছিল স্মার্ট। এখানে তাদের চাকরী হওয়ার এটাও একটা কারণ যে, তাদের উভয়েরই চেহারা সুন্দর, দেহ কাঠামো সুঠাম, সবল ও পৌরুষদীপ্ত। রাজকীয় মেহমানখানায় কাজ করার উপযুক্তই বটে।
ভিক্টর তার প্রকৃত নামেই সবার কাছে পরিচিত। কারণ সে আসলেই খৃস্টান। রাশেদ চেঙ্গিস ছিল তুরস্কের নাগরিক, মুসলমান। খৃস্টানদের কাছে সে তার নিজের দেয়া খৃষ্টান ছদ্মনামে পরিচিতি ছিল। এ জন্য কোন খৃস্টানই তার আসল নাম জানতো না এবং সে যে মুসলমান তাও জানতো না।
গভীর রাত পর্যন্ত চলল সম্মেলনের কাজ। আহারাদি, মদপান ও আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে রাত পার করে দিল সম্রাটগণ। বিশ্বস্ত খাদেমের মতই হাসি মুখে তারা এই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সেবা করে যাচ্ছিল।
মাঝ রাতের পর মিটিং শেষ হলো। তখন তারা ছুটি পেল নিজ নিজ কামরায় যাওয়ার।
‘আমরা দুজন একই সাথে চাকরী ও ডিউটিতে অনুপস্থিত থাকতে পারি না।’ ভিক্টর বললো, ‘এ সংবাদ অন্য কাউকে দিয়ে কায়রো পাঠাতে হবে। এমন বিশ্বস্ত লোক কাকে পাওয়া যায় বলতো?’
‘ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলতে হবে।’ রাশেদ চেঙ্গিস বললো, ‘তিনি ভাল বলতে পারবেন, কে দ্রুত ও বিশ্বস্ততার সাথে এ সংবাদ কায়রো পৌঁছাতে পারবে। তবে যেই যাক, তাকে বিশ্বস্ত হতে হবে।’ সে আরো বলল, ‘আমি আজই এ সংবাদ দিয়ে কাউকে পাঠানোর দরকার মনে করছি না। এখনো খৃস্টান সম্রাটরা যুদ্ধের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেনি। যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিকল্পনা ও পরিপূর্ণ তথ্য নিয়েই কায়রোতে লোক পাঠানো দরকার। অসম্পূর্ণ সংবাদ দিয়ে সুলতান আইয়ুবীকে হয়রান পেরেশান করার কোন মানে নেই।’
‘না, আমি এটুকুকেই অনেক বড় খবর মনে করি। ইমাম সাহেবকে বলা দরকার, ক্রুসেড বাহিনী বিশাল শক্তি নিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে। যাতে তিনি এ খবর কায়রো পৌঁছে দিতে পারেন।’ ভিক্টর বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী এতে করে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পাবেন। এখনো যেসব দিকে তাঁর দুর্বলতা রয়েছে দ্রুত তা সংশোধন করে নিতে পারবেন। অভাবগুলো দ্রুত পূরণের জন্য সচেষ্ট হতে পারবেন। পরে যখন বিস্তারিত পরিকল্পনা পাবো তখন সে খবরও পাঠাবো।’
‘কিন্তু বার বার যাতায়াত করলে হরমনের গুপ্তচরদের নজরে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে!’
‘আর এমন যদি হয়, কোন খবর পাঠানোর আগেই আমরা ধরা পড়ে গেলাম!’
‘কেন, তোমার কি নিজের প্রতি আস্থা নেই?’
‘নিজের প্রতি আস্থা আমার ঠিকই আছে, কিন্তু তোমার প্রতি নেই। শোন!’ ভিক্টর চেঙ্গিসকে বললো, “যে সময় মেহমানরা আক্রমণের কথা বলছিল, তখন আমি তোমাকে লক্ষ্য করে দেখেছি। তুমি মদের পিয়ালা সম্রাট রিমাণ্ডের সামনে সাজিয়ে রাখতে রাখতে একবার থেমে গিয়েছিলে। তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তুমি তার কথার দিকে খেয়াল করছে। আমি তোমার চেহারা দেখছিলাম। খবরটি শুনে তোমার চেহারায় প্রফুল্ল ভাব ফুটে উঠেছিল। আমি জানতাম, এত দামী তথ্য পাওয়ার পর আতংক বা খুশীর ভাব ফুটে উঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু তোমার ভুলে গেলে চলবে না, হরমনও এখানে উপস্থিত আছেন। হরমন আলী বিন সুফিয়ানের সম পর্যায়ের গোয়েন্দা। আমি তোমাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে হরমনের দিকেও তাকিয়েছিলাম। আমার তখন আশংকা হলো, তিনি তোমাকে লক্ষ্য করছেন। তাই তো বলছি, ভাই, আমাদের নিঃশ্বাসের কোন বিশ্বাস নেই।’
‘হরমনের কাছে আমি কোন অপরিচিত লোক নই।’ রাশেদ চেঙ্গিস বললো, ‘আমার সম্পর্কে তিনি সন্দেহ অনেক আগেই শেষ করেছেন। এখন ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
‘ভয় করার কথা বলছি না, সাবধান হওয়ার কথা বলছি।’ ভিক্টর বললো, ‘আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমরা শত্রুর পেটের মধ্যে বাস করছি।’
‘তা ঠিক। কিন্তু ভাই, যাই বলো, আমিও তো একজন মানুষ। মানবিক ত্রুটিবিচ্যুতির উর্ধ্বে কি করে উঠি!’
‘সে জন্যই তো তোমাকে সাবধান করছি। তুমি তো জানো না আজ হরমনের ওপর কি নির্দেশ জারী করা হয়েছে। এখন থেকে প্রতিটি মানুষকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখার জন্য বলা হয়েছে তাকে। আর তাকে এই ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে, এ ক্ষেত্রে তিনি যা ভাল মনে করবেন, সেটাই আইন। তিনি কাউকে সন্দেহ করলে এবং সেই সন্দেহের বশে কাউকে খুন করলেও কেউ তার কাছে কোন কৈফিয়ত তলব করতে পারবে না।’
‘বলো কি! এ ব্যাপারে তার হাতে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, শোন, এসব কথা এখন থাক। আগে কাজের কথায় আসি। তুমি এখনি সোজা মসজিদে চলে যাও। সবাই এখন ঘুমিয়ে আছে। এই সুযোগে আজকের আলোচনা ইমাম সাহেবকে বিস্তারিত জানিয়ে এসো। যদি কায়রোতে যাওয়ার মত লোক পাওয়া যায়, তবে যেন দ্রুত অকে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে পাঠিয়ে দেয়। আর যদি ওদিক থেকে কেউ এসে থাকে, তবে আমার সাথে দেখা না করে যেন ফিরে না যায়।’
শহরের এক মসজিদের ইমাম সুলতান আইয়ুবীর গোপন সংবাদ আদান-প্রদানের মাধ্যমে পরিণত হয়েছেন। সেই সুবাদে মসজিদটিও মুসলিম গোয়েন্দাদের গোপন আড্ডায় পরিণত হয়েছে। আলী বিন সুফিয়ানের কোন গোয়েন্দা গোপন কোন খবর পেলে মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবকে সে তথ্য দিয়ে আসে। ইমাম সাহেব আবার সে খবর অন্য গোয়েন্দা মারফত জায়গা মত পৌঁছে দেন।
ভিক্টর কখনও মসজিদে যায় না। সে বলে, “আমি মুসলমানও না, নামাজ-কালামও জানি না। আর মসজিদের ইজ্জত-সম্মান বিষয়েও কোন জ্ঞান নেই আমার। আমি কেন মসজিদে যাবো?’
তার এ কথা যেমন খাঁটি, তারচেয়ে বেশী খাঁটি, সে এক হুশিয়ার গোয়েন্দা। অযথা মসজিদে যাওয়ার ঝুঁকি সে কেন নিতে যাবে! মসজিদে মুসল্লী বেশে ক্রুসেড গোয়েন্দা নেই, এমন তো নয়। অনেক মুসল্লীই আছে, যারা পাকা গোয়েন্দা। তারা খৃস্টানদের চর হিসাবে মুসলমানদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। তারা মসজিদের মুসল্লীদের প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখে এবং তাদের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে। এ জন্যই দেখা যায়, আইয়ুবীর প্রতি সামান্য দরদ রাখে এমন বেশীর ভাগ মুসলমানই গ্রেফতার হয়ে যায়।
রাশেদ চেঙ্গিসও দিনের বেলা এবং প্রকাশ্যে কখনো মসজিদে যায় না। কারণ সে নিজেও খৃস্টান পরিচয়েই সবার কাছে পরিচিত। কোন খৃস্টান মসজিদে গেলে প্রথম দর্শনেই সে সন্দেহভাজনদের তালিকায় পড়ে যাবে। যে লোক খৃস্টান রাজসভায় মদ পরিবেশনের দায়িত্ব পালন করে, মসজিদের তার কি দরকার? এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর সে দিতে পারবে না। তাই যখনি প্রয়োজন পড়ে, তখন গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে ইমামের সাথে দেখা করতে যায়। ইমাম সাহেবের কামরা মসজিদের সাথে লাগোয়। কামরার দরজা মসজিদের বারান্দার দিকে। বারান্দা দিয়ে উঠে দরজায় ধাক্কা দিলে দেখা যাবে, দরজাটি ভেতর থেকে ভেজানো বা আটকানো। তখন নিয়ম মাফিক সাংকেতিক টোকা দিতে পারলেই সে দরজা খুলে যাবে।
রাশেদ চেঙ্গিস তার পোষাক পরিবর্তন করলো। গায়ে জোব্বা ও মাথায় পাগড়ী বেঁধে নিল মুখে কৃত্রিম দাড়িও লাগাল। এরপর কামরা থেকে বেরিয়ে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল। আদেশ অনুযায়ী তাকে সব সময় ক্লীন সেভ থাকতে হয়। গোপন মিশনে যাওয়ার সময় সে কৃত্রিম দাড়ি লাগিয়ে বের হয়, যাতে কারো চোখে পড়লেও সহজে ধরা না পড়ে।
একজন পাক্কা হুজুর সেজে রাস্তায় নামে সে। রাজ দরবারের বাইরে তাদের থাকার জন্য নির্দিষ্ট কোয়ার্টার আছে। সেখানেই থাকে সে এবং ভিক্টর। তাই বেরোতে কোন অসুবিধা হয়নি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাতি জ্বলছে। সে যতটা সম্ভব আলো এড়িয়ে পথ চলছিল।
রিমাণ্ডের পারিষদ এবং সেনা অফিসার ছাড়াও ওখানে জমায়েত হয়েছিল অনেক মেহমান। তারা বিভিন্ন খৃস্টান সাম্রাজ্যের সম্রাট বা সেনাপতি। সম্রাট রিনাল্ট, তার অনেক নাইট এবং অফিসারও সেখানে উপস্থিত ছিল। আরও ছিল বিভিন্ন রাষ্ট্রের সেনা কর্মকর্তাবৃন্দ।
এইসব সম্মানিত মেহমানদের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন সম্রাট রিমাণ্ড। আলাপ-আলোচনা ও যুদ্ধের পরিকল্পনায় যেটুকু সময় ব্যয় হতো তার বাইরে বাকী সময়টুকু তারা কাটিয়ে দিত আমোদ-স্ফুর্তি ও মাতলামী করে। অধিকাংশ রাত তারা পার করতো মদ ও মেয়ে নিয়ে।
দরবারে ছিল অভিজাত শ্রেণীর পেশাদার নিশিকন্যাদের রমরমা ভাব। উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসাররা মেতে উঠে স্ত্রী বদল খেলায়। ফলে রাতে শহর জুড়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে এলো।
রাশেদ চেঙ্গিস তার কামরা থেকে বেরিয়ে পথে নেমেই বিপাকে পড়ল। কোথায় সে একটু নিরিবিলিতে পথ চলবে, গোপনে দেখা করবে ইমাম সাহেবের সাথে, তা নয়, পথ ভর্তি লোকজন। পথের পাশে বিভিন্ন দেশের সৈনিকরা তাঁবু টানিয়ে নিয়েছে। সেই সব তাঁবুতে, এমনকি পথের মধ্যেও অসভ্যপনা চলছিল। বেসামাল মাতাল জোড়া এমন ভাবে পথ চলছে, যেন ওটা ওদের ড্রয়িং রুম।
সে এই সব জুটির দৃষ্টি এড়িয়ে কৌশলে রাস্তা পার হয়ে এলো। শেষ পর্যন্ত সে বিপদসীমা পার হয়ে শহরের সাধারণ আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করলো। একটু পর গিয়ে হাজির হলো সেই মসজিদের পাশে।
মসজিদটি এক মুসলিম মহল্লার অভ্যন্তরে। এখানে কোন কোলাহল ছিল না, আশেপাশে কেউ জেগে আছে বলেও মনে হলো না তার। সে বারান্দা পেরিয়ে ইমাম সাহেবের দরজায় গিয়ে হাজির হলো। এদিক-ওদিক ভাল ভাবে লক্ষ্য করে কামরায় প্রবেশ করতে যাবে, এমন সময় কারো আলতো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। থমকে দম আটকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল সে। শব্দটি গলি পেরিয়ে মসজিদের মোড়ের কাছে এসে নীরব হয়ে গেল।
রাশেদ চেঙ্গিস অনেকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে রইল। আর কোন শব্দ নেই। সে ভাবল, তবে কি এটা মনের ধোঁকা? নাকি ভুল শুনলাম? সে বারান্দা দিয়ে হেঁটে আবার এসে গলি মুখে উঁকি দিল। না, আশেপাশে কেউ নেই।
রাশেদ চেঙ্গিস ভাবলো, হয়তো কোন কুকুরের পদধ্বনি ছিল ওটা। সে তার মনকে শান্ত করে ইমাম সহেবের কামরার দরজায় ধাক্কা দিল। খুলে গেল দরোজা। রাশেদ চেঙ্গিস ভেতরে প্রবেশ করে ইমাম সাহেবকে সব কথা খুলে বলল।
‘ক্রুসেড বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য এখানে জড়ো হয়েছে।’ চেঙ্গিস বললো, ‘সবচেয়ে বড় দলটি নিয়ে এসেছে সম্রাট রিনাল্ট। ত্রিপলীর সেনাবাহিনী আগে থেকেই এখানে আছে। অন্যান্য সম্রাটরাও তাদের বাহিনী এসে পৌঁছার জন্য অপেক্ষা করছে। কায়রোতে এ সংবাদ তাড়াতাড়ি পাঠানো দরকার। সৈন্য অভিযানের আগেই এ বার্তা সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌঁছলে তিনি তাদের সম্বর্ধনার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারবেন।’
‘তুমি খুব গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে এসেছো। আমি এ খবর কায়রো পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। তুমি আর কিছু বলবে?’
‘আমরা যদি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারি, তবে অভিযানের আগেই কমান্ডো হামলা চালিয়ে এই বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা সব। বিষয়টি আপনি গভীরভাবে ভেবে দেখবেন। আর যদি এটা সম্ভব না হয় তবে তাদেরকে অভিযানের মাঝ পথে বাঁধা দেয়া যেতে পারে।’
‘তোমার কথার অর্থ হচ্ছে, কমান্ডোদের বলতে হবে, তারা যেন শক্রদের রসদপত্র পথেই জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেয়।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি এ কাজ করাতে পারবো, কিন্তু করাব না। তুমি হয়তো শুনে থাকবে, যে সব অধিকৃত শহরে আমাদের কমাণ্ডো বাহিনী ক্রুসেড বাহিনীর ক্ষতি সাধন করেছে, সেখানে নিরীহ মুসলমানদের বস্তিগুলোর কি অবর্ণনীয় দুর্দশা হয়েছে। সে এলাকার মুসলমানদের জীবন জাহান্নামের মতই কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে। ক্রুসেড বাহিনী প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে অনুসন্ধান করেছে। আমাদের পর্দানশীন নারীদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। আমাদের যুবতী মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে গেছে ওরা। কিশোর ও যুবকদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। বুড়োদেরকে বন্দী করে নিয়ে গিয়ে ওদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ করাচ্ছে।’
আমি বিষয়টি সুলতান আইয়ুবীকে জানিয়েছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘মুসলমান নাগরিকদের জান ও মালের ক্ষতি হতে পারে এমন ভয় থাকলে সেই শহরে কমাণ্ডো অভিযান চালানো যাবে না। শত্রুদের খাদ্যসামগ্রী তাদের বাহিনীর সাথে আসতে থাকুক। সময়মত সেগুলোর ব্যবস্থা আমি করবো।’
‘আমি আরো বিস্তারিত রিপোর্ট আপনাকে দু’চার দিনের মধ্যেই দিচ্ছি।’ চেঙ্গিস বললো, ‘আপনি এখন আরও বেশী সাবধান থাকবেন। এখানকার গোয়েন্দা সংস্থা খুব বেশী তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা এখন পশু-পাখীকেও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে।’
“ঠিক আছে, এ নিয়ে ভেবো না। তুমিও সাবধানে থেকো।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘আগামী কাল ভোরেই আমি কাউকে কায়রো পাঠিয়ে দেবো।’
রাশেদ চেঙ্গিস মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলো। এবার সে আর চোরের মত লুকিয়ে নয়, প্রকাশ্যেই গলি পথ ধরে হাঁটতে লাগল।
সে যেই রাস্তার মোড় ঘুরলো, তখন আবারও কারো পায়ের চাপা শব্দ শুনতে পেল। সে পিছন ফিরে তাকালো, অন্ধকার গলিপথে কাউকে দেখতে পেল না। তবে এবারের শব্দটা এত স্পষ্ট ছিল যে, এটা আর অমূলক ধারণা রইল না, কেউ তাকে অনুসরণ করছে, এই সন্দেহ দৃঢ় তার বিশ্বাসে পরিণত হলো। সে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পিছন ফিরে আবার গলিপথে ঢুকে বেশ কিছু দূর অগ্রসর হলো। কিন্তু না, কাউকেই দেখা গেল না।
সে আবার ফিরতি পথ ধরলো এবং দ্রুত হেঁটে তার ঠিকানায় পৌঁছে গেল। কামরায় পৌঁছে সে তার কৃত্রিম দাড়ি খুলে পুরাতন কাপড়ের বাণ্ডিলে তা লুকিয়ে রাখলো। তারপর সে তার পোষাক পাল্টাল, যেমন পোষাক সাধারণত খৃস্টানরা পরিধান করে। এখন আর কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারবে না।
ভিক্টর ও চেঙ্গিস চেষ্টা করছিল, ক্রুসেড বাহিনী কোথায় আক্রমণ চালাবে এবং তাদের অভিযানের ধরণ কি হবে তা জানার জন্য।
ত্রিপলীতে সেনা সমাবেশ বেড়েই চলছিল। গোয়েন্দাদের আনাগোনা এবং ছুটাছুটিও বেড়ে গিয়েছিল। এই দুই গোয়েন্দা চোখ কান খোলা রেখে প্রত্যেকের গতিবিধি জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সম্রাট রিমাণ্ডেরে দায়িত্ব ছিল মেহমানদের আতিথেয়তা করা। কারণ তার রাজধানীতেই এই সমাবেশ হচ্ছে।
এক রাতে তিনি সমস্ত খৃষ্টান সম্রাট, উচ্চ সামরিক অফিসার ও অন্যান্য শাসকবৃন্দকে নৈশভোজের দাওয়াত দিলেন। এই রাতটি ছিল চেঙ্গিস ও ভিক্টরের জন্য অসম্ভব ব্যস্ততার রাত।
সম্রাট রিমান্ড মেহমানদেরকে উত্তম আপ্যায়ন ও দামী মদ পরিবেশনের জন্য হুকুম দিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের ব্যস্ততা বেড়ে গেল। তারা জানতো, এই ব্যস্ততা ও সতর্কতার প্রয়োজন ততক্ষণ, যতক্ষণ মেহমানরা সজ্ঞানে থাকে। মেহমানরা মদের নেশায় বিভোর হয়ে গেলে সেই সতর্কতার আর প্রয়োজন পড়ে না। তখন ভোজসভার কর্মচারীদের জন্য সৃষ্টি হয় সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগে অনেকেই দু’চার পেগ মদ সরিয়ে রাখে। পছন্দের খাবারটা একটু চেখে দেখে। আর কেউ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে রাজ-রাজরাদের লীলাখেলা ও অসভ্যতা।
এই ভোজ সভা ছিল নারী-পুরুষের অবাধ মিলনকেন্দ্র। তার মধ্যে যুবতী মেয়েরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল যুবতী সাজা বৃদ্ধারাও।
ভিক্টর ও চেঙ্গিস উভয়েই খাবার ও মদ পরিবেশনের তদারকিতে খুবই ব্যস্ত ছিল। এক যুবতী রাশেদ চেঙ্গিসের কাছ থেকে দু’তিন বার মদ চেয়ে নিল। চেঙ্গিস প্রত্যেকবারই কোন বয়কে ডেকে মদ দিতে বললো।
মেহমানরা অনেকেই সম্রাট রিমাণ্ডকে ঘিরে বসে বসে গল্প গুজব করছিল। কেউ বসেছিল হলরুমের ভেতর, কেউ বারান্দার খোলামেলা পরিবেশে ছোট ছোট টেবিলে জুটি বেঁধে আলাপ করছিল। কেউ আবার নিরিবিলি পরিবেশ পাওয়ার আশায় বাগানে নেমে পড়েছিল।
যে যুবতী বার বার চেঙ্গিসের কাছে মদ চাচ্ছিল, আবারও সে হাত ইশারায় তাকে কাছে ডাকল। মেয়েটি ছিল খুবই সুন্দরী চেঙ্গিস তার কাছে যেতেই সে বলল, ‘আমি যতবার তোমার কাছে মদ চেয়েছি ততবারই তুমি বয়-বেয়ারা দিয়ে ত পাঠিয়ে দিয়েছে। এক যুবতীকে খুশী করার জন্য তুমি কি নিজের হাতে একবার পরিবেশন ধ্বতে পারো না?”
‘জী, কেন নয়। চেঙ্গিস বিনয়ের হাসি হেসে বলল, ’আমি এখুনি এনে দিচ্ছি।’
‘উহু, এখানে নয়।’ মেয়েটি মুচকি হেসে বললো, ’আমি বাগানে যাচ্ছি, ওখানে নিয়ে এসো।’
চেঙ্গিস মদের একটি সুন্দর সুরাহী ও পিয়ালা নিয়ে বাগান চলে গেল। মেয়েটা আগেই ওখানে গিয়ে বসেছিল। রাতে প্রাসাদের আঙ্গিনায় চমৎকার সাজানো গুছানো বাগান সেখানেও মেহমানরা জোড়ায় জোড়ায় বসে গল্প করছি সেই সাথে চলছিল সমানে পানাহার।
কিন্তু এই মেয়েটি বাগানের এক টেবিলে একাকীই বসেছি এতে চেঙ্গিস একটু বিষ্মিত হলো। কারণ এখানে কেউ একা নেই, সবাই ব্যস্ত আপন আপন সঙ্গীর সাথে। এতসব জুটির মাঝে তাকে বড় বেমানান লাগছিল।
এমন সুন্দরী ও যুবতী মেয়ের তো একা থাকার কথা নয়। ভাবল চেঙ্গিস, তার চারপাশে তো এতক্ষণে ভ্রমরের ভিড় লেগে যাওয়ার কথা! সে মেয়েটির পিয়ালায় মদ ঢালতে ঢালতে বললো, ‘আপনার আর কিছু লাগবে?’
‚না, ধন্যবাদ।’ মেয়েটি সৌজন্য প্রকাশ করে বলল, ‘আমার আর যা লাগবে তা তুমি দিতে রাজি হবে কিনা তাই ভাবছি।’
আরো অবাক হলো চেঙ্গিস। জিজ্ঞেস করলো, ‘বলুন, কি লাগবে আপনার?’
‘দেখতেই পাচ্ছো আমি একা। তোমার সাথে একটু কথা বললে অসুবিধা আছে?’
বিনয়ের সাথে বললো চেঙ্গিস, ‘না, না। বলুন কি জানতে চান?’
‘তোমার দেশ কোথায়?’
সে ইউরোপের একটি অঞ্চলের নাম বললো।
‘এখানে কতদিন আছো?’
‘বলতে পারেন শিশুকাল থেকেই। আমার বাবা ছিলেন সম্রাট রিমাণ্ডের রাজ পরিবারের কর্মচারী। এখন আমি তার সামান্য গোলাম।’
‘বাহ! তাহলে তো দেখছি, তুমি রাজ পরিবারেরই একজন। অন্তত এ রাজ পরিবারের যত কাহিনী তোমার জানা আছে, অনেকেরই তা নেই।’
‘হ্যাঁ, বলতে পারেন এ আমার পরম সৌভাগ্য।’ বিনয়ের সাথে বলল চেঙ্গিস।
‘তোমার এ সৌভাগ্যে সামান্য ভাগ বসানোর লোভ হচ্ছে। আমি কি তোমার কাজের ক্ষতি করছি?”
‘না, না। আপনাদের সেবা করাই তো আমার কাজ! বলুন, কি বলবেন।’
‘তাহলে তুমি আরো কিছুক্ষণ আমাকে সঙ্গ দাও।’ মেয়েটি তার পিয়ালা চেঙ্গিসের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘নাও, তুমিও সামান্য পান করে নাও।’
‘না, না। একি বলছেন আপনি! আমি আপনার সামান্য গোলাম মাত্র!’ তার কণ্ঠ থেকে অকৃত্রিম বিস্ময় ও বিনয় ঝরে পড়ল, ‘আপনি আমার মুনীবের মেহমান! একি করে সম্ভব!’
‘রাখো তো ওসব কথা! এখানে তোমার সংকোচের কিছু নেই। আমি নিজেই তো তোমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।’ মেয়েটির কণ্ঠে অন্তরঙ্গতা। সে পাত্রটি বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘এই মুহূর্তে কিছুক্ষণের জন্য না হয় তুমি সম্রাট হয়ে যাও, আর আমাকে তোমার দাসী মনে করো।’ মেয়েটি তার হাত ধরে তৃষ্ণার্ত হাসি হেসে বলল, ‘আমার চোখে তুমি এখন পরদেশী এক শাহজাদা! আর আমি এখানকার শাহজাদী! কই, নাও! ধরো তো এটা! আমার মেহমানকে আমি কিছু খেতে দেবো না!’
চেঙ্গিস বিব্ৰত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘আপনি এখানে একা কেন? আপনার সঙ্গী কোথায়?’
‘আমার সঙ্গী আমার পাশেই আছে।’ মেয়েটি রহস্যময় কণ্ঠে বলল, ‘আমার মন যারে চায় তাকেই তো সঙ্গী করা উচিত, কি বলো? যাদের আমি ঘৃণা করি তাদের সাথে কেমন করে হেসে খেলে বেড়াই।’ মেয়েটি উত্তর দিল। ‘আমার যাকে ভাল লাগছে, আমি তাকেই পাশে ডেকে নিয়েছি। তুমি তো আমার হাত থেকে পিয়ালা গ্রহণ করলে না?’
‘যদি কেউ দেখতে পায়, তবে আমাকে শুলে চড়াবে।’ চেঙ্গিস ভয়ার্ত ধরে বললো।
‘কিন্তু যদি তুমি আমার নিবেদন প্রত্যাখ্যান করো, তবে আমিই তোমাকে শুলে চড়াবো।’ মেয়েটি হেসে বললো, ‘পাগল! তোমাকে আমার ভাল লেগেছে বলেই না তোমাকে এখানে ডেকে এনেছি।’
মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো এবং তার কাঁধে হাত রেখে কানে কানে বললো, ‘তুমি আমাকে নিরাশ করো না যুবক।’ তখনও তার ঠোঁটের কোণে লেগেছিল ভূবন মোহিনী হাসি।
“কিন্তু আমি তো এখন মদ পান করতে পারবো না। এখন যে আমি ডিউটিতে আছি!’ চেঙ্গিস আড়ষ্ট কণ্ঠে বললো।
‘আচ্ছা, নাই বা করলে মদ পান।’ মেয়েটি তার কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, ‘কিন্তু আমি যখন ও যেখানেই ডাকি, সেখানে তোমাকে হাজির হতে হবে।’
রাশেদ চেঙ্গিস এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। সে ধারণা করলো, এই মেয়ে কোন বৃদ্ধ জেনারেলের স্ত্রী হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, তার স্বামী অন্য কোন নারী নিয়ে মেতে আছে। তারই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এ মেয়ে তাকে বাছাই করেছে।
সে ছিল এক বিচক্ষণ গোয়েন্দা। তাই মেয়েটির আচরণে সে সামান্য বিচলিতও হলো না। এমন সুন্দরী ও অভিজাত যুবতী তার বন্ধুত্বের আকাংখা করেছে, এটা তার কাছে কোন নতুন ঘটনা নয়। চেঙ্গিস এতটাই সুদর্শন ও আর্ষণীয় দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী যে, এর আগেও তাঁকে এমন ব্রিতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে।
খৃস্টান সম্রাট ও অফিসারদের মাহফিলগুলো সুন্দরী ও আকর্ষণীয় মেয়েরাই সরগরম করে রাখে। এর আগেও একাধিক মেয়ে চেঙ্গিসের সাথে সম্পর্ক করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু চেঙ্গিস তার কর্তব্যের খাতিরে তাদের এড়িয়ে গেছে। সুলতান আইয়ুবী তাকে যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন, সে দায়িত্ব পালনে কোন ক্রটি ঘটতে পারে এমন কোন কিছুর সাথে সে নিজেকে জড়াতে চায় না।
আলী বিন সুফিয়ান তাকে ট্রেনিং দেয়ার সময় তার মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এই চিন্তা, নিজের কর্তব্যকেই সব সময় প্রাধান্য দেবে। কখনো এমন কিছুর সাথে নিজেকে জড়াবে না, যাতে দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। মেয়ে মানুষের কাছ থেকে সাবধান থাকবে। কখনো আপন বিবি ছাড়া অন্য কারো দিকে নজর দেবে না। মনে রাখবে, দুশমন তোমাদের ঘায়েল করার জন্য যেটি সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করবে তার নাম মেয়ে। যারা অন্য নারীর প্রেমে পড়ে যায় বা নেশা ও বিলাসিতায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে; আপন দায়িত্ববোধের কথা তাদের স্মরণ থাকে না। তারা ধীরে ধীরে দায়িত্বহীন হয়ে যায়। তার মন-মগজে মদ ও নারীর মোহ এমন বিষের ন্যায় কাজ করে যে, সে ধীরে ধীরে তার ঈমানও হারিয়ে ফেলে। অতএব নেশা ও নারী থেকে সব সময় দূরে থাকবে।’
সম্রাট রিমাণ্ডের রাজপ্রাসাদে এসে সে দেখেছে, রাজার খেয়াল কাকে বলে। এখানে সম্রাট যখন যাকে ইচ্ছা চাকরী প্রদান করে এবং যাকে ইচ্ছা চাকরী থেকে বরখাস্ত করে। রাজার ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্ব যাদুর মত। এখানে এমন কেউ নেই, যে তাকে প্রশ্ন করতে পারে।
এখানে এসে সে আর যে জিনিসটি দেখে অবাক হয়েছে, তাহলো খৃস্টানদের চরিত্র। এদের কাছে চরিত্র বলে কিছু নেই। নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনাকে তারা গর্বের বিষয় বলে মনে করে। তাই এখানকার মেয়েরা এমন খোলামেলা প্রেম নিবেদন করলেও সে আর অবাক হয় না।
একজন গোয়েন্দা হিসাবে সে তখন চিন্তা করছিল, মেয়েটির কাছ থেকে তার কিছু পাওয়ার আছে কিনা। সে চিন্তা করে দেখল, এই মেয়েকে ব্যবহার করে সে এমন কিছু তথ্য পেতে পারে, যা অন্যভাবে পাওয়ার উপায় নেই। মেয়েটি যখন তাকে বলছিল, আমি যখন ও যেখানেই ডাকি সেখানে তোমাকে হাজির হতে হবে’ তার এ বক্তব্যে ধমক বা আদেশের সুর ছিল না বরং ছিল আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বের আবেদন। চেঙ্গিস এটা ভাল করে বুঝেছিল বলেই সেও মেয়েটির হাসির উত্তরে হাসি মুখেই সে প্রস্তাব কবুল করে নিয়েছিল। হাসির বিনিময়ে হাসি দিয়েই সে তার শিকারকে ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করেছিল।
‘এখন আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিন।’ চেঙ্গিস বললো, ‘আপনি বরং মেহমানদের কাছে চলে যান।’
‘অনুমতি দেবো, তার আগে বলো, তুমি ঠিক ঠিক আসবে তো?’
‘আসবো। সময় পেলেই আমি আপনার ডাকে সাড়া দেবো, কথা দিলাম।’ চেঙ্গিস বললো, ‘কিন্তু আমি তো আপনার ঠিকানা জানি না। আপনি কার স্ত্রী?’
‘স্ত্রী নই, আশ্রিতা!’ মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক সেনা অফিসারের নাম উল্লেখ করে বললো, ‘হতভাগার কাছে অঢেল , ধন-সম্পদ আছে। আর এই সম্পদের জোরে যে, আমার মত মেয়েদের কিনে নিয়ে তার হেরেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে। আমি একা নই, আরো বেশ কিছু মেয়ে আছে তার, যাদের সাথে সে দাসী-বাদীর মত ব্যবহার করে। কিন্তু কে যে তার মনের মানুষ তা আমরা কেউ জানি না।’
‘এত লোভ না করে ওখান থেকে চলে এলেই পারেন!’
‘না, তা আমরা পারি না। সে আমাকে মুক্তি দিতে নারাজ। বলে, তোমার কোন সাধ-আহলাদ আমি অপূর্ণ রাখবো না। তাহলে কেন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? সেই গর্দভ সম্পদের দম্ভটুকুই চেনে, নারীর মন চেনার সময় কোথায় তার!
যখন বুঝেছি এ লোকের হৃদয়ে দয়া, মায়া, প্রেম বলতে কিছু নেই তখন থেকেই তাকে আমি ঘৃণা করতে শুরু করেছি। সেই ঘৃণা এখন আমার মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে আছে। এই চাপ সহ্য করা আমার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কিন্ত যখন তোমাকে দেখলাম, কেন জানি না, তোমাকে আমার ভাল লেগে গেল। বিশ্বাস করো, তুমি আমার কাছে প্রথম পুরুষ, যাকে আমি অন্তর দিয়ে বেছে নিয়েছি। আমি তোমার কাছ থেকে শারিরীক বা দৈহিক কোন তৃপ্তির পিয়া নই। পিপাসা আমার অন্তরের, পিপাসা আমার ভালবাসার। তোমাকে দেখে চোখের পানিতে আমি সে পিপাসা নিবাবণ করতে পারবো। দোহাই লাগে, তুমি আমার দৃষ্টির আড়ালে যেও না। আমাকে পাষাণপুরীতে ফেলে রেখে দূরে কোথাও পালিয়ে যেও না। যদি এমন করো তবে আমার ওপর জুলুম করা হবে। আমি সব সইতে পারবো, কিন্তু এ অত্যাচার সইতে পারবো না। এখন যাও, তোমার অনেক সময় আমি নিয়ে ফেলেছি, আর নয়। কাল রাতে আমি নিজেই তোমাকে খুঁজে নেবো, কষ্ট করে তোমাকে আমার কাছে যেতে হবে না।’
যে সময় রাশেদ চেঙ্গিস বাগানে মেয়েটির সাথে কথা বলছি, ভিক্টর তখন মেহমানদের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। সে মেহমানদের আপ্যায়ন করছিল ঠিকই কিন্তু তার কান পড়েছিল ক্রুসেড লিডারদের আলোচনায়। তারা আলোচনা করছিল, কোন দিকে অভিযান চালালে সুবিধা হবে। কোথায় আক্রমণ করলে আইয়ুবী সহজে ধরাশায়ী হবে, এইসব।
এসব আলোচনা থেকে সে তার প্রয়োজনীয় কথা মনে মনে টুকে নিচ্ছিল। কিন্তু তখনও আলোচনা ও পরামর্শ চলছে। সেদিকে কান পেতে দ্রুত হাতে কাজ করছে ভিক্টর।
রাশেদ চেঙ্গিস মেয়েটির কাছ থেকে ছুটি পেয়ে মেহমানদের মধ্যে এসে পড়লো। ঘুরতে ঘুরতে সে সম্রাট রিনাল্টের পাশে চলে এলো। রিনাল্ট তখন তার সাথীদের বলছে, তোমরা কোন চিন্তা করো না। এবার আমি এত বেশী সামরিক শক্তি নিয়ে এসেছি, আমার তো মনে হয়, আমি একাই আইয়ুবীকে ধরাশায়ী করে ফেলতে পারবো। ভাবতে পারো, আমার সাথে আছে আড়াইশো নাইট। যাদের প্রত্যেকের আণ্ডারে আছে আলাদা বাহিনী। এক নাইটকে পরাজিত করলে আরেক নাইট এগিয়ে যাবে তার বাহিনী নিয়ে। আইয়ুবী একা কয়টা বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করতে পারবে?’
এভাবে রিনাল্ট শক্তির বড়াই করছিল আর বড় ধরনের সফলতা ছিনিয়ে এনে দেবে বলে দাবী করছিল সঙ্গীদের কাছে।